১৪. স্বাধীন বাংলাদেশ

চতুর্দশ অধ্যায় – স্বাধীন বাংলাদেশ : ১ জানুয়ারি ১৯৭২-সেপ্টেম্বর ১৯৭৩

ডেপুটি কমিশনার নিয়োগ

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার আনন্দ অনেক ম্লান হয়ে আসে যখন সংবাদ আসে যে বদর বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণের পূর্বমুহূর্তে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী নিধনের তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়, তবু জীবন থেমে থাকে না। স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার ব্রত নিয়ে সরকারকে এগিয়ে আসতে হয়।

সরকারের প্রথম দায়িত্ব ছিল প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসন গড়ে তোলা। প্রথম জেলা প্রশাসক মনোনীত হন ওয়ালিউল ইসলাম। যশোর সেনানিবাস পতনের পর ৯ ডিসেম্বর পূর্বাহ্নে যশোর কালেক্টরেটে জনাব ওয়ালিউল ইসলামের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের জেলা প্রশাসনের যাত্রা শুরু হয়। এরপর কয়েক দিনের মধ্যেই সরকার ১৭টি জেলায় জেলা প্রশাসক নিয়োগ করে। এই নিয়োগগুলো ছিল নিম্নরূপ :[১]

(১) শামসুল হক, ইপিসিএস, কুষ্টিয়া। (২) সৈয়দ আবদুস সামাদ, সিএসপি, চট্টগ্রাম। (৩) আকবর আলি খান, সিএসপি, সিলেট। (৪) খসরুজ্জামান চৌধুরী, সিএসপি, ময়মনসিংহ। (৫) মামুনুর রশীদ, সিএসপি, বরিশাল। (৬) কাজী রকিবউদ্দিন আহমদ, সিএসপি, কুমিল্লা। (৭) কামাল উদ্দীন সিদ্দিকী, সিএসপি, খুলনা। (৮) কাজী লুফুল হক, ইপিসিএস, পাবনা। (৯) জহুরুল ইসলাম ভূঁইয়া, ইপিসিএস, রাজশাহী। (১০) বিভূতিভূষণ বিশ্বাস, ইপিসিএস, পটুয়াখালী। (১১) এম ইসহাক, ইপিসিএস, টাঙ্গাইল। (১২) আবদুল মোমেন, ইপিসিএস, ফরিদপুর। (১৩) জে এন দাস, ইপিসিএস, নোয়াখালী। (১৪) মোহাম্মদ আশরাফ, ইপিসিএস, পার্বত্য চট্টগ্রাম। (১৫) আবদুল লতীফ ভূইয়া, ইপিসিএস, বগুড়া। (১৬) আমানত উল্লাহ, ইপিসিএস, দিনাজপুর। (১৭) এম আবুল কাশেম, ইপিসিএস, রংপুর।

ঢাকা জেলায় প্রথমে ডেপুটি কমিশনার নিয়োগ করা হয়নি। পরবর্তীকালে নাটোরের মহকুমা প্রশাসক কামাল উদ্দীনকে এই জেলার ডেপুটি কমিশনার নিয়োগ করা হয়। আমাকে ১৯ ডিসেম্বর সিলেটের ডেপুটি কমিশনার পদে যোগ দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক আদেশ দেওয়া হয়। যে কর্মকর্তা আমাকে আদেশটি দেন, তিনি জানান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে অবিলম্বে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আমি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে গেলাম। প্রধানমন্ত্রী সিলেটের ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত হওয়ায় আমাকে অভিনন্দন জানান। এরপর তিনি বলেন, সিলেটের ডেপুটি কমিশনার হিসেবে তার জন্য আমাকে একটি বিশেষ কাজ করতে হবে। বিশেষ কাজটি কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেখানে আবদুস সামাদ আজাদকে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করতে হবে। আবদুস সামাদ আজাদ তার নিজের লোক। সিলেট যাওয়ার আগে তিনি আমাকে আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে দেখা করতে বলেন।

আমি কিছুক্ষণ পর আবদুস সামাদ আজাদের শয়নকক্ষে উপস্থিত হই। তিনি তখন থিয়েটার রোডের দোতলার একটি কক্ষে থাকতেন। তাঁর কাছে যাওয়ার পর তিনি আমাকে আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানান এবং বলেন, সিলেট জেলাতে আমার অনেক কাজ করতে হবে। কী কাজ করতে হবে প্রশ্ন করায় তিনি বললেন, ‘দাঁড়ান এখনই বলছি।’ বলে একটি কাগজ নিলেন। সেই কাগজে সিলেট থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নামের তালিকা লিখলেন। এরপর যারা তার সমর্থক, তাঁদের নামের পাশে টিক চিহ্ন দিলেন। যারা তার সমর্থক, নন, তাঁদের নামের পাশে ক্রস মার্ক দিলেন। তিনি বললেন, যারা তার সমর্থক তাদের অনুরোধ রাখতে হবে আর যারা তার সমর্থক নন, তাঁদের অনুরোধ রাখার আগে তাঁর সমর্থকদের মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এরপর তিনি আরেকটি তালিকা তৈরি করলেন। সেই তালিকায় কিছু রাজনৈতিক নেতার নাম ছিল। তিনি বললেন, এই তালিকায় যাদের নাম আছে, তাঁরা দেওয়ান ফরিদ গাজীর গুন্ডা। এঁদেরকে যত তাড়াতাড়ি পারেন জেলে ঢোকাবেন। অন্যথায় জেলায় শান্তি স্থাপিত হবে না। তিনি আমার সাফল্য কামনা করলেন।

আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। আমার মনে প্রশ্ন জাগল, যে আশা নিয়ে আবদুস সামাদ আজাদ আমাকে সিলেট নিতে চাচ্ছেন, সে আশা পূরণ করা আমার জন্য সঠিক হবে কি না। আমরা যখন সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে যোগ দিই, তখন আমাদের ধারণা দেওয়া হয়েছিল দেশের আইন এবং বিধির ভিত্তিতে আমাদের জেলা প্রশাসন পরিচালনা করতে হবে। এখানে কে সন্তুষ্ট হলো আর কে অসন্তুষ্ট হলো, সেটা বড় কথা নয়; কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানের ব্যবস্থা অচল মনে হলো। আমি যদি সিলেটে গিয়ে আবদুস সামাদ আজাদের নির্দেশমতো কাজ না করি, তাহলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করবেন এবং প্রধানমন্ত্রী আমাকে সিলেট থেকে বদলি করে দেবেন। আর যদি আবদুস সামাদ আজাদের হাতের পুতুল হিসেবে আমি কাজ করি, তাহলে আমার ডেপুটি কমিশনার হওয়ার কোনো অর্থ হয় না। যতই এ সম্পর্কে ভাবতে থাকি, ততই আমি উত্তেজিত হতে থাকি। যাঁদের কাছ থেকে এ বিষয়ে পরামর্শ নিতাম, তারা তখন কলকাতায় নেই। ওয়ালিউল ইসলাম যশোরে ডেপুটি কমিশনার পদে যোগ দিয়েছেন। কামাল। সিদ্দিকী খুলনায় ডেপুটি কমিশনার পদে যোগ দেওয়ার জন্য চলে গেছেন। কাজী রকিবউদ্দিন কুমিল্লায় ডেপুটি কমিশনার হিসেবে কাজ করছেন। এঁদের কারও সঙ্গেই পরামর্শ করার কোনো উপায় ছিল না।

এদিকে আমাকে সিলেট যাওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছিল। আমি সম্ভবত ২১ বা ২২ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডাক বহনকারী বিমানে করে কলকাতা থেকে রওনা হই। বিমানটি প্রথমে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি যায়। সেখান থেকে অরুণাচল প্রদেশের একটি বিমানবন্দরে নামি। তারপর মিজোরামে একটি বিমানবন্দরে নামি। মিজোরাম থেকে শিলচর যাই। শিলচরে যখন পৌঁছি, তখন প্রায় বিকেল চারটা। আমাদের বিমানবন্দরে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে আলোচনা করে জানি, সিলেট যেতে হলে শিলচর থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তা করতে হবে। অন্যথায় আমি আগরতলায় যেতে পারি। সেখান থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে আমি সিলেট যেতে পারি।

আমি আগরতলা চলে গেলাম। সেখানে রকিব যে বাসা ভাড়া করেছিল, সে বাসায় গিয়ে উঠলাম। তারপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানা যায় আগরতলা থেকে সিলেটে যাওয়ার রাস্তা তখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। তাই আমাকে শিলচর ফিরে যেতে হবে অথবা আমি আগরতলা থেকে ঢাকায় যেতে পারি। ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমি আগরতলা থেকে ঢাকা গেলাম। ঢাকায় গিয়ে প্রথমে আনুদার বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি যে আমার ছোট ভাই জসিম তখন। ঢাকায় ফিরে এসেছে। কাছেই ধানমন্ডিতে জসিমের বাসা। আমি জসিমের সঙ্গে চলে গেলাম। আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিলাম। কেউ প্রাণে মরেনি কিন্তু নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাবা-মা তখনো নবীনগরে ফিরে যাননি, কণিকাড়ায় আমার মামাবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অনেক বন্ধুবান্ধব এবং শুভানুধ্যায়ী মারা গেছেন। এসব দুঃখের কাহিনি শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। আওয়ামী লীগের রাজনীতির অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় সিলেট যাওয়ার ইচ্ছা আমার অনেক কমে যায়। আমি সচিবালয়ে যাই। আমাকে। তৎক্ষণাৎ সিলেট যেতে বলা হয়। কিন্তু সিলেট যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা হয় না। আমি শেষ পর্যন্ত সিলেট যাইনি।

সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা

সচিবালয়ে তখন বিশৃঙ্খলা চলছে। নুরুল কাদের খান তখন সংস্থাপনসচিব। সংস্থাপনসচিব হিসেবে তিনি তার পছন্দমতো লোকদের ইচ্ছেমতো পদোন্নতি দিচ্ছেন। তাঁর বড় ভাই একজন সার্কেল অফিসার (রাজস্ব বিভাগ) ছিলেন। পাকিস্তান শাসনামলে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে কাজ করেছেন। হঠাৎ তাকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করে সার্কেল অফিসার রেভিনিউ থেকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর আগে এ ধরনের পদোন্নতি কাউকে দেওয়া হয়নি। ঢাকা শহরে ডেপুটি কমিশনার পদে নিয়োগ করা হয় নাটোরের মহকুমা প্রশাসক কামাল উদ্দিন আহমদকে। ঢাকায় তখন পাকিস্তানিদের অনেক বড় বড় বাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। এ বাড়িগুলো দখল করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ অভিযানে সহায়তা করেন ঢাকার ডেপুটি কমিশনার। ১৬ ডিসেম্বরের পর যারা মুক্তিবাহিনীর আদৌ সদস্য ছিলেন না, তাঁরা নিজেদের মুক্তিবাহিনীর সদস্য বলে দাবি করেন। এই ধরনের নকল মুক্তিযোদ্ধারা ১৬ ডিভিশন’ নামে পরিচিত হন। অনেক পরিত্যক্ত বাড়ি ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের সহযোগিতায় সামরিক এবং বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারা দখল করে নেন। সাধারণ মানুষের বাড়িঘর লুট করা হয়। আমার ছোট ভাই জসিম। ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে চাকরি করত। তার বাসায় একজন উর্দু ভাষাভাষী অফিসার থাকত। এই উর্দু ভাষাভাষী অফিসারকে ধরার নাম করে যখন তাদের কেউ বাসায় ছিল না, তখন বাসায় হামলা করে জসিমের বিদেশি টেলিভিশন ও টেপ রেকর্ডার লুট করে নিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারদের সুস্পষ্ট আশ্বাস সত্ত্বেও এগুলো পুনরুদ্ধার করার কোনো ব্যবস্থাই করা যায়নি। এ ধরনের লুটপাটের পরিস্থিতিতে আমার সিলেটের ডেপুটি কমিশনারের দায়িত্ব গ্রহণ করার ইচ্ছা একেবারেই উবে যায়।

আমি বঙ্গভবনে হোসেন তৌফিক ইমামের সঙ্গে কাজ করতে থাকি। ইতিমধ্যে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিযুক্ত ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ আহমদ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হন। এর ফলে সিলেটে নতুন ডেপুটি কমিশনার নিয়োগের অত্যাবশ্যকীয়তা থাকে না। আমি সাত দিনের ছুটির জন্য একটি দরখাস্ত দিয়ে বাড়ি চলে যাই। আমরা ঢাকা থেকে ছোট ভাই জসিমের গাড়িতে করে কুমিল্লা হয়ে কোম্পানীগঞ্জ যাই। কোম্পানীগঞ্জ-নবীনগর রাস্তার যুদ্ধে বিশেষ ক্ষতি হয়নি। তবে রাস্তা ছিল অত্যন্ত খারাপ। তবু এই রাস্তা দিয়ে আমরা নবীনগর পর্যন্ত যাই। নবীনগরে গিয়ে দেখতে পাই বাবা-মা ফিরে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে কয়েক দিন কাটিয়ে আমি আবার ঢাকায় ফিরে আসি।

মুক্তিযোদ্ধা সেল

ঢাকায় ফিরে আসার পর আমাকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে মুজিবনগর সেলের উপসচিব নিয়োগ করা হয়। আমি এই পদে যোগ দিই। এই পদের দায়িত্ব ছিল দুটি। একটি দায়িত্ব ছিল মুজিবনগর সরকারের যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী দেশে কোনো চাকরি পাচ্ছেন না, তাদের চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় দায়িত্ব ছিল পাকিস্তান থেকে যারা পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে, তাদের বাংলাদেশ সরকারে যোগ দেওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া। দ্বিতীয় কাজটি তখনো পুরোদমে চালু হয়নি। অল্প কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী তখন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আফগানিস্তান এবং ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসছিলেন। তবে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তারা কেউ কেউ চাকরির জন্য এই সেলের কাছে আসতেন।

সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে তখন অনেক পরিবর্তন হয়। প্রথমত, সৈয়দ হোসেনকে যুগ্ম সচিব পদে নিয়োগ করা হয়। সৈয়দ হোসেন পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সচিবালয়ের একজন সেকশন অফিসার ছিলেন। সেকশন অফিসার থেকে পদোন্নতি হলে উপসচিব হয়। কিন্তু তাঁকে সরাসরি যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। তার কারণ, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট বোনের স্বামী। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে তিনি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে তাঁর প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। এই সময়ে নিয়মবহির্ভুত পদোন্নতির জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের ওপর অনেক চাপ আসে। সৈয়দ হোসেন যদিও নিজে নিয়মবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন, তবু তিনি অনেক ক্ষেত্রে বেআইনি পদোন্নতি প্রতিহত করেন।

এই সময়ে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে মুজিব বাহিনীর কর্মকর্তাদের সরকারের বেসামরিক পদে নিয়োগ করা হবে। এই উদ্দেশ্যে তালিকা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদকে। ১৯৭২ সালে ১ হাজার ৩১৩ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বিশেষ ব্যাচ হিসেবে উচ্চতর বেসামরিক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই নিয়োগের দুটি তালিকা করা হয়। প্রথম তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর একটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস নামে নতুন একটি সার্ভিসে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই দুটি তালিকাভুক্ত কর্মকর্তাদের দুষ্টু লোকেরা পরবর্তীকালে ‘তোফায়েল সার্ভিস অব বাংলাদেশ’ নামে ডাকত। এই নিয়োগের দুর্বলতা ছিল দুটি। প্রথমত, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে কর্মকর্তা নিয়োগ করা বাঞ্ছনীয় ছিল। এই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব ছিল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের। কিন্তু পাবলিক সার্ভিস কমিশন। কোনো পরীক্ষা নেয়নি; তারা তোফায়েল আহমেদের তালিকার ভিত্তিতে নিয়োগে অনাপত্তি জ্ঞাপন করে। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় চাকরি হলে তা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকার কথা। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধে আদৌ অংশগ্রহণ করেননি, তাদেরকেও তোফায়েল আহমেদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমার একজন সহপাঠী ছিলেন, যিনি ছাত্রজীবনে একজন ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন–পরবর্তীকালে তিনি সার্কেল অফিসার রেভিনিউ পদে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সরকারের অধীনে কাজ করেন। তাঁকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়। কারণ, তিনি শেখ মনির খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

যেভাবে এসব নিয়োগের প্রক্রিয়া করা হয়, তা সাধারণত সরকারি নিয়োগের সময় করা হয় না। আমার মনে আছে, এ তালিকা যেদিন প্রকাশিত হয়, সেদিন আমার পাশের রুমে কর্মরত সংস্থাপন বিভাগের আরেক উপসচিব এ টি এম শামসুল হুদার কক্ষে অনেক গন্ডগোল শোনা যায়। হুদা সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী আমার কক্ষে এসে বলেন, ‘স্যার, মুক্তিযোদ্ধারা আমার স্যারকে মারতে যাচ্ছে। আমি ওই কক্ষে গেলাম। যাওয়ার পর দেখতে পাই একজন নিয়োগের চিঠি নিয়ে হুদাকে বলছেন, এই ব্যাটা রাজাকারের পোলা, তুই আমার বাবার নামে চাকরি দিয়েছিস কেন? আমার নামে ঠিক করে অবিলম্বে নিয়োগ দে।’

উপসচিব হুদা আমাকে নথিটি দেখালেন। নথিটিতে যে তালিকা রয়েছে, সেসব ব্যক্তিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এই তালিকার ওপরে এবং নিচে প্রতি পৃষ্ঠায় তোফায়েল আহমেদ ও বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর রয়েছে। এই তালিকায় যদি কোনো ভুল হয়, তাহলে তা সংশোধনের জন্য নথি বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠাতে হবে। এই নথি পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দরখাস্ত দিতে হবে। যদি দরখাস্ত না দেওয়া হয়, তাহলে ভুল হয়েছে–এ দাবি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে করা সম্ভব নয়। কিন্তু দরখাস্ত দিয়ে ভুল সংশোধন করানোর মতো ধৈর্যও তখন ওই ব্যক্তির ছিল না। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তার কাছ থেকে দরখাস্ত আদায় করে তাঁকে সেদিনের মতো বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তোফায়েল আহমেদের মনোনীত কর্মকর্তাদের চাকরি দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রশাসনে রাজনীতিকরণ শুরু হয়।

এই সময় সেনাবাহিনীর আরেকটি আদেশ প্রশাসনে রাজনীতিকরণের জন্ম দেয়। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল আগে এ সম্পর্কে বিধি প্রণয়ন করা এবং সব নিয়োগবিধির ভিত্তিতে সম্পন্ন করা। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় এ কাজটি করেনি। তার ফলে পদোন্নতি নিয়ে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। অমুক্তিযোদ্ধা মেধাবীরা যাতে একেবারে বাদ না পড়েন, সে জন্য মাহাবুবুজ্জামান কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তবে কোটা ব্যবস্থা শুধু মুক্তিযোদ্ধা এবং অমুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করা হয়নি। মাহাবুবুজ্জামান জেলাভিত্তিক কোটা ব্যবস্থারও প্রবর্তন করেন। জেলা কোটার ফলে অনেক মেধাবী প্রার্থী চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়।

সেনাবাহিনীতে সব মুক্তিযোদ্ধাকে দুই বছরের জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়। এর ফলে অনেক সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকদের পাকিস্তান সরকারে যেসব সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিক কাজ করেছে, তাদের আগে পদোন্নতি দেওয়া সম্ভব হয়। বেসরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ১৯৮৩ সালের আগে কোনো বিধি ছিল না। সরকার আশির দশকে এই বিধি প্রণয়ন করে। এই বিধির লক্ষ্য মুক্তিযোদ্ধাদের পদোন্নতি দেওয়া নয়, এর লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশাসনিক শূন্যতায় তাদের যে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল, তা রক্ষা করা। তবে এই বিধি পরিবর্তন সত্ত্বেও মুজিবনগর সরকারের সচিবদের বাংলাদেশ সরকারে অতিরিক্ত সচিব পদে নামিয়ে দেওয়া হয়। নয়জন কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তাদের সব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দেশ স্বাধীন হওয়ার দু-তিন মাসের মধ্যে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে আদৌ কোনো পদোন্নতি হয়নি। এর পরেও পাকিস্তান সরকারের অধীনে যারা কাজ করেছেন, তাঁদের মনের দুঃখ মেটেনি। মরহুম সুলতান উজ জামান খান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাদেশিক সরকারের সচিব ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব হন। তখন মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রশাসনিক শূন্যতায় জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে যেসব কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন, তাঁদের সম্বন্ধে উম্মা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন :

আমি আগেই উল্লেখ করেছি, সিএসপিসহ কিছু অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা যারা মুজিবনগর গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁরা চাকরিতে কেবল দু’বছরের জ্যেষ্ঠতাই লাভ করেননি, সেই সঙ্গে দু’এক ধাপ ত্বরিত পদোন্নতি পেয়ে সরাসরি সচিবের পদ লাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে স্থল পরিবহন সংক্রান্ত যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব। আবদুস সামাদ (সিএসপি, ১৯৫৯) শেষোক্ত শ্রেণীভুক্তদের অন্যতম ছিলেন।[২]

দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অজস্র সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রাণ বিসর্জন। দিয়েছেন এবং অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁদের কোনো পদোন্নতি হয়নি। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় সুলতান-উজ জামান খান সক্রিয়ভাবে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে প্রাদেশিক সরকারের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন এবং পরবর্তীকালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় সচিবের পদে পদোন্নতি লাভ করেছেন। তাদের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার কোনো শাস্তি হয়নি, কারণ দেশ গড়ার জন্য তখন অভিজ্ঞ সরকারি কর্মকর্তার প্রয়োজন। এ ধরনের সরকারি কর্মকর্তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ সরকার–উভয়ের কাছ থেকেই পদোন্নতি নিয়েছেন। তাঁরা গাছেরও খেয়েছেন, তলারও কুড়িয়েছেন। আবার কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান একেবারে অগ্রাহ্য করেছেন। যেমন : বাংলাদেশের অর্থসচিব মতিউল ইসলাম নিজেকে বাংলাদেশের প্রথম অর্থসচিব হিসেবে জাহির করেছেন। অথচ বাংলাদেশের প্রথম অর্থসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থসচিব ছিলেন। তার এই অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই।

এ সময়ে শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেই নয়, দেশে জনগণের মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছিল। দাবি করা হচ্ছিল, দেশের ভেতরে যারা ছিলেন, তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পদাঘাতে নিষ্পেষিত হয়েছেন এবং প্রতিমুহূর্তে তাদের মৃত্যুর ভয়ে থাকতে হয়েছে। যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের প্রাণের ভয় ছিল না। কয়েক মাস ভারতে কষ্টভোগের পর তারা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন। সমালোচকেরা যে তথ্যটি বিবেচনায় নেননি, সেটি হলো প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা পাকিস্তানের প্রশাসনব্যবস্থাকে দুর্বল করেছেন। যারা দেশের ভেতরে থেকে হামলাকারীদের প্রতিরোধ করেছেন, তাঁরা অবশ্যই নমস্য কিন্তু তাঁদের সংখ্যা অত্যন্ত কম। সরকারি কর্মচারীরা, যারা দেশের ভেতরে ছিলেন, তাঁরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে বাধ্য হয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে পাবনার তখনকার একজন এডিসির অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যেতে পারে। বর্তমানে কর্মকর্তাটি কারও কারও কাছে বিতর্কিত। কেননা তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে বরিশালে জেলা প্রশাসক থাকাকালে বিএনপির রাজনীতিবিদ আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তা সব সময় বহাল ছিল এবং তা আজও অটুট রয়েছে। এই কর্মকর্তার নাম এম এ হাকিম। তিনি ১৯৬৫ ব্যাচের সিএসপি কর্মকর্তা। ১৯৯৭ সালে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ২০০৭ সালে মাদারীপুর-১ আসনে তাঁকে বিএনপির মনোনয়ন দেওয়া হয়। তবে লেখকের বিএনপিপ্রীতি সত্ত্বেও তার আত্মজীবনীতে বিএনপির কোনো ছায়া পড়েনি। তাঁর কাছে যা সত্য মনে হয়েছে, তা-ই তিনি লিখেছেন এবং কোনো রাজনৈতিক মতবাদ প্রচার করেননি। সিভিল সার্ভিসে ৩২ বছর: স্মৃতি সম্ভার শীর্ষক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে তার বর্ণনা অকপট এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে সত্য। লেখককে এ জন্য ধন্যবাদ জানাই।

হাকিম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পাবনার এডিসি পদে বদলি হন। ১৯৭১ সালের ৩ জুলাই তার পাবনা যোগদানের তারিখ ছিল। ১৯৭১ সালের ২ জুলাই ঢাকায় রিকশা দুর্ঘটনার ফলে তিনি পাবনায় যোগ দেন ১৪ জুলাই তারিখে। যদি দুর্ঘটনার জন্য ১২ দিন পর পাবনায় যোগ দিতে পারেন, তবে ইচ্ছা করলে পাবনায় না গিয়ে তিনি ভারতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি পাবনায় জয়েন করেন। এই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন :

আমি পাবনা জয়েন করে দেখতে পাই যে, সেখানকার প্রশাসন প্রায় সম্পূর্ণভাবে মিলিটারীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। পাবনার ডিষ্ট্রিক্ট মার্শাল ’ল এডমিনিষ্ট্রেটের (ডিএমএলএ)-এর অফিস ও সেনা ছাউনি স্থাপন। করা হয়েছে শহরের উত্তর পশ্চিম দিকে ওয়াপদা কলোনীতে। শহরের আরও কয়েকটি স্থানে মিলিটারীদের অফিস স্থাপন করা হয়েছিল। এ ছাড়া সেনাসদস্যদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ করে আহতদের জন্য একটি ফিল্ড এ্যামবুলেন্স হসপিটাল স্থাপন করা হয়েছিল। পাবনা শহরের অনেক লোকজন গ্রামে চলে গিয়েছিল। বাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেকেই তাদের পরিবার অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা একা থাকতেন।[৫]

পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য তাঁকে কী করতে হয়েছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা তাঁর আত্মজীবনীতে রয়েছে। তিনি লিখেছেন :

আমার জয়েন করার কিছুদিন পর সরকার থেকে আদেশ গেল রাজাকার বাহিনী গঠন করার জন্য। ইতিপূর্বে জেলা, মহকুমা, থানা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছিল মিলিটারীদের নির্দেশক্রমে। এসব শান্তি কমিটির প্রধান কাজ ছিল পাক সেনাদের বিভিন্ন কাজে ও অপারেশনে সাহায্য করা। এদের পাশাপাশি রাজাকার বাহিনী সৃষ্টি করে তাদেরকে অস্ত্র (রাইফেল) দেওয়া হলো মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাক সেনাদের সাহায্য করার জন্য। রাজাকার বাহিনী গঠনের সময় ডিএমএলএ-কে কোনো কোনো বিষয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতে হয়েছিল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটকে (আবদুল কুদুস) জেলা প্রশাসক লিয়াজোঁ অফিসার হিসাবে নিয়োজিত করেছিলেন। অনেক ব্যাপারে আমাকেও জড়িত হতে হয়েছে মার্শাল ল কর্তৃপক্ষের সাথে। এসব কাজ করার ইচ্ছা না থাকলেও প্রকাশ্যে তা বলা যেত না। জেলা প্রশাসনের কাজ ছাড়াও পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসাবে মিলিটারীদের জন্য অনেক কিছু করতে বাধ্য হয়েছি। তবে আমি যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব করছি তা মুক্তিযোদ্ধারা ও তাদের সমর্থনকারী লোকজন বুঝতে পারত। পৌরসভার একজন ওভারসিয়ার (মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারী)-এর মাধ্যমে পাবনার মুক্তিবাহিনীর ২/১ জন কমান্ডারের সাথে গোপনে আমার যোগাযোগ হতো। তারা আমাকে বিভিন্ন কাজের জন্য বললে আমি সঙ্গে সঙ্গে তা করে দিতাম। অনেক সময় তাদের জন্য আমি সাহায্য পাঠাতাম। পাবনা শহরে এ সময়ে মুসলিম লীগ, জামাত ও নেজামে ইসলাম দলের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দল- সমূহের নেতাগণ ছিলেন না। প্রশাসনের প্রয়োজনে আমাদেরকে ঐসব নেতাদেরকে ডাকতে হতো এবং তাদের সহযোগিতা নিতে হতো।[৬]

তিনি আরও লিখেছেন :

অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ডও ধীরে ধীরে জোরদার হতে থাকে। বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুক্তিবাহিনীর অপারেশনের সংবাদ মাঝে মাঝে জানা যায়। এমন অবস্থার মধ্যে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে মিলিটারী কর্তৃপক্ষ পাবনা শহরে একটি হোল্ডিং ক্যাম্প তৈয়ার করে। পাবনা মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হিসেবে এ ক্যাম্পের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পানি সরবরাহ, ল্যাট্রিন, ড্রেন, ইত্যাদির ব্যবস্থা আমাকে করে দিতে হয়েছিল। গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুর রহমান কিছু নির্মাণ কাজ করে দিয়েছিলেন। পাক-মিলিটারী অফিসাররা আমাদের দ্বারা তাদের প্রয়োজনীয় কাজ করিয়ে নিত ঠিকই, কিন্তু তারা আমাদেরকে বিশ্বাস করত না। আমরাও সব সময়ে একটা ভয় বা আতংকের মধ্যে থাকতাম। জানি না কোনো কারণে মিলিটারীরা। আমাদেরকে সন্দেহ করলে আর নিস্তার নেই। ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন চালাতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্যাতন। করে বা গুলি করে মেরে ফেলতে পারে। আমাকে যখনই কোনো কাজে মিলিটারী ক্যাম্পে বা অফিসে যেতে হতো তখনই মনের মধ্যে একটা অজানা আতংক এসে যেত কি জানি কি হয়। অন্যদিকে আমার পরিবারের লোকজন ভয়ে ভয়ে থাকত এবং আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত স্বস্তি পেত না। আমার মনে হয় বাঙালী অফিসার যারাই ঐ সময়ে এদেশে কাজ করেছে তাদের সকলেরই এরূপ একটি ভীতিকর ও অজানা আশংকার মধ্যে কাটাতে হয়েছে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকেও বিপদ আসার সম্ভাবনা ছিল। ঐ সময়ে আমরা উভয় সংকট পরিস্থিতিতে দারুন ভীতিকর অবস্থায় জীবন যাপন করেছি।[৭]

প্রশ্ন ওঠে, কেন সরকারি কর্মকর্তারা এই ভীতিকর পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেননি। অবশ্যই যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, তারা বিশ্বাস করতেন যে সংগ্রামে পাকিস্তানিরা জয়যুক্ত হবে। তাই মাত্র ১৪ জন সিএসপি কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। অথচ শতাধিক সিএসপি কর্মকর্তা ভারতে পলায়নের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের দাসত্ব করেছেন। এঁরাই মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নন। এঁদের অনেকেরই রাজাকারদের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার জন্য বিচার হওয়া উচিত ছিল। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের পুরস্কার দেওয়ার নাম করে তিন প্রজন্ম পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা সৃষ্টি কতটুকু সঠিক ছিল, সে সম্পর্কেও প্রশ্ন রয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি

সচিবালয়ের বিশৃঙ্খলা দেখে আমি হতোদ্যম হয়ে যাই। এই সময় আমার যেসব সহকর্মী ডেপুটি কমিশনার হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই জেলা প্রশাসনে টিকতে পারেননি। তাঁরা সচিবালয়ে ফিরে আসেন। কামাল সিদ্দিকী ভারতীয় বাহিনীর লুটতরাজের বর্ণনা করে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলেন। এ সময় ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসারের কন্যা খুলনার মুক্ত অঞ্চল দেখতে আসেন। কামাল সিদ্দিকী তাঁকে এই প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি দেন। এই প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত পি এন হাকসারের কাছে চলে যায়। এর ফলে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। কামাল সিদ্দিকী ঢাকায় তদবির করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চলে আসেন। ওয়ালিউল ইসলাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হন। তবে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়েই সবচেয়ে বেশি হরিলুট চলছিল। তাই আমি সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হতে চাই। তখন শিক্ষাসচিব ছিলেন প্রফেসর আজিজুর রহমান মল্লিক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব অবসর গ্রহণ করার পর কামাল সিদ্দিকী আমার নাম ড. মল্লিকের কাছে প্রস্তাব করেন। ড. মল্লিক সংস্থাপনসচিবকে আমাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিব পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য একটি আধা সরকারি পত্র পাঠান। কিন্তু সংস্থাপনসচিব কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন না। আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল বা মহাসচিব রুহুল কুদুসের কাছে গেলাম। তাকে গিয়ে বললাম যে আমাকে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে বদলি না করলে আমি চাকরি ছেড়ে দেব। তিনি আমাকে উত্তেজিত না হতে অনুরোধ করেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি হই।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ১৯৭১ সালে তিনি আওয়ামী লীগের প্রধান হুইপ পদে নির্বাচিত হন। মুজিবনগরে যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়, তখন আওয়ামী লীগ দলের হুইপ হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি তিনি ছিলেন অনুগত। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তার ব্যবহার ছিল সংযত। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ড. এ আর মল্লিক দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হয়ে চলে যান। তাঁর স্থলে আসেন ১৯৫৪ ব্যাচের সিএসপি এ এস নূর মোহাম্মদ। শুনেছি এ এস নূর মোহাম্মদ নাকি পাকিস্তান সরকারের একজন চৌকস আমলা ছিলেন। তিনি জেনেভায় বিশ্ববাণিজ্য সম্পর্কে আলোচনায় পাকিস্তানের প্রতিনিধি ছিলেন। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর তাঁকে শিক্ষাসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। সিএসপি হওয়ার আগে তিনি কোনো স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। হেডমাস্টারের অনেক স্বভাব তার মধ্যে সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত থাকে। তিনি সব ব্যাপারেই ছিলেন প্রাচীনপন্থী। এমনকি বানানের ক্ষেত্রেও যেখানে ‘ী’-এর পরিবর্তে ‘ি’ চালু হয়েছে, তা তিনি মানতে চাইতেন না। তিনি সাধু ভাষায় লিখতে পছন্দ করতেন, আর আমরা পছন্দ করতাম চলতি ভাষায়। সুতরাং তার কাছে কোনো সারসংক্ষেপ পাঠালে তিনি বানান এবং ভাষা নিয়ে অনেক প্রশ্নবোধক চিহ্ন মোটা কলমে করতেন, তারপর নাম স্বাক্ষর করতেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনে আদৌ বিশ্বাস করতেন না। আমি ছিলাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপসচিব। তিনি প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কারণ দর্শানোর জন্য পত্র লিখতে আমাকে আদেশ করতেন। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করতেন, তখন তিনি আমাকে দোষ দিতেন। উপাচার্যরা আমার অভিমত জানতেন। তাই কেউই তাঁর বক্তব্য বিশ্বাস করেননি। আমার এবং তার মধ্যে সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল তিক্ত। তবে সান্ত্বনা ছিল এই যে যেখানে শিক্ষাসচিব আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন, সেসব বিষয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলে তিনি শিক্ষাসচিবের আদেশ বাতিল করে দিতেন এবং আমার সঙ্গে একমত পোষণ করতেন।

পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুধু শিক্ষার বিষয়টি পরিচালনা করত। স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষা ছাড়া আরও তিনটি বিষয় যুক্ত হয় : (১) সংস্কৃতিবিষয়ক কার্যাবলি, (২) বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও (৩) ক্রীড়া ও যুবকদের কার্যাবলি। এই অতিরিক্ত কাজের জন্য দুটি নতুন যুগ্ম সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়। একটি পদ সংস্কৃতি, ক্রীড়া এবং যুব কল্যাণসংক্রান্ত বিষয়গুলোর দায়িত্বে ছিল। এই পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ১৯৪৮ ব্যাচের ইপিসিএস ক্যাডারে নিযুক্ত এ কে এম জাকারিয়াকে। তিনি দিনাজপুরের ডেপুটি কমিশনার ছিলেন। শিক্ষামন্ত্রীও দিনাজপুরের লোক ছিলেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক খুবই ভালো ছিল। এই অতিরিক্ত কাজ সামলানোর জন্য দুটি সেকশন সৃষ্টি করা হয়। আরেকজন যুগ্ম সচিব নিযুক্ত করা হয় বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য। এই যুগ্ম সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয় ড. ফারুক আজিজ খানের ওপর। ড. ফারুক আজিজ খান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন। মুজিবনগরে থাকতেই তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। তার অধীনে একটি শাখাপ্রধানের পদ সৃষ্টি করা হয়। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ে একটি উপশিক্ষা উপদেষ্টার পদ সৃষ্টি করা হয়। তবে এ পদ যখন সৃষ্টি হয়, তখন আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তখন সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল স্থানাভাব। দুজন যুগ্ম সচিব ও তিনজন সেকশন অফিসারসহ পাঁচজন অফিসারের জায়গা দিতে হবে। কিন্তু তাদের জন্য কোনো আলাদা জায়গা নেই। এর ফলে জায়গা ভাগাভাগি করতে হয়। তিনজন শাখা প্রধানকে বিদ্যমান শাখাসমূহে টেবিল চেয়ার দিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক যুগ্ম সচিবের জন্য একটি উপসচিবের কামরা দেওয়া হয়। আমার জন্য কোনো কামরা প্রথম চার মাস ছিল না। ড. ফারুক আজিজ খানকে যে কামরা বরাদ্দ করা হয়, সেই কামরায় একটি ইজিচেয়ার ছিল। মধ্যাহ্নভোজনের পর কর্মকর্তাদের বিশ্রামের জন্য জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কক্ষে ইজিচেয়ার দেওয়া হতো। ফারুক আজিজ খানের কক্ষে যে টেবিল-চেয়ার ছিল, সেখানে তিনি অফিস করতেন আর ইজিচেয়ারে বসে আমি আমার অফিস করতাম। ছোটখাটো নোট ইজিচেয়ারে বসেই লিখতাম, যেখানে বড় নোট লিখতে হতো, সে ক্ষেত্রে নথি বাড়িতে নিয়ে হাতে নোট লিখতাম। স্থানাভাব ছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা ছিল বাংলা টাইপরাইটারের নিদারুণ ঘাটতি। মন্ত্রণালয়ে চারটি বাংলা টাইপরাইটার ছিল। একটি টাইপরাইটার শিক্ষামন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ করা হয়। বাকি তিনটি টাইপরাইটার দিয়ে সারা মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম চালাতে হতো। কোনো কিছু টাইপ করতে হলে টাইপিস্টের কাছে তা পাঠিয়ে অপেক্ষা করতে হতো। টাইপিংয়ে ছোটখাটো ভুল হলে দ্বিতীয়বার টাইপ করা হতো না, কলম দিয়ে সেগুলো শুদ্ধ করা হতো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমার দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপ

(১) উচ্চশিক্ষা। (২) শিক্ষা সংস্কার (৩) পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (৪) চারটি শিক্ষা বোর্ড এবং মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (৫) সংস্কৃতিবিষয়ক কার্যাবলি (৬) ক্রীড়াবিষয়ক কার্যাবলি ও। (৭) যুবকদের সংক্রান্ত কার্যাবলি।

পাঠ্যপুস্তক বোর্ড

সরকারের অনুমোদিত পাঠ্যসূচি অনুসারে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রদের জন্য বই ছাপিয়ে তা বিনা মূল্যে বিতরণ করত। শিক্ষার উন্নয়ন খাতের একটি উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ ছিল পাঠ্যপুস্তকের জন্য। আমি এই উপবিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পর পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে অনুরোধ করি তারা যেন তাদের প্রকাশিত সব পাঠ্যপুস্তকের একটি কপি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন। আমি বইগুলো পড়া শুরু করি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমি প্রায় পনেরো মাস কাজ করেছি। তাতে বাংলা এবং সমাজবিদ্যা সম্পর্কের বইগুলো পর্যালোচনা করতে পেরেছিলাম। এই পর্যালোচনায় দেখা যায় যে বইগুলোর মান খুবই নিচু এবং অধিকাংশ বই অজস্র ত্রুটিতে ভরা। নবম এবং দশম শ্রেণির ভূগোল বইটি পর্যালোচনা করে চার শ রও বেশি ভুল নজরে আসে। এ সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সঙ্গে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গণশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক এবং তাঁর সহকর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন। এই বইয়ে লেখা হয়েছে যে কাশ্মীর ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত। আসলে কাশ্মীর উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত। কাশ্মীরকে ভারত অধিকৃত বলে দেখানো হয়েছে। এ ধরনের বক্তব্য স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার অবশ্যই গ্রহণ করে না। বোর্ডের চেয়ারম্যান ভুলের জন্য ক্ষমা চান। এবং এ সম্পর্কে একটি আলাদা ছাপার ভুলের তালিকা (Errata) ছাপিয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে নতুন করে সেই মুহূর্তে বই ছাপানোর জন্য কাগজ নেই এবং বইটি লেখার জন্যও সময় লাগবে। সুতরাং এই ত্রুটিপূর্ণ বই দিয়েই আরও এক বছর চালানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। বাংলা বইগুলো পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমার চোখে দুটি ত্রুটি ধরা পড়ে। প্রথমত, প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা বইয়ে বিখ্যাত লেখকদের লেখা নির্বাচন করা হয়। তবে বিখ্যাত লেখকের কোনো সংজ্ঞা নেই। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যেসব ব্যক্তি লেখক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তাঁদের লেখাও অন্তর্ভুক্ত করা হতো। আমার মনে হয় লেখক নির্বাচনের একটি ভিত্তি নির্ধারণ করা উচিত এবং কোন ধরনের লেখকের লেখা নিচের শ্রেণিতে এবং কোন ধরনের লেখকের লেখা ওপরের শ্রেণিতে পড়াতে দেওয়া হবে, সে সম্পর্কে সুনির্ধারিত নীতি থাকা প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষা শুধু বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিতির জন্য শেখানো হয় না, বাংলা ভাষার মাধ্যমে ছাত্রদের সব বিষয় সম্পর্কে বক্তব্য প্রকাশের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাই সাহিত্যের বাইরেও বিজ্ঞান, ব্যবহারিক বিষয়সহ সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাংলা পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। এর সঙ্গে ছাত্রদের বয়সের কথাও মনে রাখতে হবে। একজন পাঁচ বছরের শিশুর কতগুলো শব্দ এবং কতগুলো ধারণা জানার প্রয়োজন, তা গবেষণা করে নির্ণয় করা যেতে পারে। সেই অনুসারে ৫ থেকে ১৩-১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ছাত্রদের পাঠ্যসূচি নিধারণ করতে হবে। এর জন্য গবেষণার প্রয়োজন। বাংলাদেশ অথবা পশ্চিম বাংলায় কেউই এ সম্পর্কে গবেষণা করেনি। অথচ উনবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের বাংলা পাঠ্যবই প্রকাশ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা বইটির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এই বইয়ে যেসব শব্দ এবং ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তা পাঁচ বছরের প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্রদের জন্য যথেষ্ট।

পাঠ্যপুস্তকের সমস্যা সমাধানের জন্য আমি শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারিনি। তবে পত্রপত্রিকা থেকে দেখা যাচ্ছে যে এ সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। এর কারণ হলো পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বই লেখকদের যথেষ্ট সম্মানী দেন। না এবং বই সম্পাদনার দায়িত্ব দেন কমিটির ওপর। কমিটি ঠিকমতো কাজ করে না। তার ফলে বইয়ের মান নিচুই থেকে যায়। উপরন্তু রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য এবং সরকারের রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের জন্যও পাঠ্যপুস্তক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থার বদলে যদি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক বাছাইয়ের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকের মধ্য থেকে সরকার দুটি কিংবা তিনটি পাঠ্যপুস্তককে পড়ানোর উপযুক্ত বলে স্বীকৃতি দেবেন। এর ফলে এদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে এবং ছাত্ররা ভালো পাঠ্যপুস্তক পাবেন।

শিক্ষা বোর্ডসমূহের কার্যকলাপ

শিক্ষা বোর্ডসমূহ পরীক্ষা পরিচালনা করে। পরীক্ষার ফি থেকে এরা প্রচুর অর্থ লাভ করে। বিশেষ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে বোর্ডগুলোর লাভ ক্রমেই বাড়ছে। প্রকৃত ব্যয়ের ভিত্তিতে পরীক্ষার ফি নির্ধারিত হওয়া উচিত। প্রতিবছর ফির হার সরকারের পর্যালোচনা করা উচিত। তারপরও শিক্ষা বোর্ডের লাভ থাকবে। এ লাভের অর্থ বর্তমানে শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন ভাতা’র নামে নিয়ে যাচ্ছেন। সরকারি আইনে এসব ভাতা সিদ্ধ নয়। এর ফলে হিসাব নিরীক্ষায় আপত্তি হচ্ছে কিন্তু কোনো বোর্ডই এসব আপত্তি মেটাচ্ছে না। সরকারের উচিত এ ধরনের অনাচার বন্ধ করা।

পরীক্ষা পরিচালনার ফলে যে লাভ হয়, তা বোর্ডের কাছে না রেখে বোর্ডের অধীন স্কুলগুলোর অবকাঠামো নির্মাণে সাহায্য হিসেবে দেওয়া উচিত। গবেষণাগার এবং লাইব্রেরির জন্যও লাভের একটি অংশ বরাদ্দ দেওয়া উচিত।

বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বাজেটে ব্যয়ের দারুণ উল্লম্ফন ঘটে। অথচ আয় প্রায় স্থির থেকে যায়। ব্যয় বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে নির্দিষ্ট কাজের জন্য যেসব অনিয়মিত কর্মচারী নিয়োগ করা হতো, তাঁদের সবাইকে ছাত্রসংগঠনগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কর্মচারী ঘোষণা করা হয়। এর ফলে ব্যয় বিপুল বেড়ে যায়, অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবার মান নেমে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায় যে এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই। সরকার অতিরিক্ত কোনো বরাদ্দ দিলে বিশ্ববিদ্যালয় চালানো সম্ভব হবে না। এই সমস্যা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রকট রয়েছে। এখনো বেশির ভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০ শতাংশ বরাদ্দ শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন ভাতার জন্য ব্যয় করা হয়ে থাকে। যদি ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রশাসন চালানো সম্ভব হয়, তাহলে প্রচুর অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে এবং এই অর্থ গবেষণাগার ও পাঠাগারে ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত করা যেতে পারে।

শিক্ষার সংস্কার

পাকিস্তান আমল থেকে মাঝেমধ্যে শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। শিক্ষা সংস্কারের জন্য শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। ষাটের দশকে শরিফ কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যে শিক্ষা সংস্কার করা হয়, তার বেশির ভাগই পরে প্রত্যাহার করতে হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের নীতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৭২ সালে সরকার ডক্টর কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেন। এ কমিশনের সদস্যসচিব ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের সুপারিশসমূহ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। শিক্ষা সংস্কার শিক্ষা কমিশনের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে না করে একটি চলমান প্রক্রিয়া হিসেবে চালু করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সেল শিক্ষা সংস্কার সম্পর্কে কাজ করবে এবং বাস্তবায়িত সংস্কারসমূহের মূল্যায়ন করবে।

সংস্কৃতি এবং ক্রীড়াবিষয়ক কার্যাবলি

১৯৭২ সালে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত অফিসগুলো চালু ছিল–

(১) প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর (2) বাংলাদেশ আর্ট কাউন্সিল (৩) কপিরাইট অফিস (৪) জাতীয় পাঠাগার ও মহাফেজখানা (৫) সরকার পরিচালিত পাঠাগারসমূহ (৬) সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত বিশেষ প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিরা।

ক্রীড়ার ক্ষেত্রে শরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত কিছু প্রতিষ্ঠান ছিল। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বরাদ্দ ছিল অপ্রতুল, নেতৃত্ব ছিল দুর্বল। এ প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে গড়ে তোলার প্রয়োজন ছিল। যে কাজ এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি।

সাংস্কৃতিক সহযোগিতা ও ভারত সফর

পাকিস্তান আমলে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা মুসলমান দেশসমূহ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবেদার রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন সাংস্কৃতিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সময় তিনটি দেশের সঙ্গে সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় : (১) পূর্ব জার্মানি, (২) রাশিয়া ও (৩) ভারত। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার কখনো সাংস্কৃতিক চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। তাই সাংস্কৃতিক চুক্তির কোনো নজির। ছিল না। এ সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে সাংস্কৃতিক চুক্তির অনুলিপি সংগ্রহ করি এবং এর ভিত্তিতে ভারত, পূর্ব জার্মানি ও রাশিয়া সরকার কর্তৃক প্রেরিত সাংস্কৃতিক চুক্তির খসড়াসমূহ পরীক্ষা করি এবং চুক্তির খসড়া প্রণয়ন করি। খসড়াসমূহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের অনুমোদন এবং মন্ত্রিসভার অনুমোদন নিয়ে স্বাক্ষর করা হয়। ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তি ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়।

এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল হাসান এবং বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মেরি এন্ডারসন জাহাজে ভারতীয় শিক্ষামন্ত্রী মেঘনা নদী ভ্রমণকালে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য একটি কার্যপত্রও অনুমোদিত হয়। কার্যপত্র অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন ভারতের শিক্ষাসচিব এবং ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা (যিনি ১৯৪৮ ব্যাচের একজন আইএএস ও বাঙালি। কর্মকর্তা ছিলেন) এবং ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা ড. জালালউদ্দিন। ড. জালালউদ্দিন বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণি লাভ করেছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য থাকায় তাঁকে বাইরে গবেষণার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। তিনি পালিয়ে ভারতে যান এবং ভারত থেকে সোভিয়েত রাশিয়াতে উচ্চশিক্ষার জন্য চলে যান। রাশিয়া থেকে পিএইচডি করার পর তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং ১৯৭১ সালে তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন যুগ্ম সচিব এ কে এম জাকারিয়া, কামাল সিদ্দিকী এবং আমি।

ভারত-বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের কিছুদিন পর ভারত সরকার বাংলাদেশকে তাদের নিখিল ভারত পল্লি অঞ্চলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। বাংলাদেশে তখন পেশাদার ক্রীড়াবিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তবু জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের খেলায় (কুস্তি, কাবাডি, শরীরচর্চা ইত্যাদি) যারা নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মধ্য থেকে প্রায় ৪০ জনের একটি টিম গঠন করা হয়। ড. জালাল প্রস্তাব করেন যে আমি যেন এই ক্রীড়া দলের মিশনপ্রধান হয়ে ভারতে যাই। আমি তাকে জানাই, আমার ক্রীড়ায় কোনো আগ্রহ নেই এবং আমি যেতে চাই না। তিনি এসে স্বীকার করলেন যে শুধু নিখিল ভারত পল্লি অঞ্চলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য আমার ভারত যাওয়ার দরকার নেই। তবে আমি ভারতে গেলে ভারত সরকার আমাকে ভারতের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করতে পারবে এবং আমাকে দিল্লির বাইরে বিভিন্ন স্থানে ও পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় এবং বিশ্বভারতীতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে। তার অনুরোধে আমি এই দলের প্রধান হিসেবে ভারতে যাই। এই দলের মধ্যে আমাকে সহায়তা করার জন্য ছিলেন মিসেস বকুল নামে শরীরচর্চা কলেজের একজন অধ্যাপিকা। তার সঙ্গে ছিলেন শেখ কামালের বাগদত্তা সুলতানা কামাল। সুলতানা কামাল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। তিনি একটি মহিলা কাবাডি দলের সদস্য ছিলেন। দিল্লি যাওয়ার আগে স্পোর্টস ফেডারেশন থেকে আমার দৈনিক ভাতা ছাড়াও আরও পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়। বলা হয় যে এই অর্থ দিয়ে আমি বিশেষ খরচ করতে পারব এবং স্পোর্টসম্যানদের কারও কোনো সমস্যা হলে এখান থেকে অর্থ সাহায্য দিতে পারব।

আমি উড়োজাহাজে করে দিল্লি যাই। দিল্লিতে একটি ক্রীড়া চক্রের ক্লাবে আমাকে রাখা হয়। ক্লাবে থাকার ব্যবস্থা ভালোই ছিল কিন্তু খাবার নিয়ে সমস্যা হয়। আমি যেহেতু নিরামিষ খাই না, সেহেতু তারা আমার জন্য আমিষের ব্যবস্থা করে। এই আমিষের বেশির ভাগই ছিল মহিষের মাংস, যেটা আমি মোটেও পছন্দ করতাম না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ আমাকে একটি গাড়ি দেয়। এই গাড়িতে করে আমি বাংলাদেশ দূতাবাসে যাই। সেখানে। আমার ব্যাচমেট মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে ভালো গরুর মাংস খেতে পাই। জিজ্ঞাসা করে। জানতে পারি দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার অঞ্চলে খাঁটি গরুর মাংস পাওয়া যায়।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ খেলার বাইরে আমার জন্য আরেকটি কর্মসূচি তৈরি করে। এ কর্মসূচি অনুসারে আমি ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার (যার সঙ্গে ঢাকায় আমার দেখা হয়েছিল) সঙ্গে দেখা করি। তিনি তাঁর অফিসের একজন কর্মকর্তাকে আমার সঙ্গে ডিউটি করার জন্য দায়িত্ব দেন এবং তাঁকে আমার কর্মসূচির একটি তালিকা দেওয়া হয়। এই তালিকা অনুসারে আমি বিড়লা ভবন, যেখানে মহাত্মা গান্ধী নিহত হন, সেখানে যাই। ভারতীয় জাতীয় জাদুঘরে যাই, ভারতীয় সরকারি মহাফেজখানায় যাই, জওহর লাল নেহরু স্মৃতিবিজড়িত জাদুঘরে যাই।

রোববার দিন তারা আমাকে আগ্রা নিয়ে যায়। আগ্রায় যাওয়ার সময় আমার বন্ধু মহিউদ্দিন ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হই। গল্প করতে করতে আমরা আগ্রায় পৌঁছালাম। আগ্রায় তাজমহল ও আগ্রার দুর্গ দেখার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ফতেহপুর সিক্রিতে। ফতেহপুর সিক্রিতে সম্রাট আকবর রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত পানির অভাবে সেখানে রাজধানী রাখা সম্ভব হয়নি। ফতেহপুর সিক্রিতে সেলিম চিশতির মাজার ছিল। সেলিম চিশতির আশীর্বাদে সম্রাট আকবরের ছেলে জাহাঙ্গীরের জন্ম হয়। হিন্দু-মুসলমান সবাই বিশ্বাস করেন, সেলিম চিশতির দোয়া পেলে ছেলেসন্তান। হওয়া সম্ভব। তাই সেই মাজারের সামনে লাইন দিয়ে ভক্তদের দেখা যায়, যারা পুত্রসন্তান লাভের আশায় সেলিম চিশতির মাজারে সুতা বাঁধার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। ফতেহপুর সিক্রি থেকে আমরা সেকেন্দ্রায় সম্রাট আকবরের সমাধিতে যাই। তাজমহলের আদিরূপ আকবরের সমাধিতে দেখা যায়।

পরদিন ছিল নিখিল ভারত পল্লি অঞ্চলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী উৎসব। সেদিন আমাকে ওই উৎসবে থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়। আমি আমার বন্ধু মহিউদ্দিনকে নিয়ে ওই অনুষ্ঠানের পেছন দিকে বসেছিলাম। আমার দল কোনো প্রতিযোগিতাতেই ভারতীয় প্রাদেশিক দলগুলোর সঙ্গে টিকতে পারেনি। হঠাৎ ঘোষণা শুনলাম যে বাংলাদেশ মার্চপাস্টে প্রথম হয়েছে। এবং বাংলাদেশের দলপতি আকবর আলি খান এ পুরস্কার গ্রহণ করবেন। আমি ভারতীয় উপরাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছাই এবং তাঁর কাছ থেকে একটি স্মারক গ্রহণ করি।

দিল্লির কর্মসূচি শেষ হলে আমি কলকাতায় ফিরে আসি। এখানে পশ্চিম বাংলার শিক্ষাসচিব এবং পশ্চিম বাংলার ডিপিআইয়ের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়। এই আলোচনায় স্কুলে বাংলা ভাষার পাঠ্যপুস্তকের মান উন্নয়নের জন্য আমি বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার যৌথ গবেষণার প্রস্তাব রাখি। পশ্চিম বাংলার প্রতিনিধিরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তবে পরে এ ব্যাপারে আর কাজ হয়নি। বাংলাদেশে এ প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন ছিল না। অনেকে মনে করতেন। যে এ ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে পশ্চিম বাংলা বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকের বাজার গ্রাস করবে। সুতরাং তারা সহযোগিতার পক্ষে ছিলেন না।

কলকাতা থেকে তিন দিনের সফরে আমি বোলপুরে বিশ্বভারতীতে যাই। বিশ্বভারতীতে আমার প্রটোকলের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিশ্বভারতী ভূসম্পত্তি অফিসের একজন কর্মকর্তাকে। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শ্যালকের ছেলে। ছোটবেলায় তিনি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন। তার পিতা পতিসর কাছারিতে ঠাকুর পরিবারের আমলা ছিলেন।

আমাকে বিশ্বভারতীর অতিথি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষ বরাদ্দ করা হয়। রাতে আমাকে বিশ্বভারতীর উপাচার্য প্রতাপচন্দ্র চন্দের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক। আমি যখন বিশ্বভারতীতে যাই, তখন বিশ্বভারতীতে ছুটি ছিল। তাই সব অধ্যাপক ক্যাম্পাসে ছিলেন না। উপাচার্য জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের নিমন্ত্রণ করেন। উপস্থিত অধ্যাপকেরা অনেকেই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণা করেন। পরের দুদিন আমাকে বিশ্বভারতীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ঘুরিয়ে দেখানো হয়। আমাকে বোলপুরের অদূরে সুরুল গ্রামে শ্রীনিকেতনে নিয়ে যাওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথের একমাত্র ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট এখানে একটি পল্লি উন্নয়ন একাডেমি গড়ে তোলেন। সেই একাডেমিতে রেশম এবং সুতার ওপর তখন গবেষণা চলছিল। আমাকে সেসব গবেষণা দেখানো হয়।

বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথ যেসব ভবনে ছিলেন, সে ভবনগুলোও ঘুরিয়ে দেখানো হয়। তিন-চারটি ছোট ছোট বাংলো সেখানে ছিল। রবীন্দ্রনাথ একটি বাংলোতে কিছুদিন থাকার পর তার নাকি দম বন্ধ হয়ে আসত। তাই তার জন্য আরেকটি নতুন ভবন করতে হতো। এভাবে দু-তিন বছর পরপর তিনি ভবন পরিবর্তন করতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য এ ভবনগুলোতে দেখতে পাই। আমাকে শান্তিনিকেতন ভবনও দেখানো হয়। ১৮৬৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুরের কাছে ২০ বিঘা জমি রায়পুরের সিংহদের কাছ থেকে কিনেছিলেন। সেখানে তিনি একটি অট্টালিকা নির্মাণ করেন, যা ‘শান্তিনিকেতন’ পরিচিতি লাভ করে। ১৮৮৮ সালে দেবেন্দ্রনাথ ট্রাস্ট ডিড করে শান্তিনিকেতনের জমি উৎসর্গ করেন এবং এর ব্যয়নির্বাহের জন্য জমির কিছু অংশ দেবোত্তর করে দেন। ট্রাস্ট ডিডে তিনি শর্ত আরোপ করেন :

তথায় কোনো মূর্তি বা প্রতিমা বা প্রতীক পূজা হইতে পারে না। কোনো ধর্মের নিন্দা, মদ্য, মৎস্য, মাংসভোজন নিষিদ্ধ; নিন্দনীয় আমোদ-আহ্লাদও হইতে পারে না।

এই শর্তের জন্যই এখনো শান্তিনিকেতনে কোনো পূজা করতে দেওয়া হয় না, অথচ বেদ, বাইবেল, কোরআন অথবা ত্রিপিটকের মতো ধর্মশাস্ত্র পাঠ করতে ও ব্যাখ্যা করতে উৎসাহিত করা হয়।

বাংলাদেশে মৌলবাদীরা প্রচার করে থাকেন যে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু পৌত্তলিকতার প্রচারক ছিলেন। বাস্তবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীতে শান্তিনিকেতনে পৌত্তলিকতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই।

বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় আমি শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি রক্ষার্থে যে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেই জাদুঘরের জন্য সহায়তা চাই। সেখানে আমি জানতে পারি শিলাইদহের কুঠিবাড়ি ১৯২০-এর দশকে রবীন্দ্রনাথের মেজ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভাগ্যকুলের জমিদারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে শিলাইদহের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির কোনো যোগাযোগ ছিল না। সুতরাং সেখানে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি রক্ষার্থে বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রনাথ পূর্ব বাংলায় বসে যেসব ছবি এঁকেছিলেন, তার অনুলিপি পাঠানো যেতে পারে। আরও সিদ্ধান্ত হয় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের যে পূর্ণাঙ্গ রচনাবলি প্রকাশিত হয়েছিল, তার একটি সেট এ জাদুঘরে দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া আরও কী কী দেওয়া যেতে পারে, সেটা আলোচনার মাধ্যমে স্থির করা যেতে পারে। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ রবীন্দ্রনাথের চিত্রকর্ম এবং বই শিলাইদহে পাঠিয়েছিল।

বিশ্বভারতী থেকে কলকাতায় ফিরে এসে দেখতে পাই যে বাংলাদেশের মহিলা কাবাডি দল আটকা পড়ে আছে। তারা দাবি করে যে তাদের দলনেত্রীর কাছে একটি ব্যাগে পাসপোর্ট ছিল। ব্যাগটি হারিয়ে যায়। তাই তারা যেতে পারছেন না। আমি কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা এদের ট্রাভেল পারমিট দেয়। দু-তিন দিন কলকাতায় থেকে ট্রাভেল পারমিট নিয়ে এরা ঢাকায় ফিরে আসে।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। প্রথমে তাঁকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। তিনি সরকারব্যবস্থায় পরিবর্তন আনেন। তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে সরকারপ্রধান হন এবং বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। সাধারণত কোনো রাজনৈতিক নেতা আমাকে না ডাকলে আমি কখনো তার সঙ্গে পরিচয় করতে যেতাম না। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় আসার পর প্রায় সব উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবু আমি নিজের উদ্যোগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। তাই আমার সঙ্গে তাঁর সরাসরি পরিচয় ছিল না। শিক্ষা কমিশনের যখন প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তখন গণভবনে বঙ্গবন্ধু তাতে সভাপতিত্ব করেন। শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলীর সঙ্গে সভার কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করার জন্য গণভবনে উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু সভায় উপস্থিত হলে শিক্ষামন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মুজিব ভাই, এ হচ্ছে আমার মুক্তিযোদ্ধা উপসচিব আকবর আলি খান। বঙ্গবন্ধু আমার পিঠে একটু হাত বোলালেন। তারপর সভাপতির আসন গ্রহণ করলেন। এই ছিল জীবনে আমার তার সঙ্গে একমাত্র সংযোগ। কিন্তু শিক্ষা। মন্ত্রণালয়ে কাজ করার ফলে তার সঙ্গে আমার তিনটি পরোক্ষ সংযোগ। ঘটেছিল, যা আমার মনে এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে।

প্রথম সংযোগটি ঘটেছিল ১৯৭২ সালের শেষ দিকে, যখন দেশে রাজাকারদের শাস্তি দেওয়ার জন্য রাজাকার দমন আইন পাস করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে রাজাকারদের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগ ওঠে। আইন অনুসারে পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে এবং কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার করার হুমকি দেয়। অভিযুক্ত শিক্ষকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর শরণাপন্ন হন। চৌধুরী। সাহেব সরাসরি গণভবনে বঙ্গবন্ধুর কাছে হাজির হন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীকে ডেকে নেন। তারা তিনজন বসে সিদ্ধান্ত নেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে রাজাকারদের সহযোগিতার অভিযোগ উত্থাপিত হলে পুলিশ কোনো তদন্ত করবে না। এ ধরনের সব অভিযোগ তদন্ত করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নিযুক্ত একটি কমিটি। তাঁরা এই কমিটির সদস্যদের নামও ঠিক করেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে সেই তালিকা অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাতে সারসংক্ষেপ ওই দিনই পাঠানো যায়, তার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করা হয়। শিক্ষামন্ত্রী সচিবালয়ে। এসে আমাকে কাগজটি ধরিয়ে দিয়ে এ সম্বন্ধে এক ঘণ্টার মধ্যে সব কাগজ। প্রস্তুত করতে বলেন। আমি তাকে বলি যে এর আইনগত দিক রয়েছে এবং এ সম্পর্কে সারসংক্ষেপ পেশ করার আগে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিতে পারলে ভালো হতো। ইউসুফ আলী বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু আদেশ দিয়েছেন। এ আদেশ সম্পর্কে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি সারসংক্ষেপ এবং আদেশের খসড়া তৈরি করে নিয়ে আসুন।

আমি আমার কক্ষে ফিরে এসে আদেশের খসড়া তৈরি করি এবং টাইপিস্টকে অবিলম্বে সেটি টাইপ করে দিতে অনুরোধ করি। তারপর আমি নোটশিটে লিখি, শিক্ষামন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন যে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং শিক্ষামন্ত্রীর একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে রাজাকারদের সঙ্গে সহযোগিতার তদন্তের ভার নিম্নরূপ কমিটির হাতে অর্পণ করা হবে। আমি শিক্ষামন্ত্রীকে বলি এই সিদ্ধান্তটির আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। থানার দারোগাকে আইন করে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আর চ্যান্সেলরের কমিটিকে একটি নির্বাহী আদেশে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। নির্বাহী আদেশে নিযুক্ত কমিটির ক্ষমতা কখনো আইনে নিযুক্ত তদন্তকারী কর্মকর্তার চেয়ে বেশি হতে পারে না। শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে প্রস্তাবিত বিজ্ঞপ্তির খসড়া আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পেশ করলাম।

এক ঘণ্টা হতে না হতেই শিক্ষামন্ত্রীর তাগাদা আসতে শুরু করে। আমি বিজ্ঞপ্তিটি টাইপ হলে ফাইলটি তৈরি করে শিক্ষাসচিবের স্বাক্ষর নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে দিই। শিক্ষামন্ত্রী কিছু না পড়েই তার স্বাক্ষর দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নথি পাঠিয়ে দেন। পরদিন সকালে গণভবন থেকে আমার কাছে জানতে চাওয়া হয় রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ফেরত এসেছে কি না। আমি তাঁকে জানাই ফাইল তখনো ফেরত আসেনি। তিনি আমাকে রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফাইলটি দ্রুত পাঠানোর জন্য অনুরোধ করতে পরামর্শ দেন। রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব জানান তিনি দ্রুততার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছে নথি দাখিল করেছেন কিন্তু রাষ্ট্রপতি এটি স্বাক্ষর করেননি। এরপর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে যায়, তবু রাষ্ট্রপতি ফাইলটি স্বাক্ষর করেননি। প্রতিদিনই আমি গণভবনে যোগাযোগ করতাম এবং প্রতিদিনই একই উত্তর পেতাম।

সাত দিন পর অধ্যাপক ইউসুফ আলী আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি এই ফাইল সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য তাঁকে বঙ্গভবনে ডেকেছিলেন। রাষ্ট্রপতি ফাইলটি দেখিয়ে বলেন, ‘ফাইলে যে নোটটি আছে, সেটি কি আপনি পড়েছেন?’ ইউসুফ আলী বলেন, ‘স্যার, নোটটি আমার এক উপসচিব লিখেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং সে কারণে আবেগপ্রবণ। রাষ্ট্রপতি তাঁকে বললেন, তিনি মোটেও আবেগপ্রবণ নন এবং তাঁর বক্তব্য সঠিক। আমি এক সপ্তাহ ধরে সরকার গঠিত কমিশনের বৈধতা সম্পর্কে বিভিন্ন হাইকোর্টের রায় পর্যালোচনা করেছি। আমার সিদ্ধান্ত হলো উপসচিবের বক্তব্য সঠিক। তাই আমি এ প্রস্তাব অনুমোদন করতে চাই না। আপনি বঙ্গবন্ধুর কাছে যান এবং তাঁকে বলেন এ কাজটি করা আইনসংগত হবে না বলে আমি মনে করি। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম এবং তাঁকে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য বলেছি। তিনি বলেছেন বিচারপতি চৌধুরী যদি এ কাজটিকে আইনসম্মত বলে মনে না করেন, তাহলে এটি না করাই ভালো হবে।’ তিনি নথিটি ইউসুফ আলীকে ফেরত দেন। ইউসুফ আলী নথিটি আমাকে দিয়ে বলেন যে এ ব্যাপারে আমাদের আর কিছু করার নেই। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে সচিবালয়ে একটি গুজব ছিল যে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমি প্রশ্ন তুললাম। এবং আমার কিছুই হলো না। আমি বুঝতে পারলাম ঠিক প্রশ্ন করার থাকলে প্রশ্ন করা যাবে কিন্তু অসৎ উদ্দেশ্যে ভুল প্রশ্ন করা হলে ক্ষমা করা হবে না।

কিছুদিন পর ইউসুফ আলী বঙ্গভবন থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এসে আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি বলেন যে বঙ্গবন্ধু তাকে ঢাকায় ইসলামি একাডেমি চালু করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। পাকিস্তানে ইসলামি একাডেমি প্রথম চালু করেছিলেন আইয়ুব খান। ইসলামি একাডেমির পরিচালক ছিলেন আবুল হাশিম। পাকিস্তান ছিল একটি ধর্মরাষ্ট্র, যার আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। ইসলামি ধর্মরাষ্ট্রে ইসলামি একাডেমি করাতে কোনো অসুবিধা নেই; কিন্তু একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ইসলামি একাডেমি চালু করা হলে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠতে পারে। আমি ইউসুফ আলীকে বললাম, আপনি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে। সেই রাষ্ট্রে ইসলামি একাডেমি করা কি যুক্তিসংগত হবে? আমি ইউসুফ আলীকে এ সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি নোট পাঠাতে অনুরোধ করি। ইউসুফ আলী চিন্তা করে বলেন, ‘আপনি আপনার বক্তব্য লিখিতভাবে দেন। আমি তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করব। আমি উৎসাহিত হয়ে এ সম্পর্কে বইপত্র জোগাড় করে নোট লিখতে শুরু করি। রাতে বাসায় বসে নোট লিখতাম। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে প্রায় ৫০ পৃষ্ঠার একটি হস্তলিখিত নোট তৈরি করি, যা টাইপ করলে হয়তো ২০ পৃষ্ঠার মতো হতো। আমি আমার নোটে ইসলামি একাডেমি পুনরায় স্থাপন করলে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সঙ্গে তা যে সাংঘর্ষিক হবে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বক্তব্য লিখি। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ সম্পর্কেও বক্তব্য উপস্থাপন করি। সবশেষে আমি যুক্তি দেখাই ইসলামি একাডেমি স্থাপন করলে তা রাষ্ট্রের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এর কারণ হলো ধর্মের প্রতিটি প্রশ্নেই মতবিরোধ রয়েছে। যদি ইসলামি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে প্রতিটি বিতর্কিত প্রশ্নে ইসলামি একাডেমির বক্তব্য রাষ্ট্রের জন্য চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। ধর্মের বিষয়ে সব ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে আমি লাহোরের কাদিয়ানি দাঙ্গা সম্পর্কে বিচারপতি মুনির কমিশনের তদন্ত রিপোর্টের উল্লেখ করি। বিচারপতি মুনির ইসলামের সংজ্ঞা সম্পর্কে ১৪০ জন আলেমকে প্রশ্ন করেছিলেন। ১৪০ জন আলেম ১৪০ ধরনের জবাব দিয়েছেন। কেউ কারও সঙ্গে একমত হননি। সুতরাং ইসলামি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করলে রাষ্ট্রের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। আমি নথি দাখিল করলে শিক্ষাসচিব এবং শিক্ষামন্ত্রী কোনো কিছু না লিখে শুধু স্বাক্ষর করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠান। এই ফাইল যাওয়ার পর প্রায় মাস তিনেক এ সম্বন্ধে আমরা আর কোনো সাড়াশব্দ পাইনি। তিন মাস পর আমার বিরাট নোটের নিচে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে লেখা ছোট একটি নির্দেশ পেলাম। তিনি লিখেছেন, ‘ইসলামি একাডেমি সম্বন্ধে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা পড়লাম। আলোচককে ধন্যবাদ। তবে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি হলো এখানে ইসলামি একাডেমির প্রয়োজন রয়েছে। তাই ইসলামি একাডেমি স্থাপনের জন্য ত্বরিত ব্যবস্থা নিন। আমার মনে হয় এ ঘটনাটি প্রধানমন্ত্রীর অফিসেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এ ঘটনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব মশিউর রহমান লিখেছেন :

ইসলামিক ফাউন্ডেশন সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হতে একটি নথি পাওয়া গেল। চল্লিশ-পঞ্চাশ পৃষ্ঠা দীর্ঘ নোটের মূল বক্তব্য অসাম্প্রদায়িক দেশে ধর্মবিষয়ক এরূপ প্রতিষ্ঠান যুক্তিহীন, অসাম্প্রদায়িক তত্ত্বের সাথে সংগতিহীন। বঙ্গবন্ধুর কাছে নথি উপস্থাপন করলে নথিটি রেখে দিতে বলেন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী কয়েকবার তাগাদা দেন। এক-দেড় মাস পরে বঙ্গবন্ধু নিম্নোক্ত মর্মে সিদ্ধান্ত দিলেন, এ দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দরকার আছে, থাকবে। আমাদের বোঝালেন, সাধারণ মোল্লা-মৌলভিদের আরবি ভাষা ও ধর্মশাস্ত্র জ্ঞানের ঘাটতি আছে, কিন্তু তাদের প্রভাব ব্যাপক। ধর্মান্ধতা দূর করতে ও ধর্ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান বিস্তারে ফাউন্ডেশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্যই গভীর।[৮]

ধর্মশাস্ত্র জ্ঞান প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা হতে পারে কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে তার সিদ্ধান্ত যে নির্ভুল, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই। বঙ্গবন্ধু শুধু ইসলামি একাডেমি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন; কিন্তু তার পরবর্তী শাসকেরা শাসনতন্ত্রে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়েছে। এই বিধান সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ বেশি সদস্যের অনুমোদন নিয়ে এখনো চালু রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ শুধু সাম্প্রদায়িকতার অনুপস্থিতি। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে অধিকাংশ মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার তৃতীয় স্মৃতি হলো সরকারি চাকরি থেকে আমার ইস্তফাদানের সময়ে তাঁর লিখিত বক্তব্য। ১৯৭৩ সালে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপকের পদে নিয়োগ পেয়ে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করি। এই পদত্যাগপত্র যখন তার কাছে যায়, তখন তিনি জানতে চান আমি কেন পদত্যাগ করছি। উত্তরে তাঁকে জানানো হয় সরকারি চাকরিতে আমি ক্লান্ত এবং আমি পড়াশোনা করতে চাই। উত্তরে তিনি নাকি বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে আরও ক্লান্ত হবে; সেখানে গিয়েও সে টিকে থাকতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রস্তাব করে যে আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে আমাকে লিয়েনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে দেওয়া যেতে পারে। নথিতে বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে লিখলেন :

 ১৫। অনুমোদন করা হল।

১৬। তবে তিন বৎসরের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। দেশ গড়ার কাজে তার বিশেষ ভূমিকা আছে।

–শেখ মুজিব।

তিন বছর পর ফিরে আসতে পারিনি, তবে সাত বছর পরে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সরকারে ফিরে এসেছিলাম। সরকারের বিশেষ ভূমিকা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হয়েছিল। আমি সরকারে ফিরে আসি এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সভাপতি, অর্থসচিব এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবের মতো পদে তিনটি সরকারের অধীনে গুরুদায়িত্ব পালন করি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা আমাকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে পদোন্নতি দিয়েছিলেন।

পাদটীকা

১. ওয়ালিউল ইসলাম, (প্রকাশিতব্য)। একাত্তরের ইতিকথা, পৃষ্ঠা-২০৫

২. সুলতান-উজ জামান খান, স্মৃতির সাতকাহন এক আমলার আত্মকথা, ২০০৭ (ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশ), পৃষ্ঠা-৩১৩।

৩. Md. Matiul Islam, Rebuilding the War-Devastated Financial Sector of Bangladesh. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রশাসন সান্নিধ্যের দুর্লভ স্মৃতি, 2021, (ঢাকা : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়)।

৪. এম এ হাকিম, সিভিল সার্ভিসে ৩২ বছর : স্মৃতি সম্ভার, ২০১২, (ঢাকা : প্রকাশক এম এ হাকিম), পৃষ্ঠা-১০৪।

৫. এম এ হাকিম, প্রাগুক্ত, ২০১২, পৃষ্ঠা-৭৩

৬. এম এ হাকিম, প্রাগুক্ত, ২০১২, পৃষ্ঠা-৭৪-৭৫

৭. এম এ হাকিম, প্রাগুক্ত, ২০১২, পৃষ্ঠা-৭৬-৭৭

৮. এ কে এম মশিউর রহমান, ২০২১, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও প্রশাসন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রশাসন, (ঢাকা : জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়), পৃষ্ঠা-১৫৩

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *