০৪.
পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে রওনা দিয়ে দুপুর বেলা আমরা আমাদের জায়গায় পৌঁছে গেলাম। প্রথমে পাকা রাস্তা, তারপর ইটের রাস্তা তারপর কাঁচা রাস্তা, তারপর কোনো রাস্তাই নাই। সেই খানাখন্দ জঙ্গলের মাঝে মামা ঘটর ঘটর করে তার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত একটা জংলা জায়গায় মামা তার মাইক্রোবাস থামিয়ে বলল, “আগামী কয়েকদিন এইটা আমাদের আস্তানা।”
মামা মাইক্রোবাস থেকে নেমে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল, “জায়গাটা কী সুন্দর দেখেছিস?”
এটা হচ্ছে বড় মানুষদের সমস্যা। দুই চারটা গাছপালা কিংবা একটা নদী কিংবা কয়েকটা গরু ছাগল দেখলেই তারা আহা উঁহু করতে থাকে, বলতে থাকে, কী সুন্দর! কী সুন্দর!
মামাকে খুশি করার জন্য আমিও বললাম, “হ্যাঁ মামা, খুব সুন্দর জায়গা।”
“এখানে নদী আছে, হাওড় আছে, জঙ্গল আছে এবং পাহাড় আছে। একসাথে কখনো এতোগুলো জিনিস পাওয়া যায় না।”
আমি মনে মনে বললাম, “নিশ্চয়ই মশাও আছে এবং জোকও আছে। জোরে জোরে বললাম, “এখন আমরা কী করব মামা?”
“প্রথমে লাঞ্চ করব তারপর কাজ শুরু করে দেব।”
ঠিক কী কারণ জানা নাই মামার সাথে রওনা দেওয়ার পর থেকে আমার খিদে বেড়ে গেছে। কী খাওয়া হবে সেটা নিয়ে এখন আমার অনেক আগ্রহ। জিজ্ঞেস করলাম, “কী লাঞ্চ করব মামা?”
“তোর মা কিছু রান্না করে দিয়েছিল। সেগুলো নিশ্চয়ই পচে গিয়েছে।”
“তাহলে?”
“পাউরুটি আছে।”
আমি শুকনো মুখে বললাম, “আর?”
“আর আরো পাউরুটি।” আমার মুখ দেখে মনে হলো মামার একটু মায়া হলো, বলল, “সাথে একটা ডিম সিদ্ধ করে নিতে পারিস।”
“ডিম?”
“হ্যাঁ।”
“কীভাবে সিদ্ধ করব?”
“মাইক্রোওয়েভ ওভেনে।”
মামা কোথা থেকে একটা পাউরুটির প্যাকেট বের করে সেখান থেকে এক স্লাইস রুটি নিয়ে মহানন্দে চাবাতে চাবাতে তার যন্ত্রপাতি টানাটানি করতে লাগল। আমিও এক স্লাইস রুটি চাবানোর চেষ্টা করলাম, চিবিয়ে নরম করার পরও সেটা গলা দিয়ে নামতে চায় না। কারণটা কী কে জানে?
মামা কাজ করতে করতে কোথা থেকে জানি একটা ডিম বের করে দিল। আমি সেটা মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ঢুকিয়ে ওভেনটা চালু করে দিলাম। মামা কেমন জানি মুচকি হাসি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করে এক দুই তিন করে গুণতে শুরু করল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী গুণছ মামা?”
“দেখি কতোক্ষণ গুণতে হয়।”
“কতোক্ষণ কী গুণতে হয়?”
“তুই নিজেই দেখবি।”
পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত গুণার পর মাইক্রোওয়েভ ওভেনের ভিতর বোমা ফাটার মতো একটা প্রচণ্ড শব্দ হলো। মামা গোণা বন্ধ করে মাইক্রোওয়েভ ওভেনের দরজা খুলে বলল, “এই যে তোর সিদ্ধ ডিম। পুরা মাইক্রোওয়েভে লেপটে গেছে। খিমচে খিমচে খেয়ে নে।” তারপর আনন্দে হা হা করে হাসতে লাগল।
আমি বললাম, “তুমি জানতে ডিমটা বাস্ট করবে?”
“না জানার কী আছে? সবাই জানে।”
“তাহলে আমাকে না করলে না কেন?”
“না করলে কী এই মজাটা হতো?” মামা আমাকে এক টুকরা কাপড় দিয়ে বলল, “নে ওভেনটা পরিষ্কার কর। তা না হলে পচা গন্ধ বের হবে।”
আমাকে ঘষে ঘষে পুরো ওভেনটা পরিষ্কার করতে হলো। মামা তখন আরেকটা ডিম দিয়ে বলল, “নে, এইটা ঠিক করে সিদ্ধ কর।”
“ঠিক করে কীভাবে সিদ্ধ করব?”
“ভেঙে একটা পিরিচে রাখ, কুসুমটা গেলে দে। ইচ্ছা হলে একটা কাপের পানিতে ডিমটা ভেঙে কুসুমটা গেলে দিতে পারিস। যেভাবে ইচ্ছা।”
আমি একটা কাপে পানি রেখে ডিমটা ভেঙে সেখানে দিলাম, তারপর ভয়ে ভয়ে মাইক্রোওয়েভ ওভেন চালু করলাম।
এবারে ওভেনের ভেতর বিকট কোনো শব্দ হলো না। এক মিনিট পরে ওভেন খুলে দেখলাম কাপের ভিতর একটা এবড়োথেবড়ো সিদ্ধ ডিম। দেখে মনে হয় অক্টোপাসের বাচ্চা। দেখতে বিদঘুঁটে হলেও ডিমটা খেতে ঠিক সিদ্ধ ডিমের মতো!
আমি শুকনা রুটি আর বিদঘুঁটে সিদ্ধ ডিম খেয়ে কোনোমতে পেট ভরিয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মামা, আমি এখন কিছু করব?”
“না। তোর এখন কিছু করতে হবে না। যখন করতে হয় বলব।”
“তাহলে কী করব?”
“জায়গাটা ঘুরে দেখতে পারিস। হারিয়ে যাবি না তো?”
“না মামা। এই জঙ্গলে বাঘ ভালুক আছে?”
“থাকার কথা না। থাকলেও তোকে খাবে না। তোর ভয় নাই।”
“আমাকে খাবে না কেন মামা?”
“তুই এতো রোগা পটকা। তোকে খেয়ে পোষাবে না।”
আমি তখন আমার পিঠে ব্যাকপেকটা ঝুলিয়ে ঘুরতে বের হলাম। ব্যাকপেকের ভিতর রাখলাম কিছু জামা কাপড়, একটা গল্প বই, কাগজ কলম আর অস্ত্র হিসেবে একটা পেন্সিল কাটার চাকু।
একটু হাঁটতেই আমি জংলা জায়গাটা থেকে বের হয়ে এলাম। সামনে উঁচু নিচু মাঠ, অনেক দূরে পানি চিক চিক করছে। সূর্যটা বেশ মাথার উপর, রোদটা ভালোই লাগছে। আমি আশপাশে দেখতে দেখতে পানির দিকে এগুতে লাগলাম। চারপাশে নির্জন। এর আগে আমি এরকম নির্জন জায়গা খুব বেশি দেখি নাই। নির্জন জায়গার মনে হয় এক ধরনের ভাব আছে, এখানে অন্য রকম লাগে। আমাকে কেউ দেখছে না তাই আমি যা খুশি তাই করতে পারি। ইচ্ছা করলে খালি গা হয়ে শার্টটা খুলে মাথায় বাঁধতে পারি। তাহলে রোদটাও কম লাগবে। আমি অবশ্য উল্টাপাল্টা কিছু না করে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি। মাঝে মাঝে ঝোঁপ ঝাড় আছে। একটা ঝোঁপ থেকে মনে হলো একটা শেয়াল বের হয়ে খুব সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আরেকটা ঝোপে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটা ছোট মতো জলা জায়গাও আছে সেখানে পৌঁছাতেই চারিদিক থেকে অনেকগুলো ব্যাঙ এক সাথে পানিতে লাফ দিল! আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম। ব্যাঙরা যে এক সাথে লাফ দেয় আমি সেটাও জানতাম না। নানারকম পাখি দেখতে পেলাম, আমি অবশ্য কোনো পাখিকেই চিনি না। কিছু পাখি একেবারে লতাপাতার সাথে মিশে থাকে, দূর থেকে বোঝাই যায় না একেবারে কাছে গেলে ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে যায়।
হেঁটে হেঁটে পানির কাছে পৌঁছানোর পর বুঝতে পারলাম জায়গাটা যেরকম পুরোপুরি নির্জন ভেবেছিলাম এটা সেরকম না। একটা ছোট নদী, পানিটা বেশ নিচুতে সেখানে বেশ কিছু নৌকা, একটা নৌকাতে একজন ছোটখাটো মানুষও আছে।
আমি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নৌকাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নৌকার মাঝি নৌকা থেকে নেমে পানিতে অদৃশ্য হয়ে গেল, একটু পরে ভুস করে ভেসে উঠল, তার হাতে একটা খাঁচার মতো কী যেন। সে খাঁচাটাকে নৌকার উপর রেখে তার ভেতর থেকে চকচকে মাছ বের করে একটা ঝুপড়ির মাঝে রাখে, তারপর আবার খাঁচাটা নিয়ে পানির নিচে অদৃশ্য হয়ে যায়। বেশ অনেকক্ষণ পর সে পানি থেকে ভেসে উঠে। একজন মানুষ যে নিঃশ্বাস না নিয়ে এতক্ষণ পানির নিচে থাকতে পারে আমি সেটাও জানতাম না।
মানুষটা যখন আবার তার নৌকায় উঠে একটা লগি দিয়ে ঠেলে নৌকাটা সামনে আনতে থাকে তখন আমি বুঝতে পারলাম যে মানুষটা আসলে আমার বয়সী একটা ছেলে! খালি গা, একটা লুঙ্গী মালকোচা মেরে পড়েছে। মাথায় একটা লাল গামছা, প্রত্যেকবার পানি থেকে উঠে গামছা দিয়ে শরীর মুছে নিচ্ছে।
নির্জন জায়গায় নদীর তীরে এসে মানুষের মনে নানারকম ভাব আসে। আমার ভিতরেও একটা গভীর ভাব এসে গেল। মনে হলো আহা, এই ছেলেটা আমার বয়সী কিন্তু আমি ভালো জামা কাপড় পরে স্কুলে লেখাপড়া করি কিন্তু এই ছেলেটাকে জীবন বাঁচানোর জন্য মাছ ধরতে হয়, পানিতে ডুবতে হয়। নিশ্চয়ই স্কুলে পড়ে না– আমার মতো সুযোগ পায় না। গভীর ভাবের কারণে আমি বড় মানুষের মতো একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
ছেলেটা আমার কাছাকাছি এসে তার নৌকাটা থামাল, লগিটা পুতে নৌকাটাকে বেঁধে আবার পানিতে ডুবে গেল। আমি যখন প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেছি যে ছেলেটা আর ভেসে উঠবে না তখন সে আবার একটা মাছ ধরার খাঁচা নিয়ে ভুল করে ভেসে উঠল। ভেতরে অনেক মাছ কিলবিল করছে। ভালো করে দেখার জন্য আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম। ছেলেটা পিছন দিকটা খুলে হাত ঢুকিয়ে যখন মাছ বের করছে তখন আমি হঠাৎ করে দেখলাম ভিতরে একটা সাপ কিলবিল করছে। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, “সাপ! সাপ!”
ছেলেটা একটুও ভয় পেল না, আমার দিকে তাকিয়ে হাসল তারপর সাপটাকে খপ করে ধরে বের করে এনে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এইটা সাপ না! এটা বাইম মাছ।”
“মাছ? এইটা মাছ?” আমি একটু অপ্রস্তুত হলাম, বললাম, “দেখতে একেবারে সাপের মতো।”
মাছটাকে ঝুড়ির ভেতর রাখতে রাখতে বলল, “সাপ আরো লম্বা হয়।”
ছেলেটা কিছু মাছ ঝুড়িতে রাখল, কিছু ছেড়ে দিল তারপর আবার পানিতে ডুবে গেল। এবারে আমি ভয় পেলাম না, আমি বুঝে গেছি এই ছেলে পানিতে অনেক সময় ডুবতে পারে। পানি থেকে বের হয়ে গামছা দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে ছেলেটা আমার দিকে তাকালো, বলল, “তুমি কোথায় থাকো?”
আমি কোথায় থাকি বললে কী ছেলেটা সেটা চিনবে? তাই সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলল, “ঐ তো। অনেক দূর।”
ছেলেটা গামছাটা মাথায় বাঁধতে বাঁধতে বলল, “বলতে চাও না?” অনেক দূর মানে কত দূর? কোপেনহেগেন নাকি নিউইয়র্ক?”
আমি খাবি খেলাম। ছেলেটা আমাকে নিয়ে কী সহজে ঠাট্টা করল। দিল্লি নাকি দুবাই না বলে কোপেনহেগেন আর নিউইয়র্ক বলেছে। কোপেন হেগেনের নাম শুনেছি কিন্তু শহরটা কোথায় আমি নিজেও জানি না। আমি আমতা আমতা করে বললাম, “আমি এতদূর বলি নাই। মিরপুর। ঢাকা।”
“আমি মিরপুর গেছি। চিড়িয়াখানা আছে।”
“ও।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কোথায় থাক?”
ছেলেটা আমার মতো করে বলল, “ঐ তো। অনেক দূর।” তারপর হিহি করে হাসল, বলল, “একটু মজা করলাম। আমি কাছেই থাকি। মনে হয় চিনবা না। তিন বাঁক দূরে।”
“বাক? বাঁক মানে কী?”
“একটা নদী যখন একটু বেঁকে যায় সেইটাকে বলে বাক।”
“তার মানে একটা বাক এক কিলোমিটার হতে পারে আবার একশ কিলোমিটার হতে পারে।”
“পারে। তবে আমাদের নদী বাচ্চা নদী, এর বাঁক ছোট ছোট।”
বাহ! কী সুন্দর নদীটাকে বাচ্চা নদী বলল। কথা শুনেই বোঝা গেল নদীটাকে ছেলেটা আদর করে। আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি স্কুলে পড়।”
“পড়ি।” সে তার লগি তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল, “তুমি?”
“আমিও পড়ি।” তারপর বললাম, “আমার অবশ্য লেখাপড়া করতে ভালো লাগে না।”
“লেখাপড়া করতে কারো ভালো লাগে না।” ছেলেটা লগি দিয়ে নৌকাটাকে ধাক্কা দিতে গিয়ে থেমে গেল, বলল, “তুমি কোন ক্লাসে পড়?”
আমি বললাম, “সেভেন। তুমি?”
“এইট।”
আমি আরেকবার খাবি খেলাম। আমার থেকে এক ক্লাস বেশি। একটু আগে আমি ভেবেছিলাম ছেলেটা বুঝি লেখাপড়াই করে না।
ছেলেটা বলল, “সেভেন এইটে আসল লেখাপড়া শুরু হয় না। আসল লেখাপড়া শুরু হয় নাইন থেকে।”
“তুমি কেমন করে জান?”
“আমি নাইন টেনের বই দেখেছি। অনেক কিছু আছে। তবে মনে হয় ভুলভাল আছে।”
আমি আবার খাবি খেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “ভুলভাল?”
“হ্যাঁ। নিউটনের সূত্রটা দেখছিলাম। লেখা হচ্ছে কোনো জিনিসের উপর বল প্রয়োগ করলে ত্বরণ হয়। এই নৌকাটারে লগি দিয়ে ঠেলা দিলে নৌকা নড়ে। ঠিক আছে। কিন্তু বড় একটা বজরাকে আমি কী লগি দিয়ে ঠেলে নড়াতে পারব? বল প্রয়োগ করলাম, ত্বরণ কই?”
ত্বরণ মানে কী আমি জানি না। তবে ছোট নৌকাকে লগি দিয়ে ঠেলা দিয়ে নাড়ানো যায়, বড় বজরাকে নাড়ানো যাবে না এর মাঝে কোনো ভুল নাই। নিউটন সাহেব যদি এইটাই বলে থাকেন তাহলে যে ভুল বলেছেন এর মাঝে কোনো সন্দেহ নাই। ছেলেটাতো ঠিকই বলছে। মনে হচ্ছে এই ছেলে নিজেও ছোটখাটো নিউটন।
আমি বললাম, “স্কুলের স্যারকে জিজ্ঞেস কর না কেন?”
“তুমি ভাবছ জিজ্ঞেস করি নাই?”
“স্যার কী বলেছে?”
“কিছু বলে নাই। কানের মাঝে একটা পাটকান দিয়েছে।”
পাটকান শব্দটা আগে শুনি নাই কিন্তু ছেলেটার কথার ধরন দেখে বুঝলাম চড় কিংবা ঘুষি জাতীয় কিছু হবে। আমি জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে পৃথিবীর সব নিষ্ঠুর স্যারদের উপর বিতৃষ্ণা জানালাম।
ছেলেটা বলে, “তারপরও যখন জিজ্ঞেস করেছি তখন বাপ মা তুলে গালি দিয়ে বলল, তুই পড়িস ক্লাস এইটে নিউটনের সূত্র দিয়ে কী করবি? ধুয়ে পানি খাবি?”
আমি আবার জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করলাম। ছেলেটা যখন লগি দিয়ে আবার ঠেলা দিয়ে নৌকা দিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ আমার একটা কথা মনে হলো, বললাম, “তুমি একটা কাজ করতে পার। আমার মামা হচ্ছে সাইন্টিস” বলেই তাড়াতাড়ি শুদ্ধ করলাম, “মানে সায়েন্টিস্ট। তাকে জিজ্ঞেস করতে পার।”
“তোমার মামা কই?”
“আছে জঙ্গলের মাঝে?”
ছেলেটা অবাক হলো, ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল, “জঙ্গলে কী করে?”
“গবেষণা করে।”
“জঙ্গলে গবেষণা করে?”
“হ্যাঁ। মামার একটা মাইক্রোবাসের মাঝখানে একটা ল্যাবরেটরি আছে। সেই মাইক্রোবাসে মামা থাকে, ঘুমায়, গবেষণা করে। আমিও থাকি।”
ছেলেটা এইবার যথেষ্ট কৌতূহলী হলো। লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটা নদীর তীরে লাগালো, তারপর লগিটা পুতে নৌকাটাকে আটকে নৌকা থেকে নেমে এলো। আমিও নদীর তীর থেকে নিচে নেমে এলাম, দুইজন কাছাকাছি দাঁড়ালাম। সে আমাকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল আমিও তাকে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম।
ছেলেটা বলল, “তার মানে তুমি মনি কাঞ্চনে থাকো না?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “মনি কাঞ্চন? সেটা আবার কী?”
“এটা রিসোর্ট।”
“রিসোর্ট মানে কী?”
“বড় লোকের হোটেল। এক রাতের ভাড়া পঞ্চাশ হাজার টাকা!”
“ধুর! এতো টাকা ভাড়া হয় কেমন করে।”
ছেলেটা গম্ভীর মুখে বলল, “হয়। এর থেকে বেশিও হয়।”
জিজ্ঞেস করলাম, “মনি কাঞ্চনটা কোথায়?”
“যদি হেঁটে যাও, দুই-তিন কিলোমিটার। নৌকাতে গেলে এক বাঁক পার হয়ে একটা হাওড়, হাওড়ের পাড়ে মনি কাঞ্চন। খুব কাছে।”
“তুমি কখনো গিয়েছ?”
ছেলেটা হা হা করে হাসল, তারপর বলল, “তুমি ভাবছ মনি কাঞ্চনে আমারে ঢুকতে দিবে? মনে হয় কাছে গেলেই আমারে গুলি করে দেবে।”
“গুলি করে দিবে?”
“মনে হয়। মনি কাঞ্চনের চারিদিকে দারোয়ানরা মেশিন গান নিয়ে ঘুরে।”
“মেশিন গান? ধুর।”
“বিশ্বাস কর না? তুমি একদিন গিয়ে দেখে আস।”
“আমি তো চিনি না।”
“ঠিক আছে আমি নিয়ে যাব। বেশি কাছে কিন্তু যাওয়া যাবে না। দূর থেকে দেখতে হবে।”
ছেলেটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “তাহলে তোমার মামা আমাকে নিউটনের সূত্র বোঝাতে পারবে? বকা দিবে না তো?”
“না। বকা দিবে না, কিন্তু অন্য ঝামেলা হতে পারে।”
ছেলেটা চিন্তিত মুখে বলল, “অন্য কী ঝামেলা?”
“তুমি জিজ্ঞেস করবে নিউটনের সূত্র। মামা নিউটন শেষ করে গ্যালেলিও, গ্যালেলিও শেষ করে আইনস্টাইন, আইনস্টাইন শেষ করে কাইনস্টাইন, কাইনস্টাইন শেষ করে টাইনস্টাইন সবার সূত্র বুঝিয়ে দেবে। তোমার বারোটা বেজে যাবে। সেইজন্য আমরা কখনো মামাকে সাইন্স নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করি না।”
ছেলেটা হি হি করে হাসল, বলল, “কানের উপর পাটকান না দিলেই হলো।”
“না। সেইটা কখনো দিবে না।”
“ঠিক আছে, আজকে বিকাল বেলা আসব।”
“খুঁজে পাবে?”
“জঙ্গলের মাঝে কী আর দশটা মাইক্রোবাসের ল্যাবরেটরি থাকবে? আমি খুঁজে বের করে ফেলব।”
“ঠিক আছে তাহলে।” আমি চলে যেতে যেতে থেমে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি এখন কী করবে?”
“আমার আরো দুইটা ঝাঁকা পানির তলা থেকে তুলতে হবে। তারপর বাড়ি যাব।” ছেলেটা হঠাৎ থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কী করবে?”
“আমি একটু জায়গাটা ঘুরে দেখব।”
“তুমি সাঁতার জান?”
“জানি।”
“তাহলে তুমি আমার সাথে নৌকায় একটু ঘুরতে পার।”
“সত্যি?” আমি খুশি হয়ে বললাম, “নিবে আমাকে?”
“নিব না কেন? আস।”
আমি ছেলেটার সাথে নৌকায় উঠলাম। নৌকাটা একটু দুলে উঠল, মনে হলো পড়ে যাব কিন্তু শেষ পর্যন্ত পড়লাম না। ছেলেটা লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকাটাকে নদীর মাঝে নিয়ে এসে বৈঠা হাতে নৌকা বাইতে শুরু করল।
আমি বললাম, “আমাকে নৌকা চালানো শিখাবে?”
“এর মাঝে শিখানোর কিছু নাই। চেষ্টা করবে শিখবে।”
“একটু চেষ্টা করি?”
“কর।” বলে সে নৌকার পিছনে বৈঠাটা রেখে সামনে চলে এলো, আমি সাবধানে পিছনে গিয়ে বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা বাওয়ার চেষ্টা করলাম। প্রথমে সেটা সামনে না গিয়ে ঘুরে যেতে লাগল। আমি বললাম, “কী হলো ঘুরে যায় কেন?”
ছেলেটা বলল, “আমি বলে দিতে পারি, কিন্তু তাতে লাভ হবে না। তোমার নিজের আবিষ্কার করতে হবে।”
কাজেই বেশ খানিকক্ষণ চেষ্টা করে আমি নিজে আবিষ্কার করলাম কেমন করে নৌকা বাইতে হয়। যখন সত্যি সত্যি শিখে ফেললাম তখন এতো আনন্দ হলো সেটা আর কী বলব। তবে বৈঠা বাইতে যে এতো পরিশ্রম সেটা আমি জানতাম না। একটু খানি যেতেই মনে হলো জান বের হয়ে যাচ্ছে।
আমার অবস্থা দেখে ছেলেটা হাসল, মাথা নেড়ে বলল, “তোমাদের শহরের ছেলেদের এই হচ্ছে সমস্যা। গায়ে কোনো জোর নাই।”
আমি বললাম, “দিনরাত ঘরের ভিতরে বসে থাকলে জোর হবে কেমন করে? আমাদের স্কুলে খালি বিল্ডিং- একটা খেলার মাঠও নাই!”
“আমাদের উল্টা। খালি মাঠ। বিল্ডিং নাই।”
আমি দাঁতে দাঁত চেপে আরো খানিকক্ষণ নৌকা বেয়ে নিলাম। তখন ছেলেটা বলল, “থামো এইখানে। আমার ঝাঁকাটা তুলি।”
আমি নৌকা থামালাম। ছেলেটা তার জায়গাটা খুঁজে বের করে নৌকাটাকে সেখানে নিয়ে গেল। লগিটা পুতে সে যখন পানিতে নামবে তখন আমি বললাম, “আমিও পানিতে নামি?”
“নামতে চাইলে নাম।”
“আমি দেখি পানির নিচে তুমি কী কর!”
“কিছুই দেখবে না। পানি ঘোলা আর পানির নিচে দেখা যায় না।”
“যেটুকু দেখা যায়!”
“ঠিক আছে।”
আমি শার্টটা খুলে ছেলেটার সাথে পানিতে নামলাম। নদীর পানি উপরে মোটামুটি কুসুম কুসুম গরম নিচে কনকনে ঠান্ডা। ছেলেটা মাথা নিচের দিকে দিয়ে তলিয়ে গেল আমি চেষ্টা করেও নিচে নামতে পারলাম না, যখনই চেষ্টা করি উপরের দিকে ভেসে উঠি। বুঝতে পারলাম পানির তলায় যাওয়া এতো সোজা না।
ছেলেটা মাছের খাঁচাটা তুলে আনল, ভেতরে বেশ কিছু মাছ। এবারে মাছের সাথে একটা কাঁকড়াও আছে। সাপের মতো দেখতে একটা মাছও ছিল কিন্তু এটাকে সে পানিতে ছেড়ে দিল। বাইম মাছের মতো দেখালেও এটা নাকি বাইম মাছ না, এটার নাম কুইচ্যা। কুইচ্যা মাছ নাকি খায় না! বাইম মাছ খাওয়া গেলে কুইচ্যা মাছ কেন খাওয়া যাবে না আমি বুঝতে পারলাম না।
নৌকায় উঠে আমিও ছেলেটার গামছা দিয়ে শরীর মুছে নিলাম। প্যান্টটা ভেজা তাই শার্ট না পরে ছেলেটার মতো খালি গায়ে বসে রইলাম। ছেলেটা আবার নৌকা ছেড়ে দিল। পরের ঝকার কাছে পৌঁছে সে আবার নৌকা থামাল। আমি বললাম, “এইবার আমি একা নামব। দেখি তোমার ঝকা তুলতে পারি কি না।”
ছেলেটা বলল, “ঠিক আছে। নামো।”
“জায়গাটা দেখিয়ে দাও।”
“এই লগিটা যেখানে পুতেছি, তার কাছে। যাও, নামো।”
আমি আগে আগে নামছিলাম সে আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়ে হি হি করে হাসতে লাগল। আমি তখন মাথা নিচে দিয়ে পানিতে ডুব দিলাম। যদি আমার বাসার কেউ দেখতে আমি নদীর পানিতে এভাবে ঝাঁপ দিয়ে পানির নিচে চলে যাচ্ছি তাহলে এতোক্ষণে নিশ্চয়ই ভয়ে চিৎকার করতে করতে হার্টফেল করে ফেলত! নিচে কনকনে ঠান্ডা পানি আমি বেশিদূর নামতে পারলাম না, ভুস করে ভেসে উঠলাম। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার নিচে নেমে গেলাম, এবার মনে হয় আরো নিচে নামতে পারলাম, হাত দিয়ে আঁকাটাকে খুঁজতে থাকি। নরম কাদার মাঝে হাত লাগল, মনে হলো পিছল মতন কিছু একটা হাতের উপর দিয়ে চলে গেল। অন্য কোনো সময় হলে নির্ঘাত ভয়ে চিৎকার করে উঠতাম, আজকে কিছুই করলাম না। হাতটা নাড়াতে থাকলাম, হঠাৎ করে একটা আঁকা হাতে লাগল। টেনে তোলার আগেই মনে হলো নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাব, তাই আঁকা ছাড়াই উপরে উঠে এলাম। ছেলেটা একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী অবস্থা? পারবে? নাকি আমি নামব?”
“পারব। আর একবার।” আমি বড় বড় করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ডুবে গেলাম। এবারে সত্যি সত্যি খাঁচাটা একবারে পেয়ে গেলাম তারপর সেটা টেনে উপরে নিয়ে এলাম।
ছেলেটা আমাকে দেখে হাততালি দিয়ে বলল, “বাহ! বাহ্! এই তো শিখে গেছ!”
আমি খাঁচাটা নৌকার ওপর রেখে নিজেকে টেনে নৌকার ওপর তুলে খানিকক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, “দাও, আমি মাছগুলো বের করি।”
“পারবে?”
“কেন পারব না?”
“ছেলেটা ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, ভেতরে মনে হয় একটা শিং মাছ আছে। শিং মাছ ঘা দিলে কিন্তু খুব ব্যথা। বিষাক্ত।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোনটা শিং মাছ?”
“ঐ যে কালো মাছটা। দুই পাশে বিষাক্ত কাটা। দাঁড়াও এইটা আমি বের করে দিই। তুমি অন্যগুলো বের করো।”
ছেলেটা খুব কায়দা করে শিং মাছটার মাথাটা কীভাবে জানি চেপে ধরে টেনে বের করে ঝুপড়ির ভেতর রেখে দিল। আমি অন্য মাছগুলো বের করলাম। একটা দুইটা মাছের রং কী সুন্দর। ছেলেটা বলল, এই মাছগুলোর বিয়ে হচ্ছে তাই নাকি তাদের এতো সুন্দর রং। কী আশ্চর্য, মাছদেরও বিয়ে হয়! গায়ে হলুদ হয়!
একদিনে কতো কী মজার জিনিস জেনে গেলাম।
সব মাছ বের করার পর ছেলেটা খাঁচাটা আবার পানির নিচে রাখার জন্য নদীতে ঝাঁপ দিল। আমি তার গামছা দিয়ে শরীরটা মোছার চেষ্টা করছি ঠিক তখন একটা মেয়ের গলা শুনতে পেলাম, “এই যে মাঝি।”
আমি চমকে উঠলাম, কে কথা বলে? নদীর তীরে তাকিয়ে দেখি সেখানে একটা নাদুসনুদুস ছেলে আর একটা টিসটাস মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনই আমাদের বয়সী কিংবা এক দুই বছর বড়। দুজনেই ফর্সা কিন্তু নিশ্চয়ই রোদে হাঁটাহাঁটি করার অভ্যাস নাই, তাই রোদে, গরমে, ঘামে লাল হয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে তাকালাম, আমাকেই মাঝি বলে ডাকছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। আমার জীবনে আমাকে অনেক কিছু বলে ডাকা হয়েছে (যার বেশির ভাগই মোটামুটি অসম্মানজনক) কিন্তু এর আগে কখনোই কেউ আমাকে মাঝি বলে ডাকে নাই। আমি নিজের দিকে তাকালাম, সারা শরীরে কাদা, খালি গা, মাথায় শার্টটা বেঁধে রেখেছি, জামা কাপড় ভিজা। কাজেই কেউ যদি আমাকে মাঝি বলে ডাকে অবাক হবার কিছু নাই।
মেয়েটা আবার ডাকলো, “মাঝি, এই মাঝি।”
আমি বললাম, “আমাকে ডাকছ?”
নাদুসনুদুস ছেলেটা মুখ ভ্যাংচে বলল, “আর কাকে ডাকব? আর কে আছে এইখানে?”
খুবই সত্যি কথা। এইখানে অবশ্য আরো একজন আছে যে এই মুহূর্তে পানির নিচে খাঁচাটা বসাচ্ছে সেটা অবশ্য তাদের জানার কথা না। সেই মুহূর্তে ছেলেটা পানির নিচ থেকে ভুস করে ভেসে উঠল, নাদুসনুদুস ছেলে আর টিসটাস মেয়েটা একটু চমকে উঠল। পানির নিচে কেউ এতক্ষণ ডুবে থাকতে পারে সেটা তাদের জানার কথা না। আমি নিজেও আগে জানতাম না।
ছেলেটা ভেজা শরীরে নৌকায় উঠে একবার আমার দিকে তাকালো তারপর তীরে দাঁড়ানো নাদুসনুদুস ছেলে আর টিসটাস মেয়ের দিকে তাকাল, তারপর আবার আমার দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”
আমি বললাম, “এরা মাঝির সাথে কথা বলতে চায়।”
ছেলেটার চোখে কৌতুক ঝিলিক করে উঠল। নৌকাটায় উঠতে উঠতে নাদুসনুদুস ছেলে আর টিসটাস মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি হেড মাঝি।” আমাকে দেখিয়ে বলল, “এ হচ্ছে আমার এসিস্টেন্ট। বল, কী বলতে চাও।”
মেয়েটা বলল, “আমরা হারিয়ে গেছি।”
আমার কেন জানি হাসি পেয়ে গেল, কষ্ট করে হাসি থামিয়ে বললাম, “কে বলেছে তোমরা হারিয়ে গেছ? এই যে তোমরা আমাদের সামনে! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।”
মোটাসোটা ছেলেটা গরম হয়ে বলল, “ঠাট্টা করবে না। আমরা মনি কাঞ্চন যাচ্ছিলাম এখন রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না।”
মনি কাঞ্চন শুনেই আমাদের হেড মাঝি তার মাথা মোছা বন্ধ করে আমার দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকাল। তার চোখের দৃষ্টির অর্থ যা কিছু হতে পারে, আমি ধরে নিলাম সে বলছে, “এরা হচ্ছে সেই বড়লোকের বাচ্চা যারা পঞ্চাশ হাজার টাকার হোটেলে থাকে। এদের শরীরের চামড়া মাখনের মতো নরম, জোছনার আলোতে সেই চামড়া পুড়ে যায়।
ছেলেটা অধৈর্য হয়ে বলল, “মনি কাঞ্চন কীভাবে যেতে হয় জান?”
“জানি। যদি হেঁটে যেতে চাও অনেক দূর। কমপক্ষে তিন চার কিলোমিটার। নৌকায় গেলে কাছে। এই বাঁকটা পার হলেই হাওড়, হাওড়ের পাড়ে।”
মেয়েটা বলল, “আমাদের নৌকা করে মনি কাঞ্চনে পৌঁছে দাও।”
আমি একটু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম, অনুরোধ নয় আবার আদেশও নয়। একটা দাবী। আমাদের উপর যেন তার একটা অধিকার আছে। আমি ভেবেছিলাম আমাদের হেড মাঝি সরাসরি না বলে দেবে কিন্তু সে না বলল না। আমার দিকে একবার তাকালো তারপর নাদুসনুদুস ছেলে আর টিসটাস মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “সাঁতার জান?”
মেয়েটা বলল, সুইমিং পুলে জানি।”
“নৌকা ডুবে গেলে সাঁতরাতে পারবে?”
নাদুসনুদুস ছেলেটা কেমন যেন ভয় পেয়ে বলল, “নৌকা কেন ডুবে যাবে?”
“আমি বলি নাই ডুববে, বলেছি যদি ডুবে যায়।”
মেয়েটা বলল, “কেন ডুবে যাবার কথা বলছ?”
“দেখ, আমার নৌকা ঘোট। তোমাদের যদি নৌকায় উঠার অভ্যাস না থাকে, ওঠে যদি নড়াচড়া করো নৌকা কাত হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া তোমাদের মনি কাঞ্চনের একটা বেয়াদব স্পিডবোট আছে, সেটাতে মাস্তানেরা ঘুরে বেড়ায়। সেটার বিশাল ঢেউ হয়, সেটা যদি নৌকার গা ঘেষে যায় তবে যা কিছু হতে পারে। সেই জন্য”
মেয়েটা কোনো কথা বলল না। নাদুসনুদুস ছেলেটা বলল, “আমরা খুব সাবধানে থাকব।”
ছেলেটা লগি দিয়ে নৌকাটাকে তীরের কাছে নিয়ে বলল, “নাও। উঠো নৌকায়।”
ছেলেটা আর মেয়েটা জুতা খুলে পানিতে পা ভিজিয়ে নৌকায় উঠল। তারা নৌকার মাঝামাঝি বসেছে, আমি পিছনে বসেছি।
ছেলেটা লগি দিয়ে ঠেলে নৌকাটাকে নদীর ভেতরে দিয়ে বৈঠা হাতে তুলে নিল। নৌকার গলুইয়ে আরো একটা বৈঠা ছিল আমি সেটা হাতে নিয়ে নৌকা বাইতে সাহায্য করতে লাগলাম।
একটু পরেই ছেলে আর মেয়েটি নিজেদের ভিতরে কথা বলতে শুরু করল। আমরা যেন বুঝতে না পারি সেইজন্য ইংরেজিতে বলছে, ছেলেটা বলল, “এদের কতো টাকা ভাড়া দিতে হবে?”
মেয়েটা বলল, “জানি না।”
“আগে থেকে ঠিক করে নেয়া উচিত ছিল। পরে অনেক বেশি চাইবে।”
“চাইলে চাইবে।”
আমি বললাম, “এই ছেলে আর মেয়ে। তোমরা ইংরেজি ছাড়া আর কোনো ভাষা জানো?”
মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
কারণ, “আমরা ইংরেজি জানি। তোমরা কী বলছ আমরা বুঝতে পারছি।”
নাদুসনুদুস ছেলে আর টিসটাস মেয়ে কেমন যেন চমকে উঠল, নৌকা বাইতে বাইতে আমাদের হেড মাঝি হা হা করে হেসে বলল, “তোমাদের কোনো টাকা দিতে হবে না। আমরা টাকার জন্য তোমাদের মনি কাঞ্চন নিয়ে যাচ্ছি না।”
নাদুসনুদুস ছেলেটা বলল, “তাহলে কী জন্যে নিয়ে যাচ্ছ?”
আমি বললাম, “হাওড়ের মাঝখানে নিয়ে তোমাদের ছিনতাই করার জন্য।”
মেয়েটা হেসে ফেলল, বলল, “যাও। ঠাট্টা করো না।”
আমাদের হেড মাঝি বলল, “তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি কারণ তোমরা বিপদে পড়েছ সেইজন্য।”
ছেলেটা মুখ গোঁজ করে বসে রইল, মেয়েটা বলল, “থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।”
আমি বললাম, “আগেই এতো থ্যাংক ইউ দিও না। তোমাদের মনি কাঞ্চনের গার্ডেরা নাকি মেশিনগান হাতে নিয়ে পাহারা দেয়। দূর থেকে আমাদের দেখে মেশিনগান দিয়ে গুলি না করে দেয়।”
আমার কথা শুনে মেয়েটা আবার হি হি করে হাসল। মেয়েটা হাসিখুশি, ছেলেটা ভোতা। নৌকা করে যেতে যেতে মেয়েটা আমাদের সাথে কথাবার্তা বলল, আমরা যে আসলে মাঝি না তাদের মতো স্কুলে পড়ি ব্যাপারটা টের পেয়ে একটু লজ্জাও পেল। আমি এখন জঙ্গলে একটা মাইক্রোবাসের ভিতরে ল্যাবরেটরিতে থাকি শুনে খুব অবাক হলো। জায়গাটা ঠিক কোথায় জেনে নিল। বেশ কয়েকবার বলল, সে দেখতে আসবে। নাদুসনুদুস ছেলে অবশ্য কোনো উৎসাহ দেখাল না।
নদীর বাঁকটা ঘুরতেই আমি দূরে মনি কাঞ্চন দেখতে পেলাম। দূর থেকে একেবারে রাজপ্রাসাদের মতো মনে হয়। পুরো এলাকাটা ঘিরে মনে হয় অনেক রকম গার্ড, নিশ্চয়ই বাইনোকুলার দিয়ে দেখে। দূরে আমাদের নৌকাটা দেখামাত্র তারা সেই বেয়াদব স্পিডবোটে করে আমাদের দিকে রওনা দিল, স্পিডবোটে একজন একটা অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, দেখে মনে হয় সত্যিই গুলি করে দেবে। স্পিডবোটটা কাছাকাছি আসার আগেই তাদের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল যেন ঢেউয়ের জন্য ঝামেলা না হয়। কাছাকাছি এসে গার্ডগুলো টিসটাস মেয়ে আর নাদুসনুদুস ছেলের খোঁজ খবর নিল। তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইল। তারপর খুব সাবধানে তাদেরকে স্পিডবোটে তুলে নিল। আমাদের দুইজনের দিকে একবার ঘুরেও তাকালো না, আমাদেরকে দেখেছে কিনা সেটাও বুঝতে পারলাম না।
স্পিডবোটটা যাবার সময় পুরো ইঞ্জিন চালিয়ে গর্জন করে চলে গেল, তার ঢেউয়ে আমাদের ছোট নৌকা দুলতে লাগল, দুলতে দুলতে ডুবে গেলেও এখন তাদের আর সমস্যা নেই। তাদের মনি কাঞ্চনের গেস্টদের তারা তুলে নিয়েছে। ঢেউ কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমরা আবার বৈঠা তুলে নিয়েছি। দূর থেকে স্পিডবোটের মেয়েটা একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, আমিও হাত নাড়লাম। হেড মাঝি ছেলেটা হাত নাড়ল না, চাপা গলায় বলল, “বড় লোক হওয়ার কত সমস্যা দেখছ?”
সমস্যাটা কী আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু তারপর মাথা নেড়ে মেনে নিলাম যে বড় লোক হবার অনেক সমস্যা।
ঠিক যেখান থেকে আমি নৌকায় উঠেছিলাম ছেলেটা আমাকে সেখানে নামিয়ে দেল। আমি আবার ব্যাকপেকটা নিয়ে ঠিক চলে যাবার আগে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নামটা জানা হয় নাই। হেড মাঝি ডাকব নাকি আরো নাম আছে?”
ছেলেটা হাসল, বলল, “হেড মাঝি ডাকতে পার, সমস্যা নাই। তবে আমাকে সবাই মাহবুব ডাকে। তোমার?”
“আমার নামটা খুবই জঘন্য। এসিস্টেন্ট মাঝিই ভালো।”
ছেলেটা আবার হাসল, তারপর বলল, “জঘন্য নামটাই শুনি।”
“টোপন।”
“টোপন? কী সুন্দর নাম, জঘন্য বলছ কেন?” আমি আর কিছু বললাম না। এইভাবে আমার সাথে হেড মাঝি মাহবুবের পরিচয় হলো।