হোটেল

হোটেল

বছরে অন্তত দু’বার টোকিও যেতে হয় দীপেশকে। ওখানেই কোম্পানির হেড কোয়ার্টার। ফলে বিগ বস আর হোমরা-চোমরাদের সঙ্গে মিটিংগুলো ওখানেই হয়। এইসব মিটিঙে মাঝেমধ্যেই তাঁকে থাকতে হয়। দায়িত্ববোধ, ক্লান্তিহীন হয়ে লেগে থাকতে পারা, সময়ানুবর্তিতা, নিজের কাজে দক্ষতা—দীপেশের মধ্যে এগুলো আছে প্রচুর পরিমাণে। এগুলোর জোরেই এত কম বয়সে এমন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এত উঁচুতে উঠে এসেছেন মধ্যচল্লিশের দীপেশ মালহোত্রা। এটা অনেকেরই ঈর্ষার বিষয়।

এর আগে প্রত্যেকবার এমন মিটিঙে আসার সুযোগ পেলেই দীপেশের একটা চাপা গর্ব হত। কিন্তু এবার তাঁর আসার ইচ্ছে হচ্ছিল না। শালিনী খুবই অবাধ্য হয়ে উঠেছে আজকাল। এত স্পষ্ট করে বারণ করা হয়েছে ওকে। তবু শালিনী সেই প্রতীক বলে ছেলেটার বাইকে চেপেই ঘুরে বেড়াচ্ছে— এমন খবরই পেয়েছেন দীপেশ। তিনি না থাকলে রোহিনী যে কতটা ওকে সামলে রাখতে পারবে, তাই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে ট্রিপ ক্যান্সেল করবেন ভেবেই সেদিন অফিসে এসেছিলেন। এসে দেখেন, স্বয়ং ওয়াটানাবি সানের মেসেজ এসেছে তাঁর জন্য। তারপর লন্ডন থেকে এল রজারের ফোন, সরাসরি তাঁর সেলফোনেই। দীপেশ বুঝলেন, এই মিটিংটা শুধু কোম্পানির জন্য নয়, তাঁর ক্যারিয়ারের জন্যও বড্ড গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপর আর ছুটি নেওয়া চলে না। দীপেশও নিতে পারেননি।

দু’মাস ধরে এক প্রাইভেট ডিটেকটিভকে লাগিয়ে রেখেছিলেন শালিনীর ওপর নজর রাখার জন্য। রজারের ফোন ছেড়েই দেখলেন, সেই কাণ্ডারকরের কাছ থেকে এর মধ্যেই তিনটে মেসেজ এসেছে। লাস্ট মেসেজটা পড়ে দীপেশের মাথাটা ফেটে পড়ার জোগাড় হল। শালিনী কলেজ কেটে লোনাভালা গেছে ওই ছোকরার সঙ্গে। এখন কোনো হোটেলের ডে-রুমে ঢুকেছে দু’জনে।

না, সহ্যের সীমা পার হয়ে গেছে এদের ধৃষ্টতা। মালহোত্রা পরিবার দরকারে যে কতখানি কঠিন হতে পারে সেটা এবার টের পাওয়ানো দরকার।

‘বড়েভাই’য়ের নাম্বারটা অনেকদিন ধরেই আছে তাঁর মোবাইলে। চার বছর আগে তাঁর অপদার্থ অকর্মণ্য দাদা রূপেশ মালহোত্রা আচমকা তিনতলার ব্যালকনি থেকে পড়ে গিয়ে মারা গেছিলেন। তার দিনদশেক আগে বড়েভাইয়ের সন্ধান পেয়েছিলেন দীপেশ। বাড়ির বড়ো ছেলে হিসেবে প্রাইম-লোকেশনের বাংলো ‘মালহোত্রা হাউজ’-এর মালিকানা মৃত্যুর আগে অবধি রূপেশের নামেই ছিল। সেটাই বদলানোর দরকার হয়ে পড়েছিল তখন।

তারপর থেকে এখনও অবধি বড়েভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার আর কোনো দরকার হয়নি। তবু, বছরে এক-দু’বার ফোন করে যোগাযোগটা রেখেছিলেন দীপেশ। এবার নম্বরটা ডায়াল করার পর প্রায় দশটা রিং হল। কলার ভেরিফিকেশন না করে ফোন ধরেন না বড়েভাই। তারপর কথাটা ভেসে এল, “নমস্তে মালহোত্রা সাব।”

“নমস্তে বড়েভাই। এক কাম হ্যায়, ছোটাসা।”

ছোট্ট করে দরকারি কথাগুলো বলে দেন দীপেশ। তিনি জানেন, বড়েভাইয়ের লোক এক ঘণ্টার মধ্যে ছেলেটার নাম, ছবি, ঠিকানা— সব ডিটেলস নিয়ে নেবে দাদার বাস-স্ট্যান্ড থেকে। তারপর তিন কি চার দিনের ওয়াস্তা।

সেক্রেটারি পুষ্পিতা ডেঙ্গি বাধিয়ে ছুটিতে। সোনালি বলে নতুন জয়েন করা এইচ.আর-এর মেয়েটি সামাল দিচ্ছিল। তাকে কিছু নির্দেশ দিয়েই দীপেশ চলে গেছিলেন কাণ্ডারকরের অফিসে। সেখান থেকে ছবি নিয়ে, বড়েভাইয়ের লোকটাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেছিলেন সেদিনের মতো। পরদিন আর তিনি অফিস যাননি। তার পরদিন রোহিনীকে মেয়ের ব্যাপারে পইপই করে সতর্ক করে, ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিয়েছিলেন দীপেশ। প্রতিবারের মত এবারও চৌহান গাড়ি নিয়ে পিক আপ করতে এসেছিল। ওর হাতেই সব দরকারি কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল সোনালি।

গাড়িতে বসে টিকিট দেখে মাথা গরম হয়েছিল আবার। চিরকাল তিনি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স-এ যাতায়াত করেন। সোনালি সেটা জানত না, তাই ক্যাথে প্যাসিফিক-এ সিট বুক করেছিল। ব্যাঙ্ককে ঘণ্টাচারেকের স্টপ। তার চেয়েও খারাপ ব্যাপার হল, ফ্লাইট রাত সাড়ে ন’টায় গিয়ে পৌঁছোবে। যাইহোক, এরপর আর কিছু করার নেই। অগত্যা দীপেশ ল্যাপটপ খুলে প্রেজেন্টেশনের কাজে ডুবে গেছিলেন।

জাপান বৌদ্ধধর্মের দেশ। আবার একইসাথে পুরোনো দেশজ কামি(দেবতা)র মূর্তিপূজা, শিন-তো ধর্মের শ্রাইন বা পুরোনো মন্দির, ধূপ জ্বালানো, ঘন্টা বাজানো, তুকতাকে বিশ্বাস— এগুলোও ওখানকার সমাজে ভালোমতোই আছে।

সেরকমই একটা শ্রাইনে হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা করছিল কিমোনো পরিহিত মেয়েটি। তার অনিন্দ্যসুন্দর মুখ দেখে বয়স বোঝা দুষ্কর, তবে চোখের পরিণত দৃষ্টি বলে দেয় সেটা তিরিশের তুলনায় চল্লিশেরই বেশি কাছাকাছি। পাশে রাখা ধূপদান থেকে আচ্ছন্ন করে দেওয়া তীব্র, মিষ্টি, ঝাঁঝালো গন্ধ ছাড়ছে। শ্রাইনটা দেখলে মনে হয় পরিত্যক্ত ও অবহেলিত। তবে সেখানে আজ যে আর কেউ নেই সেটা অবাক করার মতো বিষয়ই নয়। শেষ যখন এখানে নিয়মিত অর্চনা-প্রার্থনা হত, তখনো এই মেয়েটি ছাড়া বিশেষ কেউ এখানে আসত না। এটা প্রাইভেট শ্রাইন, পারিবারিক মন্দির— বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ।

বাড়ির পিছনদিকে, বড়ো-বড়ো চেরি গাছের আড়ালে ছোট্ট মন্দিরটা চোখেই পড়ে না বাইরে থেকে। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভাল। কামিনাগা পরিবারের পদবী বলে দেয় তারা ফুজিওয়ারা, আসানো, মিনামোতোর মতোই এক বনেদি গোষ্ঠী। মাসাকো কামিনাগা, মানে এই নতজানু মেয়েটিই এই বংশের শেষ উত্তরাধিকারী। বাকিরা বহু বছর আগেই বাড়ির অন্যদিকে, মানে পারিবারিক গোরস্থানে নিজের জায়গা পাকাপাকি করে ফেলেছে।

এই মন্দিরের দেবতাটিও একান্তভাবেই পারিবারিক। হিদেমিৎসু কামিনাগাকে এ বংশের আদি পুরুষ ধরা হয়। এরকম মানুষ থেকে কামিতে পরিণত হওয়া জাপানে নেহাৎ দুর্লভ নয়। তেনজিন-ও এরকম মানুষ থেকে দেবত্বে উন্নীত কামি।

কবে এবং কেন হিদেমিৎসু পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দেবতা হিসেবে গণ্য হতে শুরু করেন সেটার সঠিক বিবরণ মাসাকো জানে না। প্রবল কিছু বীরত্বের মাধ্যমে জমিদারি রক্ষা করার গল্প শুনেছে সে, যার শেষে এক পরিত্যক্ত গ্রামের পুকুরে ডুবে হিদেমিৎসুর মৃত্যু হয়। কিন্তু সে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, হিদেমিৎসু’র সেবা-অর্চনা করাই তার মুক্তির একমাত্র উপায়। এঁর কৃপা কীভাবে পাওয়া যায়, সেই নিয়ে বুড়ি ঠাকুমার মুখে একটা অব্যর্থ তুকের কথা সে শুনেছিল ছোটবেলায়। সেটাতেও মাসাকো’র অগাধ বিশ্বাস। এতগুলো বছর ধরে ও সেই কাজটাই করে চলেছে নিষ্ঠাভরে। উপকরণ জোগাড় করে দিলে বাকিটুকু হিদেমিৎসু নিজেই করে নেন।

উঠে দাঁড়িয়ে বারবার নত হয় মাসাকো। তখনই ওর চোখে পড়ে, সিঁড়ির ধাপের নীচে ইয়ুকি দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। ওর মতোই বছরের এই দিনটা কখনো ভোলে না ইয়ুকি।

ভোলা সম্ভবও নয় অবশ্য।

জার্নিটা মোটের ওপর ঠিকঠাকই হল। প্লেনেই ডিনার সেরে নিয়েছিলেন দীপেশ। আর্লি ডিনার করাই তাঁর অভ্যাস। কাল সকালে মিটিং, তাই ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি শোয়াই তাঁর লক্ষ্য ছিল।

চট করে সোনালিকে মেসেজ করে দিলেন দীপেশ, “রিচড টোকিও সেফলি। শ্যাল ইনফর্ম এগেইন আফটার রিচিং হোটেল।” এটাই প্রোটোকল।

রোহিনীকে ডায়াল করে অবশ্য পেলেন না। বিজি আসছিল। বার তিনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন দীপেশ। হোটেলে পৌঁছেই কথা বলবেন না হয়।

এয়ারপোর্টের বাইরে দাঁড়ানো বাকি ট্যাক্সিগুলো ভাড়া নিয়ে সটাসট চলে যাচ্ছিল। এই সেডানটা একেবারে ভিন্টেজ মডেলের বলেই হয়তো কেউ ডাকেনি। ড্রাইভার যুবকটি গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিল গেটের দিকে। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই, সে ভেতরে-ভেতরে কতটা অস্থির হয়ে পড়েছে। সন্ধে থেকে দাঁড়িয়ে থেকেও এখনো অবধি কাউকেই দেখে উপযুক্ত বলে তার মনে হয়নি।

তবে পেয়ে যাবে। এখানে আরো ঘণ্টাখানেক দাঁড়াবে। তাতেও কাউকে না পেলে চলে যাবে রেলস্টেশনে। রাত বাড়লে একটা না একটা মদ্যপ অপদার্থ পাওয়াই যাবে। ব্যস্ত হবার কিছু নেই। এত বছরে কখনো ফাঁক পড়েনি। মাসাকো তো বলেই, হিদেমিৎসু নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নেন।

চোখটা আলগা বুজে আসছিল, হঠাৎ সজাগ হয়ে টানটান হয়ে দাঁড়াল ইউকি। একটা স্যুটকেস আর ল্যাপটপের ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে আসছে একটা লোক। তার শরীরের পিছনেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটা ধূসর ছায়া— এক হাত তোলা, তাতে ধরা ছোট একটা দণ্ড। হিদেমিৎসু’র চিহ্ন, অর্থাৎ এই হল তাঁর জন্য চিহ্নিত মানুষ।

কিন্তু… এ তো বিদেশি। শুধু বিদেশি নয়, চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে এ ইন্ডিয়ান! অস্বস্তি হয় ইউকি’র। হাজার হোক, এ তো লর্ড বুদ্ধ’র দেশের লোক। তবে হ্যাঁ, লর্ড বুদ্ধ তো বহিরাগত! ইউকি’র মনে পড়ল, মাসাকো মুখ উঁচু করে বলত, “আমাদের এই শতাব্দী প্রাচীন দেশে কি নিজস্ব দেবদেবীর এতই অভাব ছিল, যে অন্যের ধর্ম ধার নিতে হবে?” বলতে-বলতে ওর গর্বিত মুখটা উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠত। অপূর্ব লাগত তখন ওকে।

আর দ্বিধা না করল না ইউকি। গাড়িটা ঠিক লোকটার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাল ও।

সিলভার কালারের সেডানটা সামনে এসে দাঁড়াতেই চট করে তাতে উঠে পড়লেন দীপেশ। এয়ারপোর্টের বাইরে বেশ ঠান্ডা আছে। দেরি না করে ঝটপট হোটেলে যেতে পারলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। সোনালি কীসব ডিসকাউন্ট পেয়ে একটা নতুন হোটেল বুক করেছে। ক্যাবি হোটেলের নাম বেশ কয়েকবার শুনেও বুঝতে পারল না। জ্বালাতন! এখানকার প্রায় সব লোকের মতোই এও ইংলিশ বলতে পারে না বললেই চলে। ব্যাগ থেকে হোটেল বুকিং এর কাগজটা এগিয়ে দিলেন দীপেশ। সেটায় ইংরেজির পাশাপাশি জাপানিতেও হোটেলের নাম লেখা আছে। এবার হাসিমুখে নড করে, কাগজটা পাশে রেখে, গাড়ি স্টার্ট করল ড্রাইভার।

একটু পরেই রোহিনী’র ফোন এল। কথা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই দীপেশ এত উত্তেজিত হয়ে পড়লেন যে গাড়ি কোথায় যাচ্ছে তা দেখার কথা তার মনেই রইল না। মেয়ে আজ আবার সেজেগুজে ডিস্কোতে গেছে ছোকরার সঙ্গে, মায়ের আপত্তি কানেই তোলেনি। রাগে মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছিল। মাত্র তিন-চারটে দিন পরেই দীপেশ ফিরে আসবেন, শান্তিও ফিরবে। এই ক’টা দিনও মেয়েকে সামলাতে পারছে না রোহিনী!

ফোন রেখে চোখ তুলে দীপেশ দেখলেন, সম্পূর্ণ অচেনা একটা রাস্তায় ঢুকে পড়েছে গাড়ি। ক’বছর যাতায়াত করতে-করতে টোকিওকে কিছুটা হলেও চিনেছেন তিনি। সেই ধারণা থেকেই মনে হল, এদিকে ভাল হোটেল থাকবে কী করে? জনবসতির ঝাঁ চকচকে ভাবটা তো ক্রমেই কমে আসছে!

এহ্, সোনালি মেয়েটা একটা বুকিংও ঠিক করে করতে পারে না! দীপেশ ঠিক করলেন, যাতায়াতে খুব বেশি সময় লাগছে বুঝলে কালই এখানকার অ্যাসিস্ট্যান্টকে ধরে হোটেল বদলে নেবেন।

শুধু বাড়িঘরের চেহারাই পাল্টাচ্ছে না, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কমে আসছে। কখন পৌঁছবেন গন্তব্যে? এত দূর জায়গা থেকে সময়মতো মিটিং-এ হাজিরা দিতে হলে কাল সকালেও তো তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে! তার সঙ্গে রোহিণী’র ফোন পাওয়ার পর থেকেই মাথায় ভনভন করা দুশ্চিন্তাগুলোর ধাক্কায় দীপেশের মাথা টিপটিপ করে ওঠে।

তখনই একটা বড়ো গেট পেরিয়ে গাড়িটা থেমে গেল। সামনের আলো ঝলমলে প্রাসাদোপম বাড়িটা যে একটা হোটেল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাই কি তাঁর হোটেল? কোথাও কোন ইংলিশ অক্ষর নেই। ড্রাইভার তাঁর ইতস্তত ভাব দেখে একগাল হেসে বলল, “ইয়েস, ইয়েস! দিস ওটেল।”

ভাড়া মিটিয়ে নেমে, স্যুটকেস হাতে দরজা ঠেলে হোটেলের ভিতরে ঢুকে পড়লেন দীপেশ।

আরো একবার হোটেলে ফোন করে চেক করে সোনালি। না, মিস্টার মালহোত্রা এখনো চেক-ইন করেননি। করলেই যেন তাকে জানানো হয়, সেটা আবার মনে করিয়ে দিয়ে ফোন রেখে দেয় সে।

হোটেলটা নতুন, খুব ভালো ডিসকাউন্টও দিচ্ছিল। ফিডব্যাকও খুব ভাল ছিল। ফ্লাইট রাইট টাইম পৌঁছেছে— এটা স্যারের মেসেজ থেকেই জানা গেছিল। কিন্তু তারপর প্রায় এক ঘণ্টা হতে চলল। এতক্ষণে তো অবশ্যই হোটেলে চেক-ইন করে ফেলার কথা! পনেরো মিনিট, বড়োজোর কুড়ি মিনিটের বেশি তো লাগার কথা নয়। স্যার এমনিতে পালা করে যে দুটো হোটেলে ওঠেন, তারই একটার প্রায় লাগোয়া বলা চলে এই হোটেলটাকে।

দুশ্চিন্তায় ছটফট করে সোনালী। কখন যে স্যারের মেসেজটা আসবে!

চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মতো সাজানো লবি। রিসেপশনে বসা কিমোনো পরা মেয়েটিকে মোমের পুতুলই বলা চলে। সোনালি’র ওপর রাগ কমে আসে দীপেশের। দূরত্ব বেশি হলেও হোটেলটায় সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব হবে না বলেই মনে হচ্ছে।

“ইয়েস, ইয়েস। রুম বুকদ, নাইস রুম, টপ ফ্লোর, রুম নাম্বার তু। ভেলি নাইস ভিউ ফম রুম।”

বাহ্! টোকিওর রাতের আলো-জ্বলা ভিউ খুব সুন্দর। মেয়েটার হাসিটাও। সইসাবুদ সেরে চাবি নিয়ে ব্যাগসহ লিফটে উঠলেন দীপেশ। মেয়েটি লিফটের দরজা অবধি সঙ্গে এসে, লিফটের বোতাম টিপে দিল। তারপর একরাশ জুঁইফুলের মতো হাসি ছড়িয়ে, ‘আরিগাতো’ বলে বিদায় নিল।

লিফটের দরজা বন্ধ হতে-হতে দীপেশও অল্প বাও করে বলে “আরিগাতো গোজাইমাসতা!” অনেক ধন্যবাদ।

হিদেমিৎসু’র ভুল হয় না। ইয়ুকি ইংলিশটা ভালো বলতে না পারলেও, দিব্যি বুঝতে পারে। তার সঙ্গে যে ইন্ডিয়ান ভাষাটা মিক্স করে বলছিল লোকটা, সেটা ও বোঝেনি। কিন্তু মূল কথাটা বুঝতে অসুবিধে হয়নি।

“ননসেন্স! কুছ ভি? গড ড্যাম ইট রোহিনী, হোয়াই ডিড য়্যু অ্যালাও সাচ ননসেন্স? আর ইয়্যু স্টুপিড অর হোয়াট?”

লোকটা রীতিমতো চেঁচিয়ে বলছিল, “নো! দ্যাট ইজ নট অ্যান এক্সকিউজ। আই ডোন্ট কেয়ার হোয়াট শি সেজ। মাই ডটার ইজ নট ম্যারিং দ্যাট গুড ফর নাথিং লোয়ার ক্লাস লোফার। আই উড রাদার প্রেফার হার ডাই। আন্ডারস্ট্যান্ড, ইউ ফুল? বেওকুফ আওরৎ, কভি তোহ কুছ চিজ সমঝা করো! উয়ো লড়কাকো বোল দেনা ফির কভি না আয়ে ঘরপে। টেল হিম টু গো টু হেল!”

কথাগুলো মনে পড়তেই ইয়ুকি’র চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।

উরিবাবা! এটা হোটেলের ঘর, না আর কিছু? সলিড কাঠের দরজা। বাকি দেওয়াল, এমন কি ছাতেও যা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কারুকার্য, তাতে মনে হচ্ছে যেন ভ্যাটিকানের কোনো চ্যাপেলে দাঁড়িয়ে আছেন দীপেশ। যুগ-প্রাচীন কোনো জাপানি শ্রাইনও বলা চলে। কিছু নকশা কাঠ খোদাই করে বানানো, কিছু আবার ঝলমলে রঙে আঁকা। চোখ সরাতে ইচ্ছে করছিল না।

কিন্তু ঘরটায় কি এসি চলছে না? দীপেশের হালকা সাফোকেশন হচ্ছে। একদম বদ্ধ ঘর তো! তাছাড়া, মনের ভুল কিনা কে জানে, খুব মৃদু একটা ধূপের গন্ধ পাচ্ছেন যেন। ধূপে আবার বরাবর অ্যালার্জি তাঁর— সেই ছোটো থেকেই।

একটা জানলা খোলা গেলে ভালো হত। তার আগে বড়েভাইকে কি একটা ফোন করা দরকার? নাহ্, তার কোনো দরকার নেই। রূপেশের বেলায় তো দেখেছেন, লোকটার কথার খেলাপ হয় না। কাজও নিখুঁত, পুলিশ কোনো ক্লু-ই পায়নি। ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ বলেই কেসটা ক্লোজ করে দিতে বাধ্য হয়েছিল ওরা।

আশ্চর্য! সিল্কের এমন লম্বা আর ভারী পর্দায় সব দেওয়াল ঢাকা, কিন্তু একটাও জানালা নেই ঘরটায়! মেয়েটা যে বলল নাইস ভিউ। কী জোচ্চর রে বাবা! নিঃশ্বাসের কষ্টটা আরো বাড়ছে। রিসেপশনে খবর দেওয়ার জন্য ফোন… নিদেনপক্ষে কোনো বেলও কি নেই?

মাসাকো’র চোখ বন্ধ ছিল। ওর ঠোঁট নড়ছিল দ্রুতগতিতে। গুনগুন ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছিল আগাছায় ঢাকা শ্রাইনটার পাথুরে চত্বরে। মাসাকো জানে, সময়মত শেষ হয়ে যাবে এই মন্ত্রপাঠ। এত বছরের অভ্যাস বলে কথা! তাই হল। শেষ পংক্তিটা বলেই একটা আভূমি বাও করে সোজা হল মাসাকো। তারপর ক্ষিপ্র পায়ে মন্দির পিছনে ফেলে, বাড়ির পাশ দিয়ে প্রায় দৌড়ে এল সে। পোর্টিকোয় ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল সেডান গাড়িটা।

দীপেশ টের পান, ঘাড় বেয়ে একফোঁটা ঘাম গড়িয়ে পড়ল। প্যালপিটেশন বাড়ছে বলেই হয়তো চোখে ক্রমশ কম লাগছে ঘরের আলোটা। দেওয়ালে আবার কোনো সুইচও নেই!

নিজেকে টেনে দরজার দিকে নিয়ে যান দীপেশ। নিজেকে আপ্রাণ বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি— এ-সবই মনের ভুল। ঘরটা হঠাৎ করে মন্দিরের ধূপধুনোর গন্ধে ভরে ওঠেনি। অন্ধকারও হয়ে যায়নি।

“খোল্! খোল্!”

ইংরেজি, শেষে হিন্দিতে চিৎকার করছিলেন দীপেশ। প্রাণপনে ঝাঁকিয়েও পাথরের মতো ভারী দরজাটা হেলাতে পারেননি তিনি। তাঁর কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল টপ্ টপ্ করে। এবার সত্যিই তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ঘরময় তীব্র ঝাঁঝালো মিষ্টি ধূপের গন্ধটাকেও আর কিছুতেই মনের ভুল বলে চালানো যাচ্ছিল না।

“খো… ওহহহহহ্!”

একটা অতর্কিত চিৎকার বেরিয়ে এল দীপেশের গলা দিয়ে। আলো নিভে গিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে ঘর। ঘরময় এখন আরো তীব্র গন্ধ— ধূপ ছাড়াও আরো কিছু মিশেছে তাতে। অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়তে পড়তেও দীপেশ চিনতে পারলেন গন্ধগুলোকে। ছোটোবেলায় গাঁওতে কাটানো ছুটির দিনগুলোয় এই গন্ধ পেতেন তিনি— জলঝাঁঝি আর পচা পানাপুকুরের কাদার গন্ধ!

মাসাকো উঠে বসতেই গাড়ি ঘুরিয়ে আবার শহরের দিকে রওনা দিল ইয়ুকি। কোনো কথা হল না দু’জনের মধ্যে। চোখে-চোখে হাসি বিনিময় হল অবশ্য। আজ, এখন তাদের নিজস্ব উৎসবের রাত। কাল থেকে তো আবার ফিরে যেতেই হবে যে যার জায়গায়।

আটচল্লিশ বছর আগের কথা। মাসাকো’র প্রবল প্রতাপান্বিত বাবা রাগে ফেটে পড়েছিলেন। তাঁদের চেয়ে বংশমর্যাদায় ছোটো, অর্থকৌলীন্যে হীন, সামান্য এক ড্রাইভার তাঁর একমাত্র কন্যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল! তার চেয়েও বড়ো কথা, কন্যাও জেদ ধরেছিল যে তাকেই সে বিয়ে করবে। এত ঔদ্ধত্য হজম করতে পারেননি তিনি।

দোনলা বন্দুক গর্জে উঠেছিল। দুটো গুলি দু’জনের সব গল্প শেষ করে দিয়েছিল এই দিনটাতেই। কিন্তু ছুটি পায়নি মাসাকো। তাই ইউকি-ও থেকে গেছিল— যাতে বছরকার এই রুটিনের মাধ্যমে ওরা একসঙ্গে আসতে পারে এক রাতের জন্য।

যাতে হিদেমিৎসু’র তৃপ্তি একদিন ওদের দু’জনকেই মুক্তি দেয়!

জং-ধরা গেট পেরোনোর সময় সেডান থেকে একবার পিছনে তাকাল মাসাকো। দশতলা বাড়িটাকে চাঁদের আলোয় তখনো প্রাসাদোপমই লাগছিল। তবে এখন সেটা একটা পুরোনো ভাঙা পরিত্যক্ত অন্ধকার প্রাসাদ। চারিদিকে আগাছার দুর্গম জঙ্গলে ভরা সেই প্রাসাদের ঘরে-ঘরে ইতস্তত পড়ে আছে অনেক কঙ্কাল। তবে সেগুলোর কথা আজও কেউ জানতে পারেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *