১০. ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে

১০.

ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে মামাকে একটু চিন্তিত দেখতে পেলাম। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার পরও মামা পরিষ্কার করে উত্তর দিল না। তখন জিজ্ঞেস করলাম, “রাত্রে বাইরে গিয়েছিলে কেন মামা?”

প্রথমে ঠিক বলতে চাইল না তারপর বলল, “বাইরে মানুষের পায়ের শব্দ শুনে দেখতে গিয়েছিলাম।”

“কাউকে দেখেছ?”

 ‘না।”

 “তোমার ভয় করে নাই?”

 “না। ভয় করবে কেন?

“আমার কাছে লাইসেন্স করা পিস্তল আছে। তুই আছিস সেজন্য একটু চিন্তা হয়।”

“আমার জন্য কোনো চিন্তা করো না মামা।”

মামা আমার দিকে তাকাল, কোনো কথা বলল না। আমি একবার ভাবলাম মামাকে সবকিছু বলে দিই কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বললাম না। ইউরেনিয়াম খনির খানিকটা মাটি নিয়ে এসে চারজন মিলে বলব। মাহবুব ডোরিন আর টনি কথা বলার সময় খুব করে থাকতে চাইছে।

আমি একটু পরে বের হয়ে গেলাম। বের হওয়ার আগে মামার কাছ থেকে চেয়ে গাইগার কাউন্টারটা নিলাম। সেটাকে আজকে হাতে না ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে ব্যাকপেকে ভরে নিয়েছি। রাতে মানুষের পায়ের শব্দ শোনা গেছে তাই আমি মাইক্রোবাসটার চারপাশে ঘুরে দেখলাম। একটা গাছের নিচে কয়েকটা সিগারেটের গোড়া পেলাম, বিদেশি সিগারেট। কেউ রাতে এখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়েছে। সিনেমায় দেখেছি ডিটেকটিভরা সিগারেটের গোড়া আঙুলের ছাপ বের করার জন্য ব্যবহার করে। আমিও গোড়াগুলো কাগজে মুড়ে নিয়ে নিলাম। হেঁটে হেঁটে নদীর তীরে গিয়ে দেখি এর মাঝে মাহবুব পৌঁছে গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, “নৌকাটা এনেছ?”

“হ্যাঁ।”

“কোথায়?”

‘নদীর অন্য মাথায় রেখে এসেছি, তাহলে বেশি দূর নৌকা বাইতে হবে না।”

“ভালো বুদ্ধি।”

আমি আর মাহবুব নদীর তীরে ইতস্তত হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে লাগলাম। মামা যখন পুরো ব্যাপারটা জানবে তখন মামা কী করবে সেটা নিয়ে কথা হলো। বিদেশিগুলো আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে কিনা সেটা নিয়েও কথা হলো।

ডোরিন আর টনির আসতে বেশ দেরী হলো। স্পিডবোটটা আগের মতো তাদেরকে নদীটার গোড়ায় নামিয়ে দিয়েছে। আমি দেখলাম তাদের দুজনের মুখ একটু গম্ভীর। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার আগেই ডোরিন বলল, মনি কাঞ্চন থেকে তাদের জানিয়েছে যে তাদের রিসোর্টে নাকি আজকের পর আর বুকিং নেই। আগে কখনো এরকম হয়নি তারা যতদিন ইচ্ছা থেকেছে। আমরা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম, আমরা তাদের গোপন ল্যাবরেটরিতে ঢুকে গেছি নিশ্চয়ই সেজন্য বদমাইশগুলো ডোরিনদের বুকিং ক্যান্সেল করে দিয়েছে।

টনি মুখ শক্ত করে বলল, “যাওয়ার আগে মনি কাঞ্চনে আগুন দিয়ে যাব।”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “গুড আইডিয়া তাহলে এটা আর মনি কাঞ্চন না থেকে ছাই ভস্ম হয়ে যাবে।”

ডোরিন হি হি করে হাসল, বলল, “রিসোর্ট ছাই ভস্ম নামটা খারাপ না।”

মাহবুব বলল, “দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল যাই।”

ডোরিন বলল, “দাঁড়াও দাঁড়াও। রওনা দেওয়ার আগে আমরা একটা সেলফি তুলে নিই।”

“সেলফি তুলবে? ক্যামেরা আছে?”

“আম্মুকে বলে তার মোবাইলটা নিয়ে এসেছি। ফিরে যাওয়ার সময় ফোন করার জন্য।”

আমরা নদীর তীরে চারজন দাঁড়ালাম। ডোরিন আমাদের চারজনের একটা সেলফি তুলল। প্রথমে স্বাভাবিক ভঙ্গী, তারপর দাঁত বের করে সবশেষে দুই আঙুল তুলে বিজয়ের ভি সাইন দেখিয়ে। বিজয়টা ঠিক কোথায় সেটা অবশ্য পরিষ্কার বোঝা গেল না।

নদীর তীর ধরে অনেকক্ষণ হেঁটে আমরা শেষ পর্যন্ত মাহবুবের নৌকাটা পেলাম। মাহবুব পানিতে নেমে নৌকাটাকে ঠেলে যতদূর সম্ভব তীরের কাছে নিয়ে এলো। আমরা জুতা খুলে পানিতে হেঁটে নৌকায় উঠে গেলাম।

মাহবুব লগি দিয়ে ঠেলে নৌকাটাকে সামনে নিতে থাকে। আমিও আরেকটা লগি দিয়ে মাহবুবকে সাহায্য করার চেষ্টা করলাম কিন্তু তাতে মাহবুবের কতোটুকু সাহায্য হলো ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটু পর। নৌকাটা নদীর একটু গভীরে যাওয়ার পর মাহবুব লগি রেখে বৈঠা তুলে নিল। সে হাল ধরল, আমরা তিনজন বৈঠা বাইতে লাগলাম, দেখতে দেখতে আমাদের নৌকা গুলির মতো ছুটতে লাগল। আমরা হেইয়া হো হেইয়া হো করে চিৎকার করতে করতে বৈঠা বাইছি। তার মাঝে ডোরিন একটু পর পর তার আম্মুর মোবাইলে ছবি তুলতে লাগল।

মাহবুব একসময় হাত তুলে আমাদের থামাল। বলল, আমরা ইউরেনিয়াম খনির কাছাকাছি চলে এসেছি। আসলেই এটা ইউরেনিয়াম খনি কিনা আমরা জানি না কিন্তু সবাই জায়গাটাকে ইউরেনিয়াম খনি বলছি।

আমরা সবাই মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম হাতের বামপাশে একটা বড় জায়গা কাটা তার দিয়ে ঘেরাও করা। এক পাশে বড় একটা সাইনবোর্ডে লেখা :

থ্রি স্টার সিমেন্ট ফ্যাক্টরির জন্য নির্ধারিত স্থান
প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত

আমি আমার ব্যাকপেক থেকে গাইগার কাউন্টারটা বের করে সেটা জায়গাটার দিকে মুখ করে ধরে অন করলাম গাইগার কাউন্টারের কটকট শব্দ তুলনামূলকভাবে বেশি কিন্তু খুব বেশি তা নয়।

মাহবুব বলল, “আমরা এখানে নামব না। এখানে কয়েকটা গার্ড ঘোরাঘুরি করছে। আরো ভেতরে যাই।”

আমি বললাম, “ঠিক আছে।”

 তারপর আবার সবাই মিলে বৈঠা বাইতে শুরু করলাম।

কিছুক্ষণের মাঝে একটা নির্জন জায়গায় পৌঁছালাম। এখানে নদীর তীরে বেশ কিছু ঝোঁপঝাড় আছে। কাঁটাতারের বেড়াটা নেই। আমরা নৌকা থামিয়ে নেমে যেতে পারব। আমি আবার গাইগার কাউন্টার বের করে পরীক্ষা করলাম। কটকট শব্দটা যথেষ্ট বেশি। সেটা হাতে নিয়ে আমি প্রথমে নৌকা থেকে নামলাম। আমার পিছু পিছু ডোরিন আর টনি এবং সবার শেষে মাহবুব নৌকা থেকে নেমে এলো।

আমি বললাম, “যদি গার্ড চলে আসে আমরা ভান করব যে আমরা জানতাম না এখানে ঢোকা নিষেধ। যদি আমাদের মাটি তুলতে না দেয় তাহলে সবাই জুতার ভেতরে মাটি ভরে নিয়ে যাবো।”

টনি অবাক হয়ে বলল, “জুতার ভিতরে?”

“হ্যাঁ, পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ে যতটুকু পার জুতার মাঝে ভরবে।”

আমরা তখন খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গী করে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে যেতে থাকি এবং হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমার গাইগার কাউন্টারটা আগের মতো অনেক বেশি কট কট শব্দ করতে শুরু করেছে। জায়গাটা সত্যিই রেডিও একটিভ মাটি দিয়ে বোঝাই।

আমি আশে পাশে তাকিয়ে ব্যাকপেকটা নামিয়ে হাতের খুরপিটা দিয়ে মাটি খুঁড়ে ব্যাগে ভরতে থাকলাম। ডোরিন টনি আর মাহবুব আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল যেন কেউ আমাকে দেখতে না পায়।

আমি যখন মাটি তুলে আমার ব্যাকপেকটা প্রায় ভরে ফেলেছি তখন হঠাৎ দেখলাম একজন গার্ড একটা বন্দুক হাতে হাত নাড়তে নাড়তে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসছে।

ডোরিন সাথে সাথে তার ক্যামেরাটা বের করে সেলফি তোলার ভান করতে লাগল। আমি দ্রুত কয়েকটা আগাছা ধরনের গাছ টেনে তুলে ব্যাকপেকে ভরে ফেললাম। মাটি কেন নিয়েছি জানতে চাইলে বলব মাটি নয়, গাছের চারা নিচ্ছি। এবং গাছের চারার সাথে একটু মাটি না থাকলে গাছের চারা বাঁচে না।

গার্ডটা হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের কাছে এসে তার বন্দুকটা রীতিমতো আমাদের দিকে তাক করে ধমক দিয়ে বলল, “তোমরা কে? এখানে কী করতে এসেছ?”

ডোরিন মধুর একটা ভঙ্গী করে হাসার চেষ্টা করে বলল, “কেন? আমরা বেড়াতে এসেছি! কী সুন্দর এই জায়গাটা।”

গার্ড গলার স্বর আরো উঁচু করে বলল, “এটা কী বেড়ানোর জায়গা? দেখো নাই এখানে প্রবেশ নিষেধ?”

“প্রবেশ নিষেধ? ডোরিন যেন রীতিমতো আকাশ থেকে পড়ল। আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকালো, রীতিমতো অনবদ্য অভিনয়, বলল, শুনেছ? এখানে নাকি প্রবেশ নিষেধ?”

আমি ব্যাকপেকটা ঘাড়ে নিয়ে বললাম, “কোথাও তো লেখা নাই প্রবেশ নিষেধ। বুঝব কেমন করে?”

মানুষটা হাত নেড়ে বলল, “এতো বড় সাইন বোর্ড, দেখ নাই?”

“সাইনবোর্ডে প্রবেশ নিষেধ লেখা নাই।”

 “আছে।”

 “নাই। লেখা আছে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত।”

 “একই কথা।”

মাহবুব বলল, “এক কথা না। প্রবেশ অধিকার সংরক্ষিত মানে কেউ কেউ আসতে পারবে।”

ডোরিন আবার মধুর ভঙ্গীতে হাসার ভঙ্গী করে বলল, “মনে করেন আমরা হচ্ছি সেই কেউ কেউ।”

গার্ড মানুষটা কী করবে বুঝতে না পেরে ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার ব্যাগে কী ঢুকাচ্ছিলে?”

“কিছু ঢুকাচ্ছিলাম না।”

“আমি দেখেছি তুমি কী যেন ঢুকাচ্ছ।”

আমি আবার ব্যাগের দিকে তাকালাম, তারপর হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গী করে বললাম, “ও আচ্ছা! এগুলো! কয়েকটা গাছের চারা নিয়েছি। এগুলো হচ্ছে রাজাকার গাছের চারা।”

“কিসের চারা?”

“রাজাকার গাছ। সেভেন্টি ওয়ানে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, কোনো কাজে লাগে না শুধু কাটা। সেইজন্য বলে রাজাকার গাছ।”

“কী করবে এই গাছ দিয়ে?”

“স্কুলে দেখাব। সায়েন্স প্রজেক্ট।”

আলাপটা কোনদিকে যাবে বোঝা যাচ্ছিল না তাই ডোরিন তার মতো করে শেষ করার চেষ্টা করল, বলল, “আংকেল, আপনার সাথে একটা পিক তুলতে পারি?” ছবিকে কখন পিক বলতে হয় ডোরিন সেটা খুব ভালো করে জানে।

মানুষটা থতমত খেয়ে বলল, “আমার সাথে? পিক?”

“হ্যাঁ। আপনি বন্দুকটা এইম করে ধরবেন।”

“এইটা বন্দুক না। এইটাকে বলে রাইফেল।”

“ও আচ্ছা! আপনি রাইফেলটা এইম করে ধরবেন, আমরা দুই পাশে দাঁড়াব।”

গার্ড মানুষটা ছবি তোলার কথা শুনে মনে হয় একটু নরম হয়ে গেল। বলল, “ঠিক আছে। তুলতে চাইলে তুলো। তারপর তাড়াতাড়ি চলে যাও। বড় স্যার দেখলে অনেক ঝামেলা হতে পারে।”

কাজেই বড় স্যার দেখার আগেই আমরা কয়েকটা ছবি তুলে নৌকায় ফিরে এলাম। নৌকাটা মাঝ নদীতে নেওয়ার পর আমি গাইগার কাউন্টারটা ব্যাকপেক বোঝাই মাটির কাছে আনার সাথে সাথে সেটা বিকট স্বরে কট কট শব্দ করতে থাকে। আমি দাঁত বের করে বললাম, “মামা আজকে কী অবাক হবে আর কী খুশি হবে চিন্তা করতে পার?”

সবাই স্বীকার করল তারা সেটা চিন্তা করতে পারে না।

দূর থেকে মামার মাইক্রোবাসটা দেখেই আমার বুকটা কেমন জানি ছাৎ করে উঠল। ঠিক কেন বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আমি নিজেও জানি না। ড্রাইভিং সীটের একটা দরজা খোলা ছিল এছাড়া আর কিছুই অস্বাভাবিক ছিল না।

আমি মাইক্রোবাসটার কাছে গিয়ে মামাকে ডাকলাম, “মামা।”

কেউ আমার কথার উত্তর দিল না। আমি আবার ডাকলাম এবারেও কেউ আমার কথার উত্তর দিল না। আমার কাছে মাইক্রোবাসের একটা চাবি তাকে, আমি সেটা বের করে মাইক্রোবাসের পিছনের দরজা খুলে ভিতরে উঁকি দিলাম। ভিতরে সবকিছু এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কিন্তু মামার কোনো চিহ্ন নাই। মামার এক পাটি জুতা শুধু পড়ে আছে। এক পাটি জুতার মতো ভয়ংকর আর কিছু হতে পারে না। এক পাটি জুতা দেখলেই বুকটা কেমন জানি ধ্বক করে উঠে। কিছু একটা অস্বাভাবিক না হলে কখনোই এক পাটি জুতা পড়ে থাকে না।

আমি আবার গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, “মামা। মামা।”

কেউ উত্তর দিল না, উত্তর দেবে আমি সেটা আশাও করি নাই, ভয়ে আমার বুকটা হিম হয়ে গেল।

মাহবুব জিজ্ঞেস করল, “কোথায়? তোমার মামা কোথায়?”

আমি শুকনো গলায় বললাম, “মনে হয় ওই বদমাইশগুলো ধরে নিয়ে গেছে।”

ডোরিন অবাক হয়ে বলল, “ধরে নিয়ে গেছে? কিডন্যাপ?”

“মনে হয়। রাত্রি বেলা এরা মাইক্রোবাসটার চারপাশে হাঁটাহাঁটি করছিল।”

“সর্বনাশ! এখন কী হবে?”

টনি জিজ্ঞেস করল, “ধরে কোথায় নিয়ে গেছে?”

“নিশ্চয়ই মনি কাঞ্চনের নিচতলায়। গোপন ল্যাবরেটরিতে।”

“কিন্তু সেইটা তো আর গোপন না, আমরা তো সেইটার কথা জেনে গেছি।”

আমি ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিলাম না। অনেক কষ্টে মাথা ঠান্ডা করে বললাম, “আমাদের এখন সেই গোপন ল্যাবরেটরিতে গিয়ে খুঁজতে হবে। মামাকে খুঁজে বের করতে হবে।”

ডোরিন মাথা নাড়ল, বলল, “না না। আমাদের খুঁজতে হবে কেন? পুলিশ গিয়ে খুঁজবে। আমরা এক্ষুণি আমার আব্বুর কাছে গিয়ে সব কিছু বলব। আব্বু তখন পুলিশকে ফোন করে দিবে। পুলিশ এসে খুঁজবে।”

মাহবুব মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ আমাদের ছোটদের কথা কেউ শুনবে না। একজন বড় মানুষকে কথা বলতে হবে।”

ডোরিন বলল, “আমি এক্ষুণি যাচ্ছি। চল সবাই।”

আমি বললাম, “আমি এখানে থাকি। যদি মামা হঠাৎ চলে আসে।”

মাহবুব বলল, “টোপনের একা থাকা ঠিক হবে না, আমি টোপনের সাথে থাকি।”

ডোরিন বলল, “ঠিক আছে। তাহলে আমি আর টনি যাচ্ছি। তুমি কোনো চিন্তা করো না টোপন। টনি আর আমরা যাই।”

আমি বললাম, “শুধু একটা জিনিস।”

“কী”

“ইউরেনিয়ামের খনির কথাটা সোজাসুজি বলে দিও না।”

“তাহলে কী বলব।”

“জানি না। আমার মাথা কাজ করছে না, চিন্তা করে কিছু একটা বলে দিও।”

“ঠিক আছে।”

 “আরেকটা ব্যাপার।”

 ‘কী?”

“আমরা যে মনি কাঞ্চনের পিছনে গোপন সিঁড়িটা পেয়েছি সেটার কথাও বলো না। এটা আমাদের কাছে গোপন থাকুক। যদি কাজে লাগে।”

“ঠিক আছে।”

 “যাও তাহলে। ডোরিন তোমার আব্বুকে ভালো করে বুঝিও।”

“বোঝাব। টোপন, তুমি চিন্তা করো না।”

ডোরিন আর টনি চলে যাবার পর আমি আর মাহবুব একা একা কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তারপর মাইক্রোবাসের চারপাশটা ভালো করে খুঁজে দেখলাম। মনে হয় মাটিতে একটু ধস্তাধস্তির চিহ্ন আছে। কাল রাতে যে রকম সিগারেটের গোড়া পেয়েছিলাম, আজকেও সেরকম কয়েকটা সিগারেটের গোড়া দেখলাম, একটু দূরে মনে হলো গাড়ির টায়ারের দাগও আছে।

আমরা আবার মাইক্রোবাসে ফিরে এলাম। ভেতরে যেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলো একটু গুছিয়ে রাখলাম। তখন মনে হলো শুধু শুধু বসে না থেকে আমরা যে মাটিটা এনেছি সেটা গামা রে স্পেকট্রোমিটারে বসিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করি। মামা যখন শিখিয়ে দিয়েছিল তখন পুরো ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। আমার ডাইরিতেও লিখে রেখেছিলাম। নিজে নিজে এটা করব কখনো ভাবিনি, তাহলে আরেকটু ভালো করে শিখে নিতাম।

আমি আমার ব্যাকপেক বোঝাই মাটিটা গামা রে স্পেকট্রোমিটারে সোডিয়াম আয়োডাইড ক্রিস্টালের চারপাশের খালি জায়গাটাতে ঢেলে দিলাম। ডাইরিতে লেখা আছে এর পরে ডিসপ্লেটা অন করতে হবে। আমি ডিসপ্লে অন করতেই চ্যানেল নম্বর আর কাউন্টস দেখা যেতে লাগল। আমি এগুলো শুধু তোতা পাখির মতো মুখস্ত করে রেখেছি কোনটার কী অর্থ কিন্তু জানি না। এরপর ফটো মাল্টিপ্লায়ারের হাই ভোল্টেজ আস্তে আস্তে বাড়াতে লাগলাম সাথে সাথে কাউন্ট দেখা যেতে লাগল। আমি আস্তে আস্তে ভোল্টেজ বাড়িয়ে যতটুকু করা দরকার ততটুকু করে দিলাম এবং অবাক হয়ে দেখলাম কুটকুট করে কাউন্ট বাড়তে থাকে এবং বেশ কয়েকটা পিক বের হয়ে আসছে। মামা যখন আমাকে শিখিয়েছিল তখন অনেকক্ষণ কাউন্ট নেওয়ার পর একটুখানি করে কাউন্ট জমা হতো। এখন কতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে।

মাহবুব আমার পাশে বসে আমি কী করছি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কী?”

“আমি জানি না।”

 “তাহলে তুমি কী করছ?”।

“সেটাও জানি না। আমি গাড়ির দেওয়ালে স্কচ টেপ দিয়ে লাগানো একটা কাগজকে দেখিয়ে বললাম, “এই কাগজটাতে ইউরেনিয়াম খনি থেকে কী রকম স্পেকট্রাম হওয়ার কথা সেটা দেখানো আছে। আমাদের সিগন্যালটা যদি এরকম হয় তাহলে বুঝতে হবে এখানেও ইউরেনিয়াম আছে।”

মাহবুব কাগজে প্রিন্ট করা সিগন্যাল আর আমাদের ডিসপ্লের সিগন্যালটা মিলিয়ে দেখল তারপর মাথা নেড়ে বলল, “মিল আছে।”

“ক্যালিব্রেশান করা হয় নাই। ক্যালিব্রেশান করলে আরো মিল হবে।”

“ক্যালিব্রেশান মানে কী?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “জানি না।”

মাহবুব অবাক হয়ে বলল, “জান না তাহলে বলছ কেমন করে?”

“সেইটাও জানি না।”

মাহবুব আর কিছু বলল না। আমি বললাম, “এখন কয়েক ঘন্টা ডাটা নিলে স্পেকট্রামটা সুন্দর হবে।”

কাজেই আমরা কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে থাকলাম।

ধীরে ধীরে দুপুর হয়ে গেল, এখনো মামার কোনো দেখা নেই। ডোরিন তার আব্বুকে ঠিকমতো বুঝিয়েছে কিনা কে জানে। তার আব্বু কী পুলিশকে ডাকিয়েছে? পুলিশ কী এসে নিচে ল্যাবরেটরিতে গিয়েছে? মামা কী সেখানে আছে? যদি মামাকে খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে কী হবে? বাসায় ফোন করে আব্বু আম্মুকে জানাতে হবে। কী জানাব? আব্বু আম্মুকে কী বলব আমি?”

দুপুর বেলার দিকে মাহবুব বলল, “আমাদের এখন কিছু খাওয়া দরকার।”

আমি বললাম, “ঠিকই বলেছ। খিদে লেগেছে। মানুষের শরীর খুবই আশ্চর্য, এতো বিপদের মাঝেও খিদে পেয়ে যাচ্ছে। আমি খুঁজে খুঁজে কয়েকটা নুডলসের প্যাকেট বের করলাম। একটা বাটির মাঝে পানি ঢেলে সেখানে নুডলসগুলো ভেঙে দিলাম, দুটি ডিমও ভেঙে সেখানে দিলাম, তারপর সবকিছু মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ঢুকিয়ে সেটা পাঁচ মিনিটের জন্য চালিয়ে দিলাম। পাঁচ মিনিট পর মাইক্রোওয়েভ ওভেন খুলে দেখলাম নুডলসগুলো এখনো সিদ্ধ হয়নি। তখন সেগুলো আরও পাঁচ মিনিটের জন্য দিয়ে দিলাম। এভাবে বেশ কয়েকবার চালানোর পর মনে হলো নুডলসগুলো সিদ্ধ হয়েছে। তবে দেখতে খুবই ভয়ংকর।

তখন আমি আর মাহবুব দুইটা চা চামচ নিয়ে নুডলসগুলো খেতে শুরু। করলাম। পুরো জিনিসটা দেখতে যত ভয়ংকর হয়েছে খেতে কিন্তু তত খারাপ হয়নি। কিংবা কে জানে হয়তো বেশি খিদে লাগলে সবকিছুই খেতে ভালো লাগে। খাওয়া শেষ করার পর আমরা বাটি এবং চামচ ধুয়ে রেখে দিয়ে আবার অপেক্ষা করতে থাকি।

গামা রে স্পেকট্রোমিটারে সিগন্যালগুলো আস্তে আস্তে বেড়েছে। বেশ পরিষ্কার কয়েকটা পিক দেখা যাচ্ছে। মামা দেখলেই এই পিকগুলো চিনে ফেলতো। আমি কিছুই চিনলাম না। শুধু বুঝতে পারলাম সিগন্যালটা দেখতে গাড়ির দেওয়ালের কাগজের প্রিন্টটার মতো। সেটাই অনেক বড় ব্যাপার।

বাইরে যখন প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে তখন আমি কাউন্ট বন্ধ করে স্পেকট্রোমিটার একটা প্রিন্ট নিয়ে নিলাম। খুবই সুন্দর প্রিন্ট। মামা আমার কাজ দেখলে খুশি হতো। কিন্তু মামা নেই। আমি প্রিন্টটা আমার ডাইরিতে স্কচটেপ দিয়ে লাগিয়ে নিলাম। কোথায় আছে কে জানে। বেঁচে আছে কিনা সেটাই বা কে জানে। চিন্তা করেই আমার শরীর খারাপ লাগতে থাকে। মনে হলো হাউ মাউ করে কাঁদি।

ঠিক এরকম সময় আমি একটা গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পেলাম। একটু পরে গাড়ির হেড লাইটের আলোতে জায়গাটা আলোকিত হয়ে উঠল।

আমি আর মাহবুব মাইক্রোবাস থেকে নেমে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। একটু পরে দেখলাম একটা গাড়ি এসে থামল আর গাড়ি থেকে বেশ কয়েকজন মানুষ নামল। কাছে আসার পর চিনতে পারলাম মানুষগুলো পুলিশ। পিছনে আমরা ডোরিনের আলুকে দেখতে পেলাম। আমি ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার মামাকে পাওয়া গেছে?

ডোরিনের আব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “না।”

 “ভালো করে খুঁজে দেখেছে?”

 “কোথায় ভালো করে খুঁজে দেখবে?”

“কেন? ডোরিন বলেনি? মনি কাঞ্চনের নিচে একটা গোপন ল্যাবরেটরি আছে, সেখানে?”

“গোপন কেন হবে? এটা মনি কাঞ্চনের বেসমেন্ট। খাবার স্টোরেজের জায়গা, কোয়ালিটি কন্ট্রোলের ল্যাব।”

আমি প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম কিন্তু ঠিক তখন পুলিশদের একজন যে মনে হয় তাদের ভেতরকার অফিসার বলল, “আমরা দেখেছি। কোনো মানুষকে কেউ আটকে রাখে নাই। কে আটকে রাখবে? “এখানে তো সন্ত্রাসী থাকে না, সম্মানী মানুষজন থাকে। বিদেশ থেকে এসেছে সব বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার।”

আমি প্রতিবাদ করে বললাম, “কিন্তু কিন্তু”।

পুলিশ অফিসারটা আমাকে কথা বলতে দিল না, বলল, “কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া সার্চ করেছি এখন বিপদে না পড়ে যাই। আমরা করতে চাচ্ছিলাম না, কিন্তু স্যারের মেয়ে আর ছেলে এতো চেঁচামেচি শুরু করল যে আমাদের সার্চ করতেই হলো। খুবই লজ্জা পেয়েছি আমরা।”

আমার প্রায় চোখে পানি এসে যাচ্ছিল, ভাঙা গলায় বললাম, “মামা আমার মামা তাহলে কোথায়?”

 “কোনো এক জায়গায় গিয়েছেন আবার চলে আসবেন।” পুলিশ অফিসার হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে বলল, “তোমার মামা আসার পর আমাদের তার সাথে কথা বলতে হবে। আমাদের কাছে রিপোর্ট এসেছে এখানে নাকি ইয়াবা তৈরির গোপন ফ্যাক্টরি আছে”

আমি অবাক হয়ে মানুষটা দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী বলছে এই মানুষটা? আমার মামা ইয়াবা তৈরি করছে? হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারলাম এই পুলিশগুলোকে আসলে বিদেশি মানুষগুলো টাকা দিয়ে কিনে ফেলেছে। এরা আমার মামাকে খুঁজে বের করবে না। উল্টো দরকার হলে ‘ মামাকে ক্রসফায়ার করে ফেলবে। মামার ল্যাবরেটরিতে ইয়াবা প্যাকেট ফেলে রেখে মামাকে বিপদে ফেলে দেবে। মামাকে আমার খুঁজে বের করতে হবে।

পুলিশ অফিসার বলল, “যাই হোক, আমরা এসেছি তোমার মামার গাড়িটা নিয়ে যাবার জন্য। আজ রাতের মতো এটাকে মনি কাঞ্চনের পার্কিং লটে রাখব। কাল লোকাল থানায় নিয়ে যেতে হবে সার্চ করার জন্য।”

ডোরিনের আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আজ রাতটা আমাদের সাথে থাকো। তোমার বাসায় ফোন করে দেব, কাল ভোরে তোমার আব্বু আম্মু এসে তোমাকে নিয়ে যাবেন।”

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “না। আমি আমার মাইক্রোবাসেই থাকব। আমার মামা এসে আমাকে না পেলে চিন্তা করবে। মাইক্রোবাসে আমি থাকি। এখানে থাকার সব ব্যবস্থা আছে।”

পুলিশ অফিসার বলল, “একা একা কীভাবে থাকবে?”

মাহবুব পাশে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল, সে হঠাৎ করে বলল, “আমি থাকব টোপেনের সাথে।”

পুলিশ অফিসার ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি কে? তোমার বাড়ি কোথায়?”

“আমার বাড়ি এখানেই।”

 “তুমি এখানে থাকলে তোমার বাসায় চিন্তা করবে না।”

 “আমি বাসায় ফোন করে বলে দেব। তাহলে চিন্তা করবে না।”

পুলিশ অফিসার কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “ঠিক আছে। তোমার ইচ্ছা। কিন্তু আমরা এই গাড়িটা এই জঙ্গল থেকে সরিয়ে নিচ্ছি। আজ রাতের মতো এটা থাকবে মনি কাঞ্চনের পার্কিং লটে।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “ঠিক আছে।”

পুলিশের একজন ড্রাইভার যখন মামার মাইক্রোবাসটা ড্রাইভ করে মনি কাঞ্চনে নিয়ে যেতে থাকে তখন আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি আমি কী করব। আমার সাইন্টিস্ট মামাকে আর কেউ খুঁজে বের করবে না। আমাকেই খুঁজে বের করতে হবে।

আমিই মামাকে খুঁজে বের করব। যেভাবে হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *