০৭. ফেয়ারওয়েল, ২২ নভেম্বর, ২০০৭
গতকাল সকালে ছোট একটা মিছিল বেরিয়েছিল পার্কসার্কাসে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘নন্দীগ্রাম তাণ্ডব’, ‘রিজওয়ান হত্যা’, আর ‘তসলিমা হঠাও’ নিয়ে কিছু একটা হবে। গোটা পঞ্চাশেক মৌলবী রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছিল। এরা কেউই আন্দোলনের মতলব নিয়ে এসেছে বলে মনে হয়নি। বাড়িতে ঘুমোচ্ছিল হয়তো, ঠেলে রাস্তায় নামানো হয়েছে। পুলিশ সবাইকে ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে। এদের মাতব্বরটিকেও। মাতব্বরটি ‘অল ইণ্ডিয়া মাইনরিটি ফোরাম’এর নামে প্রায়ই এ ধরনের গণ্ডগোল সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয়।
কিন্তু এর পর পরই দেখা গেল পার্কসার্কাসের এক গলি থেকে অল্প বয়সের কিছু ছেলে বেরিয়ে পুলিশের দিকে ঢিল ছুঁড়তে লাগলো। ছুঁড়ে মারতে লাগলো কোক খেয়ে কোকের বোতল, আর হিহি হাসি। পুলিশেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের মার খেলো আর মাঝে মাঝে কাঁদানে গ্যাস ছুড়লো। লুঙ্গি আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি ছেলেরা হুল্লোড় করতে করতে গাড়ি পোড়াতে লাগলো, বাস ট্রাক পোড়াতে লাগলো, সাংবাদিকদের ক্যামেরা ভাঙতে লাগলো। এই ভাংচুর, এই জ্বালাও পোড়াও, এই হৈ-হল্লা অনেকটা সংক্রামক, এর পেছনে কোনও উদ্দেশ্য থাকার প্রয়োজন হয় না। অনেকটা পকেটমারকে পেটানোর মতো। পিটিয়ে আনন্দ। পার্কসার্কাসের রাস্তায় পুলিশ আর গাড়ি বা কিছু চলতে দিচ্ছে না। সারা শহরে ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়ে গেল। দুতিনটে ছেলে গলির ভেতর কাগজে ‘তসলিমা গো ব্যাক’ লিখে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালো। কলকাতার কয়েকজন বন্ধুকে ফোনে জিজ্ঞেস করি, ‘কারা ওরা?’ প্রায় সবাই বললো, ‘ওরা জানে না তসলিমা কে, কী জিনিস, তসলিমার বই কোনোদিন পড়েনি, উর্দুভাষী অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত মুসলমান, পকেটমার, ছিচকে চোর, মুদির দোকানি, ফেরিঅলা। ওদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। ওদের পথে নেমে ঠিক যা যা করতে বলা হয়েছে, সব করছে ওরা। আমি হতবাক বসে থাকি। টেলিভিশনে যা দেখলাম, নীল পোশাকের অভিজ্ঞ পুলিশ র্যাফ নামলো, সেনা নামলো। শহরময় টহল দিল। কাফু জারি হল। আর রাতে সিপিএমএর রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বললেন, ‘তসলিমাকে নিয়ে ঝামেলা হলে তসলিমার এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।’
পুলিশের নিরাপত্তা প্রধান আগেও যেমন জানিয়েছিলেন, সেদিনও এবং পরদিনও জানালেন আমাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত একেবারে পাকা। মৌলবাদীরা আসছে আমার বাড়িতে, শুক্রবার নামাজের পর। আগেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, এবারও করি, ওদের অ্যারেস্ট করছেন না কেন?
বি–অসুবিধে আছে।
ত–কী অসুবিধে? আপনারা আছেন, নিশ্চয়ই ওরা বাড়িতে আসার সাহস পাবে না।
বি–আমরা ওদের কিছু করতে পারবো না।
ত–কেন?
বি–মুসলমানদের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। রায়ট লেগে যাবে।
ত–হিন্দু মুসলমানের ব্যাপার নয়, টেরোরিস্ট হল টেরোরিস্ট। কেউ অন্যায় করলে তাকে শাস্তি দেবেন। রায়ট লেগে যাবে, এ কোনও যুক্তি হল কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার?
বি–রায়টের রিস্ক নিতে পারবো না। ত তাহলে কী করতে হবে?
বি–আপনাকে দু’দিনের জন্য জয়পুরে যেতেই হবে।
ত–দু’দিন?
বি–হাঁ, ঠিক দু’দিন।
ত–দু’দিনে সব ঠিক হয়ে যাবে?
বি–সিওর।
ত–জয়পুরে কেন?
বি–জয়পুরে লাক্সারি রিসর্ট আছে আমাদের। ওখানে দু’দিন একটু বিশ্রাম নিন। আমরা দুদিন পর আপনাকে ফেরত নিয়ে আসবো।
ত–আমি জয়পুর যাবোনা। আপনারা যদি আমার বাড়িতে আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারেন, তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে শুক্রবার দিনটা কাটাই।
বি–কোথায়?
ত–বেহালায়।
বি–না, বেহালায় সিকিউরিটি ছাড়া আপনাকে থাকতে হবে। যেখানেই যাবেন, নিজ দায়িত্বে।
ত–সল্টলেকে?
বি–আমাদের পক্ষে সিকিউরিটি দেওয়া সম্ভব নয় সল্টলেকে। আপনার নিজ দায়িত্বে থাকতে হবে।
ত–আমি বেলঘরিয়া যাবো। একদিনের তো ব্যাপার। আমার পাবলিশারের বাড়ি ওখানে।
বি–হবে না।
ত–দুর্গাপুরে, বোলপুরে?
বি–সবখানেই আপনার সিকিউরিটির দায়িত্ব আপনার।
ত–আপনারাই বলছেন আমাকে মেরে ফেলার জন্য দল তৈরি হয়ে গেছে। আবার বলছেন কোথাও সিকিউরিটি দেওয়া সম্ভব নয়! এতদিন যে নিরাপত্তা দিলেন, কেন দিলেন! হঠাৎ বিপদের সময় বন্ধ করে দেবেন কেন? বিপদের কথা তো আমার জানা ছিল না। আপনারাই জানাচ্ছেন, এখন সবচেয়ে বেশি বিপদ। আর আপনারাই এখন বলছেন, নিরাপত্তা দেবেন না। কী করবো আমি, কিছু তো বুঝতে পারছি না।
বি–আপনি আমাদের কথা শুনুন। আপনি জয়পুর যান। আপনার ভালোর জন্যই বলছি।
ত–আমি অবাক হচ্ছি, এত বড় পুলিশ বাহিনী গোটা কয় লোকের মার্ডার প্ল্যানএর বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। যদি আচমকা কিছু ঘটতো, সে না হয় বুঝতাম। এ তো আপনাদের নলেজের মধ্যে। কেন আমাকে বাঁচাতে পারবেন না?
বি–সরি। আমরা পারবো না।
সাফ সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাকে মেরে ফেলবে মৌলবাদীরা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ কোনো নিরাপত্তা আমাকে দিতে পারবে না। আমি স্তম্ভিত বসে থাকি। এ কী ঘটছে! কোনোদিন নিরাপত্তা চাইনি সরকারের কাছে। কিন্তু ভারতে যখনই এসেছি বা থেকেছি, সেই তিরানব্বই সাল থেকে আমার নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করেছে সরকার। আমাকে একদিনের জন্যও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রাখেনি। আর আজ কি না আমাকে বলা হচ্ছে আমাকে আক্রমণ করা হবে, পুলিশ কোনো নিরাপত্তা আমাকে দেবে না, আমাকে পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করতে হবে, তাহলেই সরকার আমার পাশে দাঁড়াবে, নয়তো দাঁড়াবে না। এমন অদ্ভুত যুক্তি আগে শুনিনি, এমন অদ্ভুত ব্যবহার আজ অবধি কোথাও পাইনি। কস্মিনকালেও নিরাপত্তাব্যবস্থা আমি চাইনি, সবসময় যা চেয়েছি, তা হলো, আর দশজন মুক্ত মানুষের মতো চলাফেরা করতে। আমি চাইনি আমার জন্য সরকারের কোনো টাকা খরচ হোক। আমি সাধারণ মানুষ, সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করতে চেয়েছি। প্রথম দিকে প্রচুর পুলিশ থাকতো ঠিকই, ধীরে ধীরে কমে গিয়ে মোটে দুজনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে হলে একজন সাদা পোশাকের কেউ যেত আমার সঙ্গে। আমি বাড়ি ফিরলে সেই সাদা পোশাক চলেও যেত নিজের বাড়ি। দু’শ থেকে দু’জন হওয়ার অর্থ এ শহরে আমার জীবনের ঝুঁকি নেই। আমিই চাইছিলাম রক্ষীর সংখ্যা কমে কমে যেন শূন্যতে চলে আসতে পারে। মানুষের ভালোবাসাই যেন আমার নিরাপত্তা হয়। কিন্তু আশ্চর্য! এই শহরই আজ আমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে চাইছে, এই খবরটি দিয়ে, যে, আমাকে আজ বা কাল মেরে ফেলা হবে, মেরে ফেলার সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেছে। আমাকে আমার আততায়ীদের খবরটা জানিয়ে নিরাপত্তা বন্ধ করা কেন? না জানিয়েই বন্ধ করলে আমি অন্তত দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারতাম!
দুপুরে পুলিশের লোক এসে আমাকে নিয়ে গেল কলকাতা বিমান বন্দরে। দাদা ছিল আমার সঙ্গে। আমার হাতে দুটো ওয়ান ওয়ে টিকিট দিল ওরা। কোথায় যেতে হবে? জয়পুর। একগাদা পুলিশ আমাকে এয়ারক্রাফটের ভেতর বসিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। উড়োজাহাজ উড়লো, তারপরও দাঁড়িয়ে রইল। কলকাতার আকাশে যতক্ষণ উড়োজাহাজের চিহ্ন দেখা যায়, রইল। ফেয়ারওয়েল ওরা এমন নিঃশব্দেই জানালো। আমি তখনও জানি না আর কলকাতায় ফিরতে দেওয়া হবে না আমাকে। তখনও জানি, আমাকে বাংলা থেকে চির জীবনের জন্য দূর করতে যে চক্রান্ত চলেছে, তা সেদিন সার্থক হল।
জয়পুর নামার পর দেখি পুলিশে ছেয়ে আছে বিমান বন্দর। তারা নাকি মাত্র কিছুক্ষণ আগে খবর পেয়েছে যে আমি আসছি। কলকাতার পুলিশ বলেছে, আমি নাকি এখানে কোন সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছি। পুলিশ নিয়ে গেল আমাকে একটা সস্তা হোটেলে। এই হোটেলই নাকি আমার জন্য ঠিক করা হয়েছে কলকাতা থেকে। অথচ বলা হয়েছিল, লাক্সারি রিসর্ট। লাক্সারি তোদূরের কথা, এঅনেকটাময়মনসিংহের নদীর পাড়ের দেড়টাকা দামের চিৎ কাত হোটেলের মতো। এমন হোটেলে কখনও থাকিনি আগে। অভিজ্ঞতাও বটে। পুলিশেরা জিজ্ঞেস করতে লাগলো, তোমার প্রোগ্রাম কাল কখন?
ত–আমার কোনো প্রোগ্রাম নেই।
পু–তবে কেন এসেছো কেন?
ত–আমাকে পাঠানো হয়েছে কলকাতা থেকে।
পু–কে পাঠিয়েছে?
ত–কলকাতার পুলিশ।
পু–কেন পাঠিয়েছে?
ত–জানি না। বলেছে দু’দিনের জন্য জয়পুরে থাকতে।
পু–ওরা আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছে, কী একটা নাকি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছে।
ত–কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ব্যাপার নেই।’
পুলিশের মধ্যে রাজস্থানী ভাষায় আলোচনা চলতে থাকে। একটু পর পর একজন আসে, কাল আমার ক’টায় প্রোগ্রাম জানার জন্য মরিয়া ওরা। প্রোগ্রাম কিছু নেই, এমনি এসেছি –এ কথা বারবারই বলছি, বারবারই শুনছে, বারবারই বিষম খাচ্ছে। ভড়কে গেছে হোটেলের সামনে সাংবাদিক আর ক্যামেরার ভিড় দেখে। আমার জানা হতো না ক্যামেরার ভিড় সম্পর্কে, যদি না হোটেল-ঘরের টেলিভিশনটা চালাতাম। টেলিভিশনে দেখি আমার খবর দেখানো হচ্ছে, আমি জয়পুরের কোন হোটেলে এখন আছি, কত নম্বর রুমে আছি, সব। আমি নিজেই জানতাম না হোটেলের নাম আর রুম নম্বর। টেলিভিশন থেকে জানা হয়, জানালার পর্দা সামান্য ফাঁক করে দেখাও হয় রাস্তার সারি সারি ক্যামেরা কী করে তাক করে আছে ঘরের দিকে। বুক কাঁপে আমার। মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা আমার রক্ত চায় জানার পরও কোনও সুস্থ সাংবাদিক কি জানাবে আমি কোথায় আছি না আছি, এভাবে? এরাকি তাহলে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সন্ত্রাসীদের যে তোদের শিকারের সন্ধান পাওয়া গেছে, আয় ছুটে আয়, এসে শিকারটাকে ইচ্ছে মতো ছিঁড়ে খা। ছিঁড়ে খা যেন আমরা সেটা ক্যামেরায় চমৎকার ধরে রাখতে পারি, আর সারাদিন ধরে প্রচার করতে পারি, আমাদের দর্শক বাড়বে, আমাদের চ্যানেলের নাম হবে!
ছটফট করি। একে ওকে ফোন করি। কলকাতার পুলিশেরা কেউ এখন আমার ফোন ধরছে না। জয়পুর পুলিশ না বোঝে ইংরেজি, না বোঝে হিন্দি। আমি প্রমাদ গুণতে থাকি। কী করে রাস্তায় ভিড় করা সাংবাদিকদের মিনতি করবো আমাকে প্রাণে মারার এই আয়োজন বন্ধ করতে! এক ফোঁটা ঘুম নেই। রাত একটার দিকে ঘরের দরজা ভেঙে ফেলছে এমন শব্দ। জিজ্ঞেস করি, কে?
পু–দরজা খুলুন।
ত–না, দরজা খুলবো না। কে আপনি?
পু–আমি পুলিশ সুপার। আপনাকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে রাজ্য ছেড়ে।
ত–কিছু বুঝতে পারছি না কী বলছেন।
পু–দরজা খুলুন।
ত–আমি দুঃখিত, এত রাতে আমি দরজা খুলবো না। যা বলবেন সকালে বলবেন।
পু–সকালে বললে চলবে না। আপনাকে বেরিয়ে যেতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর অর্ডার।
ত–আপনি রিসেপশন থেকে ফোন করুন ঘরের ফোনে। আমি কথা বলছি।
রিসেপশান থেকে ফোনে আমাকে পুলিশের বড় কর্তা বললেন–আপনি এক্ষুণি। হোটেল ছাড়ুন।
ত–হোটেল ছেড়ে আমি যাবো কোথায় এত রাতে?
পু–সে আপনার ব্যাপার, আপনি কোথায় যাবেন।
ত–এখন তো কোনো ফ্লাইট নেই কলকাতায় যাওয়ার।
পু–আমরা অত কিছু জানি না। শুধু জানি আপনার রাজস্থানে থাকা চলবে না।
ত–কেন চলবে না?
পু–আমাদের এখানে মুসলমানরা অসন্তুষ্ট হতে পারে। ল এণ্ড অর্ডার প্রবলেম হতে। পারে। সে কারণে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আপনাকে রাজস্থান ছাড়তে।
ত–কিছু কি প্রবলেম হয়েছে এর মধ্যে?
পু–হয়নি। কিন্তু যে কোনও সময় হতে পারে।
ত–মানে ‘হতে পারে’ অনুমান করে আমাকে চলে যেতে বলছেন।
পু–হ্যাঁ।
ত–সে আমি ছাড়বো হোটেল। সকালটা হতে দিন। আমি এয়ারপোর্টে চলে যাবো কলকাতার ফ্লাইট ধরতে।
পু–সকাল হতে দিতে পারছি না। সকালের আগেই যেতে হবে। সূর্য ওঠার আগে।
ত–সূর্য ওঠার ঠিক কত আগে বলুন।
পু–আপনাকে পাঁচটার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে।
ত–ঠিক আছে।
পু–পাঁচটার পাঁচ মিনিট আগেই আপনি রুম ছেড়ে নিচে নেমে আসবেন। গাড়ি অপেক্ষা করবে আপনাকে এয়ারপোর্টে নেওয়ার জন্য।
ঠিক আছে বলে ফোন রাখলাম। সত্যি বলতে কী, স্বস্তি পেলাম অনেক। এই রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া ঠিকানা যত শীঘ্র সম্ভব ত্যাগ করা উচিত। রাজস্থান ছাড়তে হবে, কলকাতায় ফেরার জন্য এ চমৎকার একটি কারণ। আমি হয়তো একটুখানি ঘুমিয়ে নেওয়ার সময় পেলাম, দাদা একেবারে ঠায় বসে রইলো বিছানায়। দাদাও বাবার মতো, ভোরে কোথাও যাওয়ার থাকলে সারারাত বসে বসে ভোর হওয়ার অপেক্ষা করে। ভোর পাঁচটায় নিচে নেমে দেখি পুলিশ আর সাংবাদিকদের ভিড়ে গিজগিজ করছে রাস্তা। ক্যামেরা আর সাংবাদিক ঠেলে সরিয়ে পুলিশ আমাকে গাড়িতে ওঠালো। এক সারি গাড়ি চললো। আমার গাড়ির পেছনে আরও পুলিশের গাড়ি, পুলিশের গাড়ির পেছনে সাংবাদিকদের গাড়ি। গাড়ি চলছে তো চলছেই। একসময় আমার খটকা লাগে, গাড়ি এত চলছে কোথায়! বিমান বন্দরে পৌঁছোতে তো এত সময় লাগার কথা নয়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত সময় লাগছে কেন এয়ারপোর্টে যেতে?’
গোঁফওয়ালা ডাকাত-ডাকাত দেখতে কয়েকজন পুলিশ গাড়িতে। পেছনের সিটে কিছু, সামনের সিটে কিছু, মাঝখানের সিটে আমি আর দাদা। আমার প্রশ্নের কেউ কোনও উত্তর দিল না। আমি আবারও জিজ্ঞেস করি। কোনও উত্তর নেই। আবারও।
ত–এয়ারপোর্টে যেতে এত দেরি হচ্ছে কেন? এয়ারপোর্ট তো এত দূরে নয়।
পু–যাচ্ছি না এয়ারপোর্টে।
ত–তবে কোথায় যাচ্ছেন?
পু–দিল্লি।
ত–দিল্লি কেন?
পুলিশ চুপ।
ত–দিল্লি কেন যাবো আমি? আমি কলকাতায় ফিরবো। আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যান।
পুলিশ চুপ।
ইংরেজি বোঝে না। দাদাকে বললাম, হিন্দিতে বলতে। দাদা হিন্দি আমার চেয়ে ভালো জানে। কিন্তু হিন্দিতে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নেরও কোনও উত্তর নেই। ওরা নিজেদের মধ্যে রাজস্থানী ভাষায় কথা বলতে থাকে। যেন আমাদের কোনও প্রশ্নই ওরা শুনতে পায়নি অথবা আমরা যে আছি গাড়িতে, সে বেমালুম ভুলে গেছে।
অন্ধকার কেটে যাচ্ছে, আলো ফুটছে। ভোরের ঘুম ঘুম রাস্তায় গাড়ি হাওয়ার বেগে ছুটছে। পুলিশগুলো বারবার পেছনে তাকাচ্ছে, দেখছে এ গাড়ির কেউ পিছু নিচ্ছে কি না। পেছন ফিরে একজন হঠাৎ হিন্দিতে বললো, দিল্লিতে যাচ্ছি, কারণ আমাদের সেরকমই বলা হয়েছে।
ত–কে বলেছে?
পু–সেরকমই অর্ডার।
ত–কে অর্ডার দিয়েছে?
পুলিশ চুপ।
ত–আমি তো কলকাতা ফিরবো। আমাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন?
পু–আমরা অত সব জানি না।
ত–কলকাতায় না গিয়ে দিল্লি যাওয়ার কারণ কী?
পুলিশ চুপ।
ত–দিল্লিই যখন যাচ্ছেন, তখন দিল্লিতে প্লেনে না গিয়ে গাড়িতে যাচ্ছেন কেন?
এ কথাটা পাঁচবার জিজ্ঞেস করার পর উত্তর জোটে, সিকিউরিটি।
গাড়ি চলছে। এরমধ্যে ফোন। কলকাতা থেকে। খবর পেলাম, আমার গাড়িকে অনুসরণ করছে স্টার আনন্দের দিল্লি সংবাদদাতা। স্টার আনন্দতে সরাসরি প্রচার করা হচ্ছে অজানার উদ্দেশে আমার যাত্রা। গাড়ি জয়পুর ছাড়িয়ে যাচ্ছে, কোথাও না কোথাও যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে জানি না। একসময় স্টার আনন্দর অনুসরণ করা সাংবাদিক ফোন করলো আমাকে, ‘দিদি, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আপনাকে?’ উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।
ত–জানি না। ওরা তো বলছে দিল্লি। কিছু বুঝতে পারছি না। দিল্লি কেন নেবে জানি না।
সা–এই আমার ফোন নম্বর। প্লিজ আমাকে জানাবেন কী হচ্ছে না হচ্ছে। আমরা আছি আপনার সঙ্গে। দিদি, কোনও চিন্তা করবেন না।
ত–কলকাতায় যাবো সকালের ফ্লাইটে। তাই কথা হল রাজস্থানের পুলিশের সঙ্গে। এখন আমাকে কি না দিল্লি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী রকম ধন্দের মধ্যে পড়েছি, দেখুন তো!
সা–আমরা তো আছি। ঘটনাটা কোথায় গিয়ে গড়ায়, দেখিই না। শুধু আমি নই, আমার মতো লক্ষ লক্ষ লোক আপনাকে ভীষণ রেসপেক্ট করে, দিদি।
ওই দিদি ডাক, ওই বাংলায় কথা বলা, হোক না ভাঙা বাংলায়, আমাকে স্বস্তি দেয়। আমি একা নই, আমার এই ভয়াবহ নিরুদ্দেশ যাত্রায় কেউ পাশে আছে, এই ভাবনাটিই আমার দুশ্চিন্তা ঘুচিয়ে দেয়।
জানি না কতদূর গিয়ে একসময় গাড়ি ঢুকে পড়ে একটা মোটেলের পেছনের নির্জন কোণায়। এক পুলিশ গাড়িতে থাকে, বাকি পুলিশ নেমে যায়। কোথায় যায় কে জানে, আর ফিরে আসে না। নতুন কিছু পুলিশ গাড়িতে ওঠে আধঘণ্টা পর। গাড়ি চলতে শুরু করে রাজপথে। আবারও হাওয়ার বেগে। কিছুক্ষণ পর সেই স্টার আনন্দের সাংবাদিক, কণ্ঠে আতংক আর অস্থিরতা, বলে, আমাদের সব সাংবাদিককে গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে বের করে মেরেছে পুলিশেরা। এখন মোটেলের একটা রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল দিয়ে চলে গেছে।
ত–কী বলছেন এসব! ভয়ংকর কাণ্ড!
সা–ওরা আপনার গাড়িকে ফলো করতে দেবে না।
ত–তাই বলে মারবে?
সা–যাচ্ছেতাই ভাবে পিটিয়েছে।
ত–আহা। বেরোবেন কী করে এখন?
সা–জানি না। মনে হচ্ছে হোটেলের লোকদের বলে দিয়েছে শেকল না খুলতে।
একসময় পুলিশদের জিজ্ঞেস করলাম, দিল্লিতে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? দিল্লির কোথায়? কোনও জায়গা আছে নির্দিষ্ট? পুলিশদের মধ্যে একজনই আছেন, যিনি হিন্দিতে অন্তত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। যদিও উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে তার আদৌ আছে বলে মনে হয় না। উত্তর দিতে পারা পুলিশটিও গোঁফওয়ালা, ডাকাত-ডাকাত।
পু–না। জায়গা আপনাকে বের করতে হবে। আমরা দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে দেব।
ত–দিল্লিতে পুলিশের হাতে দেবেন তো আমাকে? মানে সিকিউরিটি পুলিশের হাতে?
পু–দিল্লির যে ঠিকানায় যেতে চান, সে ঠিকানায় আমরা আপনাকে পৌঁছে দেবো৷ হোটেলের নাম টাম জানেন?
ত–আমার কোনও ঠিকানা নেই দিল্লিতে।
পু–কী নেই?
ত–ঠিকানা।
ভ’বাবুকে ফোন করি। সরকারের বড় পদে এই ভদ্রলোককেই আমি চিনি। খুব দ্রুত, খুব ব্যস্ত মানুষটিকে তথ্য জানিয়ে দিই, তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই।
ত–‘আমাকে কলকাতা থেকে জয়পুর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কাল রাতে জয়পুর পৌঁচেছি। এখন ওখান থেকে কয়েক ঘণ্টা পরই আমাকে, সকাল হওয়ার আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দিল্লি। কলকাতায় ফিরতে চাইলাম। কিন্তু না জানিয়ে দিল্লি পাঠানোর কোনও কারণ আমি জানি না। দিল্লিতে নাকি কোনো পুলিশের সঙ্গে ওদের কথা হয়নি। আমার কাছে জানতে চাইছে কোথায় যাবো আমি।
ভ’বাবু বললেন কেন আমাকে পাঠানো হচ্ছে দিল্লিতে, কী ঘটেছে রাজস্থানে, এসব খবর নিয়ে তিনি আমাকে জানাবেন। তিনি আর জানাননি। তার সেক্রেটারি ফোন করে বললেন, আমি যেন রাজস্থানী পুলিশদের বলি আমাকে দিল্লির পুলিশ-স্টেশনে নামিয়ে দিতে। ওখান থেকেই আমাকে তুলে নিতে আসবেন ভ’বাবুর লোক।
‘তাহলে সিকিউরিটির লোকেরা ওখান থেকে আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাক। আমি চলে যাবো কলকাতায়।‘
ওদিকে ভ’বাবুর সেক্রেটারি। শুনছেন।
‘দেখুন তো, এর কোনও মানে হয়। আমাকে জয়পুরে থাকতে দেবে না দুদিন, তো আমাকে বাড়ি ফিরতে দাও। জয়পুর থেকে কলকাতা চলে গেলেই ঝামেলা চুকে যেতো। এখন জয়পুর থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে কলকাতা। এত ঘুরপথের দরকার কী ছিল, বুঝি না।
ভ’বাবুর সেক্রেটারি বললেন, হুম।
আমি বললাম, ”আচ্ছা বলুন তো, দিল্লি শহর থেকে এয়ারপোর্ট কি খুব দূর? ঠিক মনে পড়ছে না। আজকেই তো ফ্লাইট ধরা যাবে, তাই না।
সেক্রেটারি বললেন, ‘আগে দিল্লি পৌঁছোন তো। পরেরটা পরে দেখা যাবে।
হঠাৎ পথে একজায়গায় গাড়ি থামিয়ে পুলিশেরা আবার হাওয়া হয়ে গেল, পুলিশের সবগুলো গাড়ি থেকেই পুলিশ হাওয়া। অনেকক্ষণ বাদে ফিরে এলো সাদা পোশাকে। গা থেকে হঠাৎ ওরা পুলিশের ইউনিফর্ম খুলে ফেললো কেন! দাদা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো, গাড়ির নম্বর প্লেটও খুলে ফেলেছে। লক্ষ্য করি, আমি যে গাড়িতে বসে আছি, সে গাড়ির তো বটেই, আমার গাড়ির সামনের এবং পেছনের গাড়িগুলোর নম্বর প্লেট নেই। দু’জন সাদা পোশাকের তাগড়া পুলিশ সব পুলিশকে বলছে রাইফেলগুলো সব লুকিয়ে ফেলতে। তার মানে কেউ যেন বুঝতে না পারে, আর্মস নিয়ে একদল লোক কোথাও যাচ্ছে! দাদা আর আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাগড়া দুজন বললো, ‘মোবাইল ফোন অফ করো। মোবাইল ফোন অফ করবো, হচ্ছেটা কী? কেন করবো অফ?’ বলতে নিচ্ছি, অমনি বিরাট ধমক, ‘অফ করোনি এখনও, এক্ষুণি অফ করো।‘ যে পুলিশ গাড়ি চালাচ্ছিল, আমার দিকে কটমট করে তাকালো, দৃষ্টিটি লোলুপ, নাকি দৃষ্টিটি রাগে ঘৃণায় ফোলা, বুঝতে পারি না।
দুপুর পার হয়ে গেছে, তখনও দিল্লি পৌঁছোনোর তোনামইনেই বরং রাস্তার সাইনবোর্ডগুলো দেখে বুঝি দিল্লির উল্টো পথে চলছে আমাদের গাড়ি। দিল্লি পেছনে। বুক ধুকধুক করে। ভয়ে কণ্ঠ শুকিয়ে খরা। গাড়ি একসময় বড় রাস্তা থেকে নেমে যায় অলিতে গলিতে, মাঠে ময়দানে, ক্ষেতে। ক্ষেত মাড়িয়ে গাড়ি চলে, পারলে নর্দৰ্মায় নেমে যায়। আমার মনে হতে থাকে, এই লোকগুলো সত্যিকার পুলিশ নয়। এরা আমাকে অপহরণ করেছে। আইএসআই বলে কী যেন ভয়ংকর কী আছে, সম্ভবত এরাই। এরাই আমাকে জয়পুর থেকে ছলে বলে কৌশলে বের করে নিয়ে এসেছে। অজ পাড়া গাঁ’র কোনও ঝাড় জঙ্গলে নিয়ে মেরে ফেলে রাখবে। মরে পচে থাকবো, কেউ জানবেও না।
দিল্লির রাস্তা থেকে এরা অনেক আগেই গাড়ির বহর ঘুরিয়ে নিয়েছে। কোথায় যাচ্ছে, তা অনুমান করার সাধ্য আমার নেই। নিজেদের মধ্যে রাজস্থানী ভাষায় কথা বলছে, আর ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। ড্রাইভারের চোখে এখনও আমাকে গিলে খাওয়ার দৃষ্টি। দেখে নিচ্ছে আমি ঠিক আছি কি না, আমার পেছনের সিটে যারা আছে, তারা ঠিক কি না, এই গাড়ির পেছনের গাড়িটায় কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না, এবং পেছনের গাড়িটার পেছনে কোনও সন্দেহজনক গাড়ির চিহ্ন আছে কি না। আমি নিশ্চিত এরা পুলিশ নয়, এরা আমার আততায়ী। আমার ফোন বন্ধ, দাদাকাঠ, আমি বোবা, গাড়ির নম্বর প্লেট নেই, লোকগুলোর গায়ে পুলিশের পোশাক নেই, হাসছে হা হা। ওদের কোনও প্রশ্ন করবো বা মোবাইলে কাউকে চুপচুপ করে এসএমএসে জানাবো অবস্থা, সে সাহস নেই, দাদার সঙ্গে কানে কানে কথা বলবো সেই শক্তিও নেই। গাড়ি এসে থামলো একটা নির্জন এলাকায় এক একলা বাড়িতে। সেই বাড়িতে একটি প্রাণী নেই, সেখানে আমাদের একটা ঘরে বসতে বলা হল। আমার রক্তচাপ, আমি নিশ্চিত, বেড়ে আকাশে উঠেছে। বাথরুমে ঢুকে ফিসফিস করে, যেন আততায়ীরা টের না পায়, ফোনে কথা বলি ভ’বাবুর ঘনিষ্ঠ এক লোকের সঙ্গে। ‘আমার মনে হচ্ছে আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। এরা নিশ্চয়ই মুসলিম মৌলবাদী, আমাকে খুন করতে এতদুর নিয়ে এসেছে, দিল্লি না গিয়ে আমাকে একটা জঙ্গলের মধ্যে, লোকালয় থেকে দূরে একটা বাড়িতে ঢুকিয়েছে। আমার ভয় হচ্ছে। চেনা লোক ভ’বাবুর কাছ থেকে খবর নিয়ে খানিক বাদে আমাকে জানালো, যে, ভ’বাবু মনে করছেন না আমাকে অপহরণ করা হয়েছে। আমার দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। এর চেয়ে স্বস্তির আর কী হতে পারে! জোরে শ্বাস নিই। কয়েকটা ঘণ্টা প্রায় শ্বাস বন্ধ করে পড়েছিলাম গাড়িতে। কয়েকটা ঘণ্টা আমার রক্তে, নাড়িতে আতংকের তুফান বয়ে গেছে। জোরে শ্বাস নিয়ে বিধ্বস্ত সন্ত্রস্ত মনটাকে আরাম দিতে চেষ্টা করি।
একজন পুলিশ এসে জানান, জয়পুর থেকে কয়েকজন অফিসার আসছেন, আমার সঙ্গে কথা বলবেন। অফিসারদের দেখে যে মৃত্যুভয় আমার ঘাড়ের ওপর শকুনের মতো বসে মাথার খুলি ঠুকরে ঠুকরে খুলে অবশ করে দিচ্ছিলো মস্তিষ্ক, পালায় লেজ গুটিয়ে। রাতের খাওয়ার সময় আমাকে বললেন ওঁরা, যে, এত সাংবাদিকের গাড়ি আমার গাড়ির পিছু নিয়েছিলো যে ওঁদের এড়াতে পুলিশ আমার গাড়ির প্লেট খুলে নিয়েছে, নিজেদের পোশাক বদলে ফেলেছে, যেন আমার গাড়ির পিছু নিতে কেউ না পারে, যেন আমার গাড়ি বলে গাড়িকে চিনতে না পারে। যে সময়ে আমার পৌঁছানোর কথা দিল্লিতে, সে সময় না পৌঁছোনো নিরাপত্তার কারণেই। সাংবাদিক থেকে, খবর থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকা।
ঘটনাটি এত কেন গোপন রাখা হচ্ছে, বুঝি না। এ কথা বললেই হতো আমাকে যে সাংবাদিকদের এড়ানোর জন্য এসব করা হচ্ছে। এত রহস্যের জট তো আমি খুলতে পারি না।
নিশ্চিন্তে দিল্লি চলি। সঙ্গে চারজন অফিসার। পথে যেতে যেতেই শুনি রাজস্থানের সরকার বিজেপি সরকার, মুখ্যমন্ত্রীর নাম বসুন্ধরা রাজে, মহিলা। এসবের কিছুই আমার জানা ছিল না। অফিসারদের মধ্যে একজন বাঙালি। যেন প্রাণ ফিরে পাই। তার সঙ্গেই গল্প করি বেশি।
দিল্লির রাজস্থান হাউজে গাড়ি থামলো। এত যে সতর্কতা ছিল সাংবাদিকদের কবলে না পড়ার, কই সে তো পড়তেই হল। ক্যামেরার ঝলসানো আলোর মধ্য দিয়ে আমাকে গাড়ি থেকে দ্রুত নামিয়ে দোতলায় ওঠানো হল। একটা সুইট দেওয়া হল বিশ্রাম নিতে। আজ রাতটা এখানে কাটালে কাল সকালে আমাকে কোনও এক নিরাপদ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। এ কথা আমাকে ভ’বাবু ফোনে বললেন। এও বললেন, আমার জন্য কেউ একজন কাপড় চোপড় কিনে নিয়ে আসছে।
ত–কাপড় কেন?
ভ–কাপড় তো লাগবে। কিছু কি এনেছেন সঙ্গে?
ত–না। শুধু ল্যাপটপ।
ভ–কাপড়চোপড়, আর যা যা দরকার, সেসব দেওয়া হবে আপনাকে। অফিসাররা আপনার গছে পৌঁছে যাবে। ওরাই আপনার দেখাশোনা করবে।
ত–আমি তো কলকাতায় ফিরবো। আমার কাপড়ের দরকার নেই। কালই তো ফিরে যেতে পারি। যেটা পরে আছি, সেটা পরে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবো, কোনও অসুবিধে হবে না। এক রাতের জন্য কাপড় চোপড়ের দরকার নেই।
ভ–না। এখন কলকাতায় ফেরা যাবে না। আপনাকে অন্য একটা বাড়িতে কাল সিফট করা হবে। সেই বাড়ির ব্যবস্থা করছি আমরা।
ত–বাড়ি?
ভ–হাঁ, সেই হাউজ।
ত–কিন্তু..
ভ–আপনি থাকুন। খাওয়া দাওয়া ওখানে ভালোই দেবে আশা করি। কোনও প্রবলেম হবে না। কিছুর দরকার হলে আমাকে ফোন করবেন।
খাওয়ার আয়োজন ভালো। একসঙ্গে আমার জন্য বরাদ্দ সুইটের বৈঠকঘরে বসেই সবাই খেলেন।
পরদিন সকালে কেন্দ্রর অফিসার এলেন ক’জন। বেশি বয়সী, অল্প বয়সী। ওঁরা বসেই রইলেন। লক্ষ্য করি জয়পুরের অফিসাররা কেন্দ্রর অফিসারদের ঠিক পছন্দ করছেন না, একটু পর পর কিছু না কিছু নিয়ে তর্ক শুরু করছেন। দাদা টেলিভিশন নিয়ে ব্যস্ত। টেলিভিশনে, বিশেষ করে কলকাতার চ্যানেলগুলোয় আমার খবর দেখিয়ে যাচ্ছে। আমি
কোথায়, কিভাবে, কেন ইত্যাদি। আমার সঙ্গে কারও যোগাযোগ করার উপায় নেই। ভ’বাবুর পাঠানো অফিসাররা বলে দিয়েছেন, কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে যেন কথা না বলি। বললেন, খুব বিপদ হবে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বললে। এদিকে জয়পুরের অফিসাররা আলাদা করে আমাকে বলছেন, যেন কথা বলি, খুব বাছাই করে হলেও। বাইরে প্রচুর সাংবাদিক ভিড় করে আছে। চব্বিশ ঘণ্টা ওরা বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত কয়েকজনের সঙ্গে যেন কথা বলি। আমি ঠিক বুঝে পাই না কী করবো। দু’দিক থেকে দু’রকম চাপ। মাঝখানে আমি বিমূঢ়। তবে কেন্দ্রর অফিসাররা যা বলছেন তাই আমি মেনে নিই। ভ’বাবু ওঁদের পাঠিয়েছেন। ভ’বাবু আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, নিশ্চয়ই যা বলছেন আমার ভালোর জন্যই বলছেন।
জয়পুরের অফিসাররা বললেন কাল আমাকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হলে ওঁরা জয়পুরে ফিরে যাবেন। কিন্তু কাল আসে। দিল্লির অফিসাররা আসেন। গলার স্বর যথাসম্ভব নরম করে জানান, আরও একদিন সময় লাগবে নিরাপদ বাড়ি খুঁজতে। অতএব আমি রয়ে যাই। সাংবাদিকরাও দিন রাত রয়ে যায়। বাড়ি ঘিরে থাকা পুলিশও রয়ে যায়। দাদা টিভিতে ব্যস্ত। আমাকে দেখায় খানিক পর পর, আমি কোথায়, কী করে আমাকে তাড়ানো হয়েছে কলকাতা থেকে, এসব নিয়ে আলোচনা চলে। স্টার আনন্দ থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে লোক, ময়মনসিংহে আমার আত্মীয় স্বজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। নিজের বউ বাচ্চার কথা শুনতে শুনতে খুশিতে দাদার চোখে জল।
কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে যেন কথা না বলি, উপদেশ দিতেই থাকেন দিল্লির অফিসাররা। সাংবাদিকদের সঙ্গে যেন কথা বলি, উপদেশ দিতেই থাকেন জয়পুরের অফিসাররা। এর মধ্যে দিল্লির অফিসারদের অনুপস্থিতি এবং আমার অন্যমনস্কতার সুযোগে এক ফটোগ্রাফার আমার পটাপট বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলে ঘরে ঢুকে। কে এই লোক প্রশ্ন করতেই জয়পুর বললেন, এই হাউজের নিজস্ব ফটোগ্রাফার। এক ফটোগ্রাফারকে রাজস্থান হাউজের নিজস্ব ফটোগ্রাফার বলে আমার ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন জয়পুর। পরে ওই ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হতে দেখেছি। গভীর রাতে হঠাৎ আমাকে বলা নেই কওয়া নেই, বরখা দত্তকে ঢোকালেন জয়পুর। যেখানে সাংবাদিকদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও কারও সঙ্গে দেখা করছি না, সবাইকে এক বাক্যে ফিরিয়ে দিচ্ছি, চেনা অচেনা কারও ফোন ধরছি না, কারও আবেদনে অনুরোধে রাজি হচ্ছি না, তখন ঘরের ভেতর ক্যামেরা আর একজন সাংবাদিক। এভাবে একজনকে খাতির করবো কেন! জয়পুরের অফিসাররা আকাশ থেকে পড়েন, তুমি বরখাকে চেনোনা, ও ভারতের সবচেয়ে নামকরা সাংবাদিক। না, আমি বরখাকে চিনি না, আমি তো করন থাপরকেও চিনতাম না। সাক্ষাৎকার চাইলে মুখের ওপর না বলে দিয়েছিলাম। করন থাপরকেই কলকাতা যেতে হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ও বুঝিনি তিনি নামকরা কোনোও লোক। আরও পরে লোকের মুখে করন থাপরের কথা শুনে বা সিএনএন-এ ডেভিলস এডভোকেট দেখে, হিন্দুস্থান টাইমসে কলাম পড়ে বুঝেছি উনি নামী লোক। বরখা সাক্ষাৎকার চাইছেন, নানাভাবে আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। আমার কথা বলা উচিত। আমি কথা বললে কী ঘটেছে তা লোকে জানতে পারবে, আমি জনতার সমর্থন পাবো। জয়পুর জোর করছেন। অপ্রস্তুত অবস্থা আমার। ভ’বাবুর কথা অমান্য করা আমার উচিত নয়। অনেক জোরাজুরির পর কথা বলতে রাজি হলাম, তবে সাক্ষাৎকার নয়। শুধু একটা বিবৃতি, ‘আমি কলকাতায় ফিরতে চাই’, এর বেশি একটিও কথা নয়।
বিজেপির এক নেতা এসেছিলেন। তেমন কোনও কোনও কথা হয়নি। উনি কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেছেন। তবে মহাত্মা গান্ধির নাতনি তারা গান্ধি এসেছিলেন দেখা করতে, উপহার দিয়ে গেলেন নিজের হাতে বোনা একটি ব্যাগ, তাঁর সঙ্গেই গল্প করেছি। তারা গান্ধির সঙ্গে ওই আমার প্রথম আলাপ। বললেন, তিনি যোগাযোগ রাখবেন। তাঁর ভাই গোপালকৃষ্ণ গান্ধি তখন পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর। রাজভবনে একবার কবিতা পড়েছিলাম, মন দিয়ে বাংলা কবিতা শুনেছিলেন, প্রশংসা করেছিলেন খুব। একবার কথাও হয়েছিলো ফোনে, যখন কলকাতায় আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিচ্ছিল না পশ্চিমবঙ্গ সরকার। আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি শুনে উনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আমি যেন কেন্দ্রকে কোনওরকম দেরি না করে খবরটা জানাই। কেন্দ্র বলতে আমি যা বুঝি, তিনি ভ। এক ভ’র সঙ্গেই কালে ভদ্রে আমার কথা হয়, যেটুকুই হয়। এক ভ’কেই আমি বলতে পারি কী ঘটছে। ভ’কে সম্ভবত বলেছিলাম। উনি ব্যাপারটা দেখবেন’ বলেছিলেন।
প্রথম দিনই মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে বলেছিলেন, ”যতদিন দরকার হয়, থাকুন রাজস্থান হাউজে’, অফিসাররাও বলেছিলেন। এই তাঁরাই তিন দিন পর বললেন, আজই আপনাকে বেরিয়ে যেতে হবে রাজস্থান হাউজ থেকে। হ্যাঁ আজই। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, আজই। ভ’বাবুর লোকদের আমি ফোনে জানিয়ে দিলাম, আমাকে বেরিয়ে যেতে বলছে, আজই’। আমি হয়তো দুনিয়ার অনেক কিছু বুঝি, শুধু রাজনীতির মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝি না। যে অফিসাররা এত আন্তরিক ছিলেন, এত শ্রদ্ধাভরে কথা বলতেন, তাঁরাই কী ভীষণ ক্রুদ্ধ এখন, তাঁদের ভাষাই কী ভীষণ কঠিন এখন, তাঁদের আচরণে স্পষ্ট অশ্রদ্ধা এখন। আমি এটুকু বুঝেছিলাম, তারা আমার ওপর সন্তুষ্ট নন, যেহেতু আমি দিল্লির অফিসারদের উপদেশ রেখেছিলাম, কোনও সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিইনি। জয়পুরীদের যুক্তি ছিল, তোমার এখন খারাপ সময়, মিডিয়া তোমার পক্ষে, তুমি মিডিয়াকে অ্যাভোয়েড করছো, মিডিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলছো, তুমি বুঝতে পারছে না মিডিয়াতে যতক্ষণ তুমি আছো, মিডিয়া যতক্ষণ তোমার পাশে আছে, ততক্ষণ কোনও সরকার, কোনও পলিটিক্যাল পার্টি তোমাকে কিছু করতে পারবে না। তুমি মিডিয়াতে নেই, যে কোনও খেলাই তোমাকে নিয়ে খেলতে পারবে যে কেউ। সিপিএম তোমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কীভাবে বের করেছে, জানাও সবাইকে। কেউ কিছু যদি না জানে, তা হলে মানুষের সাপোর্ট তুমি কী করে পাবে? এ দেশের মানুষ তোমাকে ভালোবাসে। তুমি এদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকবে কেন? মিডিয়াকে ব্যবহার করো মানুষের কাছে পৌঁছোননার জন্য। সারাদিন জয়পুর বলেই চলেছেন, ‘তুমি ভুল করছো, বেছে বেছে হাতে গোনা দুতিনটে মিডিয়ার সঙ্গে তোমার কথা বলা উচিত। এত বলার পরও আমি রাজি হইনি। শীলা রেড্ডির সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছিলাম, সাক্ষাৎকার দিতে নয়, সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে। আউটলুকের সাংবাদিক শীলা। আমাকে দিয়ে কয়েকটি লেখা লিখিয়েছিলেন আউটলুকের জন্য। শীলা রেডিও বলেছিলেন, যতক্ষণ মিডিয়া আছে সঙ্গে, ততক্ষণ সরকার আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না।
কিন্তু সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হইনি বলে একটি রাজ্যের একটি সরকারি বাড়ি থেকে অতিথি হিসেবে বরণ করে নিয়েও আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হবে, এ আমার বিশ্বাস হয় না। হয়তো অন্য কোনও কারণ আছে। সে কারণ আমার কাছে চিরকাল অজানাই থেকে যাবে।
রাত বিরেতে পেছনের দরজা দিয়ে বের করা হল আমাকে। বের করার আগে দিল্লির অফিসাররা এক অফিসারকে তসলিমা সাজিয়ে বোরখা পরিয়ে রাজস্থান হাউজ থেকে বের করলো, গাড়িতে ওঠালো। সেই গাড়ির পেছনে যখন সাংবাদিকদের দল ছুটলো, সন্তর্পণে সত্যিকার আমাকে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে সোজা ক্যান্টনমেন্ট। ওখানে দুদিন রেখে আমাকে আরেক ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হল। ঠিকানা জানি না। আমার অজ্ঞাতবাস শুরু হল এখানেই। অনেক কিছুই দেওয়া হল আমাকে। মোবাইল। ইন্টারনেট। কাপড় চোপড়। সাবান শ্যাম্পু। যা খেতে চাই, সব। বিছানা, টেবিল চেয়ার, সোফা, টিভি আর আমাকে সঙ্গ দিতে, বা পাহারা দিতে, বা চোখে চোখে রাখতে দু’জন করে সরকারি অফিসার। সব আছে, একটি জিনিসই নেই অজ্ঞাতবাসে, কোথাও যাবার, ঘর থেকে বেরোবার বা কারও সঙ্গে দেখা করার অধিকার বা স্বাধীনতা।
অফিসাররা মাঝে মাঝেই বলেন, স্বাধীনতাহীন বেঁচে থাকাটা ভয়ংকর।
আমি চুপ হয়ে শুনি। ওঁরা আমার মুখে অপলক তাকিয়ে লক্ষ্য করতে থাকেন, ত্বকের কোন অঞ্চলে ভাঁজ পড়ছে, ক’টা শিরা দপদপ করছে, ক’টা স্নায়ু নড়ছে, পেশিগুলোর কী হাল।
দাদা অস্থির হয়ে পড়ে দেশে ফেরার জন্য। কিছুতেই তাকে আর রাখার উপায় নেই। বোনকে এই অবস্থায় ফেলে কেন যেতে চাইছো, তোমাদের কী কোনও মায়া নেই, কখন কী হয় কে জানে, যদি মরে যাই, এসব কথা বা আমার চোখের জল কিছুই দাদাকে রুখতে পারে না। দাদাও কি মনে মনে ফেয়ারওয়েল জানায় আমাকে! পরম আনন্দে কলকাতা হয়ে ঢাকায় ফিরে যায় দাদা। মুক্তি পায়। আমি একা। আমার সংগ্রাম চিরকালই আমার একার।