০৩. গৃহবন্দি

০৩. গৃহবন্দি

ইসলাম সম্পর্কে একটি শব্দ উচ্চারণ না করেও হায়দারাবাদে আমাকে মৌলবাদীদের আচমকা আক্রমণের রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে। আমাকে আক্রমণের পিছনে, যা শুনলাম, ছিল এলাকায় জনপ্রিয় হওয়ার বাসনা। হামলা চালিয়েছিল হায়দারাবাদের মজলিস ইত্তেহাদুল মুসলিমিন নামের এক রাজনৈতিক দল। অন্ধ্র প্রদেশের বিধানসভায় এই দলের এক বড় নেতা বলেছেন, ‘ধর্মদ্রোহী কথাবার্তা যারা বলে, তাদের কোতল করাই উচিত।‘ প্রেসক্লাবে গতকালের হামলার পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে তাঁর বক্তব্য, আমাদের বিধায়করা যা করেছেন, তার জন্য মুসলিমরা গর্বিত। তাঁদের সাধুবাদ পাওয়া উচিত। মোহম্মদের প্রতি কোনও অসম্মান আমরা বরদাস্ত করবো না।

অন্য একটি ইসলামি গোষ্ঠী উঠে এসেছে। মজলিস বাঁচাও তেহেরিক। এই গোষ্ঠী বলছে, আমাকে নাকি মেরে ফেলারই পরিকল্পনা করা হয়েছিল, এমআইএম (মজলিস ইত্তেহাদুল মুসলিমিন) বরং আমাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এমআইএমের তিন বিধায়ককে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, জামিনে ওরা ছাড়াও পেয়ে গেছে। দলের নেতা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নির্ভুল উচ্চারণে নির্মেদ ভাষায় ঘোষণা করে দিয়েছেন, হায়দারাবাদে ফের যদি যাই কখনও, আমাকে মেরে ফেলা হবে। হ্যাঁ, আমাকে মেরে ফেলবেন ওঁরা। কী কারণ এসবের? এই প্রশ্নের উত্তর চারদিক থেকে যা পাই তা হল, পুরসভা নির্বাচনের আগে ইসলামি গোষ্ঠীগুলো নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিতে চাইছে। আমাকে যারা আক্রমণ করবে, আঘাত করবে, তারা ইসলামকে বাঁচাবে। ইসলামকে যারা বাঁচাতে পারবে, তাদেরই মুসলমানরা চোখ বুজে সমর্থন করবে, ভোট দেবে। তসলিমা নামের এক মেয়ে ইসলামকে ধ্বংস করে ফেলছে, সুতরাং তসলিমার হাত থেকেইসলামকে বাঁচাতে হলে ওকে মেরে ফেলতে হবে, ওকে মারলে এপারে ফতোয়ার অগাধ টাকা পাওয়া যাবে, ওপারে বেহেস্তলাভ হবে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে আজ মুসলিম মৌলবাদীরা ঠিক এভাবেই দরিদ্র অশিক্ষিত অজ্ঞান মুসলমানদের উস্কানি দিচ্ছে এবং তাদের ভোটও ছলে বলে কৌশলে বাগিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও পাকা করছে। দেশের প্রায় পঁচিশ ভাগ লোক মুসলমান, এবং মৌলবাদীরা এই বিশাল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। কোনো সুসভ্য, সুশিক্ষিত সেকুলার, যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক লোককে এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ভাবা হয় না। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে!

সংসদে আমার প্রসঙ্গ ওঠে, ঘটনার নিন্দা করা হয়। টিভিতে আলোচনার আসর বসে। বাক স্বাধীনতা নিয়ে তর্ক তুঙ্গে ওঠে। হায়দারাবাদের মৌলবাদীরাও সেই আসরে বসে রীতিমত বাক স্বাধীনতা নিয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করে। আমি ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, মোহাম্মদকে অপমান করেছি, মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি, সুতরাং আমাকে মারা হয়েছে, মারটাকম হয়েছে, আরোমারা উচিত ছিল। কেবলবে, যে, সেদিনের আমার ভাষণে ইসলাম শব্দটিই ছিল না! ওদের মূল বক্তব্য, আমাকে ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। আমি বিদেশি, আমার কোনো অধিকার নেই এ দেশের মুসলমানের মনে আঘাত দেওয়ার। মনে মনে বলি, ‘বিদেশিদের অধিকার নেই, তবে কি তোমাদের মনে আঘাত দেওয়ার অধিকার দেশিদের আছে?’ সোজা কথা বললেই তো হয় যে ‘জগতের কারও অধিকার নেই মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার’! বললেই তো হয়, যে, ‘আমরা বাক স্বাধীনতায়, মত প্রকাশের অধিকারে এক ফোঁটাও বিশ্বাস করি না!’

জীবনে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অনেক যন্ত্রণা সয়েছি। কিন্তু মাঝে মাঝে যন্ত্রণার ওপর পরশ বুলিয়ে যায় কারও কিছু কথা। সকালবেলাতেই আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়টি পড়ে মন ভালো হয়ে যায়।

‘স্বাধীনতার হীরকজয়ন্তি পূর্তির অব্যবহিত আগে তসলিমা নাসরিনের উপর ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনা এ দেশের সাংস্কৃতিক অশক্ত, দুর্বল অবয়বটি আবার চিনাইয়া দিল। হায়দরাবাদের প্রেস ক্লাবে এই সুখ্যাত ও বিতর্কিত লেখকের উপর শারীরিক-মানসিক নিগ্রহের যে প্রয়াস দেখা গেল, তাহা এক কথায়, বর্বরতা। এমন একটি ঘটনার নেতৃত্ব দিলেন তিন বিধায়ক, ইহা প্রমাণ করে যে এ দেশের সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতা কোনও প্রান্তিক বা বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, মূলস্রোতের রাজনীতির উপর-পরতেও তাহা যথেষ্ট দৃশ্যমান। এবং এই অসহিষ্ণুতার প্রকাশ যথেষ্ট পরিকল্পিত ও সংগঠিত। তসলিমা নাসরিন তাঁহার বিতর্ক ফুলিঙ্গ-বিধৃত রচনার জন্য স্বদেশ এবং অন্যান্য দেশে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণের মুখে পড়িয়াছেন, কিন্তু দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ, বহু-সংস্কৃতিবাদী ভারতবর্ষে তাঁহার এই অভিজ্ঞতার স্বাদ নিশ্চয় অনেকাংশে আলাদা। তিনিও নিশ্চয় এখন এ দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন যাতায়াতের আগে পুনর্বিবেচনা করিবেন, হয়তো এখন হইতে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ঘেরাটোপে আশ্রয় লইয়া গণতন্ত্রের আওতা হইতে খানিক দূরত্বে বসবাস করিবেন। দুর্ভাগ্য এই আত্মগর্বিত দেশেরও –-ব্যক্তিগত মতামত ও সামাজিক সহিষ্ণুতার ভিতরে সীমারেখাঁটি কী ও কেমন, ষাট বৎসরের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র যাহাকে শিখাইয়া উঠিতে পারে নাই।

সমস্যার মূলটি এইখানেই। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার তীব্র সমালোচনা সর্বত্র, এমনকী রাজনৈতিক দলগুলিও প্রতিবাদ জানাইয়াছে।

ব্যক্তিগত মতামত ও সামাজিক সহিষ্ণুতার এই প্রথম পাঠ বিভেদরেখার সকল দিকের মানুষকেই গ্রহণ করিতে হইবে, গত্যন্তর নাই। আদিমতা হইতে আধুনিকতার যাত্রাপথে একটি বিষয় স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিশ্বাস ও মতামতকে শ্রদ্ধা করা না গেলেও সহ্য করিতেই হইবে, ইহা সভ্যতার মৌলিক ভিত্তি। অর্থাৎ ইহা কেবল বাঞ্ছনীয় নয়, ইহা একেবারে আবশ্যিকএর পর্যায়ে। প্রয়োজনে অধৈর্য ও অসহিষ্ণুতার অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন। দেব দেবীর প্রেমলীলাঅঙ্কন করিয়াছেন বলিয়াশিল্পীকে যাহারা। লাঞ্ছনা করেন, কিংবা ধর্মপুরুষের অবমাননা রচনা হইয়াছে বলিয়া যাহারা লেখকের দিকে আক্রমণার্থে ধাবিত হন, তাহাদের সকলেরই কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। সমাজ যদি নিজে হইতে সভ্যতা ও সুশীলতার সংস্কৃতি গড়িয়া তুলিতে না পারে, পরস্পর-সহনের বোধটিতে পৌঁছাইতে না পারে, তবে রাষ্ট্রেরই আগাইয়া আসিতে হইবে, উপায় কী!

প্রতিবাদ এমন অনেক হয়েছে। না, শাস্তি ওই হায়দারাবাদি মৌলবাদীদের কারওরই হয়নি। গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেছে, থানায় কিছুক্ষণ রেখে, সম্ভবত চা বিস্কুট খাইয়ে, ছেড়ে দিয়েছে। সরকারি দলের জোটশক্তি ওরা। সুতরাং সত্যিকার শাস্তি, অনেকে বলছে, ওদের কেউ দেবে না। এমনিতে পার পেয়ে যাবে।

মানুষ কেন এত মূর্খ হয়, কেন এত নিষ্ঠুর হয়, আমি বুঝতে পারি না। ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মুখতা আর নিষ্ঠুরতার সম্পর্ক খুব গভীর। নিষ্ঠুরতা খুব সংক্রামক। হায়দারাবাদে আমাকে আক্রমণ করা হলো, কিন্তু যে শহরে থাকি সে শহরে কোনও জুৎসই আক্রমণ এখনও হলো না, এ নিয়ে কলকাতার মৌলবাদীরা দুঃখ প্রকাশ করতে শুরু করলো। দুঃখ ঝেড়ে একদিন সোজা নেমে পড়লো আমার মাথার দাম ঘোষণা করতে বা কুশপুতুল পোড়াতে। মাঠে নামানো হল মাদ্রাসার ছাত্রদের, যারা জানেই না আমার নাম,বা কিছু। মাদ্রাসার এক পাল ছেলে আমার কুশপুতুল পোড়াচ্ছে, অথচ কোনওদিন পড়েনি আমার একটিও বই। কেন পোড়াচ্ছে, কারণ তাদের মৌলবাদী নেতা বলেছে, আমি নাকি ইসলামের বারোটা বাজিয়েছি, ইসলামকে প্রায় ধ্বংসই করে ফেলেছি, এখন তাদের সবার দায়িত্ব ইসলামের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটুকু বাঁচানো। মাদ্রাসা-মসজিদে এভাবেই আমার বিরুদ্ধে মগজ ধোলাই চলে। আমার সম্পর্কে না হয় তারা না জানলো, ইসলামকে পুঁজি করে মিটিং মিছিলের আয়োজন করতে গেলে ইসলাম সম্পর্কে তো সামান্য কিছু জানতে হয়। ধর্মতলার জনসভায় হায়দারাবাদ থেকে মৌলবাদীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে। সবাই মিলে মহাসমারোহে আমার মাথার দাম ঘোষণা করলো। দামটা কত জানতে চাইলো মৌলবাদী দর্শক শ্রোতা। মঞ্চ থেকে একজন নেতা বললো, পাঁচ লাখ। হায়দারাবাদের বড় নেতা সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ লাখকে শুধরে দিয়ে বললো ‘আনলিমিটেড। মঞ্চের বাকিরা চেঁচিয়ে বললো। ‘আনলিমিটেড। শত শত টুপি মাথার লোক উল্লাসে উচ্ছাসে ফতোয়াকে স্বাগত জানালো। জনসভায় পুলিশের বড়কর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সামনেই আমার মাথার দাম ঘোষণা হল। সব মৌলবাদীই বুক ফুলিয়ে ফতোয়া দিল, বুক ফুলিয়ে পুলিশের নাকের ডগায় হেঁটেও গেল। এই অবৈধ ফতোয়া জারিতে কারো বিন্দুমাত্র কোনো অসুবিধে হলো না। কী চমৎকার জীবনই না এরা যাপন করে ভারতবর্ষে।

হায়দারাবাদ থেকে কলকাতায় ফেরার পর দুটো ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমার জন্য। দরজার কাছে বেশ কয়েকজন নতুন পুলিশ বসেছে। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে পুলিশের কাছে নাম ঠিকানা লিখে ঢুকতে হয় ভেতরে। দুনম্বর, আমাকে বাড়ি থেকে কোথাও বেরোতে দেওয়া হয় না। যেখানেই যেতে চাই, পুলিশ বলে দেয়, বড়বাবুর অনুমতি নিতে হবে। অনুমতির জন্য ওরা ছোটবাবুকে ফোন করে। ছোটবাবু করে বড়বাবুকে। অনুমতি মেলে না। বেশ কিছুদিন এরকম হবার পর আমি বুঝে নিলাম, আমাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। বাড়িতে বন্ধুরা আসছে বটে, কিন্তু কোথাও আমার বেরোনো নিষেধ। বাজারে যাবো, না যেতে দেওয়া হবে না। বন্ধুর বাড়ি, না। অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে, না কোথাও না। এরকম গৃহবন্দি জীবন আগে কাটাইনি। ভেবেছিলাম, কিছুদিন পর বোধহয় অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু তার কোনও লক্ষণ দেখি না। এদিকে তাইওয়ান থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি তাইওয়ান যাবো। সুতরাং ট্রাভেল এজেন্সিতে আমাকে যেতে হবে। বড়বাবু এবার যেতে দেবেন। অবশ্য তাইপেই-এ কবিতা উৎসবে যাওয়ার জন্য কোনো ট্রাভেল এজেন্সিতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার। ইলেকট্রনিক টিকিট ইমেইল করে দিলেই হয়। শুধু শহরটা দেখার জন্য, বাইরের হাওয়াটা নেওয়ার জন্য ফুসফুসে, স্বাধীনতার স্বাদটা নেওয়ার জন্য অন্তরে, আমার বের হতে চাওয়া। স্বাধীনতা কাকে বলে আমি জানি। স্বাধীনতার রূপ রস গন্ধ আমি চিনি। স্বাধীনতা ফিরে পেতে আমার প্রতি বিন্দু রক্ত টগবগ করে, ফুঁসে ওঠে, ফুলে ওঠে। সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে দেখুক কেউ, কী হয়। ঘরের বাইরে কোথাও যেতে না দেওয়া, শুধু ট্রাভেল এজেন্সিতে যেতে দেওয়ার অর্থ আমি টের পাই, শুধু দেশের বাইরে বেরোনোর অনুমতি পেতে পারি, দেশের ভেতরে আমার চলাফেরা নিষিদ্ধ।

বাড়ির সামনে বসা পুলিশদের সকাল বিকেল চা দেওয়া হচ্ছে। ওদের জন্য বিস্কুট আনাচ্ছি। মিঠাই থেকে মিষ্টি আনাচ্ছি, দই আনাচ্ছি। চিড়ে ভাজা, মুড়ি ভাজা। নিজে নুডলস বেঁধে দিচ্ছি। দিনে কয়েকবার চা। কয়েকবার আমপোড়া শরবত, অরেঞ্জ স্কোয়াশ। নিচে যারা বসেছে বাইরের গেইটের কাছে, ওপরে যারা ফ্ল্যাটের দরজার কাছে, কেউ যেন শুকনো মুখে বসে না থাকে, সেদিকে কড়া নজর আমার। অনেকগুলো শারদীয়া, ম্যাগাজিন, বই দেওয়া আছে, যার পড়তে ইচ্ছে করে পড়বে। ফ্যান দুদুটো কিনেছি। যেন হাওয়া খেতে পারে। চেয়ার তো প্রথম দিনই বেশ অনেকগুলো কিনে দেওয়া হয়েছিল। সবাইকেই অতিথির মতোই আপ্যায়ন করি। মাঝে মাঝে পুলিশেরা এসে বসে ঘরে। টেলিভিশনে খেলা দেখে। একজন তো সোফায় লম্বা হয়ে ঘুমোয় দুপুরের খাবারের পর। পুলিশের মধ্যে এমনিতেই একটা কাড়াকাড়ি চুলোচুলি আছে আমার ডিউটি করার। কেউ বদলি হলো তো রীতিমত কেঁদে কেটে বুক ভাসাবে। আমার ওপর চিঠি লেখার চাপ আসে, ”দিদি, লিখে দিন আমি খুব ভালো দেহরক্ষী, আমাকে ছাড়া আপনার অসুবিধে হচ্ছে, আমাকে ছাড়া চলবে না।

শুধু বোঝার জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়েছে কি না, দেড় বা দু’সপ্তাহ পর পর পুলিশকে বলি, যে, বাইরে যেতে চাই। শংকরকেই বলি এক মন কেমন করা বিকেলে, আজ বাইরে যাবো, শংকর বললো, –কোথায় যাবেন? এরকম কখনও আগে আমাকে জিজ্ঞেস করা হতো না। আমিই যখন খুশি বেরিয়ে গাড়িতে উঠে তবে শংকর বা তপনকে বলতাম কোথায় যেতে চাই। দিন হঠাৎ করে পাল্টে গেছে। একটু চমকাই, কিন্তু সামলে নিই। শান্ত কণ্ঠে বলি, –দীপংকরদা’র বাড়ি যাবো, বেহালায়। শংকর আর তপন রীতিমত আত্মীয়র মতোই হয়ে গিয়েছিল। দু’জনের বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেছে, আদর করে খাইয়েছে। আমার বাড়িকেও নিজের বাড়ির মতোই অনেকটা মনে করতো। হঠাৎ ওলোট পালোট হয়ে গেছে সবকিছু, সব সম্পর্ক, সব চলাফেরা, সব নিয়ম, সব বিশ্বাস। একটা বড় প্রশ্ন বোধক চিহ্ন ঝুলে থাকে মাথার ওপর সারাক্ষণ। চিহ্নটি দিন দিন অতিকায় হচ্ছে। শংকর নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অপেক্ষা করতে থাকি আমি। পনেরো মিনিট বা আধঘণ্টা পর শংকর এসে রবোটের গলায় বলে, –ওখানে যাওয়ার অনুমতি নেই।

–কেন নেই?

–সে তো জানি না।

–আপনার তো জানা উচিত। কেন আমি আজ বেহালায় যাওয়ার অনুমতি পাবো?

–আমি অফিসারকে জানালাম। অফিসার বড়বাবুকে জানালেন। বড়বাবু কিছুক্ষণ পর ফোনে জানিয়ে দিলেন, যাওয়া যাবে না।

–কেন? কেন যাওয়া যাবে না?

–সে সম্পর্কে কিছু বলেননি।

–কেন বলেননি? জিজ্ঞেস করুন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, কেন যাওয়া যাবে না, কী অসুবিধে।

শংকর ঘর থেকে বেরোয় তবে না মানুষের গলায়, না রবোটের গলায় আমাকে আর সে জানাতে আসে না আমার বেহালায় যাওয়ার অনুমতি না পাওয়ার কোনও কারণ।

এরপর আরেকদিন সল্টলেক যাবো, তৈরি হয়ে নিই। শিবনারায়ণ রায়ের বাড়ি আমাকে যেতেই হবে। উনি অসুস্থ।

বড়বাবুর আদেশ জানিয়ে দেওয়া হল আমাকে, –না, হচ্ছে না।

–না কেন?

–না, কারণ কলকাতা জুরিসডিকশনের বাইরে সল্টলেক।

–সারা বছর তো কত বারই সল্টলেক গেলাম, জুরিসডিকশনের প্রশ্ন তো ওঠেনি।

শংকর বা তপন চুপ। ওদের মুখেও ভয় আর একধরণের কী-হচ্ছে-কিছু-বুঝতে-না পারা থমথম করে।

অনেকদিন বিরাটি যাইনি। যাওয়া খুব জরুরি।

ওই একই উত্তর, বড়বাবু জানিয়ে দিয়েছেন, সম্ভব নয়।

এর কদিন পর আবারও আমার ইচ্ছের কথা জানাই, হাওড়া যাবো।

–না হবে না।

এরপর আরও কাছাকাছি কোথাও যাবো। জুরিসডিকশনের মধ্যে কোথাও যাবো। ভবানীপুর যাবো, যদুবাবুর বাজারে।

–সম্ভব নয়।

–এখন তো কলকাতা শহরের মধ্যেই, সম্ভব নয় কেন?

–সে সম্পর্কে কিছু জানায়নি আমাকে।

–কে বাজার করবে? না খেয়ে থাকবো?

–তা জানি না। শুধু জানি, যে, হবে না যাওয়া।

–এতকাল নিজে বাজার করেছি। এখন বাজারটাও করতে পারবো না!

–বড়বাবু বলে দিয়েছেন, সম্ভব নয়।

–কেন?

–কেন, তা বলেননি।

–সিদ্ধান্ত কি বড়বাবুর?

–হ্যাঁ।

আমার ধারণা হয়, সিদ্ধান্ত আরও ওপরের।

বাড়িতেই শুধু নয়, পরিবর্তন লক্ষ করি অন্যত্র। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বক্তৃতা করতে। প্রায় বছর হল চেষ্টা করছেন আমাকে রাজি করাতে। শেষ রাজি হয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় উচ্ছ্বসিত। কিন্তু হায়দারাবাদের ঘটনার পর আমাকে সংক্ষিপ্ত চিঠিতে ওঁরা জানিয়ে দিলেন, আমার অনুষ্ঠান বাতিল করতে ওঁরা বাধ্য হচ্ছেন। কেন বাতিল করেছেন, তা অবশ্য জানালেন না। জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। অনুষ্ঠান বাতিল করার পেছনের কারণ, ওঁরা নিশ্চিত যে, আমি বুঝবো। তবে একটা সত্য ওঁরা হয়তো জানেন না, যে, আমি মৌলবাদীদের আস্ফালন খুব ভালো বুঝি, ওদের চেঁচামেচির আসল কারণটাও আমার জানা, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক, বা সাহিত্য সংস্কৃতির লোক, বা সরকারের লোক বা রাজনীতির লোক –এঁদের ভয় বা কুঁকড়ে থাকাটা আমি ঠিক বুঝি না। অথবা বুঝি কিন্তু মানতে পারি না।

এক ফতোয়ায় জীবন অতিষ্ঠ। তার ওপর আরেক ফতোয়া জারি করে বসলেন জনপ্রিয় গায়ক কবীর সুমন, এককালের সুমন চট্টোপাধ্যায়। টিভিতে আমার ‘দ্বিখণ্ডিত বইটি খুলে মুহম্মদ সম্পর্কে কোথায় কী লিখেছি তা শুধু পড়ে শুনিয়ে শান্ত হননি সুমন, বইয়ের কোন পৃষ্ঠায় কী আছে, তাও বলে দিয়েছেন, এবং এও বলেছেন আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের জারি করা ফতোয়াকে তিনি সমর্থন করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর, সত্যি বলতে কী, অতিরিক্ত মুসলমান হয়েছেন তিনি। এমনিতে নব্য মুসলমানদের সম্পর্কে কথাই আছে যে পারলে মৌলবাদীদের চেয়েও দু’কাঠি বেশি মৌলবাদী। সত্যি কথা বলতে কী, মৌলবাদীদের অত ভয়ংকর ফতোয়াকেও আমি অত বেশি ভয়ংকর মনে করিনি, যত করেছি সুমনের ফতোয়াকে। বারবারই সুমন বলেছেন, তাঁর পয়গম্বর সম্পর্কে আমি জঘন্য কথা লিখেছি–ক্রুদ্ধ, ভয়ংকর সুমন, যে সুমন এতকাল নাস্তিক বলেই পরিচিত ছিলেন, গানও লিখেছেন ভগবানকে অপমান করে। আমার বিশ্বাস হয় না সুমন মুহম্মদকে পয়গম্বর মানেন, বা ইসলামে বিশ্বাস করেন। আগাগোড়াই ধর্মের রাজনীতি তাঁর। সে রাতে ভয়ে আমার বুক কেঁপেছে। সে রাতেই আমি প্রথম জানালা দরজাগুলো ভালো করে লাগানো হয়েছে কী না তা পরখ করে শুয়েছি। সে রাতে আমি সারারাত ঘুমোত পারিনি। সে রাতেই আমার মনে হয়েছে, মৌলবাদীরা আমাকে সত্যিকার ফতোয়া দেয়নি, দিয়েছেন সুমন। মৌলবাদীরা কোনোদিনই স্পষ্ট করে বলতে পারেনি ইসলাম সম্পর্কে ঠিক কী লিখেছি, প্রমাণ দেখাতে পারেনি আমি ইসলামের অবমাননা করেছি, কিন্তু সুমন আমার বই হাতে নিয়ে ক্যামেরার সামনে বসেছেন, পড়েছেন সেই সব লেখা, যুক্তি দিয়ে ধর্ম খণ্ডন করা। দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে বলেছেন, বিশ্বাস না হয় আপনারই পড়ুন, দেখুন কী লিখেছে। ক্যামেরা তখন ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইয়ের সেইসব পৃষ্ঠায়। যে কোনও জঙ্গি মুসলমান সে রাতে ভাবতে পারতো, ‘মরি তো মরবো, ওকে মেরে মরবো’। এই কাজটা কে করলো! না কোনও মৌলবাদী নয়, সাংস্কৃতিক জগতের নামি দামি প্রগতিশীল বলে খ্যাত এক শিল্পী। অবিশ্বাস্য লাগে সবকিছু। কেমন যেন স্বাসকষ্ট হতে থাকে। যেন সুস্থ স্নিগ্ধ খোলা হাওয়া নেই আর কোথাও। মৌলবাদীদের আক্রমণের পর যাদের আমার পাশে থাকার কথা, তাঁদেরই দেখি দূরে চলে যেতে, শুধু দুরেই চলে যান না, মৌলবাদীদের চেয়েও দ্বিগুণ আক্রমণ করে আমাকে স্থবির করে দেন। আমি একা হতে থাকি। ভীষণ একা। পায়ের তল থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। বুঝি। টের পাই। যাঁদের কাছে আমার লেখা, আমার আদর্শ, আমার নীতি মোটেও দোষের নয়, তাঁরাও আমার দোষ ধরতে থাকেন। যারা ধর্মের সমালোচনা করে অভ্যস্ত, তাঁরাও আমার ধর্ম নিয়ে কথা বলাকে সইতে পারেন না।

পায়ে আমার অদৃশ্য শেকল। চলতে গেলেই বাজে এই শেকল। শেকলই বলে দেয়, কোথায় এবং কতদূর যেতে পারি আমি। অন্যায় মেনে নেওয়ার মানুষ তো আমি নই। বিনা অপরাধে আমাকে বন্দি করা হবে কেন? আমার মনে আর শরীরে লক্ষ করি প্রতিবাদের বুদবুদ। অস্থির আমি কেবল ঘর-বারান্দা করি। এত প্রিয় ঘর, এটিকেই মনে হতে থাকে কারাগার। বন্ধুরা যারাই আসে, এই বন্দিত্বের কথা শোনে, চুক চুক করে দুঃখ করে চলে যায়। হয়তো কারওরই কিছু করার নেই। অথবা করার থাকলেও করা উচিত হবে কী না ঠিক বুঝে পায় না। একদিন হঠাৎই দেখতে চাই সরকারি নিষেধাজ্ঞা কত দূর গেছে, বা যেতে পারে। পুলিশদের জানিয়ে দিই, জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করবো। সঙ্গে সঙ্গে ওপরতলায় খবর চলে গেল। জ্যোতি বসুর বাড়ি যেতে চাইছি আমি। সত্যি বলতে কী, জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করা জরুরি ছিল না আমার। মনে হয়েছিল, উনিই হয়তো একমাত্র মানুষ এ শহরে, যার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমার পায়ের শেকল খুলে দেওয়া হবে। জ্যোতি বসু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীই শুধু নন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। শুরু থেকেই আছেন এই পার্টির সঙ্গে। সাতাত্তর থেকে দু’হাজার সাল, সবচেয়ে দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। জ্যোতি বসুকে ফোন করে দেখা করতে চাই’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজি হয়েছেন। মানুষটি অসাধারণ। একবারও ভাবলেন না, তাঁর পার্টির সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, আর এখন হায়দারাবাদে আমার ওপর হামলা হওয়ার পর কোথায় আমাকে পাশে দাঁড়াবে, তা নয়, আমাকে গৃহবন্দি করেছে, আমার সঙ্গে দেখা করাটা তার উচিত হবে না। একবারও জিজ্ঞেস করেননি, কী কারণে দেখা করতে চাই, কী কথা বলতে চাই বা এ জাতীয় কোনও প্রশ্ন।

বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এখন অনুমতি দেন কী না প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে, সেটিই দেখার বিষয়। আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। মুহূর্তে খবর চলে এলো, দেবেন দেখা করতে। হাসি ফুটলো শংকরের মুখে। পুলিশগুলো ভালোবাসে আমাকে। আমার বন্দিত্ব এদেরও পীড়া দেয়। ছোট সরকারি চাকুরে, সরকারি সিদ্ধান্ত বদল করার শক্তি এদের নেই। ফুলের বড় একটা তোড়া নিয়ে, মিঠাই থেকে অনেক দই আর রসগোল্লা নিয়ে রওনা হই মহান নেতার ইন্দিরা ভবনে। কী আনন্দ যে হয়! আনন্দ হয় মুক্তির স্বাদ পেয়েছি বলে। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছি বলে বারবারই বিপদের মুখে পড়ছি। বারবার পরাধীনতার শৃংখলে জড়িয়ে পড়ছি। সে আমি জানি। তারপরও আপোস করার কথা মুহূর্তের জন্যও মনে আনি না।

ইন্দিরা ভবনে পৌঁছোনোর পর জয়কৃষ্ণ, জ্যোতি বসুর দেখাশোনা করার ভার যার ওপর, জানিয়ে দিলেন, কোনও মিষ্টিই ঘরে আনার দরকার নেই, তিনি খাবেন না। কী কাণ্ড! খাবেন না, অতিথিদের তো খাওয়াতে পারেন! জয়কৃষ্ণের তীব্র সতর্কতার অথবা কঠিন আদেশের সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছে করেনি। ঘরে ঢুকে তাঁর জন্য অপেক্ষা করি। তিনি এসে মুখে সেই রহস্যের হাসি, হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন। উঠে দাঁড়িয়ে আমিও। খুব বেশি কারও সঙ্গে আজকাল দেখা করেন না। অসুস্থ। পরনে সবুজ একখানা লুঙ্গি আর সাদা ফতুয়া। তাঁর সঙ্গে আগে আরও দুবার আমার দেখা হয়েছে, এই ইন্দিরা ভবনেই। এত বড় একজন মানুষ, অথচ আমার সঙ্গে বসে কী সহজে কথা বলেন। কথা বলতে বলতে আমি ভুলে যেতে থাকি তার সঙ্গে বসে গল্প করার যোগ্য আমি নই। সম্ভবত রাজনীতির খুব বেশি কিছু আমি বুঝি না বলেই কোনওদিনই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ভালো কথা বলতে জানি না আমি।

খুব বড় মানুষদের সঙ্গে যেচে কোনোদিন পরিচিত হতে বা খাতির জমাতে যাই না। এ আমার স্বভাবের বাইরে। বড়রা যদি আমার ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহ দেখান, তাহলেই সশরীরে উপস্থিত থেকে বড়দের আগ্রহ যথাসম্ভব মেটাতে অথবাদূর করতে তেমন আপত্তি করি না। বড়দের কাছে আমার না যাওয়ার কারণ কিন্তু অহংকার নয়, নিতান্তই সংকোচ। বড়রা ব্যস্ত মানুষ, অযথা তাদের বিরক্ত না করে দুর থেকে তাদের সরবে নীরবে শ্রদ্ধা করে যাওয়াই স্বাস্থ্যসম্মত। কিন্তু আমারই তৈরি এই নিয়ম অনিচ্ছাসত্ত্বেও কখনো কখনো আমাকে ভাঙতে হয়েছে। ফ্রাঁসোয়া মিতেরোঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে, জ্যাক শিরাখের সঙ্গেও। লিওনেল জসপা তোমাকে ডেকেছেন, সিমোন ভেইল অপেক্ষা করছেন, গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে দেখা করবে এসো, অ্যালেন গিন্সবার্গ কথা বলবেন। বাধ্য হয়েছি দেখা করতে। বড়দের সঙ্গে সত্যি বলতে কী কখনো কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না আমার। ওঁদের সঙ্গে দেখা হয়, ওঁরা চমৎকার কথা বলেন, কেউ কেউ বেশ আদর যত্নও করেন। কিন্তু বিদেয়টা শেষ বিদেয়ই হয়। যোগাযোগে আলসেমি আছে বলে ও পথ মাড়াই না, আর বড়রা বড় বলে খুব স্বাভাবিক, যে, কোনো খোঁজ খবরও আর করেন না। জ্যোতি বসুর সঙ্গে বছর সাত আগে এভাবেই আমার দেখা হয়েছে। প্রথম দেখা। কারও কাছে কোনো আবদার করিনি, কোনো ইচ্ছে প্রকাশ করিনি দেখা করতে চাওয়ার, হঠাৎ শুনি তাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার দিন তারিখ সব ঠিক। ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন আমার এক শুভাকাঙ্খী, সম্ভবত তিনি আমাকে বড় জাতের কিছু বলে ধারণা করেছিলেন। জ্যোতি বসুর মতো বিশাল এক মানুষের সঙ্গে আমার মতো ক্ষুদ্র লেখক রাজনীতির মাথামুণ্ডু যে কিচ্ছু জানে না, কী কথা বলবে! নিজের মুখতা আর অজ্ঞতা নিয়ে আশংকায় কুঁকড়ে ছিলাম। আমি ক্ষুদ্র জেনেও আমার সঙ্গে দেখা করতে কোনো অনীহা ছিল না জ্যোতি বসুর। তিনি তো এলেনই, তাঁর স্ত্রীও এলেন, এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন আমাকে কতকাল চেনেন, যেন আমি তাঁদের কতকালের চেনা বা আত্মীয়। মানুষ খুব বড় হলে সম্ভবত অচেনা অজানা লোক আর নিজের মাঝখানে কোনো দেয়াল রাখেন না। এই প্রথম আমি কোনো বড় মানুষের কাছাকাছি এসে বোধ করলাম যে মানুষটির সঙ্গে আবার কখনও আমার দেখা হতে পারে। তাঁর সঙ্গে রাজনীতির সাদা কালো, মন্দ ভালোর গল্প করার আমার কোনো দরকার নেই। আমি শুধু তার শৈশব কৈশোরের গল্প, তার দুঃখ সুখের, আনন্দ বেদনার ছোট ছোট কথা কাহিনী শুনেই মুগ্ধ।

যখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করেছিলো, সিদ্ধান্তটি যদিও অগণতান্ত্রিক এবং বাক স্বাধীনতা বিরোধী, দলের সিদ্ধান্ত বলেই আশংকা করেছিলাম জ্যোতি বসুও বই নিষিদ্ধের পক্ষে। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে দলের একজনই, তিনি, বই নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। কখনও কারওর পায়ের ধুলো নিইনা আমি। জ্যোতি বসুরও নিইনি। যখনই দেখা হয়েছে, শ্রদ্ধা ভরে নমস্কার করেছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে চিরকালই আমি খুব আনাড়ি। জানি না তিনি বুঝতে পেরেছেন কি না তাঁর দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে হলেও মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে কথা বলে শুধু নিজেকেই মহান করেননি, আমরা যারা লড়াই করছি এই অধিকারের পক্ষে, আমাদের প্রচুর শক্তি আর সাহস জুগিয়েছেন। জ্যোতি বসু সম্পর্কে মন্দ কথা বলার লোকের অভাব নেই। উন্নাসিক ছিলেন? হয়তো ছিলেন। কিন্তু বই নিষিদ্ধের বিপক্ষে তাঁর বক্তব্য শুনে, তাঁকে উন্নাসিক তো নয়ই, বরং বড় বিচক্ষণ, বড় বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ বলে আমার মনে হয়েছে। অন্য কোনো কমিউনিস্ট নেতা, দলের সিদ্ধান্ত, সে সিদ্ধান্ত ভুল হলেও, আদর্শগত কারণে তা মানতে না পারলেও মুখ ফুটে কিছু বলেননি। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে কোনো দলে নাম লেখাতে হলে যদি নিজস্ব বোধবুদ্ধিবিবেক বিসর্জন দিয়ে তবে লেখাতে হয়। যদিও কমিউনিজমে ধর্ম মানা নেই, তারপরও ধর্মের সমালোচনা করেছি এই দোষে আমাকে দোষী করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্টরা আমার বই নিষিদ্ধ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতার চিতার ওপর ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিলেন। এই বিজয় মৌলবাদীদের এত উৎসাহ দিয়েছে যে প্রকাশ্যে তারা একের পর এক আমার মাথার দাম ঘোষণা করতে কোনো দ্বিধা করেনি, রাস্তায় আগুন জ্বালানোর সাহসও তাদের হয়েছে।

যে সময় পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট নেতাদের কেউই আমার সঙ্গে দেখা করেন না, আমি একটা ভয়ংকর নিষিদ্ধ নাম, আমাকে সমর্থন করা মানে, তাদের বদ্ধ বিশ্বাস, জেনেশুনে মুসলমানের ভোট হারানো সে সময় জ্যোতি বসু আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। কারও বিরুদ্ধে আমি কোনো অভিযোগ করতে যাইনি তাঁর কাছে। দুজন আমরা গল্প করছিলাম সেই আগের দিনের মতো। তিনি তাঁর দেশের বাড়ি, তাঁর পাড়া পড়শি, তাঁর শৈশব কৈশোরের কথা বলছিলেন। বলছিলেন দেশভাগ, ধর্মান্ধতা, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার কথা। আমার লেখালেখি আর এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা।

দিন যায়। যেতে থাকে। জ্যোতি বসু ছাড়া আর কারও সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি দেশের ভেতর। দেশের বাইরে যেতে দেওয়া হয়েছে। তাইপেই কবিতা উৎসব থেকে ফিরে আসি। প্যারিসে গিয়েও অনুষ্ঠান শেষে ফিরি। আমার ফিরে আসাটি যে কাঙ্ক্ষিত নয়, টের পাই। ফেরার সঙ্গে সঙ্গে, যে জীবন যাপন করছিলাম, সেই জীবন আবার যাপন করতে বাধ্য হই। নীরবে নিভৃতে গৃহবন্দি জীবন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, কতদিন, ঠিক কত মাস বা বছর আমার স্বাধীনতা আমি ফিরে পাবো না। কেউ নেই আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেবে। অনেকটা চোখ বুজে, মুখ বুজে, দাঁত কামড়ে পড়ে থাকি। পায়ে অদৃশ্য শেকল। যাঁরা শেকল পরিয়েছেন তাঁরা জানেন, আর যার পায়ে শেকল সে জানে, এ ছাড়া খুব বেশি মানুষের জানা সম্ভব হয় না শেকলের কাহিনী।

1 Comment
Collapse Comments

Chi!!tor moto nirlojjo meye Islam e jonmo nieche….kono vul koreni AIMIM

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *