নির্বাসন
আত্মজীবনী সপ্তম খণ্ড
তসলিমা নাসরিন
প্রথম প্রকাশ জানুয়ারী ২০১২
মদনজিৎ সিং শ্রদ্ধাস্পদে
.
০১. নিষিদ্ধ মত, দ্বিখণ্ডিত পথ
হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অদ্ভুতও নয়-চমৎকারও নয়-খুব যাচ্ছে তাই নয়-আবার খুব ঝলমলেও নয় জীবন পার করেছি। টানা এক বছর। হারভার্ড ল’ ইস্কুলের উল্টোদিকে পঞ্চাশ ল্যাঙ্গডন স্ট্রিটের সাদা তিনতলা বাড়ির তিনতলাটি ভাড়া নিয়ে নিই হঠাৎ একদিন। বাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে হারভার্ডের কেনেডি ইস্কুলএ যাই। কেনেডি ইস্কুল অব গভর্মেন্ট। হারভার্ডের এই ইস্কুলটিই শুনেছি সবচেয়ে নামি-দামি। নামি, দামি, বিখ্যাত, বিরাট এসব শব্দ আমাকে আকষ্ট করে না। মানুষগুলো ভালো কি না, সৎ কি না, মনে যা, মুখে তা-ই কি না সেটাই আমি আগে দেখি। কেনেডি ইস্কুলের হিউম্যান রাইটস সেন্টারে আমার জন্য অফিস, ডেস্ক, কমপিউটার, ইন্টারনেট, প্রিন্টার, কাগজ, কলম, স্টেপলার, আলপিন খুঁটিনাটি। অফিসের দরজা খুলে বেরোলেই করিডরে চা কফি বিস্কুট। নিচের ক্যাফেটেরিয়ায় সুস্বাদু স্বাস্থ্যকর খাবার। গলায় আমার হারভার্ডের আইডি ঝোলে। ‘রিসার্চ স্কলার’, কেনেডি ইস্কুল, হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এই আইডি জাদুর মতো কাজ করে। হারভার্ডের অলি গলি চষে বেড়ানো যায়। অত বড় লাইব্রেরি থেকে যখন তখন দুষ্প্রাপ্য বই নিতে পারা, রাতে যতক্ষণ খুশি অফিসে কাটাতে পারা, দু’মিনিটে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হয়ে যাওয়া, মুহূর্তে চিকিৎসা হয়ে যাওয়া যে কোনও অসুখের! কী নয়।
দিনে প্রায় সারাদিন অফিসেই থাকি। কাছের কোনো রেস্তোরাঁয় খেতে যাই দুপুরে। কখনও ভারতীয় রেস্তোরাঁ, কখনও সাদামাটা আমেরিকান, কখনও সী ফুড। বিকেলে সাঁতার কাটি নয়তো মানুষের গোছানোবা এলোমেলো জীবন দেখতে দেখতে অনেকটা পথ অবধি আনমনে হাঁটি। ওজন পঞ্চাশ কিলো। জিনস, টপস। দেখতে কিশোরী কিশোরী। সুদর্শন হারভার্ড ফেলো গ্রেগ কারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে হতে হয় না, স্টেডিয়ামে পাশে বসিয়ে হারভার্ড আর ব্রাউনের ফুটবল খেলা বোঝালো, সুইটি টুইটি বলে বেশ ই-মেইল করলো অনেকদিন, ফেরারিতে চড়ে চলে এলো বাড়িতে, নেমন্তন্নও করলো তার পেন্টহাউজে। কিন্তু হঠাৎ কী কারণে জানি না, আমেরিকার ইরাকে বোমা ফেলাকে পছন্দ করিনি বলে নাকি এ নিয়ে বেজায় তর্ক করেছি বলে, যোগাযোগ দুম করে প্রায় বন্ধ করে দিল। অত প্রেম নিমেষে উড়ে গেল! বড়লোকদের শখ আর রকম সকমে আমার উৎসাহ চিরকালই কম। তবে গ্রেগ কারকে আমি শ্রদ্ধা করি এবং করবো, হারভার্ডে হিউমেন রাইটসের সেন্টার খুলেছেন বলে। টাকা তো অনেকের হাতেই আছে, ক’জন আর মানবাধিকারের সেবায় কোটি কোটি টাকা ঢালে! হারভার্ডের ফেলো আর প্রফেসরের সঙ্গে মাঝে মাঝেই জগতের একশ’ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কবিতা লিখি। আত্মজীবনী লিখি। প্রবন্ধ লিখি। দূরের কোনো অচেনা মানুষের জন্য প্রেমের চিঠি লিখি। আবার হারভার্ডের জন্য সেকুলারিজম এর ওপর একটা বড় লেখাও লিখতে হয়। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক যাওয়া হয়, দেশে, দেশের বাইরে, ইউরোপে, কিছু না কিছুতে, পুরস্কার আনতে, নয়তো কবিতা
পড়তে, বক্তৃতা দিতে। বক্তৃতাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বক্তৃতা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে, সঙ্গে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার নেত্রী মেরি রবিনসন, বস্টনের কেমব্রিজ সেন্টারে কবিতা পাঠ, সঙ্গে ভ্যাজাইনা মনোলগ-এর ইভ এন্সলার, হারভার্ডের উইমেন স্টাডিস ডিপার্টমেন্টের ফাণ্ড রেইজেংএ সাহায্য করা, মাইকেল ইগনাটিফ বা স্যামুয়েল হান্টিংটঙের ক্লাস বা হারভার্ডে আসাবিখ্যাত অতিথিদের বক্তৃতা শোনা, নোয়াম চমস্কির সঙ্গে তাঁর এমআইটির ঘরে আড্ডা আর ইমেইলে ইরাক যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা, যুদ্ধের প্রতিবাদে আমার লেখালেখি, দল বেঁধে বস্টনের ফেনওয়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে রেড সক্সএর বিখ্যাত বেইসবল দেখা, হঠাৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত দীর্ঘদিনের বন্ধু স্টিভ লেসিকে দেখতে যাওয়া, হারভার্ড চ্যাপলেন্সিতে মানববাদীদের সঙ্গে মানববাদ নিয়ে আলোচনা, সুয়ানি হান্টের বাড়িতে পাঁচমিশেলি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করা, মাঝে মাঝে কিছুদিন নিউইয়র্ক, হঠাৎ আবার কলকাতা ঘুরে আসা বইমেলায়। আবার হারভার্ড।
.
এর মধ্যে খবর পাই বাংলাদেশ তেতে উঠেছে। বিবিসি খবরটা দেয়। কলকাতায় প্রকাশিত আমার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড ‘দ্বিখণ্ডিত’র বাংলাদেশ সংস্করণের নাম ‘ক’। প্রথমে ‘ক’ ই ছিল নাম। পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশক ‘ক’ নামটায় আপত্তি করায় নাম দিয়েছি”দ্বিখণ্ডিত। ‘ক’ বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি আগুন জ্বলছে। আমাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করা হচ্ছে সব পত্রিকায়। লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক আমার বিরুদ্ধে ক্লান্তিহীন নিন্দায় মেতে আছেন। কার কার সঙ্গে শুয়েছি তাই নাকি লিখেছি আমি বইয়ে, আমার মতো নির্লজ্জ বেশ্যা’ আর জগতে নেই। বইয়ের যে পাতায় লেখা আছে আমার ‘শোয়াশুয়ি’র ঘটনা, সেই পাতা ফটোকপি করে ছড়ানো হচ্ছে সবখানে। সৈয়দ শামসুল হক একবার আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন দুরে। সেখানে গিয়ে আমার যে ধারণা জন্মেছে তাঁর সম্পর্কে, নিতান্তই তার নিটোল বর্ণনা ছিল এক জায়গায়। এ নিয়ে তাঁর রাগ করার কিছু আমি দেখি না। কিন্তু শুনেছি তিনি রাগে নাকি হায়েনার মতো করছেন। এ কথা প্রথম জানিয়েছিলেন মেজবাহউদ্দিন, বইয়ের প্রকাশক। তাঁর শ্যালিকার সঙ্গে তাঁর যে একটা গোপন সম্পর্ক আছে, তা আমার লুকোনো উচিত ছিল, কিন্তু আমি লুকোইনি। সৈয়দ হকের রাগের কারণ এটিই। শ্যালিকা নিয়ে লেখা বইয়ে একটিই বাক্য সম্ভবত আছে, ওই বাক্যটি পড়েই তিনি উত্তেজিত। আমি নাকি যা লিখেছি সব মিথ্যে, মামলা ঠুকে দিলেন ১০ কোটি টাকার। সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন সবখানে, ‘তসলিমা আমার চরিত্র হনন করেছে। মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ৫২ বছরে লেখক হিসেবে আমি যে সম্মান কুড়িয়েছিলাম তা আজ ধুলোয় ধূলিস্যাৎ। নিশ্চয়ই এর পিছনে কিছু রহস্য আছে। না হলে তিনি দেশের এত সম্মানিত লেখক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে লিখতে সাহস পেতেন না। আমার মনে হয়েছে, প্রতিবাদ করা দরকার। তাই মামলা ঠুকে প্রতিবাদ জানালাম। তসলিমার বইয়ে এ ধরনের আরও যাদের নাম রয়েছে, আমি আশা করবো তারাও কোনো না কোনো পদক্ষেপ নেবেন। আমারটা আমি ভেবেছি, আইনের আশ্রয় নিয়ে করবো।’
বিবিসি থেকে আমার মন্তব্য চাইতে ফোন করলো, শুনিয়েও দিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সৈয়দ হক আমার বিরুদ্ধে কী নিন্দা করেছেন সেসব। ক্রোধ,ঘৃণা, বিদ্রূপ, কটাক্ষ দুজনের কণ্ঠেই। সৈয়দ শামসুল হক না হয় তার গোপন সত্য প্রকাশ হওয়ায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, চেঁচিয়ে, লাফিয়ে, হম্বিতম্বি করে, গালি দিয়ে, থুতু ছুঁড়ে, মামলা করে বোঝাতে চাইছেন যে তাঁর সম্পর্কে যা লিখেছি আমি তা ভুল। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিয়ে বইয়ে তেমন কোনো কথা নেই। তার এত রাগ কেন! তিনি তো কোনো ‘পুরুষ রক্ষা সমিতি’র সদস্যও নন। তিনি বারবারই বলেছেন, দুটো মানুষের মধ্যে দরজা বন্ধ করে। যা ঘটে, তা কখনো বাইরে প্রকাশ করতে হয় না। বাইরে প্রকাশ করা যাবে না, এমন কাজ অপরাধীরাই করে। আর অপরাধীদের বাঁচানোর দায়িত্ব কে বলেছে সব মেয়েকেই নিতে হবে। আগুন যেমন এক অরণ্য থেকে আরেক অরণ্যে বাতাসের আগে ছুটে যায়, তেমন গেল, কলকাতাতেও সাহিত্য মহলের একাংশে নিন্দার ঝড় বইছে, এই ঝড়ের দেবতা, কেউ কেউ বললো, স্বয়ং সুনীল। যদিও তাঁর কিছুই আমি ফাঁস করিনি, কিন্তু কিছু যদি করি পরের বইগুলোতে, এই ভয়। আমাকে বাতিল করে, ব্যান করে, ত্যাগ করে, ত্যাজ্য করে পাঠকের কাছে আমাকে মিথ্যুক, অযোগ্য, কাণ্ডজ্ঞানহীন, ভারসাম্যহীন লেখক হিসেবে দাঁড় করাতে পারলে কেউ আমার কথা আর বিশ্বাস করবে না, আমার লেখা আর পড়বে না। এই নিন্দার ঝড়তুফান শান্ত হওয়ার আগেই খবর ছাপা হয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করেছেন। পঁচিশ জন লেখক, বুদ্ধিজীবী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন আমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করার জন্য। মুখ্যমন্ত্রী সবার কথা শুনেছেন, নিজেও বইটি কয়েকবার পড়েছেন। পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিষিদ্ধ করার। নিষিদ্ধ করা হয়েছে অবশ্য অন্য কারণ দেখিয়ে, আমি নাকি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি। ওদিকে বাংলাদেশে ‘ক’ নিষিদ্ধ। হাইকোর্টে সৈয়দ শামসুল হক আমার বিরুদ্ধে দশ কোটি টাকার মামলা করেছেন মানহানির, বই নিষিদ্ধ করার আকুল আবেদন জানিয়েছেন সরকারের কাছে। সরকার বই নিষিদ্ধ করার আগেই হাইকোর্ট নিষিদ্ধ করেছে। এসবে অনুপ্রাণিত হয়ে কী না জানি না, কলকাতায় প্রায় অচেনা এক কবি মানহানির মামলা ঠুকে দেয়, এ আবার এগারো কোটির। লেখকরা বই নিষিদ্ধ করছেন, লেখকরা লেখকের বিরুদ্ধে মামলা করছেন। জগতের কোথাও এমন ঘটনা ঘটে না। সভ্য লেখকরা লেখকের বাক স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ান, বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কথা বলেন। বাংলার লেখকদের যত দেখি, তত অবাক হই। বেশির ভাগই স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী, সরকারী আনুকূল্য ছাড়া বাঁচতে জানেন না। আদর্শ! নীতি! ওসব মুখে বা বইয়ে। অন্তরে নেই, বিশ্বাসে নেই, জীবন যাপনে নেই।
.
পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের বিখ্যাত সাহিত্যিকরা আমার নিন্দায় বিষম মেতে আছেন। নিন্দা কী রকম বীভৎস হতে পারে, কুৎসা কী রকম নির্মম হতে পারে, ঘৃণা কী রকম ভয়ংকর হতে পারে, তা অনুমান করতে হলে শুনতে হয় ওঁরা কী বলছেন, কী লিখছেন আমাকে নিয়ে। বাংলাদেশের লেখক হুমায়ুন আজাদ লিখলেন, “আমি ‘ক’ বইটি পড়ার উপযুক্ত মনে করিনি বলেই পড়িনি। এই বইয়ে আমাকেও নানারকম গালাগালি করা হয়েছে, মিথ্যে কথা লেখা হয়েছে। কিন্তু আমার সম্পর্কে কোনও যৌনতার অভিযোগ আনতে পারেনি। কারণ আমি কখনই তসলিমার ডাকে সাড়া দিইনি। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ক’ বইটি সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটি একটি পতিতার নগ্ন আত্মকথন অথবা একজন নিকৃষ্টতম জীবনের কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা।’
হুমায়ুন আজাদ প্রায়ই ধর্মের সমালোচনা করেন। আমি নারীর অধিকার নিয়ে লিখতে শুরু করার পর তিনিও একই বিষয় নিয়ে একটি বই লিখতে শুরু করেন। বই লিখেছেন কিন্তু মেয়েদের প্রতি কখনও তার কোনও শ্রদ্ধাবোধ দেখিনি। একসময় নারী বিরোধী প্রবচন লিখেছেন। নারীর পক্ষে লিখলে জনপ্রিয়তা অর্জন সম্ভব হতে পারে, তা আমার ‘নির্বাচিত কলাম’এর জনপ্রিয়তা দেখেই ‘নারী’ নামে বই লিখেছেন, কিন্তু নারীকে যৌনবস্তু ভাবার মন বই লেখার আগে যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। কোনও পরিবর্তন হয়নি। আমার সম্পর্কে মিথ্যে উচ্চারণে হুমায়ুন আজাদের কোনও অসুবিধে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তিনি, বলে ফেললেন তসলিমার ডাকে আমি সাড়া দিইনি। যেন আমি তাঁকে ডেকেছিলাম কোনওদিন! একজন ডাক্তার, তার ওপর জনপ্রিয় লেখক, সাহিত্য পুরস্কার সহ প্রচুর মানবাধিকার পুরস্কার পাওয়া প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন নারীর আত্মজীবনীকে তিনি বলে দিলেন ‘পতিতার নগ্ন আত্মকথন এবং নিকৃষ্টতম জীবনের কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা’। প্রচণ্ড নারীঘৃণাকারী বদমাশও কোনো নারী সম্পর্কে না জেনে না বুঝে এই মন্তব্য করতে না। হুমায়ুন আজাদের মতো দুশ্চরিত্র, মিথ্যুক, ঈর্ষাকাতর, ছোট-লোক যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন, তবে নতুন প্রজন্ম কী শিক্ষা পেয়ে বড় হবে, ভেবে আমি শংকিত হই, সত্যি। নারী বিরোধী সমাজে নারী বিরোধী হুমায়ুন আজাদকে ঘিরে থাকার জন্য নারী বিরোধী বালককুলের অভাব হয় না।
নিমা হক বলেছেন, ‘স্বাধীনতা ভোগের একটা সীমা আছে। তসলিমা সে সীমা লঙ্ঘন করেছেন। সাহিত্যের নামে এই ধৃষ্টতার জন্য তার শুধু তিরস্কারই প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য শাস্তিও’। আসাদ চৌধুরীকে বহুকাল চিনি, খুব প্রশংসা করতেন আমার লেখার। তিনি বলেছেন, ‘ব্যক্তি সমাজ বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়েই সাহিত্য, কোনও লাম্পট্যের নির্লজ্জ বর্ণনা কখনো সাহিত্য হতে পারে না’।
এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লেখকরা শকুনের মতো খামছে ধরেছেন আমাকে। সমরেশ মজুমদার লিখলেন, ‘প্রায় ৯০ বছর আগে কলকাতার সোনাগাছিতে খ্যাতনামা বেশ্যা থাকতেন। তাঁর নাম ছিল নন্দরানী। কলকাতার প্রায় সমস্ত খ্যাতনামা ব্যক্তিদের যাতায়াত ছিল তাঁর কাছে। অবশ্যই খদ্দের হিসেবে। তিনি যদি এঁদের নিয়ে উপন্যাস রচনা করার কথা ভাবতেন তাহলে তিনি তা অনেকদিন আগেই করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে সমাজে চুপচাপ থাকার ভদ্রতা ও সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তসলিমা নাসরিন নন্দরানীর সেই আত্মসম্মানবোধের অংশীদার হতে পারেননি। তসলিমা শাড়ি বদলাবার মতো করে পুরুষ বদলেছেন। মানসিক সম্পর্কের চেয়ে শারীরিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে এসেছেন। সাধারণ মেয়েরা তাঁর এই দ্বিচারিতার কথা জানতে পারেনি। তবে সবারই বাক স্বাধীনতা আছে। তসলিমা বলেছেন, আমরা শুনেছি। বিচার করার ক্ষমতা নিজেদের ওপর নির্ভর করছে। ঘরের ভিতর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে খিস্তি খেউর করা যায় কিন্তু প্রকাশ্যে তা করলেই তাকে অশ্লীলতা বলে। এখন যা তিনি প্রকাশ্যে বলছেন, একসময় সেই কাজে নিজেই সহযোগিতা করেছেন। আসলে ওঁর উদ্দেশ্য ছিল বই বিক্রি করা এবং প্রচার পাওয়া। পশ্চিমবঙ্গের কবি সুবোধ সরকার লিখেছেন, তিনি সুইডেন থেকে ‘ক’ নামে একটি যৌন বোমা পাঠিয়েছেন ঢাকায় এবং ঢাকায় সেটি ফেটেছে। বইটিতে নাকি সমাজ নিয়ে, পরিবার নিয়ে, ধর্ম নিয়ে কথা আছে, কিন্তু কে শোনে ওদের কথা, যখন একই মোড়কে রয়েছে বেশ কয়েকটি রগরগে বেড সিন। বেডসিনের কাছে এই মর পৃথিবীতে ইরাক-আমেরিকাও তুচ্ছ সেটা আবার বোঝা গেল। ..হায়রে, যৌনতা কি তসলিমার ভেতরের কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি, যা তার বাবাকে ছাড়ে না, বাবার বয়সীদেরও ছাড়ে না! শুনেছি আপনার যৌনকেচ্ছার তালিকা নাকি আরও বেরোবে। কলকাতার লেখকরাও দিন গুনছেন। নিশ্চয়ই আপনার স্টকে ফরাসি ইতালিয়ানরাও আছেন। অচিরেই আপনার নাম বিখ্যাত বাঈজির তালিকায় উঠবে। দু’একজন বাঙালি স্কলার আপনাকে নিয়ে বই লিখবে, একজন লেখিকা কোন আর্থ সামাজিক চাপে বাঈজি হয়ে গেলেন। ভাগ্যিস, আপনি সুইডেনে থাকেন। খারাপ পাড়ার লোকেরা এরপর জানতে চাইবেন, কীসে আপনার পেমেন্ট হয়, ডলারে, সুইডিশ ক্রোনারে, টাকায় না রুপিতে? ভাষাহীন মেয়েদের ভাষা দিতে চেয়েছিলেন আপনি, সেই মহৎ ইমেজ আর থাকলো না। এবার মেয়েরাও আপনাকে ছুলে ডেটল দিয়ে হাত ধোবেন। আরবের আতরও আপনার ছোট্ট দুটো হাতের গন্ধ দূর করতে পারবে না কোনোদিন’।
আরেক বিখ্যাত লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘শুনেছি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার যৌনসম্পর্কের নানা বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। আমি এটাকে অশ্লীল বলে মনে করি না। তিনি যদি তার বিবেক মুক্তির জন্য লিখে থাকতেন তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন। এটাকে আমি মেনে নিতে পারি না। সাহিত্য ও অশ্লীলতার মধ্যে সীমারেখা টানতে জানাই সাহিত্যিকদের দায়িত্ববোধের পরিচয়’।
নবনীতা দেব সেনও বলেছেন মন্দ। বাণী বসুও মন্দ। বাণী বসু বলেছেন, ‘আত্মজীবনী পড়ে যদি গিমিক মনে হয় তাহলে তার সততা নিয়ে সকলে প্রশ্ন তোলে। পাঠকের এই কৌতূহল সাময়িক। সাহিত্য বিচারে তার লেখা নিম্নমানের। এই ধরনের লেখার কোনো সাহিত্যমূল্য নেই। এই বাণী বসুও অবশ্য পরে দৈনিক স্টেটসম্যানএ ছাপা হওয়া আমার কলাম পড়ে ফোন করেছিলেন আমাকে, বলেছিলেন আমার লেখা নাকি খুব ভালো লাগে তাঁর। অবশ্য আমি জানি না আমি ছাড়া বাইরের কাউকে তিনি তার মুগ্ধতার কথা জানতে দিয়েছেন কি না।
মল্লিকা সেনগুপ্ত, নতুন নারীবাদী কবি, লিখলেন, এখানে শুধু শোওয়ার জন্য শোওয়া। একের পর এক তালিকা। এটা কোনো আত্মজীবনী হতে পারে না। এর মধ্যে কতটা সত্যি আছে জানি না, কারণ অতীতেও তার সততায় সংশয় ছিল। এর সাহিত্যিক সততা এবং নারীবাদী সততা আমার কাছে স্বচ্ছ নয়। প্রতিটি সম্পর্ক তসলিমা নিজেই তৈরি করেছেন। সেখানে কার সঙ্গে শুয়েছেন, কার সঙ্গে কি করেছেন সেটা চমক তো বটে। এর মধ্যে কোনো বিশেষত্ব নেই। তসলিমার এই জীবনলেখ মানুষের আস্থা হারিয়েছে।… শোবার ঘরের অন্য গল্প আছে, কিন্তু তাঁর মতো রগরগে ভাষায় লেখার রুচি সকলের হয় না। হয় না বলেই সাহিত্য টিকে আছে। তসলিমার শোবার ঘরের চেয়ে অনেক বড় জায়গায় নারীবাদের লড়াই বেঁচে আছে।
গৌতম ঘোষ দস্তিদারকে বন্ধু-কবি বলেই জানতাম। তিনি দ্বিখণ্ডিত সম্পর্কে লিখলেন, ‘এই স্ববিরোধিতা, এইসব সচেতন যুক্তিহীনতা, অর্ধসত্য, ক্লেদ আর নির্লজ্জতাই তসলিমার চরিত্র। মূল্যবোধ জাতীয় কোনো শব্দ তসলিমার অভিধানে নেই। খ্যাতি, খ্যাতি আর খ্যাতি ছাড়া কোনো লক্ষ্য নেই। অখ্যাতিকেও তিনি খ্যাতি বলে ভাবেন। ফলে, সত্যের অছিলায় নিজের জীবনকাহিনী লিখতে গিয়ে নিজেকেই কেবল নগ্ন করে দেখান না, অন্যকেও নগ্ন করেন। এখানেই তার মূল্যবোধহীনতা প্রকট হয়ে ওঠে। আমরা যদি তার এইসব যৌনগাথাগুলিকে সত্যি বলেও ধরে নিই, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে, এই গোপন তিনি প্রকাশ্যে করতে পারেন কি না, তাতে সম্পর্কের (হোক তাজৈব) শর্ত ভাঙে কি না। অবশ্য, তসলিমার কাছে এইসব স্বাভাবিক বৃত্তি আশা করা বৃথা। প্রথমাবধিই তাঁর এই জাতীয় মূল্যবোধ গড়ে ওঠেনি’।
আর কমিউনিস্ট লেখক আজিজুল হক লিখলেন, ‘শারীরিক এবং মানসিকভাবে দেউলিয়া লেখিকা লজ্জা বিসর্জন দিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। পোশাক পরে আছেন নেহাত অভ্যাসবশত। ..এটা নাকি বাক স্বাধীনতা। ভাদুরে কুকুর রক্ষা সমিতির দাবি, পাগলা কুকুরদের খ্যাক খ্যাক করে তেড়ে আসার অধিকারটাও হিউম্যান ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে কুকুরীয় স্বাধীনতা। কারুর যদি যা খুশি বলার স্বাধীনতা থাকে, অন্য কারুর হাতের স্বাধীনতা থাকতেই পারে। গলাটা টিপে দেওয়ার স্বাধীনতাই বা থাকবে না কেন! কোনো মহিলা যদি নিজের দেহকে পাবলিক ইউরিনাল করে সাজিয়ে তুলে ধরেন, কী বলবেন? সুলভ কমপ্লেক্স হলে পে এণ্ড ইউজ। এতে হইচই করার কী আছে? .. নিষিদ্ধ নয়, বর্জন করুন এই বর্জ্য পদার্থ। রাস্তায় বর্জ্য পদার্থ পড়ে থাকলে কেউ লাথি মারে না। হয় ডিঙিয়ে যায়, না হয় সাফাইকর্মী ডাকে। সাফাইকর্মীরা সাফ করুক। প্রতিরোধ গড়ে উঠুক ছাপাখানায়। বাইণ্ডারদের কারখানায়। জবাব এটাই। ..সুস্থ সংস্কৃতির জন্য যারা গলা ফাটান, তাঁরা কোথায়? কোথায় গেলেন সেই কর্মী বাহিনী, যারা প্রকাশক, মুদ্রক, এবং বাঁধাইখানার সামনে পিকেট করে আমাদের সংহতি বিনষ্টকারী বর্জ্য পদার্থটিকে (বই বলতে ঘৃণা হয়) বর্জনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলবেন?’
আজকাল পত্রিকার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘তসলিমার দ্বিখণ্ডিত দুটি কারণে জঘন্য, বর্জনীয়। প্রথমত রুচি, অশালীনতা, অবাধ চরিত্রহনন। মামলা হয়েছে ঢাকায়, কলকাতায়। রাজ্য সরকার সে জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। কিন্তু আমরা এই প্রথম কারণটিও একটু দেখব। ক. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও প্রাপ্ত বয়স্ক নারী যদি স্বেচ্ছায় কোনও সম্পর্ক স্থাপন করেন, তা একধরনের চুক্তি, যে কোনও একজন নিজের স্বার্থে তা প্রচার করতে পারেন না। অন্তত, উচিত নয়। খ. ফুটপাতের হলুদ মলাটের বইয়ে হয়তো আরও রগরগে বর্ণনা থাকে, কিন্তু সেখানে সব চরিত্র কাল্পনিক, জীবিত, পরিচিত ব্যক্তিদের টেনে আনা হয় না। গ. কোনো লেখক বা লেখিকা তার পরিচিত ব্যক্তিদের নাম করে যা খুশি লিখেছেন, কেন মানতে হবে সে সব সত্যি? কী করে বলা যাবে যে অতিরঞ্জিত বা বিকৃতি নেই? ঘ. তসলিমা নিজে না হয় চালচুলোহীন, সামাজিক দায়দায়িত্বের ধার ধারেন না, যাঁদের সম্পর্কে লিখেছেন, সত্যি অথবা মিথ্যে, তাঁদের সামাজিক সম্মান নেই? তাঁদের সন্তান নেই? পারিবারিক বৃত্ত নেই? .. তসলিমার ৩৯৩ পাতার আবর্জনাকে যদি বা উপেক্ষা করা যায়, ২ পাতার প্ররোচনামূলক অসভ্যতাকে ক্ষমা করা যায় না। শঙ্খ ঘোষ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোনো বই নিষিদ্ধ ঘোষণার পক্ষে নন। কিন্তু এই একটি বইকে ওঁরা ব্যতিক্রম মনে করছেন।’
.
বিষ মাখানো নিন্দা আর ঘৃণার তীর যখন দুই বাংলা থেকে ছোঁড়া হচ্ছিল, তখনই দেশ পত্রিকা থেকে আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিলো প্রতিক্রিয়া লিখতে। লিখেছিলাম, নিউইয়র্কে বসে, এক মধ্যরাতে। ঠিক এভাবেই লিখেছিলাম —
‘Freedom is always and exclusively freedom for the one who thinks differ ently.’ –Rosa Luxemburg
জীবনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যখন দেখি পিছনের দিনগুলো ধূসর ধূসর, আর সেই ধূসরতার শরীর থেকে হঠাৎ হঠাৎ কোনো ভুলে যাওয়া স্বপ্ন এসে আচমকা সামনে দাঁড়ায় বা কোনো স্মৃতি টুপ করে ঢুকে পড়ে আমার একাকী নির্জন ঘরে, আমাকে কাঁপায়, আমাকে কাঁদায়, আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেই দিনগুলোর দিকে –তখন কী জীবনের সেই অলিগলির অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে কিছু শীতার্ত স্মৃতি কুড়িয়ে আনতে আমি না হেঁটে পারি! কী লাভ হেঁটে! কী লাভ স্মৃতি কুড়িয়ে এনে! যা গেছে তা তো গেছেই! যে স্বপ্নগুলো অনেককাল মৃত, যে স্বপ্নগুলোকে এখন আর স্বপ্ন বলে চেনা যায় না, মাকড়সার জাল সরিয়ে ধুলোর আস্তর ভেঙে কী লাভ সেগুলোকে আর নরম আঙুলে তুলে এনে! যা গেছে, তা তো গেছেই। জানি সব, তবুও আমার নির্বাসনের জীবন আমাকে বারবার পিছনে ফিরিয়েছে, আমি আমার অতীত জুড়ে মোহগ্রস্তের মতো হেঁটেছি। দুঃস্বপ্নের রাতের মতো এক একটি রাত আমাকে ঘোর বিষাদে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তখনই মেয়েটির গল্প বলতে শুরু করেছি আমি।
একটি ভীরু লাজুক মেয়ে, যে মেয়ে সাত চড়েও রা করেনি, পারিবারিক কড়া শাসন এবংশোষণে ছোট্ট একটি গণ্ডির মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে, যে-মেয়ের সাধ-আহ্লাদ প্রতিদিনই ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে আবর্জনার স্তূপে, যে-মেয়েটির ছোট্ট শরীরের দিকে লোমশ লোমশ লোভী হাত এগিয়ে এসেছে বারবার, আমি সেই মেয়ের গল্প বলেছি। যে-মেয়েটি কিশোর বয়সে ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন লালন করতে শুরু করেছে, যে-মেয়েটি হঠাৎ একদিন প্রেমে পড়েছে, যৌবনের শুরুতে বিয়ের মতো একটি কাণ্ড গোপনে ঘটিয়ে আর দশটি সাধারণ মেয়ের মতো জীবন যাপন করতে চেয়েছে, আমি সেই সাধারণ মেয়েটির গল্প বলেছি। যে-মেয়েটির সঙ্গে প্রতারণা করেছে তার স্বামী তার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ, যে মেয়েটির বিশ্বাসের দালানকোঠা ভেঙে পড়েছে খড়ের ঘরের মতো, যে-মেয়েটি শোকে, সন্তাপে, বেদনায়, বিষাদে কুঁকড়ে থেকেছে। চরম লজ্জা আর লাঞ্ছনা যাকে আত্মহত্যা করার মতো একটি ভয়ংকর পথে নিয়ে যেতে চেয়েছে, চুরমার হয়ে ভেঙে পড়া স্বপ্নগুলো জড়ো করে যে-মেয়েটি আবার বাঁচতে চেয়েছে, নিষ্ঠুর নির্দয় সমাজে নিজের জন্য সামান্য একটু জায়গা চেয়েছে, যে-মেয়েটি বাধ্য হয়েছে সমাজের রীতিনীতি মেনে পুরুষ নামক অভিভাবকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে, আর তার পরও যে মেয়েটির ওপর আবার নেমে এসেছে একের পর এক আঘাত, যে-আঘাত গর্ভের জ্বণটিকে নষ্ট করে দেয়, যে আঘাত প্রতি রাতে তাকে রক্তাক্ত করে, যে-আঘাত তার, কুটিলতার, অবিশ্বাসের আর, অসহ্য অপমানের আমি সেই দলিত দংশিত দুঃখিতার গল্প বলেছি মাত্র। দুঃখিতাটি তার শরীরে আর মনে যেটুকু জোর ছিল অবশিষ্ট, সেটুকু নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়াবার জন্য সামান্য জায়গা পেতে কারও দ্বারস্থ হয়নি এবার, একাই লড়েছে সে, একাই বেঁচেছে, নিজেই নিজের আশ্রয় হয়েছে, এবার আর কারও কাছে নিজেকে সমর্পণ করেনি, বঞ্চিত হয়েছে বলে যোগিনী সাজেনি, কারও ছিঃ ছিঃর দিকে ফিরে তাকায়নি এই ফিরে না তাকানোর গল্প আমি বলেছি। সমাজের সাত রকম সংস্কারের ধার ধারেনি মেয়ে, বারবার তার পতনই তাকে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, বারবার তার হোঁচট খাওয়াই তাকে হাঁটতে শিখিয়েছে, বারবার তার পথ হারানোই তাকে পথ খুঁজে দিয়েছে। ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে যে-নতুন একটি বোধ আর বিশ্বাসকে সে জন্ম নিতে দেখেছে, তা হল, তার নিজের জীবনটি কেবল তারই, অন্য কারও নয়। এই জীবনটির কর্তৃত্ব করার অধিকার কেবল তারই। আমি মেয়েটির সেই গড়ে ওঠার গল্প বলেছি যে পরিবেশ প্রতিবেশ তাকে বিবর্তিত করেছে, তাকে নির্মাণ করেছে, পিতৃতন্ত্রের আগুনে পুড়ে যে-মেয়ে শেষ পর্যন্ত দগ্ধ হল না, পরিণত হল ইস্পাতে, সেই গল্প।
আমি কি অন্যায় কিছু করেছি? আমার কাছে অন্যায় বলে মনে না হলেও আজ অনেকের কাছে এটি ঘোরতর অন্যায়। আমি ভয়াবহ রকম অপরাধ করেছি গল্পটি বলে। অপরাধ করেছি বলে জনতার আদালতের কাঠগড়ায় আমাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। অপরাধ হয়তো হতো না যদি না আমি প্রকাশ করতাম যে, যে-মেয়েটির গল্প আমি বলেছি সে মেয়েটি আমি, আমি তসলিমা। কল্পনায় আমি যথেচ্ছাচার করতে পারি, মিথ্যে মিথ্যে আমি লিখতে পারি কোনো সাধারণ মেয়ের আর দশটি মেয়ে থেকে ভিন্ন হওয়ার গল্প, ও না হয় ক্ষমা করে দেওয়া যায়। কিন্তু এই বাস্তব জগৎটিতে দাঁড়িয়ে রক্তমাংসের মেয়ে হয়ে কোন স্পর্ধায় আমি ঘোষণা করছি যে, ওই মেয়েটি আমি, আমি দুঃখ ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি, আমার যেমন ইচ্ছে তেমন করে নিজের জীবনটি যাপন করবো বলে পণ করেছি, আমার এই দুর্বিনীত আচরণ লোকে মানবে কেন! এরকম স্পর্ধা কোনো মেয়েকেই মানায় না। বড় বেমানান আমি পুরো পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে।
আমার প্রিয় দেশটিতে, প্রিয় পশ্চিমবঙ্গে আজ আমি একটি নিষিদ্ধ নাম, একটি নিষিদ্ধ মানুষ, একটি নিষিদ্ধ বই। আমাকে উচ্চারণ করা যাবে না, আমাকে ছোঁয়া যাবে না, আমাকে পড়া যাবে না। উচ্চারণ করলে জিভ নষ্ট হবে, চুলে হাত নোংরা হবে, পড়লে গা রি রি করবে।
এরকমই তো আমি। সে কি আজ থেকে!
‘দ্বিখণ্ডিত’ লেখার কারণে যদি সহস্র খণ্ড হতে হয় আমাকে, তবু আমি স্বীকার করতে চাই না যে আমি কোনো অপরাধ করেছি। আত্মজীবনী লেখা কি অপরাধ? জীবনের গভীর গোপন সত্যগুলো প্রকাশ করা কি অপরাধ? আত্মজীবনীর প্রধান শর্ত তো এই যে, জীবনের সব কিছু খুলে মেলে ধরবো, কোনো গোপন কথা কোনো কিছুর তলায় লুকিয়ে রাখবো না। যা-কিছু গোপন, যা-কিছু অজানা, তা বলার জন্যই তো আত্মজীবনী। এই শর্তটিই সতোর সঙ্গে পালন করতে চেষ্টা করেছি। আত্মজীবনীর প্রথম দুই খণ্ড ‘আমার মেয়েবেলা’ আর ‘উতল হাওয়া’ নিয়ে কোনোরকম বিতর্ক না হলেও তৃতীয় খণ্ডটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্ক কিন্তু আমি সৃষ্টি করিনি, করেছে অন্যরা। বিতর্ক হওয়ার মতো উত্তেজক বিষয়, অনেকেই বলেছেন, আমি বেছে নিয়েছি। এই প্রশ্ন আর যখনইউঠুক, আত্মজীবনীর ক্ষেত্রে ওঠা উচিত নয়। কারণ সব রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমার বড় হওয়া বা বেড়ে ওঠার ঘটনাগুলোই আমি বর্ণনা করেছি। আমার দর্শন অদর্শন, আমার হতাশা-আশা, আমার সুন্দর, আমার কুৎসিত, আমার শোক সুখ, আমার ক্রোধ আর কান্নাগুলোর কথাই বলেছি। কোনো স্পর্শকাতর বা উত্তেজক বিষয় শখ করে বেছে নিইনি, আমার জীবনটিই আমি বেছে নিয়েছি জীবনী লেখার জন্য। এই জীবনটা যদি স্পর্শকাতর আর উত্তেজক হয়, তবে এই জীবনের কথা লিখতে গিয়ে আমি অস্পর্শকাতর আর অনুত্তেজক বিষয় কোত্থেকে পাবো? বিতর্ক তৈরি করার জন্য বা চমক সৃষ্টি করার জন্য আমি নাকি বই লিখেছি। যেন বদ একটি কারণ থাকতেই হবে বই লেখার পিছনে। যেন সততা আর সরলতা কোনও কারণ হতে পারে না। যেন সাহস, যে-সাহসের প্রশংসা করা হত যে, আমি সাহস করে নাকি অনেক কিছুই বলি বাকরি, সেই সাহসটিও এখন আর কোনও কারণ হতে পারে না। আমার লেখা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। লেখালেখির শুরু থেকেই তা হচ্ছে। এটিই কি মোদ্দা কথা নয় যে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের সঙ্গে আপোস না করলেই বিতর্ক হয়।
আত্মজীবনীর সংজ্ঞা অনেকের কাছে অনেক রকম। বেশির ভাগ মানুষই সেই জীবনীকে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত, যে জীবনীটি ভূরি ভূরি ভালো কথা আর চমৎকার সব আদর্শ উপস্থাপন করে। সাধারণত মনীষীরাই আত্মজীবনী লিখে যান অন্যকে নিজের জীবনাদর্শে আলোকিত করতে, সত্যের সন্ধান দিতে, পথ দেখাতে। আমি কোনও জ্ঞানী গুণী মানুষ নই, কোনও মনীষী নই, কোনও মহামানব নই, কিছু নই, অন্ধজনে আলো দেওয়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আমি জীবনী লিখছি না। আমি কেবল ক্ষুদ্র একটি মানুষের ক্ষতগুলো ক্ষোভগুলো খুলে দেখাচ্ছি।
কোনও বড় সাহিত্যিক বা বড় কোনো ব্যক্তিত্ব না হলেও এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, খুব বড় বড় ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনটিতে। আমার বিশ্বাস এবং আদর্শের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি পথে নামে আমার ফাঁসির দাবি নিয়ে, যদি ভিন্ন মতের কারণে একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করা হয়, যদি সত্য কথা বলার অপরাধে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র আমার নিজের দেশে বাস করার অধিকার হরণ করে নেয়, তবে নিশ্চয়ই জীবনটি একটি সাদামাটা জীবন নয়। এই জীবনের কাহিনী অন্যের মুখে নানা ঢঙে নানা রঙে প্রচারিত যখন হচ্ছেই, তখন আমি কেন দায়িত্ব নেব না জীবনের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করতে। আমার এই জীবনটিকে আমি যত বেশি জানি, তত তোআর অন্য কেউ জানে না।
নিজেকে যদি উন্মুক্তনাকরি, নিজের সবটুকু যদি প্রকাশ না করি, বিশেষ করে জীবনের সেইসব কথা বা ঘটনা, যা আমাকে আলোড়িত করেছে, যদি প্রকাশ না করি নিজের ভালো মন্দ, দোষ গুণ, শুভ অশুভ, আনন্দ বেদনা, উদারতা ক্রুরতা, তবে আর যাই হোক সেটি আত্মজীবনী নয়, অন্তত আমার কাছে নয়। কেবল সাহিত্যের জন্যই সাহিত্যই আমার কাছে শেষ কথা নয়, সততা বলে একটি জিনিস আছে, সেটিকে আমি খুব মূল্য দিই।
যে-রকমই জীবন হোক আমার, যে-রকমই নিকৃষ্ট, যে-রকমই নিন্দা, নিজের জীবন কাহিনী লিখতে বসে আমি কিন্তু প্রতারণা করছি না নিজের সঙ্গে। পাঠক আমার গল্প শুনে আমাকে ঘৃণা করুক কী আমাকে ছুঁড়ে ফেলুক, এটুকুই আমার সন্তুষ্টি যে, আমার পাঠকের সঙ্গে আমি প্রতারণা করছি না। আত্মজীবনী নাম দিয়ে পাঠককে কোনো বানানো গল্প উপহার দিচ্ছি না। জীবনের সব সত্য, সত্য সবসময় শোভন বা সুন্দর না হলেও, সঙ্কোচহীন বলে যাচ্ছি। জীবনে যা কিছু ঘটে গেছে, তা তো ঘটেই গেছে, তা তো আমি বদলে দিতে পারবো না, আর অস্বীকারও করতে পারবো না এই বলে যে, যা ঘটেছে তা আসলে ঘটেনি। সুন্দরকে যেমন পারি, অসুন্দরকেও তেমন আমি স্বীকার করতে পারি।
চারদিক থেকে এখন বিদ্রুপের তির ছোঁড়া হচ্ছে আমাকে লক্ষ্য করে, অপমান আর অপবাদের কাদায় আমাকে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে এর কারণ একটিই, আমি সত্য কথা বলেছি। সত্য সবসময় সবার সয় না। আমার মেয়েবেলা’ আর ‘উতল হাওয়া’র সত্য সইলেও দ্বিখণ্ডিত’র সত্য সবার সইছে না। আমার মেয়েবেলায় আমাকে অপদস্থ করার কাহিনী যখন বর্ণনা করেছি, সেটি পড়ে লোকে চুকচুক করে দুঃখ করেছে আমার জন্য, উতল হাওয়ায় যখন স্বামী দ্বারা প্রতারিত হয়েছি, তখনও আহা আহা করেছে আমার জন্য, আর দ্বিখণ্ডিত’য় যখন বর্ণনা করেছি পর পর একের অধিক পুরুষের সঙ্গে আমার। সম্পর্কের কথা, তখন ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করেছে। এর অর্থ তো একটিই, যে, যতক্ষণ একটি মেয়ে অত্যাচারিত এবং অসহায়, যখনই সে দুর্বল, এবং যখন তার দুঃসময়, ততক্ষণই তার জন্য মায়া জাগে, ততক্ষণই তাকে ভালো লাগে। আর যখনই মেয়েটি আর অসহায় নয়, যখনই সে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ায়, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে,নিজের শরীরের এবং মনের স্বাধীনতার জন্য সমাজের নষ্ট নিয়মগুলো ভাঙে, তখন তাকে আর ভালো লাগে না, বরং তার প্রতি ঘৃণা জন্মে। আমাদের সমাজের এই চরিত্র আমি জানি, জেনেও কোনও দ্বিধা করিনি নিজেকে জানাতে।
দ্বিখণ্ডিত বইটি নিয়ে বিতর্কের একটি বড় কারণ, যৌন স্বাধীনতা। আমাদের এই সমাজের বেশির ভাগ মানুষ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তাই একজন। নারীর যৌন স্বাধীনতার অকপট ঘোষণায় বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। যে যৌন স্বাধীনতার কথা আমি বলি, তা কেবল আমার বিশ্বাসের কথাই নয়, নিজের জীবন দিয়ে সেই স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছি, অথচ যে-কোনও পুরুষ আমাকে কামনা করলেই পাবে না। এই সমাজ এখনও কোনও নারীর এমন স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত নয়। প্রস্তুত নয় এটা শিরোধার্য করতে যে, কোনও নারী তার ইচ্ছেমতো পুরুষকে সম্ভোগ করতে পারে এবং তা করেও কঠোরভাবে যৌন-সতীত্ব বজায় রাখতে পারে।
আমাদের নামি-দামি পুরুষ লেখকেরা আমাকে এখন মহানন্দে পতিতা বলে গালি দিচ্ছেন। গালি দিয়ে নিজেরাই প্রমাণ করছেন কী ভীষণ নোংরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সুবিধেভোগী পুরুষ-কর্তা তাঁরা। পতিতাকে তাঁরা ভোগের জন্য ব্যবহার করেন, আবার পতিতা শব্দটিকে তারা সময় সুযোগমতো গালি হিসেবেও ব্যবহার করেন। নারীকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করার নিয়ম আজকের নয়। যদিও দ্বিখণ্ডিত বইটিতে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে আমার লড়াইএর কথা বলেছি, বলেছি নারী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সমাজের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা, কেউ কিন্তু সে নিয়ে একটি কথাও বলছেন না, যারাই বলছেন, বলছেন যৌনতার কথা। আমার কোনও কষ্টের দিকে, কান্নার দিকে কারও চোখ গেল না, চোখ গেল শুধু যৌনতার দিকে। চোখ গেল আমার সঙ্গে পুরুষের সম্পর্কগুলোর দিকে। যৌনতার মতো গভীর গোপন কুৎসিত আর কদর্য বিষয় নিয়ে আমার মুখ খোলার স্পর্ধার দিকে চোখ।
পৃথিবীর ইতিহাসে, কোনো অন্ধকার সমাজে যখনই কোনও নারী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছে, নিজের স্বাধীনতার কথা বলেছে, ভাঙতে চেয়েছে পরাধীনতার শেকল, তাকেই গাল দেওয়া হয়েছে পতিতা বলে। অনেক আগে নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য বইটর ভূমিকায় আমি লিখেছিলাম, নিজেকে এই সমাজের চোখে আমি নষ্ট বলতে ভালোবাসি। কারণ এ কথা সত্য যে, যদি কোনো নারী নিজের দুঃখ দুর্দশা মোচন করতে চায়, যদি কোনও নারী কোনও ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের নোংরানিয়মের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়, তাকে অবদমনের সকল পদ্ধতির প্রতিবাদ করে, যদি কোনও নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয়, তবে তাকে নষ্ট বলে সমাজের ভদ্রলোকেরা। নারীর শুদ্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত নষ্ট হওয়া। নষ্ট না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই। সেই নারী সত্যিকার সুস্থ ও শুদ্ধ মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে। আজও এ কথা আমি বিশ্বাস করি যে, কোনও নারী যদি তার সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়, তবে এই সমাজের চোখে তাকে নষ্ট হতে হয়। এই নষ্ট সমাজ থেকে নষ্ট বা পতিতা আখ্যা উপহার পাওয়া একজন নারীর জন্য কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়। এ যাবৎ যত পুরস্কার আমি পেয়েছি, পতিতা উপাধির পুরস্কারটিকেই আমি সর্বোত্তম বলে বিচার করছি। পুরুষতন্ত্রের নষ্টামির শরীরে সত্যিকার আঘাত করতে পেরেছি বলেই এই উপাধিটি আমি অর্জন করেছি। এ আমার লেখকজীবনের, আমার নারীজীবনের, আমার দীর্ঘকালের সংগ্রামের সার্থকতা।
বইটি লিখেছি বলে বাংলাদেশের একজন লেখক আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন, কলকাতাতেও একজন বাংলাদেশি লেখকটির পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। কেবল মানহানির মামলা করেই ক্ষান্ত হননি, দুজনই আমার বইটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। আমি ঠিক বুঝি না, কী করে একজন লেখক আর একজন লেখকের বই। নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন। কী করে সমাজের সেই শ্রেণীর মানুষ, যাঁদের দায়িত্ব মুক্তচিন্তা আর বাক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা, মৌলবাদীদের মতো আচরণ করেন। আমাকে নিয়ে এ যাবৎ অনেক মিথ্যে, অনেক কল্পকাহিনী লেখা হয়েছে, আমি তো তাদের কোনও লেখা নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে আদালতে দৌড়ইনি। আমি বিশ্বাস করি, এভলিন বিয়াট্রিস হল যা বলেছিলেন, ”I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it” –আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু আমি আমৃত্যু তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য লড়ে যাবো। কেন আমাদের বিদগ্ধ লেখকগণ বাক-স্বাধীনতার পক্ষে এই চরম সত্যটি অস্বীকার করতে চান!
পৃথিবীর কত লেখকই তোলিখে গেছেন নিজেদের জীবনের কথা। জীবন থেকে কেবল পরিশুদ্ধ জিনিস ঘেঁকে নিয়ে তারা পরিবেশন করেননি। জীবনে ভ্রান্তি থাকে, ভুল থাকে, জীবনে কালি থাকে, কাঁটা থাকে, কিছুনা কিছু থাকেই, সে যদি মানুষের জীবন হয়। যাদের মহামানব বলে শ্রদ্ধা করা হয়, তাঁদেরও থাকে। ক্রিস্টান ধর্মগুরু অগুস্ত (৩৩৫-৪৩০ খ্রি.) নিজেই লিখে গেছেন তার জীবনকাহিনী, আলজেরিয়ায় তিনি যেভাবে জীবন কাটাতেন, যে রকম অসামাজিক অনৈতিক বাধনহীন জীবন কিছুই প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। তার যৌন স্বেচ্ছাচারিতা, উচ্ছংখলতা, জারজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার কোনও কাহিনীই গোপন করেননি। মহাত্মা গান্ধীও তো স্বীকার করেছেন কী করে তিনি তার বিছানায় মেয়েদের শুইয়ে নিজের ব্রহ্মচারিতার পরীক্ষা করতেন। ফরাসি লেখক জ জ্যাক রুশোর (১৭১২-১৭৭৮ খ্রি.) কথাই ধরি, তার স্বীকারোক্তি গ্রন্থটিতে স্বীকার করে গেছেন জীবনে কী কী করেছেন তিনি। কোনও গোপন কৌটোয় কোনও মন্দ কথা নিজের জন্য তুলে রাখেননি। সেই আমলে রুশোর আদর্শ মেনে নেওয়ার মানসিকতা খুব কম মানুষেরই ছিল। তাতে কী! তিনি তার পরোয়া না করে অকাতরে বর্ণনা করেছেন নিজের কুকীর্তির কাহিনী। মাদমাজোল গতোঁ তো আছেই, আরও অনেক রমণীকে দেখে, এমনকী মাদাম দ্য ওয়ারেন, যাঁকে মা বলে ডাকতেন, তাঁকে দেখেও বলেন যে তার যৌনাকাঙ্ক্ষা জাগতো। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৯-১৭৯০ খ্রি.) তাঁর আত্মকথায় যৌবনের উতল উন্মাতাল সময়গুলোর বর্ণনা করেছেন, জারজ পুত্র উইলিয়ামকে নিজের সংসারে তুলে এনেছিলেন, তাও বলেছেন। বার্সাণ্ড রাসেল তাঁর জীবনীগ্রন্থে লিখে গেছেন বিভিন্ন রমণীর সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্কের কথা। টিএস এলিয়টের স্ত্রী ভিভিয়ানের সঙ্গে, লেডি অটোলিন মোমেলের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা কে না জানে! লিও তলস্তয় লিখেছেন চৌদ্দ বছর বয়সেই তাঁর গণিকাগমনের কাহিনী, সমাজের নিচুতলার মেয়ে, এমনকী পরস্ত্রীদের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক, এমনকী তার যৌনরোগে ভোগার কথাও গোপন করেননি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন তাঁরা, সমাজ যা মেনে নিতে পারে না, এমন তথ্য পাঠককে শোনাতে গেলেন! শোনানোর নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। নিজেদের আসল পরিচয়টি তারা লুকোতে চাননি অথবা এই অভিজ্ঞতাগুলো তাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই শুনিয়েছেন। এতে কি তাঁদের জাত গিয়েছে নাকি তাদের মন্দ বলে কেউ? কেউই তাদের মন্দ বলে না, যে অবস্থানে ছিলেন তাঁরা সে অবস্থানে আছেনই, বরং সত্য প্রকাশ করে নিজেদের আরও মহিমান্বিত করেছেন। পশ্চিমি দেশগুলোয় নারী পুরুষ সম্পর্কটি বহুকাল হল আর আড়াল করার ব্যাপার নয়। হালের ফরাসি মেয়ে ক্যাথারিন মিলে তার নিজের কথাই লিখেছেন La Vie Sexuelle de Catherine M বইটিতে। পুরো বই জুড়ে আছে ষাটের দশকে অবাধ যৌনতার যুগে তার বহু পুরুষ-ভোগের রোমাঞ্চকর কাহিনী। মৈথুনের নিখুঁত বর্ণনা। এ কারণে বইটিকে কি সাহিত্যের বইয়ের তাকে রাখা হয়নি? হয়েছে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেও Vivir para contara বইটিতে পরনারীদের সঙ্গে আঁর লীলাখেলার কিছুই বলতে বাদ রাখেননি। মার্কেজকে কি কেউ মন্দ বলবে তাঁর জীবনটির জন্য, নাকি কেউ আদালতে যাবে বইটি নিষিদ্ধ করতে?
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই বিখ্যাত মানুষদের জীবনী প্রকাশ হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে সেসব জীবনী লিখছেন জীবনীকাররা। খুঁড়ে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে সব গোপন খবর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপন কথাটিও তো রইছে না গোপনে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কথা বলেও তিনি কেন নিজের বালিকা-কন্যাটির বিয়ের আয়োজন করেছিলেন, সেই কারণটি মানুষ আজ জানছে। প্রশ্ন হল, এইসব তথ্য কী আদৌ পাঠকের জানা প্রয়োজন? কে কবে কোথায় কী করেছিলেন, কী বলেছিলেন, জীবনাচরণ ঠিক কেমন ছিল কার, তা জানা যদি নিতান্তই অবান্তর হত, তবে তা নিয়ে গবেষণা হয় কেন? জীবনীকার গবেষকরা যেসব মানুষ সম্পর্কে অজানা তথ্য জানাচ্ছেন, সেসব তথ্যের আলোয় শুধু মানুষটি নন, তাঁর সৃষ্টিরও নতুন করে বিচার ও বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে।
বাঙালি পুরুষ লেখকদের অনেকেই গোপনে গোপনে বহু নারীর সঙ্গে শরীরী প্রেমের খেলা খেলতে কুণ্ঠিত নন, নিজেদের জীবনকাহিনীতে সেসব ঘটনা আলগোছে বাদ দিয়ে গেলেও উপন্যাসের চরিত্রদের দিয়ে সেসব ঘটাতে মোটেও সংকোচ বোধ করেন না। কেউ কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। প্রশ্ন ওঠে, কোনও মেয়ে যদি যৌনতা নিয়ে কথা বলে। সে গল্প উপন্যাসে হোক, সে আত্মজীবনীতে হোক। যৌনতা তো পুরুষের ‘বাপের সম্পত্তি’। আমার তো পুরুষ-লেখকদের মতো লিখলে চলবে না। আমার তো রয়ে সয়ে লিখতে হবে। রেখে ঢেকে লিখতে হবে। কারণ আমি তো নারী। নারীর শরীর, তার নিতম্ব, স্তন, উরু, যোনি এসব নিয়ে খেলা বা লেখার অধিকার তো কেবল পুরুষেরই আছে। নারীর থাকবে কেন? এই অধিকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাকে দেয়নি, দেয়নি বলে তোয়াক্কা না করে আমি যে লিখে ফেলেছি, যত করুণ হোক, যত মর্মান্তিক হোক, আমার সে কাহিনী, আমি যে অনধিকার চর্চা করেছি, তাতেই আপত্তি।
পুরুষের জন্য একাধিক প্রেম বা একাধিক নারীসম্ভোগ চিরকালই গৌরবের ব্যাপার। আর একটি মেয়ে সতোর সঙ্গে কাগজকলমে নিজের প্রেম বা যৌনতা নিয়ে যেই না লিখেছে, অমনি সেই মেয়ে বিশ্বাসঘাতিনী, সেই মেয়ে অসতী, সেই মেয়ে দুশ্চরিত্র। আমার আত্মজীবনীতে আমি এমন কথা বলেছি, যা বলতে নেই। আমি সীমা লঙ্ঘন করেছি, আমি বাড়াবাড়ি করেছি, আমি অশ্লীলতা করেছি, নোংরা কুৎসিত ব্যাপার ঘেঁটেছি। দরজা বন্ধ করে যে ঘটনাগুলো ঘটানো হয়, পারস্পরিক বোঝাঁপড়ায় যে সম্পর্কগুলো হয়, সেসব নাকি বলা অনুচিত। সেসব নাকি বলা জরুরি নয়। কিন্তু আমি তো মনে করি উচিত, আমি তো মনে করি জরুরি। কারণ আমার সংস্কার সংস্কৃতি, ধ্যান, ধারণা, বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে আজ এই যে আমি, এই তসলিমার নির্মাণ কাজে জীবনের সেইসব ঘটনা বা দুর্ঘটনাই অন্যতম মৌলিক উপাদান। আমি যে ভূঁইফোড় নই, তিল তিল করে চারপাশের সমাজ নির্মাণ করেছে তিলোত্তমার বিপরীত এই অবাধ্য কন্যার। নিজেকে বোঝার জন্য, আমি মনে করি, জরুরি এই আত্মবিশ্লেষণ।
নিজের সম্মান না হয় নষ্ট করেছি, অন্যের সম্মান কেন নষ্ট করতে গেলাম। যদিও অন্যের জীবনী আমি লিখছিনা, লিখছি নিজের জীবনী, কিন্তু অন্যের পারিবারিক সামাজিক ইত্যাদি সম্মানহানির বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। আমি ঠিক বুঝি না, নিজের মান সম্মানের ব্যাপারে যারা এত সচেতন, তাঁরা এমন কাণ্ড জীবনে ঘটান কেন, যে কাণ্ডে তাঁরা ভালো করে জানেন যে তাঁদের মানের হানি হবে। আমি বিশ্বাসভঙ্গ করেছি? কিন্তু, আমি তো কাউকে প্রতিশ্রুতি দিইনি যে এসব কথা কোনওদিন প্রকাশ করবো না! অলিখিত চুক্তি নাকি থাকে। আসলে এই চুক্তির অজুহাত তাঁরাই তুলছেন, গোপন কথা ফাঁস হয়ে গেলে নিজেদের দেবতা চরিত্রটিতে দাগ পড়বে বলে যাঁরা আশংকা করছেন। আর তাই চোখ রাঙিয়ে শাসিয়ে দিতে চান যে সীমানা লঘন করলে চুক্তিভঙ্গের অপরাধে আমার শাস্তি হবে।
আমি যা প্রকাশ করতে চাই তা যদি আমার কাছে উচিত বলে মনে হয়–তবে? উচিত অনুচিতের সংজ্ঞা কে কাকে শেখাবে? আমার কাছে যদি অশ্লীল মনে না হয় সে কথাটি, যে কথাটি আমি উচ্চারণ করেছি তবে? শ্লীল অশ্লীল হিসেব করার মাতব্বরটি কে? সীমা মেপে দেওয়ার দায়িত্বটি কার? আত্মজীবনীতে আমি কী লিখবো, বা লিখবো না, তার সিদ্ধান্ত তো আমিই নেব! নাকি অন্য কেউ, কোনও মকসুদ আলী, কোনও কেরামত মিয়া বা পরিতোষ বা হরিদাস পাল বলে দেবে কী লিখবো, কতটুকু লিখবো!
সমালোচকরা আমার স্বাধীনতাকে চিহ্নিত করতে চাইছেন স্বেচ্ছাচারিতা বলে। আসলে আমাদের সুরুচি কুরুচি বোধ, পাপ পুণ্য বোধ, সুন্দর অসুন্দর বোধ, সবই যুগ যুগান্ত ধরে পিতৃতন্ত্রের শিক্ষার পরিণাম। নারীর নম্রতা, নতমস্তকতা, সতীত্ব, সৌন্দর্য, সহিষ্ণুতা সেই শিক্ষার ফলেই নারীর বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের সুনিয়ন্ত্রিত চেতনা কোনও রূঢ় সত্যের মুখোমুখি হতে তাই আতঙ্ক বোধ করে। কোনও নিষ্ঠুর বাক্য শুনলে কানে আঙুল দিতেইচ্ছে করে, ঘৃণায় ঘিনঘিন করে গা, অনেক সমালোচকেরও বাস্তবে তাই হচ্ছে। আমি লেখক কি না, আমার আত্মজীবনী তাও আবার ধারাবাহিকভাবে লেখার অধিকার আছে কি না, এমন প্রশ্নও তুলেছেন। বস্তুত সবার, যে কোনও মানুষেরই আত্মকথা লেখার অধিকার আছে। এমনকী আত্মম্ভর সেই সাংবাদিকদেরও সেই অধিকার আছে যিনি মনে করেন আমার হাতে কলম থাকাই একটি ঘোর অলুক্ষণে ব্যাপার। আমাকে দোষ দেওয়া হচ্ছে এই বলে যে, আমি চরম দায়িত্বহীনতার কাজ করেছি। আমি দায়িত্বহীন হতে পারি, যুক্তিহীন হতে পারি, তবু কিন্তু আমার অধিকারটি তাগ করতে আমি রাজি নই। জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, A reasonable man adapts himself to the world. An unreasoble man persists in trying to adapt the world to himself. Therefore, all progress depends upon the unreasonable man. বুদ্ধিমান বা যুক্তিবাদী লোকেরা পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে চলে। নির্বোধ বা যুক্তিহীনরা চেষ্টা করে পৃথিবীকে তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে। অতএব সব প্রগতি নির্ভর করে এই যুক্তিহীনদের ওপর। আমি তসলিমা সেই যুক্তিহীনদেরই একজন। আমি তুচ্ছ একজন লেখক, এত বড় দাবি আমি করছি না যে পৃথিবীর প্রগতি আমার ওপর সামান্যতম নির্ভর করে আছে। তবে বিজ্ঞদের বিচারে আমি নির্বোধ বা যুক্তিহীন হতে সানন্দে রাজি। নির্বোধ বলেই পিতৃতন্ত্রের রাঘব বোয়ালরা আমাকে পিষে মারতে আসছে দেখেও দৃঢ় দাঁড়িয়ে থেকেছি। আমার মূর্খতাই, আমার নির্বুদ্ধিতাই, আমার যুক্তিহীনতাই সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
ধর্মের কথাও উঠেছে। আমি, যারা আমাকে জানেন, জানেন যে, সব ধরনের ধর্মীয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলি। ধর্ম তো আগাগোড়াই পুরুষতান্ত্রিক। ধর্মীয় পুরুষ ও পুঁথির অবমাননা করলে সইবে কেন পুরুষতান্ত্রিক ধারক এবং বাহকগণ। ওই মহাপুরুষরাই তো আমাকে দেশছাড়া করেছেন। সত্যের মূল্য আমি আমার জীবন দিয়ে দিয়েছি। আর কত মূল্য আমাকে দিতে হবে।
দাঙ্গার অজুহাত দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম নয়, এর আগে বাংলাদেশেও আমার বই নিষিদ্ধ হয়েছে। এই যে নিরন্তর দাঙ্গা হচ্ছে উপমহাদেশে, আমার বই বা বক্তব্য কিন্তু দাঙ্গার কোনও কারণ নয়। কারণ অন্য। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারে, গুজরাতের মুসলমান নিধনে, অসমে বিহারি নিগ্রহে, খ্রিস্টানদের ওপর হামলায়, পাকিস্তানে সিয়া সুন্নি হানাহানিতে আমি আদৌ কোনও ঘটনা নই। অকিঞ্চিৎকর লেখক হলেও আমি মানবতার জন্যই লিখি। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষই যে সমান, সকলেরই যে সমান অধিকার মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার, সে কথাটিই হৃদয় দিয়ে লিখি। না, আমার লেখার কারণে দাঙ্গার মতো ভয়াবহ কোনও দুর্ঘটনা কোথাও ঘটে না। যদি কিছু ঘটে, সে আমার জীবনেই ঘটে। আমার লেখার কারণে শাস্তি এক আমাকেই পেতে হয়, অন্য কাউকে নয়। আগুন আমার ঘরেই লাগে। সকল গৃহ হারাতে হয় এক আমাকেই।
চারদিকের এত ভয়ংকর নিন্দার বিরুদ্ধে আনন্দবাজার পাশে দাঁড়ালোআমার। দেশ পত্রিকায় আমাকেই প্রচ্ছদ কাহিনী করা হল। শিবনারায়ণ রায়, আমার, এবং আরও ক’জনের লেখা নিয়ে বেরোলো দেশ। দেশ এর সম্পাদকীয় ছিল অসাধারণ। না স্মরণ করে পারছি না!
‘সে কালে মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করতে চার জন যুবক। সে ছিল কবিতার কাল, কল্পনার সাম্রাজ্য। যুগ বদলেছে। এখন, মধ্যরাতে নয়, দিনে দুপুরে, কবির কল্পনায় নয়, আমজনতার চাক্ষুষ বাস্তবে, কলকাতা শাসন করেন দু’ডজন বুদ্ধিজীবী। না, কেবল কলকাতা নয়, তামাম পশ্চিমবঙ্গ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর পশ্চিমবঙ্গ। নাট্যকার, অনুবাদক, সংস্কৃতিমনস্ক, নন্দনপ্রেমী আমাদের মুখ্যমন্ত্রী তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর তৃতীয় পর্ব ‘দ্বিখণ্ডিত’র ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কেন এই নিষেধাজ্ঞা? এ বইয়ের কিছু অংশ নাকি সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে, তাই। বইটির কয়েক হাজার কপিইতিমধ্যেই ক্রেতার হাতে পৌঁছে গেছে। তসলিমার অন্য সব লেখার মতোই এই লেখা নিয়েও তর্কবিতর্ক, বাদপ্রতিবাদ হয়েছে, এমনকী মামলা-মোকদ্দমাও। কিন্তু কোথাও সাম্প্রদায়িক অশান্তির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। সেটা এই সমাজের বড় হয়ে ওঠার লক্ষণ। মস্ত সুলক্ষণ। তা হলে পশ্চিমবঙ্গের উন্নততর বামফ্রন্ট সরকারের গণতন্ত্র-অন্ত-প্রাণ কর্তারা এমন দমননীতি জারি করলেন কেন? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ২৫ জনের মত নিয়েছি। তাদের পড়িয়েছি। তার পরেই এই সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ, ওই কতিপয় বুদ্ধিজীবীর সুপারিশ অনুসারেই এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তিন দশকের প্রবীণ বামফ্রন্ট সরকার। লেখকের স্বাধীনতা, নিজের কথা নিজের মতো করে লেখার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁদের সুপরামর্শে। সত্য সেলুকাস। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার হামেশাই বইপত্র নিষিদ্ধ করতো, কিন্তু তার দায়িত্ব নিতো নিজেরাই। জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলোতেও এমন অনেক নিষেধ জারি হয়েছে, কিন্তু সে জন্য ইন্দিরা গান্ধী বা সিদ্ধার্থশংকর রায়কে বুদ্ধিজীবীদের দোহাই পাড়তে শোনা যায়নি। উন্নততর বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী এ এক নতুন মডেল চালু করলেন বটে। সেই মডেলের সার কথাটি হল, হুকুম জারি করবো, কিন্তু তার দায় নেব না। অবশ্য নেবেনই বা কোন দুঃখে? হাত বাড়ালেই যদি এক ঝাঁক গণ্যমান্য স্বনামধন্যের হাত মিলে যায়, যারা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে (মাপ করবেন, অনুরোধে) রাত জেগে তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী পড়ে ফেলে চটপট সুপারিশ জানিয়ে দিতে প্রস্তুত, তবে তো প্রশাসনের পৌষমাস–সংস্কৃতির ঘাড়ে বন্দুক রেখে সংস্কৃতি শাসনের এমন সুযোগ রাজপুরুষরা ছাড়বেন কেন? বিশেষত, সেই রাজপুরুষদের যদি আবার সংস্কৃতির নন্দনকাননে বিহারের বাসনা থাকে?
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তার পরামর্শদাতারা কী ভেবে দেখেছেন, তাদের এই যৌথ উদ্যোগের তাড়নায় দেশে ও বিদেশে এই রাজ্যের গণতান্ত্রিকতার মর্যাদা কোন ধুলোয় লুটোলো? গোটা দুনিয়া জেনে গেল, পশ্চিমবঙ্গে একটি স্তালিন-রাজ জারি রয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র শক্তি সম্পূর্ণ খেয়ালখুশি মতো আপনার কণ্ঠরোধ করতে পারে এবং সেই চণ্ডনীতিতে সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতির জগৎ থেকে নামজাদা কিছু নাগরিকের সমর্থন যোগাড় করে নিতে পারে। এ যদি সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের লক্ষণ না হয়, তবে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ কাকে বলে, মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাশয় বলে দেবেন কি? কে জানে হয়তো বা তসলিমা নাসরিনের বই নিষিদ্ধ করা এবং করানোর জন্য এই উদগ্র তৎপরতার পিছনে আসলে অন্য কারণ আছে। যে মেয়ে নিজের জীবনের বৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে ক্রমাগত আরও অনেকের জীবনের বৃত্তান্ত জনসমক্ষে মেলে ধরে, তাকে আত্মপ্রকাশের অধিকার দেওয়াটা বোধহয় এ বার অতিমাত্রায় বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তা না হলে, পঁচিশ জন বুদ্ধিজীবী বললেন, তাই বই নিষিদ্ধ করলাম –এমন হাস্যকর নাবালকোচিত কৈফিয়ৎ, আস্তে কন, ঘুড়ায় হাসব।
বাংলার, দুই বাংলার সবচেয়ে বড় মনীষী শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন ‘.. এ কথা নিশ্চয় করে বলতে পারি সমকালীন দুই বাংলা মিলিয়ে মেরি ওলস্টনক্রাফটের যোগ্যতমা উত্তরসাধিকা হচ্ছেন স্বদেশ থেকে নির্বাসিতা তসলিমা নাসরিন। দ্বিখণ্ডিত’ নামে তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর যে তৃতীয় খণ্ডটি প্রথমে বাংলাদেশে এবং সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দ্বারা নিষিদ্ধ হয়েছে, আমার বিবেচনায় সেটি একটি অসামান্য গ্রন্থ। মাতৃগর্ভে আমাদের চেহারা নানা রূপের ভিতর দিয়ে মনুষ্য রূপ ধারণ করে। কিন্তু জন্মের পর থেকেই নানাভাবে চেষ্টা চলে শিশুকে সমাজ-স্বীকৃত একটি ধাঁচে গড়ে তুলবার। বিভিন্ন সমাজে, বিভিন্ন যুগে ধাঁচটির অদলবদল ঘটে, কিন্তু উদ্দেশ্যের অদলবদল ঘটে না। সেই উদ্দেশ্যটি হল সমষ্টিস্বীকৃত একটি ধাঁচের মধ্যে ফেলে ব্যক্তির স্বকীয় স্বাধীন বিকাশের সম্ভাবনাকে বিলুপ্ত করা। সমাজে যারা ক্ষমতার দখলদার তারা ধর্ম, ঐতিহ্য, শাস্ত্র, লোকাঁচার ইত্যাদির নামে এই ধাঁচে ফেলবার প্রক্রিয়াটি চালু করে। কিন্তু প্রতি শিশুর মধ্যে নিহিত থাকে নিজস্ব একটি অস্মিতা অর্জনের সামর্থ্য। তবে সেই অর্জনের জন্য লাগে ইচ্ছাশক্তি ও প্রয়াস, যুক্তিশীলতা এবং সততা, একনিষ্ঠ সাধনা ও অনুশীলন। এখনও পর্যন্ত দেখা যায় অধিকাংশ মানুষ সমাজ স্বীকৃত ছাঁচেই গড়ে ওঠে। কিন্তু কেউ কেউ তাঁদের প্রাজাতিক সামর্থ্যকে নিজের চেষ্টায় শত বাধাবিপত্তির সঙ্গে লড়াই করেই ক্রমে বাস্তবায়িত করেন তাঁদের স্বোপার্জিত অস্মিতা তাঁদের জীবনযাত্রায়, চিন্তায়, কার্যকলাপে ভাবনায়, এবং রচনায় প্রকাশিত হয়। এইভাবেই আমরা পাই সক্রেটিস থেকে বিদ্যাসাগর, জ্যোদানো ব্রুনো থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায়। কিন্তু কীভাবে তারা নিজেদের এই অনন্যতন্ত্র, অস্মিতা গড়ে তুলেছিলেন তার বিবরণ কচিৎ মেলে। এ ক্ষেত্রে ফরাসি দার্শনিক সিমোন দ্য বোভায়ার-এর মতো তসলিমা নাসরিনকেও ব্যতিক্রমী মনে করি। খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীর, এবং বিশেষ করে দ্বিখণ্ডিত’ নামে তাঁর তৃতীয় খণ্ডটির সবচাইতে বড় মূল্য এবং আকর্ষণ এটির ভিতর দিয়ে আমরা অনেকটা জানতে পারি কীভাবে বহু বাধাবিপত্তি, আঘাত, অপমান আর ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে মুসলমান মধ্যবিত্ত ঘরের একটি সাধারণ মেয়ে তাঁর আত্মশক্তি আবিষ্কার করেন, অপ্রতিম তসলিমা নাসরিন হয়ে ওঠেন। প্রথম দুটি খণ্ডে যে ভূমিকা রচিত হয়েছিল তৃতীয় খণ্ডে তা পরিণতি পায়। এই গ্রন্থের যেমন ঐতিহাসিক তেমনি সাহিত্যিক মূল্য প্রচুর। দুই বাংলার সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই বই অনেকে পড়বেন, এর ঢাকঢাক গুড়গুড়হীন স্পষ্টতা অনেকের অপছন্দ হবে। আবার অনেকেই এ বই থেকে আত্মরূপান্তরের প্রেরণা পাবেন। পশ্চিমবঙ্গে এখন যেসব বই জনপ্রিয় তাদের বেশির ভাগই অবক্ষয় এবং আপজাত্যের কাহিনী, অথবা লঘু রম্যরচনা। তসলিমার কষ্টের অন্ত নেই, কিন্তু তিনি পারিপার্শ্বিক চাপের কাছে হার মানেননি, নারী এবং পুরুষ উভয়েরই ভিতরে মনুষ্যত্বের উজ্জীবনে তার প্রয়াস আজও ক্লান্তিহীন।… তসলিমা তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম দুটি খণ্ডে তাঁর বাল্যকাল এবং বয়ঃপ্রাপ্তির বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। কিছুই রেখেঢেকে লেখেননি। ফলে দুই বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের অধিকাংশ স্ত্রী-পুরুষ–যাঁরা সমস্ত অপ্রিয় সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখাকেই সভ্যতার আবশ্যিক শর্ত বিবেচনা করেন –স্বভাবতই খুব বিচলিত হয়েছিলেন। ..
এখন থেকে প্রায় একশো বছর আগে বেগম রোকেয়া লিখেছিলেন, আমাদের যথাসম্ভব অবনতি হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পারি নাই, তাহার প্রধান কারণ এই বোধ হয় যে যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, তখনই ধর্মের দোহাই অথবা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমাদের অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এই দুঃসাহসী সত্যঘোষণার জন্য তাকে যথেষ্টনিগ্রহ সইতে হয়, এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময়ে নবনূর এ প্রকাশিত মূল প্রবন্ধটির কিছু অংশ বাদ দিতে হয়। একশো বছর পরেও প্রস্তাব শুনছি তসলিমার বইটি থেকেও কিছু অংশ বাদ দিলে সেটির ওপরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হতে পারে। একশো বছর পরেও কি আমরা অতীত সময়ের সেই দুঃসহ বিন্দুটিতে দাঁড়িয়ে?
পশ্চিমবঙ্গের অনেক কাগজেই বই নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ বেরিয়েছে। অনেক কাগজের সম্পাদকীয় বা কলামে অনেকে বই নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন, যদিও বড় কিছু লেখক এবং শিল্পী সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেছেন। ঢাকার কোনো কাগজেই বই নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে খুব বেশি কেউ টু শব্দ করেননি বরং প্রায় সবাই সায় দিয়েছেন বই নিষিদ্ধের মতো নিষিদ্ধ কাজে। ঘৃণার মতো সংক্রামক আর কিছু নেই। কেউ যদি একবার কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করে, সেই ঘৃণা সম্পূর্ণই মিথ্যের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হলেও আলোর গতিরও আগে ছোটে সেই ঘৃণা।
কত কিছু ঘটে গেল ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিয়ে। নিষিদ্ধ হল একটি মত, ‘দ্বিখণ্ডিত’ হল পাঠকের পথ। কেউ বলছে নিষিদ্ধ হোক, কেউ বলছে না হোক। কেউ বলছে ধর্ম নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করা যাবে না, কেউ বলছে যাবে। কেউ ভয়ে কেঁপে উঠে বলছে, দাঙ্গা লেগে যাবে। কেউ ঠোঁট উল্টে বলছে, দাঙ্গার কোনোআভাসই কখনো দেখা দেয়নি। কেউ বলছে, মুসলমানের ভোট পাওয়ার জন্য সরকারের এই নিষিদ্ধকরণ। কেউ বলছে, পয়গম্বরকে অশ্রদ্ধা করা হয়েছে সুতরাং নিষিদ্ধ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যে যাই বলুক, আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। কেবল নিজের মত নয়, অন্যের মতও, সে মত আমার মতের যতই বিপরীত হোক। এ বিষয়ে আমার নিজের বিশ্বাস সামান্যও খণ্ডিত হয়নি। আমি অখণ্ডই থেকে গেছি যেমন ছিলাম।
বাংলাদেশ আমার পাঁচটি বই নিষিদ্ধ করেছে। সে তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ কম করেছে। একটি। কিন্তু নিষিদ্ধ করার কারণ দু সরকারই একই দেখিয়েছে, মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করেছি। ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার অজুহাতে চিরকালই শাসককুল মানুষের কণ্ঠরোধ করেছে। আমরা তো এখনও সেই যুগকেই ‘অন্ধকার যুগ’ বলি, যে যুগে ধর্ম দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হত!
‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করায় যে অন্ধকার কেঁপে নেমেছিল, সে থেকে মানুষকে বাঁচাবার দায়িত্ব প্রথম নিয়েছিলেন সুজাত ভদ্র। তিনিই আদালতে গেলেন জরুরি একটি প্রশ্ন নিয়ে, ‘আমি এ দেশের নাগরিক, এ দেশে প্রকাশিত ‘দ্বিখণ্ডিত’ নামের বইটি আমি পড়তে চাই। কে আমার পড়ার অধিকার খর্ব করছে? তাঁকেই সাহায্য করতে গিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে জয়মাল্য বাগচি তাঁর অসাধারণ যুক্তি পেশ করে আদালত মুগ্ধ করলেন। ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা আমি সুজাত ভদ্র বা জয়মাল্য বাগচিকে জানাইনি। জানাইনি মহামান্য বিচারকদেরও, যারা দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ হওয়ার বিপক্ষে রায় দিয়েছেন। জানাইনি, কারণ যদিও বইটি আমার লেখা, আপাতদৃষ্টিতে এ আমার ব্যক্তিগত বটে, কিন্তু নিষিদ্ধ হওয়ার পর ব্যাপারটি মোটেই আমার ব্যক্তিগত নয়। নিষিদ্ধ হলে আপনাতেই লেখক আড়ালে চলে যান, সামনে এসে দাঁড়ায় বড় প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো লেখার অধিকার। কেবল তার নয়, সবার। সবার ন্যায্য অধিকারের পক্ষে চিরকালই লড়াই করেন গুটিকয় মানুষ। তারা অলক্ষ্যে অজান্তে ইতিহাস রচনা করেন। সভ্যতার ইতিহাস। সুজাত ভদ্র এই ভারতবর্ষে এক আকাশ আলো ছড়িয়ে সেই ইতিহাসটিই রচনা করলেন। দু’বছর নিষিদ্ধ থাকার পর ‘দ্বিখণ্ডিত’ মুক্তি পেল। আদালতের রায়ে নিষিদ্ধ ‘দ্বিখণ্ডিত’র মুক্তি পাওয়া আমার ব্যক্তিগত কোনো জয় নয়, এ জয় মুক্তচিন্তার জয়, বাক স্বাধীনতার জয়, এ মত প্রকাশের অধিকারের জয়। অনেকেই যোদ্ধা ছিলেন। লেখক আর প্রকাশক তো ছিলেনই, আদালতে শুনানির দিন নিষিদ্ধের বিপক্ষে, অনেকে আবার বাক স্বাধীনতার পক্ষে উপস্থিত থাকতেন। যত দুরাশাই দেখা দিক, একটি সান্ত্বনা এই, অধিকাংশ মানুষ বই নিষিদ্ধ হোক চায় না, সে যে মতের বইই হোক না কেন। তবে একই সঙ্গে একটি আশংকা এই, অধিকাংশ এই মানুষ মুখ বুজে থাকে।