০৬.
পরদিন ভোরবেলা ঘুম পুরোপুরি ভাঙার আগেই মামা বলল, “আজকে তোর তিনটা কাজ।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী কাজ?”
মামা বলল, “রেডি হয়ে নে, তারপর বলব।”
কাজেই আমি রেডি হতে শুরু করলাম। সকাল ঘুম থেকে উঠে রেডি হওয়ার প্রথম অংশটা হচ্ছে বাথরুম করা। বাসায় আমি শান্তিতে বাথরুম করতে পারি না। বাথরুমে ঢুকলেই আপু দরজা ধাক্কা দিয়ে বলতে থাকে, কী হলো টোপন? এতোক্ষণ লাগে? ঘুমিয়ে গেছিস নাকি? আর কত? বের হ। তাড়াতাড়ি।
এখানে আপু নাই, কিন্তু বাথরুমও নাই। (মাইক্রোবাসের ভিতরে যেটা আছে সেটা নাকি শুধুমাত্র সুপার ইমার্জেন্সির সময় ব্যবহার হবে। কাজেই আমাকে একটা “ইয়ে হাতে নিয়ে গভীর জঙ্গলের ভিতর ঢুকে যেতে হলো। শুধু তাই না পরিবেশ রক্ষা করার জন্য মামা আমার হাতে একটা ছোট খুরপি দিল, কি বেইজ্জতি ব্যাপার। কেউ যদি দেখে ফেলে কী সর্বনাশ হবে!
যাই হোক বাথরুমের পর খুবই অল্প পানি দিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আমরা নাস্তা করতে বসলাম। মামা পাউরুটির সাইসের উপর জেলির মতো চেপা ভর্তা লাগিয়ে সেটা মহা আনন্দে খেতে লাগল। আমি শুকনো রুটি চিবিয়ে চিবিয়ে যখন অর্ধেক স্লাইস খেয়ে শেষ করেছি মামা ততক্ষণে চার সুইস খেয়ে ফেলেছে। আমাকে দেখে মামার মনে হলো একটু মায়া হলো, বলল, “দাঁড়া চা বানিয়ে দিই। চাতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খা, ভালো লাগবে।”
মামা তারপর আলকাতরার মতো কুচকুচে কালো চা বানিয়ে দিল। সেই চা তিতকুটে এবং বিস্বাদ, আমার মনে হয় ইঁদুর মারার বিষ খেতে এর থেকে ভালো। পাউরুটি ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাওয়ার পর আমার মনে হলো পাউরুটির স্লাইসটা পেটের ভিতর কোন জায়গা থেকে কোন জায়গায় যাচ্ছে। সেটাও বাইরে থেকে বলে দেওয়া যাবে।
মামা খুব তৃপ্তি করে তার আলকাতরার মতো চা খেয়ে শেষ করে বলল, “ব্রেকফাস্টের সময় একটা ফল খাওয়া ভালো।”
আমি আশা নিয়ে বললাম, “কোনো ফল আছে, মামা?”
মামা বলল, “দেখি।” তারপর খুঁজে খুঁজে একটা ঝুড়ির ভেতর থেকে। কয়েকটা কলা বের করল। আমি এর আগে কখনো এরকম কুচকুচে কালো কলা দেখি নাই। মামাকে অবশ্যি সেইজন্যে খুব বেশি চিন্তিত দেখা গেল না, কলা ছিলতে ছিলতে বলল, “এর শুধু ছিলকেটা অক্সিডাইজড হওয়ার কারণে কালো হয়ে গেছে। ভিতরে ঠিক আছে।”
আমার অবশ্য ভিতরটাকেও বেশি ঠিক মনে হলো না কেমন যেন ক্যাতক্যাতা নরম। তবে মামাকে খুশি করার জন্য সেটা খেয়ে ফেললাম।
মামা দ্বিতীয় কাপ আলকাতরার মতো চা নিয়ে সেটা খেতে খেতে বলল, “টোপন, তোকে বলেছি আজকে তোর তিনটা কাজ।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী কী কাজ?”
“দুইটা রিসার্চ আর একটা ম্যানেজমেন্ট।”
আমি বাকিটা শোনার জন্য মামার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মামা বলল, “ম্যানেজমেন্টের কাজ হচ্ছে কাছাকাছি গ্রামের একটা দোকান খুঁজে বের করে ডেইলি সাপ্লাই কিনে আনা।”
“ডেইলি সাপ্লাই কী, মামা?”
“আমি যদি সেটা জানতাম তাহলে তোকে এসিস্টেন্ট বানালাম কী জন্য? তুই দেখ কী কী লাগবে। পারবি না?”
আমি একটু আঁ উঁ করে বললাম “পারব।”
“গুড। আর রিসার্চের কাজের প্রথমটা হচ্ছে একটা গাইগার কাউন্টার নিয়ে এই পুরো এলাকাটার ম্যাপিং করা।”
আমি মাথা চুলকে বললাম, “গাইগার কাউন্টার কী?”
“গাইগার কাউন্টার হচ্ছে এক ধরনের রেডিয়েশন মনিটর। কোথাও রেডিও একটিভিটি কিছু থাকলে সেটা সিগনাল দেয়।”
“কী রকম সিগনাল?”
“আমার কাছে যেটা আছে সেটা কট কট শব্দ করে। সেটা নিয়ে পুরো এলাকাটা চষে ফেলবি। দেখবি কোথাও বেশি রেডিও একটিভিটি আছে কি নেই।”
“কেমন করে বুঝব কোথায় বেশি কোথায় কম?”
“খুবই সোজা, বেশি রেডিও একটিভিটি হলে বেশি কটকট করবে কম হলে কম করবে।”
“যন্ত্রটা কতো বড় মামা?”
“দাঁড়া তোকে দেখাই।” বলে মামা ভেতরে একটা বাক্স খুলে একটা ছোট যন্ত্র বের করে আনল। একটা টিউবের মতো অংশের পেছনে একটা হাত দিয়ে ধরার জন্য তার উপরে একটা হ্যাঁন্ডেল। চারকোণা উপরে একটা পুরানা আমলের কাটাওয়ালা মিটার লাগানো। দেখে মনে হয় কেউ ঘরে বসে এটা তৈরি করেছে। একটা সস্তা মোবাইল ফোন পর্যন্ত এর থেকে বেশি মডার্ন। এররকম মান্ধাতা আমলের একটা যন্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে চিন্তা করে আমার একটু মন খারাপ হলো।
যন্ত্রটার নিচে একটা সুইচ ছিল, মামা সেটা অন করল, তখন যন্ত্রটা কট কট শব্দ করতে লাগল। আমি বললাম, “শব্দ করছে কেন? এইখানে তো কোনো রেডিওএকটিভ কিছু নাই।”
“আছে।” মামা বলল, “সব জায়গায় থাকে। আকাশ থেকে হাই এনার্জি মিউডন আসে। কসমিক রে আসে।”
আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম যে মামা হয়তো এক্ষুণি মিউডন জিনিসটা কী আর কসমিক রে কেমন করে আসে সেটা ব্যাখ্যা করা শুরু করে দেবে। কপাল ভালো সেটা শুরু করে দিল না। বলল, “তোর কাজ হচ্ছে এটা নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখা, কোথাও বেশি কট কট করে কি না।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “যদি করে তাহলে কী করব?”
“জায়গাটা চিনে রাখবি। পরে আমি ভালো করে দেখতে যাব। বুঝেছিস?”
“বুঝেছি।” আমি যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বললাম, “এটার নামটা ফানি। গাইগার কাউন্টার। কী আজিব।”
মামা বলল, “এর মাঝে তুই আজিব কী দেখলি? যে সায়েন্টিস্ট এটা বানিয়েছে তার নাম ছিল গাইগার।”
আমি বললাম, “টাইগার শুনেছি, গাইগার কখনো শুনি নাই। বাপ মা আরেকটু ভালো একটা নাম দিলেই পারতো।”
“গাইগারের বাবা মায়ের সাথে দেখা হলে সেটা নিয়ে তাদের সাথে তর্ক করিস। এখন বের হবার জন্য রেডি হয়ে নে।”
“কিন্তু তিন নম্বর কাজটা কী সেইটা বললে না?”
“সেটা হচ্ছে সেম্পল নিয়ে আসা।”
“সেম্পল? মানে মাটি, পানি, গাছ, পাতা, মাছ।”
“না, না। এতো কিছু না, শুধু মাটি। আমি সবার সামনে গাছ, পাতা, পানি নিয়ে কথা বলেছিলাম যেন মনে করে আসলেই পরিবেশ দূষণ নিয়ে কাজ করছি।”
“কোথা থেকে মাটি আনব?”
“পাঁচশ মিটার পর পর। ল্যাটিচ্যুড লঙ্গিচ্যুড জানতে হবে। জিপিএসটা নিয়ে যাবি।”
জিপিএসটা কী ঠিক বুঝি নাই কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। তাহলে মামা পুরো জিনিসটা বোঝাতে বোঝাতে মাথা খারাপ করে দেবে। যেটুকু দরকার মামা নিজেই নিশ্চয়ই বলে দেবে।
হলোও তাই, ঠিক যখন বের হব তখন কী কী করতে হবে মামা গুছিয়ে শুধু বলে দিল, একটা নোট বইয়ে লিখেও দিল। মামা যে আসলেই সায়েন্টিস্ট সেটা তার লেখা থেকে বোঝা যায়। মুখে যখন কথা বলে তখন একশটা কথা বলে। লেখার সময় দরকারি কথা ছাড়া একটা বাড়তি কথা লিখে না।
একটু পরেই আমি বের হওয়ার জন্য রেডি হলাম। এক হাতে গাইগার কাউন্টার রেডিওএকটিভিটি মাপার জন্য আরেক হাতে লম্বা একটা লাঠি (কেন আমি জানি না), মাথায় বেস বল ক্যাম্প, (রোদ থেকে বাঁচার জন্য।), পিঠে ব্যাকপেক (ডেইলি সাপ্লাই আনার জন্য), পায়ে টেনিস সু (কাদা মাটি থেকে পা বাঁচানোর জন্য), পকেটে মানি ব্যাগ (ডেইলি সাপ্লাই কেনার জন্য)। যে কেউ আমাকে দেখলে মোটামুটি অবাক হয়ে যাবে। ক্যামেরা থাকলে আপুকে দেখানোর জন্য আর আমার ক্লাসের হিংসুটে ছেলেগুলোকে দেখানোর জন্য একটা ফটো তুলে রাখা যেতো। কিন্তু আফসোস সাথে ক্যামেরা নেই।
আমি হাঁটতে হাঁটতে একটু চিন্তা করলাম। আমাকে যে কাজগুলো করতে হবে তার একটা হচ্ছে একটা দোকান খুঁজে বের করে সেখান থেকে ডেইলি সাপ্লাই কিনে আনা। এই কাজটা ভালো করে করা যাবে যদি মাহবুবকে সাথে নিয়ে যাই। আরেকটা কাজ হচ্ছে কয়েক কেজি করে মাটি তুলে আনা, সেই কাজটাও ভালো করে করা যাবে যদি সাথে মাহবুব, ডোরিন আর টনি থাকে। সবাই মিলে এক সাথে অনেক মাটি আনা যাবে। আমি একা একা যে কাজটা করতে পারব সেটা হচ্ছে গাইগার কাউন্টার দিয়ে এলাকাটা চষে ফেলা। কাজেই আপাতত আমি সেটাই করি। মাহবুব বলেছে সে দশটার দিকে আসবে, এখন বাজে আটটা। তার মানে আমার হাতে দুই ঘণ্টা সময়। দুই ঘণ্টা অনেক সময়, ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার করে হাঁটলে আমি দশ কিলোমিটার হেঁটে ফেলতে পারব।
তাই আমি বুকে ফুঁ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আমার হাতের গাইগার কাউন্টারটা মাঝে মাঝে কট কট শব্দ করতে লাগল। কোথাও যদি শব্দ বেশি হয় তাহলে আমাকে সেই জায়গাটা চিনে রাখতে হবে। আশা করতে লাগলাম যে কোনো সময় কট কট শব্দটা অনেক বেড়ে যাবে এবং সেই জায়গাটা মামাকে দেখিয়ে অবাক করে দেব।
আমি টানা আধঘণ্টা হেঁটে গেলাম কিন্তু গাইগার কাউন্টার শব্দ এতটুকু বাড়ল না। আমি আস্তে আস্তে অনুমান করতে শুরু করলাম যে গাইগার কাউন্টারে কট কট শব্দ বেড়ে যাওয়ার কোনো চান্স নেই, বিষয়টা নিশ্চয়ই গুপ্তধন পাওয়ার মতন। আসলে তো আর কেউ সত্যি সত্যি গুপ্তধন খুঁজে পায় না শুধু এর গল্প শোনা যায়, আমারও সেই অবস্থা আমি খালি খুঁজে বেড়াব। কে জানে মামা হয়তো সেটা আগে থেকেই জানে, আমাকে ব্যস্ত রাখার জন্য কোনো একটা ফালতু যন্ত্র আমার হাতে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। এটা হয়তো আসলে গাইগার কাউন্টারই না, অন্য কিছু। কিংবা কে জানে আসলে হয়তো গাইগার কাউন্টার বলে পৃথিবীতে কিছু নাই, মামা বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বলে আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। পরে যখন বাসায় যাব তখন আমাকে কীভাবে বোকা বানিয়েছে সেটা নিয়ে সবার সাথে গল্প করে হাসাহাসি করবে। মামার অসাধ্য কিছু নাই।
যাই হোক, এখন সেটা নিয়ে কিছু করার নেই। হাঁটতে যখন বের হয়েছি তখন হেঁটেই যাই। কাজেই আমি হাঁটতে থাকলাম। হাতের গাইগার কাউন্টারটা শুরুতে হালকাই ছিল, কিন্তু যতই হাঁটছি এটা ততই ভারি হতে শুরু করেছে। যদি বেশি ভারি হয়ে যায় তাহলে আর হাতে করে টানা যাবে না। পিছনের ব্যাকপেকে রেখে দেব, সেখান থেকে যথেষ্ট স্পষ্টভাবে কটকট শব্দ শোনা যাবে। এটাকে যে হাতে রাখতেই হবে সেটা কে বলেছে? এর কটকট শব্দটা শুনতে পেলেই হলো।
শুধু যে গাইগার কাউন্টারটা আস্তে আস্তে ভারী হতে শুরু করেছে তা নয় রোদটাও কেমন যেন গরম হতে শুরু করেছে। প্রথম প্রথম মিষ্টি একটা রোদ ছিল। সেটা এখন আর যাই হোক মিষ্টি নেই, রীতিমতো ঝাল’ অর্থাৎ গরম!
আশেপাশে কেউ নেই তাই ইচ্ছে করলে শার্ট খুলে খালি গা হয়ে যেতে পারি। শুধু তাই না চিৎকার করে গানও গাইতে পারি কিন্তু আমি সেসব কিছু করলাম না, আমি ঘাড় গুঁজে হাঁটতে লাগলাম।
পুরো এলাকাটা ফাঁকা। মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুত জন্তু জানোয়ার দেখা যায়। ইঁদুরের মতো কিন্তু ইঁদুর নয় সেরকম একটা জন্তুকে তাদের বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। মোটাসোটা একটা গুই সাপ খুবই ধীরে সুস্থে আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল, আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল কিন্তু ভয় পেল বলে মনে হলো না। পুঁইসাপ যে একটু পরপর জিব বের করে আমি সেটা জানতাম না। জলা জায়গা অনেক ব্যাঙ, কাছাকাছি গেলে এক সাথে পানির মাঝখানে ঝাঁপ দেয়। গাছে অনেক পাখি কিচিরমিচির করছে, তবে পাখি থেকে বেশি মজার জিনিস বানর, এদের হাবভাব এতো মানুষের মতো যে দেখে অবাক হয়ে যাই। একটা বানর আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিল, বানর যে পাজি ছেলেদের মতো মুখ ভেংচি দিতে পারে আমি জানতাম না।
আমি গরমে ঘামতে ঘামতে হাঁটতে থাকলাম। একটা বড় হাওড় পর্যন্ত গিয়ে আবার ঘুরে ফিরে আসতে লাগলাম। মোটামুটি অনেকটুকু জায়গা দেখে ফেলেছি, এর মাঝে কোনো রেডিও একটিভিটি নেই। আমি এখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছি যে কোথাও কিছু পাওয়া যাবে না। সাইন্টিস্টদের জীবনে কোনো আনন্দ নেই, উত্তেজনা নেই, আছে শুধু রোদের মাঝে হাঁটা, কী আশ্চর্য।
আমি কতক্ষণ হেঁটেছি জানি না, রোদ থেকে বাঁচার জন্য বড় একটা গাছের নিচে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার জন্য যাচ্ছিলাম তখন একেবারে ভূতের মতো হঠাৎ করে কোথা থেকে জানি একজন মানুষ বের হয়ে এলো। আমি তাকে দেখে যত অবাক হয়েছি মনে হলো সে আমাকে দেখে তার থেকে বেশি অবাক হয়েছে। সে চমকে উঠে প্রায় চিৎকার করে বলল, “কে? কে তুমি?”
মানুষটাকে হঠাৎ করে দেখে আমি নিজেও চমকে উঠেছিলাম, কয়েক সেকেন্ড লাগল শান্ত হতে। মানুষটার মাথায় টুপি, থুতনির মাঝে একুশ বাইশটা দাড়ি। (যার দাড়ি এতো কম সে কেন দাড়ি রাখে সেটা একটা রহস্য)। মানুষটার কাছে একটা ছাতা, আমাকে দেখে ছাতাটা অস্ত্রের মতো ধরে রেখেছে। বোঝা যাচ্ছে দরকার হলে সে এই অস্ত্র নিয়ে আমাকে আক্রমণ করে ফেলবে। মানুষটার চোখে মুখে কেমন জানি ভয়ের চিহ্ন, আমি তার অর্ধেক সাইজ আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কী আছে বুঝতে পারলাম না। মানুষটা তার ছাতাকে বন্দুকের মতো করে আমার দিকে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, “বল, বল। কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ? এখানে কী কর?”।
আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। মানুষটা আমাকে যে প্রশ্নগুলো করেছে তাকে খুশি করার মতো সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা নেই। আমি যেটাই বলব এই মানুষটার কাছে তার কোনো অর্থ নেই। কিন্তু তবু কিছু একটা বলতে হবে, বললাম, “আমি এইখানে ঘুরতে এসেছি।”
মানুষটা উত্তর শুনে খুশি হলো কি না বুঝতে পারলাম না। ছাতাটা বন্দুকের মতো ধরে রেখে কেমন যেন কার্টুনের মতো ছোট ছোট লাফ দিয়ে বলল, “তোমার হাতে অস্ত্র কেন? খবরদার আমার দিকে অস্ত্র ধরবে না।”
আমি একবার খাবি খেলাম, আমার হাতে অস্ত্র? তখন বুঝতে পারলাম আমার হাতের গাইগার কাউন্টারের সামনে যেহেতু একটা টিউব আছে সেই জন্য এটাকে মানুষটা কোনো একটা অস্ত্রের নল ভাবছে। টিউবটা সামনের দিকে মুখ করে আছে তাই মানুষটা ভাবছে অস্ত্রটা তার দিকে তাক করে রেখেছি।
আমি গাইগার কাউন্টারের টিউবটা ঘুরিয়ে বললাম, “এইটা অস্ত্র না।”
“এইটা কী?”
“এইটার নাম গাইগার কাউন্টার।”
মানুষটা কী বুঝল কে জানে, আবার একটা ছোট লাফ দিয়ে বলল, “সর্বনাশ! কে তোমাকে এটা দিয়েছে? ফালাও নিচে ফালাও। এক্ষুণি নিচে ফালাও।”
মানুষটার কথা শুনে আমার এই মূল্যবান গাইগার কাউন্টার নিচে ফেলা ঠিক হবে না। কিন্তু তাকে কীভাবে শান্ত করব বুঝতে পারলাম না। বললাম, “এইটা নিচে ফেলা যাবে না। এইটা অনেক মূল্যবান যন্ত্র।”
“তুমি এই মূল্যবান যন্ত্র কোনখানে পেয়েছ? এইটা দিয়ে কী করে?”
একসাথে দুইটা প্রশ্ন, কীভাবে উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যখন কঠিন হয় তখন তার উত্তর দিতে হয় প্রশ্ন করে। কাজেই আমি সেই টেকনিক শুরু করলাম, বললাম, “আপনি সাইন্টিস কী জানেন?”
“সাইন্টিস?”
“হ্যাঁ।”
“কেন? কী হয়েছে সাইন্টিসের?”
মানুষটা এখন আমার টেকনিক শুরু করেছে। আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে প্রশ্ন দিয়ে। কী মুশকিল! কিন্তু কিছু একটা উত্তর দিতে হবে, তাই বললাম, “আমার মামা হচ্ছে সাইন্টিস, তাই মামা আমাকে এই যন্ত্রটা দিয়েছে গবেষণা করার জন্য।”
মানুষটা আমার কথা বিশ্বাস করল না, বলল, “তুমি এতো ছোট মানুষ, তুমি কেমন করে গবেষণা করবা?” তারপর নাক দিয়ে বাতাস বের করে ঘোত করে একটা শব্দ করল। অবিশ্বাসের শব্দ।
আমি বুঝতে পারলাম এই মানুষটার সাথে কথা চালিয়ে যাওয়া খুব মুশকিল, তাই খামাখা চেষ্টা করে লাভ নাই। আমার এখন এই মানুষটির কাছ থেকে চলে যাওয়াটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি তাই আর কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলাম, সাথে সাথে মানুষটা চিৎকার করে বলল, “খবরদার। খামোশ। নড়বে না, তুমি নড়বে না।”
আমি বললাম, “নড়ব না?”
“না।”
“কেন?”
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মানুষটা তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা লাল রংয়ের মোবাইল ফোন বের করে সেটাতে দুই একটা চাপ দিয়েই কথা বলতে শুরু করল। “হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো হ্যালো আক্কাইস্যা হ্যালো হ্যালো”।
কাউকে ফোন করলে কানেকশান হতে যে সময় লাগে এই মানুষটা সেটা জানে না, ডায়াল করেই সে আক্কাস মানুষটাকে ডাকাডাকি শুরু করেছে। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আক্কাস নামের মানুষটা ফোন ধরল তখন একুশ দাড়ির মানুষটা কথা বলতে শুরু করল, “হ্যালো আক্কাইস্যা, ফোন ধরিস না কেন? কততক্ষণ থেকে ফোন করতেছি। শোন ভালো করে কী বলি, এক্ষুণি আয়, নদীর পাড়ে জঙ্গলের কিনারায় বড় বটগাছের নিচে। একটা ছেমড়া এক অস্ত্র নিয়ে ঘুরতেছে তারে ধরে বেন্ধে নিতে হবে”
আমার চোয়াল স্কুলে পড়ল। বলে কী এই মানুষ? আমাকে ধরে বেন্ধে নিতে হবে? কোথায় ধরে বেন্ধে নিতে হবে? আমি বুঝতে পারলাম আমার আর এই মানুষের কথাবার্তা শোনার দরকার নেই। আমি হাঁটা শুরু করলাম। যদি আসলেই আমাকে ধরার চেষ্টা করে তখন দেখা যাবে কী করা যায়। যদি সত্যি সত্যি দরকার হয় তখন এই মানুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য গাইগার কাউন্টারটাকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করে ভয় দেখানো যেতে পারে।
আমি পিছনের দিকে না তাকিয়ে লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকি। ঠিক তখন শুনতে পেলাম পেছন থেকে কে যেন ডাকলো, “টোপন! তুমি এখানে? আমরা তোমাকে কখন থেকে খুঁজছি।”
আমি পিছন ফিরে তাকালাম, দেখলাম, মাহবুব, ডোরিন আর টনি।
আমার বুকের মাঝে পানি ফিরে এলো। একুশ দাড়ির মানুষটার সাথে আমার আর একা ঝগড়াঝাটি করতে হবে না। আমরা চারজন মিলে এখন এই খ্যাপা মানুষের সাথে তর্ক বিতর্ক করতে পারব।
অবশ্য তার আর দরকার হলো না। আমার সাথে অন্য তিনজন একত্র হওয়ার সাথে সাথেই একুশ দাড়ির মানুষটার উত্তেজনা মিইয়ে গেল। মানুষটা কেমন যেন ম্যাদা মেরে গেল। আমাকে ধরে বেন্ধে ফেলার চেষ্টা না করে মাথা নিচু করে উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করে দিল।