০৩.
যামিনী দূর থেকেই দেখতে পেল স্কুলগেটের একপাশে বিশাখা দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে, কারও জন্য অপেক্ষা করছে।
এই সময়টা স্কুলে সবথেকে হই-হট্টগোলের সময়। গেটের কাছে ঠাসাঠাসি অবস্থা। মেয়েরা হুড়োহুড়ি করে ঢুকছে। ছোট ছোট দল পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মায়েরা। চোখেমুখে গভীর উদবেগ। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে অকারণ উদবেগ। কেউ কেউ টিচার দেখলে পড়িমড়ি করে ছুটে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে জানে না। কিছু বলার নেই। তবু যাচ্ছে, হাবিজাবি প্রশ্ন করছে। যেন টিচারের সঙ্গে কথা বলতে পারলেই মেয়ের জীবন এগিয়ে যাবে তরতর করে! রোজকার ঘটনা।
ভিড় দেখে প্রতিদিনকার মতো আজও যামিনীর গা জ্বলে গেল। উফ, আবার ওখান দিয়ে ঢুকতে হবে। তাকে যে সবাইকে ঠেলে ঢুকতে হবে এমন নয়। টিচারদের দেখলে সকলেই পথ ছেড়ে দেয়। তাকেও দেবে। যামিনীর রাগ হওয়ার কারণ অন্য। সে এলেই ছাত্রীর মায়েরা নিজেদের মধ্যে কথা বন্ধ করে দেয়, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। যতক্ষণ না বাগান পেরিয়ে, সিঁড়ি টপকে স্কুল বিল্ডিংয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ছে ততক্ষণ এই দেখা চলতে থাকে। এতদিনে সকলেই ঘটনাটা জেনে গেছে। এমনকী যেসব মেয়েরা স্কুলে নতুন অ্যাডমিশন নেয় তাদের মায়েরাও কীভাবে যেন খবরটা সবার আগে পেয়ে যায়।
যামিনী মিসের বর নিখোঁজ।
বেশিরভাগেরই বিশ্বাস পালিয়ে গেছে। অন্তত সেরকম ভাবতে ভালোবাসে। পালিয়ে গেছের মধ্যে একটা রসালো ব্যাপার আছে। তাই যামিনীকে দেখার সময় দৃষ্টিতে একইসঙ্গে থাকে করুণা আর আঁশটে ভাব। প্রথম প্রথম লজ্জা, অপমানে মরে যেত যামিনী। ইচ্ছে করত মাটির সঙ্গে মিশে যেতে। ধীরে ধীরে সেটা রাগে পরিণত হল। পরে অভ্যেস করে নিল। তবে সবদিন অভ্যেস কাজে দেয় না। কোনও কোনওদিন ভিড় থেকে ফিসফিস শুনতে পায়–ওই যে আসছে দেখ। মাথায় আগুন জ্বলে যায় তখন। স্কুলের পিছনে একটা ছোট গেট আছে। যামিনী হেডমিস্ট্রেসকে গেটটা খুলে দেওয়ার জন্য বলেছিল।
মায়াদি, ওই গেটটা, আপনি খুলে দিন। শুধু টিচাররা ইউজ করবে।
কেন মেইন গেটে সমস্যা কী হয়েছে?
হেডমিস্ট্রেসের টেবিলের ওপর খানিকটা গলা মোম জমে আছে। খাম-টাম সিল করতে গলা মোম লাগে। যামিনী মাথা নামিয়ে নখ দিয়ে সেই মোম খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, না, সেরকম কিছু নয়। আসলে স্কুলে ঢোকার সময় খুব ভিড় হয়। স্টুডেন্ট, গার্জেন সবাই দাঁড়িয়ে থাকে।
মায়াদি অবাক হয়ে বললেন, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না যামিনী। এতদিন তো ওখান দিয়েই সবাই আসা যাওয়া করেছে। আমি করেছি, তুমি করেছে। হঠাৎ কী এমন ঘটল, যার জন্য আমাকে পিছনের গেটটা খুলে দিতে হবে!
যামিনী মুখ তুলল। বেশিরভাগ স্কুলের হেডমিস্ট্রেসরাই এরকম হয়। টিচারদের অসুবিধের কথা কিছু শুনতে চায় না। অথচ নিজেরা সাধারণ টিচার থাকার সময় অসুবিধে নিয়ে বিপ্লব দেখাত। দ্বিচারিতার চরম। নিজেরা চেয়ারে বসলে পুরোনো কথা সব ভুলে যায়। এই মহিলা মনে হয় সবার থেকে বেশি। মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলে। কোনও সমস্যা শুনলে এমন অবাক হয়ে পড়ে যেন আগে কখনও শোনেনি।
যামিনী বিরক্ত গলায় বলল, কিছু হয়নি। গেটের ওপর থেকে ভিড়ের চাপটা একটু কমে আর কী।
হেডমিস্ট্রেসের বিস্ময় আরও বাড়ল। তিনি চোখ বড় করে বললেন, ভিড়ের চাপ! দশ পনেরো মিনিটের তো মামলা। তুমি এমনভাবে বলছ যামিনী যেন এটা স্কুল নয়, ফুটবল খেলার স্টেডিয়াম বা শপিং মল। কাতারে কাতারে লোক ঢুকছে।
যামিনী বুঝল, এই মহিলাকে বোঝানো যাবে না। ইনি বুঝতে চান না। সে গলায় কঠিন ভাব এনে বলল, খুললে অসুবিধে তো কিছু নেই। গেটটা তো রয়েছেই, নতুন করে বানাতে হবে না। খরচ কিছু হচ্ছে না। আপনি এত চিন্তা করছেন কেন?
মায়াদি চেয়ারে হেলান দিলেন। একটু হাসলেন। বললেন, প্রশ্নটা সুবিধে অসুবিধের নয় যামিনী, প্রশ্নটা কারণ। একটা কাজ করতে গেলে তার পিছনে কারণ লাগে। এটা মেয়েদের স্কুল। তাদের ঢোকা বেরোনোর ওপর সবসময় নজর রাখতে হয়। দুম করে আরও একটা গেট খুলে দিলেই হল না। সেখানেও একজন দারোয়ান রাখতে হবে। তার মানে নতুন পোস্ট, নতুন অ্যাপয়েন্টমেন্ট। গভর্নিংবডির ডিসিশন লাগবে।
যামিনী উঠে পড়ে। মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে বাদ দিন। বিষয়টা এত জটিল বুঝতে পারিনি। আমারই বলা ভুল হয়েছে।
হেডমিস্ট্রেস সামান্য হাসলেন। বললেন, যামিনী, তুমি কোনও কারণে উত্তেজিত হয়ে আছো। ঠিক আছে আমি অন্যদের সঙ্গে কথা বলব। সবাই যদি বলে তখন তো একটা কিছু করতেই হবে।
যামিনী হাতজোড় করে বলল, দোহাই আপনাকে, এটা নিয়ে আর পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলতে যাবেন না। সামান্য একটা গেট খোলা নিয়ে যে এত কথা শুনতে হবে আমি বুঝতে পারিনি। সরি মায়াদি।
ঘর থেকে বেরিয়ে আসে যামিনী, বেরোনোর সময় ঘরের দরজাটা অতিরিক্ত আওয়াজ করে বন্ধ করে। ইচ্ছে করেই করে। মানুষটাকে রাগ দেখানো প্রয়োজন। রাগ দেখানোর প্রতিশোধ নিলেন মায়াদি। পাঁচজনকে বললেন না, কিন্তু দুএকজনকে ডেকে ঘটনাটা বলে দিলেন। তিনি জানেন, টিচারদের মধ্যে কীভাবে দল বানাতে হয়। দল না থাকলে কন্ট্রোল থাকে না। সবাই ঘাড়ে ওঠে। গেটের খবর স্টাফরুমে আসতে সময় লাগল না। স্কুলের স্টাফরুম যে কত ভয়ঙ্কর জায়গা যার অভিজ্ঞতা নেই সে জানে না। যামিনী বলে, মেয়েদের স্কুল এককাঠি ওপরে। যে যার ইচ্ছেমতো ঘটনায় রং লাগাতে পারে। রং কতটা হবে তা নির্ভর করছে হিংসে আর কেচ্ছার ওপর। দুদিনের কানাঘুষোয় যামিনী শুনতে পেল, সে নাকি গোপনে স্কুলে যাতায়াত করতে চাইছে। সবার চোখের আড়ালে। এমনকী বসার জন্য ম্যানেজমেন্টের কাছে আলাদা ঘর পর্যন্ত চেয়ে চিঠি লিখেছে। কথাটা কানে যেতে যামিনী একবার ভেবেছিল, হেডমিস্ট্রেসের ঘরে গিয়ে চেঁচামেচি করে আসবে। তারপর বুঝল, এতে লাভ হবে একটাই, কেউ কেউ আলোচনার জন্য মুখরোচক বিষয় পাবে। তার থেকে পাত্তা না দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। দেবনাথ চলে যাওয়ার পর থেকে কতজনই তো নানান ভাবে অপমান করছে। কলিগরাই বা বাদ যাবে কেন?
তবে সবাই যে এরকম তা নয়। কেউ কেউ অন্যরকমও আছে। সবথেকে অন্যরকম বিশাখা। দেবনাথের ঘটনাটার পর সে ভীষণভাবে যামিনীদির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যে-কোনও আত্মীয়ের থেকে অনেক বেশি। শুধু বিশাখা নয়, সঙ্গে আছে তার স্বামীও। যে হিন্দোল চাকরির জন্য বাড়িতে আসার সময় পেত না, সে অফিস কামাই করে যামিনীর সঙ্গে ছোটাছুটি করেছে। কতদিন। প্রথম কটা দিনের কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। তখন দু-বেলা হাসপাতালে হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নেওয়া হত, নাম না জানা, ঠিকানা না জানা কেউ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ভরতি হয়েছে? হিন্দোল ওয়ার্ড পর্যন্ত ঢুকে যেত। তখন নীলাদ্রির পরীক্ষা। তাকে নিয়ে সব জায়গায় যাওয়া যায় না। হারিয়ে যাওয়ার কেস দেখে সি আই ডি। তাদের দপ্তর কলকাতার ভবানীভবনে। দুদিন অন্তর সেখানেও ছুটতে হত। কোনওদিন সঙ্গে হিন্দোলও যেত। যে পুলিশ অফিসার তখন দেবনাথের ফাইলটা দেখতেন, তার কথাবার্তা কর্কশ, কিন্তু মানুষটা ভালো। শিক্ষিকা বলে যামিনীকে সম্মান দেখাতেন। কথা বলতেন দিদিমণি বলে। ভদ্রলোকের মা-ও নাকি স্কুলে পড়াতেন। সেই কারণেই বাড়তি খাতির। তবে গলায় সবসময় একটা ধমক ধমক ভাব। নিশ্চয় পুলিশে চাকরি করতে করতে গলাটা এরকম হয়ে গেছে।
আপনি রোজ রোজ আসছেন কেন দিদিমণি? পথ তো কম নয়।
যামিনী চুপ করে থাকে। কী বলবে? তার আসা ছাড়া উপায় কী? হারিয়ে যাওয়া মানুষটার খোঁজ আর কোথায় করবে? যদি পথে পথে ঘুরে করা যেত, তা হলে তাই করত। পুলিশ একমাত্র ভরসা। তখন সবে ছমাস পেরিয়েছে। সবসময় আশা মানুষটা ফিরে আসবে। একটু দৌড়াদৌড়ি করলেই হবে। চারপাশে সবাই কত কথা বলছে। কেউ বাড়ি এসে বলছে, কেউ টেলিফোন করছে। দূর সম্পর্কের এক ননদ বলল, অনেক সময় মানুষের স্মৃতি কিছুদিনের জন্য লোপ পায়। নিজের নাম-ঠিকানা সব ভুলে যায়। সেই স্মৃতি আবার ফিরে আসে নিজে থেকেই, তুমি চিন্তা কোরো না যামিনী। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার এক কাকার হয়েছিল। সাতদিন বাইরে ছিল।
যামিনী চোখের জল মুছে বলল, এর তো ছমাস হয়ে গেল।
ননদ ঢোঁক গিলে বলেছিল, আহা, সবার তো একরকম হবে না। কেউ অল্পদিন, কেউ বেশি। ফিরে এলেই তো হল।
সেই কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। এমনকী ছোট ছেলেমেয়েদুটোও নয়। তবু তখন কলিংবেল বাজলে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। তারা দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। বিশেষ করে সন্ধের পর। দেবনাথ যখন অফিস থেকে ফিরত। বুকটা হাহাকার করে উঠত। কিঙ্কিনি কতদিন পড়তে পড়তে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছে। যামিনী নীচু গলায় বলেছে, কাদিস না। কাঁদবি কেন? তোর বাবা তো মারা যায়নি!
কে বলল তোমায় মারা যায়নি? মারা না গেলে কেন ফিরছে না?
যামিনীর চোখ ছাপিয়ে জল পড়ত। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড় বলত, কেন সে তো মানুষটা ফিরে এসে বলবে। দেখবি ঠিক বলবে। রাতে খেতে বসে কত গল্প করবে।
কিঙ্কিনি ডুকরে উঠে বলে, আমি কিছু শুনব না, কিচ্ছু না। আমার বাবাকে চাই।
ভবানীভবনে অফিসারের ঘরের বাইরে বসে স্লিপ পাঠাত যামিনী। সময় হওয়ার আগেই ডাক পড়ত। অফিসার বলতেন, দিদিমণি, আপনাকে কতদিন টানতে হবে আপনি কি তা জানেন? জানেন না। এখনই দম ফুরিয়ে ফেললে চলবে কেন?
যামিনী বলত, আপনি একটু চেষ্টা করুন।
অফিসার বলত, এই তো ফাউল করে ফেললেন দিদিমণি। একটু চেষ্টা করুন কথাটার মানে কী? আমরা কি চেষ্টা করছি না? যথেষ্ট চেষ্টা করছি। আমাদের রাজ্যে গড়ে রোজ কতজন করে মিসিং হয় আপনি জানেন? হারিয়ে যাওয়ার মানুষ খোঁজার কতকগুলো পদ্ধতি আছে। আমরা তার বাইরে যেতে পারি না। সব থানায় মেসেজ গেছে। আপনার হাজব্যান্ডের ফটো গেছে। আমরা হাসপাতাল নার্সিংহোমগুলোতে খবর পাঠিয়েছি। ছোট বড় যতগুলোতে পারা যায়। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। এর বেশি কী করব?
যামিনী বলল, বিজ্ঞাপনটা একটু বড় করে দেওয়া যায় না। একেবারে সকলের মধ্যে এইটুকু ফটো গেছে।
অফিসার ভুরু কুঁচকে যামিনীর দিকে তাকালেন। বললেন, সরকারের একটা বাজেট আছে। সবাইকে সেই বাজেট মেনে চলতে হয়। যে হারিয়ে যায়নি তাকেও মেনে চলতে হয়, যে হারিয়েছে তাকেও মেনে চলতে হয়। আপনি যদি চান কাগজে কাগজে বড় বিজ্ঞাপন দিন, রাস্তায় হোর্ডিং লাগান। তবে মনে রাখবেন দিদিমণি, সরকারিভাবে নিরুদ্দেশ বলতে কিন্তু আমাদের দেওয়া ওইটুকু বিজ্ঞাপনই বোঝাবে।
হিন্দোল তাড়াতাড়ি ম্যানেজের চেষ্টা করে। কাচুমাচু গলায় বলল আপনারা সব পারেন। স্যার।
না, সব পারি না। আবার অনেক কিছু পারি। দেবনাথবাবু যদি বাহান্ন বছরের পুরুষ মানুষ না হয়ে তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলে হত, আমাদের সুবিধে হত। মুম্বই পুলিশকে অ্যালার্ট করতাম। স্টেশনে স্টেশনে জিআরপি নজর রাখত। ঠিক কান ধরে নিয়ে আসতাম। নদশ বছরের মেয়ে হলেও হত। চাইল্ড ট্রাফিকিং-এর সুতোগুলো আমাদের জানা আছে। রেড লাইট এরিয়াগুলোতে সোর্স আছে। একটা না একটা খবর জুটে যেত। দেখবেন বাইরে একজন মহিলা বসে অছে। বসিরহাটের দিক থেকে এসেছে। কলকাতায় মেইড সারভেন্টের কাজ করে। ওর দুটো মেয়ে। কাছাকাছি বয়স। দশ-এগারো। একসঙ্গে দুটোই মিসিং। আমরা নিশ্চিত মিসিং নয়, টাকার লোভ দেখিয়ে কোনও টাউট নিয়ে গেছে; হয়তো চালানও করে দিয়েছে এতক্ষণে।
যামিনী আঁতকে উঠে বলল, সে কী! চালান করে দিয়েছে? কী হবে?
অফিসার হালকা গলায় বললেন, কী আর হবে? মুম্বই দিল্লি বা কলকাতার রেড লাইট এরিয়া রেড করে হয়তো একদিন পেয়ে যাব। কবে পাব জানি না, তবে পাব বলেই বিশ্বাস। টিপ-অফের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু একটা ধেড়ে লোক হারিয়ে গেলে আমাদের ধরে নিতে হবে নিজেই লুকিয়ে পড়েছে। তাকে খুঁজে বের করা কঠিন। অবশ্যই যদি না কোনও…।
অফিসার চুপ করলেন। যামিনী বলল, কী?
অফিসার ঠোঁটের কোনায় সামান্য হেসে বলল, বাদ দিন দিদিমণি। যখন যেমন হবে আপনাকে খবর দেব। আপনার নম্বর তো আমার কাছে রইল।
দেবনাথ নিখোঁজ হওয়ার দেড়বছরের মাথায় একদিন দুপুরে যামিনীর মোবাইল বেজে উঠল। যামিনী তখন স্কুলে। স্টাফরুমে বসে হাফইয়ারলি পরীক্ষার খাতা দেখছে। রিং টোনের মিহি আওয়াজে দ্রুত ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল বের করল। নম্বর দেখে চমকে উঠল। ভবানী ভবন থেকে অফিসারের ফোন। এতদিন পর! মানুষটার গলা থমথমে। মনে হচ্ছে ঠান্ডা লেগেছে। নাকি গলা এরকমই? অনেকদিন পর শুনছে বলে ভুলে গেছে!
একবার যে আসতে হবে দিদিমণি।
যামিনী ব্যস্ত হয়ে বলল, কবে?
কবে নয়, আজ। আজই আসতে হবে।
বুকটা ধক করে উঠল। কবজি উলটে ঘড়ি দেখল যামিনী। স্কুল থেকে বেরিয়ে স্টেশন, তারপর ট্রেন ধরে কলকাতা পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। তা হোক। সে উঠে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বলল, আসছি, সময় লাগবে। আপনি অফিসে থাকবেন তো?
অফিসার ধমকের সুরে বললেন, কী অদ্ভুত কথা বলছেন! আপনাকে আসতে বলে আমি চলে যাব!
যামিনী তাড়াতাড়ি বলল, না, না আমি সেরকম কিছু বলিনি। কোনও খবর আছে?
অফিসার বোধহয় অল্প চুপ করে থেকে মেজাজ ঠিক করতে চাইলেন। পারলেন না।
খবর না থাকলে আপনাকে এতদূর কি গল্প করার জন্য ডেকে আনছি দিদিমণি? আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব।
যামিনী টেবিল থেকে ব্যাগটা তুলে নিল। বলল, খারাপ কোনও খবর?
খারাপ ভালো আপনি বুঝবেন। আই অ্যাম ডুয়িং মাই ডিউটি। আর শুনুন, একা আসবেন না। কাউকে সঙ্গে আনবেন। পারলে ওই ছেলেটাকে নিয়ে আসুন। ওই যে আপনার কলিগের হাজব্যান্ড, হি জি আ স্মার্ট বয়। আমি রাখছি। আর হ্যাঁ, চিন্তা করবেন না। লাক ফেভার করলে ঘটনাটা আলটিমেটলি ভালোও হতে পারে।
বিশাখাকে বলতে সঙ্গে-সঙ্গে সে হিন্দোলকে ফোন করল। হিন্দোল লাফিয়ে উঠল। নিশ্চয় সুখবর। সুখবর ছাড়া পুলিশ এত তাড়াহুড়ো করত না।
কোনও চিন্তা নেই, ঠিক সময় ভবানীভবনের সামনে চলে আসছি।
বিশাখা বলল, তোমার অফিস?
উত্তেজিত হিন্দোল বলল, অফিসের গুলি মারো। দেড়বছর পর একজন হারানো মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, আর আমি অফিস করব? আমি যে কী এক্সাইটেড ফিল করছি বিশাখা, তোমাকে বোঝাতে পারব না।
বিশাখা যামিনীর হাত চেপে বলল, আমিও যাব যামিনীদি। তুমি না বলবে না। আমি শাশুড়িকে ফোন করে দিচ্ছি।
অফিসার তিনজনকে দেখে একটু ভুরু কোঁচকালেও খুশি হলেন। চা দিতে বললেন। যামিনী বলল, আমরা চা খাব না, আপনি চলুন কোথায় যেতে হবে।
অফিসার হেসে বললেন, খান, সামনের মাসে আমি বদলি হয়ে যাচ্ছি। নর্থ বেঙ্গল চলে যাব। তখন আর চা খাওয়াতে পারব না। অবশ্য পুলিশের চা যত কম খাওয়া যায় ততই ভালো। কথা শেষ করে অফিসার এবার জোরে হাসলেন।
হিন্দোল বলল, এরকম কেন বলছেন? ইউ হ্যাভ ডান আ লট। অনেক করেছেন।
অফিসার যামিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মিসেস চ্যাটার্জি, আমি আপনাদের কয়েকটা কথা বলতে চাই। গত দেড়বছর ধরে আপনার হাজব্যান্ডকে ট্রেস করবার জন্য কিছু চেষ্টা আমি করেছি। আমাদের যা যা রুটিন পদ্ধতি আছে তার বাইরে গিয়েই করেছি। কেন করেছি জানেন? করেছি কারণ হাজার হাজার মিসিং-এর মধ্যে এই কেসটা সম্পর্কে আমার গোড়াতেই খটকা লেগেছিল। শুধু খটকা বলব না, খানিকটা ইন্টারেস্টিংও। একটা মানুষ নিজের বাড়ি পছন্দ করে, পরিবারের লোকদের পছন্দ করে, তাদের কোম্পানি সবসময় এনজয় করে, তা হলে কেন দুম করে হারিয়ে যাবে? পুলিশের কাজই অবিশ্বাস করা। আমিও আপনাকে অবিশ্বাস করলাম। বুঝলাম আপনি যা বলছেন সব ঠিক নয়। নয়তো কিছু কিছু জিনিস লুকিয়েছেন। আমি লোক লাগিয়ে আপনাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম। ভেবেছিলাম, আপনার আর দেবনাথবাবুর। সম্পর্কের মধ্যে বড় কোনও গোলমাল পাব। পেলাম না। অন্তত বাইরে থেকে তো নয়ই। এরপর আপনার হাজব্যান্ডের অফিসে লোক পাঠাই। ধারদেনা আছে কিনা জানতে চাই। অনেক সময় ফাইনানশিয়াল কোরাপশনে জড়িয়ে পড়লে এরকম হতে পারে। কিছুদিন ডুব দিয়ে দেয়। এরকম ঘটনা আমি দেখেছি। কিন্তু তা-ও কিছু পেলাম না। আমার লোকেরা খবর এনেছে, দেবনাথবাবু চাকরি বেশ ভালোই করতেন। টাকা পয়সা, প্রোমোশন, ইনক্রিমেন্টের ডিমান্ডও বেশি ছিল না, আবার আনসার্টেনিটিও কিছু ছিল না। যাকে বলে নিশ্চিন্ত জীবন। সব মিলিয়ে হি ওয়াজ আ হ্যাপি পারসেন। গুড ফ্যামিলি ম্যান। তা হলে উনি কোথায় গেলেন? কেন গেলেন? আদৌ কি গেছেন?
অফিসার থামলেন। পিওন চা এনেছে। সবাই চা নিল। বিশাখা চা খুব কম খায়। দিনে খুব বেশি হলে দুকাপ। সে-ও নিল। হিন্দোল গোড়ায় একটু উসখুস করছিল। অফিসারের কথা শুনতে শুনতে সেই উসকানি বন্ধ হয়ে গেছে। টেবিলের আড়ালে বিশাখা যামিনীর হাতটা চেপে ধরে আছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অফিসার আবার বলতে শুরু করেন।
আমি দেখলাম পসিবিলিটি দুটো। যেটার যুক্তি স্ট্রং সেটা হল উনি কোথাও যাননি। অ্যাক্সিডেন্ট ধরনের কিছু ঘটেছে। হয় বড় ধরনের ইনজুরি, নয় ফেটাল। আর দুর্বল পসিবিলিটি হল, সুখ শান্তি, নিশ্চয়তার পরও মানুষটার ঘরবাড়ি, সংসার ভালো লাগেনি। তাই সবাইকে ছেড়ে, সব ছেড়ে চলে গেছেন। তা হলে সেটা হবে একটা দার্শনিক ব্যাপার। এই সম্ভাবনা আমি উড়িয়ে দিয়েছি। না দিয়ে উপায় ছিল না, এটা ধরে নিলে পুলিশের আর কোনও কাজ থাকত না। ফাইল বন্ধ করে দিতে হয়; দর্শনের রহস্য ভেদ করা পুলিশের কর্ম নয়। তাই ওটা সরিয়ে ভাবাই ভালো। এরপর থেকে আমি নিজে রেগুলার বিভিন্ন থানার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করলাম। হাওড়া শিয়ালদা জিআরপির সঙ্গে কথা বলেছি। এতদিন কাজের কাজ কিছু হয়নি। মনে হচ্ছে, এবার ফল পেয়েছি। মনে হচ্ছে বলছি এই কারণে যে আমি সিওর নই। আপনি সিওর করবেন। এখান থেকে বেরিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশন যাব। জিআরপি লকআপ।
হিন্দোল চমকে উঠে বলল, লকআপ! লকআপে কী হয়েছে?
অফিসার হিন্দোলের দিকে তাকিয়ে বললেন, লকআপে কিছু হয়নি। যেখানে একজনকে রাখা হয়েছে। কাল রাতে আদ্রা চক্রধরপুর ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ট্রেনে লোকটাকে জিআরপি ধরে। ভিখিরি, ভবঘুরে টাইপ। গেটের পাশে মেঝেতে বসে আসছিল, রাতে এক প্যাসেঞ্জারের খাবার কেড়ে নিতে যায়। বাধা দিতে গেলে গলা টিপে ধরে। প্যাসেঞ্জাররা সবাই মিলে ধরে তাকে রেল পুলিশের হাতে তুলে দেয়। দেখা যায়, লোকটা পুরোপুরি উন্মাদ। কখনও হাসছে, কখনও তেড়ে যাচ্ছে। এ ধরনের কেসে জিআরপি সাধারণত আসামিকে গভীর রাতে কোনও স্টেশনে নামিয়ে দেয়। ভবঘুরে পাগলকে কে সামলাবে? এই লোক নাকি কিছুতেই নামতে চায়নি। বাধ্য হয়ে তাকে আজ সকালে হাওড়ায় নিয়ে আসা হয়েছে।
অফিসার চুপ করেন। টেবিলে ছড়ানো কাগজপত্র গোছগাছ করতে থাকেন। জলভরা চোখে যামিনী ফিসফিস করে বলল, তারপর কী হল?
অফিসার উঠে পড়লেন। বললেন, চলুন, এবার বেরোই। দুপুরে আমাকে হাওড়া থেকে ফোন করে ঘটনাটা জানিয়েছে। জানানোর কারণ, আমরা দেবনাথবাবুর যে ফটো পাঠিয়েছিলাম তার সঙ্গে লোকটার মিল আছে। কপালের কাটা দাগটাও রয়েছে। যে ছেলেটা ডিউটিতে ছিল তার কেমন সন্দেহ হয়। সে মিসিং ফাইল বের করে। এটাও একটা আশ্চর্য বিষয়। সন্দেহ করে কেউ পুরোনো ফাইল বের করছে সচরাচর দেখা যায় না। কে আবার আগ বাড়িয়ে খাটতে চায়? হয়তো আমি নিয়মিত লেগে ছিলাম বলেই করেছে। যাক, লোকটা নাম-ঠিকানা কিছুই বলতে পারছে না। বলেছে, শুধু বউয়ের নামটা মনে আছে, যামিনী। বছর দেড়েক হয়ে গেল বাড়ি থেকে কাজে বেরিয়েছিল, এখন আর চিনে ফিরে যেতে পারছে না। বাড়ির কেউ এলে চিনতে পারবে।
যামিনী মুখে শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, এক্ষুনি আমাকে নিয়ে চলুন..প্লিজ…।
বিশাখা যামিনীর কাঁধটা চেপে ধরে বলল, শান্ত হও যামিনীদি।
ডুকরে উঠে যামিনী বলল, ভিখিরি হয়ে গেছে!
অফিসার নরম গলায় বললেন, ভিখিরি হোক আর পাগল হোক, মানুষটাকে পাওয়াই আসল। অসুখের চিকিৎসা আছে। তবে ভুলও হতে পারে। ওরকম একটা লোক নিজের নাম বলতে পারছে না, শুধু স্ত্রীর নাম মনে আছে এটা এখনই বিশ্বাস করার কিছু নেই। ঠিক বললেও যামিনী যে একজনেরই নাম হবে এমনটাও ভাবার কারণ নেই। আমি জিআরপিকে বলেছি, আজই কোর্টে তুলবেন না, একটা দিন অপেক্ষা করুন। নিন, চলুন।
ভুলই হয়েছিল। মানুষটা যে তার স্বামী নয় সেটা বুঝতে এক ঝলকের বেশি সময় লাগেনি যামিনীর। রোগা চেহারায় একমুখ দাড়ি গোঁফ। গায়ে লুঙ্গি আর ছেঁড়া ফতুয়া। তীব্র দুর্গন্ধ। যামিনীকে দেখে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, কীরে খেতে দিবি না? খিদেতে তো মলুম রে হারামজাদি।
ভবানীভবনের অফিসারের দিকে তাকিয়ে ইনস্পেক্টর ছেলেটি নীচু গলায় বলল, স্যার বিকেল থেকে স্ত্রীর নামও বদলে ফেলেছে। কখনও বলছে জয়া, কখনও বলছে উমা। লেখাপড়া জানা লোক। আমার কীরকম সন্দেহ হচ্ছে।
কীরকম?
মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করে কনফিউজ করছে।
অফিসারের ভুরু কুঁচকে গেল। বললেন, আপনি ভালো করে দেখুন।
দেখছি স্যার।
সেদিন ট্রেনে গোটা পথটা কাঁদতে কাঁদতে ফিরেছিল যামিনী। বিশাখা পাশে বসে হাত ধরে রেখেছিল। মুখে কিছু বলেনি। স্পর্শ বলেছিল, আমি তোমার চোখের জলের কারণ বুঝতে পারছি যামিনীদি। তুমি কাঁদো।
.
যামিনীকে দেখতে পেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একদল ছাত্রীকে ঠেলে এগিয়ে এল বিশাখা। যামিনী দেখল মেয়েটার মুখটা যেন কেমন চিন্তিত হয়ে আছে।
কী হয়েছে?
বিশাখা গলা নামিয়ে বলল, একটা কথা আছে। স্কুলে বলা যাবে না।
যামিনী অবাক হয়ে বলল, কী কথা? স্কুলে বলা যাবে না কেন?
বিশাখা এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, ভেবেছিলাম ফোনে বলব…হিন্দোল বলল, এসব কথা ফোনে বলা ঠিক নয়।
কী হয়েছে বলবি তো? যামিনীর গলায় অধৈর্য ভাব।
সামনের দিকে তাকিয়ে গলা আরও নীচু করল বিশাখা। বলল, এখন নয়, ওই যে রাজলক্ষ্মী আর আরতিদি আসছে। টিফিনের সময় স্কুল থেকে দুজন বেরিয়ে যাব। বীণাপাণিতে বসে কথা বলব।
বীণাপাণি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার স্কুল থেকে খানিকটা দূরে। নামে মিষ্টির দোকান হলেও, শিঙাড়া, কচুরিতে বিখ্যাত। টিচাররা টিফিনের সময় লোক দিয়ে কিনে আনায়। ছুটির পর বা হাতে সময় থাকলে নিজেরাই দোকানে চলে যায়। দোকানে গিয়ে জমিয়ে বসে খেয়ে আসে।
বিশাখার কথা জানবার আগ্রহ হলেও যামিনী স্কুলে সুযোগ পেল না। বিশাখার টানা ক্লাস। মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্য আরতিদির পাল্লায় পড়তে হল। ফাঁকা স্টাফরুমের টেবিলের উলটো দিক থেকে ঝুঁকে পড়ে মহিলা বললেন, তোমাদের পশুপতিদার লেটেস্ট কীর্তিটা শুনবে নাকি যামিনী?
যামিনী আজকাল স্কুলে যতটা পারে কম কথা বলে। যেটুকু না বললে নয়। কথা বলতে শুধু যে ভালো লাগে না এমন নয়, কথা শুনতেও তার ভালো লাগে না। অন্যের সংসারের গল্পের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারে না। কী করে মেলাবে? তার সংসার যে একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। তাই বিরক্ত লাগে। ক্লাস না থাকলে ব্যাগ থেকে পত্রিকা বের করে ওলটায়। খাতা দেখে। সবসময়েই যেন মেজাজটা রুক্ষ হয়ে থাকে। এই রুক্ষ ভাবটা আরও বাড়ছে। অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলে। ছাত্রীরা আজকাল ভয় পায়। আরতিদির কথা শুনে বিরক্ত হয় যামিনী।
এখন থাক, ব্যস্ত আছি আরতিদি।
আরে বাবা শোনই না। ওই লোক সেদিন দেখি আমাকে আড়াল করে কী যেন দেখে। আমিও ছাড়বার পাত্রী নই। পা টিপে টিপে পিছনে গিয়ে উঁকি দিলাম। দেখি কোলের ওপর ইংরেজি ম্যাগাজিন। আমাকে দেখে ফট করে পাতা বন্ধ করে দিল।
যামিনী মুখ দিয়ে বিরক্তির আওয়াজ করে বলল, খাতা দেখছি, আপনি এবার থামুন।
রাখ তোমার খাতা। খাতা কি শুধু তুমিই দেখ? আমরা দেখি না? আগে কথাটা তো শুনবে। ঘরে কে ফট করে এসে যাবে তখন আর বলতে পারব না। আমি তারপর থেকে ওই ম্যাগাজিন দেখার জন্যে তক্কেতক্কে ছিলাম। তোমাদের পশুপতিদা বাথরুমে যেতেই টেবিলের তলা থেকে বের করে পাতা ওলটালাম। কী দেখি জানো?
আরতি মুখ ঘুরিয়ে দরজাটা দেখে নিলেন। যামিনী খানিকটা ধমকের সুরে বলল, আপনি থামুন তো। বয়স হচ্ছে তবু একই কথা বলে যান।
আরতিদি ধমক গায়ে না মেখে ফিসফিস করে বললেন, পাতা জোড়া জোড়া মেয়েদের সব ছবি। গায়ে বুকে কিচ্ছু নেই! কোমরে কোনওরকমে একফালি করে নেকড়া জড়ানো, সে ও না থাকার মতো। মাগো!
যামিনী ইচ্ছে করল গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে। সে কষ্ট করে নিজেকে সামলাল। বাধা দিয়ে লাভ নেই। আরতিদি গজগজ করতে লাগলেন, সব পুরুষমানুষ এক, সুযোগ পেলেই নোলা লকলক করে। কাউকে বিশ্বাস করি না। একটু বউয়ের চোখের আড়াল হয়েছে কি হয়নি অমনি ঘাড়ে আঁপিয়ে পড়ে। মেয়েমানুষ একটা পেলেই হল। কোনও বাছবিচার নেই। এই তো আমাদের মোড়ের পন্টুর স্টেশনারি দোকান, অনেক সময় দোকানে পন্টু থাকে না, ওর বউটা এসে বসে। তোমায় কী বলব যামিনী, ওই মেয়েকে যে কী হতকুচ্ছিত দেখতে, একবারের বেশি দুবার মুখের দিকে তাকানো যায় না। কিন্তু হলে কী হবে তোমার পশুপতিদা একটু ফাঁক পেলেই বলে, যা-ই পন্টুর দোকান থেকে পাঁউরুটিটা নিয়ে আসি, একটু টুথপেস্ট কিনে আনি, যা বাবাঃ সিগারেট তো নেওয়া হল না। খালি ছুতোনাতা। পরশু সন্ধেবেলা মাথায় গেল আগুন ধরে, বললাম, অত বাহানার কী দরকার? যাও না, গিয়ে সরাসরি বল, অ্যাই মেয়ে তোমার বুকের কাপড়টা সরাও তো, আমি সাধ মিটিয়ে তোমার বুকদুটো দেখি। দেখে বাড়ি যাই। তা হলে আর বারবার ছুটে আসতে হবে না। ভালো বলেছি না?
আরতিদি ফাঁকা স্টাফরুমে আরও বকবকানি চালাতেন। দেবলীনা ঢুকতে চুপ করে গেলেন। ভয়ে নয়, এটাই তাঁর রীতি। তিনি তার স্বামীর গল্পগুলো সবসময় একজনকে ধরে বলেন। যখন যাকে একা পান। সন্দেহবাতিক অসুখের এটা একটা লক্ষণ। অসুস্থ মানুষ যখন কোনও অবিশ্বাসের কথা কাউকে বলে তখন এমন ভঙ্গি করে শুধু তাকেই কথাগুলো বলা হচ্ছে। তাদের সব সন্দেহের গল্পগুলোই বানানো বলেই এই ভানটা করতে হয়।
ঘণ্টা বাজতে ক্লাসে যাওয়ার জন্য উঠলেন আরতিদি। টেবিলটা ঘুরে যামিনীর পাশে। এসে দাঁড়ালেন। পিঠে হাত দিয়ে নীচু গলায় বললেন, সব পুরুষমানুষ বলায় রাগ করেছ নাকি? আমি কিন্তু দেবনাথের কথা বলতে চাইনি। তোমার স্বামী এই দলে পড়ে না। ও একদম আলাদা, আমি জানি।
যামিনী চমকে উঠল। এ আর একরকম আরতিদি! নিমেষে সব রাগ কমে গেল যামিনীর। হেসে বলল, আমি জানি আরতিদি।
বীণাপাণি মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের এককোণায় দুটো বেঞ্চ আর টেবিল। দোকানের ছেলেটা জানে স্কুলের দিদিমণিরা এসে চট করে সেখানে বসবে না। তারা পিটপিটে স্বভাবের। আগে টেবিল বেঞ্চ ভালো করে মুছতে হবে। মোছা থাকলেও সামনে মুছতে হবে। কাপ প্লেট নিয়েও এক কারবার। এটা মোছো, ওটা ধোও করেই যায়। আজ কিন্তু দুই দিদিমণি এসে সে-সব কিছুই করল না। পিছনের বেঞ্চে মুখোমুখি বসে সামান্য কিছু খাবারের অর্ডার দিল।
যামিনী বলল, নে এবার বল। কী প্রবলেম হয়েছে? শ্বশুরবাড়িতে ঝামেলা করেছিস?
বিশাখা সরাসরি যামিনীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, না, আমার কোনও প্রবলমে নয়। দেবনাথদার ব্যাপার।
যামিনী চমকে উঠে বলল, দেবনাথ! দেবনাথের কী ব্যাপার!
যামিনীদি, হিন্দোল মনে হয়, দেবনাথদার একটা খবর পেয়েছে।
যামিনী হাত বাড়িয়ে বিশাখার একটা হাত চেপে ধরল।
কী খবর! খারাপ কিছু? মরে গেছে?
ছি ছি মারা যাওয়ার কথা কেন বলছ? সেরকম কিছু নয়। যেটুকু জেনেছি সুস্থ শরীরের কথাই জেনেছি। তবে খবরটা সেবারের মতো ভুলও হতে পারে। সেই যে সিআইডি অফিসার। ভুল করেছিল। একটা ভবঘুরের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছিল। এটাও হয়তো সেরকম…।
যামিনী বড় করে শ্বাস নিয়ে বিশাখার হাতটা আরও শক্ত করে চেপে ধরল। বলল, হোক ভুল, তুই বল। হিন্দোল কী খবর পেয়েছে?
বিশাখা মাথা নামাল।
খবরটা আমরা তোমাকে বলতে চাইনি, হিন্দোল তো একেবারেই নয়। তারপরেও অনেক আলোচনা করে দেখলাম, তোমাকে না জানানোটা অন্যায় হবে। আমরা চাই খবরটা ভুল হোক। ভালো নয় যামিনীদি। খবরটা খুব খারাপ।
যামিনীর শরীরটা কেঁপে উঠল।