০৮. একটা রিভলভার

০৮.

আমাকে একটা রিভলভার জোগাড় করে দিবি?

কেন?

আমি একজনকে খুন করব।

 ওরে বাবা, কাকে খুন করবি?

 বলব না।

আমাকে নয় তো?

 হতে পারে। ঠিক বুঝতে পারছি না।

কিঙ্কিনি সোফার ওপর টানটান হয়ে শুয়ে আছে। সে পরে আছে জিনস আর টপ। টপটা উঠে গিয়ে কিঙ্কিনির পেটের অনেকটা দেখা যাচ্ছে। কিঙ্কিনির সেদিকে মন নেই। তার পা দুটো সোফার হাতলের ওপর তোলা। হাতে একটা নেল কাটার। আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে নখের পরিচর্যা করছে।

একই সোফার গায়ে হেলান দিতে মেঝেতে বসে আছে বৈদর্ভী। হাঁটু দুটো ভাজ করে বুকের কাছে রেখেছে। হাফ প্যান্ট আর টি শার্টে তাকে আজ যেন বেশি ছিপছিপে লাগছে। বৈদর্ভীর এই ঘরে দুটো জানলা। দুটোতেই পরদা টানা। আলোও জ্বলছে না। ফলে এই কড়া রোদের দুপুরেও ঘর বেশ অন্ধকার। এই অন্ধকারেও কিঙ্কিনি কী করে যে নখ পরিচর্যা করছে। সেটা একটা বিস্ময়। ঘর শুধু অন্ধকার নয়। ঘরে প্রচুর ধোঁয়া আর কটু গন্ধ। গন্ধটা গাঁজার। একটু আগেই কিঙ্কিনি আর বৈদর্ভী একটা গাঁজা ভরা সিগারেট ভাগ করে খেয়েছে। সকালে বৈদর্ভী কিঙ্কিনিকে ফোন করে বলল, কিঙ্কিনি, আজ আমাদের বাড়িতে দুপুরে চলে আয়। বাবা মা কেউ থাকছে না। ওরা কলকাতায় যাবে, ফিরতে রাত।

কিঙ্কিনি তখনও বিছানায় ছিল। জড়ানো গলায় বলল, গিয়ে কী হবে?

সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেব। কম্পিউটারে ভালো ভালো জিনিস দেখব। একটা সাইটে হলিউডের হিরো হিরোইনদের নেংটুপুঁংটো ফটো আছে। বাবা-মা থাকলে তো দরজা আটকেও দেখতে পারি না। সন্দেহ করে। আজ প্রাণ খুলে দেখব।

কিঙ্কিনি পাশ বালিশ জড়িয়ে বলল, দুর হলিউড দেখতে তোর বাড়িতে কষ্ট করে যাব কেন? আমারই তো নেট আছে।

বৈদর্ভী কাতর গলায় বলল, কেন আয় না বাবা, সবাই মিলে হইচই হবে।

কিঙ্কিনি হাই তুলে বলল, আমাকে ছাড়া হইচই কর। আজ আমি দুপুরে বাড়ি থেকে বেরোব না। হায়ার সেকেন্ডারির পর বিছানা থেকে না নামবার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। অথচ দেখ একদিনও ভালো করে শুতে পারছি না।

বৈদর্ভী এবার প্রায় কেঁদে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, তুই না এলে প্রোগ্রাম ক্যানসেল। কাউকে ডাকব না।

কিঙ্কিনি তড়াক করে লাফ দিয়ে বসল। চাপা গলায় বলল, সেটাই ভালো। কাউকে ডাকতে হবে না। শুধু তুই আর আমি।

বৈদর্ভী একটু চুপ করে থেকে গাঢ় গলায় বলল, মিথ্যে বলছিস না তো কিনি?

না, সত্যি বলছি। কিন্তু ওয়ান কন্ডিশন। একটা জিনিস খাওয়াতে হবে।

কী? বৈদর্ভী উগ্রীব হয়ে বলল, কী খাবি?

কিঙ্কিনি মুখ ফিরিয়ে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, মদ খাওয়াতে হবে, ভদকা। পাতি লেবুর রস দিয়ে খাব; দোয়েল সেদিন বলল না, ওর বাবা খায়। ওরকমভাবে খাব। খাওয়াবি কিনা বল।

বাপরে তুই তো দেখছিস বিরাট মদখোর হয়ে গেছিস! একদিন খেয়েই নেশায় পড়ে গেলি?

ইয়ার্কি না, তুই অ্যারেঞ্জ করতে পারবি কিনা বল। কিঙ্কিনির গলায় উত্তেজনা। বলল, মদ খাওয়ার পর…।

বৈদর্ভী বলল, খাওয়ার পর কী?

কিঙ্কিনি হেসে বলল, জানো না কী। ন্যাকা?

বৈদর্ভী হেসে বলল, তোর দেখছি একদিনেই ভালো সবকটা জিনিসে নেশা ধরেছে। যাক তুই চলে আয়, আমি শিবুকে দিয়ে ব্যবস্থা করে রাখছি।

কপাল কুঁচকি কিঙ্কিনি বলল, শিবুটা আবার কে? একে কোথা থেকে জোটালি?

বৈদর্ভী মুখ দিয়ে বিদ্রুপের আওয়াজ করে বলল, আমি কি তোদের মতো শুধু গুডবয় আর গুডগার্লদের সঙ্গে থাকি? ব্যাডদের সঙ্গেও আমার দোস্তি রয়েছে। রেলগেটের ঠেকে যাতায়াত আছে শিবুর। আমি তো আর দোকানে ঢুকে মদ কিনতে পারব না। ওই-ই এনে দেবে।

শিবু মদ আনেনি। সে বৈদর্ভীকে দিয়ে গেছে কতগুলো গাঁজাভরা সিগারেট। বলেছে, বাড়িতে মদ খেলে ঝামেলায় পড়ে যাবে দিদিভাই। মাসিমা, মেসোমশাই এসে ঠিক গন্ধ পাবে। তার থেকে এই জিনিস নাও। কোন ঝুট ঝামেলা নেই, টানার পর অ্যাসট্রে ঝেড়ে ফেলে দেবে। অথচ নেশা ডবল।

সবে একটা করে সিগারেট খাওয়া হয়েছে। প্রথম কটা টানে কাশি হয়েছে বেশি। আদ্দেক ধোঁয়াই নাক-মুখ দিয়ে ফসকে গেছে। পরের দিকে বৈদর্ভী, কিঙ্কিনি দুজনেই ম্যানেজ করেছে। নেশা ডবল না হাফ বোঝা না গেলেও, বেশ একটা ঝিম ভাব এসেছে।

বৈদর্ভীর সামনে টিভি চলছে। তবে কোনও চ্যানেলই কয়েক সেকেন্ডের বেশি স্থির নয়। কারণ বৈদর্ভী ক্রমাগত রিমোট সার্ফ করে যাচ্ছে। একটা চ্যানেলে বৈদর্ভী থমকে গেল। হিন্দি সিনেমার নাচ গান। টিভির ভলুম কম থাকায় গান তেমন করে শোনা যাচ্ছে না। ফিসফিসানির মতো লাগছে। সেদিকে তাকিয়ে বৈদর্ভী বলল, তোর হঠাৎ খুনের ইচ্ছে মাথায় চাপল কেন কিনি?

হঠাৎ কেন চাপবে? অনেকদিন ধরেই প্ল্যান করছি। সেই ছোটবেলা থেকে। আজ তোকে বলে ফেললাম।

রিভলভার দিয়েই খুন করতে হবে? অন্য কিছু দিয়ে হবে না? এই ধর ছুরি বা বিষ?

কিঙ্কিনি বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের নখ ঘষতে ঘষতে বলল, জানি না। এমনভাবে বলছিস যেন আগেও আমি খুন করেছি আর খুনের ওয়েপন বিষয়ে আমার বিরাট এক্সপিরিয়েন্স আছে। রিভলভার দিয়ে মারলে একটা প্রেস্টিজ হয় তাই রিভলভার বললাম। বিষটি কেমন হেঁদো ব্যাপার। পুলিশ যখন আমাকে ধরে নিয়ে যাবে কাগজে ফটো বেরোবে, আমার হাতে রিভলভার। হি হি।

চ্যানেল বদলাতে লাগল বৈদর্ভী। খবরের চ্যানেলে এসে আটকে গেল। কোথাও গোলমাল হয়েছে। পরদায় ছবি দেখাচ্ছে। বাসে আগুন জ্বলছে। ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে। কোথায় গোলমাল? নিশ্চয়ই কলকাতার কোনও কলেজে। কলেজগুলোতে আজকাল রোজ গোলমাল হয়। ভাগ্যিস সে কলকাতায় থাকে না। গোলমালে পড়তে হত। পা দুটো সামনের দিকে মেলে দিল বৈদর্ভী। মাথাটা হালকা টাল খেল। না, শিবু ব্যবস্থাটা ভালোই করেছে। জল, গেলাস, পাতিলেবুর রস কিছুই দরকার হল না। মদ খেলে সত্যি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যেত। এতে সে সমস্যা নেই। একটু পরে জানলা দরজা খুলে ফুল স্পিডে ফ্যান চালিয়ে দিলেই হবে। রুম স্প্রে, ধূপ তো আছেই। ঘরটা অন্ধকার করায় ঝিম ভাবটা বেশি লাগছে।

কাকে খুন করবি সে তো বলবি না, কিন্তু কেন করবি সেটা কি জানতে পারি?

কিঙ্কিনি বলল, আসলে কী জানিস বৈদর্ভী, যাকে খুন করব ভাবি তার নাম রোজই বদলে বদলে যাচ্ছে।

বৈদর্ভী হেসে ফেলল। বলল, মানে? খুনি ঠিক আছে কিন্তু টার্গেট পালটাচ্ছে?

অনেকটা তাই, এই ধর আজ তোকে খুন করতে ইচ্ছে, কাল মনে হচ্ছে, তোকে নয়, শিবুটাকে মারলে ঠিক হবে। হারামজাদাটা আমাদের একটা বাজে নেশা ধরিয়ে দিতে চাইছে। দেখবি ওই ছেলে নিজে গাঁজার পুরিয়া বেচে। তবে জিনিসটা কাজ করছে ভালো।

আর আমাকে? আমাকে কেন খুন করতে ইচ্ছে করবে?

কিঙ্কিনি উঠে বসল। মনে হচ্ছে এবার সে পায়ের নখ নিয়ে পড়বে।

তুই খুব বিশ্রী একটা কাজে আমাকে জড়িয়ে ফেলেছিস। যদিও পুরো দোষটা তোর নয়। আমি ইচ্ছে করে খারাপ হব ভেবে ঝাঁপ দিয়েছিলাম, তারপর দেখলাম ব্যাপারটা মন্দ নয়। জীবনে ছেলেদের যত কম লাগে তত ভালো। এখন থেকেই জানা রইল।

বৈদর্ভী চ্যানেল বদলাল। হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটা ধুমসো চেহারার পুরুষ মানুষ গান। করছে। জঘন্য। টিভি বন্ধ করে দিল বৈদর্ভী। ঘরটা আরও অন্ধকার হয়ে গেল। পাশে সেন্টার। টেবিলে সিগারেটগুলো সাজানো হয়েছে। একটা নিয়ে দেশলাই জ্বালালো বৈদর্ভী। লম্বা টান দিল চোখ বুজে। কাশি একটু হল বটে, তবে আগের তুলনায় কম। কিঙ্কিনি না খেলেও, আগে বেশ কয়েকবার সিগারেট খেয়েছে বৈদর্ভী। সিগারেটের ধোঁয়ায় তার অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। এই ধোঁয়াটায় একটা জ্বালা ভাব আছে। কিঙ্কিনি ঝুঁকে পড়ে বৈদর্ভীর হাত থেকে সিগারেটটা নিল। পরপর দুটো টান দিল চৌখস কায়দায়। নাক মুখ দিয়ে ঘন ধোঁয়া ছাড়ল গল গল করে।

বৈদর্ভী বলল, বাঃ ওস্তাদ হয়ে গেছিস!

দেখছি খারাপ জিনিসগুলো রপ্ত করতে বেশি সময় লাগছে না। ঘূর্ণীর পারফরমেন্স নিশ্চয়ই তোর মনে আছে।

আজ দেখব ইমপ্রুভ করেছিস কিনা। চোখ নাচিয়ে বলল বৈদর্ভী।

মনে হয় করব। সহজ গলায় বলল কিঙ্কিনি।

বৈদর্ভী সিগারেটে শেষ টান দিয়ে অ্যাশট্রের মধ্যে গুঁজে দিল। হেসে বলল, তা হলে আর দেরি করে লাভ কী? তুই যেভাবে মার্ডারের প্ল্যান করছিস তাতে কখন গলা টিপে ধরবি তার ঠিক নেই।

কিঙ্কিনি সত্যি সত্যি এবার পায়ের নখ নিয়ে পড়ল। মাথাটা ঘুরছে। মাথা একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে বলল, তুই তো বাদ পড়ে গেছিস। বললাম না? আমার একজন যায় একজন। আসে। অথবা বলতে পারিস আমি নিজেই কনফিউজড হয়ে পড়ি। বুঝতে পারি না কাকে মারলে ঠিক হবে।

তোর নেশা হয়ে গেছে কিনি। তুই আর খাস না। শেষে সেদিনকার মতো কাণ্ড করবি।

কিঙ্কিনি বুঝতে পারল বৈদর্ভী ঠিকই বলছে। তার নেশা হয়ে গেছে। বেশ লাগছে। কেমন যেন নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে।

বুঝলি বৈদর্ভী, একটা বয়স পর্যন্ত খুনের জন্য অনেকগুলো নাম মাথায় ঘুরত। কখনও মনে হত, হাতের কাছে পেলে আমার আমেরিকা প্রবাসী মামাকে খুন করব। তার দিদির এতবড় একটা শোকের সময়ে সে একবারও আসেনি। শুনেছিলাম, মাকে নাকি বলেছিল, জামাইবাবু যখন চলে গেছেন তখন তাকে যেতে দাও। লেট হিম গো। এটা নিয়ে বেশি সময় নষ্ট কোরো না। ধরে নাও হি ইজ ডেড। ধরে নাও ইটস আ কেস অব ডিভোর্স। বরং আমি তোমাদের কিছু ডলার পাঠাচ্ছি ফর আ নিউ বিগিনিং। দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ভুলে নতুন করে শুরু কর। তারপর থেকেই মামাকে ঠিক কপালের মাঝখানে গুলি করে মারার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

বৈদর্ভী মেঝে থেকে উঠে পাশের সোফাটায় বসল। চোখ বড় করে বলল, মামাকে খুন করবি! বলিস কীরে কিঙ্কি!

কিঙ্কিনি হাসল। বলল, কিছুদিনের মধ্যেই মামাকে ক্ষমা করে দিলাম। দেখলাম আরও বড় ক্রিমিনাল আছে। তারা হল আমার জেঠা আর জেঠিমা। খুন যদি করতে হয় এদের করাই উচিত। ওরা বলে বেড়াত বাবার হারিয়ে যাওয়ার জন্য আমরাই নাকি দায়ী। দাদা একদিন জেঠুকে ফোন করেছিল। প্রচণ্ড ধমক দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছিলেন জেঠিমা। ভেবে দেখ বৈদর্ভী, ওইরকম ভয়ঙ্কর সময়ে…যাক এরাও আমার লিস্ট থেকে বাদ পড়ে গেল। এলেন অর্ধেন্দু দত্ত।

অর্ধেন্দু দত্ত! সেটা আবার কে?

বৈদর্ভী সবটা যে বুঝতে পারছে এমন নয়। কিন্তু না শুনে পারছেও না। বাবার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে কিঙ্কিনি কখনওই বন্ধুদের কাছে কিছু বলে না। যে পাঁচ-ছজন কাছাকাছির বন্ধু তারা এই প্রসঙ্গ তুলতে চায় না। কম্পিউটার ক্লাসে ভরতি হওয়ার পর অনীক একবার বলেছিল, কিঙ্কিনি, একটা কথা বলব কিছু মনে করবি না তো? অনীকের সঙ্গে সৌগত, সৌম্য শুভমও ছিল।

কিঙ্কিনি হেসে বলেছিল, তোরা যদি কিছু মনে না করিস আমি করব কেন?

 সৌগত বললে, শুনলাম তোর বাবা নাকি…।

কিঙ্কিনি সাইকেলে উঠতে উঠতে সহজভাবে বলেছিল, ঠিকই শুনেছিস। বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

সৌম্য ফট করে বলে বসল, কেন?

কিঙ্কিনি সাইকেলের ঘন্টিটা দুবার বাজিয়ে বলল, মানুষ কেন সংসার ছেড়ে চলে যায়। সে কি কেউ বলতে পারে রে? গৌতম বুদ্ধর কথাই ধর না, তিনিও তো স্ত্রী পুত্র রেখে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কেন কেউ কি জানে? ভাবছি আর কটা দিন অপেক্ষা করব, তারপর বাবার নামে গাছের তলায় একটা বেদি বানাব। বলব, আমাদের পিতা সংসার ত্যাগ করিয়াছিলেন এবং এই স্থানে আসিয়া মোক্ষ লাভের হেতু ধ্যান করিয়াছিলেন। তোরা মাঝেমাঝে বেদির কাছে গিয়ে হাতজোড় করে দাঁড়াবি। পারবি না? হি হি।

এরপর অনীকরা আর কখনও কিঙ্কিনির বাবা সম্পর্কিত কোনও প্রশ্নের মধ্যে যায়নি। কিঙ্কিনিও বলেনি। আজ বহুদিন পরে সে অনেক কথা বলছে।

অর্ধেন্দু দত্ত আমার হারিয়ে যাওয়া বাবার অফিসের কলিগ। ইউনিয়নের নেতা। অসহায় পরিবারকে সাহায্য এবং সহযোগিতা করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং মায়ের হাতটা খপ করে চেপে ধরলেন। চেপে ধরারই কথা। সেই সময় মায়ের হাত সুন্দর ছিল। বহুদিন পর্যন্ত উনি স্বাস্থ্য ধরে রেখেছিলেন। যাই হোক, সেই অর্ধেন্দু দত্ত বাড়িতে আসতে লাগলেন, গভীর রাতে ফোন করলেন, মা সেজেগুজে বেরোতে লাগল। বেশ লাটুস পুটুস চলতে লাগল। আমি সিওর, কেসটা আরও দূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আমি তো ভেবেছিলাম, একটা বাবা গেছে আর একটা বাবা এসে গেল। হি হি। ঠিক করলাম মা বিয়ে করলেই নতুন বাবাকে পেটে গুলি করে। মারব। যাক, সেও গেল। মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক কাটল। ও এর মধ্যে আরও একজনকেও মারবার। প্ল্যান করেছিলাম রে।

বৈদর্ভী বলল, সত্যি তোর মাথাটা আজ গেছে।

বৈদর্ভী হাত বাড়িয়ে শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে ফেলল। টান দিয়ে এগিয়ে গেল কিঙ্কিনির দিকে। কিঙ্কিনি নখের পরিচর্যা বন্ধ করেছে। মাথা যেভাবে টলটল করছে তাতে বকবকানি ছাড়া আর কিছু করা অসম্ভব।

একবার আমাদের বাড়িওলা লোকটা আমার সঙ্গে খুব খারাপ একটা কাজ করল।

কে? জানকীকাকু? সে কী! উনি তো ভালোমানুষ বলেই জানি। বৈদর্ভী অবাক হল।

মুখ ভরতি ধোঁয়া নিয়েই কিঙ্কিনি হাসল। বলল, আমরাও তাই জানতাম। ভালোমানুষ। হি হি। পছন্দও করতাম। একদিন মা আমাকে ভাড়া দিতে ওপরে পাঠাল। আগেও বহুবার গেছি। উনি বেশি কথা বলতেন না। বাবার কথা তো একেবারেই না। সেই কারণেই ভালো লাগত। সেদিন দরজা খোলার পর আমি ভেতরে ঢুকে খামটা দিতেই উনি ফট করে হাত বাড়িয়ে আমার বুকটা ধরলেন। ধরেই রাখলেন। ঘটনাটা আমার কাছে এত আকস্মিক ছিল যে আমি চিৎকার করতে পারিনি। ছুটে নেমে এসেছিলাম একতলায়। বাড়িতে কেউ ছিল না। দরজা আটকে থরথর করে কেঁপেছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে ভেবেছিলাম মাকে বলে দেব। পরে দেখলাম, একটা ভয়ঙ্কর। সমস্যার মধ্যে দুমড়েমুচড়ে পড়ে থাকা মাকে আরও একটা বিপদে ফেলা হবে। কোথায় বাড়ি খুঁজতে যাবে তখন? স্বামী-পালানো মহিলাকে কে-ই বা বাড়ি দেবে? তাই শুধু বলেছিলাম, উনি আমার বুকের দিকে তাকিয়েছেন। ঠিক করেছিলাম, কোনওদিন সুযোগ পেলে ওই লোকটাকে খুন করব। ওখানে গুলি করব। কোমরের নীচে। পরে সেটাও বদলে গেল। ঠিক করলাম, এই সব ছোটখাটো রাগ পুষে লাভ নেই। তার থেকে বরং মাকেই ফিনিশ করে দিই। দে শেষ টানটা আমি দিই।

বৈদর্ভী সিগারেটটা এগিয়ে বলল, ইটস টু মাচ কিনি। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এবার থাম।

সিগারেটে টান দিয়ে মুখ লাল করে অনেকটা কাশল কিঙ্কিনি।

বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই আমার ওপর মায়ের খুব রাগ। বকাঝকা মারধর লেগেই থাকত। তুচ্ছ সব কারণে বেদম মার খেতাম। আজও মনে আছে একদিন দুপুরে খেতে বসে বলেছিলাম, লাউ করেছ চিংড়ি দাওনি কেন? লাউয়ের সঙ্গে চিংড়ি সবথেকে ভালো যায়। যদি কই মাছ হত তা হলে ফুলকপির কথা বলতাম। মা সেদিন ডালের হাতা দিয়ে আমাকে খুব মেরেছিল। দুপুরে খেতে পর্যন্ত দেয়নি। বলেছিল, খাওয়া নিয়ে বায়না করলে গোটা দিন উপোস করিয়ে রাখব। আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি কী করেছি! বাবাই তো আমাদের এ সব বলত। বাজারের কম্বিনেশন শেখাত। গরম চায়ের কাপ হাতে খবরের কাগজ পড়েছিলাম বলে মা চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে ঠুকে দিয়েছিল। পরে মারধর বন্ধ হল কিন্তু মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভালো হয়নি। মায়ের রাগের কারণ প্রথমে বুঝতে পারতাম না। পরে পারলাম।

কী? অস্ফুটে বলল বৈদর্ভী।

আসলে একটা সময় পর্যন্ত আমি অনেকটাই বাবার মতো আচরণ করে ফেলতাম। বাবার মতো ভালো স্বভাব, বাবার মতো হাসিখুশি, বাবার মতো মজাদার। মা এটা নিতে পারত না। আমাকে মেরে বাবার ওপর রাগ ফলাত। আমি বোকা ছিলাম তাই ধরতে পারিনি, হি হি। আশ্চর্য না? যখন বুঝতে পারলাম, তখন ঠিক করলাম, খারাপ হয়ে যাব। বাজে মেয়ে। মদ খাব, গাঁজা খাব, রাত করে বাড়ি ফিরব, মেয়ে হয়ে মেয়ের সঙ্গে শোব। সেইসঙ্গে ওই মহিলাকেও মারব, আমার মাকে। মেরেই ফেলব। হি হি।

হাসতে লাগল কিঙ্কিনি। হাসতে হাসতে সোফার ওপর গড়িয়ে পড়ল। গড়াতে গড়াতে বলল, অ্যাই বৈদর্ভী এখান থেকে বেরিয়ে আমরা রেলগেটে যাব। ভাঙা মন্দিরের ঠেকে বসে ভদকা খাব। তুই শিবুকে খবর দে। শুনেছি জায়গাটা খারাপ। গিয়ে দেখব কত খারাপ হয়। শিবুকে এক্ষুনি খবর দে। হি হি।

বৈদর্ভী বলল, আচ্ছা সে দেব, আগে তুই হাসি থামা।

 কিঙ্কিনি হেসে যেতেই থাকে। বলল, উফ পারছি না, পারছি না রে থামাতে…হি হি..।

 বৈদর্ভীও হেসে উঠল বলল, বেটা গাঁজাখোর। দাঁড়া আমি তোর হাসি থামাচ্ছি।

গায়ের টি শার্টটা দ্রুত খুলে ফেলে দিয়ে বৈদর্ভী কিঙ্কিনির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পড়ে থমকে গেল। কিঙ্কিনি হাসছে কোথায়! তার দুটো চোখই যে ভেসে যাচ্ছে জলে! তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াল বৈদর্ভী। চোখ খুলে জল মুছতে মুছতে কিঙ্কিনি বলল, মাকেও শেষ পর্যন্ত লিস্ট থেকে বাদ দিয়েছি। বেচারি মা আমার, কী হবে তাকে খুন করে? তার কী দোষ? কোনও দোষ নেই। যদি মারতেই হয়, আসল কালপ্রিটকে মারতে হবে। তার জন্যই তো সব। সে-ই যত নষ্টের গোড়া। আসল কালপ্রিটকে চিনিস বৈদর্ভী? হি ইজি মাই ফাদার। আমার বাবা শ্রীদেবনাথ চট্টোপাধ্যায়। একটা রিভলভার পেলে, ঢিসুম।

হাতে গুলি করার ভঙ্গি করল কিঙ্কিনি। তারপর পাশ ফিরে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

.

রাত আটটা নাগাদ পুলিশ হানা দেয় রেলগেটের ভাঙা মন্দিরে। রুটিন রেইড। মাঝেমধ্যেই পুলিশ এটা করে। নেশাখোরদের ধরে থানায় নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে ছোটখাটো ছিঁচকে চোর, ছিনতাইবাজ, গুন্ডা মস্তানরাও থাকে। কোনও কোনও দিন এক-দুজন মহিলাকেও পাওয়া যায়। পুলিশ এলে তারা ব্লাউজের ভেতর থেকে মুঠো করে কোঁচকানো দশ টাকার নোট বের করে। হাতে গুঁজে রেললাইন দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় দ্রুত। অনেক সময় পুলিশ যাদের ধরে কটা লাঠির ঘা দিয়ে ছেড়ে দেয়। কখনও আবার একরাত লকআপে রেখে পরদিন সকালে কোর্টে চালান করে। আজকের রুটিন রেইডে কজন যুবকের সঙ্গে দুটি অল্পবয়সি মেয়েও ধরা পড়েছে। একবার তাকিয়েই পুলিশ বুঝতে পারে, এরা জামার ভেতর থেকে টাকা বের করে দেওয়ার মেয়ে নয়। অন্য কোনও গোলমাল রয়েছে। জটিল কিছু। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় অন্ধকার চাতালের একপাশে জড়ামড়ি করে পড়েছিল দুজনে। প্রায় জ্ঞান হারানো অবস্থা। তাদের টেনে হিঁচড়ে যখন ভ্যানে তোলা হচ্ছে, একটি মেয়ে জড়ানো গলায় বলল, দাদা, একটা রিভলভার হবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *