০৬. নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে

০৬. নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে

কী এক ঘোরের মধ্যে আমি নিজের সঙ্গে কথা বলতে থাকি। বলতে থাকি—

আমার জন্ম ভারতবর্ষে নয়। অথচ দেখতে শুনতে রুচিতে সংস্কৃতিতে আমি সামান্যও অভারতীয় নই। কিছু বছর এগিয়ে জন্মালেই আমি ভারতীয় হতে পারতাম। আমার বাবা জন্মেছিলো ভারতভাগের আগে। এই ভারতের ইতিহাস আমার বাবাকে তিনটে দেশের নাগরিক করেছে। আমাকে করেছে দুটো দেশের।

পূর্ববাংলার গ্রামে হারাধন সরকার নামে এক হিন্দু কৃষক ছিল। হারাধন সরকারের একটি ছেলে জানি না কী কারণে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, হয়তো সে ছেলের নাম ছিল যতীন্দ্র, হয়েছে জমির, অথবা কমল থেকে কামাল। সেই সরকার বংশের মেয়ে আমি। হারাধন সরকার আমার ছ’ পুরুষ আগের পূর্ব পুরুষ, তার অন্য সন্তানদের বংশধরেরা নিশ্চয়ই ভারতে চলে এসেছে দেশভাগের পর। তারা এখন ভারতের নাগরিক। আমার ঠাকুরদা জমির সরকার অথবা কামাল সরকার দেশ ত্যাগ করেননি কারণ তার নামটা ছিল মুসলমান নাম।

যখন ছোট, শুনেছিলাম, মুসলমানের একতা একটা অসম্ভব ঘটনা, মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধ হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য। যদিও আমি ভারতভাগের পরে জন্মেছি, অবিভক্ত ভারতের জন্য শৈশব থেকেই আমার একটা আকর্ষণ ছিল। অল্প বয়সে অনেক গদ্য পদ্য লিখেছি অবিভক্ত বাংলা নিয়ে, অবিভক্ত ভারত নিয়ে। এসব লিখেছি আমার প্রথম ভারত ভ্রমণের অনেক আগেই। একই ভাষার এবং একই সংস্কৃতির মানুষের মাঝখানে, বন্ধু এবং আত্মীয়দের মাঝখানে কোনও কাঁটাতার আমি মানি না, আমি বিশ্বাস করি না। ছোটবেলা থেকেই বাংলা সাহিত্যের পাঠক আমি, দুই বাংলার গল্প, উপন্যাস, কবিতা প্রবন্ধ গোগ্রাসে পড়তে পড়তে বড় হয়েছি। খুব অবচেতনেই আমি বাঙালি লেখকদের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করেছি। লেখকতালিকার বেশির ভাগ লেখকেরই বাস পশ্চিমবঙ্গে।

শৈশব থেকেই আমি ধর্মমুক্ত। আমার সচেতন মন আমাকে মানববাদ আর নারীবাদে বিশ্বাসী করিয়েছে। আমার বাবা ছিলেন ধর্মমুক্ত মানুষ, সম্ভবত অবচেতনে তার দ্বারাই আমি প্রভাবিত। আমার বেড়ে ওঠা এভাবেই হয়েছে: নারীবিরোধী সংস্কার, ঐতিহ্য, রীতিনীতি ইত্যাদিকে ভাঙতে ভাঙতে। যখন ১৯৮৯ সালে আমি প্রথম ভারত ভ্রমণ করি, একবারের জন্যও অনুভব করিনি পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্য বা অঞ্চল কোনও ভিন্ন দেশ। যেদিন প্রথম আমি পা দিই ভারতে, সেদিন থেকে এখন অবধি আমি বিশ্বাস করি আমি অখণ্ড ভারতের মেয়ে, ভারত থেকে আমি বাংলাদেশকে সত্যি বলতে কী, আলাদা করতে পারি না। আমার সেই হিন্দু পূর্বপুরুষের জন্য নয়, ভারতের অনেক সংস্কৃতির একটি সংস্কৃতি আমার বলে নয়, বা এর একটি ভাষায় আমি কথা বলি বলে নয় আমি দেখতে ভারতীয় বলে নয়, ভারতীয় সত্তা আমার ভেতর গভীরভাবে প্রোথিত বলে। এই সত্তা আমার ভেতর প্রোথিত করেছে ভারতের ইতিহাস। আমি ইতিহাসের শিকার একজন, অথবা ইতিহাস দ্বারা আমি সমৃদ্ধ, যতটুকুই সমৃদ্ধ। এর দারিদ্র, উপনিবেশিকতা, এর ধর্ম, এর ধর্মান্ধতা, এর হিংসে, হিন্দু মুসলমান, রক্তপাত, দেশভাগ, মাইগ্রেশন, একজোড়াস, এর দ্বিজাতিতত্ত্ব, বা টু নেশন থিউরি, এর অগণতন্ত্র, এর জাতপাত, রায়ট, যুদ্ধের শিকার আমি। এসব আমাকে ভারতীয় করেছে, যতটাই করেছে। এসবের ওপর বাংলাদেশ নামের এক মৌলবাদ, সন্ত্রাস, স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতি, দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ পীড়িত দেশ আমাকে আরও বেশি অভিজ্ঞ করেছে।

মুসলিম মৌলবাদীদের অন্ধতা, অশিক্ষা, আর অসহিষ্ণুতা ভারতের ইতিহাসের একটি টুকরো বাংলাদেশ থেকে আমাকে নির্বাসন দিল। দেশের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হল। আমি সেই তখন থেকেই ভারতের দরজায় কড়া নাড়ছি। যেদিন দরজা খোলা হল, আর আমি নির্বিঘ্নে ঢুকে গেলাম, মনে হয়নি কোনো বিদেশে ঢুকেছি। কেন মনে হয়নি? কেন আজ এশিয়ার অন্য দেশগুলোকে, ইউরোপ আর আমেরিকার দেশগুলোকে বিদেশ বলে মনে হয় আমার, কিন্তু ভারতবর্ষকে নয়। ইউরোপে বারো বছর কাটিয়েও ইউরোপকে নিজের দেশ বলে মনে করতে পারিনি। ভারতবর্ষে একটি বছরও কাটাতে হয়নি একে নিজের দেশ বলে মনে করার জন্য। একই ইতিহাস বহন করি বলেই তো! আজ যদি আদি ভারতের একটি টুকরোর, পূর্ববাংলার বা নতুন নাম ধারন করা বাংলাদেশের মানুষের (ভারতবর্ষের মাটিতে ইসলাম প্রচারকদের আসার কারণে ধর্মান্তরিত হওয়া মানুষের) ধর্মান্ধতা রাজনৈতিক নেতাদের ধর্মভীরুতা এবং দুরভিসন্ধির কারণে এমনই তুঙ্গে ওঠে যে গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তাকে সবলে অস্বীকার করে এবং মানবাধিকার, মানবতার পক্ষের আপাদমস্তক সেকুলার লেখিকাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে, তবে সেই লেখিকাকে বাঁচাবার দায় কি সুদূর ইউরোপের নাকি আমেরিকার নাকি সেকুলার ভারতের?

আমার ওই দুঃসময়ে ভারতের দরজা ছিল বন্ধ। ইউরোপ নিয়েছিল আমাকে লুফে। সেই ইউরোপের সমাজে সবসময় নিজেকে মনে হয়েছে বহিরাগত। ইউরোপ ছেড়ে ভারতে এসেছি, ভারতে আসার পর মনে হয়েছে, বারো বছরের দীর্ঘ মৃত্যুময় নিস্তব্ধতা যেন শেষ হল। এই সমাজ যেহেতু আমার চেনা সমাজ, আমি যেহেতু এরকম সমাজেই বড় হয়েছি, তাই এত শান্তি স্বস্তি আর ভালো লাগা। সেই আগের মতো লেখালেখি নতুন উদ্যমে চালিয়ে যাচ্ছি। এই সমাজের জন্য ভালও কিছু করার সংকল্প আমার। মেয়েরা যেন নিজেদের শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতা অর্জন করার জন্য সচেতন হয়, নিজেদের স্বাধীনতা এবং অধিকারের জন্য সংগ্রাম করার সাহস অর্জন করে। চিরকালের নতমুখ, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত নারী ভয় কাটিয়ে সেই আত্মবিশ্বাসটাই, সেই সাহসটাই, সেই শক্তিটাই যেন আমার লেখা থেকে পায়।

এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে যে বাংলাদেশে যে অবস্থা আমার হয়েছিল, প্রায় একই অবস্থা হতে যাচ্ছে এই প্রগতিশীল ভারতে, ততোধিক প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গে। আমাকে গৃহবন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে। কোনও ‘পাবলিক প্লেস’-ই নাকি আমার জন্য আর নিরাপদ নয়। শুধু তাই নয়, কোনো বন্ধুর বাড়িও নিরাপদ নয়, আমি শুধু অন্ধকার ঘরে বন্দি জীবন কাটাবো। যারা প্রকাশ্যে খুনের হুমকি দিচ্ছে, তাদের জন্য এ রাজ্যের প্রতিটি ইঞ্চি নিরাপদ। যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার তারা রাখে। রাস্তা অবরোধ করে মানুষকে ভোগাবার, ধর্মের নামে যাকে ইচ্ছে তাকে সর্বনাশ করার সব অধিকারই তাদের অলিখিত ভাবে দেওয়া হয়েছে। ওইসব সন্ত্রাসীদের সবরকম স্বাধীনতা আছে সন্ত্রাস করে যাওয়ার। আর যারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অসত্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তাদের মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা হচ্ছে। আমাকে মুহুর্মুহু উপদেশ দেওয়া হচ্ছে মৌলবাদীদের মিছিল মিটিং হবে, অতএব আমি যেন ঘর বাড়ি ছেড়ে, শহর ছেড়ে কোথাও চলে যাই। হাঁ, পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরে এসো। পরিস্থিতি কি কোনোদিন শান্ত হয়? বাংলাদেশ থেকেও একই কথা বলে আমাকে বের করা হয়েছিল। আজ তেরো বছর পরও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। আর এ কথাও আমার মনে হয়েছে, মৌলবাদীদের ভয়ে আমি যদি দূরে চলে যাই, তবে এ তাদের জন্য বিশাল এক বিজয় হবে। মুক্তচিন্তা, বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ও সেকুলারিজম ধর্মমুক্ত পদ্ধতির বিপক্ষে বিরাট এক বিজয়। এই বিজয়টিই তাদের কিছুতেই দেওয়া উচিত নয়। যদি তারা জয়ী হয়, তাতে আমার যত ক্ষতি, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি ভারতবর্ষের। আমাকে দেশছাড়া করিয়ে তাদের দাবি যদি পুরণ করা হয়, তবে তাদের দাবির অন্ত থাকবে না। একটার পর একটা দাবি তারা করতেই থাকবে, গণতন্ত্র বিরোধী আস্ফালন করতে দ্বিগুণ উৎসাহী হয়ে উঠবে। একে তাড়াও, ওকে বন্দি করো, তার বই নিষিদ্ধ করো, একে মারো, তাকে পোড়াও চলতেই থাকবে। আর বশংবদ ধর্মনিরপেক্ষগণ ধর্মীয় মৌলবাদীদের সব আদেশ নিষেধ মাথা পেতে বরণ করে নেবে। মৌলবাদীদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করলে মৌলবাদীরা কখনও তুষ্ট হয়, তারা আরও ভয়ংকর গণতন্ত্রবিরোধী দাবি নিয়ে আরও ভয়ংকর রূপে উপস্থিত হয়।

আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যে কখনও এমন ছিল না যে ভারতেও আমাকে বাংলাদেশের মতো ভুগতে হবে। এক দেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, আরেক দেশে সংখ্যালঘু, কিন্তু দাপট প্রায় একই। ধর্মান্ধতা, অসহিষ্ণুতা, মেরে ফেলা, কেটে ফেলা, মুণ্ডু চাওয়া, প্রগতি, বিজ্ঞান ইত্যদিকে বাজে কাগজের মতো উড়িয়ে দেওয়া সব এক। আমাকে মেরে তাদের লাভ কী হবে, মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। মৌলবাদী নেতারা ভালো করে জানে যে এতে তাদের লাভ থাকলেও থাকতে পারে, ইসলামের কোনও লাভ নেই। ইসলাম যেমন আছে, তেমনই থাকবে। ইসলামকে স্পর্শ করার সাধ্য আমার কেন, কোনও প্রাণীরই নেই। ধর্ম ধর্মের মতো থাকে, মানুষ ধর্ম আঁকড়ে ধরে নয়তা ধর্ম থেকে দূরে সরে। মৌলবাদের চেহারা পৃথিবীর সব দেশে এক। তাদের ভাষা এক, তাদের ক্রুরতা এক, চরিত্র এক, তাদের স্বপ্ন এক। সমাজকে কয়েক হাজার বছর পেছনে ঠেলে দেওয়ার আরামটা পেতে চায়, ও থেকে বঞ্চিত হওয়ার আদৌ কোনোও ইচ্ছে নেই কারও।

ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে আমার পৃথিবী। শহর জুড়ে যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়ানোর মানুষ আমি। এখন আমার হাতে পায়ে শেকল। সব বলে ফেলার মানুষ আমি, এখন আমার জিভে সেলাই। বাইরে নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল, আমি অংশ নিতে পারছি না। বাইরে চলচ্চিত্রের, নাটকের, গানের উৎসব, আমি উপভোগ করতে পারছি না। আমাকে একটি দরজা জানালা সাঁটা ঘরে দমবন্ধ অবস্থায় বসে থাকতে হবে। না, একে আমি আমার নিয়তি মানছি না। আমি এখনও বিশ্বাস করছি, আমি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবো। এখনও বিশ্বাস করছি, ভারত আমাকে সেই শাস্তি দেবে না, যে শাস্তি মৌলবাদ অধ্যুষিত বাংলাদেশ দিয়েছে। এখনও বিশ্বাস করছি, এ দেশই আমাকে নিরাপত্তা দেবে। মানুষের ভালোবাসাই আমার নিরাপত্তা হবে। আমি এ দেশেই বাকি জীবন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে কাটাতে পারবো। এই দেশকে আমি ভালোবাসি। এই মাটিকে আমি নিজের মাটি বলে ভাবি। এই দেশও যদি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তবে আমার শেষ ভরসা, শেষ অবলম্বন, আমার শেষ স্বপ্নকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা ছাড়া আর কিছু নয়।

আমার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কোনো দেশ নেই, কোনো ঘর নেই, এক ভারতবর্ষই দেশ আমার। এখানেই আমার ঘর। সত্য বলার অপরাধে আমাকে আর কত শাস্তি দেবে ধর্মবাদীরা আর ধর্ম ব্যবহার করে ভোট পেতে চাওয়া রাজনীতিকরা? এই যে এত ভোগান্তি, এত লাথি, এত গুঁতো, এত ঘাড় ধাক্কা। এত কিছুর পরও আমার স্বপ্ন আমি সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারি না। এখনও স্বপ্ন দেখি যে উপমহাদেশের একজন সৎ, সত্যবাদী, সেকুলার লেখকের জন্য ভারতবর্ষই দেশ, সবচেয়ে নিরাপদ দেশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *