০৫. কিঙ্কিনি সত্যি কথাই বলেছিল

০৫.

কিঙ্কিনি সত্যি কথাই বলেছিল। সে পিকনিক করতে যেখানে এসেছে সেটা জায়গা হিসেবে খানিকটা ভয়ঙ্করই। স্টেশন থেকে ভ্যানরিকশাতে চেপে চল্লিশ মিনিটেরও বেশি সময় লাগল। পাকা রাস্তার কোনও বালাই নেই। গোটাটাই গ্রামের এবড়ো-খেবড়ো মাটির পথ। খানিকটা আবার খেতের মধ্যে দিয়ে যেতে হল। ভ্যান লাফাতে লাফাতে চলেছে। যত এগিয়েছে পথ এই সকালেও জনমানব শূন্য হয়েছে। নির্জন পথের পাশে একটা ঝাপসা জারুলগাছ দেখে শালিনী হইহই করে উঠল–

অ্যাই থামো থামো। এই তো গাছ।

ভ্যান রিকশাতে ব্রেক নেই। বুড়ো চালক লাফ দিয়ে নেমে হ্যাঁন্ডেল টেনে ধরল। পিছনে পা ঝুলিয়ে বসা তিন মেয়ে ঝপাঝপ লাফ দিয়ে নামল। ভ্যানের মাঝখানে বাবু হয়ে বসেছিল বৈদর্ভী। সে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। মাটির ওপর উবু হয়ে পা চেপে ঝাঁকিয়ে উঠল, ওরে বাবা, মরে গেলাম।

বাকি তিনজন সেই কাতরানি পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে গেল। দোয়েল অবাক গলায় বলল, গাছ দিয়ে কী হবে রে শালিনী! আমরা কি গাছে বসে পিকনিক করব?

কিঙ্কিনি কোমরে হাত দিয়ে গাছটার দিকে তাকিয়ে বলল, সমস্যা কী? পিছনে একটা করে ল্যাজ লাগিয়ে উঠে যাব। তোর অবশ্য লাগাতে হবে না। ওরিজিনালটা বের করবি।

দোয়েল ছেলেদের মতো ঘুসি পাকিয়ে তেড়ে এল। শালিনী বলল, মারপিট পরে করবি। আগে চল।

কিঙ্কিনি সিরিয়াস গলায় বলল, তোর মামারবাড়ি কোথায় শালিনী! নদী? মিথ্যে কথা বলিসনি তো?

বৈদর্ভী কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়েছে। দু-পা খুঁড়িয়ে হেঁটে বলল, কোথায় যাব? আমি গাছে উঠতে পারব না বাবা। আমার পা ভেঙে গেছে।

দোয়েল বলল, চিন্তা করিস না তোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে তুলে নেব। গাছ-পিকনিকে তুই আজ সারাক্ষণই দড়িতে ঝুলবি। ট্রাপিজের মতো।

হাসতে হাসতে চারজনেই আরও খানিকটা এগিয়ে গেল।

ভ্যান রিকশা চালক গোড়া থেকেই মজা পাচ্ছে। সেই স্টেশন থেকে যখন এই চার মেয়ে তার গাড়িতে উঠেছে তখন থেকেই। প্যান্ট-জামা পরা মেয়েরা কখনও তার ভ্যানে ওঠেনি। কাঁধে একটা করে ব্যাগ। সবথেকে বড় কথা, এরা নিজেরা ঠিক জানে না কোথায় যাচ্ছে। শুধু বলেছে, নদীর ধারে চল। একটা গাছ দেখলে নেমে পড়ব। অদ্ভুত! নদীর পাশে গাছ কি কম আছে? কথা শুনে মনে হয়েছিল, ঠাট্টা করছে। এখন দেখা যাচ্ছে ঘটনা সত্যি। সত্যি মেয়েগুলো গাছ দেখে নেমে পড়েছে। বাড়িতে ফিরে গল্প করার মতো ব্যাপার। শালিনী এসে ভাড়া মিটিয়ে দিল।

ভ্যানচালক বলল, তোমরা কখন ফিরবে? রাত কোরো না।

অন্য সময় অচেনা কেউ তুমি সম্বোধন করলে শালিনী আজকাল রেগে যায়। এই মানুষটার কথায় মজা পেল। লোকটা শুধু তুমি করে বলছে না, বাবা-কাকার মতো উপদেশও দিচ্ছে।

শালিনী হেসে বলল, কেন? দেরি করলে কী হবে? ভাবছি রাতে থাকব।

এ আবার কী কথা! খবরদার, ও কাজও করো না। রাতে থাকবে কী!

কেন সমস্যা কোথায়? এখানে ভূত আছে নাকি? শালিনী ভুরু কুঁচকে, মিটিমিটি হেসে বলল।

ভ্যানচালক তার গাড়ি পিছনে ঠেলে বলল, ভূত নেই, তবে ডাকাত আছে। জায়গা ভালো না। আলো থাকতে ফিরে যেও। মেয়েছেলে এখানে অন্ধকারে থাকে নাকি! তারওপর আজকাল সন্ধের পর ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে।

শালিনী ফিক করে হেসে বলল, মেয়েছেলেদের তুমি নিতে আসবে? আসবে বিকেলে?

ভ্যানচালক সিটে উঠে বলল, ঠিক আছে দেখব। অন্য ভাড়া না থাকলে আসব।

অন্য ভাড়ার কথা ভাবতে হবে না। তুমিও এসো, আমরা পুষিয়ে দেব।

রাস্তা ছেড়ে গাছের দিকে আরও কয়েক পা এগোতেই কিঙ্কিনি হাততালি দিয়ে চিৎকার করে উঠল–

ওই তো, ওই তো!

দোয়েল ছুটে গেল। বৈদর্ভী ছুটতে গিয়ে আউচ বলে পায়ে হাত দিয়ে থেমে গেল। সত্যি তার লেগেছে। গাছের ফাঁক দিয়ে এবার বাড়িটা দেখা গেছে। ভেঙে পড়া একটা পুরোনো বাড়ি। বাড়ি খুব বড় কিছু নয়, তিনতলা। সারা গায়ে সিমেন্টের পলেস্তারা খসে খসে লালচে ইট বেরিয়ে পড়েছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, একটা ধ্বংসস্তূপ। গা ছমছম করে ওঠে। কিন্তু একটু তাকিয়ে থাকলেই ভালো লেগে যায়। মনে হয়, পেনসিলে আঁকা ছবির মতো। জারুল গাছটা বাড়িটাকে রাস্তা থেকে আড়াল করে রেখেছিল।

কিঙ্কিনি হাত বাড়িয়ে শালিনীর গাল টিপে বলল, থ্যাঙ্কিউ ডার্লিং। তোমার জন্যই এমন দারুণ জায়গায় আসতে পারলাম।

দোয়েল বলল, এবার ঠিকমতো ফিরতে পারলে হয়।

কিঙ্কিনি হাত তুলে বলল, আসতে না আসতে ফেরার কথা বলছিস কেন! আমি সিওর এ বাড়িতে ভূত আছে। আজ ভূতেদের সঙ্গে থাকব।

বৈদর্ভী নাক টেনে বলল, তা থাক, কিন্তু দেখিস অসভ্য ভূতের পাল্লায় পড়িস না।

শালিনী বলল, পড়লে পড়ব। সভ্য মানুষের থেকে অসভ্য ভূত ভালো।

 বৈদর্ভী কাঁধের ব্যাগটা শালিনীর দিকে এগিয়ে বলল, ধর তো। আমার পায়ে ব্যথা করছে। আমি একটা অসভ্য ভূতের কথা শুনেছিলাম, বেটা চান্স পেলে মেয়েদের আন্ডারগার্মেন্টস খুলে দিত।

শালিনী থমকে দাঁড়িয়ে বলল, মানে?

বৈদর্ভী বলল, মানে আবার কী! এই ধর একটু পরে দেখলি সব ঠিকঠাক আছে, শুধু তোর জামার ভেতরে ব্রা-টা ভ্যানিশ। তুই জানতেও পারিসনি ভূত কখন খুলে নিয়ে গেছে। এই নিয়ে বেশি লাফালাফি করলে আরও কেলেঙ্কারি করে দেবে। তখন দেখবি…।

বৈদর্ভীর বলার ভঙ্গিটা এমন ছিল, যেন ঘটনাটা সত্যি। সবাই হেসে উঠল। দোয়েল কানে হাত দিয়ে বলল, আর এগোবি না।

বৈদর্ভী আবার বলল, তা হলে নে ব্যাগটা ধর। নইলে কিন্তু সব বলব।

শালিনী মুখ বেঁকিয়ে বলল, পায়ে ব্যথা কাঁধে ব্যাগ নিতে অসুবিধে কোথায়? তুই দুম করে ভ্যান থেকে লাফ দিলি কেন? এই ছেলে-ছেলে ভাবটা এবার ছাড় বৈদর্ভী।

বৈদর্ভী তার ছোট করে কাটা চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ছাড়ব কেন? আমি তো ছেলেই। আজ তোরা সাবধানে থাকিস। এক জওয়ান আউর তিন জওয়ানি। সবকটাকে রেপ করব।

দোয়েল বলল, জওয়ান বলছিস কেন? এক খোঁড়া জওয়ান বল।

 বৈদর্ভী মুখ পাকিয়ে বলল, চেপে ধরলে খোঁড়া জওয়ানের জোর বুঝতে পারবি।

কিঙ্কিনি ছাড়া সবাই হেসে উঠল। এই ব্যাপারে বৈদর্ভীকে নিয়ে কিঙ্কিনির চাপা একটা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এতদিন মেয়েটার যেসব কাজ ঠাট্টা-ইয়ার্কি বলে মনে হত, কদিন হল অন্যরকম লাগছে। গত সপ্তাহে বন্ধুরা মিলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। হল অন্ধকার হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই বৈদর্ভী চুপিচুপি তার হাত ধরল। হাত ছাড়াতে গেলে ফিসফিস করে বলল, কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?

ইয়ার্কি মারিস না বৈদর্ভী। হাত ছাড়। নীচু গলায় বলল কিঙ্কিনি।

 ঠিক আছে ছাড়ব। একটু তো ধরি। হাতটা কী নরম রে কিঙ্কিনি!

কিঙ্কিনির বাঁ-হাতের তালুতে আঙুল ঘষতে থাকে বৈদর্ভী। কিঙ্কিনির হাত, শরীর শিরশির করে উঠল।

না, একটুও নয়। হাত সরাতে গেল কিঙ্কিনি।

বৈদর্ভী গাঢ় গলায় বলল, প্লিজ।

কিঙ্কিনির বুকটা ছাত করে উঠল। মেয়েটার গলা অচেনা! সে হাত সরিয়ে পাশ ফিরে। বলল, কী ব্যাপার বল তো। তোর সমস্যাটা কী?

পিছনের সিটে-বসা কেউ বলে উঠল–

এই যে খুকিরা, ঝগড়াঝাটি হলের বাইরে গিয়ে করো। আমাদের ছবিটা দেখতে দাও।

বৈদর্ভী উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার সঙ্গে ঝগড়া করতে যায়। তাকে টেনে বসায় কিঙ্কিনি। সেদিনের ঘটনাটায় খটকা লাগলেও ভুলে যেতে চায় কিঙ্কিনি। মনে মনে ভাবে, এটাও বৈদর্ভীর। মাত্রা ছাড়া ফাজলামি। কিন্তু দুদিন বাদে আবার হল। বেশি রাতে বৈদর্ভী ফোন করল। নীচু গলায় বলল, সত্যি তুই আমার সমস্যা বুঝতে পারছিস না?

কিঙ্কিনি ধমক দিয়ে বলল, কী সমস্যা?

বৈদর্ভী তরল গলায় হেসে বলল, ইস ন্যাকা, বুঝেও না বোঝার ভান করছে।

কিঙ্কিনি আমতা আমতা করে বলল, কী বুঝেছি? কী হয়েছে তোর?

আমি তোকে ভালোবাসি এটা তুই বুঝিস না? আই লাভ ইউ।

 কী যা-তা শুরু করেছিস বৈদর্ভী? কিঙ্কিনি বোঝাতে চেষ্টা করে।

যা-তায়ের কী হয়েছে? মেয়েরা বুঝি মেয়েদের ভালোবাসতে পারে না।

কিঙ্কিনি একবার ভাবল বলে, বৈদর্ভী, তুই খুব বাড়াবাড়ি করছিস। এরকম করলে তোর। সঙ্গে সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দেব। তারপর নিজেকে সামলাল সে। যদি তার বুঝতে ভুল হয়? হতেই পারে। বৈদর্ভী হয়তো মাত্রা ছাড়া ঠাট্টাই করছে। ও তো সারাক্ষণই এসবের মধ্যে থাকে। খুব সহজেই খারাপ কথা বলতে পারে। এইজন্য বন্ধুরা ওর কোম্পানি চায়। বলে, ও না থাকলে জমে না। কিঙ্কিনির ঘাবড়ানোর কথাটা নিশ্চয়ই বন্ধুদের বলবে। সে একটা বিরাট লজ্জার ব্যাপার হবে।

কিঙ্কিনি স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করল।

ভালোবাসিস তো মাঝরাতে বলার কী আছে? বন্ধু বন্ধুকে ভালোবাসবে না তো কী করবে?

বৈদর্ভী ওপাশ থেকে বলল, দুর, ওই ভালোবাসা নয়।

কিঙ্কিনি সহজ গলায় হেসে বলল, কোন ভালোবাসা? টাকা-পয়সা চাই?

বৈদর্ভী এক মুহূর্ত দেরি না করে ফিসফিস করে বলল, আমি তোর শরীর চাই। বুঝতে পারিস না কিঙ্কি? দেখিস তোরও ভালো লাগবে। মেয়েদের সঙ্গে মেয়েরা সেক্স করলে নাকি খুব ভালো লাগে।

শরীর শিরশির করে উঠল কিঙ্কিনির। বলল, চুপ কর, চুপ কর, ইস মাগো।

বৈদর্ভী পাত্তা দিল না। বলল, মেয়েরাই একমাত্র মেয়েদের শরীর বোঝে। কোনখানটা ছুঁলে ভালো লাগবে পুরুষমানুষ জানবে কী করে? ওদের সব বাঁধাধরা ব্যাপার। হি হি।

এসব তুই কোথা থেকে শিখলি! কিঙ্কিনি অবাক হয়ে গেছে।

অনেক ম্যাগাজিন আছে, নেট সার্চ করলে ফটোও পাবি। মেয়েতে মেয়েতে ফটো। ওসব ছাড়, আমি তোকে এখন চুমু খেতে চাই।

কথাতেই থামল না মেয়েটা। সত্যি সত্যি টেলিফোনের মধ্যে আওয়াজ করে চুমু খেতে লাগল! কী করবে বুঝতে পারল না কিঙ্কিনি। একটু যেন ভয়ও পেল। মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেছে!

এই পর্যন্ত হলে তা-ও কথা ছিল। সেদিন রাতে কিঙ্কিনি বিচ্ছিরি একটা স্বপ্ন দেখল। দেখল, সত্যি সত্যি বৈদর্ভী তাকে চুমু খাচ্ছে! সে বাধা দিচ্ছে না! উলটে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরছে। এটা কেন হবে? তার তো বাধা দেওয়ার কথা।

এরপর থেকে বৈদর্ভী সম্পর্কে অস্বস্তি শুরু হয়েছে। হালকা অস্বস্তি।

ডাকাডাকি করতে হল না, ভাঙা বাড়ির কাছাকাছি যেতেই জবুথবু ধরনের একটা মাঝবয়সি লোক এসে উঁচু লোহার গেটটা খুলে দিল। চার মেয়ে ঢুকে পড়ল হইহই করে। লক্ষ করার বিষয়, বাড়িটা ভাঙা হলেও গেট কিন্তু মজবুত। জং ধরেনি। তার মানে নিয়মিত রং করা হয়। কবজায় তেল পড়ে। বাড়ির মালিক বাড়ির দিকে নজর না দিলেও গেটের দিকে নজর রেখেছেন। সম্ভবত বুঝেছেন, সম্পত্তি রক্ষা করতে হলে, সম্পত্তির থেকে সম্পত্তির ফটকটাই আসল।

শালিনী এগিয়ে গিয়ে বলল, আপনিই জনার্দনদা তো? এই বাড়ির কেয়ারটেকার?

মানুষটার গায়ে চাদর। একটু একটু কঁপছে যেন। অতিথিদের প্রতি বিন্দুমাত্র উৎসাহ না দেখিয়ে সে বলল, হ্যাঁ আমিই জনার্দন! কলকাতা থেকে বাবু খবর পাঠিয়েছেন। আমি দুটোতলায় একটা করে ঘর পরিষ্কার করে রেখেছি। এর বাইরে অন্য কোথাও যাবেন না।

শালিনী তাড়াতাড়ি বলল, আমি জানি। আর ছাদ? ছাদে যাওয়া যাবে তো?

না, যাওয়া যাবে না, ছাদের পাঁচিল ভাঙা। মেঝেতেও ফাটাফুটি হয়েছে। পা দিলে ধসে যেতে পারে।

শালিনী কাচুমাচু গলায় বলল, বড়মামা কিন্তু বলেছিল, আমরা ছাদের একটা দিকে যেতে পারব।

জবুথবু মানুষটা মাথা নীচু করে বিশ্রীভাবে কাশতে লাগল। বুক থেকে ঘঙ ঘঙ ধরনের আওয়াজ বেরোচ্ছে। কাশি শেষ হলে বলল, কলকাতায় উনি বলতে পারেন, কিন্তু কিছু ঘটলে তো আমার ঝামেলা। ছাদে যাওয়া যাবে না। ছাদের তালা খুলব না। বাড়ির বাইরেটা দেখছেন তো? জঙ্গল, আগাছায় ভরতি। সাপখোপ থাকতে পারে। বেশি বাইরে ঘোরাঘুরি না করাই ভালো। যতক্ষণ থাকবেন ঘরে থাকার চেষ্টা করবেন। একতলায় বাথরুম আছে, বাইরে কুয়ো আছে। কিছুটা জল তুলে দিয়ে এসেছি। বাকিটা নিজেদের তুলে নিতে হবে।

শালিনী হতাশ ভঙ্গিতে বলল, আপনাকে ডাকলে পাব তো?

না পাবেন না। আমার জ্বর হয়েছে, আমি ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ব। আপনারা কি রান্নাবান্না করবেন?

মানুষটার কটকটে ধরনের কথা শুনে সবাই বিরক্ত। দোয়েল রাগ রাগ গলায় বলল, করলে করব। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না।

জনার্দন গায়ের চাদরটা ঠিক করতে করতে বলল, ব্যস্ত হতে বললেও হতে পারব না। এখানে উনুন বা জ্বালানির কোনও ব্যবস্থা নেই।

বৈদর্ভী বলল, আমরা গাছের ডালপালা জ্বেলে রান্না করব। আপনি নিশ্চিন্তে কথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে যান।

মানুষটা কাঁপা কাঁপা পায়ে বাড়ির পিছন দিকে চলে গেল। দোয়েল সেদিকে তাকিয়ে, বিড়বিড় করে বলল, ডেফিনিটলি হি ইজ আ গোস্ট। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি। ওই মানুষটা ভূত ছাড়া কিছু নয়।

শালিনী চোখ দিয়ে দোয়েলের বুকের ইঙ্গিত করে বলল, ভেতরের ওটা আছে তো রে? অসভ্য ভূত হলে কিন্তু এতক্ষণে খুলে নিয়ে গেছে।

সবাই খুব জোরে হেসে উঠল। বাড়ির বাইরের জংলি বাগান থেকে কয়েকটা পাখি উড়ে গেল পাখার আওয়াজ করে। শালিনী হাত তুলে বলল, বন্ধুগণ, সিদ্ধান্ত মতো এবার তোমরা তোমাদের মোবাইল ফোন বন্ধ করে দাও। বহির্জগতের সঙ্গে আমাদের সব যোগাযোগ এখন থেকে কাট।

রান্নাবান্নার কথাটা ঠিক নয়। খাবার সঙ্গে আনা হয়েছে। কিছুটা কেনা হয়েছে, কিছুটা শালিনী আর দোয়েল বাড়ি থেকে রান্না করে এনেছে। কিঙ্কিনি, বৈদর্ভী বাড়ি থেকে কিছু করেনি বলে তার কেনা খাবারের পুরো খরচটাই দিয়েছে। যখন পিকনিকের পরিকল্পনা হয়, তখনই শালিনী বলেছিল, ওখানে কিন্তু রান্না করা যাবে না। বড়মামা বলেছে, বাড়িটা কয়েকঘণ্টার জন্য খুলে দিতে পারি তার বেশি নয়। রান্নাঘর ভেঙে গেছে। কাছাকাছির মধ্যে কোনও দোকান। বাজারও নেই। খাবারটাবার সব নিয়ে যেতে হবে।

কিঙ্কিনি বলেছিল, তাই হবে। এমন একটা দুর্দান্ত বাড়ি পাচ্ছি, আর কী চাই?

দোয়েল বলেছে, ঠিকই বলেছিস। একেই নদীর পাশে, তারওপর আবার ভাঙা বাড়ি। সোনায় সোহাগা। একেবারে ছোটবেলায় পড়া গল্পের বই।

বৈদর্ভী বলেছে, তুই তো ছোটই। হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছিস ঠিকই কিন্তু তোর সব এখনও ছোটই আছে। এইটুকু।

কথাটা বলে অশ্লীল ইঙ্গিত করেছে বৈদর্ভী। দোয়েল বলেছে, তোর বুঝি বিরাট বড়?

চুপ কর দোয়েল, চুপ কর, বৈদর্ভীর কিন্তু কিছু এসে যাবে না। জামা খুলে দেখিয়ে দেবে, লজ্জায় পালাবার পথ পাবি না।

বাজে কথা থামা। জায়গাটার নাম কী? এখান থেকে কতদূর? আমরা যাচ্ছি কবে?

শালিনী ডান হাত ছাড়িয়ে ঘোষণার ঢঙে বলে, জায়গার নাম ঘূর্ণী। ওখানকার নদীর নামও ঘূর্ণী। ট্রেনে তিন ঘণ্টা। তারপর ভ্যান রিকশাতে আধঘণ্টার একটু বেশি। বাসেও যাওয়া যাবে। ঘুরপথে যেতে হবে। ঘণ্টাখানেক বেশি সময় লাগবে। বন্ধুগণ, বড়মামা যে কোনও সময় ওই ভাঙা বাড়ি বিক্রি করে দেবেন। সুতরাং আর সময় নষ্ট না করে সামনের রবিবার চল ঘুরে আসি।

দোয়েল বলে, রবিবার বাদ দিলে হয় না?

বৈদর্ভী বলে, হোয়াই? রবিবার বাদ কেন? রবিবারই তো ভালো। কম্পিউটার ক্লাস নেই। ট্রেনে ভিড় কম।

দোয়েল বেজার মুখে বলে, বাড়িতে বাবা থাকবে। খ্যাচ খ্যাচ করবে। কোথায় যাচ্ছ? কার সঙ্গে যাচ্ছ? কখন ফিরবে? এখনও ভাবে ক্লাস এইটে পড়ি।

শালিনী বলে, এদিক থেকে আমার কোনও সমস্যা নেই। বাবা আমাকে কিছুতে বারণ করে না। জানে আমি কখনও খারাপ কিছু করব না।

বৈদর্ভী কাধ আঁকায়। ঠোঁট উলটে বলে, এর মধ্যে বাবার কথা উঠছে কেন? আমি কোথায় যাব আমি বুঝব? আঠেরো বছর হয়ে গেছে। নাউ আই অ্যাম অ্যাডাল্ট।

দোয়েল মুখ দিয়ে ফুঃ ধরনের আওয়াজ করে বলে, রাখ তোর আঠেরো! ওসব বলতেই ভালো লাগে। আটতিরিশ হলেও বাবারা পিছনে পড়ে থাকে। আমার দিদির তো বিয়ে করে ছেলেমেয়ে হয়ে গেল। এখনও দেখি বাবা ফোন করে বলে, মিমি, বিকেলের দিকে ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে ছাতা নিয়ে বেরোস কিন্তু।

কথাটা বলার সময় বাবার গলা নকল করে দোয়েল। শালিনী বলে, আহা, এটা আর পিছনে পড়ে থাকা কী হল? মেয়েকে বাবারা তো ভালোবেসে এসব বলবেই।

দোয়েল বলে, ও গড, এটা ভালোবাসা? এটাকে বলে বাড়াবাড়ি। একবার কী কেলেঙ্কারি হয়েছিল জানিস? শুনলে তোদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। বিশ্বাসই করবি না। তখন সবে দিদির বিয়ে হয়েছে। দিদি শ্বশুরবাড়িতে। বাবা মাঝেমাঝেই কলকাতায় যায়। একদিন দিদি মাকে ফোন করে বিরাট চেঁচামেচি শুরু করল। কী ব্যাপার না বাবা নাকি মাঝেমধ্যেই বালিগঞ্জে গিয়ে দিদির শ্বশুরবাড়ির সামনে ঘুরঘুর করে। যদি দিদিকে একবারে ছাদে বা বারান্দায় দেখা যায় এই ধান্দা। দিদির এক দেওর হাতেনাতে ধরে ফেলেছে।

শালিনী হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। বৈদর্ভী মুখ বেঁকিয়ে বলে, হাসিস না শালিনী। এটা হাসির ব্যাপার নয়। দোয়েলের দিদির অবস্থাটা একবার ভেবে দেখ তো। কী এমব্যারাসিং। এইজন্যই বাঙালি মেয়েরা কমপ্লিট মানুষ হতে পারল না। বাবাদের আদিখ্যেতার কারণে শুধু মেয়ে হয়েই রইল। বাইরের দেশে এসব ফালতু জিনিস নেই।

কথাটা বলতে বলতে বৈদর্ভী কিঙ্কিনির দিকে তাকিয়ে চুপ করে যায়। বাকিরাও তাকায়। বুঝতে পারল, প্রসঙ্গটা নিয়ে এতখানি আলোচনা ঠিক হয়নি। কিঙ্কিনি শুকনো হেসে বলল, তা হলে আমার কোনও সমস্যা নেই বল। বাবা নেই বলে আমি কমপ্লিট মানুষ হতে পারব। তাই না?

শালিনী তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পালটানোর জন্য বলল, তা হলে রবিবার বাদ।

কিঙ্কিনি আবার হেসে বলল, আমি কী বলব? আমার তো বাবার কেস নেই। যাদের সে ঝামেলা আছে তারা বলবে।

বাবা না থাকলেও কিঙ্কিনি চায়নি, তাদের আউটিং রবিবার হোক। রবিবার মা বাড়িতে থাকবে। কথাবার্তা যতই কমে আসুক, সারাদিন বাইরে থাকলে একটা কৈফিয়ত তো দিতেই হয়। যদিও কিঙ্কিনি দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করে আছে। মাকে বড় ধরনের একটা ধাক্কা দেবে। হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট বেরোলেই দেবে। কলকাতার কোনও কলেজে ভরতি হবে। হোস্টেলে থাকবে। এখানকার পাট একেবারের মতো চুকিয়ে চলে যাবে। মা যদি হোস্টেলের খরচ দিয়ে রাজি না হয়, তা হলে নিজে টিউশন বা পার্টটাইম চাকরি করবে। আজকাল কলকাতায় ভদ্রসভ্য ভাবে মেয়েদের কাজের সুযোগ হয়েছে। দাদাকে বললে কোনও একটা কল সেন্টারে ঢুকিয়ে দিতে পারবে না? নিশ্চয় পারবে। ওই লাইনে ওর চেনা। তার খুব ইচ্ছে করে এফ এম রেডিয়োতে আর জে ধরনের কাজ করতে। অনেকেই তার গলার প্রশংসা করে। এই মফস্সল শহরে থাকলে কিচ্ছু হবে না। বাবার মতো একদিন পালাতে হবে।

তাই সপ্তাহের মাঝেই এই ঘূর্ণীতে, শালিনীর মামার ভাঙা বাড়িতে হুল্লোড় করতে আসা হয়েছে। কথায় কথায় একদিন এই বাড়িটার গল্প করেছিল শালিনী। বৈদর্ভী বলল, চল শালিনী, ওখানে আমরা ঘুরে আসি। ভাঙা বাড়িতে পিকনিক দারুণ জমবে। প্রস্তাব শুনে বাকিরা লাফিয়ে উঠল। সেদিন দুজন ছেলেও ছিল। অনীক আর প্রিয়ম। কম্পিউটার ক্লাসে একসঙ্গে পড়ে।

অনীক বলল, আজই সব ফাইনাল করে ফেল। চাঁদা কত করে?

শালিনী বলল, খেপেছিস নাকি? মরে গেলেও বড়মামা, ওই বাড়িতে আমাদের ঢুকতে দেবে না। বাড়ি ভেঙে পড়ছে। অনেক ঘরে দরজা-জানলাই তো নেই, চুরি হয়ে গেছে। কিছুদিন হল, একজন কেয়ারটেকার রাখা হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি পারে বাড়িটা বিক্রি করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। যতই নদীর ধারে হোক আর গাছপালা থাকুক, পোড়ো বাড়ি রেখে কী হবে? অনেক বছর আগে মামারা দল বেঁধে কলকাতা থেকে গাড়ি করে বেড়াতে যেত। আমিও গেছি। এখন আর কেউ ওদিকে পা বাড়ায় না। সে অবস্থা নেই। মেইনটেন হয় না। বাড়ি বেদখল হওয়ার জোগাড়।

প্রিয়ম বলল, বেদখল হওয়ার আগে আমরা একবার দখল নিতে চাই শালিনী প্লিজ। মাত্র একদিনের জন্য তুই পারমিশান জোগাড় কর। আমি ক্যামেরা নিয়ে যাব। পোড়ো বাড়ির ওপর একটা ফোটো ফিচার করার শখ আমার বহুদিনের। ফেসবুকে হন্টেড হাউস বলে একবার দিয়ে দিতে পারলে মারকাটারি কাণ্ড হবে। তোর বড়মামার বাড়ি দেশে-বিদেশে নাম করে যাবে। দলে দলে সবাই আসতে চাইবে।

শালিনী চোখ পাকিয়ে বলল, খবরদার, ওই সব একদম করবি না, বাড়িটা বিক্রি করতে হবে না? ভূতের বাড়ি বললে আর কেউ নেবে?

অনীক এগিয়ে এসে বলল, প্রিয়ম তা হলে বাদ, আমি যাব।

বৈদর্ভী আড়চোখে তাকিয়ে বলল, চারটে মেয়ের সঙ্গে একা যাবি? ভয় পাবি না?

অনীকের মধ্যে একটা হিরো সাজার শখ আছে। সবসময় ফিটফাট। চোখে সানগ্লাস। সাইকেলটা এমন ভাবে ধরে যেন সাইকেল নয় মোটরবাইক। বুদ্ধিও কমের দিকে। সুযোগ পেলেই মেয়েরা খেপায়। বৈদর্ভীর কথায় চোখ কুঁচকে বলল, কেন ভয় পাব কেন? তোরা কি রাক্ষস?

কিঙ্কিনি বলল, না, রাক্ষস নই মানুষ। কচি পাঁঠা ভালোবাসি।

অনীক ভুরু কুঁচকে বলল, মানে!

দোয়েল ফিক করে হেসে বলল, মানে বুঝে লাভ নেই। চাপ নিস না অনীক।

কিঙ্কিনি বলল, তুই আজই তোর বড়মামার সঙ্গে কথা বল শালিনী। আমরা এই ভয়ঙ্কর জায়গাতে যাব।

শালিনী বলল, কথা বলে লাভ নেই।

প্রিয়ম অতি উৎসাহে বলল, আমরা যদি কথা না বলে নিজেদের মতো চলে যাই? ব্যাপক হবে কিন্তু।

শালিনী মুখ ভেংচে বলল, ব্যাপক হবে না আমার পিঠে ব্যাপক পিটুনি পড়বে?

শেষপর্যন্ত সবই হল। শালিনীর বড়মামা তার ভাঙা বাড়িতে একবেলার জন্য পিকনিকের অনুমতি দিলেন। কিন্তু প্রিয়ম পড়ল জুরে।

বৈদর্ভী বলল, জ্বর না ছাই, মেয়েরা যাবে শুনে বাড়ি থেকে ছাড়ছে না।

অনীকও ডুব দিয়েছে। ফোন করলে তুলছে না। মেসেজ পাঠালে রিপ্লাই দিচ্ছে না। কিঙ্কিনি বলল, ছাগলটার বাড়িতে গিয়ে হামলা করব নাকি?

বৈদর্ভী হাত নেড়ে বলল, দুর দুর, ভয় পেয়ে গেছে। চারটে মেয়ের সঙ্গে একা যাবে শুনে নার্ভ ফেল করেছে। ছেলেদের আমার চিনতে বাকি আছে নাকি? চল আমরা চারজনেই যাব।

একতলা আর দোতলার যে ঘরদুটো জনার্দন খুলে পরিষ্কার করে দিয়েছে দুটোতেই বড় বড় খাট পাতা। তিনতলার ঘরে খাবারের ব্যাগট্যাগ রেখে বৈদর্ভী ছাড়া সকলেই ছুটল ছাদের দিকে। এখনও নদী দেখা হয়নি। ছাদে যেতেই হবে। ছাদের দরজায় সামনে এসে থমকে দাঁড়াতে হল। সত্যি তালা দেওয়া। তালার সাইজও বেশ বড়। কী হবে তা হলে? কিঙ্কিনি আর শালিনী তালা ধরে টানাটানি করল। দরজা নড়বড় করে উঠল, তালার কিছু হল না। একটু পরেই মচকে যাওয়া পা টানতে টানতে ওপরে উঠে এল বৈদর্ভী। তার হাতে একটা বড় সাইজের হাতুড়ি।

শালিনী বলল, এটা কী রে!

বৈদর্ভী মুখ কুঁচকে বলল, হাতুড়ি চিনিস না? মাথায় এক ঘা দিলে বুঝতে পারবি। সিঁড়ির নীচে পেয়ে গেলাম। কেয়ারটেকার কয়লা ভাঙে। এখানে এখনও কয়লা-ঘঁটের উনুন চলে। এটা না পেলেও অবশ্য কিছু এসে যেত না, দরজা খোলার একটা না একটা ব্যবস্থা তো করতেই হত। জনার্দন বলল আর আমরা ভালোমানুষের মতো মুখ করে নদী না দেখে ফিরে গেলাম, তা তো হতে পারে না। নে সর। তালাটা ভাঙতে দে।

তালা ভাঙা গেল না। কিন্তু মিনিট পনেরোর চেষ্টায় দরজা থেকে একটা কড়া উপড়ে ফেলা গেল। কাঠের গোড়ায় ঘুণ ধরেছিল। কড়াটা যেন এতদিন অপেক্ষা করছিল, কবে খুলে পড়বে। আজ খুলে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

ছাদে পা দিয়েই চারজনে লাফিয়ে উঠল। লাফিয়ে ওঠবার মতোই দৃশ্য। বাড়ির ঠিক পিছন দিয়েই নদী চলে গেছে। ঘূর্ণী নদী। ছাদ থেকে সেই নদীর অনেকটাই দেখা যায়।

শালিনী দু-হাত ছড়িয়ে বলল, আমার গ্র্যান্ড গ্র্যান্ড ফাদার শুধু নদীটার জন্যই এখানে বাড়ি কিনেছিলেন। সন্ধের পর ছাদে মাদুর পেতে বসে এস্রাজ বাজাতেন।

কিঙ্কিনি বলল, উরিব্বাস সে তো বিরাট রোমান্টিক ব্যাপার।

নদী চওড়ায় খুব বড় কিছু নয়। ওপাড় দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। ডানপাশে বাঁক নেওয়ার মুখে কয়েকটা নৌকো দাঁড়িয়ে আছে অলসভাবে। হয়, মাছ ধরছে, নয়তো রোদ পোয়াচ্ছে। জলে কোথাও মেঘের ছায়া কোথাও রোদ। হঠাৎ নদীর দিকে তাকালে মনে হবে, কোনও মেয়ে তার শাড়ির আঁচল পেতে দিয়েছে। সেই আঁচলে আলো ছায়ায় নকশা কাটা। চারজনেই ভাঙা পাঁচিলের ধারে গিয়ে নদী দেখতে লাগল।

শালিনী বলল, নদীর এটাই ম্যাজিক। মেয়েদের চট করে মাথা গুলিয়ে দেয়। নদী দেখার জন্য তারা যে-কোনওরকম ঝুঁকি নিতে পারে।

দোয়েল শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বলল, আমি আরও ঝুঁকি নেব। নদীতে স্নান করব। ওই যে ঘাটটা রয়েছে, ওখান থেকে জলে লাফ দেব।

শালিনী হেসে বলল, তোর বাবা যদি জানতে পারে? একেই না বলে এসেছিস, তারপর নদীতে স্নান! বাপরে।

দোয়েল সুর করে বলল, আমি ভয় করব না, ভয় করব না। নদীতে ডুব না মেরে ফিরব না গো ফিরব না।

বৈদর্ভী দোয়েলের পিঠে চাপড় মেরে বলল, সত্যি বীর বটে, তুই হলি নদী বীরাঙ্গনা।

কিঙ্কিনি বলল, আমিও দোয়েলের সঙ্গে জলে নামব। আমাকে বাবা বকতে পারবে না, কারণ সেই সুযোগ নেই।

শালিনী বলল, এসব মাথা থেকে বাদ দে। জলে কারেন্ট আছে। নাম শুনে বুঝতে পারছ না? ঘূর্ণী নদী। তার ওপর এদিকটায় কোনও লোকজনও নেই। ডুবে যাওয়ার সময় যে কেউ লাফ দিয়ে বাঁচাবে, নো চান্স। হাজার চিৎকারেও কেউ আসবে না। শুধু পাখি উড়ে যাবে।

দোয়েল বলল, সেইজন্যেই তো সুবিধে, নিজেদের মতো জলকেলি করব। কেউ দেখবে। না।

বৈদর্ভী বলল, সুইমিং কস্টিউম এনেছিস?

কিঙ্কিনি বলল, দুর নদীতে আবার সুইমিং কস্টিউম কী?

দোয়েল এক দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। বলল, বিকিনি পরে সমুদ্রে নামা যায়, নদীতে যায় না।

শালিনী হেসে বলল, নদীতে মনে হয় শাড়ি ফিট করে। ভেজা গা, কাঁধে কলসি, যেন যমুনার জল থেকে রাধা উঠছে।

সবাই হেসে উঠল। বৈদর্ভী বলল, এক কাজ করি চল, সবাই নুড হয়ে জলে নামি। দেখবি নিমেষের মধ্যে আশপাশে সব গ্রামে খবর হয়ে গেছে, চারটে মেয়ে জামাকাপড় খুলে নদীতে স্নান করছে। দলে দলে লোক আমাদের দেখতে ছুটে আসবে। নদীর পাড় দেখবি মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে। আমরা ডুবে যাচ্ছি দেখলে একসঙ্গে হাজার লোক জলে ঝাঁপ মারবে। ভেসে যাওয়ার ভয়ও থাকবে না। হি হি।

দোয়েল বলল, বৈদর্ভীর প্ল্যানটা নট ব্যাড।

শালিনী আঁতকে উঠল, কোনটা? ন্যুড হয়ে জলে নামাটা?

দোয়েল হাত উলটে বলল, সমস্যা কোথায়? ছেলেরা যদি থাকত, এতক্ষণে দেখতিস জামা প্যান্ট খুলে নেমে গেছে।

কিঙ্কিনি বলল, ছেলেরা যা পারে আমরা তা পারি নাকি?

বৈদর্ভী ভাঙা পাঁচিলে হেলান দিয়ে বলল, আমি পারি। যদি তোরা চ্যালেঞ্জ করিস, তা হলে আমি জামাকাপড় খুলে নদীতে গিয়ে সাঁতার কেটে আসতে পারি। আমি ছেলেদের থেকে কম কিছু নই। তোরা কি চ্যালেঞ্জ করছিস?

দোয়েল হেসে বলল, হ্যাঁ করছি। আমি চ্যালেঞ্জ করছি, তুই পারবি না।

বৈদর্ভী সহজভাবে বলল, কী দিবি?

কিঙ্কিনি বলল, অ্যাই তোরা অসভ্যতামি থামাবি?

দেখা গেল, নদী আছে শুনে সকলেই স্নানের জন্য কমবেশি তৈরি হয়ে এসেছে। সুইমিং কস্টিউম না আনলেও অতিরিক্ত একসেট জামা কাপড়, বড় তোয়ালে এনেছে। কিঙ্কিনি আর শালিনী শালোয়ার বের করে পরল, দোয়েল ছোটো ঝুলের পায়জামা। বৈদর্ভীর পোশাকটাই একটু গোলমেলে। শর্ট প্যান্ট স্লিভলেস গেঞ্জি পরে এসে কিঙ্কিনিকে বলল, কেমন দেখাচ্ছে ডার্লিং?

কিঙ্কিনি একটু চমকেই উঠল। বাঃ সুন্দর লাগছে! সুন্দরের থেকে অন্যরকম লাগছে বেশি। গায়ের রং বাদামি আর কালোর মাঝামাঝি হওয়ার কারণে মেয়েটার শরীরে একটা বুনো ভাব ফুটেছে। বৈদর্ভীর এই রূপের কথা আগে জানা ছিল না কিঙ্কিনির। জানার কথাও নয়। এতটা খোলামেলা ভাবে আগে কখনও বৈদর্ভীকে দেখেনি সে। কলকাতায় যে পোশাক রাস্তাঘাটে কোনও ব্যাপার নয়, মফস্সলে সেটাই অসম্ভব। তাই এসব পরে রাস্তায় বেরোনোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। স্প্যাগেটি পরার কারণে বৈদর্ভীর বুক, পিঠ দেখা যাচ্ছে অনেকটা। বুকদুটো তার মতো বড় না, ছোটই। যেন আলগোছে ছুঁয়ে আছে। চওড়া কাঁধে একটু পুরুষালি ধরন। হাত, পায়ের পেশিগুলোও স্পষ্ট। শরীরে মেয়ের নরমসরম ভাবের বদলে একটা কাঠিন্য।

বৈদর্ভী জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, হাঁ করে কী দেখছিস?

কিঙ্কিনি দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, তোর বেহায়াপনা দেখছি। আর বাকি কী রাখলি? এটা তো কলকাতা নয়, পাড়াগাঁয়ের মানুষ এসব দেখলে ভিরমি খাবে। গায়ে টাওয়াল চাপা দিয়ে চল।

বৈদর্ভী কাছে সরে নীচু গলায় দ্রুত বলল, আমি নদীতে যাব না। আমার পায়ে টান পড়েছে, জলে নেমে মরব নাকি? ওদের রেখে তুই একটু পরেই চলে আয়।

কিঙ্কিনি চারপাশ তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, পাগলামি করিস না বৈদর্ভী। আমি এবার সবাইকে বলে দেব ঠিক করেছি।

একইরকম গলা নীচু করে বৈদর্ভী বলল, যা খুশি বল। আই ডোন্ট কেয়ার। আমি তোকে চাই।

বৈদর্ভী এগিয়ে এসে কিঙ্কিনির হাত চেপে ধরল। কিঙ্কিনি হাত সরিয়ে বলল, ছিঃ এসব কী খারাপ কথা বলছিস তুই!

বৈদর্ভী ঠোঁটের কোনায় হেসে বলল, দেখবি খারাপ হলেও খুব ভালো লাগবে। এমনভাবে আদর করব তুই ছাড়তেই চাইবি না।

কানে হাত চাপা দিয়ে কাতর গলায় কিঙ্কিনি বলল, প্লিজ এরকম করিস না। কেউ জানলে বাজে একটা ব্যাপার হবে।

বৈদর্ভী হিসহিসে গলায় বলল, বাজে হলে হবে। অনেক তো ভালো ছিলি লাভ কী হল? আমি তোর জন্য এই ঘরে অপেক্ষা করব।

কিঙ্কিনি বুঝতে পারল তার অসুবিধে হচ্ছে, বৈদর্ভীর কথায় ঝিমঝিম করছে শরীর। আজ নতুন নয়। সেদিন ফোনে কথা বলার সময়ও হয়েছে। তবে এতটা নয়। আজ মেয়েটার শরীর অনেকটা দেখতে পাচ্ছে বলে? জড়তা ঝেড়ে ফেলতে চাইল কিঙ্কিনি। বলল, একদম না।

ঠিক নীচে নামার মুহূর্তে বৈদর্ভী সত্যি সত্যি ঘোষণা করল, সে যাবে না। তার পা ব্যথা করছে। জলে নামার ঝুঁকি নেবে না।

শালিনী বলল, তুই মগ নিয়ে চল, পাড়ে বসে মাথায় জল ঢালবি।

বৈদর্ভী বলল, তোরা যা, ততক্ষণ আমি আমার ইনজিওরড পা-টাকে রেস্ট দিই। তা ছাড়া হঠাৎ মনে পড়ে গেল, জলে আমার ফঁড়া আছে। হয়তো বা ডুবব না, দেখলি কুমির টেনে নিয়ে গেল। বরং একটা কাজ করিস, কিঙ্কিনিকে দিয়ে এক বালতি নদীর জল পাঠিয়ে দিস। নদীতে নামতেও হবে না, আবার নদীর জলে স্নান করাও হবে। হি হি।

দোয়েল বলল, দেখেছিস তো প্রথমে কত বড় বড় কথা বললি, ন্যুড হয়ে জলে নামবি, এই করবি সেই করবি, এখন ঘরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবি বলছিস। ভালোই হয়েছে তোকে যেতে হবে না। টাওয়ালটা দে।

শালিনী বলল, কেন তুই টাওয়াল আনিসনি?

দোয়েল বলল, এনেছি, আমার দুটো লাগবে।

 বৈদর্ভী চোখ নাচিয়ে বলল, ওনার একটায় ঢাকে না।

দোয়েল এগিয়ে গিয়ে বৈদর্ভীর পিঠে কিল বসাল।

নির্জন নদীর কাছে পৌঁছে হঠাই মনখারাপ হয়ে গেল কিঙ্কিনির। বৈদর্ভী কেন তার সঙ্গে এমন আচরণ করছে? কই অন্যদের সঙ্গে তো করছে না। তাকে কি খারাপ ভাবে? নিশ্চয় তাই। বাবা চলে যাওয়ার পর তাদের বাড়িটাকে তো অনেকে খারাপ ভাবে। এই পাঁচ বছরে সে কত কী শুনছে। সামনাসামনি বলেনি, আড়ালে আবডালে বলেছে। যখন বয়স ছোট ছিল, বন্ধুদের মায়েরা তার সঙ্গে মেয়েদের মিশতে দিত না। আজও মনে হচ্ছে, সেইসময় অনেকেই বাসে তার পাশে বসত না। ছুতোনাতা করে উঠে যেত। তপজা তো বলেই ফেলেছিল, কিছু মনে করিস না কিঙ্কি, তোর পাশে বসলে মা রাগ করবে। এ তো অল্প কানাঘুষো, আরও কত কী শুনতে হয়েছে! কেউ বলেছে, বাবা নাকি মায়ের জন্যই চলে গেছে। মায়ের অন্য পুরুষমানুষ আছে। অন্য পুরুষমানুষ ব্যাপারটা কী তখন বুঝত না। পরে অর্ধেন্দু দত্তকে দেখে বুঝতে পারল। লোকটা রাতবিরেতে ফোন করত, মা কলকাতায় যাওয়ার আগে গালে পাউডার দিত। একসময় মনে হত, তার প্রতি মায়ের রাগের কারণ, সে এসব জানে বলে। পরে বুঝেছিল না, কারণ অন্য। সে নাকি অনেকটা তার বাবার মতো। নদীর দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা অনেকদিন পরে হাহাকার করে উঠল কিঙ্কিনির। কেন সে বাবার মতো! কেন? চলে যাওয়ার সময় বাবা কি তার কথা মনে রেখেছিল? ছোট মেয়েটার জন্য থমকে দাঁড়িয়েছিল এক মুহূর্ত? দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে আবেগ সামলালো কিঙ্কিনি।

ঘাটের অবস্থা বাড়ির মতো অতটা বিপজ্জনক নয়। দোয়েল আর শালিনী ভালো সাঁতার জানে। কিঙ্কিনিও সাঁতার জানে। খুব ছোটবেলায় দেবনাথ ছেলেমেয়েদের পাড়ার সুইমিংপুলে নিয়ে গিয়ে সাঁতার শিখিয়েছিল। তারপর বহু বছর জলে নামা হয়নি। জলে পা দিয়েই কিঙ্কিনির বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। অভ্যেস নেই, যদি কোনও বিপদ হয়? বাড়িতে বলে আসেনি। কাদের সঙ্গে কোথায় গেছে দাদার খুঁজে বের করতে করতেই অনেকটা সময় চলে যাবে। তার থেকে বড় কথা মুডটা হঠাৎই চলে গেছে।

শালিনী চিৎকার করে উঠল, কী হল তোর? থম মেরে গেলি কেন?

কিঙ্কিনি শুকনো হেসে বলল, কই! কিছু হয়নি তো?

 দোয়েল বলল, বাড়ির জন্য মন কেমন করছে।

কিঙ্কিনি হেসে বল, আমাদের বংশে ওটি নেই। বাড়ির জন্য মন কেমন করা কী বস্তু আমরা জানি না। আমার বাবার কাণ্ড দেখে বুঝতে পারিস না?

দোয়েল বলল, সরি কিঙ্কি, আমি কিছু মিন করে বলিনি।

কিঙ্কিনি বড় করে হেসে বলল, দুর, আমি কি তাই ভেবেছি? কথাটা মনে হল তাই বললাম। মজার কথা বলতে ভালো লাগে।

শালিনী বলল, ঠিক আছে আয় এবার জলে ঝাঁপ দিই।

দোয়েল বলল, ঝাঁপ-টাপ হবে না, নীচে কী আছে কে জানে বাবা, এমনি সিঁড়ি দিয়ে নামছি। আয় কিঙ্কি।

তারা জলে নেমে পড়ল। এবং দ্রুত খানিকটা দূর চলেও গেল। কিঙ্কিনি সাঁতার কাটতে গেল না, কোনওরকমে কটা ডুব দিয়ে উঠে এল। তোয়ালে দিয়ে মাথা মোছার পর মুখ তুলে দেখল, ভাঙা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আছে বৈদর্ভী। হাসছে। পিছনে ফিরল কিঙ্কিনি। শালিনী আর দোয়েল ঘাট থেকে খানিকটা দূরে জলে হুটোপুটি করছে। ফাঁকা নদীতে কোথা থেকে যেন দুটো বালক এসে জুটেছে! আশ্চর্য! এরা কি জলের তলায় লুকিয়ে ছিল? নাকি ভেসে এল? কিছু একটা হবে। শালিনীদের সঙ্গে ওরা দিদি দিদি বলে মিশে গেছে। গাছের ডালপাতা নিয়ে কী। যেন খোল বানিয়ে খেলছে চারজনে। হাসছে খিলখিল করে। যেন কতদিনের চেনা!

কিঙ্কিনি ভেবেছিল জলে ডুব দিলে মন খারাপ ভাবটা কাটবে। কাটল না। সে শালিনীদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল।

দোয়েল চিৎকার করে বলল, এখন যাব না। অনেকক্ষণ থাকব।

গায়ে ভেজা তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিঙ্কিনি। শীত শীত করছে। কতক্ষণ এভাবে থাকবে? আবার মুখ তুলে ছাদের দিকে তাকাল। বৈদর্ভী হাতছানি দিয়ে ডাকছে। খারাপ হওয়ার হাতছানি? শরীর কেঁপে উঠল কিঙ্কিনির! কী করবে সে? সে কি খারাপ হবে? দেবনাথ চট্টোপাধ্যায় যে খারাপ মানুষ ছিলেন না। তা হলে? কিঙ্কিনি সিদ্ধান্ত নিল সে বৈদর্ভীর কাছে যাবে। সে খারাপ হবে।

ঘাটে খালি পায়ের জলছাপ রেখে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল সে।

দরজা ভেজিয়ে বৈদর্ভী ঝাঁপিয়ে পড়ল উন্মত্তের মতো। কিঙ্কিনির শরীর থেকে জলমাখা পোশাক টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে মুখ ঘষতে লাগল বুকে, ঘাড়ে, গলায়। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল স্তনদুটো। তারপর নতজানু হয়ে বসল কিঙ্কিনির সামনে। দুহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ নামিয়ে দিল চরম আশ্লেষে। চাপা ঘর ঘর আওয়াজ তুলতে লাগল। শিহরণ আর লজ্জায় শীৎকার তুলল কিঙ্কিনি।

একসময় মাথা উঁচু করে জড়ানো গলায় বৈদর্ভী বলল, হয়েছে? হয়েছে তোর?

বৈদর্ভীর পুরুষালী কাঁধে নখ বসিয়ে চোখ বোজা কিঙ্কিনি বলল, প্লিজ, আর একবার… ওয়ানস মোর সোনা…।

ঠোঁটে মুখ নামাল বৈদর্ভী।

বিকেলে রওনা দেবার ঠিক আগে ব্যাগ থেকে মাঝারি মাপের একটা বোতল বের করল দোয়েল। লাজুক হেসে বলল, এটা ভদকা। তোদের জন্য সারপ্রাইজ। যাবার আগে ছাদে বসে। এক ছিপি করে খাব। কেমন হবে?

বৈদর্ভী লাফ দিয়ে বলল, ফাটাফাটি।

শালিনী মাথায় হাত দিয়ে বলল, সর্বনাশ! এই মেয়ে যে বাড়াবাড়ির চরম করছে। বাবাকে না জানিয়ে এসেছে, নদীতে স্নান করেছে, এবার মদের বোতলও বের করছে! কী হবে গো!

কিঙ্কিনি বলল, আমি এসবে নেই বাবা। আমি খাব না।

বৈদর্ভী বলল, আরে বাবা, মোটে তো এক ছিপি খাবি। আর দেরি না করে বসে যা সবাই। পিকনিক মেমরেবল করে রাখি।

শালিনী নাক কুঁচকে বলল, মুখে গন্ধ-টন্ধ থাকবে না তো?

দোয়েল বলল, থাকলে থাকবে। আই ডোন্ট কেয়ার। আমি এখন অ্যাডাল্ট।

 বৈদর্ভী বলল, আর বীরত্ব ফলাতে হবে না। তাড়াতাড়ি দাও দেখি, ট্রেন ধরতে হবে।

শালিনী ভয় পাওয়া গলায় বলল, জনার্দনদা দেখে ফেললে কেলো, বড়মামাকে বলে দেবে।

বৈদর্ভী বলল, চিন্তা করিস না আমি নীচের দরজা আটকে এসেছি। চারটে মেয়ে বাড়িতে রয়েছে, কেউ হুট করে ঢুকলেই হল। তোর জনার্দনদা জানবে কী করে?

কাগজের গ্লাসেই ভদকা ঢালা হল। প্রথম চুমুকে গা গুলিয়ে ওঠে, জ্বালা করে ওঠে পেট। তারপর ধীরে ধীরে অজানা একরকমের ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়তে লাগল শরীর জুড়ে। মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। তখন আকাশে কালো করে মেঘ জমতে শুরু করেছে। নদী থেকে উড়ে আসছে বাতাস। এবার ভদকার সঙ্গে মাপ করে সফট ড্রিঙ্কস মেশানোর দায়িত্ব নিয়েছে। দোয়েল। তার এই গুণ দেখে বাকিরা বিস্মিত! সে নাকি বাবা কাকাকে দেখে শিখেছে। যত সময় যেতে লাগল, জিনিসটার স্বাদ আরও ঘন হয়ে আসতে লাগল।

দুবার গ্লাস শেষ করে যখন তিন নম্বরের পালা শুরু হয়েছে তখন আকাশ পুরোপুরি কালো। হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি এল মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। অসময়ের কালবৈশাখী। অসময়ের কালবৈশাখী কি অতিরিক্ত জোর পায়? কে জানে পায় কিনা। তবে মেয়েরা দারুণ মজা পেল। তারা ঠিক করল ঝড়ের মধ্যেই নদীর কাছে যাবে। শালিনী প্রায় টলতে টলতে বলছে, ঝড়ের সময়ে নদীতে একধরনের সঙ্গীত তৈরি হয়। জল ছুঁলে সেই সুর শরীরেও বাজে। কথাটায় বাকিরা হইহই করে উঠল। এখনই নদীর জল ছোঁয়া হবে। জনার্দন বারণ করলে কোনও পাত্তা দেওয়া হবে না।

শালিনী জড়ানো গলায় বলল, হু ইজ জনার্দন? হি ইজ নো বডি।

বৈদর্ভী বলল, বেশি বকবক করলে চ্যাংদোলা করে ছাদ থেকে ফেলে দেব শালাকে।

কিঙ্কিনি হুংকার দিল, চল, নদীতে চল।

.

রাত এগারোটার অল্প কিছু পর বাড়ি ফিরল কিঙ্কিনি। কিছু করার ছিল না। ঝড়ে ওভারহেড তার ছিঁড়ে গেছে। ট্রেন বন্ধ। রাত নটার লাস্ট বাস ধরে ঘুরপথে ফিরতে হয়েছে। নীলাদ্রি সাইকেল নিয়ে স্টেশনে গেছে।

রান্নাঘরের জানলা থেকে মেয়েকে দেখতে পেল যামিনী। দরজা খুলতেই বিশ্রী বিশ্রী গন্ধ ভেসে এল। চমকে উঠল যামিনী। কীসের গন্ধ, মদের না?

ঘরে পা রেখে কিঙ্কিনি জড়ানো গলায় বলল, চমকে উঠলে কেন মা? কী ভেবেছিলে? বাবা এসেছে? হি হি। ঠিক এক কায়দায় বেল বাজিয়েছি না টিং টিং, টিং টিং।

নাকে আঁচল চাপা দিয়ে সরে দাঁড়াল যামিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *