০১. শব্দটা হচ্ছে সায়েন্টিস্ট

আমার সাইন্টিস মামা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

০১.

আমার মামা হচ্ছেন একজন সাইন্টিস-জানি, জানি শব্দটা সাইন্টিস না, শব্দটা হচ্ছে সায়েন্টিস্ট-বাংলায় বৈজ্ঞানিক। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বললে কেউ তার মানে বুঝতে পারে না, সায়েন্টিস্ট বললে সবাই ঘাবড়ে যায়। শর্টকাটে সাইন্টিস বললে সবাই বুঝতে পারে, মাথা নাড়ে, চোখ বড় বড় করে বলে, ‘ও, আচ্ছা! তাই নাকি। ইন্টারেস্টিং।’ সেই জন্যে কারো কাছে মামার পরিচয় দিতে হলে আমি সব সময় বলি সাইন্টিস।

যাই হোক, যারা কখনো সাইন্টিস কিংবা সায়েন্টিস্ট দেখে নাই তাদের কাছে মনে হতে পারে তারা হয় বুড়ো, তাদের মাথায় থাকে বড় বড় এলোমেলো পাকা চুল এবং বড় বড় গোঁফ। তাদের নাকের উপর থাকে গোল গোল চশমা, তারা হয় খুবই ভুললামনের এবং তাদের পরনে থাকে ভুসভুসে ময়লা কাপড়। শার্টের বোতাম লাগায় উল্টাপাল্টাভাবে, জুতোর ফিতা থাকে ভোলা এবং দুই পায়ের মোজা হয় দুই রংয়ের। কিন্তু আমার মামা মোটেও সেই রকম না, আমার মামার বয়স কম, গোঁফ নাই, স্টাইলের চুল এবং সব সময় জিন্স আর টি শার্ট পরে থাকে। তার পায়ে দামি কেডস। মামা মোটেও ভুলো মনের মানুষ না, তার সবকিছু মনে থাকে-এক কথায় একেবারে টনটনে ব্রেন। মামা হাসিখুশি মানুষ, সবাইকে নিয়ে মজা করে, গল্প করে, সখ করে খায়। মামার সমস্যা একটাই সেটা হচ্ছে বিজ্ঞান নিয়ে কিছু একটা প্রশ্ন করলেই মামা তখন নিজেকে সামলাতে পারে না। সেটা নিয়ে কথা বলতে বলতে কান ঝালাপালা করে দেয়। সেইজন্যে আমরা কখনো মামাকে বিজ্ঞান নিয়ে কোনো প্রশ্ন করি না, ভুলেও জিজ্ঞেস করি না মামা কী করে। তার কথাবার্তা থেকে বোঝার চেষ্টা করি মামা কী রকম সাইন্টিস বা সায়েন্টিস্ট।

কিন্তু কিছু সায়েন্টিস্ট আছে তারা ল্যাবরেটরির অন্ধকার ঘরের ভিতর কোনো একটা যন্ত্রের পিছনে পড়ে থাকে। দিনের পর দিন রাতের পর রাত কুঁজো হয়ে তারা সেই যন্ত্র নিয়ে কাজ করে। কোনো কোনো সায়েন্টিস্ট একটা কম্পিউটারের পিছনে বসে থাকে, রাগী রাগী চেহারা নিয়ে ভুরু কুচকে কম্পিউটারের মনিটরের ছোট ছোট বিন্দি বিন্দি লেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। কী দেখে তারাই জানে। আবার কোনো কোনো সায়েন্টিস্ট (কিংবা সাইন্টিস!) কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে বসে থাকে, কাগজে এক লাইন লিখে তারপর পেন্সিলের গোড়া চাবাতে থাকে, চাবাতে চাবাতে মাঝে মাঝে পেন্সিলের অর্ধেক খেয়েই ফেলে!

কিন্তু আমার মামা সম্পূর্ণ অন্যরকম সাইন্টিস (কিংবা সায়েন্টিস্ট!)। মামা একটা প্রজেক্ট থেকে বেশ কিছু টাকা পেয়েছে (প্রজেক্ট বিষয়টা কী, সেটা থেকে কেমন করে একজন টাকা পায় আমি সেটা জানি না। কাজকর্ম না করে সবাই প্রজেক্ট কেন করে না, টাকা কেন পায় না আমি সেটাও জানি না।) মামা কত টাকা পেয়েছে সেটা জিজ্ঞেস করলে মামা বলে অনেক টাকা (অনেক টাকা মানে কতো টাকা সেটাও আমি জানি না, মামা সেটা আমাদের পরিষ্কার করে কিছু বলে না।) সেই টাকা দিয়ে প্রথমে মামা বড় একটা মাইক্রোবাস কিনেছে, এর ভিতরে পনেরোজন আরাম করে বসতে পারে। রিকন্ডিশনড না, নতুন মাইক্রোবাস। কিন্তু মামা সেই মাইক্রোবাসে পনেরোজনকে কোনোদিন বসানোর চেষ্টা না করে সামনের দুইটা সিট রেখে পিছনের সব সিট খুলে ফেলে দিয়েছে। (আসলেই ফেলে দিয়েছে, ফেলে না দিয়ে আমাদের দিয়ে দিলে আমরা সেগুলো দিয়ে খেলতে পারতাম!) তখন মাইক্রোবাসের পিছনে যে একটা ঘরের মতো খালি জায়গা হয়েছে, সেখানে একটা টেবিল আর একটা ছোট বাথরুম ফিট করেছে। দেওয়ালে একটা ফোল্ডিং বিছানা রেখেছে, টান দিলেই ঘুমানোর জায়গা হয়ে যায়। গাড়ির দেওয়ালে একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন ফিট করেছে। গাড়ির বাকি জায়গায় অনেক রকম যন্ত্রপাতি, সেগুলো কী আমি জানি না। দেখে মনে হয় একটা সাইন্স ফিকশনের সিনেমার দৃশ্য। বসার জন্য ছোট ছোট চেয়ার আছে সেই চেয়ারে বসে মামা সেই সাইন্স ফিকশনের যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করতে পারে। যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য ইলেকট্রিসিটি লাগে, সেই ইলেকট্রিসিটির জন্য অনেকগুলো বড় বড় ব্যাটারি আছে, সেই ব্যাটারি চার্জ করার জন্য ছোট একটা জেনারেটর (সেই জেনারেটর যখন চালানো হয় তখন বিকট ভট ভট শব্দ হয়, এটা ছাড়া অন্য সব যন্ত্রপাতি নিঃশব্দ!) তবে মামা যখন কাজ করে তখন বড় বড় ব্যাটারির ইলেকট্রিসিটি দিয়ে কাজ করে তাই জেনারেটরের শব্দ শুনতে হয় না।

আমি জানি, যারা এইটুকু শুনেছে তারা মনে মনে ভাবছে, বাহ! কী অসাধারণ। কিন্তু আসল জিনিসটাই এখনো বলাই হয় নাই। আমার মামা সেই মাইক্রোবাসটা নিয়ে সারা দেশে ঘুরে বেড়ায়। মামার কোনো ড্রাইভার নাই, মামা নিজেই গাড়ি চালায়। মামা গাড়িতে থাকে, গাড়িতে ঘুমায়, গাড়িতে রান্না করে, গাড়িতে খায়। নির্জন কোনো নদীর তীরে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে নেমে পড়ে, সেগুলো নিয়ে নদীর তীরে বালুর মাঝে বসিয়ে কী কী জানি করে। মাঝে মাঝে নদীর তীরে গর্ত করে সেখান থেকে বালু তুলে এনে গাড়িতে বসে বসে কী যেন পরীক্ষা করে। আমরা সেটা জানি না। ভয়ে ভয়ে এক দুইবার মামাকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি মামা ঠিক করে বলে না। বিজ্ঞানের অন্য যে কোনো জিনিস জিজ্ঞেস করলে কথা বলতে বলতে মাথা খারাপ করে দেবে সেই জন্যে আমরা ভয়ের চোটে মামাকে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করি না! দেশের নানান জায়গা ঘুরে ঘুরে মামা মাঝে মাঝে মানুষজনের মাঝে ফিরে আসে তখন মামার সাথে আমাদের দেখা হয়। তখন মামা কোথায় কোথায় গিয়েছে, কোথায় কোথায় থেকেছে সেগুলো নিয়ে গল্প করে। যন্ত্রপাতি নিয়ে কী করছে সেইটাও মাঝে মাঝে বলার চেষ্টা করে কিন্তু আমরা সেটা বুঝি না বলে শুনতে চাই না। অন্য কিছু নিয়ে আলাপ শুরু করে দিই!

মামা যখন আমাদের বাসায় আসে তখন আমাদের আম্মু ভালো ভালো খাবার রান্না করেন। পাহাড়ে, নদীতে, জঙ্গলে মামা ঠিক করে খেতে পারে না তাই মামা খুব সখ করে কয়েকদিন খায়। রাত জেগে তার কম্পিউটারে কাজ করে তারপর হতাশার মতো করে মাথা নাড়ে। মামার ভাব-ভঙ্গী দেখে মনে হয় মামা কিছু একটা সারা দেশে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেটা পাচ্ছে না! মনে হয় গুপ্তধনের মতো কিছু একটা হবে কিন্তু গুপ্তধন খোঁজার জন্য কী আর এরকম সায়েন্স ফিকশানের যন্ত্রপাতি লাগে? সিনেমায় দেখেছি গুপ্তধন খোঁজার জন্য দরকার শুধু একটা ম্যাপ আর একটা পুরানা আমলের কম্পাস!

মামা শেষবার যখন এসেছে তখন একদিন ডাইনিং টেবিলে বসে বসে আমার আম্মু আর আব্বুর সাথে কথা বলছিল। আমরা ছোট বলে বড়দের কথা বলার সময় সেখানে থাকার নিয়ম নাই তাই আমি কাছাকাছি একটা সোফায় বসে গোপনে তাদের কথা শোনার চেষ্টা করছিলাম। আমার হাতে একটা বই, ভান করছি বই পড়ছি, আসলে পড়ছি না। বড়রা যখন কথা বলে তখন তার মাঝে অনেক ইন্টারেস্টিং কথা থাকে। অনেক সময় তারা আমাদের অন্য আত্মীয়স্বজন নিয়ে কূটনামি করে, খারাপ খারাপ কথা বলে, শুনতে বেশ মজা লাগে। (আমরা নিজেরা যদি অন্যদের নিয়ে খারাপ কথা বলি তখন কিন্তু তারা আমাদের বকাবকি করে।)

সোফায় বসে শুনলাম মামা বলছে, “বুঝলে আপা আর দুলাভাই, শেষবার যখন গিয়েছি একটা নদীর তীরে ক্যাম্প করে আছি, পূর্ণিমার রাত আকাশে একটা ইয়া বড় চাঁদ উঠেছে, জোছনায় চারিদিক থই থই করছে। একটা মানুষ নাই, শুধু দূর থেকে মাঝে মাঝে শিয়াল ডাকছে। আমি আমার কাউন্টারের পাশে বসে আছি, কুয়াশায় যেন ভিজে না যায় সেজন্য একটা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছি। হঠাৎ শুনি পায়ের শব্দ। আমি চমকে উঠলাম, ভাবলাম এতো রাতে কে যায়? তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে একা একা হেঁটে হেঁটে নদীর দিকে যাচ্ছে। নদীর তীরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, বাতাসে চুল উড়ছে, শাড়ীর আঁচল উড়ছে জোছনার আলোতে মনে হচ্ছে একটা অশরীরি প্রাণী! আকাশ থেকে নেমে আসা পরী!”

আম্মু বললেন, “সর্বনাশ! ভয় লাগে নাই তোর?”

মামা বলল, “ভয়? ভয় কেন লাগবে?”

 “জীন ভূত কিছু যদি হয়।”

মামা হাসল, বলল, “না আপা! জীন ভূতে আমার কোনো ভয় নাই। একটা যদি পেয়ে যেতাম, ধরে বোতলে ভরে নিয়ে আসতাম এক ধাক্কায় ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি আর লাইফ সাইন্সে এক সাথে তিনটা নোবেল প্রাইজ।”

আব্বু বললেন, “তারপর কী করল সেই মেয়ে।”

 “নদীর উঁচু তীর থেকে পানিতে ঝাঁপ দিল!”

আব্বু চমকে উঠলেন, “পানিতে ঝাঁপ দিল? সুইসাইড?”

মামা বলল, “প্রথমে আমিও তাই ভেবেছিলাম। ছুটে দিয়ে মেয়েটাকে পানি থেকে টেনে তুলব কি না চিন্তা করছিলাম, তখন শুনলাম মেয়েটা গান। গাইছে।”

“গান গাইছে?”

“হ্যাঁ। গভীর রাতে কনকনে ঠান্ডা পানিতে একটা মেয়ে নদীতে সাঁতার কাটছে আর গান গাইছে। একেবারে অলৌকিক একটা দৃশ্য।”

আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “তারপর কী হলো?”

“একসময় মেয়েটা পানি থেকে উঠে এলো। তারপর ভিজে শাড়িতে সপ সপ শব্দ করে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। আমার কী হলো কে জানে, জোছনা রাতের মনে হয় এক ধরনের এফেক্ট আছে, আমি মেয়েটার পথ আটকে দাঁড়ালাম।”

আম্মু বললেন, “তুই মাঝ রাতে একটা মেয়ের পথ আটকে দাঁড়ালি? তোর মাথা খারাপ?”

মামা বলল, “শোন না আগে, কী হলো। মেয়েটা ভয়ে না চিৎকার করে দেয় সেই জন্য বললাম, তুমি ভয় পেয়ো না মেয়েটা কী বলল জান?”

“কী বলল?”

“বলল, ভয় পাব কেন? আপনাকে ভয় পাবার কী আছে? আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি আমাকে চিন? মেয়েটা বলল, চিনব না কেন? রাত বিরাতে যন্তরের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন আপনারে চিনব না! তারপর কী বলল জান?”

আম্মু বললেন, “কী বলল?”

“বলল, একটা বিয়া করেন। তাহলে রাত বিরাতে বউয়ের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে পারবেন। যন্তরের সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে হবে না।”

মামার কথা শেষ হবার আগেই আব্বু আর আম্মু শব্দ করে হেসে উঠল, আমিও হাসলাম কিন্তু গোপনে।

আমি যে তাদের কথা শুনছি না আপন মনে নিজের বই পড়ছি সেটা বোঝানোর জন্য গলা উঁচিয়ে বললাম, “কী হয়েছে আম্মু? তোমরা হাসছ কেন?”

আম্মু বললেন, “কিছু না, কিছু না।”

 মামা বলল, “এই, এমনিই হাসছি।”

আমি আবার সহজ সরল বোকাসোকা মানুষের ভান করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে কান খাড়া করলাম। শুনলাম, আম্মু বললেন, “মেয়েটা তো ভুল কিছু বলে নাই। ঠিকই বলেছে। তোর তো আসলেই একটা বিয়ে করা দরকার।”

মামা বলল, “আমাকে কে বিয়ে করবে?”

আব্বু বললেন, “পছন্দের কেউ থাকলে আমাদের বল আমরা প্রস্তাব নিয়ে যাই।”

“ঠিক আছে দুলাভাই, যদি থাকে আপনাদের জানাব।”

আমি আবার বইয়ের আড়ালে মুখ টিপে হাসলাম। বড়রা জানে না কিন্তু আমরা ঠিকই জানি আমার পছন্দের একজন মেয়ে আছে, নাম মেহরিন, ইউনিভার্সিটির টিচার। এইখানে আমাদের একটু খানি আপত্তি আছে, টিচার মানেই রাগী রাগী চেহারার কড়া টাইপ মহিলা। মামাকে যে বিয়ে করবে তার হওয়া উচিত হাসি খুশি মজার একটি মেয়ে। টিচার মানেই বিভীষিকা।

আমি আবার কান খাড়া করলাম। শুনলাম আব্বু বলছেন, “রাত বিরেতে রোমান্টিক সেটিংয়ের একটা মেয়ে ঠিক আছে কিন্তু তুমি কেমন করে জান কোনো একদিন একটা ক্রিমিনাল এসে হাজির হবে না, কিছু একটা করে ফেলবে না।”

মামা বলল, “না দুলাভাই ভয়ের কিছু নাই। আমাকে কেউ কিছু করবে না। আমি যখনই কোথাও যাই লোকাল অথরিটি সেটা জানে। আমাকে প্রটেকশন দেয়। আমি নিজেও রেডি থাকি।”

“তুমি কীভাবে রেডি থাক?”

মামা এবারে পিছনে ফিরে আমার দিকে তাকাল, আমি তাদের কথা শুনছি কি না সেটা লক্ষ করল। আমি তখন বইয়ের দিকে আরো বেশি নজর দিয়ে চেহারার মাঝে একটা ভ্যাবলা ভাব ফুটিয়ে একেবারে শুয়ে পড়ার ভান করে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি।

মামা গলা নামিয়ে বলল, “আমি সবসময় সাথে একটা হ্যান্ডগান। রাখি।” এবারে কথাটা শুনতে একটু কষ্ট হলো তারপরও শুনতে পেলাম।

আব্বু গলা নামিয়ে বললেন, “হ্যান্ড গান? মানে রিভলবার?”

 “পিস্তল।”

আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “রিভলবার আর পিস্তলে পার্থক্য কী?”

মামা গলা নামিয়ে বলল, “রিভলবারে গুলির ম্যাগাজিনটা রিভলব করে, মানে ঘুরে। পিস্তলে ম্যাগাজিন আলাদা।”

আম্মু ভয়ে ভয়ে বলল, “সর্বনাশ! তুই অস্ত্র নিয়ে ঘুরিস, সন্ত্রাসীদের মতো?”

মামা হাসল, বলল, “সন্ত্রাসী হব কেন? লাইসেন্স করা হ্যান্ডগান। নিজের প্রটেকশনের জন্য রাখি।”

“কোথায় রাখিস?”

“আছে আমার সাথে।”

আম্মু বললেন, “দেখি।”

মামা এবং আব্বু আম্মু আবার পিছনে ফিরে দেখলেন আমি কী করছি। আমি এবারে প্রায় গড়িয়ে পড়ার ভান করে বইয়ে আরো বেশি মনোযোগ দিয়ে চোখের কোণা দিয়ে তাকালাম। সরাসরি না তাকিয়েও যে চোখের কোণা দিয়ে সবকিছু পরিষ্কার দেখা সম্ভব বড় মানুষেরা সেটা জানে না দেখে আমি খুবই অবাক হলাম! মানুষের জন্মের সময় মাথা ভরা বুদ্ধি থাকে, যতই বড় হয় সেই বুদ্ধি উড়ে উড়ে মানুষ বোকা হতে থাকে। যত বড় তত বোকা!

স্পষ্ট দেখলাম মামা খুব সাবধানে ডান হাত দিয়ে বাম হাতের নিচে কোথা থেকে একটা কালো রংয়ের পিস্তল বের করে টেবিলে রাখল। কী অসাধারণ একটা পিস্তল। ইশ! আমার যদি এরকম একটা পিস্তল থাকতো! এতোদিন মামাকে সায়েন্টিস্ট হিসেবে কোনো পাত্তা দেই নাই, সবসময়ই মনে হয়েছে অকাজের একটা মানুষ। কিন্তু যে মানুষ বগলের কাছে একটা পিস্তল নিয়ে ঘুরে তার থেকে অসাধারণ মানুষ আর কে হতে পারে? একেবারে সিনেমার নায়কের মতো।

আম্মু ফিসফিস করে বললেন, “গুলি বের হয়ে যাবে না তো।”

মামা বলল, “না, সেফটি ক্যাচ অন করা আছে।”

 “কয়টা গুলি আছে?”

 “আটটা।”

 মামা মনে হয় পিস্তলটা খুলে গুলি বের করে দেখাল।

এবারে আব্বু ফিসফিস করে কিছু একটা বললেন, এতো আস্তে বললেন যে আমি শুনতে পারলাম না। বুঝতে পারলাম এখন আমার আবার কথা বলা দরকার। হঠাৎ করে সোজা হয়ে বসে বইটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আম্মু! আব্বু!

মামা তখন রীতিমতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তার পিস্তলটা দুই হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা কী নিয়ে কথা বলছ?”

আম্মু শক্ত গলায় বললেন, “আমরা যেটা ইচ্ছা সেটা নিয়ে কথা বলব। তোর সমস্যাটা কী?”

“না। সমস্যা নাই। কিন্তু–”

“কিন্তু কী?”

“তোমরা এতো ফিসফিস করে কথা বলছ তাই জানতে চাচ্ছিলাম কী নিয়ে কথা বলছ।”

আব্বু বললেন, “টোপন, তোর বড়দের কথা জানার কোনো দরকার নাই। যা, অন্যদের সাথে খেল গিয়ে।”

কাজেই আমি মুখে চরম একটা বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে বইটা হাতে নিয়ে ডাইনিং রুম থেকে বের হয়ে এলাম। বের হয়ে শুনলাম আম্মু আমাকে নিয়ে কোনো একটা মন্তব্য করলেন। কী মন্তব্য করলেন বুঝতে পারলাম না শুধু নিজের নামটা শুনতে পেলাম।

আমার নাম হচ্ছে টোপন। পৃথিবীতে নাকি সাতশ কোটি মানুষ, সাতশ কোটি মানুষের সাতশ কোটি নাম। এই সাতশ কোটি মানুষের সাতশ কোটি নামের ভিতরে খুঁজে খুঁজে আমার আব্বু আম্মু আমার জন্য এর থেকে ভালো কোনো নাম খুঁজে পেল না? টোপন একটা নাম হলো? যতদিন ছোট আছি টোপন নামটা সহ্য করা যায়। যখন বড় হব তখন যদি কেউ এই নামটা জেনে যায় তখন কী হবে?

আমি ঠিক করেছি মরে গেলেও বিয়ে করব না। (মানুষ কেমন করে বিয়ে করে কে জানে?) ভাগ্যিস কোনোদিন বিয়ে করব না, যদি করতাম তাহলে আমার ছেলে মেয়ে হতো, তারা জানতো তাদের বাবার নাম হচ্ছে টোপন। কী লজ্জার একটা ব্যাপার হতো।

.

আমি বিয়ে না করলেই যে বিপদ কেটে যাবে সেটা পুরোপুরি ঠিক না। আমার একটা বোন আছে, নাম রত্না এবং একটা ভাই আছে নাম মিঠুন তারা নিশ্চয়ই বিয়ে করে ফেলবে। তাদের নিশ্চয়ই বাচ্চা কাচ্চা হবে সেই বাচ্চা কাচ্চারা আমাকে হয় টোপন মামা নাহলে টোপন চাচা ডাকবে। যদি একটু নেকু টাইপ হয় তাহলে হয়তো টোপন চাচ্চু ডাকবে কী ভয়ংকর শোনাবে। সর্বনাশ!

যাই হোক এগুলো নিয়ে পরে দুশ্চিন্তা করা যাবে, আমি আপাতত বসার ঘরে ঢুকলাম। আপু সামনে টেবিলে পা তুলে সোফায় বসে আছে। আমি যদি কখনো টেবিলে পা তুলে বসি আপু মুখ শক্ত করে বলে, ‘এই টোপন। পা নামিয়ে বস। আপুর অবশ্যি মুখ শক্ত করতে বেশি কষ্ট করতে হয় না, এমনিতেই তার মুখটা শক্ত, দেখে মনে হয় পেট ব্যথা করছে না হয় কান পেকেছে। আমি ভাবলাম একবার বলি, “আপু পা নামিয়ে বস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বললাম না। বড় বোনদের কারণে এমনিতেই ছোট ভাইদের জীবনে কতো রকম যন্ত্রণা, এই যন্ত্রণার মাঝে নূতন করে আগুন জ্বালিয়ে লাভ নাই। কিন্তু আরেকটা ইন্টারেস্টিং কাজ করা যায়!

আমি সোফায় বসে আপুর মতো টেবিলে পা তুলে দিলাম। আপু চোখের কোণা দিয়ে আমার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলতে পারল না, নিজে টেবিলের উপর পা তুলে রেখে আমাকে কেমন করে পা নামাতে বলে। আমিও চোখের কোণা দিয়ে আপুর দিকে তাকালাম। হাতে একটা ইংরেজি বই কেন তার ভাব দেখানোর জন্য ইংরেজি বই নিয়ে বসতে হবে কে জানে।

আমি আমার বইটা খুলে বসলাম, এতক্ষণ বইটা খুলে বই পড়ার ভান করছিলাম এখন আসলেই পড়া যেতে পারে। ভয়ংকর একটা রহস্যোপন্যাস। প্রতি পৃষ্ঠায় একটা করে খুন হচ্ছে। আর কী বীভৎস সেই খুন পড়লেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠে। আমি পড়তে শুরু করলাম। বইটাতে যখন আরো দুইটা নতুন খুনের বর্ণনা শেষ করেছি তখন মিঠুন এসে ঢুকল। সে এই বাসার সবচেয়ে ছোট সেই জন্য তার আদর সবচেয়ে বেশি। বেশি আদরের কারণে সে ভয়ংকর একজন নেকু বাচ্চা হিসেবে বড় হচ্ছে। তার হাতে একটা খেলনা ব্যাটম্যান। আমার কাছে এসে তার নেকু নেকু গলায় বলল, “ভাইয়া, কে বেশি পাওয়ারফুল, ব্যাটম্যান নাকি স্পাইডারম্যান?”

ন্যাকামি দেখে মরে যাই! ইচ্ছা হলো কান ধরে একটা ঝাঁকুনি দেই কিন্তু আপুর কাছে বসে বসে সেটা তো আর করতে পারি না তাই মুখ গম্ভীর করে বললাম, “ব্যাটম্যানও না স্পাইডারম্যানও না। সবচেয়ে বেশি পাওয়ারফুল হচ্ছে চিকাম্যান।”

“চিকাম্যান?” মিঠুন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।

“হ্যাঁ। চিকা দেখিস নাই, চিকা? এই মোটা মোটা, ভোটকা ভোটকা? ইন্দুরের মতো। সেই চিকাম্যান।”

মিঠুন কেমন যেন অবাক হয়ে বলল, “চিকাম্যানের নাম কখনও শুনি নাই।”

“কীভাবে শুনবি। এটা থাকে কুড়িল বস্তিতে। এটা তো আর ব্যাটম্যান আর স্পাইডারম্যানের মতো আমেরিকায় থাকে না”।

গাধাটার কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে যে আমি ইয়ারকি করছি। যখন বুঝল তখন আঁ আঁ করে কাঁদার মতো একটা ঢং করে গেল আপুর কাছে, গিয়ে নালিশ করল, “আপু দেখো ভাইয়া আমার সাথে ঠাট্টা করে। আঁ আঁ “

আমি বললাম, “ঠাট্টা? আমি কখন ঠাট্টা করলাম?”

মিঠুন বলল, “আঁ আঁ আঁ–”

আপু তখন তার কঠিন মুখটাকে আরেকটু কঠিন করার চেষ্টা করে বলল, “দেখ টোপন, কাজটা ভালো হচ্ছে না। মিঠুন ছোট একজন মানুষ তাকে নিয়ে এভাবে ইয়ারকি করছিস কেন? একটা প্রশ্ন করেছে ঠিক করে তার উত্তর দে”

 ‘“আমি ঠিক করেই উত্তর দিয়েছি। সবচেয়ে পাওয়ারফুল হচ্ছে চিকাম্যান। চিকা একটা ব্যাটকেও খপ করে কামড় দিতে পারে স্পাইডারকেও পারে”

“খবরদার টোপন ঢং করবি না। ছোট একজন বাচ্চাকে এভাবে টিজ করতে হয় না।”

“ছোট? মিঠুনের বয়স হয়েছে আট। আট বছর বয়সে আমি ওয়ার এন্ড পিস পড়েছি।”

আসলে পড়ি নাই, কিন্তু কথা বলার সময় একটু বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলতে হয়। আপু সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাল, চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তুই ওয়ার এন্ড পিস পড়েছিস?

“পুরাটা শেষ করতে পারি নাই।” কথাটা একেবারে মিথ্যা না। আসলে মনে আছে বইটা উল্টে পাল্টে দেখে ভাবছিলাম কোন পাগল এরকম মোটা বই লিখতে পারে আর কোন বোকা এটা পড়তে পারে। কিন্তু সেটা আর বললাম না।

আপু হাল ছেড়ে দিয়ে মিঠুনকে আদর করে বলল, “আস ভাইয়া আমার কাছে। টোপন তোমার সাথে ঠাট্টা করছে। চিকাম্যান বলে কেউ নাই।”

“ভাইয়া সব সময় আমাকে জ্বালায়।”

“আমি জানি। টোপন হচ্ছে দুষ্টু, সেই জন্য জ্বালায়। তুমি কখনো দুষ্টু হবে না। তুমি হবে গুডি বয়।”

আমি বললাম, “গুডি বয় বলে কোনো শব্দ নাই। শব্দটা গুড বয়। আর তোমার বলা উচিত নেকু বয়। ন একারে নে ক উকারে কু। নেকু।”

আপু চোখ লাল করে বলল, “চুপ করবি তুই? আম্মুকে বলে দেব কিন্তু।” আমি বুঝলাম আমার আর এখানে বসে থাকা ঠিক হবে না। তাই উঠে পড়লাম। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে বললাম, “আরেকটা কথা আপু। তুমি যে ইংরেজি বইটা নিয়ে পড়ার ভান করছ, সেটা বানান করে পড়তে পড়তে তোমার কমপক্ষে দুই বছর লাগবে। তখন তোমার বয়স হবে ষোলো। বিয়ের বয়স। এখন থেকে একটা ছাগল টাইপের জামাই ঠিক করে রাখ।”

আপু রেগে মেগে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “তবে রে বদমাইশ–”

আমি তখন এক লাফে অদৃশ্য হয়ে গেলাম। মিঠুনকে কাঁদিয়ে এবং আপুকে রাগিয়ে মনের ভিতরে একটা ফুরফুরে আনন্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে। একটা কাজের কাজ করতে পেরেছি।

এটা হচ্ছে আমার দৈনন্দিন জীবন। খারাপ না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *