০৯.৪ ডায়রির পাতা (মার্চ)

২ মার্চ

আমি অবাক হয়ে যাই মানুষের ধর্মবিশ্বাস দেখে। মঙ্গলবার এরা মাছ মাংস খাবে না। হনুমানজির পুজো আছে। প্রত্যেকে পুজো করে। প্রত্যেকে ধর্ম বিশ্বাসী। সবারই হাতে লাল সুতো বাঁধা। শুধু ধর্মে নয়, যত রকম কুসংস্কার আছে, সবকিছুতে বিশ্বাসী। একজন ডাক্তার পেলাম না, যে ডাক্তার ধর্মের কথা বলে না। প্রতিটি ডাক্তারই, ছোট বা বড়, ভগবান যে আমার শরীরটা বানিয়েছেন, ভগবান যে অসুখ দিয়েছেন এবং ভগবানই যে অসুখটা সারাবেন তা বেশ জোর দিয়েই বললেন। আমি থ হয়ে বসে থাকি। শিক্ষিত অশিক্ষিত, নারী পুরুষ, গরিব ধনী নির্বিশেষে এই দেশে প্রায় সবাই ধর্মবিশ্বাসী।

এত ধর্ম বিশ্বাস, এত ধর্ম পালন, এত উপোষ, এত সংস্কার, এত লাল সুতো আমি আর কোনো দেশে দেখিনি। বাংলাদেশেও দেখিনি। ভারতকে যখন পশ্চিমের দেশ বলে ধর্মের দেশ, আমি আপত্তি করতাম, সেইসব পুরোনো নাস্তিকদের কথা, লোকায়ত দর্শনের কথা আওড়াতাম। কোথায় সেসব, চিহ্নমাত্র নেই। নাস্তিকের সংখ্যা সত্যি বলতে কী, হাতে গোনা। কুসংস্কারে, জ্যোতিষীতে, ধর্মান্ধতায় ঠাসা এ দেশ। সেনানিবাসে একটি মন্দির আছে, সারাদিন সারারাত মন্দিরটিতে গান বাজে। যত মানুষ বাস করে এই সেনানিবাসে, সেনা বা অ-সেনা এক আমি ছাড়া, সবাই আস্তিক। গা ছমছম করে ভাবলে।

সেনানিবাসের গেটের কাছে ছোট একটা ঘর আছে, ওই ঘরের বাইরে বড় করে লেখা আছে –‘এক বার খেলে তুমি যোগী, দুইবার খেলে তুমি ভোগী, তিনবার খেলে তুমি লোভী, আর চারবার খেলে তোমার এক পা অলরেডি কবরে। কী ভুল এসব তথ্য। আমি হাঁহয়ে থাকি। এই ভগবানের দেশকে শোধরানোর কোনো উপায় আমার নেই।

আমার তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়, সেই নারী পুরুষের সঙ্গে যারা ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক, ধর্ম আর কুসংস্কারে ঠাসা। মানুষগুলোর সঙ্গে প্রতিদিন আমাকে বাক্য বিনিময় করতে হয়। এরাই আমার সঙ্গী। আমার পছন্দের সঙ্গী নির্বাচন করার কোনো অধিকার আমার নেই।

৩ মার্চ

বন্ধু অনেক হারিয়েছি এর মধ্যে। কেউ কেউ আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখাকে রাজনৈতিক ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেছে। আবার বন্ধু দু’একজন জুটেছে, নতুন বন্ধু। কিন্তু কদিন কোন বন্ধুত্ব টেকে তা কে বলবে! কেয়া নামের এক মেয়ে পাটনা থেকে প্রতি রাতে ফোন করে, দীর্ঘক্ষণ কথা বলে। পাগলের মতো আমার বই পড়ে, ভালোবাসে। সুমিত চক্রবর্তী খবর নেন নিয়মিত। কেমন আছি জানতে ফোন করেন আরও-কিছু-নাম-ভুলে-গেছি-স্ত্রী-পুরুষ। দীপ্তেশ নামের এক সাংবাদিক, সেও খবর নেয়। ওকেই দিতে বলেছিলাম বাঙালি কোনও কার্ডিওলোজিস্টের নাম দিয়েও ছিল। সেই ডাঃ তরুণ বাগচির সঙ্গে কথাও হয়েছিলো ক’দিন। হঠাৎ একদিন তিনি আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন, কোনওদিন আর ফোন ওঠাননি। প্রভুকে বলেছিলাম, ডাক্তার তরুণ বাগচির সঙ্গে দেখা করতে চাই। নাকচ হয়ে যায় আমার প্রস্তাব। প্রভু বলেছেন, ওই সরকারি ডাক্তারের সঙ্গেই শলা পরামর্শ করতে হবে। অন্য কোনও ডাক্তার চলবে না। দীপ্তেশকেও ফোনে পাওয়া যায় না। হঠাৎ করে। একদিন ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কী, এড়িয়ে চলছে নাকি। দীপ্তেশ চুপ থেকে কিছুক্ষণ, বললো, আর বলবেন না, ভয়ংকর অবস্থা চলছে, আমাকে খুঁজতে তো পুলিশ এসেছিলো অফিসে, আমি কে, কী করি, নাড়ি নক্ষত্র।

–কেন?

–ডাক্তারের নাম আপনাকে দিয়েছি বলে।

–ডাক্তার বাগচি?

–হ্যাঁ।

–ডাক্তার তো ফোন ধরছেন না। কয়েকদিন ধরে করেই যাচ্ছি।

–উনি আর কথা বলবেন না। ভীষণ ভয় পেয়েছেন। ওর চেম্বারেও পুলিশ গিয়ে থ্রেট করে এসেছে।

–ডাক্তারবাবু আর কথা বলবেন না? আশ্চর্য। এসব কি সত্যি বলছো তুমি? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না পুলিশ গিয়ে কোনো ইনোসেন্ট ডাক্তারকে থ্রেট করবে ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছে বলে! আনবিলিভবল।

–আমি আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সব পাল্টে ফেলেছি।

–কেন?

–সরকারি নজর আমার ওপর। ভয়ংকর অবস্থা।

–এত ভয় পেও না দীপ্তেশ।

এইমসএর যে ডাক্তার আমাকে দেখেছেন, ডাক্তার বেহাল, একদিন দীপ্তেশ বললো, তার নিজের ডাক্তার। ডাক্তার বেহালের মোবাইল নম্বর চেয়েছিলাম দীপ্তেশের কাছে। সরাসরি কথা বলতে। রক্তচাপএর অদ্ভুত ওঠানামা নিয়ে একটু আলোচনা করতে। যেহেতু তিনি হাসপাতালে রেখে আমার রক্তচাপ স্থির করে দেননি, তাই তাঁর সঙ্গে জরুরি অবস্থায় কথা বলা জরুরি। ডাক্তার বেহালের নম্বর অনেক চেয়েও প্রভুর কাছ থেকে পাইনি। প্রভু আমার কাছে প্রশ্ন শুনে ডাক্তার বেহালকে জানাতেন, তার থেকে উত্তর প্রভু আমাকে জানাতেন ডাক্তার বেহাল কী বলেছেন। ডাক্তার বেহালের ডিপার্টমেন্টে ঘোট ঘোট যে ডাক্তার আছেন, তাদের সঙ্গেও সরাসরি কথা বলতে আমাকে প্রভু দেননি। কোনও প্রশ্ন থাকলে যেন অফিসারদের বলি, অফিসাররা ওই ডাক্তারদের কাছ থেকে জেনে আমাকে বলবে। আমি যদি নিজে ডাক্তার না হতাম, এই ব্যবস্থাটা আমাকে পীড়া দিত না। দিয়েছে কারণ একজন ডাক্তারের সঙ্গে সরাসরি ডাক্তারি ভাষায় কথা না বলে বলতে হচ্ছে একজন অ-ডাক্তারের মাধ্যমে। দীপ্তেশ ডাক্তার বেহালের নম্বর আমাকে দিতে পারেনি, কারণ ডাক্তার বেহাল বলেছেন না দিতে। বলেছেন, চাকরিটা তিনি খোয়াতে চান না। আশ্চর্য, আমি তাঁর রোগী, তিনি চান না আমার সঙ্গে কথা বলতে?

দীপ্তেশ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো, না।

দীপ্তেশের কথাগুলো আজগুবি শোনায়। পুলিশ, ওর অফিস, ডাক্তারের চেম্বার, ফোন নম্বর –সব কিছু দীপ্তেশ কি বানিয়ে বলছে! বানিয়ে কেন বলবে, কী স্বার্থ তার! সে কি আর চাইছে না আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে! একজন সাংবাদিক, যে আমার লেখা খুব পছন্দ করে, যে করেই হোক চাইবে আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে, ভাঙতে চাইবে কেন? তাহলে কি তাকে কেউ বলেছে যেন সব বন্ধ করে দেয়, সব যোগাযোগ! কে বলবে, সরকার। সরকারেরই বা স্বার্থ কী! আমি বুঝে পাই না এসবের কিছু।

১০ মার্চ

কলকাতা থেকে তপন রায় চৌধুরী এলেন। এ নিয়ে দুবার আসা। যখন দেখা করলেন, ভ’র পক্ষে সওয়াল করেননি অত। দ্বিতীয়বার এই কারণেই এসেছেন আমাকে কয়েকঘণ্টা ধরে বোঝাতে, যেন আমি দেশ ছাড়ি। অনেকক্ষণ কেবল ভ’রই প্রশংসা করলেন। ভ হচ্ছেন মহামানুষ। উনি কেন ছোটখাটো পুরস্কার পাবেন। উনার ভারতরত্ন পাওয়া উচিত।

তিক্ত বিরক্ত স্বরে বললেন, তোমার চলে যাওয়া উচিত। কেন তুমি এ দেশ ছাড়ছে? ইওরোপ বা আমেরিকায় বসে নিশ্চন্তে নিজের লেখালেখি করো। আর তা ছাড়া..

–তা ছাড়া কী?

–এদেশে তোমার থ্রেট আছে।

–কী করে জানেন যে থ্রেট আছে?

–রাজ্যপাল বলেছেন যে থ্রেট আছে। আমি বলেছি, থ্রেট তো আছেই। থ্রেট নিয়েই তো পনেরো কুড়ি বছর বেঁচে আছি। থ্রেট পৃথিবীর কোথায় নেই? মুসলিম মৌলবাদীরা পৃথিবীর কোন জায়গায় নেই বলুন তো! কাজ হাসিল করতে ওরা কোথায় বা না যেতে পারে?

আমি কোথায় যাবো, কোন দেশে আমাকে যেতে বলা হচ্ছে। যে কোনো দেশে। এ দেশ থেকে বেরোই, সেটাই আসল কথা। এর পর আমি মরি বা বাঁচি তাতে কারওর কিছু যায় আসে না। না, কারওর না।

তপন রায় চৌধুরী বললেন, সিপিএম ক্যাডাররা পছন্দ না হলে গায়েব করে দেয় লোকদের।

–মানে?

–মানে মেরে ফেলে। ইঙ্গিত দিলেন, শুধু মৌলবাদী নয়, ক্যাডাররাও আমাকে মেরে ফেলতে পারে।

কয়েক ঘণ্টা কথোপকথনের পরও যখন তিনি দেখলেন, আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল, আমি দেশ ছাড়বো না, কারণ দেশ ছাড়ার পক্ষে যত যুক্তিই তিনি দেখাচ্ছেন, আমি মানছি না, তখন তিনি ক্রুদ্ধ স্বরেই কথা বললেন আমার সঙ্গে। তাঁকে আর চেনা যায় না তখন। মনে হয় না আমার তিনি দীর্ঘকালের চেনা। আমাকে স্নেহ করেন তিনি। ভালোবাসেন তিনি।

মানুষ দেখলে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কতটুকু তার মুখ আর কতটা মুখোশ!

বিকেলে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল তার জন্য। সোজা তিনি বিমান বন্দরে যাবেন কিন্তু আগে কেন বললেন, যে ভ’বাবুর সঙ্গে দেখা করে তারপর যাবেন বিমান বন্দরে! তা তো নিশ্চয়ই তিনি করছেন না। কেন বললেন, দুদিন আগে এসেছেন দিল্লিতে। তার সঙ্গে তো

কোনো লাগেজ ব্যাগেজ নেই। ভুল করে বলেও ফেলেছিলেন যে আজ প্লেনে বসে পত্রিকা পড়েছেন তিনি, কলকাতার পত্রিকা। কলকাতা থেকেই তাহলে সেদিন সকালেই তিনি রওনা হয়েছেন। দেশের একজন বিশাল ব্যক্তি আরেক বিশাল ব্যক্তির কাছ থেকে রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে সাহায্য চেয়েছেন। একটা আদেশ নির্দেশ না মানা মেয়েকে আদেশ মানতে বাধ্য করতে।

আমার চারপাশের মানুষগুলোকে আমি চিনতে পারি না।

১১ মার্চ

এই সনাতন সেনগুপ্তই একদিন মদনজিৎ সিংকে লেখা আমার একটি চিঠির কপি আমাকে দেখিয়ে কী ভীষণ দুর্ব্যবহারই না করেছিলেন। বলেছিলেন, এইসব কী ছড়াচ্ছেন আপনি সারা পৃথিবীতে? যে সরকার আপনাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে, সেই সরকারের বিরুদ্ধে বলে বেড়াচ্ছেন? আপনি জানেন কী অন্যায় আপনি করছেন, কী শাস্তি আপনার হতে পারে? এইসব বন্ধ করুন। আমি বলেছিলাম, সরকারের বিরুদ্ধে আমি কোনও কথা লিখিনি। আমি শুধু আমার অবস্থার কথা লিখেছি। সনাতন সেনগুপ্ত চেঁচিয়েই যাচ্ছিলেন। একটা সময় তাকে মনে হচ্ছিল মেশিন বুঝি। ঘাড়ের কাছে কোথাও সুইচ আছে অন/অফ করার। কেউ সুইচটাকে অন করে দিয়েছে। একই বাক্য, শব্দ বারবার আওড়াচ্ছিলেন।

মন্ত্রণালয়ে আমি লিখিত অনুরোধ করেছিলাম, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ বাড়ানোর পর, যে, আমাকে কিছুটা অন্তত স্বাধীনতা দেওয়া হোক, এই দিল্লিতেই নিজের মতো করে থাকার অধিকার, যতদিন কলকাতায় ফিরে যেতে না পারছি। দেহরক্ষী যদি থাকে থাকবে, কলকাতায় যেমন ছিল। আমি কোথায় যাবো না যাবো, কার সঙ্গে দেখা করবো না করবো, আমার সিদ্ধান্ত। এর উত্তর সনাতন সেনগুপ্ত আমাকে জানিয়েছিলেন, গম্ভীর গলায় একদিন স্ট্যাটাস কুও।

–মানে?

–মানে যেমন আছেন, তেমন থাকতে হবে।

–কোনও পরিবর্তন নেই?

–না।

–কতদিন এভাবে?

–অনির্দিষ্টকালের জন্য।

একটা জিনিস আমার মনে হয়, সচিবরা মন্ত্রীদের আদেশ পালন করেন বটে, তবে মন্ত্রীদের সব কাজকেই তারা পছন্দ করেন না। করলে সনাতন সেনগুপ্ত বলতেন না, যে, যা-ই হোক, যা কিছুই ঘটুক, যা কিছুই বলি আপনাকে, সচিব সনাতন সেনগুপ্ত হয়ে নয়, আজ মানুষ সনাতন সেনগুপ্ত আপনাকে বলছি, আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আপনাকে নিয়ে গর্ব হয় আমার। আপনার সততা আর সাহসের সামনে, আপনার ব্যক্তিত্বের সামনে ক’জন দাঁড়াতে পারবে? আপনি আমার স্যালুট নিন।

১২ মার্চ

নানাভাবে কায়দা করে এটা অন্তত বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, এ দেশে থাকতে হলে এভাবেই বন্দি জীবন আমাকে যাপন করতে হবে। এরকমই বন্দি, আমি কোথাও বেরোতে পারবো না, কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। আমার কোনো সামাজিক জীবন থাকবে না। আমাকে একটা ঘরে পুরোপুরি বন্দি থাকতে হবে। যদি ডাক্তার দেখানোর খুব প্রয়োজন পড়ে, সেটার ব্যবস্থা সরকার করবে। এবং এই জীবন পছন্দ না হলে, বলে দিয়েছেন, নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে।

আমাকে নাকি যে জায়গাটায় আমি আছি, তার থেকে সরানো হবে। সরিয়ে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, তা বলা হয়নি। কোনো গুহায়। বা কোনো নির্জন পাহাড়ে। আমার ফোন নেট কেড়ে নেওয়া হবে কি? হতে পারে। আমি এখন সরকারের হেফাজতে অথবা হাতের মুঠোয়। আমাকে নিয়ে তারা যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু কতদিন এইভাবে আমি বাঁচতে পারবো। মানুষ কি এইভাবে পারে! কেউ পারে! রাজনীতিকরা হয়তো পারেন। আমি রাজনীতির সাতেপাঁচে নেই, দেশের ক্ষমতা নিয়ে আমি দুশ্চিন্তা করছি না কোনও। স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছি জীবন ভর, আজ আমার জীবনটিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনও স্বাধীনতা আমার নেই। আজ দীর্ঘ সাতমাস যাবৎ সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বুঝি, টের পাই, অনুভব করি, যে, দেশটিতে বাস করা শেষ অবদি আমার আর সম্ভব হবে না। কেন আমি অপেক্ষা করছি কোনোদিন ক্ষমতাবানদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে? শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে আঁচ করা যায়। কিছুই তো আঁচ করতে পারি না। আমাকে এভাবে একটা ঘরের মধ্যে ফেলে রাখতে, এভাবে শেকলে বেঁধে রাখতে কারও তো কোনো অসুবিধে নেই। অসুবিধে আমার। আমার অসুবিধে যেন হয়, তা অনেকে মনে প্রাণে চাইছে। বাইরের মানুষ নানারকম ভেবে নিচ্ছে। ভেবে নিচ্ছে যে হয়তো নিরাপত্তার জন্য এভাবেই ঘরবন্দি করতে হয়। কজন মানুষের মনে প্রশ্নের উদয় হয়, কার সময় আছে প্রশ্ন। করার? যদি সময় থাকেই, ক’জনের সাহস আছে চ্যালেঞ্জ করার।

আমি একা হয়ে যাচ্ছি। বাইরে যে আন্দোলন প্রতিবাদ হচ্ছিল, সব স্তিমিত হয়ে গেছে। যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। এই এত বড় পৃথিবী, আমি এই পৃথিবীর সন্তান। একটু পছন্দের জায়গায় যে কটা বছর বেঁচে থাকবো নিজের মতো করে, মানুষের সেবা করে, মানুষের উপকার করে, সে অধিকার নেই আমার।

ওদিক থেকে পশ্চিম থেকে আমাকে ডাকা হচ্ছে। আমি যাচ্ছি না। ওসব দেশে বাস করার কথা ভাবলে আমার গায়ে জ্বর চলে আসে। ওদিকে গণতন্ত্র, ওদিকে বাক স্বাধীনতা, ওদিকে মুক্তবুদ্ধি, মানবাধিকার, ওদিকে সুস্থতা, সমতা, ওদিকে নিশ্চিতি, নিরাপত্তা, ওদিকে যুক্তিবাদ, ওদিকে জীবন। এদিকে দারিদ্র, এদিকে দূষণ, দুঃশাসন, এদিকে সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা, পরাধীনতা, এদিকে নির্যাতন, এদিকে ধর্মান্ধতা, জড়বুদ্ধি। এদিকে বৈষম্য, এদিকে আতংক, অনিশ্চয়তা, মৃত্যু।

আমি কোনদিকে যাবো? জগৎ বলছে ওদিকে যাও, বাঁচো। ওদিকে সহমর্মিতা, স্বর্ণপদক, এদিকে অবজ্ঞা, এদিকে অপমান।

আমি এদিকটাকেই বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু এদিকের রাজনীতির কাছে আমার স্বপ্ন পরাজিত হল।

১৩ মার্চ

অনেকদিন হল। সাত মাস। চার মাস গৃহবন্দি ছিলাম কলকাতায়। তিন মাস এই দিল্লিতে। যখন কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, নভেম্বরের ২২ তারিখে, গিয়ে পড়লাম জয়পুরে, আর জয়পুর থেকে তাড়ানো হল ২৩ নভেম্বরে। যে অচ্ছুৎকে কোনও রাজ্য আর নিচ্ছে না, তাকে কেন্দ্র নিল। ভেবেছিলাম ভালোবেসে নিয়েছে বুঝি। ভ যখন ফোনে বলেছিলেন কাপড়চোপড় কিনে দেবে, বই টই নিয়ে নিন, কী রকম যেন পিতার কণ্ঠস্বর বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু কাপড়চোপড়, বইপত্রেরই বা দরকার কেন, বুঝে পাইনি। সোজা কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন, তা নয়তো, ঝামেলা করছেন কেন। ঝামেলা কেন করেছিলেন, তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। রাজনীতিকদের রাজনীতি বুঝতে বুঝতে আমার প্রায় তিনমাস সময় নিল। সম্ভবত তুলনায় কমই সময় নিয়েছে আমার অপরিপক মস্তিষ্ক। অবশ্য আমার মস্তিষ্ক যে সব কিছু ধরতে পেরেছে তা নয়, অন্যের মস্তিষ্ক যেসব রাজনীতি বোঝে ভালো, তারা আমার ঢের আগে ধরেছে। তারা সোজা বলেছে, তোমাকে এভাবে রাখা হয়েছে, যেন তুমি, অতিষ্ঠ হয়ে একদিন দেশ ছেড়ে চলে যাও।

সুয়েনস এলো সুইডেন থেকে, ওকে আমার সঙ্গে থাকতে দিল না, দেখাও খুব একটা করতে দেয়নি। তারপরও ওর সঙ্গে দেখা করতে দেবার পেছনে হয়তো উদ্দেশ্য ছিল। সুয়েনসন নিশ্চয়ই আমার প্রেমিক, আমার এই হাল দেখে, নিশ্চয়ই বলবে এ দেশ ছাড়তে। উদ্দেশ্য সফল হয়নি, সুয়েনসন আমাকে বরং উল্টো বুঝিয়েছে। দ্বিতীয় যে বন্ধুকে দেখা করতে দিয়েছিল, সে অশেষ সান্যাল। অশেষ কলকাতা থেকে আমার কিছু জিনিস সুটকেসে করে নিয়ে এসেছিল, তাই অশেষকে দেওয়া হয়েছে দেখা করতে। সুটকেসের ঘটনা না থাকলে দেখা করতে দেওয়া হত না। আর্জি জানিয়ে রাখতে হয়েছিল অনেক আগে। সুয়েনসনের বেলায় তো লিখিত চিঠি পাঠাতে হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ভ’কে ফোনেও বলেছিলাম যে আমার এক বিদেশি বন্ধু আসছে, আমার কাছে থাকবে কদিন। উনি নাম লিখে নিলেন বন্ধুর। কিন্তু ওকে আমার কাছে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই দু’জন ছাড়া আর যাদের সঙ্গে দেখা করানো হয়েছে, তা তাদের লোক। এম এ বেবি। সিপিএমের লোক। তপন রায় চৌধুরী। ভ’ বাবু পাঠিয়েছেন। আমাকে দেশ ছাড়ার জন্য বোঝাতে। দু দুবার এসেছেন তপন রায় চৌধুরী। প্রথমবার যখন এলেন, তখন মনে হয়েছিল বুঝি ভালোবেসে এসেছেন। তিনি যে ভ’বাবুর পাঠানো দূত, তা দ্বিতীয়বার আসার পর বুঝেছি। খুব আহত হয়েছি। এত ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, আর তিনি কিনা আমাকে বলতে এসেছেন, যেন দেশ ছাড়ি। বাক স্বাধীনতা নিয়ে, নির্যাতিত লেখকের অধিকার নিয়ে নিজে লেখক হয়েও, বুদ্ধিজীবী হয়েও ভাবলেন না কিছু! কিছু কিছু জিনিস যে কী অসম্ভব। বিশ্বাস হতে চায় না। ওদিকে এনামুল কবীর নামের এক দীর্ঘদিনের বন্ধুও দেখি ব্যবহার অন্যরকম করছেন। পুরো পাল্টে গেছেন। তাঁকে বুদ্ধবাবু বলেছেন আমাকে বোঝাতে, যেন চলে যাই এ দেশ ছেড়ে। যে ক’জন ছিলেন সঙ্গে, যাঁদের থাকার কথা ছিল পাশে, তাঁরাও ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন।

এই তিন মাস ধরে এক অজ্ঞাতবাসে আমাকে রাখা হয়েছে। আমার ইচ্ছে অনুযায়ী আমাকে এক পা কোথাও বেরোতে দেওয়া হয় না। আমাকে কারও সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় না। কী কারণ এর? একটিই কারণ, আমাকে শাস্তি দেওয়া। আমাকে কষ্ট দেওয়া। আমাকে বোঝানো যে তোমাকে আমরা চাইনা। মানুষ কী করে বাঁচবে সমাজ ছাড়া। কী করে বাঁচবে বন্ধু ছাড়া। কী করে স্বাধীনতাহীনতায়, কতদিন! একদিন না একদিন আমি তো অতিষ্ঠ হবই। একদিন তো আমি বলবোই আমি আর পারছি না। আমাকে তালাবন্ধ করে রাখতে কারও তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না, হবেও না। হবে আমার। আমি তো মানুষ। কোনও অপরাধ না করে কতদিন এই কঠোর কঠিন শাস্তি মাথা পেতে নেব আমি! আমাকে এভাবে বছরের পর বছর রেখে দিতে সরকারের কোনও অসুবিধে নেই। বাইরে দু’একটা লোক প্রতিবাদ করবে। কিন্তু কতদিনই বা প্রতিবাদ করবে! লেখালেখি এর মধ্যেই অনেক কমে গেছে। টেলিভিশনের শিরোনাম থেকে খসে গেছে বিষয়টি। এখন আলোচনা অন্য কিছু নিয়ে হচ্ছে। তসলিমা কোথায় আছে কেউ জানে না। কোথাও হয়তো আছে। সরকারের হেফাজতে খুব কি আর খারাপ থাকবে?

সরকারের হেফাজতে কেমন থাকা যায়, তা হেফাজতে যতদিন না থাকার অভিজ্ঞতা হয়, ততদিন বোঝা যাবে না, বোঝানোও যাবে না। সরকার যখন তোমাকে হেফাজতে রাখে দেশের সীমান্ত পার করার জন্য, তখন সেই হেফাজতটি খুব ভয়ংকর হয়। প্রতি মুহূর্তে বুলডোজার চলতে থাকে মনের ওপর। মনকে ভেঙে গুঁড়ো করে দেওয়ার সব আয়োজন রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতের মুঠোয়।

এখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, আমাকে তাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে অনেকে। আমাকে ভীষণ আতংকের মধ্যে রাখার ভীষণই চেষ্টা চলছে। রেসিডেন্স পারমিট এর মেয়াদ বাড়ানোর আগেই যেন দেশ ছাড়ি, তার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি এলেন এ দেশে, আসার আগে সারকোজির দল থেকে সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কারটি আমার হাতে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। যেই না ইচ্ছে প্রকাশ, অমনি জানিয়ে দেওয়া হল, অসম্ভব, ওকে ভারতের মাটিতে তো পুরস্কার দিতে পারবে না। যে দেশের মানুষ পুরস্কার পাচ্ছে, এবং যারা দিচ্ছে পুরস্কার, তাদের দেশে পুরস্কার অনুষ্ঠান করো। হয় বাংলাদেশে যাও, নয়তো ফ্রান্সে যাও। ফরাসি সরকার মাথা পেতে মেনে নিলেন ভারতের প্রস্তাব। আমাকে ফ্রান্সে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। আমন্ত্রণ জানানোর আগে একবার ফরাসি দেশের মতো বিরাট দেশের সরকার এইটুকু বুঝতে পারলেন না যে, নিরাপত্তার যে কারণটা দেখানো হচ্ছে, তা মিথ্যে। হয়তো বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু আমার পক্ষে লড়ার চেয়ে জরুরি ভারতের মতো বিরাট দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করা। আমার বিবৃতি দিতে হল, যে, পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান প্যারিসে হয়ে গেছে অনেক আগেই, ৯ জানুয়ারি, প্যারিসে। আমার ফরাসি প্রকাশক সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে আমার পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। আমার বক্তৃতাও পড়ে দিয়েছেন। পুরস্কারের মানপত্রটি আমার প্রকাশকের কাছ থেকে আনার জন্য আমার ভারত থেকে প্যারিসে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। আমার প্রকাশক দিব্যি কুরিয়ার করে দিতে পারেন সেটি আমার কলকাতার ঠিকানায়। আমাকে তাড়ানোর জন্য সত্যিই মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার।

১৪ মার্চ

কোথায় আছি? এই প্রশ্নের উত্তর, আমার বিশ্বাস, কেউ বিশ্বাস করবে না যে, আমি জানি না। না বিশ্বাস করলেও এটা ঠিক যে, আমি জানি না। আমি কেমন আছি-র উত্তরও আমার কাছে ওই একই, জানি না। মাঝে মাঝে টের পাই না নিজের অস্তিত্ব। বেঁচে আছি নাকি মরে আছি, বুঝি না। আমার ভেতরের আমিটিকে এখন আমি আর স্পর্শ করতে পারি না। একটা অনুভূতিহীন জড়বস্তুর মতো, একটা প্রায় মৃত মানুষের মতো পড়ে থাকি। সারাদিন একটা ঘরে। সারারাত একটা ঘরে। মৃত্যু এসে প্রায়ই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। কাঁধে হাত রাখে। হ্যাঁ এইরকম ভাবে আজকাল আমি বেঁচে আছি। এর শুরু হঠাৎ সেদিন, কলকাতা থেকে আমাকে উৎখাতের পর নয়, দীর্ঘদিন ধরে, একটু একটু করে আমাকে পান করানো হচ্ছে বিষ, ভেতরে আলগোছে জলজ্যান্ত মৃত্যুকে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার ভেতরের আমিটিকে, সাহসী, প্রত্যয়ী, আপোসহীন, দুরন্ত, দুর্বিনীত আমিটিকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমি টের পাচ্ছি, কিন্তু সমস্ত শক্তি দিয়েও আমি ক্ষমতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে পারি না। আমি নিজে লোকবলহীন একটি কণ্ঠস্বর শুধু। আমার পাশে যারাদাঁড়ায়, অন্ধকার ঘনিয়ে এলে তাদের মুখ আর দেখা যায় না।

