বেগমের বরাদ্দ পাঁচ টাকা
সিপাহি-বিদ্রোহের প্রায় পঁচিশ বছর পরে, ১৮৮১ সালে, ভারত সরকার একটি আবেদনপত্র পেলেন। আবেদন করেছেন শাহজাদা ফিরোজ শাহর বিধবা। মক্কা শহরে তাঁর স্বামী শাহজাদা ফিরোজ শাহর মৃত্যু হয়েছে। তিনি সরকারের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছেন। ফিরোজ শাহর নাম খুব বেশি লোকের কাছে পরিচিত নয়। দিল্লির সম্রাট-বংশে তাঁর জন্ম। আওরঙ্গজেবের পুত্র, যিনি প্রথম বাহাদুর শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেছিলেন, ফিরোজ শাহ তাঁর বংশের সন্তান। হয়ত সিংহাসনে বসতে পারতেন, কিন্তু তাহলে বোধহয় এতদিন বেঁচে থাকতেন না। প্রথম বাহাদুর শাহর মৃত্যুর পরে দিল্লির সিংহাসন নিয়ে নানারকম রাজনৈতিক খেলা চলছিল। ফিরোজ শাহর বাবার নাম আমরা জানি, নিজাম বখ্ত। যে কর্মচারীর হাতে এই দরখাস্তটি পড়েছিল, তিনি নিশ্চয়ই এত খবর জানতেন না, তাই দরখাস্তের উপর লিখে দিলেন, মাসিক পাঁচ টাকা মঞ্জুর। এই দেশ যখন ক্রমশ ইংরেজদের অধিকারে আসে, তখন তারা আগেকার রাজাদের বৃত্তি দিতে কৃপণতা করেনি। দ্বিতীয় বাজীরাও পেশোয়া তো বছরে আট লাখ টাকা বৃত্তি পেতেন। অনেকে তখন মনে করেছিলেন যে, বেশি দেওয়া হচ্ছে, এর চেয়ে কম দেওয়া উচিত। ইংরেজের কাছে হাজার টাকার বেশি বৃত্তি পেতেন এরকম রাজা কিংবা নবাব সংখ্যায় কম ছিলেন না। তখনকার দিনে সামান্য সিপাহিদের মাইনেও ছ’সাত টাকার কম হত না। কর্মচারীটি সম্ভবত এসব কথা ভেবে দেখেননি। যা হোক, লর্ড রিপন যখন বড়লাট হয়ে এলেন তখন তিনি এই ভুল খানিকটা সংশোধন করেছিলেন। তিনি ফিরোজ শাহর বেগমকে ভাতা বাড়িয়ে মাসিক একশো টাকা করেছিলেন, দরখাস্তের সময় থেকেই এই হারে দেওয়া হবে।
কাউকে দোষ দেওয়া উচিত হবে না। ইতিহাসে শাহজাদা ফিরোজ শাহ প্রায় অজ্ঞাত পুরুষ। কোনো কোনো ইতিহাসে তাঁর নামের উল্লেখ আছে, কিন্তু তাঁর ছবি কখনও স্পষ্ট হয়নি। সিপাহি-যুদ্ধের কিছুদিন আগে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উত্তর ভারতে বেড়াতে গিয়েছিলেন, যেমন তিনি মাঝে-মাঝে যেতেন। দিল্লিতে যমুনা নদী দিয়ে নৌকোয় যেতে-যেতে দেখলেন, লালকেল্লার পিছন দিকে প্রাসাদের ছাতে বাদশাহ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন। বাদশাহর ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে কিছু ভিড় জমেছিল। মহর্ষির আত্মজীবনী পড়লে মনে হয় যে, ঘটনাটি তাঁর কাছে একটু আশ্চর্য মনে হয়েছিল, কিন্তু তিনি এ-কথাও ভেবেছিলেন যে, তাতে ক্ষতি কী? বাদশা তো তখন ইংরেজদের হাতের পুতুল। ঘুড়ি ওড়ানো ছাড়া তাঁর আর কী কাজ থাকতে পারে? আসল কথা, ঘটনার স্রোত কোনদিকে যাচ্ছে, সে সম্বন্ধে কারুর কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না।
১৮৫৭ সালের মে মাসে সিপাহি- যুদ্ধ যখন আরম্ভ হল, ফিরোজ শাহ তখন মক্কায় তীর্থ করছিলেন। বোম্বাই এসে সে-কথা শুনলেন। মিরাট থেকে একদল সিপাহি বিদ্রোহ করে দিল্লি এসে পৌঁছল। সম্রাট বাহাদুর শাহকে জানানো হল, ইংরেজদের বিরুদ্ধে তামাম হিন্দুস্থান লড়াই করবে, সম্রাট তাদের নেতা হবেন। বাহাদুর শাহ এমন বিপদে আর কখনও পড়েননি। কবিতা লিখে, পাখি পুষে, ঘুড়ি উড়িয়ে তাঁর দিন কেটেছে। তিনি কিছু বুঝতে না পেরে, যে ইংরেজ কর্মচারী তাঁর সঙ্গে থাকতেন তাঁকে ডেকে পাঠালেন। তিনি আসামাত্র সিপাহিদের হাতে খুন হয়ে গেলেন। এক বছরেরও বেশি পরে দিল্লি আবার ইংরেজদের হাতে এল। বৃদ্ধ বাহাদুর শাহকে বন্দী করে রেঙ্গুনে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তাঁর কয়েকজন ছেলেকে হাডসন সাহেব বন্দী করে নিয়ে আসছিলেন, রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে তাদের খুন করলেন।
ফিরোজ শাহ ইতিমধ্যে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথম দিকে তিনি সীতামৌ আক্রমণ করলেন। সেখান থেকে মান্দাসোর। মান্দালোরে গিয়ে তিনি প্রচার করে দিলেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে তিনি ধর্মযুদ্ধ শুরু করেছেন, একজন প্রধানমন্ত্রীও বহাল করলেন। সিপাহিরা তাঁর চারদিকে এসে জড়ো হতে লাগল। ফিরোজ শাহ ভাবলেন, এবার তাঁকে সিপাহিদের একজন প্রধান নেতা বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তিনি চারপাশের কোনো কোনো রাজা বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তিকে চিঠি লিখলেন এই আশায় যে, তাঁরা তাড়াতাড়ি তাঁর সঙ্গে এসে যোগ দেবেন। তখন তাঁর সৈন্যসংখ্যা অন্তত সতেরো-আঠারো হাজার হয়েছিল। কিন্তু এ-অবস্থা বেশিদিন থাকল না। স্যার হেনরি ডুরাণ্ডের কাছে পরাজিত হবার পর দ্রুত পতন হতে লাগল। দলের লোকেরা তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে লাগল। কিছুদিন তিনি মধ্যপ্রদেশের এক জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করেছিলেন। কিন্তু ইংরেজ সৈন্যের তাড়া খেয়ে সে-আশ্রয়ও তাঁকে ছাড়তে হয়। ফিরোজ শাহর সেনাবাহিনীর অতি অল্পই অবশিষ্ট ছিল। ফিরোজ শাহ ও তাঁর দুই বন্ধু পাণ্ডুরঙ্গ সদাশিব রাওসাহেব ও তাঁতিয়া টোপি, এই তিনজনের সৈন্যসংখ্যা মিলিয়ে দু’হাজার হবে কিনা সন্দেহ। অবস্থা এরকম দাঁড়াল যে, তাঁরা আর একসঙ্গে থাকা নিরাপদ মনে করলেন না। একসঙ্গে থাকলে ইংরেজের হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি, কাজেই তারা যে-যার সৈন্য নিয়ে আলাদা হয়ে গেলেন। তাতেও সুবিধা হল না। তাঁতিয়া টোপিকে তাঁর বন্ধু মান সিং বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজের হাতে ধরিয়ে দিলেন। রাওসাহেবও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁরও সেই পরিণতি হল। কিছুদিন আগে মহারানী ভিক্টোরিয়া এক ঘোষণাপত্র প্রচার করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, যাঁরা ইংরেজদের রক্তপাত করেননি, তাঁদের প্রাণের ভয় নেই। তাঁতিয়া টোপি ও রাওসাহেব দু’জনেই বলেছিলেন যে, ইংরেজদের হত্যার জন্য তাঁরা কেউই দায়ী নন। ইংরেজরা একথা বিশ্বাস করেনি। তাঁতিয়া টোপি ও রাওসাহেবের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবার লোকের অভাব হয়নি। ফিরোজ শাহর মনে হল, তাঁর পক্ষে দেশ ছেড়ে যাওয়াই মঙ্গল। ইংরেজরা। বলেছিলেন যে, ফিরোজ শাহকে যদি শাস্তি দেওয়া নাও হয় তাহলেও তাঁকে নিজের ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে দেওয়া হবে না। ইংরেজ সরকার ঠিক করে দেবেন তিনি কোথায় থাকবেন। ফিরোজ শাহ এই শর্তে রাজি হলেন না। বিদ্রোহের সূত্রপাতে যেমন হঠাৎ আরব দেশ থেকে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, সেইরকম একদিন আবার ভারতবর্ষ ছেড়ে আরব দেশে চলে গেলেন। যাবার আগে তিনি তাঁর এক কর্মচারীকে চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর ভাষা এমন যে, পড়লে মনে হয় তিনি যেন দিল্লির বাদশা। ইংরেজদের ধারণা হয়েছিল, এমন দুর্বিনীত লোকের সঙ্গে আলোচনায় ফল হবে না।
এর পরে ফিরোজ শাহ সম্বন্ধে নানারকম খবর রটতে লাগল। ১৮৬০ সালে শোনা গেল, ফিরোজ শাহকে কান্দাহারে দেখা গিয়েছে। পরের বছর বোখারাতে। আবার কয়েক বছর পরে কাবুলে। তখন সিপাহি-বিদ্রোহের উত্তাপ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। ফিরোজ শাহ তাঁর রাজ্যে বাস করবেন এটা কাবুলের আমির ভাল চোখে দেখেননি। ১৮৭২ সালে ফিরোজ শাহকে কনস্টেনটিনোপ্লে (এখন ইস্তাম্বুল) দেখা গিয়েছিল। নানা সময়ে নানা দেশ থেকে তাঁর সম্বন্ধে খবর আসতে লাগল। সব খবরই যে সত্যি, তা নাও হতে পারে।
সরকারি কাগজপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, কিছু ভারতীয় তখন দেশ ছেড়ে আরবের বিভিন্ন শহরে কিংবা তুর্কি দেশে বসতি করতেন। তার মধ্যে বেশিরভাগই সিপাহি-যুদ্ধের সময় দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। তাঁরা সাধারণ মানুষ, খুব যে বড় চাকরি বা ব্যবসা করতেন, তা নয়। একজন ছিলেন ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর ডাক্তার। তিনি এদেশে এসে হাকিমি ব্যবসা করতেন। একজনের ছিল সোনারুপোর গয়নার দোকান। আর একজন চীন দেশ থেকে আমদানি করা জিনিসের ব্যবসা করতেন। কেউ কেউ সাধারণ ফেরিওয়ালা। একজন নিজেকে বলতেন ‘পীর’। তিনি মাদুলি বেচতেন। অনেকের বিশ্বাস ছিল, এই মাদুলিতে খুব কাজ হয়। এঁরা অনেকে ফিরোজ শাহকে নেতা বলে মানতেন। একজন ইংরেজ কর্মচারী ১৮৭৫ সালে লিখেছেন যে, তাঁর বিশ্বাসী এক লোক ফিরোজ শাহকে দেখেছেন। তাঁর মতে ফিরোজ শাহ কিছুকাল ইস্তাম্বুলে থাকার পর মক্কা চলে গিয়েছেন। তখন ফিরোজ শাহর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। এক চোখে ভাল দেখতে পান না, একটু খুঁড়িয়ে চলতে হত। সম্ভবত অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে ও পথক্লেশে তাঁর শরীর ভেঙে পড়েছিল। তাঁর বয়স তখন পঞ্চাশের নীচে। যতদিন ফিরোজ শাহ বেঁচে ছিলেন, ইংরেজরা তাঁর উপর নজর রেখেছিল। খবর আছে, ফিরোজ শাহর ইচ্ছা ছিল যে, পশ্চিম এশিয়ার মুসলমান রাজ্যগুলিকে এক করে আবার ইংরেজদের সঙ্গে লড়বেন। দিল্লির বাদশাহি তাঁর কাছে আবার ফিরে আসবে।
ফিরোজ শাহর শেষের জীবন খুব কষ্টে কেটেছিল, প্রায় ভিখিরি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাদশাহির স্বপ্ন তিনি ছাড়তে পারেননি। কী করে তাঁর দিন চলত, ইংরেজরা সে-খবরও বের করেছিলেন। আবদার রহমান নামে এক ভারতীয় মুসলমানের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন ফিরোজ শাহ। শ্বশুরের সঙ্গেই থাকতেন। হতাশা ও দুঃখকষ্টের মধ্যে ফিরোজ শাহর মৃত্যু হল। মৃত্যুর পর তাঁর বিধবা ভারত সরকারের কাছে কিন্তু অর্থসাহায্য চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তার ফল কী হয়েছিল সেকথা প্রথমেই বলেছি।