০৬. বাড়িটা হলুদ রঙের

০৬.

বাড়িটা হলুদ রঙের। তবে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়ার কারণে রং ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না। শেষ বিকেলের আলোকে বলে কনে দেখা আলো। এই আলোয় কালো মেয়েও নাকি ফরসা হয়ে ওঠে। অথচ এই বাড়িটাকে দেখাচ্ছে মলিন। মলিন বাড়ির দরজা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এল। নীলাদ্রি। কোনওরকমে সিঁড়িকটা টপকে হুড়মুড়িয়ে নেমে গেল নীচে, পেট চেপে উবু হয়ে বসে পড়ল ফুটপাথের ওপর।

রাস্তার দুপাশে অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কেউ একা দাঁড়িয়ে, কেউ এসেছে দল বেঁধে। তারা চাপা গলায় কথা বলছে। প্রায় সকলেরই চোখেমুখে উদ্‌বেগ। বড় রাস্তা থেকে একটু ঢুকে এই গলিটাই থমথমে। কয়েকজন নির্লিপ্ত ভঙ্গির মানুষও রয়েছে। তারা বসে আছে ফুটপাথে, ব্যাটারির খোল আর আধলা ইটের ওপর। বেশিরভাগেরই লুঙ্গির ওপর খালি গা, থলথলে শরীর। কেউ বিড়ি টানছে, কেউ কানের কাছে রেডিয়ো ধরে গান শুনছে। একজনের হাতে অ্যালুমিনিয়ামের থালা। কিছু খাচ্ছে। নীলাদ্রি পাশে বসে বমি করায় তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হল না। পুলিশ মর্গ থেকে ছিটকে বেরিয়ে মানুষ বমি করবে না তো কী করবে? আর এই ছেলে তো নেহাতই ছোট।

রেডিয়োতে গান শোনা লোকটা কাছে ছিল। পাশে রাখা একটা মগ তুলে এগিয়ে দিল হাত বাড়িয়ে। নীলাদ্রি অবাক হয়েই মগটা ধরল। খানিকটা জল রয়েছে। লোকটা গানের তালে মাথা নাড়তে নাড়তেই ইঙ্গিত করল। চোখে মুখে জল ছিটিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত। নীলাদ্রি তাই করল। মগ ফেরত দিয়ে বলল, থ্যাঙ্কিউ। লোকটা গা করল না। মগটা পাশে রেখে ফের মন দিয়ে গান শুনতে লাগল। যেন ঘটনাটা কিছুই না।

মর্গের দরজার মুখে একটা লোক এসে চিৎকার করছে—

নেক্সট, নেক্সট…পরের জন কে আছেন? কৌন হ্যায়… তাড়াতাড়ি আসুন। জলদি জলদি…।

বাইরে অপেক্ষা করা কয়েকজন ছুটে গেল দরজার দিকে। দরজায় দাঁড়ানো লোকটা বাংলা হিন্দি মিলিয়ে ধমক দিয়ে বলল, আরে আরে, এ কেয়া করতা হ্যায়! এক এক করকে আইয়ে। এ ডেডবডি আছে, ভাগ নেহি সকতা। ঠেলাঠেলি করবেন না। ঝামেলা পাকালে দরজা বন্ধ করে দেব।

ধমক শুনে ছুটে যাওয়া মানুষগুলো থমকে দাঁড়াল। ভাবটা এমন যেন, সত্যি তারা ভুলে গিয়েছিল, তারা মৃতদেহ দেখতে যাচ্ছে। ধীরেসুস্থে গেলেও কোনও সমস্যা নেই। তারা একই। ভাবে শুয়ে থাকবে।

পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল নীলাদ্রি। হাঁটতে শুরু করল। জায়গাটা ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সরে যাওয়া যায় তত ভালো। মুখটা তেতো লাগছে। থুতু কাটছে। মোবাইল বের করে সময় দেখল। শ্রীময়ীর আসতে এখনও একঘণ্টা দেরি। নন্দনের গেটে ঠিক ছটায় দাঁড়াবে। নীলাদ্রি ঠিক করে হাঁটবে। নন্দন পর্যন্ত না পারুক, যতটা পারে ততটা হাঁটবে। তারপর বাসে উঠবে। তার আগে ভালো করে মুখ ধোয়া দরকার। মোবাইল বেজে উঠল। নীলাদ্রি তুলে দেখল পরদায় মা ফুটে উঠেছে।

বল।

 গিয়েছিলি?

হ্যাঁ।

যামিনী চুপ করে রইল। নীলাদ্রির সংক্ষিপ্ত উত্তরেই বোঝা যাচ্ছে, কোনও লাভ হয়নি। তবু তার রাগ হল। লাভ হোক বা না হোক ছেলেটা ফোন তো করবে।

আমাকে ফোন করলি না তো!

কিছু হলে করতাম।

যামিনী আবার চুপ করে রইল মুহূর্তখানেক। তারপর বলল, বাঃ আমাকে একবার জানাবি না?

বলছি তো কিছু হলে সঙ্গে-সঙ্গে তোমাকে জানাতাম। একই কথা কী বলব?

 যামিনী বলল, কী আর বলবি, মা ওকে পেয়েছি?

নীলাদ্রি বুঝতে পারল কাজটা ভুল হয়েছে। একবার ফোন করা উচিত ছিল। সে বলল, উফ তুমি শান্ত হও তো মা। সবসময় হাইপার হয়ে থাক কেন। এই কারণে কিঙ্কির সঙ্গে তোমার এত লাগে। একটু বাদেই তোমাকে ফোন করতাম। আসলে দিনের পর দিন কী একই কথা বলব? সকালে তুমিই তো বললে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। বলনি? এখন আবার রাগারাগি করছ!

যামিনী কথাটা যেন শুনতে পেল না। বলল, আমি জানি, তোরা আমাকে গুরুত্ব দিস না। একটা মানুষ যে অপেক্ষা করে বসে আছে সেটুকুও পর্যন্ত মাথায় থাকে না। যাক, আমি ফোন রাখছি, আমার আজ বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।

কোথায় যাবে?

যাব একটা জায়গায়। বিশাখা থাকবে।

যামিনী ফোন কেটে দেওয়ার পরও মোবাইলের দিকে একটু সময় তাকিয়ে হইল নীলাদ্রি। মা কোথায় যাবে এটা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। নিশ্চয় কোথাও পুজো দিতে বা মানত করতে। পাঁচ বছরে কম করে পাঁচশো জায়গায় পুজো দেওয়া হয়ে গেছে। যে যেমন বুঝিয়েছে। প্রথম বছর সপ্তাহে একদিন উপোস পর্যন্ত শুরু করেছিল। আশ্চর্যের কথা হল, পাঁচ বছর পরেও মানুষটা বাবার জন্য অপেক্ষা করে আছে! সে আর কিঙ্কিনিও কি অপেক্ষা করে? কিঙ্কিনি করে না। বহুদিন আগে সে বলে দিয়েছে, প্লিজ দাদা, এবার তোরা খোঁজাখুঁজি বন্ধ কর। যে লোকটা নিজেই লুকিয়ে আছে তাকে তুই কোথায় পাবি?

লুকিয়ে আছে বলছিস কেন? অ্যাক্সিডেন্ট হতে পারে।

কী বলছিস তুই, অ্যাক্সিডেন্ট হলে ঠিক জানা যেত। এতগুলো থানায় খবর দেওয়া আছে, ফটো পাঠানো হয়েছে, কাগজে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে।

দুর বোকা, এত বড় দেশ রোজ কোথায় কী ঘটছে জানা যায়। পুলিশ জানতে পারে? দেখিস না রোজ কত মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে? তাদের কোনও ট্রেস পাওয়া যায় না। পেপারে পড়িস না? বিদেশেও তো কিছু হতে পারে। ধর বাবা ফরেনে কোথাও গিয়ে…।

কিঙ্কিনি ঠোঁটের ফাঁকে হেসে বলল, তোদের মতো বুদ্ধিমান না হলেও আমি একেবারে বোকাও নই দাদা। বাবা রাতারাতি পাসপোর্ট বানিয়ে ভিসা করে জাপান, আমেরিকা বা আবুধাবি চলে গেছে এ কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলিস? সরি। আর যদি দেশের অন্য কোথাও অঘটন কিছু ঘটে থাকে আমি মনে করি সেটাও একই হল। আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছে বলেই তো কোথাও গেছে। অতবড় একটা মানুষকে তো ছেলেধরা ধরে পাচার করে দেয়নি। নাকি তোর মনে হয় দিয়েছে?

নীলাদ্রি চুপ করে গিয়েছিল সেদিন। বোনের যুক্তি ভাঙতে পারেনি। আজ বোঝে যতটা না সে তার হারিয়ে যাওয়া বাবার জন্য অপেক্ষা করে আছে তার থেকে অনেক বেশি কর্তব্য করছে। শুধু কি কর্তব্য? নাকি আরও কিছু?

মর্গে মৃতদেহ দেখতে আসা নীলাদ্রির এই প্রথম নয়। গত পাঁচ বছরে তাকে বহুবার আসতে হয়েছে। থানা থেকে আনক্লেইমড ডেডবডির খবর দিলেই দেখে যেতে হত। মৃত্যুর তালিকায় কিছুই বাদ যায়নি। বাসে চাপা, ট্রেনে কাটা, জলে ডোবা, আগুনে পোড়া সব পেয়েছে। নীলাদ্রি যখন আসত সঙ্গে কেউ না কেউ থেকেছে। হিন্দোল বেশ কয়েকবার গেছে। পাড়ার আর কলেজের বন্ধুরাও ছিল। একবার দেবনাথের অফিসের অনেকে এল। সেবার সবাই প্রায় নিশ্চিত ছিল, দেবনাথের মৃতদেহই আছে। পুলিশ সেরকমই বলেছিল। একেবারে প্রথম দিকের ঘটনা। হারিয়ে যাওয়ার মাস তিনেকও হয়নি। বড় ধরনের একটা বাস অ্যাক্সিডেন্ট ছিল সেটা। বাস খালে পড়ে গিয়েছিল। ঘটনার পনেরো দিন পরে জানা গেল, তিনটে মৃতদেহ এখনও আনক্লেইমড, নাম-ঠিকানা নেই, খুঁজতেও আসেনি। তার মধ্যে একজনকে নাকি অবিকল দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো দেখতে। গায়ের জামা, হাতের আংটি, কপালে কাটা দাগ–সব মিলে যাচ্ছে। সবাই ছুটে এল মর্গে। কীভাবে মৃতদহ বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে তা-ও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। দেহ। দেখেছিল নীলাদ্রিই। জামা, আংটি দেখতে হয়নি, একঝলক মুখ দেখেই বুঝেছিল, না, মানুষটা তার বাবা নয়। মর্গে অনেকে এলেও ভিতরে ভিড় বাড়ানোর নিয়ম নেই। একা গিয়ে মৃতদেহ দেখে আসত নীলাদ্রি। কোনও রকম সন্দেহ হলে আর একজনকে ডেকে নেওয়া যেত। সেরকম সন্দেহ খুব কমই হয়েছে। হাতে গুনে বার দুই বিভ্রান্ত হয়েছে। মনে হয়েছে হলেও হতে পারে। এই রকম একটা শার্ট ছিল না বাবার? ঘড়ির ব্যান্ডটাও তো এক! প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। বীভৎস মৃতদেহের সারি দেখে শিউরে শিউরে উঠত। ভয় করত। রাতে ঘুম হত না। একেকদিন যামিনীকে ডেকে তুলত।

মা আর পারছি না। রোজ রোজ মরা মানুষের মুখ দেখে আমার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

কী করবি বল? যামিনী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলত।

আমি আর যাব না।

যামিনী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলত, ঠিক আছে আমি যাব। আমিই তো যেতে চাই, পুলিশ বলে বাড়িতে পুরুষমানুষ কেউ থাকলে তাকে পাঠাবেন।

নীলাদ্রি বলল, পুলিশকে বলে দেবে, আমরা কেউ যাব না। তুমি আমি কেউ নয়; দয়া করে তারা আমাদের যেন আর খবর না দেয়। অনেক হয়েছে। এনাফ ইজ এনাফ।

যামিনী চুপ করে থেকে বলে, আচ্ছা, তাই বলে দেব।

কদিন পরেই থানা থেকে আবার ফোন আসে–

বাগনানের কাছে রেললাইনের পাশে একটা বডি পাওয়া গেছে ম্যাডাম। অবস্থা খুব খারাপ। মুখ প্রায় বোঝাই যাচ্ছে না। রেলেকাটা যেমন হয় আর কী। একবার যদি চান কাল মর্গে গিয়ে দেখে আসতে পারেন।

আমরা আর ডেডবডি দেখব না বলতে গিয়েও থমকে যায় যামিনী। বুঝতে পারে একথা বলার ক্ষমতা তাদের নেই। ক্লান্ত গলায় বলে, ঠিক আছে আমি যাব।

আপনি!

কেন আমি হলে অসুবিধে?

ওপাশের লোকটা সামান্য হাসল। বলল, আমাদের আর সুবিধে-অসুবিধে কী বলুন। ম্যাডাম? আমাদের কিছু নয়, আমরা বলি, মেয়েমানুষের ওসব সিন না দেখাই ভালো।

মেয়েমানুষ শুনে যামিনী বিরক্ত হয়। কঠিন গলায় বলে, যাদের ঘরে পুরুষমানুষ নেই তারা কী করে?

সে না থাকলে আর কী করা যাবে? আপনি যদি যেতে চান তো যাবেন।

যামিনী খানিকটা আপনমনে বলল, হ্যাঁ, এবার থেকে আমিই যাব।

যামিনীর নাকে-মুখে আঁচল। মর্গের থলথলে চেহারার ডোম প্রথমে ভুরু কুঁচকে যামিনীকে। দেখেছিল। তারপর খানিকটা দ্বিধা নিয়েই মৃতদেহের মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে দিল। মুখ নয়, একটা খোবলানো মাংস পিণ্ড! মাথা ঘুরে সেখানেই পড়ে যায় যামিনী। মর্গের কর্মীরা বাইরে ছুটে আসে। খোঁজ নেয়, জ্ঞান হারানো মহিলার সঙ্গে কেউ এসেছে কিনা। না, কেউ আসেনি।

সবাই খুব বকাবকি করেছিল সেবার। বিশাখা বলেছিল, এটা তোমার খুব অন্যায় হয়েছে যামিনীদি। অন্তত নীলকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।

যামিনী বিষণ্ণগলায় বলেছিল, নীল আর পারছে না। আমার কিছু হত না, আসলে ডেডবডিটা খুব খারাপ ছিল। রেল অ্যাক্সিডেন্ট। মুখটা একেবারে বিকৃত হয়ে গেছে। মনে পড়তে শিউরে উঠল যামিনী।

হিন্দোলকে বলতে পারতে।

কত বলব? ছেলেটা তো সবই করছে। অনেকবার মর্গেও তো গেছে। ডেডবডি ঘাঁটার জন্য মানুষকে রোজ রোজ বলতে লজ্জা লাগে। তোদের দেবনাথদা তার বউ, ছেলের জন্য চমৎকার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে। ডেডবডি দেখার ব্যবস্থা। খুব ভাগ্য করলে সংসার এমন মানুষ পায়।

বিশাখা বলে, এমন করে বলছ কেন যামিনীদি? এমন করে বোলো না।

যামিনী আর পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, এর থেকে যদি দুটো লাইন চিঠি লিখে বলত, আমি ভালো আছি, তোমরা চিন্তা করো না। আমি আর বাড়ি ফিরব না। তা হলে এই খুঁজে বেড়ানোর যন্ত্রণা থেকে আমরা মুক্তি পেতাম।

তারপর থেকে আর কখনও মর্গে যায় না যামিনী। নীলাদ্রিই আবার শুরু করেছে। তবে যত দিন যাচ্ছে, ডাক কমে আসছে। প্রায় এক বছর পরে ভবানীভবন থেকে আজ সকালে ফোন এল। বসার ঘরে ফোনটা বেজে যাচ্ছিল, যামিনী ধরছিল না। কাউকে ধরতে বলছিলও না। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কাল রাতের পর থেকে কথাবার্তা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। কিঙ্কিনি ফেরার পর নীলাদ্রিকে মোবাইলে ফোন করেছিল।

ফিরে এসো।

 কিঙ্কি ফিরেছে?

যামিনী থমথমে গলায় বলল, হ্যাঁ, ফিরেছে।

নীলাদ্রি উদবিগ্ন হয়ে বলল, কী হয়েছিল?

 জানি না। জানতে চাইও না। মদ খেয়ে ফিরেছে।

 নীলাদ্রি একটু চুপ করে থেকে বলে, কী আজেবাজে কথা বলছ মা!

যামিনী বলল, ঠিকই বলছি। তোমার বোন শুধু মদ খায়নি, বাড়িতে ঢুকে মাতালের। মতো আচরণ করছে। তুমি চলে এসো।

হতভম্ব নীলাদ্রি দ্রুত সাইকেল চালিয়ে ফিরেছে। সন্ধের ঝড়-বৃষ্টিতে চারপাশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। তার ওপর অনেক রাত। কিঙ্কি মদ খেয়েছে! হতেই পারে না। মা নিশ্চয় বানিয়ে বলছে। মেয়েটার ওপর মায়ের খুব রাগ। বানিয়ে বানিয়ে দোষ খোঁজে। তবে যতই রাগ থাকুক মেয়ে সম্পর্কে এমন বিশ্রী কথা বানিয়ে বলাও ঠিক নয়। কিঙ্কি শুনলে কী হবে? মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও তেতো হবে। এর একটা শেষ দরকার। তবে কিঙ্কিটা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। পাড়ার দু-একজন পুরোনো বন্ধু তাকে বলেছে। বদ্র একদিন বলেছিল, একটা কথা বলব নীল? কিছু মনে করবি না তো?

কী হয়েছে?

বদ্রু একটু দ্বিধা করেই বলল, তোর বোন বলেই বলছি।

 কিঙ্কি! কী করেছে কিঙ্কি!

বদ্রু একটা হাত নীলাদ্রির কাঁধে রেখে বলল, তোর বোন তো আমাদেরই বোনের মতো, সেদিন দেখলাম ঠা ঠা দুপুরে রেল গেটের কাছ দিয়ে যাচ্ছে।

নীলাদ্রি বিড়বিড় করে বলল, হয়তো কাজে যাচ্ছিল, পড়তৌড়তে যায়।

পড়তে যাচ্ছিল না, ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছি। জায়গাটা তো ভালো নয়। রেলগেটের ভাঙা শিবমন্দিরে একটা বাজে আখড়া আছে, জানিসই তো। মদ-গাঁজা খাওয়া হয়।

নীলাদ্রি বোনকে ডেকে বলেছিল। ভালোভাবেই বলেছিল, রাগারাগি করেনি।

জায়গাটা বাজে, ওদিকে যাসনি।

কিঙ্কিনি উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, কত বাজে? আমার বাড়ির থেকে বাজে তো নয়। আমি আজকাল বাজে জায়গাই পছন্দ করছি দাদা। ভাবছি একদিন ওই ভাঙা মন্দিরে যাব। তুই যদি চাস, চল না।

সেদিন হাসাহাসি করলেও আজ মারাত্মক অন্যায় করেছে কিঙ্কি। কোনওভাবেই তাকে ক্ষমা করা যায় না। এত রাত করা তার উচিত হয়নি। মোবাইল ফোনটাও বন্ধ রেখেছিল! হায়ার সেকেন্ডারি কেন চাকরি করলেও কোনও মেয়ে এই কাজ করতে পারে না। না বলে এত রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে! বাবা থাকলে, ও এই সাহস পেত? কিঙ্কি কেন? ছেলে হয়ে সে নিজেও একাজ করতে পারত না। নীলাদ্রি ঠিক করেছিল, বাড়ি ফিরেই কিঙ্কিনিকে বকাঝকা করবে। সে সুযোগ পায়নি। কিঙ্কিনি দরজা আটকে শুয়ে পড়েছিল। সেই দরজা সকালেও খোলেনি। মা বাড়ি থাকা পর্যন্ত সে খুলবে না তা-ও বোঝা যাচ্ছিল।

ফোনটা বেজেই যাচ্ছিল। নীলাদ্রি নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ধরল। ভবানীভবন শুনে বিরক্ত গলায় বলল, বলুন কী ব্যাপার।

একটা সুইসাইড কেস হয়েছে। মিডল এজেড মেইল। দুবছর হল বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। বাড়ি মানে একতলার একটা ঘর। কাল বিকেলে গলায় দড়ি দিয়েছে। পুলিশ গিয়ে জানতে পেরেছে, লোকটা বাড়িওলার কাছে নাম ঠিকানা সবই মিথ্যে দিয়েছিল। সুটকেসের একপাশে শুধু লেখা আছে ডি. চট্টোপাধ্যায়।

নীলাদ্রি বলল, ডি মানেই দেবনাথ হবে এমনটা ভাবলেন কেন? ডি দিয়ে অনেক নাম হতে পারে।

ওপাশ থেকে লোকটি বলল, আমরা কিছুই ভাবিনি। আপনাদের জানানোটা ডিউটি তাই জানালাম। নইলে আপনারাই তো বলবেন পুলিশ কিছু করে না। এখন বুঝতে পারছেন, পুলিশ করে। পাঁচ বছরের পুরোনো কেসও আমরা তামাদি করিনি।

নীলাদ্রি চাপা গলায় বলল, লাভ তো কিছু হচ্ছে না, অকারণ ছোটাছুটি করছি।

আর দুটো বছর কষ্ট করুন।

 তারপর কী? নীলাদ্রি অবাক হল।

সাত বছর হয়ে গেলে গভর্মেন্ট থেকেই ডেথ ডিক্লেয়ার করে দেয় বলে শুনেছি। সার্টিফিকেট পেয়ে যাবেন।

নীলাদ্রি মুখ দিয়ে আওয়াজ করে বলল, জানি, কিন্তু তারপর কি আর ডেডবডি দেখতে হবে না?

লোকটা ব্যঙ্গের গলায় বলল, না দেখলেও চলবে। এত বিরক্ত হতে হবে না।

নীলাদ্রি লজ্জা পেল। বিরক্ত ভাবটা বেশি দেখানো হয়েছে। সত্যি তো পুলিশ কী করবে? তারা যে আজও খবর দিচ্ছে, এটাই অনেক।

যামিনী কোনও উৎসাহ দেখাল না। নীলাদ্রি আত্মহত্যার কথাটা গোপন রেখে বলল, সুটকেসের গায়ে না কোথায় ডি চট্টোপাধ্যায় লেখা পেয়েছে। কী করব? যাব?

তুমি যদি চাও যাবে।

 নীলাদ্রি খবরের কাগজ টেনে নিয়ে বলল, যা চাই তা কি করা যায়? পাঁচ বছরে পেরেছি?

 যামিনী খানিকটা নিজের মনেই বলল, গিয়ে কোনও লাভ হবে না।

জানি, তবু যেতে হবে। নীলাদ্রি কাগজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল।

যামিনী বলল, যদি যাও সঙ্গে কাউকে নিয়ে যেও, একা যেও না।

নীলাদ্রি মুখ তুলে বলল, না, যাওয়ার হলে এবার থেকে আমি একাই যাব। কাউকে বলতে অপমান লাগে। মনে আছে, গতবার প্রণবকে বলেছিলাম, কেমন অ্যাভয়েড করে গেল। বলল ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত আছি। আর নয়।

যামিনী খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কাল ওখানে গিয়েছিলি না?

 কোথায়? বাবার অফিসে?

কিছু হল? কিছু বলল? যামিনী দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

কাগজের পাতা উলটোতে উলটোতে নীলাদ্রি এমন ভান করল যেন কথাটা শুনতে পায়নি। যামিনী আবার বলল, কীরে, কী হল বললি না তো?

নীলাদ্রি বলল, না, কিছু হয়নি। কথাটা বলেই বুঝল, মিথ্যেটা সহজভাবে বলা হল না।

যামিনী ভুরু কোঁচকালো, হয়নি মানে!

নীলাদ্রি মুখ নামিয়ে বলল, অর্ধেন্দুকাকুর সঙ্গে দেখা হয়নি।

ও, তুই আর ফোন করেছিলি?

নীলাদ্রি কথা ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, না, পরে করব। মা শোনো, কিঙ্কিকে নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

যামিনী রান্নাঘরে ঢুকে যেতে যেতে বলল, আমার নেই।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর ওপর মিষ্টির দোকান দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল নীলাদ্রি। এখানে জল পাওয়া যাবে। চা-ও রয়েছে। চা খেলে কি মুখের তেতো ভাবটা কমবে? চায়ের অর্ডার দিয়ে। ভালো করে মুখ ধুল নীলাদ্রি। দোকানের কিশোর ছেলেটি এগিয়ে বলল, আর কিছু খাবেন?

না।

খান না ভালো শিঙাড়া আছে। গরম।

নীলাদ্রি হেসে হাত নাড়ল। ছেলেটা যদি জানত, খানিকক্ষণ আগে তার খদ্দের মর্গের ভেতর ছিল, তা হলে কি এত সহজে শিঙাড়ার কথা বলতে পারত? শ্রীময়ীকে না বললে সে ও কি বুঝতে পারবে? পরশু যখন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল, তখন অবশ্য মর্গের বিষয়টা ছিল না। ফোনে শ্রীময়ী বলেছিল, ছটার সময় নন্দনের সামনে দাঁড়াই তা হলে?

নীলাদ্রি বলল, আবার সেই নন্দন? তোমাকে বলেছি না, জায়গাটা আমার পছন্দ হয় না।

শ্রীময়ী হেসে বলল, কেন বল তো, তোমার নন্দন নিয়ে এত অ্যালার্জি কীসের?

নন্দন নিয়ে নয়, কবিদের ভিড় নিয়ে। শরীরের ভেতর আমার কেমন যেন করে? ইরিটেশন হয়।

আমিও তো কবিতা লিখি। আমাকে নিয়ে ইরিটেশন হয় না তো? কথাটা বলে সুন্দর করে হাসল শ্রীময়ী।

শ্রীময়ীর এই সুন্দর হাসি নীলাদ্রি প্রথম দেখে ঠিক দু-বছর আগে। কলকাতার কোনও এক বিয়েবাড়িতে। মেয়েটাকে আহামরি কিছু দেখতে নয়, চট করে চোখেও পড়েনি। হঠাৎ নীলাদ্রির নজর কাড়ল হাসি। চমকে উঠেছিল। মেয়েটা হেসে শুধু নিজেই সুন্দর হয়নি, চারপাশটাও বদলে দিয়েছে! ঝলমলিয়ে উঠেছে। মানুষের হাসি এত সুন্দর হয়। সেদিন সেই মেয়ে যতবার হেসেছে লুকিয়ে দেখেছিল নীলাদ্রি। বিয়েবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সময়, সিঁড়ির কোনায় মেয়েটাই তাকে ধরে। সহজভাবে বলে, খেলেন, অথচ মেনুটা নিয়ে গেলেন না? খাবারের নাম তো সব ভুলেই যাবেন। নিন ধরুন। হাতে একটা কাগজ গুঁজে তরতরিয়ে ওপরে উঠে যায় একইরকম সহজ ভঙ্গিতে।

হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে সেই কাগজ খুলেছিল নীলাদ্রি। কাগজে দ্রুত হাতে লেখা–

একটা অচেনা মেয়ের দিকে অমন করে তাকিয়ে থাকতে হয়? ছিঃ। আমি খুব রাগ করেছি। আপনি কে? আমি শ্রীময়ী। আমার মোবাইল নম্বর নীচে লিখে দিলাম। আপনি কাল বিকেলে ফোন করে ক্ষমা চাইবেন। আমি অপেক্ষা করব।

নীলাদ্রি পরদিন সকালেই ফোন করেছিল। সেদিন তার অফিসে কাজ ছিল। যাওয়ার পথেই করে। বিকেলে ছুটির পর দেখা করে শ্রীময়ী।

শ্রীময়ী একদিন জিগ্যেস করেছিল, শুধু কি আমার হাসিও সুন্দর, আমি সুন্দর নই?

নীলাদ্রি বলল, হাসি কান্না সুন্দর হলে তবেই মানুষ সুন্দর হয়।

তোমার হাসিও সুন্দর নীল।

নীলাদ্রি মুখ ফিরিয়ে বলেছিল, মনে হয় না।

শ্রীময়ী হেসে বলে, তুমি কী করে বুঝবে? তুমি কি কখনও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাসি দেখেছ? আজই বাড়ি ফিরে দেখবে।

নীলাদ্রি ম্লান হেসে বলল, আমাদের বাড়িতে বহুদিন হাসি বন্ধ শ্রীময়ী। হাসতে ইচ্ছে করলেও আমি বা আমার বোন হাসতে পারি না। কেন পারি না জানো? পাছে লোকে কিছু বলে, বলে এদের বাবা এদের ছেড়ে চলে গেছে তবু এরা হাসে কী করে! এদের লজ্জা করে না!

শ্রীময়ী ঘন হয়ে আসে। নীলাদ্রির পিঠে হাত রেখে বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

হবে না শ্রীময়ী। মানুষ মারা গেলে একদিন সব ঠিক হয়ে যায়। হারিয়ে গেলে হয় না। মাঝেমধ্যে বড় অপমানিত লাগে।

শ্রীময়ী থামিয়ে দেয়। নীলাদ্রির হাত ধরে বলল, ওসব কথা রাখো। এখন আমার দিকে তাকাও তো, অ্যাই তাকাও বলছি। একটা কবিতা লিখেছি শুনবে?

নীলাদ্রি মুখ ফিরিয়ে হেসে ফেলে। বলে, আমাকে কবিতা শোনাবে! খেয়েছে, আমি কবিতার কী বুঝব?

শ্রীময়ী হেসে বলল, কেন তুমি কি শুধু হাসি বোঝ? হাসিবিশারদবাবু? এবার থেকে তোমাকে কবিতাও বুঝতে হবে। কবিতা রাগ দুঃখ অপমান সব মুছে দিতে পারে।

চায়ের কাপ মুখে তুলতে গিয়ে নীলাদ্রি হাত সরিয়ে নেয়। একটু আগে দেখে আসা মুখটা আবার মনে পড়ল। কী ভয়ঙ্কর! গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলে মানুষের মুখ এত ভয়াবহ হয়ে যায়! এত বীভৎস। জিভ ঝুলে পড়েছে, চোখ বেরিয়ে এসেছে ঠিকরে। যেন শেষ মুহূর্তে সবটা দেখে নিতে চেয়েছিল! একটা জীবনে যতটা দেখা যায়, যতটা বাকি রয়ে গেল– সব। ভাগ্যিস মানুষটা তার বাবা ছিল না। মা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারত না।

আবার গা গুলিয়ে উঠল নীলাদ্রির। সে ভরা চায়ের কাপ রেখে দাম মিটিয়ে বেরিয়ে এল। ফোন করে আজ আসতে বারণ করে দেবে শ্রীময়ীকে? বাড়ি ফিরে যাবে? না থাক, শ্রীময়ীর সঙ্গে থাকলে মনটা ভালো হয়।

মন ভালো হল না নীলাদ্রির। মর্গের কথা শুনে শ্রীময়ীও মুষড়ে পড়ল।

নীলাদ্রি বলল, সরি, তোমাকে বলা ঠিক হয়নি।

শ্রীময়ী ফিসফিস করে বলল, না, তুমি সবই বলবে। সব।

নীলাদ্রি বিষণ্ণ হেসে বলল, একটা সুন্দর হাসির মেয়ে কেমন দুঃখের মধ্যে জড়িয়ে পড়ল বল দেখি।

একশোবার পড়ব। তুমি কিছু লুকোবে না, তোমার সব কষ্ট আমাকে জানাবে। নীলাদ্রি আবার হাসল। সব জানাবে কী করে? সব কি জানানো যায়? সব কি সে নিজেও জানে? জানে না। কেন কিঙ্কির ওপর মায়ের এত রাগ, এত ঘৃণা? কেন অর্ধেন্দু দত্ত তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বাবার অফিসে পিওনের কাজ দিতে চায়? কীসের প্রতিশোধে সে এই অপমান করে? কেন কিঙ্কির মতো চমৎকার মেয়ে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে? তার থেকেও বড় কথা পাঁচ পাঁচটা বছর পার হয়ে গেল, আজও জানা হল না, সেই মানুষটা কেন সব ছেড়ে চলে গেল? সবাইকে ছেড়ে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *