০৪.
কেমন আছ নীলাদ্রি?
ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?
আছি একরকম। বয়স বাড়ছে, শরীরে নানান গোলমাল শুরু হয়েছে। তোমার মা কেমন আছেন? বোন? তোমার বোনের নামটা যেন কী? খুব সুন্দর একটা নাম…আহা, মনে পড়ছে না…কী যেন…।
কিঙ্কিনি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েছে, কিঙ্কিনি। নীলাদ্রি, কিঙ্কিনি–তোমার বাবা সুন্দর সুন্দর নাম রেখেছে।
বাবা নয়, আমার মায়ের দেওয়া নাম।
তাই নাকি! বাঃ। কিঙ্কিনি কেমন আছে? সে কত বড় হল?
এবার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়েছে।
সে কী! এত বড় হয়ে গেছে। আমি যখন দেখেছিলাম, এইট না নাইনে পড়ছে। কী খাবে নীলাদ্রি?
না না, আমি কিছু খাব না, খেয়ে এসেছি।
খেয়ে এসেছে তো কী হয়েছে? ট্রেন জার্নিতে সব হজম হয়ে গেছে।
সত্যি খাব না।
আচ্ছা, সে দেখা যাবে। আগে কাজের কথা বলে নিই, তারপর দুজনে মিলে না হয়। বেরিয়ে গিয়ে কোথাও খাব। নাকি তোমারও তোমার বাবার মতো স্বভাব? সবসময় বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে? হা হা। তোমার বাবার ব্যাপারটা জানো তো? অফিস টাইমের পর একমিনিটও উনি অপেক্ষা করতেন না। ট্রেন ধরতে ছুটতেন।
অর্ধেন্দু দত্ত আওয়াজ করে হাসলেন। নীলাদ্রির অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তি হওয়ার কথা। সে বসে আছে তার বাবার অফিসে। অর্ধেন্দু দত্ত অফিস ইউনিয়নের সেক্রেটারি। তিনি নীলাদ্রিকে একতলায় ইউনিয়নরুমেই বসিয়েছেন। যতই ইউনিয়নরুম তোক বাড়িটা তো এক। অস্বস্তি তো হবেই। দেবনাথ কখনও ছেলেমেয়েদের অফিসে নিয়ে আসেনি। ফ্যামিলি পিকনিক, অ্যানুয়াল ফাংশনে অনেকেই স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে আসত। সেখানেও নীলাদ্রিরা আসেনি। দেবনাথ নিজেই এ ধরনের গেটটুগেদার যতটা পারত এড়িয়ে যেত। তার ভালো লাগত না, আবার দূরত্বটাও একটা কারণ ছিল।
অর্ধেন্দু দত্ত কাল ফোন করেছিলেন। রাতে যামিনীকে কথাটা বলতে যামিনী ছেলের দিকে চমকে তাকাল। দু-বছর পর লোকটার নাম শুনছে। ভুরু কুঁচকে বলল, কখন করেছিল?
দুপুরে। বললেন, কাল সেকেন্ড হাফে যেন একবার বাবার অফিসে যাই।
যামিনী উৎসাহ গোপন করে বলল, কেন? কিছু বলেছে? তোর বাবার টাকা-পয়সার কিছু ব্যবস্থা করেছে?
না, বাবার কিছু নয়, আমার কাজের ব্যাপারে কথা বলতে চান। এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন জানতে চাইলেন। কী করি বল তো?
যামিনী আবার বিছানা করার কাজে মন দেয়। নিস্পৃহ ভাবে বলল, তুই যা ভালো বুঝবি কর। একটা পাকা কাজ পেলে তো ভালোই।
নীলাদ্রি বলল, তুমি আমার সঙ্গে যাবে মা?
যামিনী মুখ ঘুরিয়ে বলল, না। আমি কেন যাব? তোমাকে ডেকেছে তুমি যাও। যদিও ওই লোক কতটা কী পারবে আমার জানা নেই। তোর বাবারটা তো কিছুই পারল না। আবার কে জানে পারতেও পারে, ইউনিয়নের অনেক ক্ষমতা। একটা পারেনি বলে আর কিছু পারবে না এমন না-ও হতে পারে, তবে পারুক না পারুক তুমি আমাকে জড়াবে না।
নীলাদ্রি আর কথা বাড়ায়নি। তার কৌতূহল বেশি নয়। একটা সময় এই অর্ধেন্দু দত্ত লোকটার সঙ্গে মায়ের খুব ভালো যোগাযোগ ছিল। মা ওঁর কাছে যেত। উনিও এ-বাড়িতে এসেছেন। ফোন করতেন। তাদের খবর নিতেন। হঠাৎ সব বন্ধ হয়ে গেল। মনে আছে কিঙ্কি তাকে জিগ্যেস করেছিল, দাদা, অর্ধেন্দুকাকুর সঙ্গে মায়ের কী হয়েছে জানিস?
নীলাদ্রি অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, অর্ধেন্দুকাকুর সঙ্গে! কী হয়েছে?
কিঙ্কিনি ঠোঁটের কোণে বেঁকা হেসে বলল, মনে হয় ঝগড়া হয়েছে।
কী বলিস যা-তা, ওরা কি তোর মতো ছেলেমানুষ?
কিঙ্কিনি স্কুল ইউনিফর্ম পরে ছিল। চুলের বেণি পিঠ থেকে সামনে এনে, ফিক করে হেসে বলল, বড়মানুষদেরও ঝগড়া হয়। কাল রাতে অর্ধেন্দুকাকু ফোন করেছিল। মা বলল, আর কখনও এ বাড়িতে ফোন করবেন না। হি হি। আমি আড়াল থেকে শুনেছি। হি হি।
নীলাদ্রি অবাক হয়ে বলল, হাসছিস কেন?
ওমা বড়দের ঝগড়া দেখলে হাসি পাবে না! সবাই কি তোর মতো হাঁদা?
কথাটা সরল হলেও কিঙ্কিনি বলেছিল বেঁকা ভাবে। তারপর কাঁধে স্কুলের ব্যাগ তুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল একছুটে। নীলাদ্রি অবাক বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর ভুলেও গেল। কাল আবার অর্ধেন্দু দত্তর ফোন পেয়ে মনে পড়েছে। সত্যি অর্ধেন্দু দত্তর সঙ্গে মায়ের কোনও সমস্যা হয়েছিল নাকি?
হ্যাঁ, সমস্যা হয়েছিল। সমস্যাটা বুঝতে পেরেও যামিনী ঠেকাতে পারছিল না। শুধু বুঝতে পারছিল, ভুল হচ্ছে। অন্যায় হচ্ছে। নিজেকে আটকাতে হবে। পারছিল না। চোরাস্রোতের মতো গোপন টানে ভেসে যাচ্ছিল। হঠাৎই একদিন মেয়ের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে সে। ভয় পায়। মনে হয় কিঙ্কিনি সব বুঝতে পারছে! সব দেখতে পাচ্ছে। কিঙ্কিনি নয়, কিঙ্কিনির চোখ দিয়ে দেখছে দেবনাথ! সেদিন থেকেই নিজেকে বেঁধে ফেলল যামিনী। অর্ধেন্দু দত্তর সঙ্গে সম্পর্কের ইতি তখনই।
এই অফিসে নীলাদ্রি আগে একবারই এসেছে। তার মায়ের সঙ্গে। পাঁচ বছর আগে। দেবনাথের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটা তখন সবে ঘটেছে। দশদিনও হয়নি। সেদিন দেবনাথের পরিচিতরা প্রায় সকলেই নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসেছিল। কেউ যামিনীর সঙ্গে টুকটাক কথা বলেছিল, কেউ চুপ করে দূরে দাঁড়িয়েছিল। যারা দেবনাথের অতটা ঘনিষ্ঠ নয়, এক ডিপার্টমেন্টে কাজও করত না, তারা মা আর ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিল হাঁ করে। সেই তাকানোয়
যতটা না সহানুভূতি ছিল তার থেকে বেশি ছিল কৌতূহল। হারিয়ে যাওয়া মানুষের স্ত্রী, সন্তান। কেমন হয় তাই দেখার কৌতূহল। সোমপ্রকাশ রায়চৌধুরি বলে এক ভদ্রলোক সেই সময় এই অফিসের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন। তার কাছেই এসেছিল যামিনী। খবর পেয়ে তিনি নিজে এসে দরজা খুলে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। দেবনাথ বলত, তাদের বস নাকি রাগী আর খিটখিটে। যামিনীরা সেরকম কিছু দেখল না। ভদ্রলোক খুবই আন্তরিকভাবে কথা বললেন। অথচ আদিখ্যেতা ধরনের সান্ত্বনাও দিলেন না। সোজা কথার মানুষ।
মিসেস চ্যাটার্জি, আপনাকে যদি বলি, চিন্তা করবেন না, সেটা মিথ্যে বলা হবে। অবশ্যই চিন্তা করবেন। আমরাও চিন্তা করব। যতদিন না ওঁর একটা খোঁজ পাওয়া যায় ততদিন এই চিন্তা থাকবে।
যামিনী বলল, আমি, আপনার কাছে সাহায্যের জন্য এসেছি।
অবশ্যই, বলুন কী করতে পারি। আমরা ঠিক করেছি, পুলিশকে অফিস ম্যানেজমেন্টের পক্ষ থেকে চিঠি দেব। রিকোয়েস্ট করব যাতে বিষয়টা প্রপার গুরুত্ব দেওয়া হয়। পুলিশ অনেক সময় কেস ফেলে রাখে। অথচ ওরা ইচ্ছে করলেই পারে। যাক, বলুন আমরা কী করতে পারি। মিস্টার চ্যাটার্জির খোঁজ পাওয়ার ব্যাপারে অফিস সবরকম কো-অপারেট করবে।
গত কটা দিন যামিনী উদভ্রান্তের মতো হয়েছিল। কী খাচ্ছে, কী পরছে খেয়াল ছিল না। দেবনাথের অফিসে আসছে বলে সেদিন খানিকটা পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়েছে। সেভাবে বাপের বাড়ি বলে যামিনীর কিছু নেই। মা ছোটবেলায় মারা গেছেন। বাবা মারা যায় মেয়ের বিয়ে দেওয়ার একবছর পর। একমাত্র ভাই বহুদিন ধরে বাইরে। পড়াশোনায় ভালো ছেলে। পড়তেই আমেরিকা যাওয়া। সেখানেই চাকরি, জোহান নামে এক ফুটফুটে আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে। তারপর এদেশ-ওদেশ করে এখন কুইবেক শহরে বাড়ি বানিয়েছে। কলকাতায় আসে না। আমেরিকান বউ বাচ্চার সহ্য হয় না। বোনের বিয়ের সময় মাত্র দুদিনের জন্য এসেছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর তা-ও পারেনি। ওখান থেকে বোনকে বলেছিল–অতদিন ধরে বডি রাখার প্রশ্ন ওঠে না দিদি। তুই আর জামাইবাবু সব মিটিয়ে ফেল। আমি আর এখন যাচ্ছি না।
যামিনী অবাক হয়ে বলেছিল, আর কাজকর্ম?
কাজকর্ম মানে!
শ্রাদ্ধশান্তির কী হবে?
ভাই টেলিফোনে একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, তুই করবি। আমি খরচ-টরচ যা লাগে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
যামিনী রেগে গিয়ে বলে, খরচের কথা বলছিস কেন? ছেলে থাকতে আমি বাবার কাজ করব কী করে? আত্মীয়স্বজন কী বলবে?
দিদি, ইটস ইওর প্রবলেম। তোদের সমস্যা। আমি অনেকদিন ধরেই এসব নিয়মকানুনের বাইরে। প্লিজ আমাকে টানিস না। তা-ও মা বেঁচে থাকলে একটা মানে ছিল। অন্যরা কী বলল না বলল কিছু এসে যায় না। হু আর দে? ওরা কে? তুইও মাথা ঘামাস না দিদি। পুজোআচ্চা যে করতেই হবে এমনটাও নয়। না পারলে করবি না। তোদের বিষয়।
তোদের বিষয় বলছিস কেন? এ ব্যাপারে দেবনাথ কে? আমাদের বাড়ির কাজ। তোর একটা রেসপন্সিবিলিটি আছে।
রেসপন্সিবিলিটি! কীসের? তোর বিয়ের পর আমি বাবাকে বলিনি তুমি আমার সঙ্গে চল? বলিনি? বাবাই রাজি হয়নি। উনি নাকি দেশ ছাড়বেন না। বোগাস! আমি কী করব? আমি তো রেসপন্সিবিলিটি নিতেই চেয়েছিলাম, উনি অ্যালাও করেননি। এখন যদি তোরা ভাবিস কাজকর্ম ফেলে কাছা পরা আর নেড়া হওয়ার রেসপন্সিবিলিটি পালন করতে আমি দেশে ছুটে যাব, তোরা ভুল করবি।
যামিনী দুঃখ পেয়ে বলেছিল, তুই এভাবে বলছিস কেন? সবার কথা ভেবেই তো বলেছি।
ভাই বিরক্ত গলায় বলল, তুই আমার হয়ে ওদের সরি জানিয়ে দিস। বল কত টাকা পাঠাব? হাউ মাচ?
যামিনী বুঝেছিল, দেশের সঙ্গে সম্পর্কের যেটুকু সুতো ঝুলছিল, বাবার মৃত্যুর পর ভাই সেটুকুও ছিঁড়ে দিল। বাপেরবাড়ি বলে তার আর কিছু রইল না। সে বলল, থাক। টাকা লাগবে না।
রাসবিহারীর কাছে এক মাঠে ব্যবস্থা করে কোনওরকমে বাবার কাজ সেরেছিল যামিনী। সবাইকে বলেছিল, ভাই আমেরিকায় করছে। সমস্যা কিছু নেই। পুজোআচ্চা, বিয়ের মতো শ্রাদ্ধশান্তির কাজও আমেরিকায় সুন্দরভাবে করা যায়।
দেবনাথের ঘটনার পরপর দূর সম্পর্কের মাসতুতো বোন সংযুক্তা কটা দিন এখানে এসেছিল। দেবনাথের অফিসে যাওয়ার সময় বলল, একটু সেজেগুজে যা।
যামিনী বলেছিল, কী হবে সেজেগুজে?
আমি বেড়াতে যাওয়ার সাজ বলছি না, কিন্তু তা বলে এরকম আলুথালু হয়ে ঘোরাটাও ঠিক নয়। তোকে দেখে মনে হচ্ছে, সব শেষ হয়ে গেছে, আর কিছু করার নেই। বাকিরাও সেই সিগন্যাল পেলে দেবনাথদাকে তাদের খোঁজার ইচ্ছেটাই কমে যাবে। স্ত্রী যেখানে ভেঙে পড়েছে সেখানে অন্যরা উৎসাহ নিয়ে কাজ করবে কেন?
কথাটা বুঝেছিল যামিনী। তাই দেবনাথের অফিসে গিয়েছিল যতটা সম্ভব ফিটফাট হয়েই। আঁচলটা কোলের ওপর নিয়ে যামিনী বলল, স্যার, সেদিন ও অফিসে কাউকে কি কিছু বলেছিল?
সোমপ্রকাশ রায়চৌধুরী ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো?
যামিনী অস্বস্তি নিয়ে বলল, মানে কোনওরকম হিন্ট? আসলে পুলিশ আমাকে বলছে, অনেকসময় কেউ কোনও মেজর সিদ্ধান্ত নিলে আগে থেকে কাউকে না কাউকে জানিয়ে দেয়। হয়তো বাড়িতে বলতে পারেনি, কলিগদের কাউকে বলেছিল…।
সোমপ্রকাশ অবাক হলেন। বললেন, পুলিশ কি ভাবছে দেবনাথবাবু নিজেই কোথাও চলে গেছেন? স্ট্রেঞ্জ! তা কেন হবে?
যামিনী পাশে বসা ছেলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, না না সেরকম কিছু নয়। তবে পুলিশকে সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখতে হয়।
জেনারেল ম্যানেজারের চোখ মুখ থেকে অবাক হওয়ার ভাবটা গেল না। তিনি বেল। টিপলেন।
তপনবাবুকে ডাকছি। উনি মিস্টার চ্যাটার্জির ঠিক পাশের টেবিলে বসেন।
মা ছেলে সেদিন বেশ খানিকটা সময় দেবনাথের অফিসে কাটিয়েছিল। প্রায় এক ঘণ্টার ওপর। কাজের কাজ কিছু হয়নি। দেবনাথের কোনও কলিগই এমন কোনও কথা বলতে পারেনি যা থেকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয়। বরং দু-একজন জানাল, মানুষটা সেদিনও একই রকম হাসিখুশি ছিল। রোজকার মতো মজার মজার কথাও বলেছে। তপনবাবু মনে করে একটা বলতেই পারলেন।
সেকেন্ড হাফে কম্পিউটারে কী একটা সমস্যা হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়র এসে বলল, মনে হচ্ছে ভাইরাস। ক্লিন করতে হবে। দেবনাথ বললেন, ভাই, তাহলে একইসঙ্গে আমাদেরও ক্লিন করে দিয়ে যাবেন। আমরা সকলেই ভাইরাস-আক্রান্ত। কী বোর্ডে একরকম কমান্ড পাঠাচ্ছি কাজ করছে অন্যরকম। এ টিপলে স্ক্রিনে জেড পড়ছে। শুরু করতে গিয়ে শেষ করে বসছি।
ক্যান্টিনের দিব্যেন্দুকেও ডেকে আনা হল। তপনবাবু বললেন, খোঁজ-খবর যখন হচ্ছে, ভালো করেই হোক। টিফিনের সময় চ্যাটার্জিদা তো ক্যান্টিনেই ছিলেন।
দিব্যেন্দু কাঁচুমাচু মুখে জানাল, কই অন্যরকম তো কিছু মনে পড়ছে না! রোজকার মতোই তো অমলেট-টোস্ট খেলেন। পরপর দুকাপ চা।
তপনবাবু ঘাড়টা একটু কাত করে বললেন, কোনও কথা বলেছিলেন?
কী কথা?
এই ধর, কটা দিন থাকব না বা ভালো থাকিস ধরনের কিছু?
দিব্যেন্দু মনে করার চেষ্টা করে। বলে, কই না তো! বরং একশো টাকার একটা নোট দিয়েছিলেন স্যার। তখন আমার কাছে ভাঙানি ছিল না। বললেন, ঠিক আছে রেখে দাও। আমি টাকাটা ম্যাডামের হাতে ফেরত দিই?
যামিনী চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না সামলেছিল। বলেছিল, না থাক, উনি এলেই ফেরত দিও।
চলে যাওয়ার সময় সবাই বলেছিল, আবার আসবেন। দরকার হলে ফোন করবেন।
সোমপ্রকাশ রায়চৌধুরি নিজে লিফট পর্যন্ত এলেন। ট্রেনে উঠে নীলাদ্রি মাকে বলেছিল, আমি আর কখনও বাবার অফিসে আসব না।
যামিনী অবাক হয়ে বলল, কেন? মানুষগুলো তো ভালো। কত যত্ন করল।
নীলাদ্রি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, সেইজন্যই আসব না। এত যত্ন আমার ভালো লাগছে না। তুমি কিঙ্কিকে নিয়ে এসো।
সদ্য কৈশোর পেরিয়ে আসা নীলাদ্রির গলায় অভিমান।
যামিনী ছেলের গায়ে হাত রেখে বলল, কী করব বল? আমি তো আর বলতে পারি না, আপনারা এত যত্ন করবেন না।
বলতে হয়নি। দেবনাথের অফিসের যত্ন কমে গেল নিজে থেকেই। নীলাদ্রি বা কিঙ্কিনি আসেনি, কিন্তু যামিনীকে তারপরও বহুবার আসতে হয়েছে। টাকা-পয়সার জন্য আসতে হয়েছে। তিনমাসের মধ্যে দেবনাথের মাইনে বন্ধ হয়ে গেল। দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে নো পে। নির্ধারিত পাওনা ছুটির পরও বেশ কিছুদিন অনুমোদন করেছিল অফিস, তারপর আর পারেনি। একসময় স্বামী নিখোঁজ হওয়ার শোক ছাপিয়ে টাকাপয়সার অভাব মাথা চাড়া দিল। দেবনাথের মাইনে বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিল না যামিনী। তাকে কেউ সতর্কও করেনি। হয়তো তারাও ঠিক জানত না। জানবেই বা কী করে? একজন চাকরি করা মানুষ মারা গেলে কী হয় কম-বেশি সকলেরই জানা আছে। কিন্তু হারিয়ে গেলে? দেবনাথের অফিসের ডিপার্টমেন্টাল হেড, ক্যাশিয়ার, অ্যাকাউন্টস ম্যানেজারের কাছে ছোটাছুটি করেও কোনও সুরাহা করতে পারল না যামিনী। সকলে নানান পরামর্শ দিল। সবটাই অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া। অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে পুলিশের ডায়েরির কপি, তিনমাসের ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট জমা দেওয়া হল। প্রথম প্রথম সঙ্গে দেবনাথের। কলিগরা অনেকেই থাকত। দোতলা, তিনতলা, চারতলা করত। এই ডিপার্টমেন্ট, সেই ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যেত যামিনীকে। ক্যান্টিনে বসে চা খাওয়াত। এগিয়ে গিয়ে হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার বাসে তুলে দিত। ক্রমশ সেই সংখ্যা কমতে লাগল। তপনবাবুর মতো একেবারে দেবনাথের পাশে বসা দু-একজনে এসে ঠেকল। তা-ও বন্ধ হল একসময়। সকলের কাজ আছে। তা ছাড়া নিষ্ফলা ছোটাছুটিতে লাভ কী? বরং যামিনীর মুখোমুখি হলে লজ্জা করছে। কী বলবে? সবাই হাল। ছাড়লেও যামিনীর পক্ষে হাল ছাড়া সম্ভব ছিল না। তার টাকা লাগবে। তাকে সংসার চালাতে হবে। ভাই আমেরিকা থেকে টাকা পাঠাতে চেয়েছিল, নিতে রাজি হয়নি যামিনী। কেন সাহায্য নেবে? স্বামী হারিয়ে গেছে বলে কারও কাছেই হাত পাতা অসম্ভব। নিজের ভাইয়ের কাছেও নয়।
যামিনী আবার একদিন দেখা করল সুপ্রকাশ রায়চৌধুরির সঙ্গে। এবার একঘণ্টার ওপর অপেক্ষা করতে হল। জরুরি কোনও মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষা নয়, লাঞ্চের পর উনি একটু বিশ্রাম নেন। তবে মানুষটা ব্যবহার করলেন আগের মতোই সুন্দর। গলায় সেই সহানুভূতি, আন্তরিকতা। অপেক্ষা করানোর জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিলেন। কিন্তু যা বললেন, তাতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যামিনীর।
সরি মিসেস চ্যাটার্জি, আমাদের আর কিছু করার নেই। আপনাদের সমস্যা আমরা বুঝতে পারছি। হঠাৎ করে এতগুলো টাকা বন্ধ হয়ে যাওয়া যে কতটা ভয়ঙ্কর আমরা জানি। আমি নিয়মের বাইরে গিয়েই বোর্ড মিটিংয়ে আরও এক মাসের এক্সট্রা লিভ স্যাংশন করেছিলাম। কিন্তু আর তো সম্ভব নয়। এবার টাকা পেতে গেলে দ্য পারসেন স্যুড জয়েন। তাকে এবার অফিসে আসতেই হবে।
যামিনী বলল, কিন্তু উনি তো মারা যাননি।
ছি ছি এ-কথা বলছেন কেন? আমরা সবসময় আশা করব, উনি সুস্থ শরীরে ফিরে আসবেন। কিন্তু নিয়ম তো নিয়মই মিসেস চ্যাটার্জি। আপনি যতই সেটা ব্রেক করুন এক সময় সেটাও আবার নিয়মের মধ্যে পড়বে।
আমি অ্যাপ্লিকেশনে ইনভেসটিগেশন রিপোর্ট জমা দিয়েছি স্যার। সেখানে সিআইডি লিখে দিয়েছে, তদন্ত চলছে। তারা আশা করছে, খুব দ্রুতই কিনারা হবে।
সুপ্রকাশ রায়চৌধুরি মার্জিত গলায় বললেন, আমরাও একই আশা করছি। কিন্তু একটা কথা আপনি বোঝার চেষ্টা করুন, সব অফিসেরই হিসেবপত্র নিয়ে অডিট হয়। কোনও কোম্পানিই মাসের পর মাস এমন কারও নামে ব্যাঙ্কে স্যালারি ভরে যেতে পারে না যার কোনও ট্রেস নেই। অডিট অ্যালাও করবে না। আমাদের হাত-পা বাঁধা।
যামিনী চুপ করে থাকে। মাথা নামিয়ে বসে থাকে।
আপনি কি এক কাপ চা খাবেন মিসেস চ্যাটার্জি?
ভদ্রতার সঙ্গে কথাটা বললেও, বলার ভঙ্গিটা ছিল, না খেলেই ভালো হয়, এবার আপনি উঠুন ধরনের। যামিনী ভঙ্গিটা বুঝতে পারে। উঠে পড়ে সে।
এরও দেড়বছর পর আবার স্বামীর অফিসে যায় যামিনী। সুপ্রকাশ রায়চৌধুরি নেই। রিটায়ার করেছেন। নতুন জেনারেল ম্যানেজার অবাঙালি এক ভদ্রলোক। কেরল থেকে এসেছেন। তিনি সপ্তাহের অর্ধেক দিন বাইরে থাকেন। সেদিন অবশ্য অফিসে ছিলেন, কিন্তু যামিনীর সঙ্গে দেখা করলেন না। আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাই। দেখা করতে চাওয়ার কারণও বলতে হবে। পি. এ. মেয়েটিও নতুন। যামিনী তার কাছেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইল। পরের সপ্তাহে যদি কোনওদিন দেখা করা যায়। মেয়েটি খাতা বের করে বিরক্ত মুখে বলে, মনে হয় না এত আর্লি হবে। তা-ও দেখব। বলুন কী কারণে দেখা করতে চাইছেন। যামিনী কারণ বলে। লেখা থামিয়ে মেয়েটি মুখ তুলে অবাক চোখে তাকায়। ফের বাকিটুকু লিখে একটু বসতে বলে। ইন্টারকমে বসের সঙ্গে কথা বলে চাপা গলায়।
স্যার বললেন, ওর সঙ্গে দেখা করার কিছু নেই। বিষয়টা নিয়ে আপনি অ্যাকাউন্টস। ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলুন। আজই বলুন। উনি বলে দিচ্ছেন।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার পুরোনো। যামিনীকে যত্ন করে বসতে বললেন। যামিনী বলল, তা হলে আমি ওর গ্রাচুয়িটি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের জন্য অ্যাপ্লাই করি।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার একটু ভেবে বললেন, আমাকে দুটো দিন সময় দিন।
আমি পরশু আসব? বুঝতেই তো পারছেন টাকাটার কত দরকার। সংসার টানা কঠিন হয়ে পড়েছে।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি বিষয়টা দেখছি আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। আমি খবর দেব। এটা আমাদের ডিউটি। খুব খারাপ লাগছে ওর মতো একজন হাসিখুশি মানুষ…।
যামিনী বিড়বিড় করে বলল, মাঝেমাঝে মনে হয়, এটাও ওর একটা ঠাট্টা। আমাদের সর্বনাশ দেখে আড়াল থেকে হাসছে।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার ডিউটি পালন করলেন। দুটো দিন লাগল না, পরদিনই বিকেলে ফোন করলেন যামিনীকে।
সরি ম্যাডাম, দেবনাথবাবুর কোনও পাওনাই এখন ক্লিয়ার হবে না।
যামিনী তখনও স্কুলে। ক্লাস নিয়ে স্টাফরুমে ফিরছিল। সিঁড়িতে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কেন!
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার ঢোঁক গিলে বললেন, কাকে টাকাটা দেওয়া হবে?
কেন আমাকে। আমি তার স্ত্রী, নিশ্চয় নমিনি করা আছে।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার টেলিফোনের ওপাশে মনে হল সামান্য হাসলেন। বললেন, সবই ঠিক আছে, কিন্তু যে মানুষটা মারাই যাননি তার নমিনির হাতে টাকাপয়সা কীভাবে দেওয়া হবে! কেউ দেবেও না।
যামিনী মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে অসহায় গলায় বলল, তা হলে কী হবে?
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার চিন্তিত গলায় বললেন, অপেক্ষা করা ছাড়া তো কোনও পথ দেখছি না।
কতদিন!
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার চুপ করে রইলেন। যামিনী রুক্ষ গলায় বলল, কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? ও না ফেরা পর্যন্ত?
যতদিন না অফিশিয়ালি একটা কিছু…।
কী একটা কিছু? আমি তো আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না!
ক্লাস টেনের কটা মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিল। যামিনী মিসের চাপা অথচ উত্তেজিত গলা তাদের কানে যায়। তারা দ্রুত সরে দাঁড়ায়। স্বামী বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মিসের হাবভাব বদলে গেছে। ভয় করে। যামিনী হাতের ইশারায় তাদের উঠে যেতে বলে।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার বললেন, বিষয়টা এখন থানা পুলিশের হাতে। মিসিং কেস চলছে। গোটাটাই লিগাল প্রসিডিওরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, একটা অফিশিয়াল ডিক্লারেশন ছাড়া কিছুই করা যাবে না। আমরা মুভ করতে পারব না।
কীসের ডিক্লারেশন?
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার সম্ভবত বুঝলেন, এবার স্পষ্ট করে বলা দরকার। তিনি তাই করলেন।
দেবনাথবাবু বেঁচে আছেন না মারা গেছেন সে বিষয় পুলিশকে জানাতে হবে। যদি ওরা বলে, বেঁচে আছেন তা হলে তো আপনাকে টাকা দেওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। যতই নমিনি থাকুক তাঁর অনুমতি ছাড়া টাকা উঠবে কী করে?
আর যদি উলটোটা বলে? মারা গেছে। কেটে কেটে বলে যামিনী।
অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার আবার একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, সেটা পারবে না। আমি খোঁজ নিয়েছি। সাত বছর পার না হলে নিখোঁজ মানুষকে মৃত ঘোষণা করা যায় না। পুলিশ পারবে না।
সেদিন ফোন ছেড়ে দিয়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে কিছুটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়েছিল যামিনী। সামনেই লম্বা কাচের জানলা। স্কুল মাঠটা দেখা যায়। স্কুল চলছে, ফলে মাঠটাও ফঁকা। একটু পরে ছুটি, তখন মেয়েতে কিলবিল করে উঠবে। বাংলা টিচার নিবেদিতা চক-ডাস্টার হাতে ক্লাসে যাচ্ছিল। যামিনীর থমথমে চোখমুখ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কী হয়েছে যামিনীদি? নতুন কোনও সমস্যা?
যামিনী মলিন হেসে বলল, তোদের দেবনাথদা আমাকে এত বড় বিপদে কেন ফেলল বলতে পারিস?
নিবেদিতা যামিনীর কনুই স্পর্শ করে বলল, এত ভেঙে পোড়ো না। নিশ্চয় খোঁজ পাওয়া যাবে।
আর খোঁজের দরকার নেই, এখন মনে হচ্ছে, মানুষটা মারা গেলেই ভালো। আমাদের তো বাঁচতে হবে!
ছিঃ যামিনীদি, মোটে কটা দিন হয়েছে। এর মধ্যে এত ভেঙে পড়লে চলবে কী করে?
আমি আর চলতে চাই না নিবেদিতা।
অনেকদিন পরে অন্যের সামনে এই ধরনের ভেঙেপড়া আচরণ করে ফেলল যামিনী। নিবেদিতা বলল, ছিঃ এরকম বোলো না। তোমার ছেলেমেয়ে আছে না? তাদের মানুষ করতে হবে।
তীব্র মাথার যন্ত্রণা নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিল যামিনী। গেট খুলে ঢুকতে ঢুকতে চমকে উঠল। বাড়ির ভেতর থেকে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে। প্রাণখোলা হাসি। ঠিক এভাবে দেবনাথ হাসত! কে হাসছে! হাসতে হাসতেই দরজা খুলল কিঙ্কিনি। যামিনী অবাক হল। মেয়েটা বাবার গলা পেয়েছে! গলা তো নয় হাসি। এমনও কি হয়? সন্তান বাবা-মায়ের হাসি কান্নার ধরন পায়? যামিনী অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
দারুণ, একটা দারুণ মজার ঘটনা হয়েছে মা। অপালা ফোন করেছিল, মিঠু একটা কাণ্ড করেছে। আমাদের ক্লাসের মিঠুকে চেনো তো? এই যে খুব ফরসা মেয়েটা, কাল বাজারে…হি হি..অপালা ভেবে…হি হি…আমাদের টিচার চৈতালি ম্যাডামের চোখ চেপে ধরে বলেছে, বল তো কে…হি হি।
যামিনী থমথমে মুখে পাশ কাটিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
সেদিন সন্ধেবেলায় দেরি করে পড়তে বসার অপরাধে যামিনীর হাতে বেধড়ক মার খেল কিঙ্কিনি, অনেক রাত পর্যন্ত নিজের ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল মেয়েটা। মেয়ের কান্নায় খুব রাগী মায়ের মনও নরম হয়। মেয়েকে কাছে নিয়ে আদর করে। কিঙ্কিনি অবাক হয়ে দেখল। সেরকম কিছুই তার হচ্ছে না! সে অন্ধকার ঘরে শুয়ে পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা মেয়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে লাগল মন দিয়ে। হাসির মতো মেয়েটার কান্নাও কি তার বাবার? হলেই বা বুঝবে কী করে? দেবনাথের কান্নার আওয়াজ কখনও শুনেছে বলে মনে পড়ছে না তার।
যামিনী ভাবছিল, ঘটনা এখানেই থেমে গেল। দেবনাথের অফিসে আর যেতে হবে না। কিন্তু তা হল না। অ্যাকাউন্টস ম্যানেজারের টেলিফোনে কথা বলার ঠিক এক সপ্তাহ পর একটা ফোন এল। গম্ভীর গলায় পুরুষমানুষ। মানুষটা এক নিশ্বাসে গাদাখানেক কথা বলে যায়–
নমস্কার আমি অর্ধেন্দু দত্ত। আপনার হাজব্যান্ডের অফিসে চাকরি করি। যদিও আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা ছিল। দেবনাথবাবুর সঙ্গে আমার সেভাবে পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। আমি অফিস ইউনিয়নের সেক্রেটারি। সবসময়েই ইউনিয়ন নিয়ে ব্যস্ত। উনি তো আবার এসবের মধ্যে ছিলেন না। ফলে দেখাসাক্ষাৎ তেমন হয়নি। যা-ই হোক, ওঁর খবরটা আমি শুনেছি, কিন্তু আমাদের ইন্টারফেয়ার করার কোনও ব্যাপার ছিল না। কিন্তু এখন শুনছি, দেবনাথবাবুর পাওনা টাকাপয়সার ব্যাপারে অফিস আপনার সঙ্গে কোঅপারেশন করছে না। আপনি যদি চান আমরা ইউনিয়নের তরফ থেকে বিষয়টা নিয়ে মুভ করতে পারি।
ভদ্রলোক থামলে যামিনী বলল, ধন্যবাদ। আমি সকলেরই সাহায্য চাই।
ধন্যবাদের কোনও ব্যাপার নেই। আমরা দেবনাথবাবুকে আজও আমাদের কলিগ মনে করি। তাঁর পরিবারের সুবিধে অসুবিধে দেখাটা ইউনিয়নের কাজের মধ্যে পড়ে। আপনি যদি কাল বা পরশু একবার আসেন তা হলে আমরা কথা বলে নেব। ইউনিয়নের অন্যদেরও থাকতে বলব।
তখন থেকেই অর্ধেন্দু দত্তর সঙ্গে যামিনীর পরিচয়। প্রথম সাক্ষাতেই মানুষটাকে পছন্দ হয়েছিল। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। পেটানো চেহারা। মাথায় কাঁচা-পাকা চুল। চেয়ারে বসে পিঠ সোজা করে। বসার মতো মানুষটার কথার মধ্যেও একধরনের সোজাসাপটা ভাব রয়েছে। ইউনিয়নের অফিসে বসে আর পাঁচজনের সঙ্গে যামিনীর সমস্যা শুনলেন। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললেন
নিয়ম নেই, হয় না, অসম্ভব–এসব হল ম্যানেজমেন্টের কথা। আমাদের শুনে লাভ নেই। ইউনিয়নের কাজই হল এর বিরুদ্ধে ফাইট করা। আমাদের একজন কলিগ নিখোঁজ হয়েছেন। কেন নিখোঁজ হয়েছে, বেঁচে আছেন না মারা গেছেন পুলিশ দেখছে। অফিস নিয়ম দেখিয়ে তার স্যালারি বন্ধ করে দিয়েছে, আইনের কথা বলে তাঁর পাওনা টাকা আটকে রেখেছে। বলছে, সাত বছর বসে থাকুন। মানে কী! এই সাত বছর দেবনাথবাবুর স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কী হবে? নিয়ম আর আইন ধুয়ে জল খাবে? আইন কীসের জন্য? মানুষের উপকারের জন্য। মানুষকে বিপদে ফেলার জন্য নয়। ঘটনাটা আজ দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের হয়েছে, কাল অন্য কারও হতে পারে।
সকলেই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। কেউ বললেন, ছি ছি, কারও মতে, খুব অন্যায় হচ্ছে। দু-একজন আরও একটু এগিয়ে গেলেন।
হিউম্যানিটেরিয়ান গ্রাউন্ড বলে একটা জিনিস আছে তো। নাকি নেই? অফিস খানিকটা টাকা অ্যাডভান্স দিক। সাত বছর পরে মিটিয়ে দেওয়া হবে।
যামিনীর খুব ভালো লাগছে। মনে জোর পেল। অফিসের এতগুলো মানুষ তার পাশে! দেবনাথকে ভালোবাসত বলেই না…।
অর্ধেন্দু দত্ত যামিনীর দিকে ফিরে বললেন, আপনি ভাববেন না মিসেস চ্যাটার্জি, আমরা কেসটা নিয়ে এগোবো। আপনি ইউনিয়নের কাছে শুধু একটা লিখিত অ্যাপিল করুন।
অর্ধেন্দু দত্ত সত্যি এগোলেন। দীর্ঘ ছমাস ধরে এগোলেন। প্রথম তিন-চার মাস দল বেঁধে, তারপর একা। একা না হয়ে উপায় ছিল না। ইউনিয়নের অন্যরা ততক্ষণে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। ম্যানেজমেন্টকে কোনওভাবেই রাজি করানো যাচ্ছে না। আর এই একা চলার সময়টাতেই সমস্যা শুরু হল। মাঝে মাঝে যামিনীকে কলকাতায় ডেকে নিতেন অর্ধেন্দু। প্রথমে অফিসে, তারপর বাইরেও। ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় বসে চা খেত দুজনে। ধীরে ধীরে কাজের কথার পাশাপাশি অল্প অল্প ব্যক্তিগত কথা চলে আসে। বেশিরভাগই দেবনাথের প্রতি যামিনীর দুঃখের কথা, অভিমানের কথা। অর্ধেন্দু দত্ত শান্ত ভাবে শুনতেন। সহানুভূতি নিয়ে উত্তর দিতেন।
আপনি এরকম ভাবছেন কেন মিসেস চ্যাটার্জি? দেবনাথবাবু যে নিজেই আপনাদের ছেড়ে চলে গেছেন এমনটা তো না-ও হতে পারে। তাঁর প্রতি আপনার এই রাগটা হয়তো ইনজাসটিস হচ্ছে।
তা হলে কী হয়েছে? কিডন্যাপ?
অর্ধেন্দু দত্ত হেসে বললেন, না না, তা হলে এতক্ষণে খবর চলে আসত। যারা কিডন্যাপ করেছে তারা তো মুক্তিপণ চাইত। চাইত না। তা ছাড়া ওকে কে কিডন্যাপ করবে?
যামিনী বলল, আপনি কী মনে করছেন, মারা গেছে?
নানা আমি সেকথা বলতে চাইনি। অর্ধেন্দু দত্ত নিজেকে সামলালেন। বললেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত ডেফিনিট কোনও প্রুফ পাওয়া যাচ্ছে কোনওটাই ধরে নেওয়া উচিত নয়।
রেস্তোরাঁর আধো আলো আধো অন্ধকারে বসে যামিনী ডুকরে কেঁদে ওঠে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, আমি জানি ও বেঁচে আছে। নিশ্চয় বেঁচে আছে। কোথাও লুকিয়ে থেকে ঠাট্টা করছে। যেদিন বুঝবে অন্যায় হচ্ছে সেদিন ঠিক ফিরে আসবে।
অর্ধেন্দু দত্ত একটু অপেক্ষা করলেন, তারপর যামিনীর হাত ধরে গাঢ় স্বরে বলেন, কেঁদো না যামিনী, তাই যেন হয়। দেবনাথবাবু যেন ফিরে আসে।
বহুদিন পর পুরুষের স্পর্শে চমকে উঠেছিল যামিনী। ভালোও কি লেগেছিল? নিশ্চয় লেগেছিল। নইলে সেদিন হাত কেন সরিয়ে নেয়নি সে? অথবা কে জানে সেই স্পর্শে হয়তো ভরসা ছিল। গভীর বিপদে পড়া কোনও নারী পুরুষের কাছ থেকে যে ভরসা খোঁজে সেই ভরসা। যামিনীর দুর্বল মন বুঝতে পারেন অর্ধেন্দু দত্ত। যামিনী নিজেই বুঝতে দেয়। কেন দেয়? পরে অনেক ভেবেছিল যামিনী। শুধুই কি আশ্রয়ের কারণ? নাকি শক্ত-সমর্থ এক পুরুষের জন্য শরীর সহসা জেগে ওঠে?
.
এক শনিবার সন্ধ্যায় অর্ধেন্দু দত্তর ফাঁকা ফ্ল্যাটে ব্লাউজ খুলে থমকে গিয়েছিল যামিনী। অর্ধেন্দু দত্ত তখন সামনে বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে আছে স্থির চোখে। যামিনী থেমে যেতে বিরক্ত গলায় বলেছিলেন, কাম অন যামিনী। তাড়াতাড়ি করো।
যামিনী দু-হাতে বুক ঢেকে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, খারাপ লাগছে।
অর্ধেন্দু দত্ত তখন পুরোপুরি তৈরি। লোহায় পেটানো শরীরে কোনও আড়াল নেই। এমনকী একটা চাদর পর্যন্ত নেই! বোধহয় যামিনীকে প্রলুব্ধ করতেই নগ্ন হয়েছিল। পেশি, ত্বক, পুরুষের সব অঙ্গ যেন লোহার মতো! বাদামি, কঠিন। খানিকটা অবজ্ঞার সঙ্গেই তিনি বললেন, কার জন্য খারাপ লাগছে যামিনী?
আপনি জানেন না?
অর্ধেন্দু দত্ত ঠোঁট উলটে হাসলেন। বললেন, না, জানি না। নিশ্চয় সেই মানুষটার জন্য নয়, যে তোমার এই সুন্দর শরীরটা ছুঁড়ে ফেলে চলে গেছে।
চলে গেছে! মুখ তুলে তাকাল যামিনী।
তুমিই তো সেরকমই বল, বল চলে গেছে। আড়াল থেকে দেখে হাসছে বল না? বাদ দাও ওসব, এসো। মনে রেখো তোমারও জীবন আছে। শরীর আছে। চলে এসো, দেখবে সে জীবন শুধু হা-হুঁতাশ আর কান্নার জীবন নয়। সে জীবনও উপভোগ করার। বেঁচে থাকার। যদি রাজি হও, যদি ভালো লাগে আমি সঙ্গে থাকব চিরকাল।
রাজনীতি করে বলেই বোধহয় এমন মন ভোলানো কথা বলতে পারে মানুষটা। নিজের শেষ আবরণ সরিয়ে সেদিন দ্বিধা জড়ানো পায়ে যামিনী উঠে গিয়েছিল বিছানায়। মানুষটা যামিনীকে আদর করেছিলেন শান্ত অথচ পরিণত মুদ্রায়। তার অধিকাংশই যামিনীর অচেনা। দেবনাথ কি এসব জানত না! শেখেনি! এই বয়েসেও শরীর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে যামিনীর। অর্ধেন্দুর কোলের কাছে বসে লজ্জায় চোখ ঢাকে। তার মাথার চুল ধরে নিজের মুখের ওপর টেনে নামান অর্ধেন্দু দত্ত। জড়ানো গলায় বলেছিলেন, কীসের অভাব তোমার? কীসের অভাব? আমি তো আছি, আছি না?
শরীরভরা যন্ত্রণা নিয়ে যামিনী বাড়ি ফিরে যেতে যেতে বুঝেছিল, এই অভিসারে কোথায় যেন প্রতিশোধ লুকিয়ে ছিল। দেবনাথের প্রতি প্রতিশোধ। মনে মনে বলেছিল, তুমি যদি না ফেরো আমিও চলে যাব। ঠিক চলে যাব তোমায় ছেড়ে।
সেদিন অনেক রাতে ঘুম ভেঙে উঠে বাথরুমে ছুটে গিয়েছিল যামিনী। বেসিন ভরিয়ে বমি করেছিল। বুঝেছিল, সমস্যা শুরু হয়েছে। কঠিন সমস্যা।
এই সমস্যার সমাধান হল কদিনের মধ্যেই। এক রবিবার বিকেলে কলকাতা যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে যামিনী। বহুদিন পরে গালে হালকা পাউডার দিয়েছিল। কপালে টিপ। অর্ধেন্দুই। বলেছেন, একটু সেজেগুজে বেরোতে পার না? বাড়ির বিপদের কথা রাস্তার লোকদের জানিয়ে লাভ কী? বাড়ির গেট খুলে বেরোতেই মেয়ের মুখোমুখি পড়ল যামিনী। কিঙ্কিনি পড়ে ফিরছিল। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। চোখে বিস্ময়। থতমত খেয়ে যায় যামিনী। নিজে থেকেই তাড়াতাড়ি বলে, তোর বাবার অফিসে যাচ্ছি।
আজ! আজ তো রবিবার। বিড়বিড় করে কিঙ্কিনি।
চমকে ওঠে যামিনী। নিজের ভুল বুঝতে পারে। সত্যি তো আজ রবিবার, অফিস বন্ধ। দ্রুত নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে। ভুল করে বসে ফের। বলে, ইউনিয়ন অফিস খোলা থাকবে। তারপর মাথা নামিয়ে হন হন করে হেঁটে যায়। পিছনে তাকায় না তবু বুঝতে পারে কিঙ্কিনি তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি কিঙ্কিনির নয়, সেই দৃষ্টি তার স্বামীর, দেবনাথের। বুকটা টনটন করে ওঠে যামিনীর। দেবনাথ হারিয়ে গিয়েও পুরোটা হারায়নি, তার মেয়ের মধ্যে থেকে গেছে অনেকটা।
মোবাইল ফোন বন্ধ করে স্টেশন থেকে বাড়ি ফিরে আসে যামিনী। রাতে অর্ধেন্দু ল্যান্ড ফোনে ধরলে যামিনী শান্ত গলায় ফিসফিস করে বলে, দোহাই আপনাকে, আপনি আর কখনও আমাকে ফোন করবেন না। ওপাশের অপমানিত, ক্রুদ্ধ মানুষটা কিছু বলতে চান। যামিনী সুযোগ দেয়নি। ফোন নামিয়ে রেখেছিল।
সেই শেষ। আবার এতদিন পরে এবাড়িতে ফোন করেছিলেন অর্ধেন্দু দত্ত। সাড়ে তিনবছর পর। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নীলাদ্রি অফিসে এসেছে। ইউনিয়নরুমে লোকের আনাগোনা লেগেই আছে। প্রায় সকলেই নীলাদ্রির দিকে তাকাচ্ছে। মনে হয় না চিনতে পারছে। পারার কথাও নয়। নীলাদ্রির অস্বস্তি বাড়ছে। অর্ধেন্দুকাকু পরিচয় দিয়ে না বসে। সেরকম কিছু হল না। ঘর ফাঁকা হওয়ার পর উনি একটু হেসে বললেন, আমি ভেবেছিলাম তুমি আসবে না নীলাদ্রি। তোমার মা বারণ করবেন।
নীলাদ্রি বলল, না না। বারণ করবে কেন!
অর্ধেন্দু দত্ত আবার একটু হাসলেন, তোমার বাবার টাকা পয়সার তো কিছুই করতে পারলাম না, রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক।
ছি ছি এটা কী বলছেন! আপনি অনেক করেছেন, নিয়ম না থাকলে কী হবে?
যাই হোক, শোনো নীলাদ্রি, এই অফিসে লোক নেওয়া হবে। পার্মানেন্ট জব। মাইনেকড়ি খারাপ নয়। বড় কথা হল সব সুযোগ-সুবিধেও রয়েছে। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়িটি। আমাদের ইউনিয়নের কোটা আছে। দু-তিনজনের জন্য আমরা বার্গেন করি। শেষপর্যন্ত একজনে এসে ঠেকে। আমি তোমার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু সমস্যা হল, তোমার যা কোয়ালিফিকেশন দেখছি। তাতে ওপরের দিকে কিছু করা যাবে না। তুমি তো জানো আজকাল প্লেইন গ্র্যাজুয়েট কোনও ব্যাপার নয়। এম এ পাসও পিওনের পোস্টে অ্যাপ্লাই করে। তুমি কি রাজি?
নীলাদ্রি বলল, কাজটা কী?
অর্ধেন্দু দত্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, তুমি যদি রাজি হও আমি ব্যবস্থা করে ডিরেক্ট আমার আন্ডারে নিয়ে আসব। আমার কাছে কাজ করলে তো আর তোমার অতটা খারাপ লাগবে না। তোমার বাবা নেই, টাকাটা তোমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
নীলাদ্রি অবাক হল। কাজ করতে খারাপ লাগবে! সে আবার বলল, কাজটা কী?
অর্ধেন্দু দত্ত হাতের পেনটা টেবিলে ঠুকে বললেন, খাতায় কলমে পিওন-টিওন যা-ই লেখা থাকুক, আমার কাছে থাকলে এই অ্যাসিসটেন্ট গোছেরই কাজ মনে করবে। চাকরিটা কিন্তু পাকা নীলাদ্রি, ভালো করে ভাব। পিওন হলে হতচ্ছেদ্দা করার কিছু নেই। বিদেশে তো সব কাজই সমান। বাড়ি গিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। বলবে, আমি বলেছি।
নীলাদ্রি কাঁদে না। আজও কাঁদল না। বিকেলে বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে নিজের মনের ফিসফিস করে বলল, বাবা, তুমি আমাদের এতবড় অপমানের মধ্যে ফেলে গেলে কেন? আমরা কী দোষ করেছিলাম?