০৫. জানালার ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু

০৫. জানালার ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু

আমার চারদিকে মৃত্যু। আমি মরবো, আজনয়তোকাল। এই আতংক পুলিশের বড়কর্তারা আমার ভেতরে ঠেলে ধাক্কিয়ে ঢোকাতে চেয়েছেন। তাঁরা আমাকে সারাক্ষণের একটা সঙ্গী দিয়ে গেছেন বেঁচে থাকার। সঙ্গীর নাম মৃত্যু। আমার রক্তে ইনজেক্ট করে দিয়ে গেছেন মৃত্ম। আমার মস্তিষ্কের কোষের ভেতর সন্তর্পণে একটি দৃশ্য ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন, পাঁচ হাজার মুসলমান ঢুকে গেছে বাড়িতে, আমাকে গুলি করে মারছে, গুলি করছে সারা শরীরে। বড় বড় ছুরি বের করে মাথা কেটে নিচ্ছে, হাত পা কেটে নিচ্ছে। টুকরো টুকরো করছে আমাকে। করছে, আর উল্লাস করছে। এই দৃশ্যটি আমি সারাদিন দেখি, সারারাত দেখি। জানালায় চোখ রাখলে এখন আর আকাশ দেখি না, আমার মৃতমুখ দেখি। বারান্দায় হাসনুহানা গাছের কাছে এসে দাঁড়ালে আমি রক্তে ভেসে যাওয়া গাছ দেখি। চারদিকে কিছু আর সবুজ নয়, সব লাল। ঘোরের মধ্যে, গৃহবন্দি আমি, লিখতে থাকি মৃত্যুর কথা।

মৃত্যু


ঠিক জানালার ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু।
দরজা খুললেই চোখের দিকে কোনওরকম
সংকোচ না করে তাকাবে,
বসলে পাশের চেয়ারটায় এসে বসবে,
বলা যায় না হাতও রাখতে পারে হাতে,
তারপরই কি আমাকে হেঁচকা টান দিয়ে নিয়ে যাবে যেখানে নেওয়ার!
কোথাও বসতে, শুতে, দাঁড়াতে গেলেই আমার মনে হতে থাকে
মৃত্যু আড়াল থেকে আমাকে দেখে দেখে হাসছে।
স্নানঘরে জলের শব্দের মধ্যে মৃত্যুর শব্দ বাজতে থাকে,
চুপচাপ বিকেলে কানের কাছে মৃত্যু এসে তার নাম ঠিকানা জানিয়ে যায়,
গভীর রাতেও মৃত্যুর স্তব্ধতার শব্দে বারবার ঘুম ভেঙে যায়।

যেই না ঘর থেকে বার হই, পায়ে পায়ে মৃত্যু হাঁটে
যেখানেই যাই, যে রস্তি বা প্রাসাদে, মৃত্যু যায়,
ঘাড় যেদিকেই ঘোরাই, সে ঘোরায়,
আকাশ দেখি, সেও দেখে,
ভিড়ের বাজারে গায়ে সেঁটে থাকে,
শ্বাস নিই, মৃত্যু দ্রুত ঢুকে পড়ে ফুসফুসে
এত মৃত্যু নিয়ে কি বাঁচা যায়, কেউ বাঁচে?
মৃত্যু থেকে বাঁচতে আমাকে মৃত্যুরই আশ্রয় নিতে হবে,
এ ছাড়া উপায় কী?

.

আরও ক’দিন বাঁচতে দাও, কমাস দাও,
আরও ক’বছর দাও সোনা,
আর বছর দুয়েক, হাতের কাজগুলো সারা হলে আর না বলবো না।

যদি বছর পাঁচেক দাও, খুব ভালো হয়।
দেবে তো? কী এমন ক্ষতি তোমার করেছি,
মৃত্যুর বিরুদ্ধে কোনও শব্দ উচ্চারণ করিনি,
একটি অক্ষরও কোথাও লিখিনি কোনওদিন!
বছর পাঁচেকে কতটুকু আর পারবো জমে থাকা কাজের পাহাড় নামাতে!
সাত আট বছর পেলে হয়তো চলে
চলে বলবো না, চালিয়ে নেব। চালিয়ে তো নিতেই হয় কাউকে না কাউকে।
দশ হলে মোটামুটি হয়। দশ কি আর দেবে তুমি সোনা?
তোমারও তো জীবন আছে, তুমি আর কতদিন বসে বসে প্রহর গুনবে!
প্রহর যদি গোনোই কিছুটা, যদি রাজি হও,
তবে শেষ কথা বলি, শোনো, দশ যদি মানো, তবে
দু’বছর কী আর এমন বছর, দিলে বারো বছরই দিও,
 জানি দেখতে না দেখতে ওটুকুও ফুরিয়ে যাবে।
জানি না কী! বছর বারো আগেই তো তার সাথে দেখা হল,
এখনও মনে হয় এই সেদিন, এখনও যেন চোখের পাতা ফেলিনি,
এখনও তাকিয়ে আছি, বারো বছর কী রকম মুহূর্তে কেটে যায়, দেখেছো?
ও মরণ, ও জাদু, ভালোবেসে পনেরো কুড়িও তো দিতে পারো,
ও-ও দেখতে না দেখতে কেটে যাবে দেখো।
বছর পেরোতে কি আর বছর লাগে?

আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছো,
কী থেকে কী হয় কে জানে!
স্বাধীনতা থাকলে কী আর ভিক্ষে করতাম দিন!
যত খুশি যাপন করা যেত।
এখন চাইলেই কেউ তো আর বাঁচতে দিতে রাজি নয়।
তুমিও ছড়ি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো গায়ের ওপর,
এখন কিছুই আর আগের দিনের মতো নেই। তুমিও তো বাঁচতে চাও,
মরণও বাঁচতে চায়।

আর আমি? এখন এক একটি দিন বাঁচি তুমি যদি করুণা কর,
এক একটি মাস বছর বাঁচি, যদি বাঁচাও।
জীবনের কাছে নয়, ঋণী যদি থাকি কারও কাছে, সে তোমার কাছে,
তোমার অনুগ্রহের কাছে।
ক্ষমাঘেন্না করে আরও কটা বছর বাঁচাও সোনা।
মৃত্যুর বিপক্ষে মনের খায়েশ মিটিয়ে দু’কলম লিখে তবে মরি।

.

রামদা বল্লম নিয়ে নেমেছে ওরা,
তলোয়ার নিয়ে,
বিষাক্তসাপ নিয়ে
মাথায় ধর্মমন্ত্র
বুকে ঘৃণা,
কোমরে মারণাস্ত্র
আমাকে হত্যা করে ধর্ম বাচাবে।

কম নয়, হাজার বছর মানুষ হত্যা করে
ধর্মকে বাঁচিয়েছে মানুষ।
মানুষের রক্তে স্নান করে দেশে দেশে
এককালে ধর্ম ছড়িয়েছিল মানুষই,
মানবতার চেয়ে ধর্মকে চিরকালই মহান করেছে মানুষই।

ধর্মের পুঁথি মানুষই লিখেছে,
নিঃসাড় পুঁথিকে মানুষখেকো বানিয়েছে মানুষই।
ধর্মের হাত পা বাঁধা, মুখে সেলাই।
ছাড়া পেলে ধর্মও চেঁচিয়ে বলতো, পাষন্ডরা মর।
প্রাণ থাকলে লজ্জায় আত্মহত্যা করতো ধর্ম,
করতো দুহাজার বছর আগেই,
করতো মানুষের জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য।

.

ওপারে কেউ নেই কিছু নেই, ফাঁকা,
আসলে ওপার বলে কিছু নেই কোথাও।
মৃত্যু আমাকে কোনও পারে নিয়ে যাবে না, কোনও বিচার সভায় না,
কোনও দরজার কাছে এনে দাঁড় করাবে না, যে দরজা পেরোলেই
হয় পুঁজ,রক্ত আর আগুন, নয় ঝরনার জল, না-ফুরোনো আমোদ প্রমোদ।

বিশ্বব্রহ্মা থেকে আমার বিদেয় হয়ে গেলে
শরীর পড়ে থাকবে কিছুদিন শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে কাঁটা ছেঁড়া হতে,
হয়ে গেলে হাড়গোড় সের দরে কারও কাছে বেচে দেবে কেউ
ওসবও একদিন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়বে, ধুলো হবে,
ধুলোও নিশ্চিহ্ন হবে কোনও এক গোধূলিতে।

যাদের ওপারে বিশ্বাস, না হয় তারাই যাক, মৃত্যুকে চুম্বন করে
রত্নখচিত দরজায় কড়া নাড়ুক,
ভেতরে অপেক্ষা করছে অগাধ জৌলুস, অপেক্ষা করছে মদ মেয়েমানুষ।
আমাকে থাকতে দিক পৃথিবীতে, থাকতে দিক অরণ্যে, পর্বতে, উতল সমুদ্রে, আমাকে ঘুমোতে দিক ঘাসে, ঘাসফুলে, আমাকে জাগতে দিক পাখিদের গানে কোলাহলে, সর্বাঙ্গে মাখতে দিক সূর্যের কিরণ, হাসতে দিক, ভরা জ্যোৎস্নায় ভালোবাসতে দিক, মানুষের ভিড়ে রোদে বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে দিক, বাঁচতে দিক।

যাদের ওপার নিয়ে সুখ, তারা সুখে থাক,
পৃথিবীতে আমাকে যদি দুঃখ পোহাতে হয় তোক,
পৃথিবীই আমার এপার, পৃথিবীই ওপার।

.

জীবন জীবন করে পাগল যে হই,
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বলেই তো সে,
তিনবেলা চোখাচোখি হয়, প্রেমিকের মতো মুচকি হাসেও,
জানি খুব ভালোবাসে সে আমাকে, জানি খুব কাছে পেতে চায়।

ওভাবে সে চুমু খেতে না চাইলে অত করে ভালোবাসতে চাইতাম বুঝি!
ওভাবে দাঁড়িয়ে না থাকলে আঁকড়ে ধরতাম বুঝি
অত শক্ত করে পায়ের আঙুলে মাটি?
ঠেকিয়ে রাখতাম পিঠ দেয়ালে? খামচে ধরতাম হাতের কাছে যা পাই?

ওভাবে আমাকে নাগাল পেতে বাড়িয়ে না দিলে হাত,
পাড়াপড়শি গ্রাম শহর নগর বন্দর জাগিয়ে উত্তরে দক্ষিণে
ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োতাম না জীবনের খোঁজে।
ওভাবে যদি না দাঁড়িয়ে থাকতো মৃত্যু দরজায়,
একবারও চাইতাম না তাকে ঠেলে সরাতে,
পালাতে চাইতাম না কোথাও, বরং চরাচর খুঁজে তাকেই বাড়ি নিয়ে এসে বসতে দিতাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *