নতুন কলকাতার সূচনা
ইংরাজরা এসে তো কলকাতা অধিকার করল। বেশি বাধা হল না। এই খবর শুনে সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা দখল করতে এগিয়ে এলেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডের উপরে, এখন যেখানে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের বাড়ি, তার কাছে এসে তাঁবু ফেললেন। তখন কলকাতার চেহারা অন্যরকম। নবাব যেখানে ছাউনি করলেন, তার চারদিকে ঝোপ জঙ্গল জল কাদা। একেবারে বাদার মতো চেহারা। একটা সরু রাস্তা দিয়ে তাঁর তাঁবুর কাছে পৌঁছানো যেত। তার দু’দিকে নিচু জায়গা, ধানের চাষ হত। ক্লাইভ ঠিক করলেন শেষ রাত্রে কামান নিয়ে গিয়ে নবাবকে আক্রমণ করবেন। ক্লাইভ সব সময় রাত্রে আক্রমণ কিংবা যুদ্ধ পছন্দ করতেন। এর আগে তিনি মাদ্রাজে ছিলেন, তখন তিনি এ-রকম করেছেন। এবার তাঁর সে ফন্দি খাটল না। তখন শীতকাল। শেষ রাত্রে যাত্রা শুরু করে ক্লাইভ যখন নবাবের তাঁবুর কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলেন, তখনও অন্ধকার কাটেনি। চারদিকে কুয়াশা। ক্লাইভের লোকজন অন্ধকারে কিছু না দেখতে পেয়ে কামানের গাড়িটাড়ি নিয়ে ভুল করে রাস্তার পাশে নিচু জমিতে গিয়ে পড়ল। খুব হৈচৈ চেঁচামেচি হল। নবাবের শিবিরে লোকজন জেগে উঠল। ক্লাইভের সৈন্যরা একটু সামলে উঠে কামান ছুঁড়তে লাগল। নবাবের শিবির থেকেও কামানের গোলা আসতে লাগল। ক্লাইভ যা ভেবেছিলেন তা হল না। নিরাশ হয়ে ক্লাইভ ফোর্ট উইলিয়মে ফিরে এলেন। তখন সকাল হয়েছে। কুয়াশা কেটে রোদ উঠেছে।
আরও কিছুদিন পরে মুর্শিদাবাদে ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যেতে লাগল। সিরাজউদ্দৌলাকে ইংরাজরা পছন্দ করত না। সিরাজউদ্দৌলাও ইংরাজদের দেখতে পারতেন না। আর কেউ কেউ ছিলেন, যাঁরা চেয়েছিলেন সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসন থেকে সরানো হোক। এর পরিণতি কী হতে পারে তা তাঁরা হয়তো ভেবে দেখেননি। এই দলে প্রধান ছিলেন বিখ্যাত ধনী জগৎশেঠের পরিবার। কিন্তু নবাবকে সরাতে হলে আর-একজনকে নবাব করতে হবে। সে তোক কোথায়? শেঠরা ইয়ার লতিফ খাঁর নাম করলেন। ইয়ার লতিফ খাঁ একজন সাধারণ সামরিক কর্মচারী, শেঠদের হাতের লোক। ইংরাজরা তাঁকে পছন্দ করত না। আরও দু’একটি নাম হয়েছিল, কিন্তু ইংরাজরা আগ্রহ দেখালেন না। তারপরে একসময় নাম হল মিরজাফরের। তখন ইংরাজদের মনে হল এতক্ষণে ঠিক লোক পাওয়া গিয়েছে। মিরজাফর আলিবর্দির বোনকে বিয়ে করেছিলেন। এক সময় ভাল সেনাপতি হিসাবে তাঁর নামও ছিল। কিন্তু তখন তাঁর বয়স হয়ে গিয়েছে। তা-ছাড়া বহুদিনের আফিং খাওয়ার অভ্যাসের ফলে তাঁর মানসিক বা শাবীরিক শক্তি কিছুই নেই। তাহলেও তাঁকে ইংরাজরা মেনে নেবে, এটাও পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল। নবাব হলে ইংরাজদের অনেক টাকাকড়ি ঐশ্বর্য উপহার দেবেন বলে মিরজাফরও প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু বিপদ হল একজনকে নিয়ে। সে উমিচাঁদ, একজন বড় ব্যবসায়ী। খুব ধূর্ত লোক। সে ঘটনার আঁচ পেয়েছিল। সে ইংরাজদের বলল, তাকে টাকাপয়সা দিয়ে খুশি না করলে সে নবাবকে গুপ্ত ষড়যন্ত্রের সব কথা বলে দেবে। এর ফল কী হবে তা বুঝতে কারুর বাকী ছিল না। ক্লাইভও এক ফন্দি করলেন। দুটি দলিল তৈরি করা হল। একটিতে উমিচাঁদ যে রকম চেয়েছিল, সে রকম লেখা হল, আর একটিতে উমিচাঁদের পাওনার কোনও উল্লেখ থাকল না।
ইতিমধ্যে নবাব আর ক্লাইভের মধ্যে চিঠি চালাচালি হচ্ছিল। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছিলেন না। কিন্তু প্রত্যেকেই মনের ভাব যথাসম্ভব গোপন করবার চেষ্টা করছিলেন। স্ক্র্যাফ্ট্ন নামে ক্লাইভের এক বন্ধু মুর্শিদাবাদে গিয়ে নবাবের সঙ্গে দেখা করলেন। নবাবকে বোঝাতে চাইলেন ইংরাজদের কোনও মন্দ অভিপ্রায় নেই। মিরজাফরকে সিরাজউদ্দৌলা খুব সন্দেহের চোখে দেখতে আরম্ভ করেছিলেন। মিরজাফরের সঙ্গে কী করে ইংরাজদের গোপনে দেখা হবে, সেটা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। অবশেষে কোম্পানির ওয়াটস সাহেব ঘেরাটোপ দেওয়া পালকি চড়ে মিরজাফরের বাড়িতে গিয়ে দেখা করলেন। এ-রকম পালকিতে মেয়েরাই যাতায়াত করতেন, রক্ষীরা কিছু সন্দেহ করল না। পালকি একেবারে মিরজাফরের অন্দরমহলে গিয়ে থামল। সেখানে মিরজাফর আর তাঁর ছেলে মিরন তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন।
ওয়াটস মিরজাফরের সামনে সন্ধিপত্র খুলে ধরলেন। মিরজাফর এক হাতে কোরান ছুঁয়ে থাকলেন, অন্য হাতে ছেলের মাথায় রেখে শপথ করলেন, তিনি ইংরাজদের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ভাঙবেন না।
যুদ্ধের প্রস্তুতি ঠিক হয়ে গেল। হুগলির কাছে কালনায় ইংরাজ সৈন্য এসে জড় হল। ওয়াটস মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। এর পরের ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি ঘটতে লাগল। মিরজাফরের ব্যবহার দেখে ক্লাইভেরও সন্দেহ হচ্ছিল, তিনি দু’কূল বজায় রেখে চলবার চেষ্টা করছেন। শেষ পর্যন্ত মিরজাফর তাঁর এক কর্মচারীকে জানালেন, তিনি ঈদের পরে ইংরাজদের সঙ্গে যোগ দেবেন। সে কথা তিনি ‘কর্নেল সাহেব’ কে অর্থাৎ কর্নেল ক্লাইভকে যেন জানিয়ে দেন। চিঠিটা খুব গোপনীয়। জুতোর মধ্যে সেলাই করে পাঠানো হচ্ছে।
ক্লাইভ মিরজাফরের কথার উপর বিশ্বাস রাখতে পারছিলেন না। মিরজাফরের অবস্থাও সেই রকম। যাই হোক, অবশেষে নবাব তাঁর ফৌজ নিয়ে ২১শে জুন দাউদপুর গ্রামে এসে পৌঁছলেন। গ্রামের কাছে নবাবের সৈন্যরা শিবির স্থাপন করেছিলেন। পলাশি, যেখানে যুদ্ধ হয়েছিল, সে-জায়গা এখান থেকে বেশি দূরে নয়। নবাবের সঙ্গে ছিল পদাতিক ও অশ্বারোহী মিলিয়ে পঞ্চাশ হাজারের বেশি লোক। তা ছাড়া পঞ্চাশটির বেশি বড় কামান। ইংরাজদের সৈন্য অনেক কম। তাহলে কী হবে? সিরাজউদ্দৌলা সেনাপতিদের মধ্যে প্রায় কাউকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মিরজাফর তখনও দু’দিক রাখবার চেষ্টা করছিলেন। ২৩শে জুন সকালে ক্লাইভ মিরজাফরকে লিখলেন, তাঁর পক্ষে যতটা করা সম্ভব তিনি করেছেন। এর পরেও যদি মিরজাফর তাঁর সঙ্গে এসে মিলিত না হন, তাহলে তিনি নবাবের সঙ্গে গোলমাল মিটিয়ে ফেলবেন।
এই চিঠি লেখার ঘণ্টাখানেক পরে সকাল আটটা নাগাদ নবাবের ছাউনি থেকে বড় বড় গোলা ইংরাজ শিবিরে এসে পড়তে লাগল। প্রায় চার ঘন্টা ধরে এই রকম চলল। ইংরাজরা ভাল করে গোলাবর্ষণের জবাব দিতে পারলেন না। তারপরে আধঘণ্টা ধরে প্রবল বৃষ্টি। বৃষ্টির সময় গোলাবর্ষণ বন্ধ ছিল। বৃষ্টির পর আবার শুরু হল।
ক্লাইভ এ সময় কোথায় ছিলেন? বৃষ্টির সময় মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভিজে গিয়েছিলেন। ইংরাজদের যেখানে শিবির, সেখানে একটি পাকা বাড়ি ছিল। তিনি সেই বাড়িতে ঢুকে জামাকাপড় বদলে শুয়ে পড়লেন। একটু ঘুমিয়েও পড়েছিলেন। তাঁর নির্দেশ ছিল, এখন এই রকম চলুক। রাত্রে যুদ্ধ করা যাবে।
ইতিমধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছিল। নবাবের সেনাপতি মির মদন গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তাঁকে নবাবের কাছে নিয়ে আসা হল। সেখানে তাঁর মৃত্যু হল। নবাব মিরজাফরকে ডেকে পাঠালেন। মিরজাফর এসে পরামর্শ দিলেন যুদ্ধ বন্ধ থাকুক, পরদিন যুদ্ধ হবে। এ-পরামর্শ নবাব প্রথমে নিতে চাননি। কিন্তু অন্য উপায় ছিল না। তাঁর সেনাপতি মোহনলালকে যুদ্ধ থামাতে বলা হল। মোহনলালের ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু নবাবের হুকুম মানতেই হয়। ইতিমধ্যে মিরজাফর ক্লাইভকে গোপনে খবর পাঠিয়ে দিলেন যে, নবাবের সৈন্যরা যুদ্ধ করবে না। ক্লাইভেরও দিনের বেলায় যুদ্ধ করবার ইচ্ছা ছিল না। তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখলেন নবাবের সৈন্যরা পিছু হটছে, তাঁর সেনাপতি কিলপ্যাট্রিক তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তখন আর কিছু করবার ছিল না। ক্লাইভ যুদ্ধে নেমে পড়লেন। সিরাজউদ্দৌলা বাধা দেবার চেষ্টা করলেন না। উটে চড়ে অল্প লোকজন সঙ্গে নিয়ে মুর্শিদাবাদে পালিয়ে গেলেন। তাঁর সব কামান পলাশিতে পড়ে রইল। বিকাল পাঁচটার মধ্যে পলাশির যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল।
নবাব মুর্শিদাবাদ থেকে ছদ্মবেশে নৌকা করে পালাতে চেষ্টা করলেন। পালিয়েও বাঁচতে পারেননি। দানশা ফকির বলে একজন তাঁকে চিনতে পেরে ধরিয়ে দেয়। সিরাজউদ্দৌলাকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হল। কয়েক ঘণ্টা পরে মিরজাফরের ছেলে মিরনের হুকুমে তাঁকে হত্যা করা হল।
এইভাবে বাংলাদেশে কোম্পানির রাজত্বের সূত্রপাত হল। মিরজাফর তো তখন বৃদ্ধ এবং একেবারে ইংরাজদের হাতের পুতুল। কিছুদিন পরে তাঁকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর জামাই মিরকাশিমকে নবাব করা হল। তাঁর সঙ্গেও ইংরাজদের বনল না। মিরকাশিম ভাল শাসক ছিলেন, কিন্তু ভাল যোদ্ধা ছিলেন না। ইংরাজদের সঙ্গে কয়েকটি যুদ্ধে হেরে গিয়ে পালিয়ে দিল্লির খুব কাছে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। সেখানে তিনি কীভাবে দিন কাটাতেন, একজন বিদেশীর লেখায় তা জানা যায়। মিরকাশিম কোষ্ঠী বিচারে খুব বিশ্বাস করতেন। সকালে উঠে প্রতিদিন দেখতেন তাঁর ভাগ্য পরিবর্তন হবে কি না, আবার তিনি মুর্শিদাবাদের নবাব হতে পারবেন কি না। নিজের জন্য রান্নাও নিজের হাতে করতেন। ভয় ছিল খাবারে কেউ বিষ মেশাতে পারে। এই রকম করে দিল্লির প্রান্তে একদিন তাঁর মৃত্যু হল। ইতিমধ্যে বাংলা-বিহার-মুর্শিদাবাদে যাঁরা নবাব হলেন, তাঁদের কথা ইতিহাস বিশেষ বলেনি। বলবার মতোও নয়।
পলাশির যুদ্ধের পঞ্চাশ-ষাট বছরের মধ্যে কলকাতার চেহারা একেবারে বদলে গেল। ইংরাজের সংখ্যা বাড়ল। অনেক বড় বড় বাড়ি। পরিষ্কার রাস্তাঘাট। এখনকার বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগকে তখন বলা হত ট্যাঙ্ক স্কোয়ার। সেখানে শহরের লোকেদের ব্যবহারের জন্য ভাল পানীয় জল পাওয়া যেত। সে জন্যে সান্ত্রির পাহারা। কিন্তু শুধু এই নিয়ে তো নতুন শহর গড়ে ওঠে না। মানুষও চাই। নতুন ধরনের বাঙালি। তারপরের কলকাতার ইতিহাস তাদেরই কাহিনী। নবাবি আমলের বাঙালির সঙ্গে তাদের মিল নেই। ‘ছেলেবেলা’ বইতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, পশ্চিমে গঙ্গা, নালা কাটা ছিল, তাই দিয়ে বাড়িতে গঙ্গার জল এসে পৌঁছত। “তখন রাস্তার ধারে ধারে বাঁধানো নালা দিয়ে জোয়ারের সময় গঙ্গার জল আসত। ঠাকুরদার আমল থেকে সেই নালার জলের বরাদ্দ ছিল আমাদের পুকুরে।” কিন্তু পশ্চিম দিক থেকে শুধু জলই আসত না, আরও অনেক জিনিস আসতে আরম্ভ করেছিল। তাই নিয়ে গড়ে উঠল নতুন কলকাতা। নতুন বাংলার ইতিহাস।