নিজেকে জিজ্ঞেস করছি, কী অপরাধ আমি করেছি? কেন আজ আমি এখানে, যেখানে আমি। এটা কি কোনও জীবন হল? আমি চৌকাঠ ডিঙোতে পারবো না, এবং কেউই আমার নাগাল পাবে না! কী অপরাধ আমি করেছি যে আমাকে লোকচক্ষুর আড়ালে জীবন কাটাতে হচ্ছে, থাকতে হচ্ছে অন্তরীণ! কী অপরাধের শাস্তি আমাকে দিচ্ছে এই সমাজ, এই দেশ, এই জগৎ! নিজের মনের কথা লিখেছিলাম, নিজের বিশ্বাসের কথা লিখেছিলাম কাগজে। কাগজেই লিখেছিলাম, কারও গায়ে পাথর ছুঁড়ে কিছু বলিনি, কারও মুন্ডু কেটেও কিছু কোনওদিন লিখিনি। কিন্তু তারপরও আমি অপরাধী। আমার নিজের মত অনেকের মতের চেয়ে ভিন্ন ছিল বলে আমাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। একটা যুগ ছিল, রাজার অবাধ্য হলে শূলে চড়ানো হত। দেশসুদ্ধ লোক দেখতো, শূলে চড়া মানুষটির কষ্ট। আমাকেও তো অনেকটা নতুন যুগের শূলে চড়ানো হল। দেশসুদ্ধ লোক কি দেখছে না আমার যন্ত্রণা? যেখছে না কী ভয়াবহ যন্ত্রণা হলে, নিজের ভেতরে নিজের মৃত্যু কতটা হলে, আশাভঙ্গ আর হতাশা কতটা চরম হলে, কতটা ভয়ংকর হলে নিজের বিশ্বাসের কথা মানুষ ফিরিয়ে নেয়, নিতে পারে! কতটা অপমানিত হলে, কতটা ব্রাত্য হলে, কতটা পিষ্ট হলে, কতটা রক্তাক্ত হলে আমি বলতে পেরেছি, আমার ওই বাক্যগুলো তোমরা বাদ দিয়ে দাও, বাদ দিয়ে যদি তোমাদের আরাম হয় হোক, বাদ না দিলে তোমরা কেউই আমাকে বাঁচতে দেবে না জানি, তোমাদের রাজনীতি, তোমাদের ধর্ম, তোমাদের হিংস্রতা, তোমাদের বীভৎসতা নারকীয় উল্লাসে আমার রক্ত পান করবে, করতেই থাকবে যতক্ষণ না শেষ বিন্দু রক্ত আমার শেষ হয়। উড়িয়ে দাও ওই নিষিদ্ধ শব্দগুলো, উড়িয়ে দাও থোকা থোকা সত্য। শব্দ তো নিতান্তই নিরীহ। সত্য তো নিরস্ত্র। মসি চিরকালই হেরে গেছে অসির কাছে। চারদিকে অসির আস্ফালন। আমার মতো সামান্য মানুষ তাবড় তাবড় শক্তির বিরুদ্ধে কী করে পেরে উঠবো! আমি তো অসত্য জানি না।

আমার শুধু সম্বল ভালোবাসা। মানুষের জন্য ভালোবাসা। ভালোবেসে চেয়েছি মানুষ দীপ্ত হোক, দৃপ্ত হোক। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তোক শ্রদ্ধার স্নেহের। ঘৃণা উবে যাক। যেভাবে ঘৃণা করে মানুষ আমার শব্দ বাক্য উড়িয়ে দিতে চায়, তেমন চেয়েছি মানুষকে ভালোবেসে বেসে মানুষের ভেতরের ঘৃণাকে উড়িয়ে দিতে। সম্ভবত অবিশ্বাস, ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা, নিষ্পেষণ, নিপীড়ন এসব না থাকলে জগৎ চলবে না। জগৎকে চলতে দিতে হবে, নিজের যাত্রাভঙ্গ করেও। আমি তো অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ এক প্রাণী। এমন এক প্রাণীকে জগৎ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিলে জগতের কিছু যাবে আসবে না। সেটা জানি। ভেবেছিলাম বাংলার বুঝি যাবে আসবে। বাংলা বুঝি ঘুরে দাঁড়াবে। যে বাংলাকে এত ভালোবাসি, সেই বাংলাও মুখ ঘুরিয়ে নিল।

ওপার বাংলা থেকে নির্বাসনদন্ড পেয়ে পৃথিবীর পথে পথে অনাথের মতো ঘুরেছি অনেক বছর। যেই না এপার বাংলায় ঠাঁই পেলাম, দীর্ঘ বছরের অপেক্ষার ক্লান্তি ঝেড়ে শান্তিতে স্বস্তিতে আমার জন্ম জন্ম চেনা বাংলায় জীবন শুরু করলাম, যতদিন বেঁচে থাকি বাংলার নদীমাঠক্ষেতে ঘুরে, বাংলার রোদেজলে ভিজে, বাংলার রূপরসগন্ধে লীন হব। যে বাংলায় পৌঁছোবো বলে হাজার বছর ধরে অমসৃণ পথে হেঁটে হেঁটে নিজেকে রক্তাক্ত করেছি, সেই বাংলা মুখ ঘুরিয়ে নিল। এ কথা আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে বাংলায় আমার ঠাই নেই। বাংলার মেয়ের, যার বাহিরে অন্তরে কেবলই বাংলা, বাংলা ভাষা বাংলা সংস্কৃতি যার প্রাণ, তার ঠাই নেই বাংলায়।

এই দেশের অতিথি আমি, আমার সংযত হয়ে কথা বলতে হবে। আমি কারও অনুভূতিতে আঘাত দিতে এ দেশে আসিনি। সম্ভবত আমি আঘাত পেতে এসেছি। নিজের দেশে আঘাত পেয়েছি, অন্য যে সব দেশে বাস করেছি, আঘাত পেতে পেতে শেষ সম্বল এই ভারতবর্ষে এসেছি আঘাত পেতেই। তারপরও আপনারা আমার অপরাধ নেবেন না, আমি চারদিকে শুনছি যে, এখানে যে রাজনীতি চলে, সে রাজনীতির নাম নাকি ভোটের রাজনীতি, শুনছি যে এদেশে সেকুলার হওয়া মানে নাকি মুসলিম মৌলবাদীর পক্ষ নেওয়া। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না এসব। আমি শুনতে চাই না এসব। তারপরও চারদিকে তাই দেখছি, পড়ছি, শুনছি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নাকচোখমুখ বন্ধ করে বসে থাকি। ধীরে ধীরে মৃত্যু যেভাবে আমার দুঃসহ একাকীত্বের নির্বাসনে এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, তার সঙ্গে বরং প্রাণের কথা বলি। প্রাণের কথা বলার আমার তো নেই কেউ আর।

আমি বাংলাকে হারিয়েছি। যে বাংলাকে আঁকড়ে ধরে আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম, যে বাংলার মাটি কামড়ে আমি পড়েছিলাম, সেই বাংলা থেকে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, মায়ের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো। আমি আমার মাকে, যে মা আমাকে জন্ম দিয়েছিল, হারিয়েছি। নিজের মাকে যেদিন হারিয়েছিলাম, সেদিনের কষ্টের চেয়ে আজকের কষ্ট তো কিছু কম নয়। আমার মা খুব চাইতেন যেন একদিন দেশের মেয়ে দেশে ফিরি। দেশে ফিরতে আমি পারিনি। কলকাতায় পাকাঁপাকিভাবে বসবাস শুরু করার পর মাকে মনে মনে বলেছিলাম, ”মা তুমি দুঃখ কোরো না, নিজের দেশেই ফিরেছি, এপার ওপার অত কী বিচার করতে আছে।

মাকে বলা হয়নি আর, মুখ ফুটে আমি বলতে পারিনি, যে, আমার এখন উদ্বাস্তু জীবন। বলতে পারিনি, মা বলে যার মাটিতে মাথা রেখেছিলাম, ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সে আমাকে বের করে দিয়েছে। বললে আমার নিরীহ মা-টি বড় কষ্ট পাবেন। তাই মাকেও বলি না, মনে মনেও বলি না। বরং নিজেকেই এখন বোঝাবার চেষ্টা করছি এই বলে যে, অপরাধ নিশ্চয়ই আমি করেছি, অপরাধ না করলে কেন আমার এমন কঠিন নির্বাসনদন্ড হবে! সত্য বলাটাই কি অপরাধ নয় এই অসত্যের যুগে? কিন্তু সত্য তো আরও মানুষ বলছে, তাদের তো এত দুর্ভোগ পোহাতে হয় না? আমাকে হয় কেন এত পোহাতে? আমি মেয়ে বলেই সম্ভবত। মেয়েদের আক্রমণ করার মতো সহজ কাজ আর কী আছে।

আমি জানি মানুষ আমাকে নির্বাসনদন্ড দেয়নি। যদি জনগণের মত নেওয়া হত, জানি অধিকাংশই চাইতেন আমি বাংলায় বাস করি। কিন্তু গণমানুষের মতে কি আর গণতন্ত্র চলে। গণতন্ত্র চালায় শাসকেরা, শাসকের সুবিধে যেভাবে হয়, সেভাবে। আমি সামান্য মানুষ। নিজের মতো করে বাস করি, নিজের বিশ্বাসের কথা নিজের মতো করে লিখি। কারও অনিষ্ট করি না। কাউকে ঠকাই না। মিথ্যে বলি না। কোনও অসততা আজ অবদি করিনি। আমার মতো সাধারণ লেখক, যে রাজনীতির সাতেপাঁচে নেই, রাজনীতি যে বোঝে না, তার ওপর যে রাজনৈতিক অত্যাচার হল, তাকে যেভাবে খুঁটি করা হল রাজনীতির, তাতে সত্যিই কোনও দলের কোনও ভোটের লাভ হবে কিনা জানি না, তবে আমার ক্ষতি হল ভীষণ। মৌলবাদী শক্তি, যে শক্তির বিরুদ্ধে আমি অনেককাল লড়ছি, তাকে অনেক বেশি শক্তিমান করা হল।

এই আমার প্রিয় ভারত, যে ভারতে বসে আমি মানবতন্ত্র, মানবাধিকার আর নারীর অধিকারের কথা বলছি, সেই ভারতে আমি যখন আমার বিশ্বাস এবং আদর্শের কারণে আক্রান্ত হই, তখন কোনও রাজনৈতিক শক্তি আমার পক্ষে একটি শব্দ উচ্চারণ করে না, কোনও অরাজনৈতিক দল, কোনও নারীবাদী সংস্থা, কোনও বড় মানবাধিকার সংগঠন আমার পাশে দাঁড়ায় না, আমার ওপর আক্রমণের নিন্দা করে না। এই ভারতবর্ষকে আমি চিনি না। তবে এ ঠিক, মানুষ এককভাবে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করছেন, লেখক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীরা লিখছেন, আমার লেখা পড়ে বা না পড়ে, কী লিখি না লিখি না জেনেই মত প্রকাশের পক্ষেই মত প্রকাশ করছেন। কিন্তু যখনই মানুষ সংগঠিত, তখনই মুখে কুলুপ। ভারতবর্ষের নতুন এই চেহারা দেখে আমি আতঙ্কিত। এটা কি আসলে নতুন চেহারা, নাকি এই চেহারাটাই ভারতবর্ষের আসল। আমি সেই বালিকাবয়স থেকে ভারতবর্ষকে মহান বলেই ভেবেছি। আমার সেই স্বপ্নের ভারতবর্ষ, দৃঢ়, দীপ্ত এবং দৃপ্ত, স্বপ্নের সেই ভারতবর্ষকে কোনও একদিন দেখবো এবং গৌরব করবো বলেই হয়তো আরও বেশি করে বেঁচে থাকতে চাই। আততায়ীকে বলতে চাই অপেক্ষা করতে। সেদিন আমি নিজেই আমার আততায়ীকে আমন্ত্রণ জানাবো, মরতে কোনও দ্বিধা হবে না, যেদিন দেখবো অন্যায়ের এবং অন্ধত্বের বিরুদ্ধে রুখে উঠতে জানে ভারতবর্ষ। আমি আর ক’দিন বেঁচে থাকবো, ভারতবর্ষকে তো বেঁচে থাকতে হবে হাজার বছর।

১৫ মার্চ

চোখ দেখানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, রেটিনোপাথি। তাহলে কি চোখ নষ্ট হওয়ার পথে! পথে, তবে যদি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, ও আর এগোবে না। দীর্ঘকাল রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এই-ই হয়। কিন্তু এই অজ্ঞাতবাসে, এই অস্থির অনিশ্চয়তায় আমি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো না। আমাকে কোনও ডাক্তারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে দেওয়া হয় না। অন্তত যে বাঙালি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলতাম দিল্লিতে, সেই ডাক্তারও ভয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন কথা বলা। একটা ভয়ংকর ভুতুড়ে পরিবেশ চারদিকে। যেন আমি পৃথিবী নামের গ্রহের অনেক অনেক দূরে অন্য কোনও গ্রহে। যেন আমাকে বন্দি করা হয়েছে, আমি ঠিক এই গ্রহের কারও মতো নই বলে আমাকে মহা বিপজ্জনক কিছু একটা ভাবা হচ্ছে। এই বাড়িতে নিরন্তর মানসিক চাপে আমার রক্তচাপ কোনওদিন নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

একটি সিদ্ধান্ত নিই। কেন এই সিদ্ধান্তটি আমি নিচ্ছি, তা দ্রুত একটি কাগজে আমি এক দুই তিন নম্বর দিয়ে লিখে ফেলি। যে কথাই টগবগ করে ফুটছে, লিখি। লিখি, যেন আজ আমার মৃত্যু হলেও মানুষ, পৃথিবীর যে ক’জন মানুষই আমাকে লেখক হিসেবে শ্রদ্ধা করেছে, ভালোবেসেছে, তারা জানতে পায়। যেন কিছুই অজানা থেকে না যায়।

এই মৃত্যু কুঠুরি থেকে আমাকে বেরোতে হবে। আমি আগে একে ‘অত্যাচারের কক্ষ বলতাম। ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি, এ আসলে মৃত্যু কুঠুরি। ডাক্তাররা যেখানে ভেবেছিলেন এবং বলেছিলেন রক্তচাপ স্বাভাবিক করার জন্য হাসপাতালে আরও দীর্ঘদিন থাকা অত্যন্ত জরুরি, আমাকে থাকতে দেওয়া হয়নি, হাসপাতালের কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে সুস্থ না হওয়া রোগী। আমি কখন হাসপাতাল ত্যাগ করবো, সেই সিদ্ধান্ত ডাক্তার নেন না, প্রভু নেন। ডাক্তার যেদিন বললেন আরও হয়তো এক বাদু’সপ্তাহ থাকতে হতে পারে হাসপাতালে, তার পরদিনই আমাকে হাসপাতাল ত্যাগ করতে হয়েছে। পত্রিকায় আমার হাসপাতালে থাকার খবর ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। মোবাইল ফোন আমার কাছ থেকে নিয়ে নেন প্রভু।

এই অজ্ঞাতবাসে আমার জন্য কোনও ডাক্তার আসতে পারবে না, আমিও এখান। থেকে কোনও ডাক্তারের কাছে যেতে পারবো না। আবার কোনও ডাক্তারের সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে পারবো না। অনেকবার চেয়েছি ডাক্তারদের ফোন নম্বর। বড় ছোট কোনও ডাক্তারের ফোন নম্বর আমাকে দেওয়া হয়নি। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ডাক্তারদের ফোন নম্বর যখন চেয়েছিলাম জরুরি হলে ফোন করবো বলে, বলেছেন, আমাকে ফোন নম্বর দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধ আছে। যা কিছুই আমি জানতে চাই আমার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে, জানাতে হবে সরকারি অফিসারদের, তাঁরা ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার প্রশ্নোত্তর জানাবেন। ডাক্তার বলেছিলেন, দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার রক্তচাপ বাড়ার মূল কারণ। আমি যেন দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকি। এখানে, এই অবস্থায়, এই বাড়িতে, দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার আমার কোনও উপায় নেই।

রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত থাকার কারণে ধীরে ধীরে হৃদপিণ্ডের দেয়াল শক্ত হয়ে উঠছে, চোখেও অসুখ দেখা দিচ্ছে। এরপর একদিন দুম করে হৃদপিণ্ড, চোখ, কিডনি সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমি মরে পড়ে থাকবো নিরাপদ বাড়িটিতে। এই অজ্ঞাতবাসের আগে আমার রক্তচাপ সবসময় নিয়ন্ত্রণে ছিল। আমার শরীরের ভেতরের কোনও কিছুতে কোনও রক্তচাপ জনিত অসুবিধে দেখা দেয়নি। চোখের ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে আমি জানিয়ে দিই, আমার সিদ্ধান্তটি, আমি ভারত ছাড়বো। প্রভুকে অনুরোধ করেছি, ভারত ছাড়ার আগে আমাকে একদিনের জন্য হলেও কলকাতা যেতে হবে, একদিনের জন্য না দিলেও অন্তত কয়েক ঘণ্টা থাকার অনুমতি দিন, আমাকে আমার জরুরি জিনিসপত্র ইত্যাদি নিয়ে আসার জন্য। এবং একা পড়ে থাকা বাড়িটির দায়িত্বও তো কাউকে দিতে হবে। প্রভু রাজি হননি। প্রভুর দোষ নয়, প্রভু বলেছেন তিনি জানিয়েছিলেন ওপরে, ওপরওয়ালারা রাজি নন।

১৭ মার্চ

অত বড় সরকারের সঙ্গে পিরবো কী করে আমি! আমি ক্ষুদ্র তুচ্ছ মানুষ। তারপরও মনে হয়, ঠেকিয়ে তো ছিলাম সাড়ে সাত মাস! যুদ্ধ তো করেছি সাড়ে সাত মাস! শুধু মৃত্যু চাইনি বলে বেরিয়ে যাচ্ছি। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। দেখা তো হবেই ভারতবর্ষ। যতই তুমি আমাকে দলে পিষে মারো না কেন! যতই তুমি আমাকে নিশ্চিহ্ন করো না কেন! যতই তুমি আমাকে নিঃশেষ করো না কেন? ভালোবাসি তোমাকে ভারতবর্ষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *