নিকোলাও মানুচির আরও গল্প
নিকোলাও মানুচির প্রায় চারশো বছর আগে মার্কো পোলো এ-দেশে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনিও মানুচির মতো ইটালির লোক, ভেনিসে বাড়ি। তিনি পৃথিবীর অনেক জায়গা ঘুরে দেশে ফিরে গিয়ে তাঁর ভ্রমণকাহিনী লিখেছিলেন। প্রথম প্রথম দেশের লোক তাঁর কথা হেসে উড়িয়ে দিত, কেউ বিশ্বাস করত না। বলত, লোকটা বাহাদুর বটে। এত মজার-মজার আর আজগুবি গল্প বানিয়ে লিখেছে। পরে অবশ্য তাদের এ-ভুল ভেঙেছিল। মানুচিকে এ-রকম কথা অবশ্য কেউ বলেনি। তাঁর লেখা মোগল সাম্রাজ্যের কাহিনী অনেক পরে উইলিয়ম আরভিন চেষ্টা করে বার করেছিলেন। সে ঊনবিংশ শতাব্দীর কথা। উইলিয়ম আরভিন ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে কাজ করতেন, কিন্তু তাঁর খ্যাতি মোগল সাম্রাজ্যের ইতিহাসকার বলে। মানুচি আওরঙ্গজেবের সময়কার কাহিনী লিখেছেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর দশ বছর পরে তিনি মারা যান। অন্য পর্যটকদের মতো তিনি আর দেশে ফিরে যাননি, শেষ জীবন মাদ্রাজে কাটিয়েছিলেন।
মানুচি অনেক পর্যটকদের চাইতে সাবধানী লেখক, সাধারণত একটু ভেবেচিন্তে বিবেচনা করে লিখতেন। তিনি তাঁর কালের একজন খুব নামজাদা ফরাসি পর্যটককে পরিহাস করে বলেছিলেন, রাস্তায় শোনা যে-কোনো গল্পগুজবকে বিশ্বাস করে ইতিহাস লেখা উচিত নয়। তাতে অনেক ভুল থাকতে পারে। কিন্তু মানুচির সব কথা বিশ্বাস করা কঠিন। অনেক অদ্ভুত গল্প তিনি নিজেও তাঁর লেখায় ঠাঁই দিয়েছেন, যেমন, ভূতে ধরার গল্প, জাদুকরদের শূন্যে হাত বাড়িয়ে নানারকম ফল নিয়ে আসার গল্প। তাঁর একটি কাহিনীতে আছে যে, তিনি আওরঙ্গজেবের এক বিখ্যাত কর্মচারীর আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। গিয়ে দেখলেন, তাঁর একটি পোষা জাদুকর সেখানে বসে আছে। সে শূন্যে হাত বাড়িয়ে নানারকম ফল এনে দিল। সে-সব ফল সে-অঞ্চলে জন্মায় না। মানুচি কিন্তু এই ফল খেতে রাজি হননি। তাঁর মনে হয়েছিল, কী জানি জাদুর ফল, খেয়ে আবার কী বিপত্তি হবে—সুতরাং খেয়ে কাজ নেই।
মানুচি নিজে অনেক সময় ডাক্তারি করেছেন। তাঁর পসারও ভাল ছিল। কিন্তু তিনি এমন কিছু কিছু ওষুধের কথা লিখেছেন যা এখনকার ডাক্তাররা পরীক্ষা করতে রজি হবেন না। তাঁর বিশ্বাস ছিল, পাগলা কুকুরে কামড়ালে সমুদ্রযাত্রায় অসুখ সেরে যাবে।
মানুচি শাজাহানের রাজত্বকালে দু’একটি বিচারের কথা লিখেছেন। এগুলি মানুচির মতে ন্যায়বিচারের এবং বুদ্ধির নিদর্শন। এ-রকম কয়েকটি ঘটনার কথা বলছি। একটি ঘটনা এইরকম। দপ্তরের এক কেরানি নালিশ করেছিল যে, তার একজন পুরনো দাসীকে একজন সৈন্য জোর করে নিয়ে গিয়েছে। দাসীটি বলতে লাগল যে, সে কেরানিটিকে চেনেই না, কখনও তার বাড়িতে কাজ করেনি। সমস্ত জিনিসটাই মিথ্যা। নীচের আদালত ব্যাপারটি ধরতে না পেরে সম্রাটের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সম্রাট বললেন “এই কথা! আচ্ছা, দাসীটি এসে কয়েকদিন আমার প্রাসাদে থাকুক।” সম্রাট একদিন লিখতে লিখতে দেখলেন যে দোয়াতের কালি ফুরিয়ে গিয়েছে। দাসীটিকে বললেন, “দ্যাখো তো নতুন কালি বানাতে পারো কি না।” সে-আমলে কেরানিরা লেখার কালি নিজেরাই বাড়িতে তৈরি করে নিত। মেয়েটি খুব সুন্দর করে দোয়াতে নতুন কালি বানিয়ে দিল। সম্রাট দেখে বললেন, “তবে রে মিথ্যেবাদী, তুই নিশ্চয় কেরানিটির বাড়িতে কাজ করতিস, নাহলে এ-রকম কালি বানাতে শিখলি কী করে?” আদালতকে হুকুম দেওয়া হল যে, দাসীটিকে কেরানির বাড়িতেই পাঠানো হোক, আর সৈনিকটিকে যেন এখনই কাজ থেকে বরখাস্ত করা হয়।
আর একটি গল্প বলছি। চার সওদাগর মিলে এক দোকান খুলেছিল। প্রত্যেকেরই দোকানের সমান ভাগ। ঠিক হল তারা পালা করে দোকানে বসবে আর সেদিনকার দোকানের তেলের খরচ দেবে। দোকানে একটি পোষা বেড়াল ছিল, তার দুধের খরচও জোগাবে। বেড়ালটি যদি মরে যায় তাহলে সেদিন যে দোকানে থাকবে তাকে নতুন বেড়াল কেনার খরচ দিতে হবে। একদিন দেখা গেল বেড়ালটির একটা পা ভেঙে গিয়েছে। সেদিন যার পালা সেই সওদাগর বেড়ালের চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। তার ভাঙা পা মলম দিয়ে বেঁধে রাখা হল। অন্য তিনজন সওদাগরকে বলা হল যে, বেড়ালের চিকিৎসার জন্য যে খরচ হচ্ছে তার জন্য তাদেরও ভাগের টাকা দেওয়া উচিত। তারা বলল যে, এ হতেই পারে না। অন্য সওদাগররা নালিশ করল যে, যেদিন বেড়ালের পা ভাঙে সেদিন যার পালা ছিল তাকেই খরচ দিতে হবে। ইতিমধ্যে বেড়ালটি ভাঙা পা নিয়ে খোঁড়াতে-খোঁড়াতে প্রদীপের কাছে বসেছে। প্রদীপের আগুন থেকে তার খোঁড়া পায়ের ব্যাণ্ডেজে আগুন লেগে গেল। ভয় পেয়ে ছুটোছুটি করতে করতে বেড়ালটি দোকানের জিনিসপত্রের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়ল আর দেকানটি দেখতে দেখতে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আদালতে এ নিয়ে মামলা হল কিন্তু ফয়সালা করা গেল না। মামলাটি শেষ পর্যন্ত সম্রাট শাহজাহানের কাছে পাঠানো হল। সম্রাট কাগজপত্র দেখে রায় দিলেন যে, যেদিন বেড়ালটি খোঁড়া হয় সেদিন দোকানে যে ছিল তার কোনো দোষ নেই, বাকি তিনজনকে সমস্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যার পালার দিন বেড়ালটির পা খোঁড়া হয়েছিল তার কোনো অপরাধ নেই। সে তো বেড়ালটির চিকিৎসাই করছে। আর খোঁড়া পায়ের ওপর ভর দিয়ে বেড়ালটি লাফালাফি করতে পারে না। যে তিনটি পা ভাল ছিল সেই তিন পা দিয়েই সে লাফিয়েছে। কাজেই ক্ষতিপূরণ অন্য তিনজন সওদাগরকেই দিতে হবে।
আরও একটি গল্প বলছি। এই ধরনের গল্প পরে একাধিক জায়গায় প্রচলিত হয়েছে। কাজেই সবার কাছে নতুন মনে নাও হতে পারে। সবাই জানে যে, সম্রাট শাহজাহান নাচগানের ভক্ত ছিলেন। হয়তো একটু বেশিই ছিলেন। তাঁর সভায় গুণীদের খুব আদর ছিল। মানুচির কথা ঠিক হলে বিশ্বাস করতে হয় যে, গাইয়ে-বাজিয়েদের মধ্যে যাঁরা একটু ভাঁড়ামি করতে পারতেন তাঁদের কদরই বেশি ছিল। যাঁরা সভায় গাইতে কি বাজাতে আসতেন তাঁদের কাছ থেকে দেউড়ির পঁচিশজন সেপাই নিয়মিত বকশিশ চাইত। নইলে ঢুকতে দেবে না বলে ভয় দেখাত। একদিন এক ওস্তাদ এলেন। ওস্তাদকে ঢুকবার সময় সেপাইরা খুব বাধা দিল। তিনি বললেন, “আচ্ছা, বাবাসকল, যা পাই ফেরবার সময় তোদের ভাগ করে দিয়ে যাব।”
ওস্তাদের গানে শাহজাহানের মন ভিজে গেল। তিনি বললেন, “ওস্তাদজি, আমি খুব খুশি হয়েছি। কী চাই বলুন?”
ওস্তাদ বললেন, “যদি খুশি হয়ে থাকেন তাহলে আমার একটি প্রার্থনা আছে।”
সম্রাট বললেন, “কী, বলুন?”
ওস্তাদ উত্তর দিলেন, “একহাজার কোড়ার ঘা।”
সম্রাট বললেন, “সে কী কথা! এরকম পুরস্কার চাইছেন কেন?”
ওস্তাদ উত্তর দিলেন, “না চেয়ে উপায় কী? প্রত্যেকদিন এখানে ঢুকবার সময় আপনার সেপাইরা জ্বালাতন করে। বলে, বকশিশ না পেলে ঢুকতে দেব না। আজ বলে এসেছি, যা পাব তোদের সব দেব।” শাহজাহান শুনে একটু হাসলেন। বললেন, “তাই হোক।” তারপর সেই পঁচিশজন সেপাইকে ডেকে এক হাজার কোড়ার ঘা তাদের ভাগ করে দেওয়া হল। ওস্তাদজিকে শুধু হাতে ফিরে যেতে হয়নি। তিনি সম্রাটের কাছ থেকে এক হাজার আশরফি পেলেন তাঁর গানের জন্যে, আর একটি ঘোড়া তাঁর বুদ্ধির জন্যে।
সম্রাট হবার পর আওরঙ্গজেবের খুব শখ হয়েছিল যে, তিনি একটি নৌবাহিনী তৈরি করবেন। দিল্লি বা আগ্রা যদি সমুদ্রের খুব কাছে হত তাহলে নৌবাহিনী আপনা থেকেই তৈরি হয়ে যেত, যেমন ইউরোপে ইংরেজ, ফরাসি ও পর্তুগিজদের দেশে। আমাদের দেশের লোকদের বড় নৌবাহিনী ছিল না। একমাত্র বোম্বাইয়ের কাছে জঞ্জিরা দ্বীপে আবিসিনিয়ানদের যুদ্ধজাহাজ ছিল। কাছেই শিবাজির রাজ্য। শিবাজি নিজের নৌবাহিনী তৈরি করেছিলেন এইসব আবিসিনিয়ানদের সাহায্যে। তাঁরা বড় নৌকর্মচারীর পদ পেতেন। শিবাজি তাঁর নৌবাহিনীতে পর্তুগিজদেরও নিতেন। আওরঙ্গজেবের এ-রকম নৌবাহিনী তৈরি করা সম্ভব ছিল না। জঞ্জিরা তাঁর সাম্রাজ্য থেকে অনেক দূরে। পর্তুগিজরা তাঁর শত্রু। কাছাকাছি সমুদ্র না থাকলে নৌবাহিনী কোথায় যুদ্ধ করবে? তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা হল যে, নৌবাহিনীর কাজ ভারতীয়দের দিয়ে ভাল হবে না, বিদেশীদের রাখতে হবে। সেটা কি উচিত? আওরঙ্গজেবও কম জেদি ছিলেন না, তিনি রাজি হলেন না। অবশেষে একটি ছোট জাহাজ তৈরি করে একটি দিঘিতে ভাসানো হল। তাতে কামান ও অন্যান্য যুদ্ধের সরঞ্জাম বসানো ছিল। আওরঙ্গজেব দেখতে লাগলেন কী করে জাহাজটি চালানো হচ্ছে। জাহাজটি সহজে এদিক-ওদিক ঘুরছিল। জাহাজ থেকে চারদিকে আক্রমণের ব্যবস্থা। তিনি সব দেখেশুনে বললেন, “না বাপু এ-সব এ-দেশের লোক দিয়ে হবে না। এ-সব ফিরিঙ্গিদেরই মানায়।” মোগল নৌবাহিনীর কথা চাপা পড়ে গেল।
ঐতিহাসিকরা যে মানুচিকে উঁচু স্থান দেন তার প্রধান কারণ কিন্তু এইসব গল্পগাছা নয়। তখনকার মোগল সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক কাহিনী, শাহজাহানের ছেলেদের মধ্যে যুদ্ধ, শাহজাহানের শেষ জীবনের বর্ণনা এবং মোগল দরবারের কথা তিনি যা লিখেছেন তার তুলনা পাওয়া কঠিন। এই সময়কার ইতিহাস জানতে গেলে বারে বারে মানুচির শরণাপন্ন হতে হয়।