তিনশো বছর আগের কলকাতা
প্রায় তিনশো বছর আগে। ১৬৯০ সালের বর্ষাকাল। কয়েকটি ছোট-বড় জাহাজ পূর্বদিক থেকে এসে সুতানুটি গ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সুতানুটি এখনকার কলকাতা শহরের উত্তর দিকে। এখন যে-জায়গাকে বলে মদনমোহনতলা, তার কাছাকাছি। জাহাজগুলির একটিতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির গোরা সৈন্য, সৈন্যদের কর্তা ক্যাপ্টেন ব্রুক। তাছাড়া কোম্পানির ব্যবসার কর্তা জোব চার্নক। এঁরা নিজেদের ইচ্ছায় এই অঞ্চলে আসছিলেন না। ইংরাজদের তখনও রাজত্ব করবার স্বপ্ন ছিল না। যা ছিল, তা হল চট্টগ্রামে কুঠি তৈরি করে ব্যবসা করবার ইচ্ছা। সেখানে মোগল সেনাপতির হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে তারা সুতানুটির কাছে আশ্রয় খুঁজছিল। ২৪ আগস্ট দুপুরবেলায় নৌকাগুলি সুতানুটিতে এসে পৌঁছল। এ-জায়গা ইংরাজদের একেবারে অজানা ছিল না। আগেও তারা এসে ওখানে কিছুদিনের জন্য ছিল। স্থায়ীভাবে থাকবে, এ কথা কখনো ভাবেনি। জোব চার্নক এদেশে প্রথম এসেছিলেন পঁয়ত্রিশ বছর আগে। দু’ বছর আগে মাদ্রাজে ছিলেন। পরে আবার বাংলায় এলেন। কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা জোব চার্নক আরও তিন বছর বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে ইংরাজদের ভাগ্যের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। শুধু সুতানুটি নয়, সুতানুটি, কলিকাতা, গোবিন্দপুর—তিন গ্রামে তাদের আধিপত্য। সুতানুটি নাম দেখেই মনে হয় এটি তাঁতিদের গ্রাম। এখনকার হাটখোলা অঞ্চলকে মোটামুটি বলা চলে তখনকার সুতানুটি। তার দক্ষিণে কলিকাতা এখনকার ডালহৌসি স্কোয়ার বা বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ। তার পশ্চিম দিকে তখন ছিল ফোর্ট উইলিয়ম। আরও দক্ষিণে এসে গোবিন্দপুর; অনেকটা তার জঙ্গল, আদি গঙ্গা বা টালির নালা পর্যন্ত চলে গিয়েছে। চোর-ডাকাতদের থাকবার জায়গা। এখনকার ময়দান তখন বড়-বড় গাছের জঙ্গল। তার ভিতর দিয়ে সরু পথ কালীঘাট মন্দিরে যাবার জন্য। ডাকাতের ভয়ে সে-রাস্তায় তীর্থযাত্রীদের যাওয়া সহজ ছিল না। বহু দিন পর্যন্ত চোর-ডাকাতদের ভয় ছিল। অনেক বছর পরে যখন এসপ্ল্যানেডের কাছে দু’তিনটি করে বাড়ি উঠতে আরম্ভ করল, তখনও ভয় যায়নি। সেখানে যারা কাজকর্ম করত, তারা রাত্রে বাড়ি ফিরবার সময় ভাল কাপড় কি দামি জিনিস রেখে যেত। সঙ্গে নিয়ে যেতে সাহস পেত না, পাছে কেউ কেড়ে নিয়ে যায়।
জোব চার্নক ১৬৯৩ সালে মারা যান। তখন সুতানুটি বেশ বর্ধিষ্ণু জায়গা হয়ে উঠেছে। কয়েক বছরের মধ্যে দুটি ঘটনা ঘটল। একটি বর্ধমানের একজন বড় জমিদার শোভা সিংহের বিদ্রোহ। ইংরাজরা নবাবকে জানাল, এই রকম বিদ্রোহ ঘটতে থাকলে তাদের ব্যবসাবাণিজ্যের সর্বনাশ হবে। কাজেই তাদের কুঠিবাড়ি ইত্যাদি সুরক্ষিত করতে দেওয়া হোক। বিদেশী বণিকদের বাণিজ্য যদি চলতে না পারে তাহলে নবাবেরও ক্ষতি। তাঁর শুল্কের টাকা কম পড়ে যাবে। আরজি মঞ্জুর করা হল। কিন্তু ইংরাজরা তাদের কুঠি ইত্যাদি সুরক্ষিত করার নামে একটি দুর্গ গড়ে তুলল। নাম দিল ইংলণ্ডের তখনকার রাজা উইলিয়মের নামে ‘ফোর্ট উইলিয়ম’। এই দুর্গ কোথায় ছিল? এখন যেখানে জেনারেল পোস্ট আপিস, সেখান থেকে আরম্ভ করে ফেয়ার্লি প্লেসে রেলের বুকিং আপিস, সবই ছিল এই দুর্গের মধ্যে। পশ্চিমে হুগলি নদী। উত্তর দিকে দুর্গের প্রাচীর কতদূর গিয়েছিল, চেষ্টা করলেই জানতে পারবে। লর্ড কার্জন ফুটপাথের উপরে প্রায় আধ ইঞ্চি চওড়া লম্বা সোনালি দাগ টেনে দিয়েছিলেন। পঁচিশ বছর আগেও তার বিবর্ণ চেহারা দেখেছি। ধুলো কাদা, নর্দমার জল, পানের পিকের তলায় লক্ষ করলে এখনও সে দাগ দেখতে পাওয়া যাবে। এখন যে ফোর্ট উইলিয়ম দেখা যায় ময়দানের পশ্চিম দিকে, সে পরে তৈরি হয়েছিল ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়।
ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি জাঁকিয়ে বসল বটে, কিন্তু নানা রকম অসুবিধা দেখা দিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত ঠিক করা হল কোম্পানির পক্ষ থেকে একটি ছোট দল দিল্লিতে গিয়ে বাদশার সঙ্গে দেখা করবেন। তখন সম্রাট আওরঙ্গজেব গত হয়েছেন। তাঁর নাতি ফরুখ্শিয়ার দিল্লির বাদশা। সঙ্গে অনেক দামি উপহার নিয়ে দলটি তো দিল্লি গিয়ে পৌঁছল। তখন বাদশার বিয়ের কথা হচ্ছে। তিনি এক রাজপুত রাজার মেয়েকে বিয়ে করবেন। বিয়ের আগে কাজের কথা হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। ইংরাজদের দলটি দিল্লিতে বসে রইল, কবে সম্রাটের বিয়ে হবে সেই দিন চেয়ে। কিন্তু বিয়েতেও অসুবিধা। ফরুখ্শিয়ার অসুখে পড়লেন। দিন পিছিয়ে যেতে লাগল। কোনো হাকিম সম্রাটের অসুখ সারাতে পারলেন না। অবশেষে দরবারের সবাই ভাবলেন ইংরাজদের দলে তো একজন ডাক্তার রয়েছেন, ডাক্তার হ্যামিলটন। হাকিমদের দিয়ে না হলে একবার বিলিতি ডাক্তারের দৌড় দেখা যাক। আশ্চর্য ব্যাপার! যে অসুখ কেউ সারাতে পারছিল না, ডাক্তার হ্যামিলটন তা সারিয়ে দিলেন। খুশি হয়ে ফরুখ্শিয়ার ইংরাজদের কলকাতার কাছে চব্বিশটি গ্রামের জমিদারি বখশিস করলেন। এই চল চব্বিশ পরগনা।
১৭৪০ সালে আলিবর্দি খাঁ বাংলা বিহার ওড়িশার নবাব হলেন। তিনি বুদ্ধিমান নবাব ছিলেন। কিন্তু তাঁর সময় এ-রাজ্যে এক বড় বিপদ দেখা দিল। নাগপুর থেকে মারাঠারা এসে বাংলাদেশ আক্রমণ করল। তাদের রাজা ছিলেন রঘুজি ভোঁসলা। তিনি অবশ্য আসেননি, তাঁর সেনাপতি ভাস্কর রামকে (ভাস্কর পণ্ডিত) পাঠিয়েছিলেন। এই সময়কার একজন কবি মারাঠা সৈন্যদের কথা লিখেছিলেন:
লুঠি বাঙ্গালার লোক করিল কাঙাল
গঙ্গাপার হইল বাঁধি নৌকার জাঙাল॥
নৌকা দিয়ে পোল তৈরি করে মারাঠারা মুর্শিদাবাদ গিয়েছিল। সেখানে ধনী জগৎশেঠের বাড়ি লুঠ করেছিল। ললাকে বলত অন্তত আড়াই কোটি টাকা সেখান থেকে মারাঠারা পেয়েছিল। বর্গির হাঙ্গামায় বাংলা ছারখার হয়েছিল, কিন্তু বর্গিরা গঙ্গাপার হয়ে কলকাতা আক্রমণ করেনি। নদীর ধারে ইংরাজদের কামান সাজানো। তারা বুঝতে পেরেছিল নৌকায় কলকাতায় আসবার চেষ্টা করলে তোপের মুখে তাদের সর্বনাশ হবে। বর্গিরা কলকাতায় এল না বটে, কিন্তু শহরের লোকদের ভয়ের অবধি ছিল না। মারাঠারা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করতে আসত। তাদের অশ্বারোহী আটকাবার জন্য শহরের ধনী ব্যবসায়ীরা চাঁদা তুলে কলকাতার চারদিকে খাল খুঁড়তে আরম্ভ করেছিলেন। তাঁদের ইচ্ছা ছিল গঙ্গা থেকে খাল কেটে সমস্ত শহরকে ঘিরে ফেলা হবে, শত্রুর ঘোড়া ঢুকতে পারবে না। এই খাল কাটা শেষ হয়নি। উত্তরে শহর পরিক্রমা করে এই খাল এখনকার এন্টালি বাজারের কাছাকাছি এসে বন্ধ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে ভাস্কর পণ্ডিতের মৃত্যু হল। আলিবর্দি তাঁর সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে সভায় ডেকে এনে তাঁকে খুন করালেন। মারাঠারা দেশে ফিরে গেল।
মারাঠারা কলকাতায় এল না। গঙ্গার পশ্চিমে ব্যবসার বড় জায়গা ছিল। সেই সব জায়গা থেকে ব্যবসায়ীরা অনেকে এসে কলকাতায় জড়ো হতে লাগলেন। ইংরাজদের কামানের আশ্রয়ে কলকাতা তখন নিরাপদ জায়গা। এই সব কারণে ইংরাজদের নামডাক বেড়ে গেল। কলকাতা শহরও বাড়তে লাগল।
কয়েক বছর পরে অন্য দিক থেকে ইংরাজদের বিপদ দেখা দিল। বুড়ো নবাব আলিবর্দি মারা গেলেন। তখন ১৭৫৬ সাল। তার পর নবাব হলেন তাঁর মেয়ের ছেলে সিরাজউদ্দৌলা। বছর কুড়ি বয়স। সাহসের অভাব ছিল না, কিন্তু অন্য দোষ ছিল। তাছাড়া রাজনীতি যে ভাল বুঝতেন, তা নয়। তিনি নবাব হবার কিছুদিন পরে ইংরাজদের সঙ্গে তাঁর কলহ আরম্ভ হল। তার একটি কারণ হল কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ ইংরাজরা আরও সুদৃঢ় করেছিলেন। চন্দননগরে ফরাসিদের দুর্গ ফোর্ট অরলেয়াঁকেও মজবুত করা হচ্ছিল। নবাব দু’ পক্ষকেই লিখলেন যে, তাদের কাজ খুব বেআইনি হয়েছে। দুর্গে যেসব পরিবর্তন করা হয়েছে, তা ভেঙে ফেলে দিতে হবে। ফরাসিরা ভালমানুষের মতো চিঠি লিখল যে, নবাব ভুল শুনেছেন, তারা সামান্য মেরামত করেছে মাত্র। ইংরাজদের জবাব ছিল অন্য রকম। তাদের বক্তব্য, দিনকাল খারাপ, চারদিকে বিশৃঙ্খলা, শক্তি বাড়ানো ছাড়া তাদের উপায় নেই। এই উত্তরে নবাব খুশি হলেন না। জুন মাসে তিনি অনেক সৈন্য নিয়ে কলকাতা আক্রমণ করলেন। ইংরাজরা পিছু হটতে হটতে দুর্গের মধ্যে আশ্রয় নিল। নবাব তখন দুর্গের চারদিক ঘিরে আক্রমণ চালাতে লাগলেন। ইংরাজদের পক্ষে তাঁকে ঠেকানো সম্ভব ছিল না। তাদের কেউ কেউ দুর্গের পশ্চিম দিক দিয়ে হুগলি নদীর দিকে নৌকা করে পালিয়ে গেল।
দুর্গ অধিকার করে সন্ধ্যার সময় ইংরাজ বন্দীদের একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। তখন খুব গরমের সময়। ১৪৬ জন বন্দী। পরদিন সকালে দরজা খুলে দেখা গেল কেবল ২৩ জন বেঁচে আছে। একে ‘অন্ধকূপ হত্যা’ বলে। এই ঘটনা কি সত্যি? পণ্ডিতরা এ নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন। কিন্তু এই কাহিনী একেবারে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। হলওয়েল সাহেব ছিলেন বন্দীদের মধ্যে একজন। তিনি এই ঘটনার দীর্ঘ বিবরণ লিখেছেন। হলওয়েলের অবশ্য মিথ্যাবাদী বলে দুর্নাম ছিল। তাছাড়া তিনি ঘটনাটিকে অনেক বাড়িয়ে লিখেছিলেন, কাজেই তাঁর কথা সহজে বিশ্বাস করায় অসুবিধা ছিল। বন্দী অবস্থায় মৃত বলে যত লোকের নাম হলওয়েল করেছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ যুদ্ধে মারা গিয়েছিল এ কথা অবশ্য প্রমাণ করা সহজ হবে না। কিন্তু চন্দননগরের ফরাসিরা ও হুগলির ওলন্দাজরা তখনই তাদের বড় আপিসকে লিখে জানিয়েছিল যে, কলকাতায় অবরোধের সময় ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়েছে। অনেক ইংরাজ ঘরে বন্দী অবস্থায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছে। এসব কথা একসঙ্গে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফরাসিরা তো ইংরাজদের চিরকালের শত্রু। ওলন্দাজরাও ইংরাজদের বন্ধু ছিল না। কিন্তু তারাও এই কথা বলে গিয়েছে।
এই বিপদের পরে, ইংরাজ বন্দীদের যখন মুক্তি দেওয়া হল, তখন তারা দক্ষিণে হুগলি নদীর ধারে ফলতা গ্রামে গিয়ে বাস করতে লাগল। এই খবর যখন মাদ্রাজে পৌঁছল, তখন মাদ্রাজ সরকার কলকাতায় ইংরাজদের সাহায্যের জন্য ক্যাপ্টেন ক্লাইভ ও একজন নৌসেনাপতি অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে যুদ্ধের জাহাজ ও সৈন্য দিয়ে ফলতায় পাঠিয়ে দিলেন। তাদের সাহায্যে ইংরাজরা কলকাতা অধিকার করল। তার অল্প কয়েকদিনের মধ্যে দ্রুত বদলে যেতে লাগল বাংলার ইতিহাসের ধারা।