১ জানুয়ারি
‘মৌলবাদীদের মন রাখতেই বুদ্ধদেব তসলিমা নাসরিনকে কলকাতা থেকে হাপিস করলেন।
–মহাশ্বেতা দেবী
আজ সুয়েনসনের সঙ্গে দেখা করানোর ব্যবস্থা করার কথা ছিল। হল দেখা। বেচারা বিদেশি। দিল্লির রাস্তাঘাট চেনে না। তাকেও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, একেকদিন একেক রাস্তা দিয়ে নিয়ে আসা হয় ওই গোপন জায়গাটিতে। দেখা হওয়ার জায়গাটিতে।
অনেকটা সময়ই কাটালাম। ভালো খাবার দাবারের ব্যবস্থা করা হল। মাঠটাতে একটু হাঁটার সুযোগও হল। খালি পায়ে হাঁটলাম। একটা মাঠ পাওয়া জগৎ পাওয়ার মতো। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে মাটির ছোঁয়া পাইনি।
.
২ জানুয়ারি
আজ কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি হলে আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নেওয়ার উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান করলো এপিডিআর, কলকাতার মানবাধিকার সংগঠন অথবা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগঠন। মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন অনুষ্ঠানের সভানেত্রী। দীপংকর চক্রবর্তী, সুজাত ভদ্র, শুভাপ্রসন্ন, অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বক্তৃতা করেছেন। উপস্থিত থাকার কথা ছিল শঙ্খ ঘোষ, অপর্ণা সেন, শাঁওলি মিত্রের। সকলেই নানা অসুবিধেয় পড়ে আসতে পারেননি। অনুষ্ঠানে প্রতুল মুখোপাধ্যায় গান গাইলেন, সেটি শুনলাম ফোনে। অসাধারণ। কী সুন্দর গান লিখেছেন আমাকে নিয়ে। হায় হায় হায় কী শরম কেয়া বাত, মার্কস বাদী পার্টি নাচে মৌলবাদ কা সাথ, দেশ ছাড়া এক তেজি মেয়ে থাকতো কলকাতায়, তার কাটতো সময় লেখাপড়ায়, সভায় আর আড্ডায়।..তারপর কী করে আমাকে পগার পার করা হল, সেই গল্প। কোনওদিন দেখা হয়নি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর গানের মুগ্ধ শ্রোতা আমি। কলকাতায় গেলে দেখা হবে, দেখা আমাদের নিশ্চয়ই একদিন হবে।
আজ শেষ দিন সুয়েনসনের। বিকেলটা একসঙ্গে কাটানো হল। হল বটে, কিন্তু ওর প্রতি কি সত্যিই আমার কোনও অনুরাগ আছে? আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে, কোনও আত্মবিশ্বাসী সচেতন মেয়ে ওর মুখদর্শন করতো না। সন্ধেয় খেয়ে দেয়ে ও চলে গেল। মানুষটা অদ্ভুত। খুব হাত পা ছড়িয়ে উপভোগ করলো ভারত সরকারের আতিথ্য। আমি কি এরকম পারতাম? ওর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে বুঝি, অসম্ভব। আমার সংকোচ হত। কোনও দেশ যদি বিপদে পড়ে আমার খরচ বহন করতে চাইতো, কিছুতেই আমি নিতাম না সে খরচ। নিজে যা পারি, নিজের যা সামর্থ, তা দিয়ে আমি চলতাম। আজ পর্যন্ত এত যে বিদেশে থেকেছি, কোথাও কোনো সরকারের দান বা করুণা নিইনি। যদিও রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে আমার নেওয়ারই কথা ছিল।
সুয়েনসনকে সরকারের কোনো এক লোক তাজমহল পর্যন্ত দেখিয়ে এনেছে, জয়পুর নিয়ে গেছে, উদয়পুরেও, দিল্লির অনেক কিছু দেখিয়েছে। খাওয়া খরচ, হোটেল খরচ সব অকাতরে দিয়েছে। আমি বলেছিলাম, এসব খরচ তো তুমিই দিতে পারো। সুয়েনসন বললো, ‘ওরা যখন দিচ্ছে, দিক। প্রভুকে বলেছিলাম বটে সুয়েনসনকে একটু ঘুরিয়ে দেখাতে, বেচারা আমার সঙ্গে কাটাতে পারছে না, তার চেয়ে ঘুরে বেড়ালে মন ভালো থাকবে। ওকে একটু সাহায্য করা। ওর গাইড হওয়া। কিন্তু যা আশা করিনি, যা চাইনি তাই করলেন প্রভু। জানি না কেন করলেন। প্রভু জানালেন সুয়েনসনকে তিনি অতিথির মতো দেখাশোনা করবেন। আমাকে খুশি করতেই সুয়েনসনের সব দায়িত্ব নিয়েছেন প্রভু। প্রভু কি ভেবেছিলেন, আমার করুণ অবস্থা দেখে সুয়েনসন আমাকে বলবে যেন ভারত ছেড়ে চলে যাই, অথবা আমাকে তার সঙ্গে যে করেই হোক সুইডেনে নিয়ে যাবে! প্রভু যা ভেবেই যা কিছুই করুন, সুয়েনসনের উচিত হয়নি এভাবে গোগ্রাসে সব গ্রহণ করা। ধন্যবাদ জানিয়ে বলতে পারতো, ওর নিজের খরচাটা ও নিজে দেবে। মাগনা পেলে কিছু লোক বিষ্ঠাও খায়। বিদেশিদের ভাবা হয়, বিশেষ করে সুইডিশদের, যে, এরা অন্যকে ঠকায় না, অন্যকে বিরক্ত করে না। তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। সুযোগ পেলে এরা রক্ত চুষে খায়। নিজেদের মধ্যে ঠকানোটা কম, যেই না অন্য জাতের কাউকে পেল, অমনি ঘাড় কামড়ে ধরবে। বিদেশিদের মধ্যে আমি যত স্বার্থপর, চশমখোর দেখেছি, দেশিদের মধ্যে তত দেখিনি। দেশিদের মধ্যে যে উদারতা, যে দয়া, এবং স্বার্থহীনতার সন্ধান আমি পেয়েছি, তার তুলনা হয় না। ভালো মন্দ দু সংস্কৃতিতেই মেলে। কার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছি, মিলছি–তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। সুয়েনসনের জন্য সরকারের যে টাকা খরচা হয়েছে, সে টাকার অংক অনুমান করে আমি শিউরে উঠি। টাকা আমি যে করে হোক, ফেরত দিতে চাই। আমার জন্য যা হচ্ছে হচ্ছে, আমার বন্ধুর জন্য হবে কেন? আমার বন্ধুকে আমি যে জায়গায় থাকছি, সেই জায়গায় না আসতে দিলে তো বাইরের বন্দোবস্ত করতেই হয়। কিন্তু তাই বলে কেন সুয়েনসনকে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে চলতে হবে। আমার সঙ্গে ওর থাকা হবে না, এ তো একরকম জেনেই ও এসেছে। থাকা হবে না বলে ওর সমস্ত দায়িত্ব কেন আমাকে নিতে হবে! কেন যে এত দরদ আমার মানুষের প্রতি। স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা আর ক্ষুদ্রতা তত কম দেখিনি আমি সুয়েনসনের। ও তো আমাকে কম কাদায়নি। আমাকে অসহায় পেয়ে ও তো আমাকে কম পেষেনি! আর ওকেই কি না দেওয়া হল বিশাল আতিথেয়তা। এসব পাওয়ার যোগ্যতা ওর নেই। কিন্তু যা পেয়েছে, লুফে নিয়েছে। আজ যদি ওকে জানাই, যে, তোমার জন্য সরকারের যে টাকা খরচ হয়েছে, সেই টাকা আমাকে ফেরত দিতে হবে সরকারকে। আমি জানি, ও শুধু”ঠিক আছে বলে দায় সারবে।
আমার ডিএনএতে যে আমার মার চরিত্র। কী করে পালাবো এ থেকে। ক্ষমা করে দিতে দিতে গেছি দুনিয়ার সব বদমাশকে। ক্ষমা আর ভালোবাসা –এ দুটো রক্তে আমার। মা’র যেমন ছিল। মা কিন্তু দুঃখই পেয়ে গেছেন মানুষের কাছ থেকে, সারাজীবন। আমারও একই নিয়তি।
.
৩ জানুয়ারি
গতকাল অনুষ্ঠান হল, কোনও বাংলাপত্রিকায় তার কোনও খবর নেই শুধুদৈনিকস্টেটসম্যান ছাড়া। যেহেতু সিপিএমের নেতারা আমার ওপর অমানবিক আচরণ করেছেন, যেহেতু দৈনিক স্টেটসম্যান এখনও সিপিএম বিরোধিতা চালিয়ে যাচ্ছে, আমার পক্ষে লিখছে। এ ক্ষেত্রে এটি সাহসী ভূমিকাই। কারণ সিপিএম বিরোধী তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আমার পক্ষে তো একটি কথাও বলছেন না তিনি! সিপিএমের চুন থেকে পান খসলে তিনি তেড়ে আসেন। কই, সিপিএম আমার সঙ্গে যা করেছে তা নিয়ে একটি সমালোচনার বাক্যও তোত তিনি উচ্চারণ করছেন না! কেউ বলে, আনন্দবাজার আপস করেছে, কেউ কেউ বলে আতাঁত করেছে। আনন্দবাজার যা করেছে, তাকে আপস বলে নাকি আঁতাত বলে জানি না। তবে অনেককাল চুপ থাকছে। মহাবোধির অনুষ্ঠান নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করেনি। আনন্দবাজারের ভূমিকা নিয়ে মানুষের সংশয় তৈরি হয়েছে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে যখন মানুষের পক্ষে না দাঁড়িয়ে সরকার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।
প্রসূন ভৌমিক আমাকে ফোনে অনুরোধ করেছিল একটা যেন লেখা দিই সেদিন অনুষ্ঠানে পড়ার জন্য। তো লিখে ফেললাম তক্ষুণি। ওই যে, স্বভাব তো আছেই আমার, ফরমায়েশ থাকলে লেখা হয়, নয়তো নয়। লেখাটা, বারবার বলে দিয়েছি, পড়ার জন্য মঞ্চে। কোথাও ছাপাবার জন্য নয়। কিন্তু পড়ার পর শুনেছি মহাশ্বেতা দেবী ঘোষণা করে দিয়েছেন এটা দৈনিক স্টেটসম্যানে ছাপা হবে।
পত্রিকায় ছাপা হওয়া মানে হাওয়ার আগে ছড়িয়ে যাওয়া সর্বত্র। সরকারের কোনও সমালোচনা আমার মুখ থেকে বেরোনো মাত্র লুফে নেয় তাবৎ সাংবাদিক। একবারও ভেবে দেখে না এতে আমার ক্ষতি কিছু হবে কি না। মৌলবাদীরা আক্রমণ করতে পারে এই আশংকা থাকার পরও কি জয়পুরের হোটেলের নাম আর রুম নম্বর জানিয়ে দেয়নি পুরো পৃথিবীকে? দিয়েছে। সাংবাদিকরা ভালো হয়, খারাপও কম হয় না। পিটিআইএর এক ছেলে, খুব ভালো সম্পর্ক আমার সঙ্গে, বারবারই বলছে আমার জন্য দুশ্চিন্তায় দিন পার করছে, কিন্তু মহাবোধি সোসাইটি হলে যাবে না। দিল্লির অফিস থেকে চাপ এলে ডেস্কে বসে এর ওর কাছ থেকে শুনে খবর লিখবে। আর আমি তো শুধু ক’টি ডায়াল দূরত্বে, আমাকে সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা না করে এদিক ওদিক থেকে আমি কী বলেছি, কোনো সরকারবিরোধী কিছু বলেছি কি না, জেনে যাচাই করা নেই কিছু নেই, ঢুকিয়ে দেবে আমার নামে। আমি যে যুক্তির কথা বলছি, বুঝিয়ে বলছি, সেগুলোতে কান কেউ দিতে চায় না। খালি বিস্ফোরক কিছু দিয়েই ভরতে চায় খবরের শিরোনাম, খবর।
তপন রায় চৌধুরী কলকাতা থেকে দিল্লি এসেছেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। দেখা করার ব্যবস্থা করলেন প্রভু, সেই গোপন জায়গাতেই। তবে এই দেখা করার ব্যাপারটিতে আমার চেয়েও বেশি উৎসাহ প্রভুর। তপন রায় চৌধুরীকে দেখে কী যে ভালো লাগলো। আমাকে বড় ভালোবাসেন। না হলে দেখা করতে চাইবেন কেন! দিল্লিতে এসে নাকি প্রথম। ভ’বাবুর সঙ্গে দেখা করেছেন, দ্বিতীয় কাজ আমার সঙ্গে দেখা করা। কলকাতা থেকে ছুটে এসেছেন শুধু এক কারণেই। আমার ব্যাপারে ভ’র সঙ্গে কথা বলতে। আমি উন্মুখ বসে রইলাম শোনার জন্য, বারবারই জিজ্ঞেস করলাম, ভ’বাবু কী বলেছেন? আমাকে কবে যেতে দেবেন কলকাতায়?
এর উত্তর না দিয়ে প্রভুর দিকে দূর থেকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে র’ এর লোক।
–র’এর লোক? মনে হয় না।
–আমার মনে হচ্ছে এরা র’ এর লোকই হবে।
-এঁরা খুবই ভালোমানুষ। খুব যত্ন নিচ্ছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা দরকার আমার, তা হল কলকাতায় ফেরা, স্বাধীন স্বাভাবিক জীবন যাপন করা, যা এতকাল করছিলাম।
আমি যতই কলকাতার কথা বলি, কবে যেতে পারবো, সেই দিন তারিখটি শুনতে চাই। তপন বাবু ততই এড়িয়ে চলেন আমার কথা। মৌলবাদীরা যে কত ভয়ংকর, তারা যে আমাকে মেরে ফেলার জন্য ছুরিতে শান দিয়ে রেখেছে, পিস্তলে গুলি ভরে রেখেছে, তলোয়ার খাপ থেকে বের করে এনেছে সে কথাই তিনি থেকে থেকে শোনান।
বহুকাল বিদেশের নিরাপদ জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষগুলো সব কিছুতে বড় ভয় পান। তিনি ভাবছেন বিরাট কোনও সন্ত্রাসী মুসলিম মৌলবাদী দল বোধহয় আমাকে টার্গেট করেছে। নিরাপত্তার কথা ভাবছেন। ভ’র সঙ্গে কথা বলে, তিনি যা বুঝেছেন, খুব তাড়াতাড়ি আমার কলকাতা ফেরা হবে না।
.
৪ জানুয়ারি
দুপুরে একটুখানি রোদে বসা। গাছগাছালির দিকে বড় শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকা। এ হল প্রতিদিনকার হু হু করা দুপুরের গল্প। আজ ওরকম দুপুরে শীলা রেড্ডিকে বললাম কাল তপন রায় চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। আসলে আমি যে আগ বাড়িয়ে সব বলি, তা নয়। শীলাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চান সবকিছু, কী ঘটছে, কী হচ্ছে, কী করছি, কী ভাবছি। শীলা বললেন, ”তুমি ওঁকেই বলো সাহায্য করতে। তোমাকে কলকাতায় পাঠানো যদি না-ই হয়, অন্তত এখানে, এই দিল্লিতেই যেন কিছুটা স্বাভাবিক জীবন দেওয়া হয়, তার জন্য তুমি কেন, তপনবাবুই ভ’কে বলুন।
শীলার আরও উপদেশ, শ্যাম বেনেগালকে ফোন করো, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাও। আমি এসব বড় মানুষদের ফোন করে অভ্যস্ত নই, বিশেষ করে যাদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্বের সম্পর্ক নেই। কিন্তু শীলা অনেকটা মনোবিজ্ঞানীর মতো, কী করে কী করে যেন আমাকে একবারে তাঁর প্রায় মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিয়েছেন। তিনি যা বলেন, তার অনেকটাই আমি মানতে না চাইলেও মানি। শ্যাম বেনেগালকে ফোন না করলে শীলা বলবেন, ”তুমি আসলে তোমার এই অবস্থা থেকে বেরোতেই চাও না। তাই চেষ্টাও করো না। এরকম আগে বলেছেন যখনই লক্ষ্য করেছেন তার উপদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে মানিনি। যেদিন উপদেশ দেন, তার পরদিন থেকে তিনি খবর নিতে শুরু করেন উপদেশের কটা এবং কতটুকু আমি মেনেছি।
শ্যাম বেনেগালকে ফোনে পেলাম না। উনি ফোন করলেন বোম্বে থেকে। ধন্যবাদ জানালাম সই করার জন্য পিটিশানে। বোম্বে থেকে দিল্লি আসতে আসতে তাঁর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। তার মানে দেখা হচ্ছে না। বন্ধু আর শুভাকাঙ্গীদের সঙ্গে দেখা করার যে কথা ভেবেছি, তা আপাতত অন্যের সঙ্গে হলেও শ্যাম বেনেগালের সঙ্গে হচ্ছে না। না হোক, অন্তত এ ভেবে ভালো লাগছে যে তিনি আমার অবস্থা নিয়ে ভাবছেন। নিজে থেকে বললেন সরকারের কারও সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। বলে কালই আমাকে জানাবেন। শ্যাম বেনেগাল জানান বা না-জানান, তিনি ভারতে আমার সবচেয়ে প্রিয় পরিচালক। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আমার একইরকম রয়ে যাবে। এমএ বেবিও বলেছিলেন জানাবেন। এমএ বেবি ওই তৃতীয় বাড়িতে দেখা করেছিলেন আমার সঙ্গে। পুরোনো কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, বুদ্ধবাবু আসলেই কেরালাতে আমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। আর আমি যখন জানিয়েছিলাম আমি কোথায় আছি, ‘সেইফ হাউজ’এর জীবন ঠিক কী রকম জীবন, ভেবেছিলাম তিনি বলবেন যে যে করেই হোক আমাকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার সবরকম চেষ্টা তিনি করবেন। বলেননি, তবে বলেছেন গান শুনতে, ভালো লাগার গানগুলো শুনতে। এমএ বেবিও পরে আর জানালেন না, কেন জানালেন না! নাকি জানানোর, আশা দেওয়ার, আশ্বাস দেওয়ার কিছু নেই আর!
.
৫ জানুয়ারি
দুটো কবিতা লিখলাম আজ। বহুদিন পর কবিতা। গৌতম ঘোষ দস্তিদার কলকাতা থেকে একটা ইমেইল পাঠিয়েছে তার ‘রক্তমাংস’ লিটল ম্যাগের জন্য কবিতা পাঠাতে অনুরোধ করে। কেউ না চাইলে আজকাল আর দেখি লেখা হয় না। লেখা চাইলেই লেখা হয়। কবিতা লিখতে লিখতে চোখ বেয়ে জল ঝরে। ঝরতে থাকে, লিখতে থাকি। লং লিভ ডিমোক্রেসি!’ ‘কোনও কবিকে কি কখনও গৃহবন্দি করা হয়েছিলো কখনও?
.
৬ জানুয়ারি
বাংলাদেশ আমার কাছে ভুলে যাওয়া নাম। সম্ভবত। বাংলাদেশ আমার সুখের এবং কষ্টের স্মৃতি। আমি ভাবতে পারি না যে বাংলাদেশে আমার বাবা মা আর নেই। তাঁদের বাড়ি ঘর খালি পড়ে আছে। এইটুকু ভাবার সাহস আমার হয় না। আমি ভাবি না। ওই ভাবনাটা আসতে গেলেই আমি ভাবনাকে সজোরে আড়াল করি। বড় খালি খালি লাগে। বুক ফেটে যায়। আমি ধারণ করতে পারি না এই শূন্যতা। তাই কোনওদিনই বাবা মায়ের থাকার কথা স্মরণ করি না। না-থাকার স্মৃতি মুছে ফেলতে চাই।
আজ কী রকম যেন ঘটনা ঘটলো। নেটে আমার বিষয়ে নতুন খবর খুঁজতে গিয়ে সকালে দেখলাম, কে এম সোবহানের ওপর একটা লেখা ডেইলি স্টারে, লেখক লিখছেন, কে এম সোবহান তসলিমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘ছিলেন’ শব্দটি আমার গা কাঁপিয়ে দেয়। তাহলে কি এখন নেই তিনি?
সকালে কলকাতা থেকে ফোন এল। কে এম সোবহানের লেখা ছাপা হয়েছে দৈনিক স্টেটসম্যানে। কে এম সোবহান, বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের প্রাক্তন বিচারক, মারা গেছেন গত সোমবার। এটিই তাঁর জীবনের শেষ লেখা। জীবনের শেষ লেখাটি আমাকে নিয়ে। কণ্ঠে জমা হতে থাকলো কষ্টের মেঘ। হ্যাঁ বাংলাদেশে হাতে গোনা যে ক’জন বুদ্ধিজীবী আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কেএম সোবহান অন্যতম।
লিখেছেন, তসলিমা নাসরিনকে বাংলাদেশ ধারণ করতে পারেনি, এ লজ্জা বাঙালির ধরে রাখার জায়গা নেই। এই বাঙালি লেখিকাকে বাংলাদেশ দিতে পারেনি তার সাংবিধানিক অধিকার।.. আপস করেছে বামফ্রন্ট সরকার জঙ্গি ধর্মান্ধদের কাছে নতজানু হয়ে।’
নিজের ওপর রাগ হয় কত বাজে কাজে সময় নষ্ট করেছি জীবনে, কোনওদিন এই মানুষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করিনি। পৃথিবীর কত কাউকেই তো কত ফোন করেছি, কোনওদিন কেন কেএম সোবহানকে ফোন করিনি। তারও নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগতো, যদি হত কথা মাঝে মধ্যে। কার ওপর অভিমান আমার? এই মানুষগুলো তো ভীষণভাবে আমাকে সমর্থন করে গেছেন, তাদের তো ক্ষমতা ছিল না আমাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার। শামসুর রাহমানও নেই আর। ওয়াহিদুর রহমানও চলে গেলেন। ওয়াহিদুর রহমান খুব ভালোবাসতেন আমাকে। আমার কথা নাকি খুব বলতেন। জনকণ্ঠে কলাম লিখতেন। তাঁর শেষ লেখাটিও শুনেছি আমাকে নিয়ে ছিল। চোখ জলে ভরে যায় শুনলে। এত বড় উদার মানুষদের কাছ থেকে আমাকে দুরে সরিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ সরকার। আমাকে আমার প্রাপ্য স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছে বাংলাদেশের ঘৃণ্য রাজনীতি।
চারদিকে শুধু শূন্যতা। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, খান সারোয়ার মুরশিদ, কলিম শরাফী, কবীর চৌধুরী এঁদের তো বয়স হয়েছে অনেক। কবে চলে যান, ভয় হয়। আর থাকলেই বা কী! আমি তো যোজন যোজন দূরে। শামিম সিকদার, রুবি রহমান, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কথাও বড় মনে পড়ে। এত দূরে চলে এলাম! এত যে যেতে চাই দেশটিতে! কেউ কি বোঝে? কেউ কি বোঝে যে পারি না যেতে? কেন বেরিয়েছিলাম দেশ থেকে। মৃত্যু হত, ওখানেই হত। বিদেশে বিদেশে ঘুরে মৃত্যু কি আমার কিছু কম হয়েছে?
বাংলাদেশের বড় মানুষগুলো আমার পাশে ছিলেন, সবসময় ছিলেন। কলকাতায় ছিলেন অন্নদাশংকর রায়। তিনি এখন নেই। আছেন শিবনারায়ণ রায়, খুব পাশে আছেন। আছেন অম্লান দত্ত। ওঁদেরও বয়স মধ্য আশি। যদি ওঁরাও চলে যান, বড় একা হয়ে যাবো। জগতে কেউ আর থাকবে না পাশে দাঁড়াবার। যতটা বড়রা বোঝেন আমাকে, লক্ষ্য করেছি মাঝারি বা ছোটরা ততটা বোঝেন না। অবশ্য বয়স হলেই যে বুঝবেন, তা নয়। বোঝার মন আছে। বলেই বোঝেন।
রাজনীতি আমাকে বড় একা করে দিল। বাবা মা থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে। যাঁরা স্নেহ করেন, শ্রদ্ধা করেন তাঁদের সবার থেকে দূরে। কী অদ্ভুত এক জীবন!
যে করেই হোক, যে ভাবেই হোক, যদি বাংলাদেশে চলে যেতে পারতাম। ইচ্ছে হয় ভ’বাবুকে বলি, আমাকে যেন দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। ভ’বাবুর সঙ্গে নিশ্চয়ই ভালো সম্পর্ক ওখানকার সরকারের। ভারতের সঙ্গে তো বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন আগের চেয়েও ভালো হওয়ারই কথা, কিছুদিন আগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশকে ভারত একশ কোটি টাকা দান করলো। যদি ভ’বাবু কোনও উদ্যোগ নিতেন আমাকে পাঠানোর। যেন হাসিনা আমার বিরুদ্ধে জারি করা হাবিজাবি মামলাগুলো তুলে নেন, যেন নিরাপত্তা দেন। আহ, যেতে পারতাম যদি নিজের বাড়িতে। নিজের ঘরে যদি বাকি জীবন বাস করতে পারতাম! মা’র অনেক আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল দেশে ফিরি। ‘‘র স্বপ্ন পূরণ করতে ইচ্ছে হয়। বেঁচে থাকা কালীন তাঁর কোনও স্বপ্নই তো পূরণ করিনি। নিজেরও কি আমার দেশে ফেরার স্বপ্ন নেই। বুকের ভেতরের খুব গোপন কুঠুরিতে থাকে আমার সেই স্বপ্ন। ওখানেই রেখে দিই ওদের, পূরণ-না-হওয়া স্বপ্নগুলোকে আমি আর চোখের সামনে মেলে ধরি না। আড়াল করে রাখি। আড়ালে রেখে যে জীবনটা যাপন করি, সে জীবনটা হয়তো আসল জীবন নয়, বানানো।
.
৭ জানুয়ারি
কাল সারাদিন টেলিভিশনে তথ্যমন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির ক্ষোভ দেখানো হল। তিনি খুবই রেগে আছেন আমার ওপর। কেন আমি ইসলামের সমালোচনা করেছি। আমার কোনও অধিকারই নেই কোনও ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করার। এটা ভারতবর্ষ, এখানে এসব চলে না। বলেছেন আমাকে করজোড়ে ক্ষমা চাইতে হবে সব মুসলমানের কাছে। ইসলাম নিয়ে যা যা এ পর্যন্ত লিখেছি, সব কিছুর জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। বই থেকে ধর্ম নিয়ে লেখা যা কিছুই লেখা হয়েছে সব তুলে নেওয়া উচিত। আসলে, দ্বিখন্ডিত বইটিই নিষিদ্ধ করা উচিত। এর নাম ভারতবর্ষ, এখানে থাকতে হলে ধর্ম নিয়ে কথা বলা চলবে না।
এই প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিই হায়দারাবাদে আমার ওপর আক্রমণ হওয়ার পর তীব্র নিন্দা করেছিলেন সেই আক্রমণের, এমনকী এও বলেছিলেন, তসলিমাকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্র এখন ভেবে দেখবে। শুনে মনে হয়েছিল নাগরিকত্ব প্রায় হয়েই আছে, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি শুধু শুভদিনটি ঘোষণা করবেন আজ বা কাল।
প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি কি ইসলামে বিশ্বাস করেন? আমার মনে হয় না, বিশ্বাস করলে তিনি ধর্মান্তরিত হতেন। তিনি হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করেন সম্ভবত, অথবা কোনও ধর্মেই বিশ্বাস করেন না। তিনি নিশ্চয়ই জানেন ‘দ্বিখন্ডিত’র কিছু অংশ আমি বাদ দিয়ে দিয়েছি। দুঃখিতও হয়েছি কেউ দুঃখ পেয়ে থাকলে। তাহলে কে বা কী তাকে হঠাৎ করে আমার বিরুদ্ধে আগুন হতে বললো। লোকে বলে, মুসলমানের ভোট পাওয়ার জন্য এরকম করছেন রাজনীতিকরা। আমার খুব অবাক লাগে, ভোটের জন্য কি নীতি আর আদর্শ সব বিসর্জন দিতে হয়। বিসর্জন দিয়ে ভোট পেতে কি সত্যিই কারও কোনও আনন্দ হয়? নীতি আর আদর্শের কথা এইজন্য বললাম, যে, গণতন্ত্রের তো একটা নীতি আছে। সবারই কথা বলার অধিকার আছে, কারও কথা পছন্দ না হলে পাল্টা কথা বলল। গায়ে হাত তোলো কেন? মুন্ডু চাও কেন? তান্ডব করো কেন? মানুষের ক্ষতি করো কেন? আগুন জ্বালাও কেন? এসব তিনি মানেন না বলেই নয়ই আগস্টে হায়দারাবাদে আমার ওপর হামলা হওয়ার পরদিন আমার পক্ষে কথা বলেছিলেন। দশই আগস্টের সেই প্রিয়রঞ্জনকে আমার মানুষ প্রিয়রঞ্জন বলে মনে হয়। তখন তিনি সত্যিকার তাঁর বিশ্বাসের কথাই বলেছিলেন। তারপর এখন যা বলছেন, মুসলমানদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে হবে, রাজনীতিক হিসেবে বলছেন। মানুষ প্রিয়রঞ্জন আর রাজনীতিক প্রিয়রঞ্জন এক নয়, ভিন্ন লোক। রাজনীতিক হতে হলে হয়তো মানুষ হওয়া যায় না, মানুষটাকে বাদ দিয়ে রাজনীতিক হতে হয়।
কুড়ি বছর কম হলে বয়স, ওঁদের জন্য দুঃখ করতাম। এখন নিজের জন্য করি। নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য করি।
একটা অতি সাধারণ জন্ম, অতি সাধারণ বড় হওয়া, অতি সাধারণ জীবন যাপন করা মানুষের এ কী হাল! সে নাকি হয়ে গেল লোকের রাজনীতি করার বস্তু? তা-ও আবার এত বড় দেশ ভারতে? না, এই বস্তুটি হওয়ার যোগ্য নই আমি। এই বস্তু হতে গেলে আরও হয়তো যোগ্যতা থাকতে হয়। যারা অতি প্রশংসা করেন আমার, সেটা পাওয়ারও যেমন যোগ্য আমি নই, যারা অতি নিন্দা করেন, তা পাওয়ারও যোগ্য নই।
আজ টাইমস নাও টেলিভিশন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মন্তব্যের পর বললো যে যেদিন থেকে তসলিমাকে তাড়ানো হল কলকাতা থেকে, সেদিন থেকেই তসলিমা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অস্পৃশ্য। যাকে বলে আনটাচেবল। তা ঠিক। তসলিমা এখন এই ভারতবর্ষে আনটাচেবল একজন। কলকাতায় এখন ফেরা সম্ভব হত, যদি বড় একটা গণআন্দোলন হত। কিন্তু আমার পক্ষে কোনও গণআন্দোলন হওয়া সম্ভব নয় কোনও দেশে। কোনও জনমত গড়ে তোলার কাজও কেউ করবে না। আমি একজন লেখক। আমার কোনও দল নেই, সংগঠন নেই। আমি আগাগোড়াই একা একজন মানুষ। ভালোবেসে লিখি। তাগিদে লিখি। লিখে বাঁচি। শরীর বাঁচানোর চেয়ে বড়, মন বাঁচানো। বড় নিরীহ, বড় নিরুপদ্রব একটা মানুষ আমি। কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী আর রাজনীতিক আমাকে ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থে, এ আজ থেকে নয়, শুরু হয়েছে বহুকাল। আজও শেষ হয়নি। বিনা অপরাধে শাস্তি কী আর কোনও লেখক এমন পেয়েছে? অনেক লেখকের জেল ফাঁসি হয়েছে অনেক দেশে। কিন্তু এত দুর্ভোগ আর কাকে পোহাতে হয়েছে! যে লেখক নির্বাসনে আজ আছে, কাল সরকার বদল হলে তার নির্বাসন জীবনের ইতি ঘটে। আমার জীবনে নির্বাসনের কোন কূল নেই, কিনার নেই।
শঙ্খ ঘোষ ফোন করেছিলেন, ভেবেছিলাম কোনও সুখবর দেবেন। না, সুখবর দেবার জন্য নয়। দ্য স্টেটসম্যানে বের হওয়া আমার ব্যানিশড উইদ এন্ড উইদাউটটা বাংলায় কেউ অনুবাদ করে লিটল ম্যাগাজিনে ছাপাতে চাইছে, সেটার জন্য। কেউ কোনও সুখবর আর দিচ্ছেন না। শঙ্খ ঘোষের কাছে আর সুখবর নেই। তিনি কি ইচ্ছে করলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ফোন করে বলতে পারেন না আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিতে? দু’জনে তো ভালো বন্ধুত্ব। হয়তো ভাবছেন, বললে কোনও কাজ হবে না। এ কিন্তু একেবারে কেউই ভাবছেন না, কে জানে, হতেও পারে কাজ!!
যত দিন যাচ্ছে, তত আমার অস্থিরতা বাড়ছে। যত দিন যাচ্ছে তত বেশি কঠিন হচ্ছে কলকাতায় ফেরা। যত দিন যাচ্ছে তত রাজনীতি বাড়ছে আমাকে নিয়ে।
.
৮ জানুয়ারি
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, রাইটার ব্লকড় শিরোনামে। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি যে আমাকে করজোড়েমুসলিমদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলছেন, সেটার সমালোচনা করে লেখা। লেখাটির শেষ দিকটা এরকম ..The problem with such a political strat egy is that the more one appeases fundamentalists, thinking their point of view to be representative of a community, the more demands they’ll raise. And the more powerful they’ll become, once they’re seen to be effective in translating their views into state policy.
A secular state has to draw the line somewhere, otherwise it will give rise to a game of competitive fundamentalism that will damage the nation’s multicul tural fabric. Moreover, a democracy cannot stifle individual dissent. An individ ual, after all, is the smallest minority. It’s on his defence that democracy rests. When calling on Taslima to bend and scrape before religious authorities, it’s these democratic basics that the good information and broadcasting minister appears to have lost sight of.
আজ খবরে দেখলাম, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির বক্তব্য মেনে নিচ্ছে কংগ্রেস পার্টি। কংগ্রেসএর মুখপাত্র বলেছেন, ঠিক কথাই নাকি প্রিয়রঞ্জন বলেছেন, এবং কংগ্রেস এ কথা বিশ্বাস করে যে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত সমস্ত মুসলিমের কাছে।
কী ভয়ংকর সংবাদ!
এসব শুনে বিজেপি বলছে, যে, সোনিয়া গান্ধি আর মনমোহন সিংকেও ক্ষমা চাইতে হবে রামসেতুর মন্তব্যের জন্য। রাম বলে কেউ ছিল না কোনওদিন, রাম হল কবির কল্পনা, এ কথা বললে হিন্দুর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। সুতরাং ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন যদি ওঠে, তাহলে শুধু এক ধর্মের মানুষের কাছে কেন, সব ধর্মের মানুষের কাছে নয় কেন? ওরা যদি আঘাত পেতে পারে, এরাও আঘাত পেতে পারে।
আমি একটা অবিশ্বাস্যরকম নির্বোধ। একটা গাধার গাধা। দেশে দেশে অত্যাচারিত নানাভাবে। প্রাণের টানে বাংলায় থাকতে এসেছিলাম, নিজের মতো ছিলাম, নিজের ছোট্ট গন্ডি নিয়ে, বেশির ভাগ সময়ই ভীষণ একাকীত্বে ভুগেছি। আর আমাকে নিয়ে করা হচ্ছে রাজনীতি! ভারতবর্ষে! ভয়ে আমি খাস নিতে পারি না। আমার গা কাঁপে। হাত পা কাঁপে। এর পরিণতি কী? এভাবে একটা খোপের মধ্যে আমাকে আর কতদিন বাস করতে হবে।
.
৯ জানুয়ারি
আশ্চর্য, এও ঘটতে পারে। সাতটা মুসলিম সংগঠন, জামাতে ইসলামি, জমিয়তে উলেমা হিন্দ এবং আরও কটা সংগঠন সরকারের কাছে বলছে আমাকে যেন দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়। কোনও ভিসা যেন না দেওয়া হয়। জমিয়তে উলেমা হিন্দের যে মাদানি, যে লোক দ্বিখন্ডিত থেকে কিছু অংশ বাদ দেওয়ার পর বলেছিল, তারা আমার বিরোধিতায় আর যাচ্ছে না–এখন সেসব কথা ভুলে গিয়ে মহাসমারোহে লেগেছে আমার বিরুদ্ধে। জমিয়তের আরেক প্রধান নুমানি বলতে চাইছে যে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধেও লিখেছি, সুতরাং সব ধর্মের লোকেরা জড়ো হয়ে আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করুক। তারা এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাচ্ছে আমাকে ভারত থেকে তাড়ানোর জন্য। যোলো তারিখে নাকি আবার সর্বধর্মের সমন্বয়ে একটা সভাও করবে।
ওদিকে কলকাতার খবর হল, ওখানে সমাজবাদী দল আমার বিরুদ্ধে নেমেছে। ইদ্রিস আলী, যাকে ফুরফুরার ত্বহা সিদ্দিকী বলেছিল যে চেনেই না, ২১ নভেম্বরের ঘটনা থেকে নিজেদের অনেক কসরত করে সরাতে চেয়েছিলো, বলেছিল ইদ্রিস ডেকেছিল অবরোধের ডাক, ফুরফুরা ওতে মোটেও নেই, সেই ফুরফুরাই এখন ইদ্রিশের গলায় মালা পরাচ্ছে। যে কংগ্রেস দল থেকে ইদ্রিসকে বের করে দেওয়া হয়েছিল ২১ তারিখের পর, তাকেই যদি দলে ফের ফেরত নেওয়া হয়, প্রদেশ কংগ্রেসের নেতারা তান্ডবকারীদের ইন্ধন জোগানোর লোকটাকে যদি হাজতে দেখতে যেতে পারেন, ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে সংবর্ধনা দিতে পারেন, ফুরফুরা দেবে না কেন! এখন আবার সমাজবাদী দলের নেতা বিজয় উপাধ্যায়। নাকি বিষোদগার করেছে আমার বিরুদ্ধে। বইমেলা কমিটির কাছে চিঠি দিয়েছে, তারা চায়না তসলিমার কোনও বই মেলায় থাকুক। যদি তসলিমার বই মেলায় বিক্রি হয়, তবে ঘোষণা করে দিয়েছে, অগ্নিগর্ভ অবস্থা হবে আবার। এ নিয়ে নাকি গোয়েন্দা বিভাগ চিন্তিত। কী হবে তাহলে। আগে প্রশান্ত রায়কে বলেছিলাম কোনও বইযেন আমার না থাকে বইমেলায়। কিছু একটা গন্ডগোল হলে ওগুলো আবার ছুতো হবে আমাকে তাড়ানোর।
আজ শীলা রেড্ডি বললো, ‘কেন বই থাকবে না মেলায়, নিশ্চয়ই থাকবে। যা হয় হোক। আগুন লাগাবে? লাগাক। এত পিছু হটার কী আছে। ওরা বড় রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ছাড়পত্র পেয়ে গেছে যা কিছু করার। তাই করছে। এখন কোন জায়গায় সরকার একটা সীমারেখা টানবে, তার বোধহয় ভাবার সময় এসেছে।’
দিন দিন একা হয়ে যাচ্ছি।
অবস্থা দেখে মনে হয় না যে খুব ভালো দিকে এগোচ্ছে। সবচেয়ে জরুরী যে প্রশ্ন, তা হল, আমাকে বন্দি করা হয়েছে কেন। সরকার বলছে মুখ বন্ধ করে থাকো। আনন্দবাজার, যে পত্রিকা জনমত তৈরি করতে পারতো, করছে না, বরং বলছে, মুখ বন্ধ করে থাকো। শঙ্খ ঘোষ, যার ওপর আশা করে বসে আছি যে সরকারের সঙ্গে কথা বলবেন, বলছেন মুখ বন্ধ রাখো কিছুদিন, শীলা বলছে, তুমি মুখ বন্ধ রাখো, তোমার সম্পর্কে অন্যরা এবার বলুক।
কিন্তু অন্যরা তো কিছু বলছে না।
খবর দেবেন বলেছিলেন শ্যাম বেনেগাল। উত্তর এলো না। এমএ বেবি জানাবেন বলেছিলেন কংগ্রেসের কারও সঙ্গে কথা বলার পর, জানালেন না। ভ’বাবুর একজন। কাছের লোক আগে প্রায়ই ফোন করতো খবরাখবর জানার জন্য, এখন আর করে না। ও যা কিছু করে ভ’বাবুর অনুমতি নিয়ে করে। তবে কি আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করার কথা কেউ তাকে বলেছে? ভ’বাবুও কিছু জানাচ্ছেন না। তপন রায় চৌধুরী দেখা করেছিলেন তাঁর সঙ্গে। আমার সম্পর্কে কথা হয়েছে। ভ’বাবু নাকি বলেছেন যে তিনি। কলকাতায় আমাকে পাঠাবেন, চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু তপন রায় চৌধুরী ভরসা পাচ্ছেন না। বললেন, রাজনীতিকদের তিনি বিশ্বাস করেন না। টাইমস নাওএর সম্বিত পাল একদিন। ফোন করে বললো, ”দিদি, ভরসা তো কিছু দেখছি না, আমরা তো যতটা সম্ভব খবর করে যাচ্ছি, কিন্তু আপনার পক্ষে তো তেমন কোনও আন্দোলন গড়ে উঠছে না। জনমত তৈরি করার চেষ্টা করেও তো জনমত তৈরি করা যাচ্ছে না।
ঝাঁক ঝাঁক বিষণ্ণতার মধ্যে সুদুর থেকে সুখবর ভেসে আসে। আমাকে প্যারিসে সিমোন দ্য বোভোয়ার একশ বছর পূর্তি উপলক্ষে, মেয়েদের স্বাধীনতার জন্য লড়ার জন্য ‘সিমোন দ্য বোডোয়া পুরস্কার প্রদান করা হল। কাল রাতে আমার বক্তব্য লিখে পাঠিয়েছিলাম। ক্রিশ্চান বেস সেটা ফরাসিতে অনুবাদ করে পড়ে শুনিয়েছেন অনুষ্ঠানে। আমার পুরস্কারখানিও গ্রহণ করেছেন। সন্ধেয় ক্রিশ্চান বেস জানালেন যে মানুষ নাকি প্রচুর হাততালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। সকলে আমার নিরাপত্তা আর মুক্তির জন্য আওয়াজ তুলেছে।
ভারতবর্ষের মাটি কামড়ে পড়ে আছি মাটিকে ভালোবেসে, আর যে মাটি আমাকে টানে না, সেই মাটিতে মানুষ আমাকে ভালোবেসে পুরস্কার দিচ্ছে।
আমি কার? মাটির না মানুষের?
.
১০ জানুয়ারি
এক.
কলকাতায় বইমেলা। প্রতিবছরের মতো এবছরও। আমি থাকবো না।
ভারতে আসার অনুমতি যখন থেকে পেয়েছি, কোনও বছরই কলকাতার বইমেলায়। আমি অনুপস্থিত থাকিনি। বিদেশে যত কাজই থাকুক, ছুটে ছুটে এসেছি কলকাতায়, শুধু বইমেলার জন্য। আর, যখন থেকে কলকাতায় বাস করতে শুরু করেছি, বইমেলা তো ছিলই, বাড়ির কাছে, হাত বাড়ালে-ছোঁয়া-যায় দূরত্বে। একজন লেখকের জন্য বইমেলাই, আমার বিশ্বাস, সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। চারদিকে বই, লেখক কথা বলছেন পাঠকের সঙ্গে। লেখকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে লেখকের বই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। নতুন ভাবনারা ঘোরাফেরা করছে। মুক্তচিন্তার সবচেয়ে সুন্দর পরিবেশ তো বইমেলাই আমাদের দেয়।
কলকাতার বইমেলায় এবছর উপস্থিত থাকার কোনও সম্ভাবনাই, আমি আশংকা করছি, আমার নেই। কেন নেই, সে প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। খুব দুঃসময় এলে শুধু প্রশ্নই থাকে, উত্তর থাকে না।
খবর এলো, আমার বই যদি বইমেলায় থাকে, মৌলবাদীরা নাকি তান্ডব করবে। তান্ডব করাটা এখন খুব সহজ হয়ে গেছে অনেকের কাছে। তান্ডব করলে, যদি জানে, যে, তাদের ক্ষতি হওয়ার কোনও আশংকা নেই, বরং বাড়তি কিছু লাভ হবে, তবে করবে না-ই বা কেন!
নিজের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আমার চাওয়া কোনওকালেই খুব বড় কোনও চাওয়া ছিল না। বাংলার মেয়ে বাংলার মাটিতে নিভৃতে নিজের মতো করে বাস করতে চেয়েছিলাম, ওপারে সম্ভব না হলে, এপারে। কলকাতায় যে কটা বছর ছিলাম, আমি কোনও ক্ষতি তো করিনি কারও কারও পাকা ধানে মই দিইনি। কারও কিছু কেড়ে নিইনি। বরং অকাতরে দিয়েছি। যা-ই সম্ভব, যতটাই সম্ভব। নিজের বিশ্বাসের কথা লিখেছি। প্রায় দু’যুগ ধরে মানবাধিকার আর নারীর অধিকারের পক্ষে গোটা তিরিশেক বই লেখার পর কিনা আমাকে ইসলাম-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হল। যেন ইসলামের বিরোধিতা করাই আমার লেখালেখির উদ্দেশ্য, আর কিছু নয়। এত ভুল, এত মিথ্যে গায়ে সেঁটে দিলে কী ভয়ংকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, সে কী দেখছি না! একজন সমাজ-সচেতন লেখকের জন্য এর চেয়ে ক্ষতিকর আর কী হতে পারে! রাজনীতির ধারে-কাছে-না-থাকা কোনও লেখককে যদি রাজনীতির খুঁটি হতে হয়, তবে দুর্যোগের কিছু আর বাকি থাকে না।
কলকাতায় আমার একলা-পড়ে-থাকা বাড়িটির প্রায়-আঙিনায় বইমেলা হচ্ছে এবার। পার্কাসে। আমার বন্ধুরা, চেনা-পরিচিতরা, মুখচেনা-অচেনারা সবাই যাবে মেলায়, কেবল আমারই যাওয়ার কোনও উপায় নেই। যতদিন বইমেলা চলবে কলকাতায়, ততদিন দিল্লির একটি ঠিকানাহীন ঘরে একলা বসে থাকতে হবে সারাবেলা ধুলোয় ধূসর হয়ে মেলায় ঘুরে বেড়ানোর সেইসব স্মৃতি সামনে নিয়ে। আমার তো হাত পা বাঁধা। মানুষের স্বাধীনতার কথা লিখে নিজের স্বাধীনতাই হারাতে হয়েছে। আমার তো কোনও শক্তি নেই বইমেলায় আগের মতো হাঁটার, চলার। আগের মতো উৎসবে সামিল হওয়ার।
আমি বিশ্বাস করতে চাই না আমার জীবন থেকে বাংলার বইমেলা চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। বিশ্বাস করতে চাই না আমার সুখ, স্বপ্ন, আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা সবকিছুরই কবর হয়ে গেছে।
এখনও আমি স্বপ্ন দেখি। এখনও ভালোবাসা পেতে সাত সমুদ্র পেরোই। একা, এক-ঘর অন্ধকারে, ভীষণ বেদনায় যখন নুয়ে থাকি, হতাশার চাবুক এসে জীবনকে রক্তাক্ত করতে থাকে, ভালোবেসে একখানা হাত কেউ যদি তখন রাখে হাতে, কী যে আশ্চর্য বেঁচে উঠি। ওই ওটুকু স্পর্শই আমাকে আবার স্বপ্নের দিকে আলোর গতিতে টেনে নিয়ে যায়।
একজন লেখকের সঙ্গে যেমন শব্দের একটা গভীর সম্পর্ক থাকে, বাঙালি একজন পাঠকের সঙ্গেও থাকে বাংলা-বইমেলার সেই সম্পর্ক। এ বছর আমাকে না হয় বিচ্ছিন্ন করা হল। প্রিয় বইমেলা থেকে, আগামি বছর থেকে বাকি জীবন যেন বাংলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন থাকে, অবিচ্ছেদ্য থাকে।
কেউ কেউ আমার নিরাপত্তার কথা বলছে। আমি জানি, মানুষের ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। গত তিনবছর কলকাতা শহরের ভিড়ের রাস্তায় কোনও নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই আমি নির্বিঘ্নে হেঁটেছি। আমাকে কোনওদিন বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করতে হয়নি। হঠাৎ কী এমন ঘটে গেল! দুটো লোক সিটি বাজাবে বলে কি আমরাসিনেমা দেখতে যাই না, বাজার হাট করি না। আমরা কি জানি না দুটো লোকের সিটি বাজানোয় সায় দিলে দশটা লোকে সিটি বাজায়! আমরা জানি সব। তারপরও মুখ বুজে থাকি। মুখ বুজে থাকতে থাকতে আমরা বছর গেলে, বয়স গেলে বুঝি যে, মুখ বুজে থাকাটাই আমাদের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুই.
সকালে সিগারেট খাচ্ছিলাম। মরতে চাইছি মনে হয়। হ্যাঁ তাই তো। তা না হলে সিগারেট আনাবো কেন? একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছি কেন। আমি কি জানি না সিগারেট আমাকে বছরের পর বছর কী করে খেয়েছে! কী কষ্ট হয়েছে সিগারেট ছাড়তে, ভুলে যাওয়ার কোনও তো কারণ নেই! সব জেনেও, সব বুঝেও আমি সিগারেট ধরাই। হাসিখুশি অফিসার মেয়েটির চোখে আমার জন্য করুণা।
–কেন, সিগারেট কেন?
–উত্তর তো খুব সোজা।
–কীরকম সোজা?
–ডিপ্রেশন।
–এদের রাজনীতির কারণে তুমি তোমার এসেন্সকে নষ্ট করবে কেন? তুমি তোমাকে ধ্বংস করবে কেন? তুমি এসবের ঊর্ধ্বে। এইসব তুচ্ছ রাজনীতি, নোংরামির কাদায় তুমি নিজেকে ডোবাবে কেন? তুমি কি এসবকে তুচ্ছ করতে পারো না?
–কী হবে..
–কী আর হবে। যা হয় তা হবে। এত ভাববারই বা কী আছে। তুমি অনেক বড়। তুমি কোনও ভুল করোনি। তোমাকে আটকে রেখেছে বলে তুমি নিজেকে ঝরে যেতে দেবে কেন? তাহলে তো তাদেরই জয় হল। বেঁচে থাকো, তোমার আদর্শ, তোমার দৃঢ়তা সবকিছু নিয়ে তীব্র ভাবে বাঁচো। তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। এখানকার রাজনীতি নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই।
–কবে যে শেষ হবে এখানকার বাস….
–শেষ তো নিশ্চয়ই একদিন হবে। এইভাবে তো চলতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনও কোনও সমাধানে আসবে সরকার।
–খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সিগারেট এই যে খাচ্ছি, অবশ্য ভেতরে ফুসফুসে ধোঁয়া নিচ্ছি। আশংকা হচ্ছে, আবার না নেশা হয়ে যায় ..
–সিগারেট ছাড়ো। বাঁচো। ইন্ডিয়া ইজ নট এভরিথিং।
ইন্ডিয়াইজ নট এভরিথিং, এই বাক্যটি আমাকে একটু হয়তো শক্তি দিল। দুপুরে লিখলাম। বিকেলে স্নান করলাম। পরিষ্কার জামা কাপড় পরলাম। সন্ধের দিকে যখন পাখিদের নীড়ে ফেরার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, পাখিরা নীড়ে ফিরছে, আমারই নীড় নেই ফেরার, মেয়েটি পাশে বসে বললো, ‘ওদের তো নীড় ভেঙে যায়। আবার গড়ে।’
–হ্যাঁ আমার মতো। কত নীড় গড়লাম। কত দেশে। ভাঙলো। আবার গড়লাম।
–তোমার কি কখনও ইচ্ছে হয় কেউ থাকুক জীবনে? সঙ্গে কেউ আছে, পাশে কেউ আছে, এই অনুভূতিটা ইচ্ছে হয় না?
–হ্যাঁ ইচ্ছে হয়। কিন্তু সবসময় ভুল মানুষকে সঙ্গী ভেবে ভুগেছি।
–একা লাগে না?
–লাগে হয়তো মাঝে মধ্যে। কিন্তু একাই তো বাস করছি দীর্ঘকাল। কেউ এসে আমার স্বাধীনতার ব্যাঘাত ঘটাক চাই না। ভালোবাসায় আপত্তি নেই।
.
১১ জানুয়ারি
৪.২৭ একটা দুঃস্বপ্ন আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। দুঃস্বপ্ন, আমার ওই নীল বইটা, ভারত বাসের অনুমতির বইটা কারা যেন ছিঁড়ে ফেলেছে টুকরো টুকরো করে। কোথাও একটা ঝগড়াঝাটি চলছে। টুকরোগুলো কুড়োতে চেষ্টা করছি আমি, টুকরোগুলো জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করছি। কোত্থেকে দমকা হাওয়া এসে টুকরোগুলোকে উড়িয়ে নিচ্ছে। আমার ঠিক মনে নেই আমি ওই কাগজগুলোর পেছনে দৌড়োচ্ছিলাম নাকি স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে ছিলাম।
৪.৩০ সিলিংএর দিকে তাকিয়ে থাকি। সাদা সিলিং। সাদা একটা পাখা ঝুলে আছে। প্রায় একই রঙের। পাখাটা স্থির হয়ে আছে। এ দেশে স্থির হয়ে থাকা পাখা খুব চেনা দৃশ্য নয়। ঘুরতে থাকা পাখা দেখেই মানুষ অভ্যস্ত। পাখার মতো আমিও ঝুলে আছি। জানিনা কোত্থেকে ঝুলে আছি, আর যদি বাঁধন ছুটে যায়, তাহলে ঝুলে থাকা আমার পতন হবে কোথাও কোথায়, জানি না।
৪.৪০ বুকটা বড় খালি খালি লাগে। প্রচন্ড শীত করতে থাকে।
৪.৪২ মাকে মনে পড়ে। আমি চোখ বুজি। মাকে আমার স্পর্শ করতে ইচ্ছে হয়। মাকে বড় জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। মার কানে কানে বলতে ইচ্ছে হয়, মা তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো, মা তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো।
৪.৪৫ বালিশে গড়িয়ে পড়তে থাকে চোখের জল।
৪.৪৬ আমার ভারী নিশ্বাসের শব্দ শুধু। চারদিকে আর কোনও শব্দ নেই। কবরের নিস্তব্ধতা চারদিকে। চোখের জল পড়ার কোনও শব্দ হয় না। ও নিঃশব্দে পড়ে।
৪.৪৮ বিছানা ছেড়ে উঠি। বিছানার এক পা দূরেই ছোট একটা টেবিলের ওপর আমার ল্যাপটপ। ল্যাপটপ চালু করি। এই ল্যাপটপটিই নিয়ে বেরিয়েছিলাম, যখন বেরিয়েছিলাম। দুদিনের জন্য যেতে বলেছিল, কোথায় নাকি কোন রিসর্ট আছে, থেকে রোববার কী সোমবার ফিরে আসবো। এখনও ভাবলে কেমন গা ছমছম করে। আমাকে। তাড়াবার জন্য কী ভীষণ ফাঁদ পেতেছিলো ওরা।
৪.৫০ গুগলে খবরগুলো দেখি। মেরিনিউজ ডট কমের একটি খবর পেয়ে খুব মন খারাপ হয়ে যায়। লেখক বলছেন আমি সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ করছি। বলেছি আমি নাকি গৃহবন্দি অবস্থায় আছি। আমি নাকি এখানে সুখে নেই। কত বড় স্পর্ধা আমার যে সুখ চাইছি। দাবির শেষ নেই আমার। কত টাকা খরচ হচ্ছে আমার পেছনে, অথচ সাত হাজার কী দশ হাজার মেয়ে আজ দিল্লির রাস্তায় গৃহহীন পড়ে আছে।
লেখাটা আমাকে চুপসে দেয়। আমি কি ইচ্ছে করে এখানে এসেছি? সরকারের টাকায় খাওয়া দাওয়ার ইচ্ছে কি আমার ছিল, নাকি আছে? আমি তো নিজের পয়সায় থাকি এ দেশে। কেউ আমাকে দুটো পয়সা দিয়ে সাহায্য করে না। বরং আমিই দিই। দরিদ্রকে যখনই যেভাবে পারি সাহায্য করি। এখানে গৃহবন্দি আমাকে করতে বলেছে কে? একটা জিনিসই আমি প্রাণপণে চাই, সে হল মুক্তি। স্বাধীনতা এবং স্বনির্ভরতা ফিরে পেতে চাই, যে দুটো পেতে জীবনভর কঠিন সংগ্রাম করছি।
৪.৫০ দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘশ্বাস।
৫.০০ ইমেইলগুলো পড়ি। একটা ইমেইল প্যারিস থেকে। আমি সেই পুরস্কারটি কালই পেয়ে গেছি। সিমোন দ্য বোভোয়া’র জন্মশতবার্ষিকীতে পুরস্কারটি দেওয়া হল। সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কার। খুব বড় বড় দার্শনিক, লেখকেরা ছিলেন, কেট মিলেটও ছিলেন জুরি হিসেবে।
৫.২০ একটা ভালো লাগা আমাকে ছুঁয়ে থাকে। আমি কল্পনা করে নিতে পারি প্যারিসের কোনও বড় অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান ঠিক কেমন হতে পারে, ওরকম অনেক অনুষ্ঠানে আমি কথা বলেছি। হাজার হাজার শিক্ষিত, সচেতন, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, দার্শনিকের সামনে আমি বক্তৃতা দিয়েছি। ওই দূর দেশের সমর্থন আমার কাছে কী রকম যেন এখন রূপকথার মতো লাগে তবু। এই বন্দি জীবনে সুদূরের সমর্থন আমাকে মুক্তির কোনও গল্প শোনাতে পারে না।
.
১২ জানুয়ারি
এক.
মাঝে মাঝে ভাবি কলকাতায় থাকার জন্য এত পাগল কেন আমি? কলকাতা আমাকে কী দিয়েছে? আমার কি খুব সামাজিক জীবন ছিল কলকাতায়। দিনের পর দিন কি আমি একাকীত্বে ভুগিনি? কোনও সাহিত্যিক আজ্ঞা কি হত আমার বাড়িতে? না। চারদিকে অনুষ্ঠান, চারদিকে উৎসব লেগেই থাকতো কলকাতায়। কোথাও কি খুব ডাক পড়তে আমার! মাঝে মাঝে রঞ্জন হয়তো কোথাও যেতে বলতো, তাও তার যদি অকস্মাৎ কোনও কারণে আমার কথা মনে পড়তো, অথবা কেউ যদি তাকে বলতো আমাকে ডাকার জন্য। যে হাতে গোনা ক’দিন আমি গিয়েছি সন্ধের পার্টিতে, আমার ভালো লাগেনি। মদ খেতে পছন্দ করলে, অথবা সাজগোজের অভ্যেস থাকলে হয়তো ওসব খুব পছন্দ হত, কিন্তু ওসব পছন্দ করার অন্তত আমার কোনও কারণ ছিল না। ভালো লাগার মধ্যে কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া। কিছু মানুষের সঙ্গে দু চারটে কথা বলা। যে কোনও কথাই তো আমার মনে ধরে না। বুদ্ধিদীপ্ত কথা খুব শুনিনি। যশ খ্যাতির পেছনে দেখেছি লোকে পড়ি কী মরি দৌড়োয়।
কলকাতায় বাস শুরু করার বছরখানিক পর থেকেই লক্ষ্য করেছি আমাকে এড়িয়ে চলেছে আনন্দবাজার। বড়লোকের খেয়াল। নারীর কোনও দেশ নেই’ পান্ডুলিপি আনন্দ পাবলিশার্সে দেওয়ার পরও ছাপাবে না বলে ফেরত দিয়ে দিয়েছে। আমার খবর হয়তো মাঝে সাঝে ছাপায়, যেহেতু ওগুলো খবর। কিন্তু লেখক হিসেবে নামটা মুছে দিয়েছে। দু’দুবার আনন্দ পুরস্কার দেওয়ার পরও। দুঃখ করা ছাড়া আমার কিছু করার নেই। দৈনিক স্টেটসম্যান-এ প্রতি বুধবারে লিখতাম। নিয়মিত কোথাও লিখতে পেরে অনেকটা দুঃখ ঘুচেছিল বটে। সামাজিক জীবন বলতে সত্যি কিছু ছিল না। হাতে গোনা ক’জন বন্ধু বাড়ি আসতো। তারা বেশির ভাগই সাহিত্যশিল্প জগতের বাইরের লোক। ওই জগতের যাদের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল, ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গিয়েছিল সেটা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার বই নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারকে আবেদন করার পর থেকে এবং সরকার সে আবেদন রক্ষা করার পর থেকে সুনীল এবং সুনীলের শিল্পী সাহিত্যিক বন্ধু ও শিষ্য এবং সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পী সাহিত্যিক শিষ্য সবাই আমাকে তাদের শত্রু জ্ঞান করাটাকেই রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে যৌক্তিক বলে মনে করেছেন এবং আমার থেকে দূরে থেকেছেন। যদিও আমি অসম্ভব আন্তরিক, এবং প্রাণবন্ত একজন মানুষ, এই আমাকেই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়েছে কলকাতায়, মাসের পর মাস। তাহলে কী আছে কলকাতায়? কেবল কি ভাষাটার জন্য? কেবল কি মাঝে মাঝে ওই দু’একজন বাঙালির সঙ্গে বাংলায় কথা বলার জন্য? মাঝে মাঝে বাংলা কোনও নাটক দেখার সুযোগ হয়, সে কারণে? ভোরে ঘুম থেকে। উঠে চা খেতে খেতে পড়া যায় বাংলা পত্রিকা? তাছাড়া আর কী?
আমার কোনও দ্বিধা নেই বলতে, যে–আমি খুব বেশি কোনও সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক পরিবেশ পাইনি। ব্রাত্য ছিলাম নাকি সেলিব্রিটি ছিলাম! দুটোতে মাঝে মাঝে তফাৎ খুব একটা থাকে না।
সুবিধে লুটতে অনেকে আসতো। রঞ্জন সেনগুপ্ত নামে এক বয়স্ক লোক হঠাৎ বন্ধু সেজে উদয় হল। ছলে কৌশলে কেবল টাকা নিত। দুদিন বাদে ফেরত দেবে বলে একবার বিরাশি হাজার টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দেয়নি।
কাজের লোক নিয়েও ভুগেছি কম নয়। এমন বন্ধু কেউ ছিল না যে একজন বিশ্বস্ত কাউকে দেবে ঘরের কাজকর্মে আমাকে সাহায্য করার জন্য। বিশ্বাস করে যাকেই ঘরে ঢুকিয়েছি, সেই বিশ্বাস ভেঙেছে।
দুই.
আমাকে নজরবন্দি করার জন্য বা আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য, বা আমাকে সাহায্য করার জন্য যে দুজন লোক থাকে, যদিও ওরা বলে যে আমার কাছে ওরা আসছে আমাকে দেশ থেকে তাড়াবার কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, আমার মনে হয় ওরা বোধহয় সত্য বলছে না, ওরা জানে সবকিছু, ওরা কায়দা করে আমার ভেতরের খবর নেয়–কিছু ভাবছি কি না, ভাবলে কী ভাবছি, চলে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আসছে কি না। হঠাৎ কেউ কেউ তো বলেই, ‘তারচেয়ে বিদেশই ভালো। যে দেশে ফ্রিডম আছে, সে দেশই তো ভালো। মাঝে মাঝে না হয় বেড়াতে এলে ভারতে। ওরা কি এই কথা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলে, বন্ধু ভেবে বলে, না কি ওপরওয়ালারা শিখিয়ে দিয়েছে বলতে, তাই বলে! আমি বুঝে পাই না। আমার বোধহয় খুব সন্দেহ-মন, অথবা পরিস্থিতি আমাকে সন্দেহপ্রবণ করেছে। অথবা চারপাশে যা চলছে, তা আরও অনেক গভীর জলের খেলা। আমি শুধু ওপর থেকে দেখছি এবং বিচার করছি। আমি আস্ত একটা বোকা।
সারাদিন লেখার চেষ্টার সঙ্গে লিখতে পারা এবং না পারা মিলিয়ে দিলে যা হয়, হয়েছে। সারাদিন আরও কিছু ঘটেছে। কিছু ছেলেমেয়ে আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সই সংগ্রহ করতে বেরিয়েছে কলকাতায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সই দিলেন, তবে বললেন, ‘যেরকম প্রচার করা হচ্ছে ওর ব্যাপারে, যে, দিল্লিতে ওকে নিজের মতো থাকতে দিচ্ছে না, তা কিন্তু ঠিক নয়। ও কিন্তু খুব ভালো আছে। মৃণাল সেনএর কাছেও গিয়েছিল ওরা। মৃণাল সেন এমনকী ফোনে আমার সঙ্গে কথাও বললেন। আমি কেমন আছি শুনে তিনি বললেন, এ কী, এ তো কল্পনা করা যায় না। কিন্তু সই দেননি। ওদেরকে বলেছেন, ‘লেখাটা কড়া হয়ে গেছে, আরেকটু নরম করে লিখে নিয়ে এসো, সই দেব।
ওরা যখন বললো যে আপনিই নরম করে লিখে সই করে দিন। তখন তিনি নিজে লেখার বদলে মনসিজ মজুমদারকে ফোনে বললেন, নরম করে লিখে দিতে।
সই দিয়েছেন বিজয়া মুখোপাধ্যায়, তবে নাকি কিছু কথা শুনিয়ে, অ্যাপোয়েন্টমেন্ট না করে গেছে কেন, ইতাদি। শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় ঘুমোচ্ছিলেন, সই দিতে পারেননি। বাংলার কবিদের মধ্য থেকে সততা দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু শরৎএর মধ্যে এখনও অবশিষ্ট আছে। এখনও তিনি দিব্যি তসলিমার মতো নিষিদ্ধ লেখককে নিয়ে খচখচ করে দুটো তিনটে কবিতা লিখে চমকে দিতে পারেন লোকদের। দিব্যেন্দু পালিত সই দিয়েছেন, তবে বলেছেন, ‘এসব সরকারের ব্যাপার, সই দেওয়ার কোনও অর্থ হয় না।
কী হয় সইয়ে? এর আগে দু’জন ছেলে, আমার সঙ্গে পরিচয় নেই, শুনেছি, পত্রিকায় পড়েছি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে সই সংগ্রহ করেছিলো। ছ’হাজার সই দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠিয়েছিল। কোথায় ওই সইওয়ালা কাগজগুলো? নিশ্চয়ই ময়লা ফেলার বাক্সে।
.
১৩ জানুয়ারি
সকালে এনামুল কবীর পড়ে শোনালেন কলকাতা থেকে আজকের কাগজে লেখা গিয়াসুদ্দিনের একটা লেখা। এনামুল কবীর প্রায় প্রতিদিনই এ কাজটি করছেন। তসলিমা, আপনার অপরাধ আপনি মুসলিম পিতামাতার সন্তান। গিয়াসুদ্দিন অকপটে জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মৌলবাদীরা ছাড়া মুসলিম মৌলবাদীদের সবাই ভয় পায়। মহান নেতা নেত্রী বুদ্ধিজীবী লেখক শিল্পী সাহিত্যিক সবাই। মুসলমানদের মধ্যে যারা গোঁড়া নয়, তারা ভয়ে কাঠ হয়ে থাকে। আর, অমুসলমান আর অসাম্প্রদায়িক যারা, তাদের ভয়, পাছে যদি ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিতে দাগ লেগে যায়। হিন্দু মৌলবাদীদের দ্বারা যারা আক্রান্ত, তাদের পাশে বিদ্বজ্জনেরা দাঁড়ান, কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ান না।
গিয়াসউদ্দিন বলছেন, রাজনীতিকদের এই প্রশ্নটা তিনি করছেন না। কারণ ওরা ক্ষমতার দাস, মোল্লা তোষণ ওদের ধর্ম। প্রশ্নটা লেখক শিল্পী সাহিত্যিক বিদ্বজ্জনের কাছে। যাঁরা হিন্দু মৌলবাদী দ্বারা আক্রান্ত সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়ান, তাঁরা মুসলিম মৌলবাদীর হাতে আক্রান্ত কারও পাশে, বিশেষ করে সে যদি মুসলমান পরিবার থেকে আসে, দাঁড়াতে পারেন না কেন? উত্তর তিনিই দিয়েছেন। উত্তর হল, মুসলিম মৌলবাদীদেরকে ভয়। আর, তারা ভাবেন, যারা আক্রান্ত এবং আক্রমণকারী তারা উভয়ে মুসলমান, সুতরাং ওসব মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
গিয়াসউদ্দিন বলছেন, তসলিমা, আপনার প্রশ্ন কী দোষে আপনাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে? আপনার বিরুদ্ধে যে দোষগুলোর কথা বলা হচ্ছে, তা সব আরোপিত, সব মনগড়া, সব অযৌক্তিক। আসলে দোষ আপনার একটাই, আপনার জন্ম মুসলিম পরিবারে। মুসলিম পরিবারে জন্মালে যুক্তিবাদী হওয়া যায় না, নারীবাদী হওয়া যায় না, মানববাদী হওয়া যায় না, প্রতিবাদী হওয়া যায় না। আপনি এসবই হয়েছেন, তাই মোল্লা মুফতিরা আপনাকে ক্ষমা করবে না। কোরান হাদিস আপনাকে ক্ষমা করতে বলেনি। আর মোল্লারা যাকে শত্রু ঘোষণা করে, আমাদের বিদ্বজ্জনেরা তাদের পাশে দাঁড়ায় না। আমাদের বিদ্বজ্জনেরা যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, আপনার পাশে দাঁড়িয়ে কেন তারা সাম্প্রদায়িক হতে যাবেন?
এসব কথা আগেও হয়েছে। হিন্দুরা, বা হিন্দু বংশোদ্ভূত অতি সৎ ও সাহসী সেকুলাররা লিখেছেন। মুসলমানরা লেখেন না এভাবে। গিয়াসুদ্দিন আপাদমস্তক নাস্তিক বলেই লিখতে পেরেছেন। তবে ভারতবর্ষে মুসলমান পরিবারে জন্মে নাস্তিক হওয়ার চল খুব বেশি নেই। গিয়াসউদ্দিনের মতো আরও কয়েকজনকে আমি একসময় আবিষ্কার করে একত্র করেছিলাম। ধর্মমুক্ত মানববাদী মঞ্চ গড়ে তুলেছিলাম। যেন মুসলমানদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারমুক্ত মানসিকতা গড়ে ওঠে। ধর্মীয় সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ, এবং ধর্মমুক্ত শিক্ষার দাবি, নারীর সমানাধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি দাবি নিয়েই গড়া হয়েছিল মানববাদী মঞ্চ।
গিয়াসউদ্দিনকে ফোনে ধন্যবাদ জানাই। কাল ওদের প্রেস কনফারেন্স। কলকাতায়।
আজ মন ভালো করা আরও একটা খবর আছে। হিন্দুস্থান টাইমসে করন থাপর খুব ভালো লিখেছেন। লিখেছেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, ভারতের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী যে আমাকে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে বললেন মুসলমানদের কাছে, যেহেতু তাদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি, মূলত সেটার সমালোচনা করেই লেখা। থাপর বলছেন, কারা তারা, যাদের অনুভূতিতে মোটেও আঘাত দেওয়া যাবে না? কারা তারা, যাদের সামনে তসলিমাকে নত হতে হবে এবং করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে? নিশ্চয়ই তারা আমরা নই, আমি নই, আপনি নন, কোনও উদার সহনশীল মানুষ নন, কোনও যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী মানুষ নন, শিক্ষিত, সচেতন কেউ নন, তারা সংকীর্ণ, স্বার্থান্ধ, ধর্মান্ধ, মোল্লাশ্রেণী। আমাদের স্বাধীনতার সীমানা কি তারা মেপে দেবে? এ দেশে কী মানা যাবে এবং কী যাবে না তার নিয়ম তৈরি করার দায়িত্ব তাদের কে দিয়েছে?
I have to assert that when Mr. Mukherjee says Taslima Nasreen must not say, do or write things that”hurt the sentiments of our people”, I do not recognise the pronoun ‘our’. Am I part of it? Are you? Is he? Or does he only have in mind a small but vocal and violent minority –perhaps disowned by, or at least, em barrassing to the majority of their co-religionists –who, he believes, delivers votes?
We don’t expect very much of our politicians –if there is one lesson experi ence has taught us, it must be this –but, at the very least, they should stand up for our freedoms. Otherwise, they could soon be tolling the bell for them selves. Let them remember what they deny Taslima or us today; they could end up losing themselves tomorrow.
প্রভু, যিনি আমার স্বাধীনতার বাহন নিয়ে আসেন এখানে, তিনি এলেন। কী, আমাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। কোথাও যাবার প্রস্তাব এলে আমি লাফিয়ে উঠি। কিছুক্ষণের জন্য হলেও বেরোনো তো যাবে এই বন্দিত্ব থেকে। সে যে উদ্দেশে হোক না কেন।
গাড়ি চলতে শুরু করলো। নতুন পথ। চারদিক দেখতে দেখতে যাই। এ অনেকটা প্রিজন ভ্যানে করে কোথাও যাবার মতো। কালো কাঁচ জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। বাইরে জীবন। মানুষ যারা যাচ্ছে নিজের কাজে, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, কার কী দায় পড়েছে আমাকে চেনার, আমাকে নিয়ে ভাবার, আমাকে মারার! কারও না। গাড়িতে তো নিরাপত্তা রক্ষী নেই। গাড়ির সামনের কাঁচ দিয়ে রাস্তার লোকে আমাকে দেখছে, তাতে হয়েছেটা কী? কারও কিছু যায় আসে না। যে চেনে, সে চেনে। যে চেনে না, সে চেনে না। তবে কেন বন্দি করা আমাকে?
আমি বেরোলে নাকি দেশের দশটা লোক মরে যাবে। এই প্রশ্নের উত্তর তারা যা দেন, আমি তা মানি না। ওই উত্তরের কোনও যুক্তি নেই।
আমার আনন্দ হয় নতুন রাস্তা দেখে, তার মানে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডেন্টিস্টের ক্লিনিকে। প্রভুকে কিছু জিজ্ঞেস করি না। কিন্তু যখন একটা গলিতে ঢোকে গাড়ি, চুপসে যাই, এ তো সেই গলি। সেই চেনা গলি। সেই ভুতুড়ে নিরাপদ বাড়ি’র গলি। সেই একই বাড়িতে আনা হল আমাকে, যে বাড়িতে কেউ বাস করে না। উঁচু দেয়াল ঘেরা বাড়ি। উঁচু লোহার গেটওয়ালা বাড়ি। বাড়িটিতে চা বিস্কুট দেওয়ার জন্য লোক আছে, এ লোক আমার বিশ্বাস, খবর পেয়ে বাড়িতে আসে।
মাঠটায় হাঁটি। ওই মাঠটুকুই আমার স্বাধীনতা। গন্ডি যখন কমে আসে মানুষের, এক টুকরো জায়গাই কী বিশাল বলে মনে হয়।
ডেন্টিস্ট আসেন। ছোট পুঁটলিতে করে দাঁত দেখার জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন। কী হত, যদি তার ক্লিনিকে যেতাম? ওষুধপত্র লিখে দিলেন। ফেরার পথে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ওষুধপত্র কিনে প্রভু আমাকে রেখে চলে গেলেন। কারাগারটিতে রেখে গেলেন।
বাকি সময় আমার পেরোলো। যে কোনও দিনের মতোই। যে কোনও রাতের মতোই।
.
১৪ জানুয়ারি
আজ কলকাতায় মুসলমানদের প্রেস কনফারেন্স হচ্ছে। প্রগতিশীল মুসলমান অথবা প্রাক্তন মুসলমান অথবা মুসলমান সম্প্রদায়ের মুসলমান নামের ধর্মহীন মানুষেরা প্রেস কনফারেন্সে বলবেন, যে, তসলিমাকে তারা ফেরত চান কলকাতায়। মুসলমান সমাজের উন্নতির জন্যই তসলিমাকে তাঁদের প্রয়োজন।
না। আজ বিশেষ কিছু ঘটলো না। পিটিআইএর সুপ্রতীককে সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কারের কথা বলাতে আজ দ্য হিন্দু আর হিন্দুস্থান টাইমসসহ কিছু কাগজে দেখলাম খবরটা। যে লেখালেখির জন্য ফ্রান্সে আমাকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে, সেই একই লেখালেখির জন্য বাংলাদেশে আর ভারতে আমাকে অপমানিত করা হল। এ ছাড়া বলার আমার কিছু নেই।
ফোন কিছু কলকাতা থেকে আসে। ফোন কিছু যায়। ফোনের আসা যাওয়ার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। হ্যাঁ কমছে। শঙ্খ ঘোষ ফোন করলেন। অভিনন্দন জানালেন সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কার পাবার জন্য। জিজ্ঞেস করলেন, ফ্রান্সে লিখেছি, যে, এখানে কেউ নেই পাশে’, সে কেন। বললাম ‘পুরোনো একটা লেখার অনুবাদ ওটি। তখন সত্যি বলতে কী কেউ ছিল না। মনে মনে বলি, এখনই বা কে আছে, কী আছে! গুটিকয় মানুষ আছে শুধু, রাজনৈতিক অরাজনৈতিক কোনও দল টল তো নেইই। বললাম, প্রথম দিকে, মহাশ্বেতা দেবীরা সভা বা মৌন মিছিল করার আগে, সত্যিই তো কিছু তো হচ্ছিল না। ঠিকই তো, কোনও রাজনৈতিক দল কি বলেছে কিছু, এত নারীবাদী সংগঠন, এত মানবাধিকার সংগঠন, কিছু তো বলেনি তারা। সেই সময়টায় ওই লেখাটা লিখেছিলাম। ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে ল্য মদ ছাপিয়েছে।
বললাম, তা ছাড়া পরে যে লেখাটা লিখেছি, যেটা আপনি কিছু লাইন কাটলেন, সেখানে তো সবাইকে আমি ধন্যবাদই জানিয়েছি।
–হ্যাঁ। সেটা পরের লেখা। ছাপা হওয়াটা আগের লেখা।
বুঝলেন শঙ্খ ঘোষ।
শঙ্খ ঘোষ বারবার বোঝাতে চাইছেন অনেকে আছেন আমার সঙ্গে। বলেছিলেন ভ’বাবুকে বলবেন আমাকে যেন কলকাতায় ফেরত পাঠান। ভ’বাবুকে অবশ্য এখনও তাঁর সেই জরুরি ফোনটা করা হয়নি। তিনি কি সত্যিই পাশে আছেন! যখন অভিযোগ করা হচ্ছে আমি মুসলিম বিরোধী, তিনি চুপচাপ শুনছেন। কোনোদিন তো প্রতিবাদ করেননি, বলেননি সেই ঘটনাটির কথা, বছর কয়েক আগে আমি যে তাঁর হাতে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলাম গুজরাতের দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মুসলমানদের জন্য সাহায্য করতে। টাকা সংগ্রহ করার ভার ছিল তাঁর। আমি ফলাও করে প্রচার চাইনি কিন্তু মিথ্যে অভিযোগে যখন আমাকে দেশ থেকে তাড়ানো হচ্ছে, তখন তো বলা যেত।
শঙ্খ ঘোষ যে সাহায্যটি করলেন, তা হল, আমার যে লেখাটা পড়া হবে অনুষ্ঠানে বা ছাপা হবে পত্রিকায়, সেটি সংশোধন করে দিলেন, মৌলবাদী মুসলমানদের আঘাত করতে পারে, বা সরকার ক্ষুব্ধ হতে পারেন এমন কোনো শব্দ বা বাক্যের অস্তিত্ব যেন না থাকে। এসবের আঁচ যেখানে পেয়েছেন, সেখানে কেটে বাদ দিয়েছেন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। বাদ দেওয়াটুকুই হয়েছে, তসলিমাকে কলকাতায় ফেরানোর ওই অনুষ্ঠানে তিনি কথা দিয়েও উপস্থিত থাকতে পারেননি। অন্য কাজ ছিল তাঁর।
কবে আমাদের বড় লেখক কবিরা ব্যানে এবং সেন্সরশিপে অগাধ বিশ্বাস থেকে নিজেদের মুক্ত করবেন, জানিনা।
আজ বিকেলে হাঁটছিলাম ছাদটায়, আকাশে কয়েকটা তারা শুধু। হাঁটছিলাম আর কথা বলছিলাম প্রভুর সঙ্গে। প্রভু এবং তাঁর বাহিনী নিজেদের অফিসের কাজ ফেলে আমার পেছনে সময় দিয়ে যাচ্ছে। আমি চাই না আমার জন্য কারও কোনও ক্ষতি হোক। কিন্তু ক্ষতি তো সরকারের হচ্ছে। সরকারি কাজ ফেলে আমাকে পাহারা দেওয়া বা সঙ্গ দেওয়া তো দিনের পর দিন চলতে পারে না। আমি ভালোবেসে এ দেশে থাকতে চাই। কারও কোনও অনিষ্ট হোক চাই না। কেবল চাই অবসান হোক এই অবস্থার। একসময় হঠাৎ প্রভু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কলকাতার বাড়িটা ছেড়ে দেননি?
–না।
–শুধু শুধু টাকা খরচ হচ্ছে না? ভাড়া লাগছে।
–হ্যাঁ তা লাগছে।
–কত টাকা যেন ভাড়া?
–কুড়ি। আর মেইনটেনেন্স আড়াইহাজার।
–এত টাকা প্রতিমাসে দিয়ে যাচ্ছেন?
–কী আর করবো! আমার পাবলিশারকে বলেছি ভাড়া দিয়ে যেতে। রয়ালটি থেকে কেটে রাখবেন।
–ছেড়ে দিতে পারেন ফ্ল্যাটটা।
–ছেড়ে নতুন একটা ফ্ল্যাট নেওয়া যেত। কিন্তু কে বাড়ি বদলাবে আমি ছাড়া। বাড়ি তো আমার গিয়ে দেখতে হবে। একটু কমের মধ্যে যদি একটা ফ্ল্যাট পাই, ভালো।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রভু আবার কথা শুরু করেন।
–পুরস্কার আনতে ফ্রান্সে যাবেন না?
আমি বললাম, ওটা তো হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান হয়ে গেছে। আমার ফরাসি প্রকাশক আমার পক্ষ থেকে পুরস্কার নিয়েছেন।
–অনুষ্ঠান হয়ে গেছে?
–হ্যাঁ হয়ে গেছে।
–কবে?
–এই তো ন’ তারিখে।
–তো পুরস্কারের জিনিসগুলো আনতে তো আপনাকে প্যারিসে যেতে হবে? তাই না?
–না। সার্টিফিকেট আর টাকাই তো। সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দেবে কুরিয়ার করে। টাকা পাঠিয়ে দেবে আমার ব্যাংকে।
–সুয়েনসন কী বলে?
–কী ব্যাপারে?
–ফোন করে না?
–তা করে।
–বলে না কিছু?
–কী বলবে?
–আপনাকে সুইডেনে যেতে বলে না?
–কোথায়?
–সুইডেনে?
–কেন বলবে?
–দেখে গেল আপনার মানসিক অবস্থা। খুব খারাপ আছেন। এসব দেখে কি আপনাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইছে না?
–না।
–বলছেন কী।
–চাইবে কেন, সে তো জানে এই দেশে থাকতে আমি পছন্দ করি। এ দেশেই আমি থাকতে চাই। সে তো জানে যে আমি বিদেশে থাকতে চাই না। বিদেশে থাকা আমি পছন্দ করি না। আর ওদেশে আমি যাবোই বা কেন, কী করবো ওখানে গিয়ে? এখানে এখন না হয় স্বাধীনতা নেই আমার, কিন্তু এভাবে তো বেশিদিন থাকবো না। এসবের তো শেষ হবে একদিন।
বুঝি। হাড়ে হাড়ে একটা জিনিস বুঝি। প্রভুকে বলা হয়েছে আমার ভেতরের কথা জানতে। কী ভাবছি। বিদেশে চলে যাবার কথা ভাবছি কি না। না ভাবলে কেন ভাবছি না। আমাকে ভাববার জন্য বলা হচ্ছে। আমাকে ভাবনাটা দিচ্ছেন প্রভু। আমি বুঝি না, দেশ ছাড়ার কোনও ভাবনা আমার মাথায় কেন আসে না!
আরেকদিন একজন অফিসার হঠাৎ বলেছিল, ‘ফ্রিডম তো আসল। জীবনে স্বাধীনতাই যদি না থাকলে তাহলে আর কী। কেন তুমি চলে যাচ্ছো না, কী দরকার এভাবে বন্দি থেকে?’
আমি চমকে গিয়েছিলাম সেদিন ওর কথা শুনেও।
আমাকে ভাঙতে চাইছে ওরা। ওদের কি কেউ দায়িত্ব দিয়েছে আমাকে ভাঙতে? নাকি এমনিতে কথায় কথায় বলছে ওরা। কিছু বুঝতে পারি না।
কিন্তু যদি না ভাঙি? ওরা কি কিছু ভেবেছে, যদি না ভাঙি, তাহলে কী করবে ওরা?
যে করেই হোক ভাঙার ব্যবস্থা করবে? ভয় পাওয়া আমার উচিত নয়, তারপরও অন্ধকার কেঁপে আসার মতো ভয় আসে কেঁপে।
.
১৫ জানুয়ারি
দিন গুলো কি যাচ্ছে, নাকি যাচ্ছে না? আমার এখানে ক্যালেন্ডার নেই। সকালের খবরের কাগজগুলোয় দেখি দিন যাচ্ছে। প্রভু দাঁতের অবস্থা জানার জন্য ফোন করেছিলেন। আমি কোনও খবর আছে কি না জানতে চেয়েছি। খবর বলতে যা শুনতে চেয়েছি, কর্তারা আমার কলকাতা ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলছেন কি না। না খবর নেই, প্রভুর যান্ত্রিক স্বর।
ভালো বা মন্দ যে কোনও একটি খবরই আমি জানতে চাই। এভাবে বাঁচতে কেউ পারে না। স্বাধীনতার জন্য সারাজীবন লড়াই করার পর আমাকে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে, পরাধীনতার শাস্তি। একশ’ কোটিরও বেশি লোক এ দেশে। এই দেশে একজন লেখককে কোথাও আটকে রাখা হয়েছে। দিনের পর দিন যাচ্ছে। কেন আমি কলকাতায় ফিরতে পারবো না, তার কোনও তো কারণ নেই। আমার বাড়ি থেকে আমাকে তুলে এনে অন্য একটা শহরে একটা ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। এ ঘটছে ভারতবর্ষে। মাঝে মাঝে আমি বিশ্বাস করতে পারি না।
আগে যারা ফোন করতো, তাদের অনেকেই এখন আর ফোন করে না। সম্ভবত আমি এখন সরকারি খাতায় বাতিলের তালিকায় বলে। বাতিলের খাতায় নাম উঠলে বা কালো তালিকাভুক্ত হলে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাটাই মঙ্গল বলে বেশির ভাগ লোকে জানে।
মানস ঘোষের পত্রিকায় খুব ছোট করে কালকের ধর্মমুক্ত মানববাদী মঞ্চের খবরটা ছাপা হয়েছে। অগ্রিম খবর দেওয়াই হয়নি যে মুসলমান সমাজের প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা একত্র হচ্ছেন তসলিমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনার জন্য। কথা নাকি ছিল দেওয়া হবে। আর, অনুষ্ঠান হয়ে যাবার পর এই এতটুকু সংবাদ। অথচ ফিরিয়ে আনার প্রথম র্যালির খবর ছিল বিরাট করে প্রথম পাতায়। মানস ঘোষও কি দুরে সরে যাচ্ছেন? কাছের মানুষগুলো, আপন মানুষগুলো কেন যে দূরে সরে যায়! আনন্দবাজার তো অনেক আগেই দূরে সরে গেছে। অন্যান্য পত্রিকার চরিত্র বোঝা দায়। একমাত্র দৈনিক স্টেটসম্যানই ছিল পাশে। নতুন পত্রিকা। তারপরও খুব দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল।
দুপুরে ঘুমোলাম। আজকাল ঘুমোলেই দুঃস্বপ্ন এসে ঘুম নষ্ট করে দেয়। ভীষণ একা লাগে। বাবা মার কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে আর একা লাগে। এত একা বোধহয় আমার কখনও লাগেনি আগে।
কাল ফকরুল মামা ফোন করেছিল। কী রকম যেন লাগে এমন ফোনে। সেই যে কবে কলকাতায় সাত কী আট বছর আগে দেখা হয়েছিল। তারপর আর কোনও যোগাযোগ নেই। আর দেখা নেই। কাল ফোন। আমি কোথায় আছি জিজ্ঞেস করলো। বুক হু হু করে ওঠে। এরাই তো আমার আত্মীয়। আমি কি ওদের ভুলে থাকি নাকি ওরা আমাকে ভুলে থাকে? আমি তো চাই সবাইকে নিয়ে এক শহরে থাকতে। আমি তো চাই সবার সুখে দুঃখে কাছাকাছি থাকতে। চাই ভালোবাসা পেতে। ভালোবাসা দিতে।
পারি না।
.
১৬ জানুয়ারি
আজ সকালে কলকাতা থেকে ফোন এল। দৈনিক স্টেটসম্যানে আমাকে নিয়ে শাঁওলি মিত্র আর ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন। গিল্ডের খবর আছে, মিল্লি ইত্তেহাদ পরিষদ যে গিল্ডকে চিঠি পাঠিয়েছে আমার বই যেন না থাকে, থাকলে মেলায় গন্ডগোল হবে, সেই চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন গিল্ডের কর্তারা আমার প্রকাশকদের কাছে। ভালো উত্তর দিয়েছেন শিবানী মুখোপাধ্যায়, বলেছেন, আমরা বই নেব, ব্যস। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে সুবীর মিত্র বলেছেন, বই মেলার দেরি আছে, এখনও ভাবার সময় আছে। বই থাকাই তো স্বাভাবিক। অনিমা বলেছেন গাঙচিল থেকে, আমরা যে বই ছাপিয়েছি সে বইয়ে ধর্ম বিষয়ে কোনও কথা নেই।
সকালে মানস ঘোষকে ফোন করলাম। কথা বলতে বলতে গলা বুজে আসে। এরপর দেখি চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। মুছে ফেলছি হাতে, আবার ভিজে যাচ্ছি।
প্রশান্ত রায়ের সঙ্গে কথা হল, ওই গিল্ডের ব্যাপার নিয়েই। গিল্ডের কাছে চিঠি, গিল্ড নিজে সামলাবে এসব সমস্যা, তা নয়, চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে প্রকাশকের কাছে, যেন প্রকাশকের দায়িত্ব এটি।
শাঁওলি মিত্র জিজ্ঞেস করেছেন, আমাকে কেন আটকে রাখা হয়েছে, আমি কি গণহত্যাকারীদের চেয়েও ক্ষতিকর। ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, যেভাবে লিখছি আমি, সেভাবে লেখায় কাজ হবে না। আমাকে মুসলিম সমাজের অশিক্ষিত লোকদের কাছে গিয়ে গিয়ে বোঝাতে হবে। বিদ্যাসাগরকে লোকে মানতেন কারণ তিনি হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে সরাসরি কোনও বাজে কথা বলেননি।
কিন্তু আমার প্রশ্ন, ওভাবেই কি করতে হবে সমাজের পরিবর্তন। বছর তো গেছে অনেক। নিয়ম কি বদলাবে না! বা আমি যদি অন্যের নিয়মের বাইরে বেরিয়ে নিজের নিয়মে কাজ করি। গ্রামে গ্রামে হেঁটে হেঁটে কাউকে না বুঝিয়ে শুধু যদি লিখি, যা আমি সবচেয়ে ভালো পারি! এ কী দোষ? লেখাটা?
সুদীপমৈত্র সংস্কার কুসংস্কার নিয়ে প্রতি বুধবারে নিয়মিত লেখেন। অসাধারণ লেখা। এবার মৌলবাদ আর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে লিখেছেন। ‘ধর্মবিশ্বাস ঠিক আছে, মৌলবাদটা ঠিক নেই’ –এই বহু পুরোনো ধারণার সমালোচনা, যেটা আমার লেখায় বারবার খন্ডন করেছি। নিজে তো আজ বন্দি হয়ে আছি। আমার লেখা, আমার ভাবনা আমার বিশ্বাসও বন্দি। আমার আদর্শের কথা যদি কোথাও দেখি কেউ লিখছে, ভালো লাগে বড়। আজ দৈনিক স্টেটসম্যানে ফোন করে সুদীপকে অভিনন্দন জানালাম। সুদীপ খুব খুশি হল। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি কখনও। বন্ধুত্ব তো দূরের কথা। একটু আফশোস হয়, কলকাতায় অনেক ভুল মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করেছি। খাঁটি মানুষগুলোই রয়ে গেছে। দূরে। কলকাতায় যাবার পর জীবনটাই পাল্টে ফেলবো, সিদ্ধান্ত নিই।
কিছুই ঘটে না আর। কিছু একটা ঘটুক চাই।
.
১৭ জানুয়ারি
রাতে আবারও দুঃস্বপ্ন। সারারাত আবারও অস্থিরতায় ভুগেছি। দুঃস্বপ্ন আমার কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। জেগে ওঠার পরও অনেকক্ষণ এই কিডনি নষ্ট হওয়া, মরে যাওয়াটা গেঁথে ছিল ভেতরে। অনেক পরে, সূর্য ওঠারও পরে আমার বোধ হল যে, না, ওটা স্বপ্ন ছিল, সত্যি ছিল না। স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন সত্যি মিথ্যে সব কেমন একাকার হয়ে গেছে। আলাদা করে কোনওটাকে আমি এখন চিনতে পারি না। আজ কোথাও কিছু নেই। কোনও পত্রিকা কিছু লেখেনি। কেউ ফোন করেনি। তপন রায় চৌধুরীর বাড়িতে ফোন করে জানলাম, যে চিঠিটি তাঁর লেখার কথা ছিল ভ’কে, আমাকে একটু যেন বেরোতে দেওয়া হয়, একটু যেন বন্দিত্ব শিথিল করা হয়, সেই চিঠিটি এখনও লেখা হয়নি। তিনি রাজ্য সরকারের কারও সঙ্গে আমার বিষয়ে যে কথা বলবেন বলে বলেছিলেন, সে কথাটাও তাঁর আজও বলা হয়নি। আমার কী রকম বাজে লাগে কাউকে ফোন করে কিছুর জন্য অনুরোধ করতে। বিশেষ করে সেই কিছুটা যদি নিজের জন্য হয়।
আমার এই এখানে এই অচেনা জায়গায় পড়ে থাকা, কী রকম অদ্ভুত লাগে সব কিছু। জোরে জোরে শ্বাস নিই। জোরে শ্বাস নিলে শ্বাসকষ্ট কিছু কমে। কত কেউ কথা দিয়েছিলো রোজ ফোন করবে, অথবা প্রায়ই, তারা সব ভুলে গেছে। যে কেউ ফোন করলে কলকাতা থেকে, অনুরোধ করি, যেন ফোন করে, যেন আবার, যেন কাল, যেন পরশু। বুঝি আমি, কী রকম ভয়াবহ অসহায়তা আমাকে চেপে ধরেছে।
বিকেলে কিছু ঘটলো। সিএনএন এর এক ছেলে কিছু প্রশ্ন পাঠিয়ে তার উত্তরগুলো লিখে নিলো। ওদের ওয়েবসাইটে আমার সঙ্গে পাঠকের চ্যাটের আয়োজন করেছিলো। কিছুটা সময় কাটলো অন্তত প্রশ্ন উত্তরে। কিন্তু তারপর? তার আর পর নেই। আবারও একলা বসে থাকা। বসে থাকা আর জানালায় তাকিয়ে থাকা। তাকিয়ে থাকা আর দীর্ঘশ্বাস ফেলা। সত্যি কথা বলতে কী, আমার লেখায় পড়ায় কিছুতেই মন বসছে না। কবে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা স্বাভাবিক স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারবো, এই ভাবনা।
শিবানীর সঙ্গে ফোনে আমাদের সেই বইমেলা যাপনের কথা স্মরণ করছি শেষ বিকেলের দিকে। বলছি সেই কফি হাউজে আমাদের সেই দিনগুলোর কথা–পিপলস বুক সোসাইটির একটা ভালো ঘর হবে কলেজ স্ট্রিটে কোথাও, যাবো প্রায়ই, আড্ডা দেব, এরকম আমাদের স্বপ্ন ছিল। সেই ভালো ঘর শেষ অবদি নেওয়া হয়েছে। কবে মুভ করবে ভালো ঘরটিতে, কবে সাজাবে ঘরটি, কবে আচ্ছা! শিবানী বললো, ”তুমি ফিরে এলে।
কথোপকথন শেষ হলে চা খাচ্ছি, প্রভু টেলিভিশন দেখছেন আর হাসছেন, হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তার, আপনার ফ্ল্যাট কি বিক্রি করে দিলেন?
–কেন? আমার প্রশ্ন।
–ওই যে কথা বললেন ফোনে। ফ্ল্যাটের কথা কী বললেন?
–না। ওটা আমার ফ্ল্যাট নয়। ওটা আমার পাবলিশারের দোকান। নতুন দোকান নিয়েছে।
প্রভু আমার ব্যক্তিগত জীবন, ফ্ল্যাট ইত্যাদি নিয়ে নাক গলানোর লোকই নন। এই নাক গলানোটা, আমার আশংকা, তার চাকরির নাক গলানো। আমার মনে হতে থাকে, তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছে আমার খোঁজ খবর রাখার জন্য, লক্ষ্য রাখার জন্য আমি কবে কাত হব, কবে বিদেয় হব, গুটিকয় আশা ফুরোতে ফুরোতে কবে আমি নিঃস্ব হব। এই নির্দেশগুলো একেবারে ওপরতলা, একেবারে ভ’ থেকে আসছে, ভ যে এত স্নেহ করতেন, সব এক ফুৎকারে উবে গেল। আমি তো কোনও অন্যায় করিনি। উনি কি জানেন না আমি কষ্ট পাচ্ছি। আমার জন্য একটুও কেন কারও মায়া হচ্ছে না?
সন্ধেয় ফোন এলো ফ্রান্স থেকে। ক্রিশ্চান বেসএর ফোন। যে করেই হোক, একটা বই চাইছেন ছাপাতে। ভারত সরকার দ্বারা ভারতেই নির্বাসিত হওয়ার কাহিনী নিয়ে বই। বললেন, ফরাসি প্রেসিডেন্টকে দিয়ে হয়তো সম্ভব হবে না, তার সঙ্গে যেমন্ত্রী বা উঁচুপদের সরকারি যারা আসবেন ভারতে, তাদের কাউকে দিয়ে চেষ্টা করছেন যেন সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কারটি আমাকেই এই ভারতেই দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়!
খুব জোরে জোরে শ্বাস নিলাম ক’টা। জানি না সামান্য বল কোথাও থেকে পেলাম কী না। একটা সাদা কাগজে টেনে নিয়ে লিখে দিলাম, কী চাই আমি। প্রভুকে আমার এই চাওয়ার লিস্টিটি দিই। এই চাওয়াগুলো মুখে জানিয়েছি অনেকবার, বেশ অনেকদিন, অনেক সপ্তাহ।
দেখা করতে চাই।
১.জাবির হোসেন, সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত কবি এবং রাজ্যসভা সদস্য।
২.সুধীরনাথ, বন্ধু এবং কার্টুনিস্ট
৩.অরুণ মাহেশ্বরী, প্রকাশক এবং বন্ধু
৪.শীলা রেড্ডি, বন্ধু।
৫.একজন মেডিসিনের ডাক্তার, যে আমার উঁচু রক্তচাপ, রক্তের চিনি, কোলেস্টোরল পরীক্ষা করবেন এবং চিকিৎসা করবেন।
৬.একজন থেরাপিস্ট বা মনোবিশেষজ্ঞ, যিনি আমার চরম মানসিক অবসাদ, হতাশা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদির চিকিৎসা করবেন।
৭.বাইরে বেরোতে চাই, মানুষ দেখতে, মানুষ হাঁটছে, চলছে, বেড়াচ্ছে, এসব দেখতে, জীবন দেখতে।
প্রভু বললেন, তিনি যথাস্থানে জানাবেন আমার আবেদন।
.
১৮ জানুয়ারি
কলকাতায় একটা পত্রিকাই ছিল আমার পক্ষে, আমার পাশে। দৈনিক স্টেটসম্যান। অন্য কাগজগুলো চুপ। ‘আজকাল’ সিপিএমের মুখপত্র। লজ্জা বেরোনোর পর থেকেই আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছে। দৈনিক স্টেটসম্যান-এর মানস ঘোষকে অনেকদিন ধরে চিনিও। বাংলাদেশে গিয়েছিলেন অনেক বছর আগে, দ্য স্টেটসম্যান এর জন্য আমার সাক্ষাৎকার নিতে। সেই মানস ঘোষ যখন বাংলা দৈনিক স্টেটসম্যান শুরু করলেন, খুব স্বাভাবিক কারণেই খুব শুভাকাঙ্ক্ষী তিনি আমার। নিয়মিত আমি লিখতামও তার কাগজে। দুঃসময়ে যখন কোনও পত্রিকা পাশে নেই, তখন দৈনিক স্টেটসম্যানই দিনের পর দিন ছাপিয়ে গেছে আমার পক্ষে সবার নিবন্ধ, প্রবন্ধ, খবরাখবর। হঠাৎ স্টেটসম্যান হাউজ, টের পাচ্ছি, দূরে সরার সব আয়োজন আনুষ্ঠানিকভাবেই সেরেছে।
মানস ঘোষ ফোন করেন না আগের মতো। স্টেটসম্যানে নিয়মিত কলাম আমি আবার লিখতে শুরু করবো বলার পর মানস ঘোষ এখন না’ বলে এড়িয়ে গেলেন। পরশু দুটো লেখা আমাকে নিয়ে ছাপা হল। ভবানীপ্রসাদের লেখায় আমার বিরুদ্ধে যে মন্তব্য আছে, তা বড় করে ছাপানো হল। কাল একটা চিঠি ছাপানো হল বিরুদ্ধে। ভারতের আইন বিরুদ্ধ কাজ করেছি, তা বলা হল। আজকে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের একটা লেখা ছাপা হল দ্য স্টেটসম্যানে। সেখানে তিনি লিখেছেন, একজন বিদেশি নাগরিকের আইনত কোনও অধিকার নেই এদেশের মানুষের ধর্ম নিয়ে কথা বলার, কুড়ি কোটি মুসলমানের মনে আঘাত দেওয়ার। সে ক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিকের ভিসাই বাতিল করা উচিত।
এই লেখাটা পড়েই আমার সন্দেহ জাগল আদৌ আমার ভিসা ভারত সরকার দেবে কি না। না দেবার যথেষ্ট লক্ষণ আছে। আমার প্রতি যদি সরকারের সহানুভূতি থাকতো, তবে তার আঁচ আমি পেতাম। আমাকে এমন দুঃসহ জীবন যাপন করতে হত না। যদি কলকাতায় ফেরা রাজনৈতিক কারণে সম্ভব এখন নাও হত, আমাকে ভ’বাবু নিজ মুখে। বলতে পারতেন, এখন সম্ভব হচ্ছে না, তুমি দিল্লিতেই আপাতত থাকো। আমি দিল্লিতেই নিজের মতো করে থাকতাম। যদি নিরাপত্তার দরকার হত, তবে ব্যবস্থা এখানেই করা হত, এই দিল্লিতেই। আমি চলাফেরা করতাম নিজের মতো, নিরাপত্তা রক্ষীর প্রয়োজন হলে নিরাপত্তা রক্ষী থাকতো।
আর এক মাস আছে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার। বিদেশ মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছেন বটে সংসদে যে, আমার ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হবে। কিন্তু কোনও না কোনও কারণ দেখিয়ে তো সরকার পারেন তা বাতিল করতে। নিশ্চয়ই পারেন। নিজের দেশই আস্ত আমাকে বাতিল করে দিল। আর ভারতকে যতই নিজের দেশ বলে মনে করি না কেন, কাগজপত্রে এ তো পরের দেশ। পরের দেশ আমার ভিসা বাতিল করার অধিকার তো বেশ ভালোই রাখে। কিন্তু একটা কারণ তো দেখাতে হবে বাতিল করার। কেউ কি বলতে পারবে সত্যি করে কেন বাতিল করা হচ্ছে। ওর বিরুদ্ধে রাস্তায় কিছু ছেলে ছোঁকরা নেমেছিলো বলে ওকে আর ভিসা দেওয়া হবে না। ছেলে ছোরারা দাবি করেছিলো তসলিমাকে দেশ ছাড়া করো! এই তো! ছেলেদের ক’টা দাবি আসলে মেনে নেওয়া হয়। কোনো দিন হয়েছে কি?
স্বপ্নের এমন ভাঙন আর কারও জীবনে কি ঘটে, আমার ছাড়া? না, এ দেশে বড় কোনও আন্দোলন ঘটেনি। আমার জন্য ঘটে না কিছুই। কিছু বড় পত্রিকায় পক্ষে কিছুকলাম লেখা হয়েছে। আর, আমারই বন্ধুরা কলকাতায় পথে নেমেছে বা সভা করেছে। এই।
একজন দেখলাম প্রশ্ন করছে, ‘কোথায় মানবাধিকার রক্ষা করার সব বড় বড় বিপ্লবীরা? কোথায় অরুন্ধতী রায়, রোমিলা থাপার, তিস্তা শীতলবাদি, শাবানা আজমি, রাম পুন্যানি, দিনেশ দিসুজা, বিজু মেথিউ, জন দায়াল। কোথায় সোনিয়া গান্ধি? কোথায় তেহেলকা ম্যাগাজিন। হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যাওয়া, মুসলিম বা ক্রিশ্চান মৌলবাদীরা অন্যায় করলে মুখ বুজে থাকাটাই এদেশে প্রগতিবাদ, মানবাধিকার রক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা, এবং সেকুলারিজম’।
আমার বুকে কষ্টের একটা পাথর। পাথরটাকে সরাতে পারি না।
আজ আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে কথা হল। তাকে বলেছিলাম, বাংলাদেশে ফেরত যেতে চাই, যেন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে কথাবলেন। আমাকে যেন আমার দেশে থাকার অধিকার তাঁরা দেন। গাফফার চৌধুরী জানালেন, তিনি ফকরুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেছেন, ফকরুদ্দিন নাকি আমার নাম শুনেই ভয় পেয়ে গেছেন। ডঃ কামাল হোসেনের সঙ্গেও নাকি কথা বলেছেন। নাম শুনে তিনিও ভয় পেয়েছেন। আমাকে কেউ সাহায্য করতে রাজি নন। কেউ আমার দেশে ফেরত চান না। বারবারই গাফফার চৌধুরী বললেন, ‘দেশে তোমাকে মেরে ফেলবে। তোমাকে কপি করে যে লোক লেখা শুরু করেছিল, তাকে মেরে ফেললো।’
–কে?
–কেন, হুমায়ুন আজাদ? তোমাকে পায়নি বলে হুমায়ুন আজাদকে মেরেছে। তুমি দেশে থাকলে তোমাকেও ওই একইভাবে মারতো।
আশিষ নন্দীর সঙ্গে কথা হল। তাঁকে এ দেশে পলিটিক্যাল সায়কোলজিস্ট বলে ডাকা হয়। আশিষ নন্দী আমার প্রশ্নর উত্তরে কিছু কথা বললেন, যে, আমাকে, তিনি মনে করেন ভিসা দেবে ভারত সরকার। বললেন, সোনিয়া পছন্দ করেন আমাকে।
–ভ’বাবুও তো স্নেহ করতেন। উনি কি স্নেহ আর এখনও করেন? যদি করেনই, তবে বন্দি কেন করেছেন? একটু মানবিক কি কেউ হতে পারছেন না? একটু বাইরে বেরোতে দেওয়া। একটু মানুষের মতো বাঁচতে দেওয়া।
–হয়তো ভয় পাচ্ছেন।
–কিসের ভয়?
–কিছু যদি হয়ে যায়।
–যদি কিছু তো যে কোনো সময়ই হতে পারতো।
কিছু খটকা থেকে যায়। তারপরও আশিষের আশ্বাস আশীর্বাদের মতো মনে হয়।
.
২০ জানুয়ারি
অরুন্ধতী আর রিতু মেনন ইন্দিরা জয়সিংএর কথা বলেছিলেন। ইন্দিরা জয়সিং খুব বড় মানবাধিকার ল’ইয়ার। এই ল’ইয়ার আমাকে সাহায্য করতে পারে, যদি আদৌ কেউ পারে সাহায্য করতে। মানবাধিকার ল’ইয়ারএর এক কথা, ‘মামলা করো।
–মামলা কার বিরুদ্ধে?
–সরকারের বিরুদ্ধে। আমি সোজা বলে দিলাম, এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
–কেন সম্ভব নয়, তুমি মামলা করলেই জিতে যাবে।
ইন্দিরা জয়সিং প্রায়ই ফোন করে আমার সিদ্ধান্ত জানতে চান। অরুন্ধতী আর রিতুরও ওই একই কথা, মামলা করা ছাড়া তোমার আর বেরোবার পথ নেই। কিন্তু আমি রাজি হই না।
বলি, আমি ভারতের নাগরিক নই, আমাকে যে ভারত বাসের অনুমতি দিয়েছেন সরকার, আমি কৃতজ্ঞ। আমি মামলা করবো না। যদি মানবাধিকারে, মত প্রকাশের অধিকারে যারা বিশ্বাস করে, তারা একজোট হয়ে সরকারের কাছে দাবি জানান, আমার বিশ্বাস, আমি মুক্তি পাবো।
আমার কোনো কথাই লইয়ার মানেন না। বলেন, ”তুমি শুধু কাগজে সই দেবে, আমাকে তোমার পক্ষ হয়ে লড়ার অনুমতিটা দেবে। আমি বাকি সব কাজ করবো। এক মামলা করেই তুমি ওই বন্দিজীবন থেকে বেরোতে পারো। তা না হলে তোমাকে লাথি মেরে দেশ থেকে বের করে দেবে যে কোনওদিন, আর কখনো ফিরতে পারবে না। একবার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে, এ সম্ভব হবে না। কিছু মৌলবাদী তোমার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে বলে তোমাকে তোমার বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে অন্য এক শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য একটা অজ্ঞাতস্থানে রেখে দিয়েছে, এ কারণে তোমার মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। মামলা করলে তোমার হারাবার কিছু নেই। তুমি এর মধ্যে সবই হারিয়েছে। এখন দেশ থেকে তোমাকে তাড়িয়ে দিলে মামলা করার সুযোগ তোমার জুটবে না, তসলিমা। ভেবে দেখো। ভাবার সময় চাও যদি, নাও।
কিছুদিন পর আবারও ফোন করে ইন্দিরা ওই একই কথা জিজ্ঞেস করেন। আমি রাজি কি না মামলা করতে।
আমি রাজি নই। এভাবেই চলতে থাকে। একদিন আমি বলি, যা-ই হোক, যা ইচ্ছে তাই হোক, সরকারের বিরুদ্ধে মামলা আমি করবো না। আমি অপেক্ষা করবো যতদিন না সরকারের সিদ্ধান্ত বদল হয়।
ইন্দিরা জয়সিং রাগ করে ফোন রেখে দেন।
.
২৩ জানুয়ারি
প্রভুকে বার বার জিজ্ঞেস করার পর জানিয়ে দিলেন, কদিন আগে কী-চাই-আমি বলে যে একটি লিস্ট দিয়েছিলাম তার হাতে, সেটির কোনওটিই মানা ভারত সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।
.
২৭ জানুয়ারি
‘এই সর্বদলীয় পাষণ্ডামি এবং তৎসহ ছলনাময় অকথ্য রাজনীতি যাঁরা করেন, তাদের মুখোশ এই প্রথম, কিংবা কেবল এইবারই লোকসমক্ষে ঝুলে পড়েছে, তা বলবো না। কিন্তু মানবিকতার প্রশ্নে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে কিংবা সর্বাপেক্ষা মূল্যবান যে প্রশ্ন, সংবিধানের অন্তর্নিহিত মহান আদর্শটির সংরক্ষণের দায়িত্বে এবার তাদের ব্যর্থতা আমাদের বুকে তীরের মতো বিঁধছে। তসলিমাকে নিয়ে যে অগ্নিপরীক্ষায় আমাদের রাজ্যের, অথবা কেন্দ্রের পীড়াদায়ক রাজনীতি চলছে, তার কোনও তুলনা হতে পারে না। এই লজ্জা তসলিমার লেখা বই ‘লজ্জা’র মলাট দিয়েও ঢাকা যাবে না। –শ্রীনিরেপেক্ষ
যারা পাহারা দিচ্ছে, তারা এখন কথায় কথায় আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে দেশ ছাড়ার জন্য। ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটছে। মানসিক পীড়ন যে কতদূর পৌঁছোতে পারে, তা দেখা হল ডাক্তারের বেলায়। ডাক্তার দেখাতে চাইছি, রক্তচাপ বাড়ছে শরীরে। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর নামগন্ধ নেই। মুখে বলে কাজ হচ্ছে না বলে লিখিত অনুরোধ জানালাম যে ডাক্তার চাই। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চাই। কার্ডিওলজিস্ট চাই। কারণ, রক্তচাপ বাড়ছে, ওষুধের মাত্রা বাড়িয়েও কমার কোনও লক্ষণ নেই। তিন সপ্তাহ কোনও যোগাযোগ করলেন না প্রভু। একজন ডাক্তার দেখানোর জন্য কাতর অনুনয়ের পরও প্রভু কর্ণপাত করলেন না। আমার জামা জুতো সাবান শ্যাম্পু লাগলে তা দিচ্ছেন, কিন্তু ডাক্তার দরকার হলে দিচ্ছেন না। প্রভু তো বলেই দিয়েছেন, সম্ভব নয়।
ত–সম্ভব নয়, কেন?
প্ৰ–বিকজ অব সিকিউরিটি।
ত–সিকিউরিটির কারণে আমি কোনও ডাক্তার দেখাতে পারবো না?
প্র–নো ম্যাডাম।
ত–সিকিউরিটির অসুবিধেটা কী হবে, শুনি?
প্র–কোনও ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া সম্ভব হবে না।
ত–তাহলে ডাক্তার নিয়ে আসুন। আমার ব্লাড প্রেশার এখন একশ’ সত্তর বাই একশ’ কুড়ি। আর আপনি বলছেন সিকিউরিটির কারণে ডাক্তার দেখানো সম্ভব নয়।
প্র–ডাক্তার নিয়ে আসাও সম্ভব নয়।
ত–তাহলে ওই তৃতীয় জায়গায় নিয়ে চলুন, যেখানে নিয়ে আসতে পারেন কাউকে।
প্র–আমি আপনার প্রস্তাব যথাস্থানে জানিয়ে দেবো। স্যরি ম্যাডাম। আমি যা নির্দেশ পাই, তা-ই আপনাকে জানাই। আপনি ভুল বুঝবেন না। আপনাকেও বুঝতে হবে আপনার সিকিউরিটির ব্যাপার। আপনার একটি জিনিস নিয়েই আমরা চিন্তিত, সে আপনার নিরাপত্তা।
ত–ডাক্তার দেখালে আমার নিরাপত্তা নষ্ট হবে। কিন্তু ডাক্তার না দেখালে, ওষুধ না খেলে আমি তো মরে যাবো।
প্র–আমি দেখছি, কী করতে পারি।
প্রায় দু’মাস ডাক্তারের জন্য অনুরোধ করার পর আমি যখন তাকে বলতে লাগলাম, আমার কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হবে, প্রভু চমকালেন না। একটু কী স্বস্তি পেলেন! হার্ট অ্যাটাক হলে তো আপদ বিদেয় হয়, একদিক দিয়ে ভালোই। এও বলি, ”আমি মারা গেলে কিন্তু লোক ভাববে আপনারা মেরে ফেলেছেন। প্রভুর পাথর-মুখে দুশ্চিন্তার কিছু ছায়া পড়েছে বলবো না। তারপর মিডিয়াকে যেদিন জানালাম, আমাকে ডাক্তার দেখাতে দেওয়া হচ্ছে না’, প্রভু ডাক্তারের ব্যবস্থা করলেন। সেই তৃতীয় জায়গায় আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে যে ডাক্তারের দেখা পেলাম, তাকে আমার পছন্দ হওয়ার কোনও কারণ নেই। ডাক্তার তাঁর পরিচয় পত্র দেখালেন না, নাম বললেন না। প্রভুর বারণ আছে। ডাক্তার ডাক্তারি জানেন বলে আমার মনে হয়নি। আমাকে দেখে যথারীতি চিনে ফেলে একরকম কাপছিলেন। তার কোনও ওষুধ লেখারও দরকার হয়নি। কারণ তিনি ঠিক বুঝে পাচ্ছিলেন না তিনি কী ওষুধ লিখবেন। ওই ডাক্তারের চেয়েও রক্তচাপ বিষয়ে জ্ঞান আমার বেশি, এ শুধু ডাক্তার বোঝেননি, পাশে বসে থেকে প্রভুও বুঝেছেন। ডাক্তার চলে গেলেন, আমাকেও নিয়ে আসা হল নিরাপদ বাড়িতে।
এরপর নিজেই কলকাতায় ডাক্তারদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে ওষুধ কী খাবো, তা জেনে নিই। রক্তচাপ একশ ষাট-একশ সত্তর/একশ-একশ দশ এরকম থাকছে। এনালাপ্রিল পাঁচ মিলিগ্রাম আর হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড সাড়ে বারো মিলিগ্রাম দিলেন কলকাতার ডাক্তার। সকালে ওষুধ খেয়েও নিলাম একদিন। যেদিন খেলাম ওষুধ, সেদিন প্রভু ফোনে বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে জানালেন, বিরাট হাসপাতালের বিরাট কার্ডিওলজিস্ট আনা হচ্ছে। বাহ, চমৎকার! তৃতীয় জায়গায় সন্ধে বেলা আমাকে নিয়ে যাওয়া হল। এবারের ডাক্তারকে ডাক্তার বলে মনে হল। ডাক্তার রক্তচাপ মাপলেন। ওষুধ লিখে দিলেন। রক্তচাপের জন্য আড়াই মিলিগ্রাম এনালাপ্রিল খাচ্ছিলাম। আমাকে লিখে দেওয়া হল তিন ওষুধের কমবিনেশন ড্রাগ। ঘরে ফিরে লিখে দেওয়া নতুন ওষুধগুলোর মধ্য থেকে একটা অ্যামলোডিপিন, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর শিথিল হয়ে আসে। শরীর কুলকুল করে ঘামতে থাকে। সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছি। কখনও শরীরে এমন অনুভূতি হয়নি। আমি বুঝতে পারছি আমি হারিয়ে যাচ্ছি, তলিয়ে যাচ্ছি। তখনও শরীরে সামান্য যেটুকু শক্তি ছিল, সেটুকু প্রয়োগ করে ফোন করলাম আকাশকে। অফিসার আকাশ। আকাশ এলো বটে, তবে আর আকাশের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না আমি। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল স্ট্রেচারে করে হাসপাতালে। স্ট্রেচার এই ক্যান্টনমেন্টেরই সম্ভবত। হাসপাতালের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রভু। ডাক্তার ছিলেন। ভর্তি করা হল সিসিইউতে। করোনারি কেয়ার উইনিটে। কথা বলতে চাইলাম, তবে কথা স্বাভাবিক নয়। একটি শব্দ বলতে দীর্ঘক্ষণ সময় নিচ্ছি। সিসিইউতে মনিটরে দেখা হচ্ছে রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন। দেখা হচ্ছে ইসিজি। ডাক্তার খুব চেষ্টা করছেন জানতে আমার গা চুলকোচ্ছে কি না, গায়ের কোথাও অ্যালার্জির রিয়েকশান দেখা দিয়েছে কি না। না, দেখা দেয়নি। সম্ভবত অ্যামলোডিপিনের প্রতিক্রিয়া, বললাম ডাক্তারকে। অথবা সারাদিনে তিন তিনটে ওষুধ খাওয়া, এটা অতিরিক্ত ওষুধের কারণে হয়ে থাকতে পারে। রাত দুটোর দিকে মরতে বসেছিলাম। আবার গা ঘামতে শুরু করলো। আবার শরীর অবশ হতে শুরু করলো। পালকের মতো হালকা হতে শুরু করলো। মনিটরে দেখি রক্তচাপ কমতে কমতে প্রায় শূন্যতে নেমে যাচ্ছে। ডাক্তারকে ডাকছি, যেন আমাকে বাঁচান। অল্প বয়সী ডাক্তার। স্যালাইনএর গতি সম্পূর্ণ বাড়িয়ে দিল। একের পর এক স্টেরয়েড চলতে লাগলো। জীবন বাঁচানোর ওষুধ। আমি পৃথিবীর কাছে বিদায় নিয়ে নিচ্ছি তখন। বিদায় অবকাশ, বিদায় ময়মনসিংহ, বিদায় বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিদায় পৃথিবী, বন্ধুরা, গুণীজনগণ, অনুরাগীগণ। বিদায় জানাচ্ছি, স্টেরয়েড চলছে হৃদপিন্ডকে ফেরানোর জন্য। স্যালাইন চলছে পুরোদমে। দু’ঘণ্টা পর ধীরে ধীরে ফিরতে থাকি মাটির পৃথিবীতে। মৃত্যুর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পর্ব সারা হল। আঙুল স্পর্শ করাই হয়েছে শুধু, নিবিড় আলিঙ্গনটিই বাকি।
পরদিন বড় ডাক্তার সব দেখেশুনে বললেন, ওষুধের ‘পয়জনাস রিয়েকশ্যান’ হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন, তিন তিনটে ওষুধে, নাকি অ্যামলোডিপিনে? ডাক্তার বললেন, ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে অ্যামলোডিপিনে হলে ওই ওষুধ আপনি আর কখনও খেতে পারবেন না। সেদিন আমি প্রভুকে বার বার বললাম, আমি ভ’বাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই। প্রভু একসময় বললেন, তিনি জানিয়ে দিয়েছেন আমার অনুরোধ। এবার আমি প্রশ্ন করলাম, যে মানুষ রক্তচাপ কমাতে একটি আড়াই মিলিগ্রামের ওষুধ খাচ্ছিল, তাকে রক্তচাপ কমানোর তিন রকম ওষুধের কম্বিনেশন কি কেউ দেয়? কোনো ডাক্তার দিতে পারে? ডাক্তার বললেন,সাধারণত এমন হয় না। যদি ভুল হয়েই থাকে, হয়েই গেছে, পুরনো কথা ভেবে লাভ কী? আপনাকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে, আপাতত সেটাই ভাবা হোক না কেন! টেনশন ফ্রি থাকার চেষ্টা করুন।
রোববার সেদিন। প্রভু আমাকে দেখতে এলেন। কিন্তু ভ’বাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দিলেন না। বললেন, ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে, উনি বলেছেন পরে তিনি কথা বলবেন।
রক্তচাপ গ্যাসবেলুনের মতো একবার ওপরে ওঠে, একবার ধপাস করে তলিয়ে যায়। এরকমই চলতে থাকে। ডাক্তাররা একেবারে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দিয়ে রেখেছেন। কোনও ওঠা নামা মানা। বারবারই বলেছেন, স্ট্রেস, টেনশন এসব আমার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে না। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আমার জীবনে সবচেয়ে ক্ষতিকর, এগুলো অনেকটা মৃত্যু ডেকে আনছে। বাঁচতে চাইলে এগুলো আমাকে ত্যাগ করতে হবে। ত্যাগ কি চাইলেই করা যায়। পরদিন, তারপরের দিনও আমি সিসিইউতে। তারপরের দিনও। ডাক্তার বলে দিলেন, যতদিন না রক্তচাপ স্বাভাবিক হবে ততদিন থাকতে হবে হাসপাতালে। এবং ওষুধ পত্র কী খেতে হবে, তা বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে বিদেয় দেওয়া হবে, তার আগে নয়। ডাক্তারদের এই সিদ্ধান্ত অবশ্য ডাক্তাররাই পরে পাল্টে ফেললেন। প্রভু ওঁদের আলাদা করে ডেকে নিয়ে কিছু বলেছিলেন, জানি না কী বলেছিলেন।
সরকারি সিদ্ধান্ত আমাকে হাসপাতাল ছাড়তে হবে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা অতপর সরকারি অফিসারের আদেশ পালন করলেন, রোগীকে বিদেয় করলেন। তখন অনুমান করা সম্ভব ছিল না, পরে অনুমান করি, টাইমস অব ইন্ডিয়ায় আমার হাসপাতালে ভর্তির খবর ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবন কী হবে না হবে এই ব্যাপারে যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাকে আর হাসপাতালে রাখা যাবে না, কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না আমার অসুখ বিসুখের খবর। লোকে তবে জেনে যাবে, কেমন আছি, কোথায় আছি, কী অবস্থায় আছি, আমাকে নিয়ে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সব! মিডিয়াকে সরকারি লোকেরা পছন্দ করেন, তবে সবসময় নয়। তাছাড়া আমাকে যেতে হবে ভ’ বাবুর কাছে। তিনি কথা বলতে চেয়েছেন। কথা বলতে চেয়েছেন, তো ফোনে কথা বললেই হয়। না, সেটি হবে না। ভ’বাবু দেখা করতে চেয়েছেন। তিনি কি আসতে পারবেন না সিসিইউতে? মানুষ তো রোগী দেখতে হাসপাতালে যায়। আমার এই প্রশ্নটি অবাক করে প্রভুকে। আসলে আমিও বোকার হদ্দ। একজন মন্ত্রী মানুষ হবেন কেন! উনি তো মন্ত্রী। মন্ত্রী আমার মতো সাধারণ মানুষকে দেখতে হাসপাতালে আসবেন কেন? সিসিইউ থেকে তুলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল ভ’বাবুর কাছে। তার সঙ্গে দেখা করার সময়ের আগে যে সময়টা, বাড়তি, হাতে পাওয়া, তা হাসপাতালেও খরচ করা হল না। নিয়ে আসা হল ‘নিরাপদ বাড়ি’তে আবার। ‘নিরাপদ বাড়ি’ থেকে ভ’বাবুর কাছে। কাছে ঠিক নয়, একটি খালি বাড়িতে। সেটিও হয়তো আরেকটি নিরাপদ বাড়ি। ও বাড়িতে আমাকে বসানো হল। সম্ভবত কোনও সরকারি অতিথিশালা। রাস্তার পাড়ে, এরকম একতলা অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বাড়িগুলো কোথায়, ঠিকানা কী, এসব কিছুই প্রভু বললেন না। প্রভু তাঁর নিজের পদ এবং পদবি দুটোই যখন গোপন রাখেন, কেন বলবেন জায়গাটা কোথায়, কোথায় এনেছেন আমাকে। একটা অদ্ভুত রহস্যের মধ্যে সব ঘুরপাক খায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর চা এলো। প্রভুকে বলছি, আমাকে এই অসুস্থ অবস্থায় আর যেন কোনও কারাগারে রাখা না হয়, আমাকে যেন অতি অবশ্যই কলকাতায়, আমার বাড়ি পাঠানো হয়। কলকাতায় থাকলে তো আমি এভাবে মরতে বসতাম না। এই নির্বাসনে আমার থাকা মানে আমার রক্তচাপ বাড়তে থাকা, আমার হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হতে থাকা। ভ’বাবু এলেন মিনিট পনেরোর মধ্যেই। প্রভুর মুখে একগাল হাসি। সারাক্ষণই আজ তিনি খুশি খুশি। এত খুশির কারণ কী! কোনও ভালো কিছু কি ঘটতে যাচ্ছে! আমার জানার সাধ্য নেই। সম্ভবত প্রভু জানেন যে আজ ভ’বাবু আমাকে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা পাকা করবেন। অথবা প্রভুর খুশির কারণ ভ’বাবুর প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছেন তিনি, তাঁর উপদেশ বা পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। অত্যন্ত নিষ্ঠ, কর্মঠ, বিশ্বস্ত। আমি ক্লান্ত। অসুস্থ। আশা আমাকে আলোকিত করে বটে, তবে এ বড় ফ্যাকাসে আলো। আমার রক্তচাপ এখনও স্বাভাবিক নয়। এখনও শরীরে টের পাই ওষুধের বিষক্রিয়া, এখনও টের পাই রক্তচাপ আকাশে উঠছে, আবার পাতালে নামছে। প্রভু কখনও কিছুই পরিষ্কার করে আমাকে বলেন না। সম্ভবত এমনই নির্দেশ তাকে দেওয়া হয়েছে। প্রভুকে অনেক সময় একটি পুতুলের মতো মনে হয়। চাবি দেওয়া পুতুল। যা বলেন তিনি, সবই শিখিয়ে দেওয়া কথা। এই খুশি খুশি মুখটাও কি শিখিয়ে দেওয়া! কে জানে!
অন্য একটি ঘরে ভ’বাবু এবং একজন অচেনা ভদ্রলোক। ভ’বাবু দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করছেন। আমিও নমস্কার জানিয়ে মুখোমুখি বসলাম। এই মানুষটি কী ভাবছেন, আমার সম্পর্কে তাঁর কী চিন্তাভাবনা, কী পরিকল্পনা তার আমি কিছুই জানি না। কিন্তু এই মানুষটির কাছ থেকে স্নেহ, সমর্থন সব আমি পেয়েছি। এই মানুষটিই তো আমার সবচেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী। তাঁর বাড়িতে কত গেছি, কত ফোনে কথা হয়েছে। সব প্রতিকূলতার মধ্যে তিনিই তো আমার ভারত-বাসের অনুমতিকে বাড়িয়ে চলেছেন। নিশ্চয়ই আমাকে কলকাতার বাড়িতে ফেরাতে খুব চেষ্টা করছেন।
খুব কাছের মানুষের কাছে যেভাবে অভিযোগ করে মানুষ, সেভাবেই অভিযোগ করলাম এত যে ডাক্তার দেখাতে চেয়েছি, তারপরও প্রভু দেরি করেছেন ডাক্তার দেখাতে। প্রায় দু’মাস পর ডাক্তারের ব্যবস্থা করলেন বটে, প্রথম তো হাতুড়ে ডাক্তার, তারপর একজন হাসপাতালের ডাক্তার, ওঁর ওষুধ খেয়েই শরীর খারাপ হল। হাসপাতালে তো মরতেই বসেছিলাম, জীবন বাঁচানোর ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়েছে।
প্রভু বসাই ছিলেন অদূরে। ভেবেছিলাম প্রভুকে এবার ভ’বাবু কিছু ধমক দেবেন। কাজে ফাঁকি দিলে যেভাবে ধমক দেওয়া হয় অধস্তনদের। বলবেন তাঁর কারণেই আমার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য কোনও কটুক্তি নয়, কিছু নয়। ভ’বাবু আমার শরীর এবং মৃত্যুর দুয়ার থেকে আমার ফিরে আসা, এখনও রক্তচাপের স্থিতাবস্থায় না আসা, এখনও যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশংকা, এসবের তোয়াক্কা না করে বললেন, আপনার সঙ্গে আমি এই কারণে কথা বলতে এসেছি যে, আপনি তো এ দেশের সম্মানিত অতিথি, আপনি নিশ্চয়ই, যেহেতু আমরা কথা দিয়েছি যে, এ দেশের আতিথ্য আপনি পাবেন, আপনি ভিসা পাবেন, নিশ্চয়ই পাবেন। আপনার ভিসার মেয়াদ আমরা সামনের ফেব্রুয়ারিতে বাড়াবো। নিশ্চয়ই বাড়াবো। তাই আপনি যদি এ সময় ফ্রান্সে যে পুরস্কারটা আপনি পেয়েছেন, সেটা আনতে যান, খুব ভালো হয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে আমি বলেছি, এরকম তো নিয়ম নেই যে ফ্রান্সের পুরস্কার ভারতে দেওয়া যাবে। যে দেশ পুরস্কার দেয়, সেই দেশে অথবা যে দেশের মানুষকে পুরস্কার দেওয়া হয়, সেই দেশে পুরস্কার দিতে হয়।
আমি বলে উঠি, ‘কিন্তু পুরস্কার তো …..’
ভ’বাবু কঠিন স্বরে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার কথা শুনুন।‘
আমি চুপ হয়ে যাই। তিনি বলতে থাকেন, আপনি তো ভারতের নাগরিক নন, সে কারণে এ দেশে তো পুরস্কার দেওয়া যাবে না। আপনাকে হয় বাংলাদেশ যেতে হবে, নয়তো ফ্রান্সে যেতে হবে পুরস্কার নিতে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আপনাকে ফ্রান্সেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ওখানে আপনার যাওয়ার সব ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে। আমরাই করে দেব। কোনও অসুবিধে নেই। আপনি পুরস্কার নিতে যান।
আমি ক্ষীণ কণ্ঠে বলি, ভ’বাবুর দিকে বড় সরল চোখে তাকিয়ে, ‘যে পুরস্কারটা আমি পেয়েছি সেটার অনুষ্ঠান গত নয়ই জানুয়ারি প্যারিসে হয়ে গেছে। ওখানে আমার প্রকাশক পুরস্কার গ্রহণও করেছেন। সার্টিফিকেটটা তাঁর কাছে আছে, ওটা আমার কলকাতার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে বলেছি।
‘হুম’। ভ’বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি যদি ফ্রান্সে কিছুদিনের জন্য যান, ভালো হয়। আমি মন্ত্রী হিসেবে বলছি, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না বিদেশে থাকার। এখান থেকে সব ব্যবস্থা করেই আমরা পাঠাবো। কোথায় থাকবেন ফ্রান্সে, তার কথা ভাবতে হবে। না আপনার। ফ্রান্স থেকে যদি আপনি অন্য কোনও দেশে বেড়াতে যেতে চান, সেই ব্যবস্থা আমরা করে দেব। টাকা পয়সার ব্যাপারে আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। সব ভারত সরকার করবে।
ভ’বাবুর দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে নয়, অন্য দিকে তাকিয়ে আমার উদ্দেশে কথা বলে যাচ্ছেন। তার পাশের লোকটি লিখে নিচ্ছেন খাতায় কথাবার্তা, প্রভুও খাতা বের করে লিখছেন। আমরা যা কথা বলছি, তা আমাদের দুদিকে দু’জন বসে লিখে যাচ্ছেন। আশ্চর্য, এ কেমন এক সরকারি দেখা হওয়া! ভ’বাবুর গায়ে সুট, মাথায় উলের টুপি। তাঁকে এই পোশাকে কোনওদিন দেখিনি আগে। যতবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁকে ধুতি পাঞ্জাবিতেই দেখেছি। সেই হাসি মুখের আন্তরিক মানুষটি কোথায়! এই মুখে সেই মুখটি খুঁজি। নেই। তিনি বিরতিহীন বলে যাচ্ছেন আপনার কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে এ সময় তো নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। ওরা আবার হৈ চৈ শুরু করতে পারে, ভিসা বাড়ানোর আগে আগে। সতেরো তারিখে আপনার ভিসার এক্সটেনশন হবে, যোলো তারিখেই একটা হৈচৈ করবে ওরা। তখন ওদের বলা যাবে যে ‘উনি দেশে নেই। উনাকে আনার ব্যাপারে পরে বিবেচনা করা হবে। পরিস্থিতি শান্ত হলে নিশ্চয়ই আপনি ফিরে আসতে পারবেন। আপনার যদি মনে হয় আপনি আর আসতে পারবেন না এ দেশে, তাহলে তো ভুল মনে হওয়া। নিশ্চয়ই পারবেন। আমি তো তপন রায় চৌধুরীকে বলেই দিয়েছি। উনি তো খুব স্নেহ করেন আপনাকে। আপনার বয়সী উনার মেয়েও আছে। খুব মেয়ের মতো স্নেহ করেন। তাকে বলেছিলাম আপনাকে বলার জন্য। আপনি ইচ্ছে করলে তাঁর বাড়িতে, অক্সফোর্ডে তার বাড়িতেও থাকতে পারেন। কোনও দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই আপনার। কবে যাবেন, তা যে এক্ষুনি ঠিক করতে হবে আপনার, তা তো নয়। আপনি দু’একদিন সময় নিন। দু’একদিন পর জানালেও চলবে।
ভ’বাবু যখন আমাকে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, বলছেন কিছু দিনের জন্য যেন যাই, আমি শিরদাঁড়ায় টের পাই, এ যাওয়া কিছু দিনের জন্য নয়। এ যাওয়া জন্মের মতো যাওয়া। সারাজীবনের জন্য যাওয়া। বাংলাদেশেও বলেছিলো, কিছু দিনের জন্য যাও, পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরে এসো। পরিস্থিতি শান্ত, আজ প্রায় চৌদ্দ বছর হতে চলল, হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় বলেছে, দুদিনের জন্য যাও, দুদিন পর ফিরে এসো। তিন মাস হতে চললো, আজও পশ্চিমবঙ্গে আমার ফেরা হয়নি।
‘আপনি থাকুন কিছুদিন বাইরে, আপনি গেলে আমাদের পক্ষে সুবিধে হবে আপনাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা। তখন আপনি ফ্রান্স থেকে বাইওরোপের যে কোনও দেশ থেকে সোজা কলকাতায় ফিরতে পারবেন। আপনার কোনও দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। কী করে যাবেন না যাবেন, সব ব্যবস্থা আমরা করে দেব। আপনি এ দেশের সম্মানিত অতিথি। দেখুন, আপনার সঙ্গে কারও দেখা করতে দিচ্ছি না, আপনাকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দিচ্ছি না, সে নিরাপত্তার কারণে। পঁচানব্বইটা লোক ভালো, কিন্তু পাঁচটা লোক তো খারাপ হতে পারে। সে কারণেই কোনও রিস্ক আমরা নিচ্ছি না।
কথা যখন বলছেন উনি, মাঝে মাঝে তাকাই তাঁর মুখের দিকে। কপালের ভাঁজগুলোয় স্পষ্টতই বিরক্তি। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই মানুষটিই সেই মানুষ, একসময় যাঁর বাড়িতে আমি যেতাম। চা খাওয়াতেন। আমি বই উপহার দিতাম। মিষ্টি, দই, ফুল এসব নিতাম তার জন্য। তিনি বসে বসে আমার কবিতা পড়তেন। বলতেন, কবিতা তাঁর খুব ভালো লাগে। একবার ভালো কবিদের সব ভালো কবিতার বইই তাঁকে দিয়ে এলাম তার বাড়িতে। যতদিনই তাঁকে ফোন করেছি, বলেছেন তাঁর বাড়িতে যেতে। দলের সাক্ষাৎপ্রার্থী কর্মীরা বসে থাকতেন, সবাইকে রেখে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন। সবচেয়ে বেশি সময় আমাকেই দিয়েছেন। আমার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আগেই তিনি খোঁজ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বলে দিতেন। বলতেন আমাকে, যে, বলে দিয়েছেন। সেই ভ’ বাবু। ভ’বাবু শত্রুর মতো কথা বলছেন, কণ্ঠে তাঁর এতটুকু মমতা নেই, তারপরও আমার বিশ্বাস হয় না তিনি সত্যিই এখন আমার শত্রু। আমার এই এক মুশকিল, কাউকে মন্দ লোক বলে বিশ্বাস হতে চায় না। তিনি বলতে থাকেন, ওই একই কথা, বারবার নানারকম ভাবে নানা দিক থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে থাকেন। সংক্ষেপ করলে একটি বাক্যই বেরিয়ে আসে, আপনি ভারত ছাড়ুন। আমি কি ছাড়বো ভারত? এককালে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতাম, যিনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আজ রাজনীতি তাঁকে তার নীতি বা আদর্শ থেকে দূরে সরিয়েছে, আমার প্রতি মায়ামমতা স্নেহ যা ছিল সব ছুঁড়ে ফেলে তিনি একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাকে লোভ দেখাচ্ছেন, মুখোশটা পরে আছেন আমার শুভাকাঙ্ক্ষীর।
এখন বলার পালা আমার। খুব শান্ত কণ্ঠ আমার। অসম্ভব শান্ত স্বর। সবে মৃত্যুর মুখ দেখে আসা আমি। এখনও আমার আকাশ পাতাল করা রক্তচাপের কাঁধে বসে দুষ্টু মৃত্যু আমার সঙ্গে নিজে নিজেই লুকোচুরি খেলছে। জাগতিক সবকিছু আমার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। সেখানে রাজনীতির মারপাঁচ, স্বার্থপরতা, নোংরামো আমার কাছ থেকে সহস্র আলোকবর্ষ দূরে। শান্ত কণ্ঠে বলি, ‘বিদেশে আমি দশ বছর ছিলাম। দশ বছরে একটি দিনের জন্য আমি ওই সমাজে, মনে করতে পারিনি যে আমি বিলং করি। আমি যদি কোনো সোসাইটিতে বিলং করি বলে না মনে করতে পারি, তবে সেই সোসাইটিতে জীবন খুব দুঃসহ হয়ে ওঠে। যদিও আমার অনেক নাম ছিল, অনেক পুরস্কার পেয়েছি বিদেশ থেকে, কিন্তু কোনওদিনই আমি মনে করতে পারিনি বিদেশ আমার দেশ। এই ভারতবর্ষ, এখানে আমি অফিসিয়ালি বিদেশি, ফরেনার। কিন্তু কখনো আমার মনে হয় না আমি এখানে বিদেশি। আমি এ দেশে নিজের ভাষায় কথা বলছি। এখানের কালচার আমার কালচার। আমি জন্ম থেকে বড় হয়েছি এই বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে। তাছাড়া শুধু বাংলা নয়, ভারতের যে অংশে, যে অঞ্চলেই আমি যাই না কেন, মনে হয়, আমি এ দেশের, এ মাটির মানুষ। কখনো মনে হয় না আমি ফরেনার, কখনো মনে হয় না আমি এ দেশে বিলং করি না। একটিবারের জন্যও এই দেশে আমার মনে হয় না আমি বিদেশি। আগে তো টুরিস্ট ভিসা দেওয়া হত, যখনই ভিসা পেতাম, চলে আসতাম কলকাতায়। আর যখন থেকে রেসিডেন্স পারমিট দেওয়া হল, তখন থেকে তো থাকতে শুরু করলাম। আমার যা কিছু ছিল বিদেশে, প্রায় সব নিয়ে এসেছি কলকাতার বাড়িতে। দেশ থেকে আমার দাদাদেরও পাঠিয়ে দিতে বলেছি আমার বইপত্র। আপনিই তো আমার রেসিডেন্স পারমিট এক্সটেনশন করায় সাহায্য করতেন, সবসময় এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করে এসেছেন। আপনি যদি আমার বাড়িতে যান কলকাতায়, দেখবেন, মনে হবে যেন তিরিশ বছরের সংসার, এমন। এই স্বপ্ন, এই সংসার ছেড়ে আমি যাবো কোথায়! আমি বাঙালি, বাংলায় লেখালেখি করি, তাই বাংলায় একটু জায়গা চাই। নিজের মতো করে থাকা, লেখালেখি করা। এর বেশি কিছু তো চাই না। বাংলাদেশে যদি সম্ভব হত, চলে যেতাম। চেষ্টা যে করিনি, তা নয়। ওখানে আমার ল’ইয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি…’।
–‘আপনার ল’ইয়ার তো সারা হোসেন, তাই না?’ ভ’বাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ সারা, সারার বাবা ডক্টর কামাল হোসেন। ডক্টর কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। উনি আমার দেশে ফেরার ব্যাপারে কোনো কথাই বলতে চান না। ওঁর স্ত্রী হামিদা হোসেনকেও তো চিঠি লিখলাম। মোটেও আগ্রহ দেখালেন না। ফেরা সম্ভব হলে ফিরতাম। এই দেশে থাকার চেষ্টা করতাম না। কোথাও কোনো জায়গা নেই বলে এই দেশে থাকি। প্রাণের টানে, ভাষার টানে, শেকড়ের টানে থাকি। এখানে লেখার মধ্যে থাকতে পারি, বাঙালি বন্ধু, বাঙালি পাঠক, এসবের মধ্যে থাকার প্রয়োজন তো খুব একজন বাঙালি লেখকের। দেশ থেকে কিছু আত্মীয় স্বজনও আসতে পারে। আমি তো ইসলাম নিয়ে এখন কিছু লিখিনি। অনেকদিন আগে লেখা বই দ্বিখণ্ডিত। ভারতে থাকা শুরু করার অনেক আগে। দ্বিখণ্ডিত বিদেশে বসে লেখা বই। ভারতে থেকে আমি ইসলাম নিয়ে লিখিনি কিছু। ওই বই থেকে তো পার্লামেন্টে প্রণব বাবু বলার পর ডিলিটও করে দিলাম। আপনার সঙ্গে প্রণব বাবুর কথা হয় কী না জানি না। উনি জানেন আমি যে ডিলিট করেছি।
ভ’ বাবু মাথা নাড়লেন।
‘এখন যদি আমার রেসিডেন্স পারমিটটা এক্সটেন্ড না করেন, তবে তো আমাকে চলে যেতেই হবে এ দেশ ছেড়ে। বুঝবো আমার জন্য এই উপমহাদেশে কোনও জায়গা নেই’।
এ সময় আমার গলা বুজে আসে কান্নায়। বলতে থাকি আমি। দু’চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে জল। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে আর চোখ বেয়ে জল ঝরছে। ঝরেই যাচ্ছে। ভ’বাবু এত বড় একটি দেশের এত বড় ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যে দেশটি অদূর ভবিষ্যতে ‘সুপার পাওয়ার হওয়ার মতো যোগ্যতা রাখছে, সেই দেশটি আমার মতো স্বদেশ হারা, স্বজনহারানো একটি অসহায় লেখককে জায়গা দিতে পারছে না একশ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশে, মাত্র হাতে গোনা কজন মৌলবাদী চাইছে না বলে। অবিশ্বাস্য লাগে সবকিছু। মৌলবাদীদের সন্তুষ্টি করা ভোটের জন্য দরকার, ক্ষমতায় থাকার জন্য দরকার। শুনেছি। ক্ষমতার এত লোভ সবার! সমাজটাকে নষ্ট করে হলেও ক্ষমতা চাই।
বলতে থাকি, চোখের জল মুছে নিয়ে বলতে থাকি, ‘বিদেশে আমি হয়তো প্রাণে বেঁচে থাকতে পারি, কিন্তু সেই বেঁচে থাকা সত্যিকার বেঁচে থাকা নয়। সত্যিকার বেঁচে থাকতে হলে, আমাকে বাংলাদেশে নয়তো ভারতে থাকতে হবে। ওসব দেশে আমি বেঁচে থাকতে পিরবো, কিন্তু লেখক হিসেবে বেঁচে থাকতে পারবো না। আমি বিদেশে যেতে চাই না। ওসব দেশে থাকতে আমার ভালো লাগে না। ওসব দেশে আমি এক মুহূর্তের জন্য ভালো থাকি না। আমি কোথাও যাবো না। দিল্লিতেই থাকবো, যেখানে রেখেছেন সেখানেই। যেদিন কলকাতা যেতে দেবেন, সেদিনই যাবো কলকাতায়। তার আগ অবধি এখানেই থাকবো। আমাকে এ দেশের অনেকে তো ভালোবাসে।
ভ’বাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ তা নিশ্চয়ই বাসে।
‘যারা চাইছে না আমি এ দেশে থাকি, ওরা তো অল্প কজন লোক। ওরা চাইছে বলে আমার জীবন নষ্ট হবে কেন! ওদের হুমকি তোত আমার জীবনে নতুন কিছু নয়। ওরা এমন হুমকি কোনো একটা উদ্দেশ্যে দেয়, পরে আবার চুপ হয়ে যায়। এখন যদি এখানে, এই সেইফ হাইজে কিছুদিন থাকতে হয়, অপেক্ষা করতে হয়, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি শুধু চাইবোদু’একজন বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে যেন দেখা করতে দেওয়া হয়..।
ভ’বাবুও তাঁর কথাগুলো পুনরায় বললেন। আমিও অত্যন্ত শান্তকণ্ঠে একই কথা আবার বললাম। কোথাও যাবো না। এরপর তিনি হঠাৎ ঘড়ি দেখলেন। তাঁর তাড়া আছে। যেতে হবে।
‘আপনাকে তো আমি ফোন করতে চাই। কিন্তু আপনার ব্যস্ততা আছে ভেবে ফোন করতে কুণ্ঠা বোধ করি।
হেসে বললেন, ”রাত দশটার পর ফোন করবেন। দেখি আমি পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সঙ্গে কথা বলে দেখি..
এতক্ষণের এই কথোপকথনের পর আমি ভাবলাম ভ’বাবুর মন বোধহয় আমার জন্য একটু নরম হয়েছে। কিন্তু কোথায় নরম। গাড়ি করে আমাকে যখন পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কারাগারে, পথে ফোন এল ভ’ বাবুর, প্রভুর কাছে। এক নম্বর, তিনি জেনুইনলি চাইছেন আমাকে হেল্প করতে। সুতরাং এটা যেন আমি বুঝতে চেষ্টা করি। দুই নম্বর, আজকের সাক্ষাতের কথা যেন মিডিয়া না জানে।
পথে প্রভুকে অনেক অনুরোধ করলাম চলুন কোনো ক্যাফেতে, কোথাও না কোথাও, কোনও রেস্তোরাঁয়, চলুন বাইরে কোথাও। আমি আসলে মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে আমি বন্দি। তাই অমন আবদার করি। প্রভু আমাকে কোথাও নেন না। কারাগারে ফিরে আসেন। পায়চারি করি ভোলা ছাদে। সঙ্গে প্রভু। উনি রহস্যময় মানুষ। বললেন, ”আপনার প্রেজেন্টেশনটা দারুণ। আমি মুগ্ধ।
আমি বলি, ‘আমি তো ওখানে অভিনয় করতে যাইনি। আমার মনের কথাগুলোই বলেছি।
পায়চারি করার সময় মনে থাকে না, ভুলে যাই যে, আমি মাত্র সিসিইউ থেকে উঠে আসা। কোনো বাঁধন না মানা রক্তচাপ থেকে উঠে আসা। রক্তচাপ মেপে দেখলাম, ২২০/১২০।
–চলুন এক্ষুণি যেতে হবে হাসপাতালে। ভর্তি হতে হবে। –কিন্তু ভর্তি করবে না। গিয়ে লাভ নেই।
–কেন করবে না। ওরাই তো বলেছিলো ব্লাড প্রেসার স্বাভাবিক না হলে হাসপাতাল থেকে ছাড়বে না। এখনও তো স্টেবল হয়নি। এই ব্লাড প্রেশার নিয়ে আমি হাসপাতালের বাইরে থাকবো না। কালই আমার রক্তচাপ দু’শ থেকে পঞ্চাশে নেমেছিলো। আমি ভরসা পাচ্ছি না এখানে থাকতে।
প্রভুর যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। কিন্তু আমি যাবোই। ভর্তি হওয়ার জন্য কিছু কাপড় চোপড়ও নিলাম। হাসপাতালে আরও কটা দিন থেকে যাওয়া উচিত, এ কথা ডাক্তাররাও বলেছিলেন। কিন্তু থাকতে দেওয়া হল না আমাকে। প্রভু এবং ডাক্তারদের মধ্যে কী কথা হল। যে ডাক্তাররা বলেছিলেন, থাকা জরুরি, তাঁরাই বলে দিলেন, জরুরি নয়। সরকারি হাসপাতাল এইমস হাসপাতাল। সরকারি আদেশ মাথা পেতে নেবেনই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা।
আমি ভাবছিলাম, খুব গভীরভাবে ভাবছিলাম, আমাকে যে ভ’বাবু দেশ ছাড়ার কথা বলেছেন, তা অতটা অমানবিক নয়, যতটা অমানবিক সিসিইউ থেকে রক্তচাপের রোগী উঠিয়ে পনেরো মাইল দূরে নিয়ে গিয়ে সবচেয়ে ভয়ংকর সংবাদটি দেওয়া। এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে! আমার দুর্বল হৃদপিণ্ডটি তো বন্ধ হয়ে যেতে পারতো!
আর কোনও রাখ ঢাক রইলো না। এ কথা এখন দিনের আলোর মতো, যে করেই হোক তারা চাইছেন চলে যাই। অসুখে বিসুখে মানুষের মন দুর্বল থাকে। দুর্বল সময়টাকেই বেছে নিয়েছেন কঠিন দাওয়াইটি দেওয়ার জন্য। আমি বললাম বটে আমি যাবো না, কিন্তু তিনি কি আর মানবেন! তিনি নিশ্চয়ই আগুন হয়ে আছেন আমার স্পর্ধা দেখে। হাল ছাড়েন নি। একা মানুষ। তার আবার শক্তি কতটুকু। কতদিন সে বইতে পারবে একাকীত্ব আর পরাধীনতার যন্ত্রণা!
হাসপাতালে গিয়েও ফেরত আসতে হল। ভর্তি নেয়নি।
বাড়িঘর ছেড়ে, প্রিয় বেড়াল ছেড়ে, বইপত্র, বন্ধুদের ছেড়ে, নিজের জীবন ছেড়ে, অনিশ্চয়তার বোঁটকা-গন্ধ-কাঁথায় মুখ-মাথা ঢেকে, দিনের পর দিন পড়ে থাকা কোথায় পড়ে থাকা কতদিন কিছুই না জানা –হৃদপিন্ডকে দাঁতে নখে কামড়েছে ভীষণ।
তারপর তো হৃদয় স্তব্ধ হলে অগত্যা সিসিইউ। যায়-যায় জীবনকে কোনওমতে টেনে আনা হল, ধুকধুক বুক ফিরে যেতে চায়, রুগ্ন শরীর ফিরে যেতে চায় ঘরে। বেড়ালের কাছে, বন্ধুর কাছে, স্পর্শের কাছে প্রিয়।
কে আর তোয়াক্কা করে হৃদয়ের! সিসিইউ থেকে তুলে নিয়ে তাকে শোনানো হল বড় গম্ভীর, গা কাঁপানো স্বর, অন্য কোনও দেশে চলে যাও, এ-দেশ ছাড়ো। কোথায় যাবো, কোথাও তো যাওয়ার নেই আর, মরলে এ মাটিতেই মাটি দিও।
মাটি খুঁড়ে দেখতে চাও তো দেখে নিও আমার শেকড়। কারই বা কী দায় পড়েছে দেখার, কারই বাদায় পড়েছে চোখের জলে ভেসে যাওয়া মানুষের কাতরানো দেখে কাতর হওয়ার! সিসিইউ থেকে আবার নির্বাসনে, আবার অন্ধকারের গায়ে আবর্জনার মতোছুঁড়ে হাত ধুয়ে বাড়ি চলে গেলেন ওঁরা, ওঁরা খুব বড় বড় লোক, হাতজোড় করে নতমস্তকে নমস্কার করি ওঁদের।