০৫.
বিকাল বেলা একটা ছেলে মামার মাইক্রোবাসের কাছে হাজির হলো। ছেলেটার ফিটফাট পোশাক চোখে চশমা, চুল পরিপাটি করে আচড়ানো, পায়ে জুতো মোজা, পিঠে একটা ব্যাকপেক। জঙ্গলের ভিতরে খুঁজে খুঁজে সে মামার মাইক্রোবাসটা বের করে ফেলেছে। মামা মাইক্রোবাসটার ভিতরে কাজ করছে, আমি পিছনে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। ছেলেটা আমার কাছে এসে হাসিমুখে দাঁড়াল, যেন সে আমার কত দিনের পরিচিত। সে কাকে চায় জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আমি থেমে গিয়ে চিৎকার করলাম, “আরে হেড মাঝি!”
মাহবুব মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ আমি।”
“তোমাকে আমি চিনতে পারি নাই! চশমায় অন্যরকম লাগছে।” আসলে শুধু চশমা না সবকিছু মিলিয়ে অন্যরকম লাগছে! তাকে আর বলতে পারলাম না গ্রামের ছেলে হলেই লুঙ্গি পরে থাকবে, খালি গায়ে থাকবে এরকম একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল।
“মাছ ধরতে গেলে বাড়িতে চশমা রেখে যাই।”
মামা ভিতর থেকে বলল, “কে এসেছে, টোপন?”
আমি বললাম, “ঐ যে মাহবুবের কথা বলেছিলাম, যে আমাকে নৌকা চালাতে শিখিয়েছে।”
মামা বলল, “যে নিউটনের সূত্রের ভুল বের করেছে?
মাহবুব লজ্জা পেয়ে বলল, “না না, নিউটনের ভুল না, মনে হয় আমার বুঝতে ভুল।”
মামা তখন মাইক্রোবাসের ভেতর থেকে বের হয়ে এলো। মাহবুবের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার পিঠে এতো বড় ব্যাকপেকে কী?”
মাহবুব ব্যাকপেকটা ঘাড় থেকে খুলে বলল, “আমার মা আপনাদের জন্য একটু খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন।”
মামা চোখ বড় বড় করে বলল, “খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন, সত্যি?”
মাহবুব মাথা নাড়ল, বলল, “বেশি কিছু না। আজকে টোপন আর আমি যে মাছ ধরেছি তার একটু ঝোল। সবজি ডাল এইসব, সাথে একটু
মাহবুব ব্যাকপেকের ভেতর থেকে প্লাস্টিকের কৌটা বের করতে করতে কথা শেষ না করে থেমে গেল।
মামা জিজ্ঞেস করল, “সাথে একটু কী?”
“আপনারা খাবেন কি না জানি না, আমি না করেছিলাম, মা তবুও দিয়ে দিল।”
“কী না করেছিলে?”
“একটু চেপা ভর্তা।”
মামা আনন্দের মতো শব্দ করল, “চেপা ভর্তা! সত্যি?”
“আপনারা খান?”
“টোপনের কথা জানি না, সে তত ভদ্রলোকের বাচ্চা, আমি খাই। ঝাল দিয়ে লাল করে চেপা ভার্তা, আহা, বেহেশতি খাবার।”
মাহবুব হাসল, “তাহলে তো ভালো।”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “মামা, যে খাবারে পচা গন্ধ সেইটা বেহেশতি খাবার হয়ে কেমন করে? বেহেশত কী দুর্গন্ধের জায়গা?”
মামা ধমক দিল, বলল, “যেটা বুঝিস না সেইটা নিয়ে কথা বলিস না।”
তাই আমি আর কথা বললাম না। মাহবুব মাইক্রোবাসের ভিতরে উঁকি দিয়ে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। মাথা নেড়ে বলল, “ইয়া মাবুদ! এতো যন্ত্রপাতি? আপনি কী নিয়ে গবেষণা করেন?”
মামা উত্তর দেওয়ার আগেই আমি বললাম, “পরিবেশ দূষণ।”
মাহবুব ভুরু কুচকালো, “পরিবেশ দূষণ?”
“হ্যাঁ। বিভিন্ন জায়গার সেম্পল নিয়ে তারপর সেইগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয় তার ভিতরে কী আছে।”
“সেইজন্য এতো যন্ত্রপাতি লাগে?” সে তখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে না।
মামা মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, অনেক সময় লাগে।”
মিথ্যা কথা বলতে বেশি ভালো লাগে না, মামাও স্বস্তি পাচ্ছিল না তাই কথা ঘোরানোর জন্য বলল, “নিউটনের সূত্র নিয়ে তোমার সমস্যাটা কী?”
মাহবুব একটু লাজুক মুখে বলল, “আমাদের ক্লাসে সেটা নাই আমি ক্লাস নাইনের বইয়ে দেখেছি। মনে হয় বুঝতে পারি নাই।”
“কী বুঝতে পার নাই?”
“সূত্রে লেখা আছে যে কোনো ভরে বল প্রয়োগ করলে তার ত্বরণ হয়। কিন্তু ভরটা যদি অনেক বড় হয়ে তাহলে কী আমি ধাক্কা দিলে ত্বরণ হবে? সেটা নড়বে? নড়বে না।”
মামা হাসি হাসি মুখে বলল, “নড়বে না?”
“না। আমি কী একটা ট্রাককে ধাক্কা দিয়ে নড়াতে পারি? কোনোদিন নড়াতে পারব না।
মামা হাসল, “ঠিকই পারতে যদি কোনো ফ্রিকশান না থাকতো। ট্রাকটা যদি পুরোপুরি পিছলে একটা জায়গায় থাকতো তাহলে তুমি ঠিকই নড়াতে পারতে।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। সত্যি।”
তারপর মামা তার অভ্যাসমতো বকবক করা শুরু করে দিল। নিউটনের সূত্র বোঝায় তারপর হাত পা মাথা নেড়ে উদাহরণ দেয়। তারপর আরো কথা বলে। মাহবুব ছেলেটা এমনিতে চালাক চতুর কিন্তু সে মামার সামনে রীতিমতো বোকামি শুরু করল। শুধুমাত্র হু হা করে মাথা না নাড়িয়ে উল্টো প্রশ্ন করতে লাগল। মামাকে তখন পায় কে! আরো উত্তেজিত হয়ে আরো বেশি কথা বলতে লাগল।
মামাকে কেমন করে থামানো যায় যখন সেটা চিন্তা করছি ঠিক তখন আমি মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম, মনে হলো তার মাঝে একটা মেয়ের গলার স্বরও আছে। আমি মাইক্রোবাস থেকে নেমে এদিক সেদিক তাকাচ্ছি তখন দেখলাম আজকে দুপুরে দেখা হওয়া টিসটাস মেয়ে আর ভোতা ছেলেটা এদিকে আসছে। তাদের পিছনে একজন বড় মানুষ, এই দুইজনের বা একজনের বাবা চাচা কেউ একজন হবে।
আমাদেরকে দেখে মেয়েটা একটা আনন্দের মতো শব্দ করল এবং তখন মামা তার বিজ্ঞান নিয়ে বকর বকর থামিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল।
মেয়েটা বলল, “এই তো পেয়ে গেছি। বলেছিলাম না, একটা মাইক্রোবাসের ভিতর ল্যাবরেটরি!
তারপর আমার আর মাহবুবের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “তোমরা? তোমাদেরকে চিনতে পারি নাই।”
আমি মুখ শক্ত করে বললাম, “কেন চিনতে পার নাই?”
“শার্ট পরে আছ তো সেইজন্য! আমি ভেবেছিলাম তোমরা সবসময় খালি গায়ে থাক!” তারপর হি হি করে হাসল। মেয়েটার মনে হয় হাসির রোগ আছে।
তাদের সাথের বড় মানুষটা বলল, “সব সময় ঠাট্টা করবি না। ডোরিন।”
মেয়েটার নাম ডোরিন। সে বড় মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আব্বু, এই যে এরা দুইজন নৌকা করে আমাদের পৌঁছে দিয়েছিল।” তারপর আমাকে দেখিয়ে বলল, “এই যে ছেলেটা বলেছিল হাওড়ের মাঝখানে নিয়ে আমাদের ছিনতাই করবে। টনি সেটা বিশ্বাস করে যা ভয় পেয়েছিল!” মেয়েটা আবার হি হি করে হাসতে শুরু করে।
ভোতা ছেলেটার নাম নিশ্চয়ই টনি, সে মুখটা আরো ভোতা করে বলল, “আমি ভয় পাই নাই।”
“পেয়েছিলি। তোর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল।”
“বোঝা যাচ্ছিল না–”
“এইখানে যে মাইক্রোবাসের ভিতরে ল্যাবরেটরি আছে তুই সেইটাও বিশ্বাস করিস নাই। এখন বিশ্বাস হয়েছে?”
মেয়েটার আব্বু একটু এগিয়ে এসে বলল, “ওয়েল ডোরিন, টনিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সেটা তো আমিও ঠিক বিশ্বাস করিনি! আসলেই তো এই মাইক্রোবাসের ভিতরে দেখি রীতিমতো হলিউডের সাইফাই ল্যাব।”
মামা তখন এগিয়ে এসে ডোরিনের আব্বুর সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, “না না! সেরকম কিছু না। স্ট্যান্ডার্ড যন্ত্রপাতি। ছোট জায়গার মাঝে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে বলে এরকম লাগছে।”
তখন ডোরিনের বাবা নিজের পরিচয় দিল, মামা তার পরিচয় দিল। তারপর বড় মানুষেরা নিজেদের ভিতরে যেভাবে কথা বলে সেভাবে কথা বলতে লাগল। কে কী করে, কোথায় থাকে, কোথায় লেখাপড়া করেছে। এইসব বেদরকারি কথা। কিন্তু এমনভাবে মুখ গম্ভীর করে কথা বলে যে মনে হয় এই কথাগুলো বুঝি খুবই দরকারী কথা। আমরা একটু অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিলাম, একটু সরে গিয়ে নিজেরা কথা বলব কী না চিন্তা করছিলাম, তখন মামা আর মেয়েটার বাবা একটু থামল। মেয়েটা তখন মামার মাইক্রোবাসের ভিতরে উঁকি দিয়ে বলল, “এত যন্ত্রপাতি!” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এই সব যন্ত্রপাতি চিনো?”
যদি আশেপাশে মামা না থাকতো তাহলে মুখ গম্ভীর করে বলতাম, ‘হ্যাঁ চিনি। তারপর কোন যন্ত্র কী কাজে লাগে সেটা বানিয়ে বানিয়ে বলতে শুরু করতাম। কিন্তু মামা কাছে দাঁড়িয়ে আছে আমি তো আর সেইটা করতে পারি না। কীভাবে উত্তর দেওয়া যায় চিন্তা করছি তখন মামা বলল, “হ্যাঁ টোপন সব চিনে। টোপন হচ্ছে আমার এসিস্টেন্ট, আমার অনেক যন্ত্র সে অপারেট করতে পারে।”
ডোরিন নামের মেয়েটা চোখ কপালে তুলে বলল, “ও মাই গড! তার মানে তুমিও একজন সায়েন্টিস্ট?”
আমি বললাম, “না, না, আমি সায়েন্টিস্ট না।”
মামা বলল, “আসলে টোপন ছোটখাটো একটা সায়েন্টিস্ট, আমার কাজকর্মে একজন এসিস্টেন্ট দরকার সেইজন্য টোপনকে নিয়ে এসেছি। টোপন খুবই স্মার্ট ছেলে”
আমি মামার দিকে তাকালাম, মামা কেন এভাবে বলছে বুঝতে পারলাম না। আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছে কী না কে জানে! কিন্তু গলার স্বরে তো ঠাট্টা করার কোনো ভাব নেই।
মামা গম্ভীর গলায় বলল, “আসার সময় একটা রোড একসিডেন্ট ভিক্টিম ফেমিলি পেয়েছিলাম, সবাইকে আমরা হাসপাতালে নিয়েছি, টোপন খুবই দায়িত্বশীল মানুষের কাজ করেছে।”
ডোরিনের বাবা বলল, “হাউ নাইস!”
মামা থামল না, বলতে থাকল, “আজ দুপুরে টোপনকে পাঠিয়েছি এলাকাটা সার্ভে করে আসতে, সে ফিরে এসেছে ভিজে কাপড়ে! তার মানে পানিতেও নেমেছে। নৌকা চালানো শিখে এসেছে। শুধু তাই না, এলাকার ছেলে পিলেদের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করে এসেছে। এমনই চমৎকার ফ্রেন্ডশিপ যে একজনের মা রান্না করে খাবার পাঠিয়েছেন। কমপ্লিট উইথ চেপা ভর্তা।”
ডোরিনের বাবা বলল, “চেপা ভর্তা? হাউ ওয়ান্ডারফুল!”
“তার মানে বুঝতে পারছেন? আজ রাতে আমাদের শুকনা রুটি আর ডিম সিদ্ধ খেতে হবে না! আমরা সত্যিকারের খাবার খাব। সব টোপনের সৌজন্যে।”
ডোরিনের বাবা বলল, “সময় পেলে আমাদের রিসোর্টে চলে আসবেন। আমরা এক সাথে লাঞ্চ কিংবা ডিনার করতে পারি।” তারপর আমার আর মাহবুবের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা দুইজন অবশ্যই আসবে। ভিতরে চমৎকার একটা ফ্যামিলি পুল আছে, তোমরা পছন্দ করবে!”
ডোরিন খুশিতে হাততালি দিল, টনি নামের ভোতা ছেলেটার মুখটা আরো একটু ভোলা হয়ে গেল! ডোরিন হাততালি দিতে দিতে বলল, “পুলের পাশে সন্ধ্যাবেলা বারবিকিউ করে, খুব মজার কাবাব তৈরি করে।”
ডোরিনের বাবা বললেন, “হ্যাঁ, তোমরা এসো। আমার ছেলেমেয়েরা রিসোর্টের ভেতর একা একা অধৈর্য হয়ে উঠছে। তোমাদের সাথে একটু সময় কাটালে ভালো লাগবে।”
ডোরিন হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “টোপন তুমি এখন কী সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট করবে?”
আমি একটু থতমত খেয়ে বললাম, “সেটা তো এখনো জানি না। আমার মামা যেটা বলবে–”
ডোরিন তখন মামার দিকে তাকাল, বলল, “সায়েন্টিস্ট আংকেল, টোপন এখন কী এক্সপেরিমন্টে করবে?”
মামা খুবই সহজ গলায় বলল, “শুরু হবে সেম্পল কালেকশন দিয়ে। ভোরবেলা এই এলাকায় বের হয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে সেম্পল নিয়ে আসবে।”
“কী রকম সেম্পল?”
“অনেক রকম হতে পারে।” বালু, পানি, কখনো গাছ, গাছের পাতা, মাছ।”
“আমরা কী টোপনের সাথে সাথে সেম্পল কালেক্ট করতে পারি?”
“তোমরা?” মামা এবারে একটু অবাক হলো, তারপর বলল, “কাজটা মোটামুটি পরিশ্রমের, রোদে হেঁটে হেঁটে সেম্পল আনতে হবে। তোমরা শুধু শুধু কেন কষ্ট করতে চাচ্ছ?”
“আমাদের পরিশ্রম করতে কোনো আপত্তি নাই।”
টনি অনেকক্ষণ পর একটা কথা বলল, নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে একটা শব্দ করে ভোতা মুখে বলল, “আমি রোদে হাঁটাহাঁটি করতে পারব না।”
ডোরিন মুখ শক্ত করে বলল, “তুই আসতে না চাইলে আসিস না। আমি আসব।”
মাহবুব বলল, “আমারও এখন স্কুল ছুটি। আমিও আসতে পারি।”
মামা বলল, “ভেরি গুড। তোমাদের গার্জিয়ানদের যদি আপত্তি না থাকে তোমরা এসে টোপনকে সাহায্য করতে পার।” মামা তখন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে টোপন? তোর কোনো আপত্তি নাই তো?”
মামা এমন ভান করল যেন আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এবং আমি পারমিশন না দেওয়া পর্যন্ত কেউ আসতে পারবে না। আমি বললাম, “না, না, আমার কোনো আপত্তি নাই।”
ডোরিন আবার আনন্দে হাততালি দিল। এই মেয়েটা খুব অল্পতেই আনন্দ পায়। তার ভাইটা ঠিক তার উল্টো। সবকিছুতেই তার সমস্যা।
ডোরিন, টনি আর তার আব্বু আরো কিছুক্ষণ থাকল, তারপর কালকে কখন কোথায় কীভাবে আসবে সেটা ঠিক করে চলে গেল। মাহবুব আরো কিছুক্ষণ থাকল মামার সাথে। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে গেল, সবই বিজ্ঞানের কথা। মামা সবাইকে চা বানিয়ে খাওয়ালো। কালো কুৎসিত চা, মুখে দিলে মনে হয় চা নয় বিষাক্ত আলকাতরা খাচ্ছি। সবাই অবশ্যি কোনো আপত্তি না করে মুখ বুজে খেয়ে নিল।
সবাই চলে যাবার পর যখন অন্ধকার নেমেছে আমি তখন মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা মামা! তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?”
“কর।”
“তুমি আজকে সবার সামনে আমাকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে এতো কথা কেন বলেছ?”
“কোনটা বানিয়ে বলেছি?”
“এই যে আমি হাফ সায়েন্টিস্ট। সব যন্ত্রপাতি চিনি, অপারেট করতে পারি এইসব।”
“তুই যন্ত্রপাতি চালাতে পারিস না? নিশ্চয়ই পারিস।”
“আমি কোন যন্ত্র অপারেট করতে পারি?”
“কেন, দুপুরবেলা মাইক্রোওয়েভ ওভেন চালিয়ে ডিম সিদ্ধ করেছিস মনে নেই?” সেইটা কী একটা যন্ত্র না?”
“যাও মামা, ঠাট্টা করো না।”
“মোটেও ঠাট্টা করছি না। আমার সাথে থাকলে তুই সবকিছু শিখে যাবি। আজকে তোকে ডাটা নেয়া শিখিয়ে দেব। এক ধাক্কায় দুই হাফ সায়েন্টিস্ট হয়ে যাবি। যেটা পরে হবি সেটা একটু আগে বলে দিলাম।”
“কেন?”
“একটা তোর বয়সী মেয়ে এসেছে। এইরকম বয়সে মেয়েদের সামনে একটু নিজেকে জাহির করার ইচ্ছা করে না? তোর পক্ষ হয়ে আমি করে দিলাম।”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। মামা মহা আজিব মানুষ।
.
রাত্রে আমরা মাহবুবের মায়ের রান্না করা খাবার খুব শখ করে খেলাম। মামা আমার থেকে বেশি শখ করে খেলো, চেপা ভর্তা জিনিসটা এতো শখ করে খাওয়া যায় কে জানত। মামা যে শুধু শখ করে খেলো তা নয় চেপার উপর একটা বিশাল বক্তৃতা দিল। এটা নাকি খাদ্য সংরক্ষণের একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক, নাম ফারমেন্টেশন টেকনিক। এই দেশের মানুষের আবিষ্কার, খাবারটা ব্যাক্টেরিয়া ধরতে পারবে না। কিন্তু রক্ষা পাবে! দেখে মনে হয় পচে ক্যাতক্যাতা হয়ে গেছে আসলে পচে নাই!
খাওয়া শেষ করে মামা তার গামা রে স্পেকট্রোমিটার দিয়ে কেমন করে ডাটা নিতে হয় শিখিয়ে দিল। পুরো ব্যাপারটা যথেষ্ট জটিল কিন্তু মামা আমাকে যত্ন করে শেখালো। আমি শেখার চেষ্টা করলাম, কী করতে হয় সেগুলো ডাইরিতেও লিখে রাখলাম। মনে হলো সত্যি সত্যি এক ধাক্কাতে আমিও হাফ সায়েন্টিস্ট হয়ে গেছি। কী মজা!
রাত্রে মাইক্রোবাসের মেঝেতে দুটি ক্যাম্প খাট পেতে সেখানে বিছানা করা হলো, খুবই আরামদায়ক বিছানা। সেখানে শুয়ে জঙ্গলে জন্তু জানোয়ার আর পশুপাখির ডাক শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম। একটু যে ভয় ভয় করছিল না তা নয়, কিন্তু মামা আছে, তার পিস্তল আছে কাজেই ভয়টা আমাকে বেশি কাবু করতে পারল না।