০৯.
এক ঝলক দেখেই নীলাদ্রি বুঝতে পারল, লোকটা জালিয়াত। ছোটখাটো জালিয়াতি নয়, বড় ধরনের জালিয়াত। বড় ধরনের জালিয়াতরা আজকাল টিয়াপাখির বদলে কম্পিউটার, মোবাইল সাজিয়ে এমন কায়দায় বসে যেন বিজ্ঞান প্রযুক্তি ছাড়া এক পা-ও নড়ে না। মানুষের ভাগ্য, কুষ্ঠি বিচার, আংটির পাথর, মাদুলির সাইজ সব কী বোর্ড টিপে বলে দেয়। এই লোকও তাই করেছে। টেবিলের ওপর ল্যাপটপ সাজিয়ে বসেছে। প্রতি কথার পরেই খটখট আওয়াজ করে কী বোর্ড টিপছে। এখানে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। তবু সে চুপ করে আছে। কারণ এই লোকের কাছে তাকে নিয়ে এসেছে শ্রীময়ী। দুম করে উঠে গেলে শ্রীময়ীকে অপমান করা হবে।
লোকটা মুখ না তুলে বলল, কী হারিয়েছে ভাইটি?
নীলাদ্রি পাশে বসা শ্রীময়ীর মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, কী নয়, কে। আমার বাবা পাঁচ বছর হল নিখোঁজ।
লোকটা মুখ তুলে একবার নীলাদ্রির মুখের দিকে তাকাল। বলল, ও। ফের ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তা বাবার নাম কী ভাইটি?
ভাইটি ভাইটি শুনতে অসহ্য লাগছে নীলাদ্রির। শুধু ভাইটি নয়, তুমি সম্বোধনেও তার আপত্তি। এই ধরনের বুজরুকদের এগুলো এক একটা অংশ।
বাবার নামটা বললে না?
দেবনাথ। দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়।
বয়স কত?
কোন বয়সটা বলব? যখন হারিয়ে গেছে? ফিফটি টু। তারপর পাঁচ বছর হয়ে গেল।
ও তা হলে সাতান্ন হল, মা আছেন?
হ্যাঁ যামিনী চট্টোপাধ্যায়।
ভাইটি, মায়ের বয়স কত?
এখনকার বয়স?
না, এখনকার নয়, তোমার বাবা যখন বাড়ি ছাড়লেন সেই সময়ের বয়সটা বল।
নীলাদ্রি বিরক্ত হয়ে ভুরু কোঁচকালো। পাশে বসা শ্রীময়ীর মুখের দিকে আবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে বলল, ঠিক জানি না।
ভাইটি এটা যে জানতে হবে। মায়ের বয়স না জানলে বাবার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ বোঝা যাবে কী করে?
নীলাদ্রির ভুরু আরও কুঁচকে গেল। কপালে ভাঁজ পড়ল। লোকটা কী বলতে চাইছে? সে নড়েচড়ে বসল। রুক্ষ গলায় বলল, আমি তো আপনার কাছে বাবার চলে যাওয়ার কারণ জানতে আসিনি। শুনলাম, আপনি নাকি হারানো জিনিস, মানুষ খুঁজে দেন। যদিও আমি এসব বিশ্বাস করি না।
লোকটা দাঁত বের করা ধরনের হেসে বলল, বিশ্বাস যে কর না দেখেই বুঝতে পারছি ভাইটি। তাতে কিছু এসে যায় না। আমার এই কাজ ধম্মকম্ম, পুজোআচ্চা নয়, এতে অং বং চং মন্ত্র নেই যে তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। জ্যোতিষীদের মতো পাথর, মাদুলি বিক্রির ব্যবসাও খুলে বসিনি। ওদের মতো তুমি কি আমার গায়ে নামাবলি বা কপালে তিলক দেখতে পাচ্ছ? পাচ্ছ না। কারও বিশ্বাস অবিশ্বাসের ওপর আমার কাজ নির্ভর করে না। আমি অন্য পদ্ধতিতে কাজ করি। দেখছই তো তোমার কাছ থেকে পাওয়া ইনফরমেশনগুলো আগে কম্পিউটারে তুলে নিচ্ছি। তারপর আমার পদ্ধতি অ্যাপ্লাই করব।
কথাটা বলে লোকটা আবার সামনে রাখা ল্যাপটপে খটাখট আওয়াজ করল। নীলাদ্রির খুব ইচ্ছে করল জিগ্যেস করে, পদ্ধতিটা কী? আপনি কি হারিয়ে যাওয়া খুঁজে পাওয়ার জন্য বিশেষ ধরনের কোনও সফটওয়্যার ব্যবহার করেন? তার আগেই শ্রীময়ী টেবিলের ওপর সামান্য ঝুঁকে পড়ে বলল, আসলে আমরা চাইছিলাম, আপনি যদি মানুষটার কোনও হদিস দিতে পারেন। শুনেছি…।
লোকটা মুখ তুলে একইরকম অতি বিনয় মাখা গলায় বলল, তুমি কে বোনটি? দেবনাথবাবুর কন্যা?
শ্রীময়ী তাড়াতাড়ি বলল, না না, আমি কেউ নই, আমি এর বন্ধু।
তা হলে তো বোনটি তোমাকে একটু বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয়।
নীলাদ্রি কড়া গলায় বলল, ও এখানেই থাকবে। ও-ই আমাকে আপনার কাছে এনেছে।
সেটা খুব আনন্দের কথা। কিন্তু বোনটিকে এখন ঘরে রাখা যাবে না। কোনও অনাত্মীয়কে সামনে রেখে আমি কাজ করব কী করে? ডাক্তার যখন রোগীকে পরীক্ষা করে বাইরের লোককে থাকতে দেয়?
নীলাদ্রি দেখল এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এটা সুযোগ। প্রতিবাদ জানিয়ে শ্রীময়ীর সঙ্গে সেও বেরিয়ে যাবে। শ্রীময়ী তার আগেই উঠে পড়ল। নীলাদ্রির কাঁধে হাত রেখে নীচু গলায় বলল, প্লিজ তুমি কথা বল। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।
অনেকক্ষণ থেকেই নীলাদ্রির মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। শ্রীময়ী ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে সেটা আরও বাড়ল। সে এখানে একেবারেই আসতে চায়নি। শ্রীময়ীর জন্য বাধ্য হয়েছে। সেদিন। শ্রীময়ীকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছিল। শ্রীময়ী বলল, একটা কথা বলব? রাখবে?
নীলাদ্রি অবাক হয়ে বলল, বাবা, এমনভাবে বলছ যেন গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে আসতে হবে।
তোমাকে একজনের কাছে নিয়ে যাব, যাবে?
কার কাছে?
শ্রীময়ী বলল, সে একজন আছে। আগে বল যাবে। তোমার বাবার ব্যাপারে।
নীলাদ্রি ঠোঁটের ফাঁকে একটু হেসে বলল, কার কাছে? তোমার চেনা কোনও পুলিশ অফিসার? কোনও লাভ নেই শ্রীময়ী। থানা পুলিশ করে করে ফেডআপ হয়ে গেছি। পাঁচ বছর তো কম সময় নয়।
না, থানা পুলিশ নয়, একজন লোক আছে সে নাকি হারানো জিনিস, হারানো মানুষ খুঁজে দিতে পারে।
নীলাদ্রি হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়ে।
ধ্যুৎ, তুমি জ্যোতিষে বিশ্বাস কর নাকি শ্রীময়ী! ছি ছি, একজন কবি হয়ে তুমি শেষ। পর্যন্ত কিনা আমাকে জ্যোতিষীদের শরণাপন্ন হতে বলছ!
শ্রীময়ী তাড়াতাড়ি বলে, আমি মোটেও ওসব বিশ্বাস করি না। আর যার কাছে যেতে বলছি তিনিও মোটে জ্যোতিষী নন।
তা ছাড়া আর কী হবে? হারানো মানুষ কোথায় আছে সে তো আর চোখ বুজে সাধারণ মানুষ বলতে পারবে না, তার জন্য অমুকবাবা তমুকবাবা কিছু একটা হতে হবে। যত সব ভণ্ড।
শ্রীময়ী হাঁটতে শুরু করল। বলল, শুনেছি এই লোকটা অন্যরকম। আমাদের রান্নার মাসি সোনারপুরের দিক থেকে আসে। ও-ই গল্প করেছিল, লোকটা সোনারপুরে বসে। তিন চারটে করে জায়গার কথা বলে দেয়। তার মধ্যে একটায় হারানো জিনিস পাওয়া যায়।
নীলাদ্রি বলল, এই রে, তুমি তোমাদের রান্নার লোকের কাছেও বাবার ঘটনা বলেছ!
মোটেও না, আমি কিছুই বলিনি। মাসিই সেদিন গল্প করছিল। মেয়ের কানের দুল হারিয়ে যেতে ওরা সেই লোকের কাছে গিয়েছিল। লোকটা অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলে, তিন জায়গার নাম বলে দিল। দ্বিতীয়টাতেই দুল পাওয়া যায়। বাড়ির পিছনে লঙ্কা গাছের টবে। আরও নাকি আছে। গ্রামের কে ছাগল হারিয়েছিল। পরদিন সেই লোকের কাছে যেতে…।
নীলাদ্রি জেরে হেসে উঠল। পথচলতি কয়েকজন মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। নীলাদ্রি বলল, আমার বাবা কানের দুল নয়, ছাগলও নয়। এভাবে মানুষ পাওয়া যাবে না।
একটা ছেলেকেও খুঁজে দিয়েছে। আট-নবছরের ছেলে। বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে এসেছিল। বড়বাজার গিয়ে পাওয়া গেল। সে নাকি ট্রাকে চেপে মুম্বই যাবে। আমি রান্নার মাসির কাছ থেকে লোকটার ঠিকানা রেখে দিয়েছি। সোনারপুর স্টেশনে নেমে একটুখানি যেতে হবে।
শ্রীময়ী, এগুলো বুজরুকি ছাড়া কিছুই নয়। শুনে মনে হচ্ছে, লোকটা কথাবার্তা বলে কয়েকটা প্রব্যাবিলিটি বুঝতে পারে। হারানো জিনিস কোথায় থাকতে পারে তার সম্ভাবনা। দু একটা কেস মিলে যায়। সেগুলিই মুখে মুখে ছড়ায়। বুজরুকের ব্যবসা বাড়ে। যেসব কেস ফেল। করে সেগুলো কেউ জানতে পারে না। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের ব্যাপারগুলো সব এরকমই। মুখে মুখে শুনে মানুষ পাগলের মতো ছোটে। কাগজে দেখনি, মানুষ যখন চাঁদে জমি কেনার কথা ভাবছে তখন এখানে অসুখ সারাতে একদল মানুষ কাদায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল! কোনও বহুদূরের গণ্ডগ্রামে নয়, কলকাতার কাছেই এ ঘটনা ঘটেছে। এইসব জালিয়াতদের পেইড এজেন্টও থাকে। তারা মুখে মুখে গপ্প ছড়ায়। তোমার এই রান্নার মাসি নিশ্চয় সেরকম একজন। কেন্স পিছু কমিশন পাবে। এসব একদম বিশ্বাস কর না।
শ্রীময়ী বলল, আমি বিশ্বাস করি না, কিন্তু একবার যেতে অসুবিধেটা কোথায়? পাঁচ বছর ধরে কত জায়গায় তো ছুটোছুটি করছ। যে যেরকম বলেছে সেখানেই গেছ। এখানে কত আর খরচ হবে?
নীলাদ্রি এবার বিরক্ত হলে বলল, খরচটা বিষয় নয়, বিষয়টা অন্য। যত বড়ই বিপদ হোক, তা বলে একজন বুজরুকের কাছে ছুটব; নিজেকে সারেন্ডার করব!
সারেন্ডারের প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে! শুনে চলে এলেই হবে। নতুন একটা সম্ভাবনার কথাও তো লোকটা বলতে পারে। না বুঝেও বলতে পারে। তোমাদের খোঁজার একটা নতুন দিক খুলে যাবে। দেখ নীলাদ্রি, তোমার বাবাকে পাওয়া গেলে আমি তোমাদের থেকে কম খুশি হব না। তার কারণ তোমার বাবা নন, তুমি। কথাটা স্বার্থপরের মতো শোনালেও সত্যি, আমার ভালোবাসার মানুষটাকে রোজ মন খারাপ করতে দেখলে আমার কষ্ট হয়।
নীলাদ্রি হতাশ গলায় বলল, ঠিক আছে চল, দেখি তোমার সাধুবাবা কী বলেন। তবে একটা কথা বলে দিচ্ছি, মেজাজ ঠিক থাকবে কিনা জানি না। ঘোরতর অবিশ্বাস নিয়ে যাচ্ছি তো, রাগ না চড়ে যায়। মাকে পাঠালেই ভালো হত। কিন্তু সেটা করব না। মা ওই লোকের কথা বিশ্বাস করে ফেলতে পারে। একবার কোন পুরোহিত মশাই মায়ের হাত দেখে বলেছিল, আপনার স্বামী ফিরে আসবে, আপনি তিনদিন ধরে যজ্ঞ করুন। মা বলল, তিন দিন ধরে! সে তো বিরাট ঝামেলা। পুরুত মশাই বললেন, সে তো ঝামেলাই। তবে শাস্ত্রে বিকল্প ব্যবস্থা আছে। মা বলল, কী ব্যবস্থা? পুরুতমশাই বললেন যজ্ঞ করতে না পারলে তিন হাজার তিন টাকা ধরে দিন। মা বলল, তিন হাজার! এত টাকা? পুরুতমশাই বললেন, স্বামী তিন বছর নিখোঁজ, তাই তিন হাজার। মা টাকা দিয়ে দিল। এই কারণেই মাকে এখানে পাঠাব না।
লোকটাকে মোটেই জ্যোতিষী বা পুরোহিতের মতো দেখতে নয়। ব্যস্ত রাস্তার ওপর একফালি চেম্বার। বাইরে ছোট একটা টিনের সাইনবোর্ডে এঁকাবেঁকা করে ভুল বানানে লেখা–
মধুসূদন কুইল্যা। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সাহায্যে হারানো জিনিস খুঁজে পাবার পরামর্শ দেন। ভিজিট একশত টাকা মাত্র।
ঘরে ঢুকে দেখা গেল লোহার টেবিলের ওদিকে কারুকাজ করা পাঞ্জাবি পরে চিমসে চেহারার একজন বসে আছে। লোকটার চেহারার মধ্যেই একটা ধূর্ত ভাব। চোখগুলো ঢুলু ঢুলু। গলায় একটা মোটা সোনার চেইন। সোনার না-ও হতে পারে, হয়তো ইমিটেশন। পাড়া গাঁয়ের লোকদের ঘাবড়ে দেবার জন্য পরে রেখেছে। অনেকসময় গরিব মানুষ বড়লোকদের বাড়তি বিশ্বাস করে। টেবিলে ল্যাপটপ খোলা। লোকটা সেই ল্যাপটপের দিকে চেয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। পিছনের দেয়ালে অজস্র ঠাকুর দেবতার ফটো। কোনওটায় শুকনো মালা ঝুলছে। টেবিলের এপাশে দুটো লোহার চেয়ার। নীলাদ্রি, শ্রীময়ী এসে সেখানেই বসেছিল। শ্রীময়ী বেরিয়ে যাওয়ার পর নীলাদ্রি বলল, একটু তাড়াতাড়ি করবেন মধুসূদনবাবু।
লোকটা চোখ তুলে গা জ্বালানো ধরনের হাসল।
বন্ধুকে চলে যেতে বলেছি বলে রাগ হল ভাইটি?
রাগে গা রি রি করে উঠল নীলাদ্রির। উপায় নেই সহ্য করতে হবে।
কী করব বল, তোমার সঙ্গে এমন সব কথা হবে যা পরিবারের বাইরের কারও শোনা উচিত নয়। জিনিস হলে একটা কথা ছিল। তার পাপপুণ্য থাকে না। কিন্তু মানুষের বেলায় তা হবার নয় ভাইটি। তার অনেক লজ্জার ব্যাপার থাকে। সেসব অন্যরা শুনলে চলবে কেন? আমিই বা বলব কেন? যাক, ওসব বাদ দাও। মানুষ খোঁজার ভিজিট কিন্তু আমার বেশি।
কত? ঠোঁট কামড়ে বলল নীলাদ্রি।
বেশি নয়, তিনশত। হাত তুলে তিনটে আঙুল দেখাল মধুসূদন।
নীলাদ্রি দ্রুত পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা দিল। আগে টাকা দিয়ে যদি আগে মুক্তি পাওয়া যায়।
ধন্যবাদ। তুমি শিক্ষিত ছেলে বলে আগে টাকা দিলে। গাঁইয়াগুলো এটাই বুঝতে চায় না। বলে আগে জিনিস পাই তারপর ভিজিট। আরে বাপু, জিনিস কি আমি খুঁজে দেব বলেছি? তুই হারিয়েছিস তুই বুঝে নিবি। আমি শুধু পরামর্শ দেব। অ্যাডভাইস। ঠিক কিনা?
নীলাদ্রি এসব কথা পাত্তা না দিয়ে বলল, বুঝতেই পারছেন মধুসুদনবাবু আমরা পাঁচ বছর ধরে কম খোঁজাখুঁজি করিনি। আজও করছি। পুলিশ ইনভেস্টিগেশন চলছে। এখনও ফোন করে ডেকে পাঠায়। সুতরাং বাদ প্রায় কিছুই নেই। আপনি সেটা মাথায় রাখবেন, তাতে আপনার পরিশ্রম কম হবে।
মধুসূদন ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল, এতে পরিশ্রম বাড়ল ভাইটি। আগে এলে কাজ সহজ হত। রোগী মর মর হলে তবে ডাক্তার বদ্যি ছেড়ে আত্মীয়রা মন্দিরে ছোটে। তখন ভগবান কিছু করতে পারেন না। কারণ ততক্ষণে কেস জটিল হয়ে গেছে, বেচারি ভগবান কী করবেন? তোমার বাবা মানুষটি কীরকম ছিলেন? রাগী না ঠান্ডা মাথার? খরুচে না কিপটে? ভীতু প্রকৃতির?
নীলাদ্রি হেসে ফেলে বলল, এগুলো সব বলতে পারব না, তবে, মিষ্টি খেতে ভালোবাসতেন। ইনফরমেশনটা কাজে লাগবে?
তুমি কি ঠাট্টা করছ ভাইটি?
নীলাদ্রি সহজভাবে বলল, তা একটু করছি বইকি। ধরা যাক, আমার বাবা সাহসী ছিলেন, তাতে কী প্রমাণ হয়? উনি জঙ্গলে গিয়ে বাঘ-ভাল্লুকের সঙ্গে গা ঢাকা দিয়ে আছেন? এ সব জেনে আপনার লাভ?
মধুসূদন চিবিয়ে বলল, ভাইটি, আমার লাভ ক্ষতিটা আমি বুঝলেই ভালো নয় কি? গোড়া থেকেই দেখছি তুমি তেড়েফুঁড়ে কথা বলছ। ব্যাপারটা কী বল তো? আমি তো হাতে পায়ে ধরে তোমাকে এখানে ডেকে আনিনি বাপু।
নীলাদ্রি নিজেকে সামলে টেবিলের ওপর ঝুঁকে বলল, আমার বাবা একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন। সবসময় হাসিখুশি থাকতেন। আমাকে আর আমার বোনকে ভালোবাসতেন খুব। অফিস ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোতেই চাইতেন না। যতটা পারেন হইচই করে সময় কাটাতেন।
স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন ছিল? তোমার মায়ের সঙ্গে?
নীলাদ্রি হেসে বলল, এই আপনার গোপন প্রশ্ন? লাভ নেই। ওই লাইনে অনেক তদন্ত হয়ে গেছে। আমার মায়ের সঙ্গে আমার বাবার সম্পর্ক ছিল লোহার শিকলে বাঁধা।
মধুসূদন মুচকি হেসে বলল, লোহাতেও যে জং ধরে ভাইটি।
সরি, আমার বাবা মানুষটা অন্যরকম।
সব ছেলেমেয়েই এ কথা বলে। বাপ-মায়ের চরিত্রকে নিষ্কলঙ্ক, পবিত্র দেখে। তারপর এরকম একটা কাণ্ড ঘটলে সব ফঁস হয়। তখন মুখ লুকোনোর জায়গা পায় না।
নীলাদ্রির চড়াৎ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল। তারপরই মনে হল, এই লোকের ওপর রাগ করার কি কোনও মানে হয়? এই বুজরুক কি রাগ করার যোগ্য? সে গম্ভীর গলায় বলল, আমার বাবা আর পাঁচজনের মতো নয়।
না, হলেই ভালো। কিছু মনে কোরো না ভাইটি, তোমার মা মানুষটি কেমন জানতে পারি কি? এই ধরনের গৃহত্যাগের ক্ষেত্রে স্ত্রী খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। স্ত্রীর চরিত্র গোলমাল থাকলে পুরুষমানুষের ঘরে মন টেকে না।
নীলাদ্রি পিঠ সোজা করে বসল। বলল, মনে হচ্ছে আপনি একটু বেশি বলছেন। লিমিট ক্রস হয়ে যাচ্ছে না কি?
মধুসূদন অবাক হওয়ার ভান করে বলল, এর মধ্যে কম বেশির কী হল? ঘরে আর কাউকে রাখিনি তো এই কারণেই। ডাক্তার, উকিল আর আমাদের মতো মানুষদের কাছে কিছু লুকোতে নেই। বাপ মায়ের কোনও দোষ থাকলে বলে দাও, আমার হিসেব করতে সুবিধে হবে। এই যে তুমি মাকে এখানে না এনে নিজে এসেছ, এটা একটি বুদ্ধিমানের কাজ করেছ। সে তো তার নিজের মুখে নিজের চরিত্রের কথা বলতে পারত না। নাও বল।
কথা শেষ করে মধুসূদন কুইল্যা ফের তাকাল ল্যাপটপের দিকে।
দাঁতে দাঁত চেপে নীলাদ্রি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। মনে হচ্ছে না পারা যাবে। এই বদ লোকটাকে ভালোমতো শিক্ষা দেওয়া দরকার।
আমার মায়ের চরিত্র কেমন বলতে পারব না, তবে উনি বুজরুক দেখলে আমার মতো হাত গুটিয়ে বসে থাকেন না এটা জানি। ঠাটিয়ে চড় লাগান।
মধুসূদন কুইল্যা চকিতে মুখ তুলে তাকাল। নীলাদ্রি নির্লিপ্ত ভাবে বলল, নিন এবার বলুন আপনার হিসেব কী বলছে?
মধুসূদন পাশে রাখা মোবাইলটা তুলে কাকে যেন মেসেজ পাঠাল। তারপর বলল, অত হুটোপুটি করলে কী করে হবে? তা ছাড়া তুমি তো ইনফরমেশন প্রায় কিছু দিতেই পারছ না।
যা পেরেছি সেটুকুতে কিছু হবে না? শুনেছি আপনি নাকি কেস পিছু খান তিন-চার অপশন দেন। আমার বাবার ক্ষেত্রে একটা অন্তত দিন। সেখানে গিয়ে একবার হারিয়ে যাওয়া মানুষটার খোঁজ করে দেখি।
মধুসুদন কুইল্যার চোখ এখন আর ঢুলু ঢুলু নয়। পুরো খুলে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে রাগ। রাগ দেখে নীলাদ্রির নিজের রাগ একটু কমল। লোকটার মোবাইলে বিপ বিপ আওয়াজ করে আবার মেসেজ এল। লোকটা ফোন তুলে মেসেজ পড়ে জবাবও দিল। তারপর মুখ তুলে ঠান্ডা গলায় বলল, দেখুন, তিনশো টাকার আদ্দেকটা ফিরিয়ে দিচ্ছি, আপনি চলে যান। আমার অনেক সময় নষ্ট করেছেন। বাইরে অন্য কাস্টমাররা আছে। ঝামেলা করবেন না।
তুমি থেকে সম্বোধন আপনি-তে উঠে যাওয়ায় নীলাদ্রি হাসল। হুমকি তা হলে ভালোই কাজ করেছে। চোখ বড় করে বলল, চলে যাব! সে কী দাদাভাই! চলে যাব কেন? বাবার কোনও হদিস দেবেন না? অত দূর থেকে এত কষ্ট করে এলাম। আমি তো ভিজিটের টাকা ফেরত চাই না, হারানো মানুষের খোঁজ চাই। সেই খোঁজ না পেলে তো এখান থেকে উঠব না।
মধুসূদন কুইল্যা এবার চেয়ারে হেলান দিল। ঠোঁট দুটোকে সরু করে বলল, কী করবেন? মারবেন?
নীলাদ্রি ডান পায়ের ওপর বাঁ-পাটা তুলে বলল, আমি তো সেরকম কিছু বলিনি। আমাকে দেখে আপনার গুন্ডা বলে মনে হচ্ছে? আপনি শুধু বাবা থাকতে পারেন এমন একটা জায়গা বলে দিন, আমি সেখানে চলে যাই। ব্যস, সমস্যা মিটে গেল।
মধুসূদন কুইল্যা দুলতে দুলতে বলল, আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।
নীলাদ্রির মজা লাগছে। লোকটা ঘাবড়ে গেছে। মনে হচ্ছে, একটু পরেই কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। ব্যস, তারপরেই উঠে পড়া যাবে।
বাড়াবাড়ির এখনই কী দেখলেন? নিন, বলুন। নইলে আরও বাড়াবাড়ি হবে।
মধুসূধন ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলল, জায়গা বললে আপনি সেখানে যেতে পারবেন?
নীলাদ্রিও পালটা হেসে বলল, চেষ্টা করব।
মধুসূদন একটু চুপ করে রইল। তারপর জিভ দিয়ে মুখে বিশ্রী একটা আওয়াজ করে বলল, হিসেবটিসেব কষে আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে, আপনার বাবা জেলখানায় আছে। ছেলেকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে বাপটি কেমন। খুন বা রেপ করে পাকাপাকিভাবে ভেতরে ঢুকে গেছে। সেখানে তো আপনি যেতে পারবেন না ভাইটি।
কথাটা বলে মধুসূধন কুইল্যা ফিক করে হাসলেন। নীলাদ্রি শান্তভাবে উঠে দাঁড়াল। বলল, কে বলেছে পারব না, খুব পারব।
কীভাবে? চোখে কৌতুক নিয়ে মধুসূদন কুইল্যা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল।
এক মুহূর্তও সময় নিল নীলাদ্রি। মনে হয় দম টানল। তারপর গায়ের সব শক্তি দিয়ে চড় বসাল গালে। চিমসে লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলের ওপর। নীলাদ্রি আঙুল তুলে বলল, আর একটু আছে দাদাভাই। ল্যাপটপটা তুলে ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। ঝনঝন আওয়াজে বাইরে থেকে প্রথম দরজা ঠেলে ঢুকল শ্রীময়ী। টেবিলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকা মধুসূদন কুইল্যা হিসহিস করে বলল, কাজটা ভালো করলে না ছোকরা, ভালো করলে না।
রাগে কাঁপতে থাকা নীলাদ্রি শ্রীময়ীর হাত ধরে বলল, এবার চল, এই লোকটার একটা শিক্ষা দরকার ছিল।
রিকশা ধরেও পালানো গেল না। নীলাদ্রিরা সোনারপুর স্টেশনে পৌঁছোনোর আগেই দুটো মোটরবাইক পথ আটকে দাঁড়াল। মোট চারজন এসেছে। বোঝাই যাচ্ছে, ঝামেলা হতে পারে ভেবে অনেক আগে থেকেই মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়ে এদের ডেকে নিয়েছিল মধুসূদন। নইলে এত তাড়াতাড়ি আসবে কী করে! তারা খুব ঠান্ডা গলায় নীলাদ্রিকে বলল, নেমে আয় শুয়োরের বাচ্চা।
মোট দুদফায় মারা হল নীলাদ্রিকে। প্রথমবার রিকশা থেকে নামিয়ে রাস্তায়। দ্বিতীয়বার মধুসূধন কুইল্যার চেম্বারের সামনে। মধুসূদন নিজে লোহার রড এনে মারল। রক্তে ভেসে যাওয়া নীলাদ্রিকে আবার রিকশাতে তুলেও দিল ওরা যত্ন করে।
গোটা পথটা তাকে জড়িয়ে শ্রীময়ী থরথর কাপল আর বিড়বিড় করে বলল, আমার জন্য হল, সব আমার জন্য হল…।
রিকশা স্টেশনে পৌঁছনোর পরপরই নীলাদ্রি পুরোপুরি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।