০৯.
লাঞ্চ খেয়েই মামা চলে গেল। আমি আর মাহবুব রয়ে গেলাম মনি কাঞ্চনে। এখানে অনেক কিছু করার ব্যবস্থা আছে, ডোরিন আর টনি সেগুলো আমাদের দেখাবে। প্রথমে দেখালো ব্যায়াম করার জায়গা। সেখানে পাহাড়ের মতো বড় বড় সাদা চামড়ার মানুষ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দৌড়াচ্ছে, দেখে খুবই আজব লাগে যে একজন প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে কিন্তু নিজের জায়গা থেকে নড়ছে না। তারপর নিয়ে গেল বিলিয়ার্ড খেলার রুমে। আমি আগে শুধু সিনেমায় দেখেছি মানুষজন বিলিয়ার্ড খেলছে এবং তখন ডাকাতেরা গুলি করে সব লুটপাট করে নিচ্ছে। একটা টেবিল খালি ছিল ডোরিন আর টনি সেটা দখল করে নিয়ে বিলিয়ার্ড বলগুলি সাজিয়ে নিল। আমরা তখন বল দিয়ে খানিকক্ষণ ঠোকাঠুকি করলাম একদিকে মারলে বল অন্যদিকে ছুটে যায় আর আমরা সেটা দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। যারা অন্য টেবিলে বিলিয়ার্ড খেলছিল তারা আমাদের এই হাসাহাসি শুনে খুবই বিরক্ত হচ্ছিল কিন্তু আমরা তাদের পাত্তা দিলাম না।
তারপর আমরা রিসোর্টের বাইরে এলাম। প্রথমে ডোরিন আর টনি আমাদেরকে সুইমিংপুলে নিয়ে গেল। সুইমিংপুলটা খুবই সুন্দর, প্রথমে ভেবেছিলাম সেখানে বুঝি টলটলে নীল পানি কিন্তু পানির তো আর কোনো রং হয় না, তখন বুঝতে পারলাম সুইমিংপুলটা নীল রংয়ের টাইলস দিয়ে তৈরি করেছে তাই মনে হচ্ছে পানিটাই বুঝি নীল। সুইমিং পুলের এক পাশে ডাইভ দেওয়ার জায়গায় মোষের মতো বড় একটা মানুষ লাল রংয়ের ছোট আর টাইট একটা জাঙ্গিয়া পরে সেখান থেকে একটা ডাইভ দিল মনে হলো তার ধাক্কায় সুইমিংপুলের সব পানি বুঝি উপরে উঠে গেল। আমরা পানিটা হাত দিয়ে দেখলাম যথেষ্ট ঠান্ডা। মাহবুব পানিটা শুঁকে বলল ওষুধের গন্ধ। নদী আর হাওড়ের এতো সুন্দর পানি থাকতে মানুষ ঠান্ডা ওষুধের গন্ধে ভরা পানিতে লাল জাঙ্গিয়া পরে কেন সাঁতার কাটতে চায় কে জানে।
সুইমিং পুলটা দেখে আমরা মাঠে চলে এলাম। সেখানে পাশাপাশি অনেকগুলো টেনিস কোর্ট। টনি বলল, “চল টেনিস খেলি।”
আমি বললাম, “টেনিস কেমন করে খেলে আমি জানি না।”
ডোরিন বলল, “এর মাঝে জানার কী আছে? বলকে র্যাকেট দিয়ে পিটাবে।”
মাহবুব বলল, “তা ঠিক। আমরা তো কম্পিটিশনে খেলব না।”
ডোরিন বলল, “দাঁড়াও, আমি টেনিস র্যাকেট আর বল নিয়ে আসি।”
আমরাও ডোরিনের সাথে টেনিস বল আর র্যাকেট আনতে গেলাম। একটা আলমারীর ভিতর র্যাকেট আর বল সাজানো আছে। আমরা বেছে বেছে হালকা দেখে চারটা র্যাকেট আর কয়েকটা টেনিস বল নিয়ে এলাম।
টেনিস কোর্টে এসে আমরা খেলার চেষ্টা করতে থাকলাম। বলগুলিকে মারতে অনেক শক্তি লাগে। প্রায় সবগুলি বলই নেটে আটকে যেতে লাগল, কিন্তু তাতে আমাদের উৎসাহ মোটেও কমল না। টেনিস খেলতে খেলতে এক সময় আমরা টেনিস বল দিয়ে একজন আরেকজনকে মারতে গুরু করলাম এবং আবিষ্কার করলাম টেনিস খেলা থেকে এই খেলাতেই মজা অনেক বেশি। টেনিস কোর্টে র্যাকেট রেখে আমরা ছোটাছুটি করতে করতে এক সময় মনি কাঞ্চনের পিছনের দিকে চলে এলাম। জায়গাটা গাছপালা দিয়ে ঢাকা এবং অনেক নিরিবিলি। বড় বড় ঘাস এবং ঝোঁপ ঝাড়। সেখানে ডোরিন একবার তার টেনিস বল দিয়ে আমাকে মারল এবং বলটা মাটিতে ড্রপ খেয়ে লাফিয়ে উপরে উঠে একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল! আমরা বলটা আর খুঁজেই পেলাম না। জলজ্যান্ত একটা বল কেমন করে চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে আমরা বুঝতেই পারলাম না।
টনি বলল, “ছেড়ে দাও। আরেকটা টেনিস বল নিয়ে আসি চল।”
কিন্তু আমার কেন জানি চোখ চেপে গেল। আমি খুঁজতেই থাকলাম, খুঁজতেই থাকলাম। ঠিক যেখানে বলটা পড়েছে সেই জায়গাটা পাতি পাতি করে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ এক জায়গায় একটা গোল গর্ত দেখতে পেলাম। গর্তটা বেশ গভীর, কিছু দেখা যায় না। আমি ভিতরে হাত ঢুকিয়ে হাতটা নাড়াচাড়া করতেই একপাশে একটা আংটার মতো জিনিস পেলাম। হাত দিয়ে সেটা নাড়াচাড়া করে বোঝার চেষ্টা করলাম এটা কী। ঠিক বুঝতে পারলাম না। তখন এটা ধরে টান দিতেই কিছু একটা নড়ে উঠল, কী নড়ল ঠিক বুঝতে পারলাম না। তখন আবার টান দিতেই উপরের মাটিটা নড়ে উঠল। মনে হলো এটা একটা ঢাকনার মতন, এর উপর মাটি জমেছে সেখানে ঘাস উঠেছে।
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, মাহবুব জিজ্ঞেস করল, “কী পেয়েছ?”
“বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে একটা ঢাকনা। টান দিলে খুলে যাবে।”
“সত্যি?” বলে মাহবুবও আমার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে গেল। তারপর সেও হাত দিয়ে কড়াটা ধরল। তখন আমরা দুজন ধরে টান দিতেই ঢাকনা বেশ একটু উঠে এলো। ডোরিন আর টনিও তখন ঢাকনাটা ধরে ফেলল। আমরা চারজন মিলে তখন ঢাকনাটা টেনে খুলে ফেললাম। অবাক হয়ে দেখলাম নিচে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। এবং সিঁড়ির নিচে আমাদের টেনিস বলটা পড়ে আছে। এখন অবশ্য এই টেনিস বলটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা এবং আগ্রহ নেই। এই রহস্যময় সিঁড়িটা কোথায় গেছে সেটা নিয়ে আমাদের আগ্রহ।
আমরা নিঃশব্দে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম। তারপর এদিক সেদিক তাকালাম, বোঝার চেষ্টা করলাম কেউ আমাদের দেখে ফেলেছে কি না। আমরা ঝোঁপ ঝাড় দিয়ে আড়াল হয়ে আছি, কেউ আমাদের দেখছে না। চারজন আরো উবু হয়ে বসলাম যেন কেউ দেখতে চাইলেও দেখতে না পারে।
আমি সবার আগে কথা বললাম, “চল, নামি।”
মাহবুব সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল, বলল, “হ্যাঁ, চল।”
ডোরিন ইতস্তত করে বলল, “নামবে? যদি কিছু হয়?”
আমি বললাম, “কী আর হবে? দেখে আসি সিঁড়িটা কোথায় গেছে।”
ডোরিন শেষ পর্যন্ত রাজি হলো। বলল, “ঠিক আছে।”
টনি ঠিক সাহস পাচ্ছিল না কিন্তু সবাই যদি নেমে যায় তখন একা একা থেকে যাওয়াটা কেমন দেখায়? তাই সেও রাজি হলো।
আমরা একজন একজন করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। সবাই নেমে যাবার পর ঢাকনাটা আবার টেনে ঢেকে দিলাম যেন বাইরে হঠাৎ কেউ চলে এলেও বুঝতে না পারে এখানে কিছু আছে।
ঢাকনাটা টেনে দেবার পর প্রথমে সিঁড়িটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে গেল তারপর আস্তে আস্তে অন্ধকারটা একটু কেটে গিয়ে আমরা আবছা আলো দেখতে পেলাম। মনে হলো সামনে একটা দরজা সেই দরজার নিচ দিয়ে একটু আলো বের হচ্ছে। আমরা কোনো কথা না বলে খুব সাবধানে নিচে নামতে থাকি। দরজার সামনে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম, দরজাতে হাত দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কোনো হ্যাঁন্ডেল আছে কি না। সত্যি সত্যি একটা হ্যাঁন্ডেল পেলাম। হ্যাঁন্ডেলটা ঘোরালে দরজাটা খুলবে আমরা একেবারেই আশা করিনি। কিন্তু সত্যি সত্যি শক্ত হ্যাঁন্ডেলটা একটু জোর দিয়ে চাপ দিতেই খুট করে দরজাটা খুলে গেল। দরজার অন্য পাশে কি আছে আমরা জানি না তাই দরজাটা আগেই খুলে ফেললাম না। খুব সাবধানে একটু ফাঁক করে সেই ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম। মনে হলো সামনে একটু খানি ফাঁকা জায়গা তারপর আরেকটা দরজা। আমরা তখন সাবধানে ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়ালাম। আগের দরজাটা খুলেছে বলে এটাও খুলবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। এবং আমাদের সন্দেহ সত্যি হলো। আমরা নাটা ঘোরানোর চেষ্টা করে বুঝতে পারলাম এটা তালা মারা। কাজেই আর ভেতরে যাওয়ার উপায় নেই। টনি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “চল ফিরে যাই।”
আমরা ফিরেই যাচ্ছিলাম তখন ডোরিন চাপা গলায় বলল, “এই দেখ।”
আমরা দেখলাম দেওয়ালে একটা চাবির রিং ঝুলছে। সেখানে ছোট বড় কয়েকটা চাবি।
আমি আনন্দের চাপা একটা শব্দ করে চাবির রিংটা হাতে নিয়ে একটা একটা করে চাবিগুলো নবের ভেতর ঢোকানোর চেষ্টা করলাম। প্রথম দুটো কাজ করল না, তিন নাম্বারটা চাপ দিতেই ঢুকে গেল। আমি সাবধানে চাবিটা ঘোরালাম এবং দরজাটা খুট করে খুলে গেল। দরজায় ওই পাশে কী আছে আমরা জানি না তাই কয়েক সেকেন্ড নিঃশব্দে অপেক্ষা করলাম। যখন কিছুই হলো না তখন খুব সাবধানে দরজাটা ধাক্কা দিয়ে একটুখানি ফাঁক করে ভিতরে তাকালাম। সামনে ঝকঝকে একটা করিডোর, আলোতে ঝলমল করছে। আমি করিডোরের দুই দিকে তাকালাম, কোনো মানুষ নেই। শুধু যন্ত্রপাতির একটা চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
টনি বলল, “অনেক দেখা হয়েছে। এখন চল যাই।”
আমি বললাম, “একটু ভিতরে ঢুকি।”
টনি ভয় পাওয়া গলায় বলল, “না, প্লিজ না।”
আমি আর কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেলাম। আমার পিছু পিছু মাহবুবও ঢুকে গেল। তার পিছনে ডোরিন এবং সবার শেষে টনি।
টনি ভয় পাওয়া গলায় বলল, “যদি কেউ দেখে ফেলে।”
“দেখে ফেললে দেখবে। আমরা কি চুরি করতে এসেছি?” আমাদের বলটা পড়ে গেছে সেটা খুঁজতে খুঁজতে এসেছি।”
মাহবুব মাথা নাড়ল, অন্যরা কিছু বলল না। আমরা করিডোর ধরে হাঁটতে থাকি। দুইপাশে বড় বড় ঘর, সেই ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে দেখা যায়। আমরা দেখতে দেখতে যেতে থাকি। নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। মনে হয় বিশাল একটা ল্যাবরেটরি। আমরা আরেকটু এগিয়ে গেলাম, জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে আমি চমকে উঠলাম, এখানে পাশাপাশি অনেকগুলো যন্ত্র এবং এই যন্ত্রগুলো আমি চিনি। মামার মাইক্রোবাসে একটা আছে, এটা হচ্ছে গামা রে স্পেকট্রোস্কোপি করার ডিটেক্টর শুধু তাই না, এক পাশে টেবিলের ওপর সারি সারি অনেকগুলো গাইগার কাউন্টার।
আমি একটা চাপা শব্দ করলাম, বললাম, “হায় খোদা!”
ডোরিন জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
“তোমরা চিন্তাও করতে পারবে না”
“কি চিন্তাও করতে পারব না?”
“চল ফিরে যাই, বাইরে গিয়ে বলব।”
আমরা চলে যাবার জন্য মাত্র ঘুরেছি ঠিক তখন করিডোরের অন্য মাথায় দরজা খুলে একজন মানুষ ঢুকল। পাহাড়ের মতন একজন মানুষ, একটু আগে সুইমিংপুলে এই মানুষটা নেংটির মতো একটা জাঙ্গিয়া পরে লাফ ঝাঁপ করছিল। মানুষটা আমাদের দেখে পাথরের মতো জমে গেল, তারপর একটা গগন বিদারী চিৎকার দিল।
আমি ফিসফিস করে বললাম, “সবাই খুবই স্বাভাবিক থাক। ভাব দেখাবে আমরা মোটেও লুকিয়ে আসিনি। ঘুরতে এসেছি।”
আমরা নিজেরা নিজেরা কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলাম। পাহাড়ের মতো মানুষটার কাছে গিয়ে ডোরিন তার দিকে হাসি হাসি মুখে বলল, “হ্যালো। গুড আফটারনুন।”
পাহাড়ের মতো মানুষটা শুভেচ্ছা বিনিময়ের ধারে কাছে গেল না, প্রায় হুংকার দিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা এখানে কীভাবে ঢুকেছ?”
“কেন? হেঁটে হেঁটে এসেছি।” ডোরিন একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “এখানে আসা কি নিষেধ?”
মানুষটা কোনো উত্তর দিল না, বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল। আমাদের কথাবার্তা শুনে আরো কয়েকজন মানুষ এসে হাজির হলো। তাদের মাঝে ব্যায়ামের ঘরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দৌড়ানো মানুষ দুইজনকেও দেখলাম। শোরগোল শুনে একজন বাঙালিকেও ছুটে আসতে দেখলাম। বাঙালি মানুষটা আমাদের দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, “কে তোমাদের ঢুকতে দিয়েছে?”
“কেউ দেয় নাই। আমরা নিজেরা নিজেরা চলে এসেছি।”
বাঙালি মানুষটা একজনকে বলল, “নিশ্চয়ই শাহবাজ। নিশ্চয়ই লিফট খোলা রেখে দিয়েছে।”
আমি হঠাৎ করে বুঝে গেলাম আমরা যে গোপন একটা সিঁড়ি দিয়ে ঢুকে গেছি এই মানুষগুলো সেটা জানে না। তারা মনে করছে আমরা লিফট দিয়ে নেমে এসেছি। আমরা সেরকম ভান করে যাই। আমি অবাক হওয়ার ভঙ্গী করে বললাম, “এখানে আসলে কী হয়? কতো সুন্দর যন্ত্রপাতি, একটু দেখে যাই।”
মানুষগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালো, মনে হলো কী বলবে বুঝতে পারল না। একজন সাদা চামড়ার মানুষ হড়বড় করে অনেক কিছু বলে গেল। আমাদের এভাবে আসা নিয়ে সে মোটেও খুশি হয় নাই সেটা আমি টের পেলাম কিন্তু ঠিক কী বলেছে সেটা বুঝতে পারলাম না। বাঙালি মানুষটা তার কথা অনুবাদ করে দেবার চেষ্টা করল। বলল, “স্যার খুব রাগ হয়েছেন যে তোমরা এখানে ঢুকে গেছ। এখানে বাইরের কারোর আসা নিষেধ।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”
মানুষটা একটু থতমত খেয়ে গেল। একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। ডোরিন বলল, “আমরা এই রিসোর্টে থাকতে এসেছি। রুমের ভাড়া দিচ্ছি, এই রিসোর্ট থেকে বলেছে আমরা এখানে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারব। আমরা আজকে জিমে গিয়েছি, বিলিয়ার্ড বল রুমে গেছি, সুইমিং পুলে গিয়েছি, টেনিস কোর্টে গিয়েছি, এখানেও এসেছি।”
মাহবুব বলল, “এখানে আসা যদি নিষেধ হয় তাহলে আমাদের কেউ থামালো না কেন? আমাদের না করলেই তো আসতাম না।”
আমি সাহস করে বললাম, “কোথাও লেখা পর্যন্ত ছিল না যে প্রবেশ নিষেধ।”
মানুষগুলো চুপচাপ থাকলো, নিজেদের ভিতরে কথা বলল, তারপর বাঙালি মানুষটাকে বলল, আমাদের বের করে দিতে। সেই মানুষটা রাগ রাগ মুখে আমাদেরকে নিয়ে একটা লিফটের সামনে দাঁড়াল। লিফটার ভেতর ঢুকিয়ে আমাদের উপরে নিয়ে বলল, “খবরদার আর কখনো এখানে ঢোকার চেষ্টা করবে না।”
আমি আমার পিছলে বুদ্ধি ব্যবহার করে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার শুধু একটা প্রশ্ন। এখানে ঢোকা নিষেধ কেন? আপনারা কী কোনো বেআইনী কাজ করেন?”
মানুষটা আমার প্রশ্নের উত্তর পর্যন্ত দিল না, থমথমে মুখে লিফটে ঢুকে গেল।
মানুষটা চলে যাবার পর মাহবুব ডোরিন আর উনি আমার দিকে ঘুরে তাকালো। ডোরিন জিজ্ঞেস করল, “এখন বলবে এখানে কী হচ্ছে?”
“বলব। কিন্তু বলার জন্য আমাদের এমন একটা জায়গায় যেতে হবে যেখানে কেউ আমাদের কথা শুনতে পারবে না। আমি তোমাদের যে ব্যাপারটা বলব সেটা টপ সিক্রেট।”
টনি বলল, “চল তাহলে হাওড়ের পারে যাই।”
আমি বললাম, “চল।”
তখন সবাইকে নিয়ে আমরা হাওড়ের পারে রওনা দিলাম। সেখানে একটা গাছ বাঁকা হয়েছিল তার মোটা একটা ডালে আমি পা ঝুলিয়ে বসলাম। ডোরিন বলল, “বল, এখন।”
আমি বললাম, “আমার মামা কী নিয়ে গবেষণা করে তোমাদেরকে বলেছিলাম মনে আছে?”
মাহবুব বলল, “হ্যাঁ। পরিবেশ দূষণ।
“সেটা আসলে সত্যি না।”
সবাই একসাথে চমকে উঠল। বলল, “সত্যি না?”
না। মামা যেটা নিয়ে গবেষণা করে সেটা আমরা সবাইকে বলতে চাই না সেজন্য বলি পরিবেশ দূষণ। মামা আসলে দেশের সব জায়গা ঘুরে ঘুরে ইউরেনিয়াম খুঁজে বেড়াচ্ছে।”
মাহবুব রীতিমতো চমকে উঠল, বলল, “ইউরেনিয়াম! যেটা দিয়ে এটম বোমা বানায়?”
‘হ্যাঁ।” আমি সবার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মনে আছে আমি একটা গাইগার কাউন্টার নিয়ে হাঁটছিলাম?”
“হ্যাঁ।”
“সেটা দিয়ে আসলে কার্বন ডাই অক্সাইড মাপে না। সেটা দিয়ে রেডিও একটিভিটি মাপে।”
সবাই চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, “মনে আছে নৌকায় যষ্ঠি মধু গাছের চারা নিয়ে একটা মানুষ উঠেছিল। মানুষটা কোথায় সেই গাছটা পেয়েছে আমি বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম।”
ডোরিন বলল, “হ্যাঁ। মনে আছে। আমি ভাবছিলাম কী আজব!”
“আসলে সেই গাছের গোড়াতে যে মাটি ছিল সেটা ছিল রেডিও একটিভ। এটার কাছে গাইগার কাউন্টার নিতেই সেটা কটকট করছিল। তোমরা কেউ লক্ষ করনি।”
মাহবুব বলল, “করেছিলাম। আমি লক্ষ করেছিলাম। কিন্তু আমি পাত্তা দেই নাই।”
“তার মানে বুঝেছ?”
টনি জিজ্ঞেস করল, “মানে কী?”
“তার মানে ঐ জায়গাটাতে নিশ্চয়ই ইউরেনিয়ামের খনি আছে।”
“সত্যি?”
‘হ্যাঁ এইজন্য এই বিদেশি মানুষগুলো এখানে একত্র হয়েছে। মনি কাঞ্চনের নিচে গোপনে একটা ল্যাবরেটরি বানিয়েছে। মামার ল্যাবরেটরিতে যে যন্ত্রপাতি ছিল তাদেরও সেগুলো আছে। আমি দেখেই চিনেছি।
“কী আশ্চর্য!”
“হ্যাঁ। তারা ইউরেনিয়ামের খনি যেখানে আছে সেই পুরো জায়গাটা নিশ্চয়ই দখল করে নিয়েছে। মুখে বলছে সেখানে সিমেন্টের ফ্যাক্টরি বানাবে, আসলে মাটি খুঁড়ে ইউরেনিয়াম বের করে নিয়ে যাবে।”
“কী সর্বনাশ।”
‘হ্যাঁ। অনেক বড় সর্বনাশ।”
“তোমার মামা শুনে কী বলেছে?”
“আমার মামাকে এখনও বলার সময় পাই নাই। তাছাড়া মনি কাঞ্চনের গোপন ল্যাবরেটরিটার কথা তো আগে জানতাম না।”
“তোমার মামাকে কখন বলবে?”
আমি বললাম, “ভাবছিলাম, ইউরেনিয়ামের জায়গা থেকে মাটি তুলে নিয়ে এসে মামাকে দেই। তারপর মামাকে বলি।”
ডোরিন বলল, গুড আইডিয়া।”
মাহবুব বলল, “কখন যাবে?”
“কাল সকালে।”
ডোরিন বলল, “গুড আইডিয়া। আমরাও চলে আসব।”
মাহবুব বলল, “হ্যাঁ। আমিও চলে আসব। একসাথে যাব।”
টনি বলল, “কিন্তু আমাদের তো ঢুকতে দেবে না।”
আমি বললাম, “বুদ্ধি করে ঢুকতে হবে।”
ডোরিন বলল, “টোপনের অনেক পিছলে বুদ্ধি! তাই না?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “হ্যাঁ।”
মাহবুব বলল, “আমি আমার নৌকাটা নিয়ে আসব, তাহলে নৌকা থেকে নেমে যেতে পারব, আমাদের ধরতে পারবে না।”
ডোরিন আবার হাতে কিল দিয়ে বলল, “ভেরি গুড আইডিয়া।”
আমরা আরো কিছুক্ষণ কথা বললাম, তারপর আগামীকাল কীভাবে কোথায় দেখা করব সেগুলো ঠিক করে ফেললাম।
ফিরে যাবার সময় ডোরিন আর টনির আব্বু স্পিড বোটের ড্রাইভারের সাথে কথা বলল, তারা আমাদের দুজনকে হাওড়ের পাড়ে নামিয়ে দিল। মাহবুব তার বাসায় রওনা দিল আমি রওনা দিলাম মামার মাইক্রোবাসের দিকে।
.
অনেকদিন ডাইরি লেখা হয় না। রাত্রে ঘুমানোর আগে এখন পর্যন্ত কী হয়েছে সব কিছু লিখে ফেললাম। আমার ডাইরিটা এখন সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং একটা ডাইরি। এই ডাইরিতে এখন মনি কাঞ্চনের নিচে গোপন ল্যাবরেটরির তথ্য আছে, ইউরেনিয়ামের খনির তথ্য আছে–মনে হয় এইটা এখন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করা যাবে।
আমি যখন ডাইরি লিখছি তখন মামা জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার? ডাইরি লিখছিস নাকি উপন্যাস লিখছিস?”
আমি বললাম, “অনেক কিছু লেখা জমা হয়ে গেছে।”
“পড়ে শোনাবি, কী লিখছিস?”
“উঁহু এটা টপ সিক্রেট।”
মামা চোখ বড় বড় করে নিজের কাজে ফিরে গেল। শুধু যে মনি কাঞ্চনের বিষয়টা টপ সিক্রেট তা নয়। ডোরিনকে নিয়ে কয়েক লাইন লিখেছি। সেটা আরো বেশি টপ সিক্রেট।
রাতের ঘুমটা খুব ভালো হলো না। মনে হলো মামা এক সময় তার মাইক্রোবাস থেকে নিচে নেমে গেল। কিছুক্ষণ বাইরে থেকে আবার ফিরে এসে অনেকক্ষণ জেগে রইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে মামা?”
“কিছু না ঘুমা।”
আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম।