১০.
দেবনাথের খোঁজে গিয়ে যখনই ব্যর্থ হয়েছে, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে যামিনী। এমনকী কয়েক বছর হল, মৃতদেহ শনাক্ত করার ডাক পেলেও কামনা করেছে, যেন দেবনাথই হয়। হারিয়ে যাওয়ার থেকে মৃত্যু ভালো। মৃত্যুতে শোক আছে, হারিয়ে যাওয়ার মতো অপমান নেই। মৃত্যুতে শেষ আছে। হারিয়ে যাওয়ার কোনও শেষ নেই। অনন্তকাল ধরে কুরে কুরে খায়।
এই প্রথম স্বামীর খোঁজে ব্যর্থ হয়ে দারুণ খুশি হল যামিনী। দুপুরে শহিদ বলরাম কলোনি থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার মনে হচ্ছিল, শরীর হালকা হয়ে গেছে। সে উড়ে যেতে পারে! খারাপ পাড়ার অশ্লীল গালি, আবর্জনার দুর্গন্ধ, পথ জুড়ে পড়ে থাকা নোংরা জল যেন কিছুই নয়! এমনকী নাকে শাড়ির আঁচল পর্যন্ত চাপা দিতে হয়নি তাকে।
পুকুরঘাটে বসে থাকা মহিলারাই যামিনীকে সাতাশ বাই দুই-এর পথ দেখিয়ে দেয়। রিকশাচালকের বারণ করা সেই বাঁহাতের পথটাই ছিল। যামিনী ধীর পায়ে হেঁটে পৌঁছে যায়। দ্রুত। বিবর্ণ দোতলা বাড়ি একটা। টিনের চাল। বারান্দায় সারি দিয়ে শুকোতে দেওয়া আছে শাড়ি, ব্লাউজ, ব্রা, ফ্রক। ফ্রক কার? দেবনাথের মেয়ের শরীর কেঁপে ওঠে যামিনীর। পাঁচ বছর ধরে এখানে থাকে দেবনাথ! মঞ্জু মেয়েটা এখানেই শরীর বেচে! দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শান্ত করে যামিনী। সে প্রতিজ্ঞা করে এসেছে, কোনওভাবে ভেঙে পড়বে না। কিছুতেই নয়। দেবনাথকে খোঁজার ব্যাপারে কোনও ছলছাতুরিও করবে না। যদি প্রথমেই তার সঙ্গে দেখা হয় তা হলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই কটা কথা বলবে। কান্না পেলে আটকানোর চেষ্টা করবে। আটকাতে না পারলে আর কী হবে, কাঁদতে কাঁদতেই বলবে।
কেমন আছ তুমি? আমাকে কি ভেতরে একটু বসতে দেবে? এটা তোমার কেমন ছেলেমানুষি? নাকি এটাও তোমার রসিকতা? এখানে আছ আমাদের জানাবে না একবার! একটা ফোন করতে কী হয়েছিল? আমি কি জোর করে ধরে নিয়ে যেতাম? তুমি কি ছেলেমানুষ যে জোর করলেই মেনে নিতে? নাকি আমার বয়স হয়নি। তোমার কোনটা পছন্দ বুঝতে পারব না? ছেলেমেয়ে দুটো পাঁচ বছর ধরে চিন্তা করে। যাক, তোমার বউ কোথায়? মেয়েকে একবার ডাকবে? হুট বলতে অফিসে যাওয়া বন্ধ করলে কেন? খারাপ মেয়ের সঙ্গে সংসার বাঁধার লজ্জায়? দুর, খারাপ ভালো ওভাবে মাপা যায় নাকি? এই দেখ না তোমার অফিসের অর্ধেন্দু দত্ত…।
আর যদি দেবনাথের বদলে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়? তাও ঠিক করা ছিল যামিনীর। কোনও লুকোচাপা নয়, একেবারে সরাসরি অনুরোধ করবে। অনুরোধ করা ছাড়া আর অন্য কী পথই বা আছে তার?
দেখুন ভাই, আমি একজনকে খুঁজছি। তিনি আমার স্বামী। পাঁচ বছর হল তিনি নিরুদ্দেশ। কদিন আগে শুনলাম, পাঁচ বছর হল এক ভদ্রলোক আপনার কাছে এসে রয়েছেন। যতদূর শুনেছি তিনি আপনার স্বামী। আমি শুধু অনুরোধ করব, ওই মানুষটার সঙ্গে আপনি একবার আমাকে দেখা করিয়ে দিন। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আমি কেন একথা বলছি। আমার সন্দেহ দূর হোক। যদি কথা না বলাতে চান তাহলে দূর থেকে দেখান। তবু দেখান। আমি কথা দিচ্ছি, কোনওরকম জোরজবরদস্তি করব না। করার অধিকার বা ইচ্ছে কোনওটাই আমার নেই। আমি খুব ক্লান্ত। একজন মহিলা হিসেবে আর একজন মহিলার এই অনুরোধ আপনি রাখবেন এই আশা কি আমি করতে পারি না?
দুটো ভাবনার একটাও মিলল না।
বাড়ির সামনে দাঁড়ানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে একজন পুরুষ মানুষ বেরিয়ে এল। গায়ে ময়লা পাজামা পাঞ্জাবি। কাঁধে ঝোলা ধরনের ব্যাগ। পাট করে চুল আঁচড়ানো। বুকটা ধক করে উঠেছিল যামিনীর। ডান হাত মুঠো হয়ে গেল। না, এ সেই মানুষ নয়। যামিনীর সাজ-পোশাক দেখে মানুষটার বোধহয় সন্দেহ হয়। কাছে এসে দাঁড়ায়।
কাকে চান?
ঢোঁক গিলে যামিনী বলল, আমি একজনকে খুঁজছি। এই বাড়িতে থাকেন।
কাকে? মানুষটা বিরক্ত গলায় বলে।
মঞ্জু নামে একজনকে।
হ্যাঁ, উনি আমার স্ত্রী। কী ব্যাপার বলুন।
বড় করে শ্বাস ফেলল যামিনী। দম বন্ধ করে থাকার পর যেন অনেক দিন পরে নিশ্বাস নিতে পারল। সামান্য হেসে বলল, কোনও ব্যাপার নয়। উনি কখন ফিরবেন?
লোকটা আরও বিরক্ত হল। বলল, জানি না। কাজে গেছে। আজ না-ও ফিরতে পারে। মোবাইলটা ফেলে গেছে, নইলে জেনে বলে দিতাম। কী দরকার আমাকে বলুন।
যামিনী বলল, তেমন কিছু নয়, আসলে উনি আমার কাছ থেকে কিছু টাকা পেতেন, বেশি নয়, এই শ তিনেক। ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে যামিনী বলল, বলবেন, যামিনী টাকাটা দিয়ে গেছে। যামিনী চিনতে না পারলে বলবেন দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী।
বাস এবং ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল যামিনীর। তার মধ্যেই ফোনে বিশাখা এবং হিন্দোলের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।
হিন্দোল ট্যুরে নর্থ বেঙ্গল। শিলিগুড়ি না জলপাইগুড়ি। সেখান থেকেই চিৎকার করে বলল, আমি যাদবের মাথা ভাঙব। ছি ছি।
যামিনী বহুদিন পর প্রাণ খুলে হাসল। বলল, কী যে বল হিন্দোল, আমি তো ঠিক করেছি ওকে মিষ্টি খাওয়াব। ভুল খবর দেওয়ার উপহার।
বাড়ি এসে লক খুলে ঘরে ঢুকল যামিনী। ছেলেমেয়ে কাউকে না দেখে চিন্তিত হল। সামান্য। নীলকে নিয়ে চিন্তা নয়। চিন্তা মেয়েটাকে নিয়ে। মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নীলই বা আজ এত দেরি করছে কেন? এই সপ্তাহে তো কাজ নেই। সেক্টর ফাইভে যেতে হয়নি। পরের সপ্তাহ থেকে নাকি লম্বা ডিউটি হবে। দুটো শিফটেও কাজ করতে হবে। নীল সেদিন বলল, চাকরির জন্য ভিক্ষা চেয়ে লাভ কী? শুধু শুধু অপমানিত হওয়া। পরীক্ষা দিয়ে ঠিক একটা কিছু পেয়ে যাব। ততদিন এই ফুরনের কাজই ভালো। টাকা তো মন্দ নয়। কথাটা ঠিক বলেছে। ছেলেটা শান্ত হয়েছে। মা বা বোনের মতো চট করে রেগে যায় না। বুদ্ধিও আছে। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক জীবন পেলে লেখাপড়াতেও ভালো করত। সেদিন বলল, কিঙ্কিকে মামার কাছে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও মা। ওকে নিয়ে ভয় হচ্ছে। তুমি বুঝিয়ে বললে মামা না করবে না। মামার যত প্রবলেম এখানে আসা নিয়ে। কিঙ্কির যাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে না। আর একবার। চলে গেলে নিজে ঠিক কিছু করে নিতে পারবে। তুমি কথা বল মা। এটাও ভালো পরামর্শ।
অনেকক্ষণ সময় নিয়ে স্নান করল যামিনী। সাবান মাখল ভালো করে। আজ অনেকটা সময় নোংরা জায়গায় কেটেছে। জলে ভেজা গায়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যামিনী নিজের ওপর রেগে গেল। কী করে সে ভেবেছিল দেবনাথের মতো সুন্দর একজন মানুষ অমন বিশ্রী একটা কাজ করবে! ছি ছি। যদি কোনওদিন লোকটা ফিরে এসে শোনে, যামিনী রেড লাইট এলাকায় তাকে খুঁজতে গিয়েছিল? কী ভাববে? ছি ছি। গা মুছতে মুছতে যামিনী শুনতে পেল, বাইরে দুটো ফোনই বাজছে। মোবাইল আর ল্যান্ড ফোন। আর ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে, এক্ষুনি বিছানায় শুয়ে পড়ি।
কিঙ্কিনির খবরটা এল মোবাইলে। থানার সেকেন্ড অফিসার ফোন করেছে। বড়বাবু থানায় ছিলেন না। টহলে গিয়েছিলেন। রাতে ফিরে এসে চিনতে পেরেছেন। হারিয়ে যাওয়া দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে। কিঙ্কিনি থানার বেঞ্চ বমি করে ভাসিয়ে তার ওপরেই শুয়ে আছে। বড়বাবু বলেছেন, মেয়ের মা যেন এখনই থানায় এসে বন্ড লিখে মেয়েকে নিয়ে যায়। এই মেয়েকে হাসপাতালে ভরতি করতে না পারলে বিপদ আছে। মনে হচ্ছে, ডি হাইড্রেশন শুরু হয়েছে। পুলিশ এসব ঝামেলা নিতে পারবে না।
অন্য ফোনটা এসেছে সোনারপুরের এক নার্সিংহোম থেকে। সেই ফোনে শ্রীময়ী নামে। এক অচেনা তরুণী হাউ হাউ করে কাঁদছে আর বলছে, আপনি এক্ষুনি আসুন, এক্ষুনি আসুন। নীলাদ্রি মরে যাচ্ছে, নীলাদ্রি মরে যাচ্ছে…।
যামিনী ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মতো। তার গা মাথা থেকে টুপ টুপ করে জলের ফোঁটা ঝরে পড়ছে। সে কী করবে? এই বিপদে কার কাছে যাবে? এমনকী একটা মানুষও আছে যে ছুটে গিয়ে তার ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে পারবে?
.
রিকশা থেকে যে মানুষটা নামল সে কে? চেহারা উদ্ভ্রান্তের মতো। কঁচা পাকা উসকোখুসকো চুল। গাল ভরতি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চশমার উঁটিটা একপাশে ভাঙা। স্ট্র্যাপ ছেঁড়া কাঁধের ব্যাগটা চেপে ধরা আছে বুকের কাছে। নামার সময় মানুষটা সাবধানে হাতলটা ধরল। মনে হয় বাঁ-হাতটায় কোনও ব্যথা আছে।
রিকশাওলাকে নীচু গলায় বল, ভাই, কটা বাজে বলতে পারো?
না, সঙ্গে ঘড়ি নেই।
মানুষটা আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, মনে হয় দেরি হয়ে গেছে। রিকশা চলে গেছে। মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে নিঝুম অন্ধকারে। সে কোন বাড়িতে যাবে?
মানুষ নিখোঁজ এর ঘটনা নিয়ে একদম অন্যরকম স্বাদের উপন্যাসটি ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ লেখককে।