তুলিজা ভবানী

তুলিজা ভবানী

প্রথম পর্ব

ভারতের পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে সহ্যাদ্রি বা পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। তার কাঁধের কাছ থেকে বিস্তৃত বাহুর মতো দক্ষিণমুখী হয়েছে বালাঘাট পর্বতশ্রেণী। প্রায় ২০০ মাইল চলার পর এই পাহাড় জানু পেতে বসেছে আজকের মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের সীমানায়, ভীমা নদীর প্রান্তে। অভ্রংলিহ হতে চেয়েও থমকে যাওয়া শিখরের দল, আর তাদের মাঝে নেমে যাওয়া গভীর উপত্যকা— এই নিয়েই গড়ে উঠেছে বালাঘাট।

সন্ধ্যা আগতপ্রায়। বালাঘাটের এক বিশেষ চূড়ায় এক নারীমূর্তিকে দেখা গেল। এই পাহাড়টি যমুনাচল নামে পরিচিত। চিন্তামগ্ন মুখে নিষ্কম্প হয়ে সামনের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে ছিলেন মানুষটি। পাহাড়ের ছায়ায় সে উপত্যকা প্রায়ান্ধকার, শুধু দূরের একচিলতে অংশ সূর্যের শেষ আলোটুকুতে রক্তাভ আর রহস্যময় হয়ে উঠেছে। পর্বতমালার পশ্চিমাংশ বলে এই অঞ্চল জলদের কারুণ্যস্পর্শে সবুজ, ছায়াচ্ছন্ন। বৃষ্টিবিরল পূর্বভাগ ততটাই নিষ্পাদপ, কঠিন, কর্কশ।

মহিলার পরনে কারুকার্যরহিত হরিদ্রাভ রেশমবস্ত্র— পর্বতারোহণের উপযুক্ত ধরণে কাছা দিয়ে কটি বেষ্টন করে আঁটোসাঁটোরূপে সেটি পরিহিত। পীত অঙ্গবাস, কেশবিন্যাস, সামান্য আভরণ— কোথাও আলাদা বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু তাঁর মুখ দেখলে অনুভূত হয়, এ কোনো সামান্য নারী নয়। অকল্পনীয় ধৈর্য ও সাহস মূর্ত হলে হয়তো এমন তেজস্বিনী তৈরী হয়। সেই মুখের অলিন্দরূপী দুটি আয়তচক্ষু সেই মুহূর্তে অন্যমনস্ক, অতীতচারী।

 দূর থেকে প্রায় অশ্রুত ঘন্টাধ্বনি ভেসে এল। সঙ্গে শোনা গেল মেষশাবকের ডাক। সচকিত হলেন নারী। তড়িৎপদে কিনারা থেকে সরে গিয়ে আরণ্য আদিমতায় মিলিয়ে গেলেন তিনি।

এখনো হয়নি সময়। এখনো তাঁর উপস্থিতি অন্যের কাছে প্রকট না হওয়াই বিধেয়।

***

বালাঘাটকে উত্তর ও দক্ষিণ দুই সীমানায় জড়িয়ে রেখেছে গোদাবরী আর ভীমা নদী। এছাড়া অন্য যে উল্লেখযোগ্য নদীটি নাচতে নাচতে এ পর্বতমালার উপর দিয়ে বয়ে গেছে তার নাম মঞ্জীরা। মঞ্জীরার গতিপথ বিচিত্র। বিদ অঞ্চলে জন্মে সে প্রথমে বাকি সব নদীর মতোই দক্ষিণ-পূর্ববাহিনী ছিল। কিন্তু মাঝরাস্তায় হঠাৎ অভিমুখ বদলে সে হয়ে গেছে উত্তর-পূর্ববাহিনী। সম্ভবতঃ গোদাবরীর আকর্ষণ ভীমার থেকে প্রিয়তর মনে হয়েছে তার।

ভীমাও অবশ্য এই অঞ্চলকে বঞ্চিত করেনি। তার দু-দুটি শাখানদী বালাঘাটের উপর দিয়ে বয়ে গেছে— বোর আর শিনা। এই বোর নদীর একটি অতিক্ষুদ্র শাখার তীরে কর্দম ঋষির আশ্রম। তিনি সস্নেহে এই চপলা তটিনীর নামকরণ করেছেন মন্দাকিনী। স্বর্গের নদী। এই কাঁটাগুল্ম-আকীর্ণ, জনবিরল, অনুর্বর স্থানটিই তাঁর কাছে স্বর্গতুল্য প্রিয়।

কর্দমপত্নী অনুভূতি কিন্তু এ-বিষয়ে সহমত নন। ঋষির দুটি তরুণ শিষ্য আর নিকটস্থ দরিদ্র গ্রাম থেকে নিয়মিত-আগতা এক স্থানীয় পরিচারিকার সাহায্যে তিনি আশ্রমের ও গার্হস্থ্যের যাবতীয় কাজ সামলান ঠিকই। কিন্তু ঋষির গোয়ার্তুমির ফলে এই শমন-অরুচি স্থানে থাকতে বাধ্য হওয়ার সমস্যা এবং শিশুপুত্রের খেলার সঙ্গীটিও না থাকা নিয়ে তাঁর হতাশা হুতাশন-সম ভাষার আকারে কর্দমের উদ্দেশে ধেয়ে আসে। কর্দম ধ্যানে সবিশেষ পটু। অভিযোগের তীব্রতার সঙ্গে তাঁর ধ্যানমগ্নতা সমানুপাতে বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

ঘনঘোর সাধনার ফলে ঋষি কর্দম ঈশ্বরের নৈকট্যলাভ করলেন বড়ো কষ্টকর পথে। বর্ষায় নদীতে বারংবার অবগাহন এবং পার্বত্য মৃত্তিকামিশ্রিত জলপানের ফলে তিনি উত্তপ্ত দেহে শয্যাশায়ী হলেন, আর উঠলেন না। শিষ্যদ্বয় যথাসাধ্য সৎকারাদি সমাপন করল, তার পর নব্য গুরুগৃহের সন্ধানে যাত্রা করল।

অনুভূতি কিছু দিন শোকবিহ্বলা হয়ে রইলেন। সহকারিণী শিশুর দেখভাল করল। তারপর অনুভূতি বুঝলেন, জীবন বড়ো নির্মম। শোকপালনের তুলনায় দৈনন্দিন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়াই আশু কর্তব্য। তিনি কর্মঠা, নেহাত নির্বুদ্ধিও নন। গৃহ প্রতিপালনের সংস্থান দ্রুত করে নিলেন। সেই সহকারিণীই গ্রামে বলে-কয়ে সম্বৎসরের তণ্ডুল আনিয়ে দিল। কিছু শাক ও আনাজের ব্যবস্থাও হল। ক্রমে তাঁদের জীবন ফিরে এল নিজস্ব ছন্দে।

এই আরণ্যক ও নির্বান্ধব পরিবেশেও শিশুপুত্রটির সহাস্য বৃদ্ধি অনুভূতিকে পূর্ণত্বের স্বাদ দিত। কিন্তু তাতে তাঁর দুশ্চিন্তা হ্রাস পায়নি। বিশাল এ-ধরায় তিনি একাকিনী। এই শিশুকে বড়ো করে, তার জন্য গুরুগৃহ সন্ধান করে তার উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা কি তাঁর পক্ষে সম্ভব?

মাতৃহৃদয় বলে, অবশ্যই সম্ভব। তবু নিরন্তর সংশয়ে দীর্ণ হন অনুভূতি। কারও আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবলে শঙ্কিত হন তিনি। রক্ষকের ভক্ষক হতে কতটুকু সময় লাগে?

এমনই এক বিনিদ্র রাতে কর্দম ঋষির কণ্ঠে শ্রুত মহিষাসুরমর্দিনীর কাহিনিটি তাঁর স্মরণে এল। একা নারী হওয়া সত্বেও ত্রিভুবনের দেবদেবী তাঁরই শরণ নিয়েছিলেন বিপদে ত্রাণ করতে। তিনিই পরম শক্তি, তিনিই চরম আশ্রয়।

মনস্থির করতে এক মুহূর্তও লাগে না অনুভূতির। শরণাগত হতে হলে এঁরই শরণাগত হবেন তিনি। ঋষিপত্নী’র অধিকারে ধ্যান, জপমন্ত্র, প্রকরণ— সবই তাঁর জ্ঞাত। কাল থেকে, প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে ওই মন্দাকিনী তীরে তিনি মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার ধ্যান-বন্দনা করবেন। তাঁর ও তাঁর পুত্রের রক্ষাভার এখন থেকে দুর্গা মাতার।

***

একটি নতুন নিয়মে অভ্যস্ত হলেন অনুভূতি। প্রতিদিন অন্ধকার থাকতে ঘুম ভাঙে তাঁর। পুত্র ও পরিচারিকা তখনো গভীর ঘুমে। তাদের নিদ্রায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে নিজের পূজা-উপচার গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি।

নির্জন মন্দাকিনীর তীরে জলের ঘ্রাণবাহী বাতাস বুকে ভরে ধ্যানে বসেন অনুভূতি। অনায়াসে তিনি ডুবে যান এক অচিন্ত্যের চিন্তায়। দুর্গা, ভবানী, শৈলজা, অম্বিকা— যেদিন যে নাম মুখে আসে, তাই জপ করেন মনপ্রাণ ভরে। ধ্যানচক্ষে ভেসে ওঠা দৃপ্ত সিংহবাহিনী মূর্তিটির সস্নেহ দৃষ্টি চেতনায় ধরা দেয়, কিন্তু মায়ের মুখটি স্পষ্ট হয় না।

ফেরার পথে পা রেখেই এতক্ষণের শুদ্ধ সুন্দর মনের ভাবটা নষ্ট হয়ে গেল অনুভূতির। আজও লোকটা দাঁড়িয়ে আছে পথের পাশে। অচেনা বিরাট বলশালী চেহারা। রুক্ষ চুল, পাকানো গোঁফ ও পোশাক দেখলে যোদ্ধা মনে হয়। রাজার কোনো সৈনিক বা কর্মচারী হবে। রাজকর আদায়ের জন্য কখনো-কখনো তারা এই পর্বতমালার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে আসে বটে। কিন্তু গত তিনদিন ধরে লোকটা এমন সময়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকছে— এটা খুবই অস্বস্তিকর।

প্রথম দু’দিন লোকটি তাঁকে উঠতে দেখেই সরে দাঁড়িয়েছিল অন্য দিক ফিরে। অনুভূতি ভেবেছিলেন হয়তো প্রাতর্ভ্রমণ করতে এসে তাঁর পূজা না হওয়া অবধি দাঁড়িয়ে আছে। কাল সরেও দাঁড়ায়নি, মুখও ফেরায়নি, বরং বেশ স্পষ্টভাবে তাঁকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করেছে লোকটা। সে চোখের চাহনি বড়ো কলুষিত, অনুভূতির সর্বাঙ্গে যেন পিচ্ছিল স্পর্শ বুলিয়ে গেছিল তা।

কাজেকর্মে সেকথা ভুলেই গেছিলেন তারপর। আজ আবার লোকটাকে পথের ঠিক মধ্যখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশংকায় মন শিউরে উঠল তাঁর। এ আজ পথ ছেড়ে সরে দাঁড়াবে না বুঝে, যথাসম্ভব নিজেকে সংকুচিত করে, পাশ কাটিয়ে যেতে গেলেন অনুভূতি।

আচম্বিতে বুকে এসে লাগল কনুইটা। যত না ব্যথা লাগল তার চেয়ে বেশি হল আতঙ্ক। হাত থেকে কোষা-কুষিটা পড়ে গেল মাটিতে। সেটা না তুলেই, ছিটকে সরে গেলেন তিনি, যথাসাধ্য তীব্র কণ্ঠে বলে উঠলেন, “সাবধান! ফের যদি এখানে দেখি তো অভিশাপ দিয়ে নির্বংশ করে দেব!”

লোকটা জবাবে জোরে হেসে উঠল একবার। কিন্তু আর এগিয়ে এল না। শুধু তাঁর হাত থেকে পড়ে যাওয়া কোষা-কুষিটা তুলে আস্তে আস্তে অন্যদিকে চলে গেল।

একছুটে বাড়ি না ঢোকা অবধি আর পিছনে তাকাতে সাহস পেলেন না অনুভূতি। তাচ্ছিল্য আর কৌতুক মেশানো কুশ্রাব্য হাসির আওয়াজ, আর কটু, ঝাঁঝালো দেশজ মদের গন্ধ তাঁকে বহুদূর অবধি ধাওয়া করেছিল।

এমনই কপাল, সেদিনই পরিচারিকাটি বিকেলে এল না। সারারাত ছেলেকে জড়িয়ে প্রায় জেগেই কাটালেন অনুভূতি। বড় ভয়ে, বড় আতঙ্কে। খালি মনে হতে লাগল সেই ভয়াল চেহারার দুর্জন লোকটা হয়তো সকালে তাঁর পিছু পিছু এসে বাড়ি চিনে গেছে। হয়তো সে এবার আসছে রাতের অন্ধকারে। সামান্য গাছের ডালের শব্দেও অনুভূতির মনে হচ্ছিল, যেন কেউ হাঁটছে বাইরের উঠোনে। হাওয়ার শব্দে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি দরজায় ধাক্কা দিল কেউ!

কাঁপতে-কাঁপতে, কাঁদতে-কাঁদতে শেষ রাতে চোখে নিবিড় ঘুম নেমে এল তাঁর। তখনই, বিনা চেষ্টায়, বিনা মন্ত্রে মাতৃমুখটি তাঁর স্বপ্নে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সাহসে, তেজে গরিমাময়ী মধ্যবয়সিনীর সেই অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী ব্যক্তিত্বে অনন্যা। সুদূরপ্রসারী ধীর চোখদুটি ছাপিয়ে দৃষ্টি যায় কপালে তৃতীয় নয়নটির দিকে। সেটি এতই জ্বলজ্বল করছে, যেন এখনই আগুন ছুটবে সেখান থেকে!

***

ঘুম ভেঙেই মনে হল, আজ সূর্যোদয় দেখতে পাবেন না। ঘরে ছেলেকে কার কাছে রেখে যাবেন তিনি? অথচ, সারারাত নির্বিঘ্নে কাটিয়ে আর ভোরে ওই অপরূপ মুখের স্বপ্ন দেখে অবধি রোজকার ধ্যানস্থলের দিকে যাওয়ার এক অদ্ভুত তাগিদ অনুভব করছেন তিনি। দোনামনা করতে করতেই তাঁর খেয়াল হল, পানীয় জলও তো অপ্রতুল! এ কাজটি পরিচারিকা করে রাখে, কাল হয়নি। জলপাত্রের সঙ্গে বাকি উপচার ও ঘুমন্ত শিশুকে কোলে নিয়ে তিনি নদীর দিকে পা বাড়ালেন।

শিশুকে একটা গাছের তলায় শুইয়ে দিয়ে, কলসে জল ভরে তার পাশে রাখলেন অনুভূতি। চারপাশে ভালো করে চেয়েও আর কাউকে দেখতে পেলেন না। কালকের তর্জনে কি তাহলে কাজ হয়েছে?

ধ্যানে বসামাত্র সেই মুখখানি তাঁর মানসপটে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে লাগল। মনে হল সে মুখের জ্যোতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর পুরো চৈতন্য গ্রাস করে নিচ্ছে। অনুভূতি সর্বাংশে মগ্ন হয়ে গেলেন। কতক্ষণ পর তিনি চোখ মেলে চাইলেন, তা তাঁর জানা নেই। অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে গেছে মন। প্রাণ ঢেলে শেষ প্রণাম করে সব গুছিয়ে তুলতে হাত বাড়ালেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে পিঠের দিক থেকে একটা কর্কশ বলিষ্ঠ হাত হ্যাঁচকা টানে তাঁকে শুইয়ে ফেলল চিত করে। হতচকিত অনুভূতি বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, তিনি সেই পাষণ্ডের কোলের ওপর শায়িত। তার একটা হাত পাথরের মতো ভারী হয়ে তাঁর গলার ওপর আড়াআড়িভাবে চেপে বসে তাঁর ঠেলে ওঠার চেষ্টায় বাধা দিচ্ছে। অন্য হাত হিংস্র লোলুপভাবে তাঁর ডান বুকে অকথ্য যন্ত্রণাদায়ক ভাবে পীড়ন করছে, যেন অঙ্গটিকে শরীর থেকে খুবলে ছিঁড়ে ফেলবে সে।

গলা চিরে চিৎকার করে ওঠেন অনুভূতি। সে শব্দে ঘুম ভেঙে যায় গাছতলায় শয়ান শিশুটির, সেও আর্ত কান্না জোড়ে। কিন্তু এই নির্জনে কে শুনবে তাঁদের গলা? কে আছে এই নরাধম পাপী ছাড়া ধারেকাছে? উলটে তাঁর চিৎকারে দুর্বৃত্তের উল্লাস যেন আরো বেড়ে ওঠে। তার উৎকট হাসির আওয়াজ শুনতে-শুনতে অনুভূতি টের পান, তাঁর গলায় হাতের চাপ ক্রমশঃ বাড়ছে। আর কোন আওয়াজ বেরোচ্ছেই না তাঁর গলা দিয়ে। হাত পা ছুঁড়ে বাধা দেবার চেষ্টা করামাত্র বিশাল বিকট শরীরটা উঠে এল তাঁর পায়ের উপর। গলায় চাপ আরো বাড়ছে, জলে ডুবে যাওয়া মানুষের মত অন্ধকার নেমে আসছে তাঁর চোখে, অন্ধভাবে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে তিনি টের পেলেন দস্যুর অন্য হাত তাঁর বুকের ওপর থেকে সরে গেছে। পরিধেয় ছিন্ন করে তাঁর নিম্নাঙ্গ অনাবৃত করে ফেলতে ব্যস্ত সে হাত এখন।

 জ্ঞান হারানোর মুহূর্তে অনুভূতি শুনতে পেলেন তাঁর পুত্রের কান্নার শব্দ। তারপর অন্ধকার।

***

দ্রুত পায়ে যমুনাচলের চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বিগত যুদ্ধ-জনিত ক্ষত সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে গেছে, মনের ক্লান্তিও আর নেই। নবোদ্যমে তিনি ফিরে যাচ্ছিলেন নিজগৃহে। হাতে একটি দীর্ঘ, পর্বতারোহন-সহায়ক বংশদণ্ড নিয়ে রাতের অন্ধকার থাকতেই যাত্রা করেছিলেন তিনি। ইচ্ছা ছিল আজই তুলিজাপুর পার হয়ে ধারাশিব পৌঁছে যাবেন। যেতেনও। বাদ সাধল দূর থেকে ভেসে আসা এক নারীকণ্ঠের আর্তনাদ। তারপর শোনা গেল একটানা এক শিশুর কান্না। দ্রুত গতি দ্রুততর করে কান্নার শব্দ অনুসরণ করলেন তিনি। অকুস্থলে পৌঁছোতে সময় লাগল না।

ঘটনাস্থলে পৌঁছেই তাঁর মাথায় রক্ত উঠে গেল। এক ভীষণদর্শন পুরুষ স্পষ্টতই এক ভূলুন্ঠিতা নারীকে বলাৎকারে রত, নারীটি তখনো প্রাণপণে বাধা দিতে চেষ্টা করছে দুইহাতে। ছুটে আসার গতি বিন্দুমাত্র না কমিয়ে সবেগে তিনি পদাঘাত করলেন ধর্ষকের মাথায়।

ছিটকে পড়ে লোকটা একটুক্ষণের জন্য হকচকিয়ে গেছিল। তার মধ্যেই তিনি হাতের লাঠিটি ঘুরিয়ে ধরেছেন। এটি নিছক বংশদণ্ড নয়। এর একপ্রান্ত লোহা দিয়ে বাঁধানো, তাতে সূচ্যগ্র ধারালো ফলা বসানো। ধাক্কা সামলে লোকটি উঠে দাঁড়াতেই সেটি নেমে এল তার মাথা বরাবর। লোকটি যেভাবে ক্ষিপ্র পায়ে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করল, তাতে বোঝা গেল যে এ বড়ো সহজ প্রতিপক্ষ নয়। তাঁর চিন্তাকেই প্রতিধ্বনি করে হেসে উঠল তাঁর চেয়ে দেড় মাথা উঁচু চেহারাটা, “কে তুমি সুন্দরী? কুক্কুরাসুরের বিরুদ্ধে লড়তে এসেছ! দম আছে, এ-কথা বলতেই হবে। যুদ্ধ না করে চল, অন্য কিছু খেলি। এদের মতো ছুঁলেই নেতিয়ে পড়া জড়পদার্থগুলোকে ভোগ করে-করে বিরক্তি ধরে গেছে।”

উত্তর না দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে লাঠি চালান তিনি। আবারও পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কুক্কুরাসুর। পুরোটা এড়াতে পারে না সে। তার বাহুতে ক্ষতর দাগ ফুটে ওঠে।

বিধ্বস্ত বিস্রস্ত শরীর আর বেশবাস সামলে, হামাগুড়ি দিয়ে ছেলের কাছে পৌঁছেছিলেন অনুভূতি। শিশুকে বুকে আঁকড়ে ধরে থরথর করে কাঁপছিলেন তিনি। এই অকুতোভয় নারীর পরিচয় তাঁর জানা নেই। তবে যে ক্ষিপ্রতায় রাক্ষসটাকে তিনি ক্রমশ কোণঠাসা করছেন, তাতে তাঁকে কোনো রাজপরিবারের শস্ত্রবিশারদ কন্যা বলেই মনে হয়। ইনি যে-ই হোন, অনুভূতি সংকল্প করলেন আজীবন এঁর দাসী হয়ে থাকার। শুধু আজ এঁকে জিতিয়ে দাও মা ভবানী! অসুরের বিনাশ হোক!

কুক্কুরাসুর কি শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল? গতরাত্রের প্রমত্ত সুরাপানের প্রভাব কি তাকে বিবশ করে দিচ্ছিল ধীরেধীরে? জানা নেই, কিন্তু ক্ষণেকের জন্য তার একাগ্রতা ভঙ্গ হল। সরে যেতে গিয়ে ভুল করে উলটো দিকে পা বাড়াল সে। বাতাস কেটে দণ্ডটা তার মাথায় আছড়ে পড়ল তৎক্ষণাৎ। দু’হাতে মাথা চেপে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখা দিল নেমে আসা ঘন লাল রেখা। সুবর্ণকঙ্কন-শোভিত সুডৌল পিত্তলবর্ণ হাত উঠল আর নামল। সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল রক্তমাখা ফলার ডগা, সটান বুক ফুঁড়ে পিঠের দিকে বেরিয়ে এসেছে সেটা।

বেশ কিছুক্ষণ সময় নিলেন তিনি নিজের উত্তাল ক্রোধকে সামলে নিতে। তারপর ঘুরে এগিয়ে গেলেন গাছের নীচে বসা মাতাপুত্রের দিকে।

অনুভূতি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন তাঁকে। কপাল বেয়ে, চুলের ধার দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। মুখ এখনো রাগে লাল, টিকোলো নাকের পাটা ফুলে উঠছে। কপালে ঘষা লেগে এলোমেলো লম্বাটে লাল তিলক জ্বলজ্বল করছে, যেন এখনই আগুন ছুটে বেরোবে সেখান থেকে।

চেনা মুখ। স্বপ্নে, ধ্যানে, আজ এঁকেই দেখেছে সে।

গলদশ্রু হয়ে লুটিয়ে পড়েন অনুভূতি, “রক্ষা কোরো মা! আমার সন্তানকে তুমিই চিরকাল রক্ষা কোরো।”

ক্লান্ত, ধীর, গম্ভীর গলায় উত্তর দেন দেবী ভবানী, “চিরকাল করব। সন্তানকে রক্ষা করাই তো মায়ের ধর্ম!”

দ্বিতীয় পর্ব

আদি মায়া আদি শক্তি দেবীর পূজা শেষ করলেন গজানন অভয়ংকর। ভোর তখনো পুরো আকাশ আলোয় আলো করে দেয়নি। বংশপরম্পরায় গজাননরা এই মন্দিরের ‘মহান্ত’ বা মুখ্য পুরোহিত। কঠিন সময় যাচ্ছে দেশে। মারাঠা রাজ্য সারা ভারতে ক্রমবর্ধমান মুঘল আধিপত্যের দাপটে একে একে দুর্গ, অঞ্চল, স্বগরিমা সকলই হারিয়ে ফেলছে। তবু এই তুলিজা ভবানী মাতার মন্দিরের নিয়ম পালনে এতটুকু শৈথিল্য আসতে দেননি গজানন। তাঁর অচল বিশ্বাস— দেবীই মারাঠা গৌরব পুনরুদ্ধার করবেন যথাসময়ে।

তাঁর বিশ্বাস ইদানীং আরো গভীর হয়ে উঠেছে শিব্বারাও এর কার্যকলাপে। অভয়ংকর পরিবার সেই দেবীমন্দির স্থাপনের সময় থেকে এখানে পুরোহিত। গজাননের স্নেহের পাত্র শিব্বারাও তথা মারাঠি মানুষের মনে আশার আলো জাগিয়ে তোলা শিবাজি মহারাজের বংশের কুলদেবীও এই তুলিজা ভবানী মাতা। কথিত আছে, মন্দাকিনী নদীতীরে কুকুর নামের এক অসুরকে বধ করে সাধ্বী অনুভূতি ও তাঁর পুত্রকে রক্ষা করেছিলেন দেবী ভবানী। কথা দিয়েছিলেন তাঁর সন্তানদের রক্ষা করবেন সর্বদা। সেই মানবীরূপা দেবীর অন্তর্ধানের পর তুলিজা নগরে স্বয়ম্ভূ দেবীমূর্তির আবির্ভাব হয়। অচিরে মন্দির গড়ে ওঠে, শহরের নামে দেবী পরিচিত হন তুলিজা ভবানী বলে।

নগরখানায় চৌঘড়া বেজে উঠে ঊষাকে প্রথম অভিবাদন জানাল। আদি মায়া দেবীর অপেক্ষাকৃত ছোটো মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন গজানন। এবার তাঁকে মূল ভবানী মন্দিরে দেবীর চরণতীর্থের আয়োজন করতে হবে। এত ভোরেও কিছু ভক্ত এসে দর্শন ও পূজনের অপেক্ষায় আছে। গজানন আসন গ্রহণ করলেন। তাঁর সামনে বেদীতে তিন ফুট উচ্চতার, গ্রানাইটের নিকষ সুন্দর মূর্তি। দেবী অষ্টভুজা, এক হাতে অসুরের ছিন্ন মুণ্ড, অন্যান্য হাতে অস্ত্রশস্ত্র।

দেবীর হাতের তরবারিটি আজ বেশিই ঝকঝক করছে যেন। নাকি আধো অন্ধকার থেকে প্রদীপের উজ্জ্বল আলোয় আসার ফলে চোখের ভুল? মন দিয়ে উষ্ণ, সুগন্ধী জল আর দুধ দিয়ে দেবীর পা ধুইয়ে দেবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন গজানন।

***

নদীর ধারে বসে থাকতে বড় ভাল লাগে রঘুবন্তের। নাম বীরত্বব্যঞ্জক হলে কি হবে, স্বভাবে সে ভারি ভীরু আর কোমল। পনেরো পেরিয়ে ষোলোয় পা দিয়েও কিন্তু বয়সোচিত দৌরাত্ম্য, চপলতা, অহং— এ-সব কিছুই তার স্বভাবে নেই। সে পড়তে ভালবাসে। একা-একা নির্জনে বসে চিন্তা করতে ভালবাসে। ভিড়ভাট্টায় তার ভারি অস্বস্তি হয়।

তার মা নেই। বাবা অম্বাজি পটেল ছোটো ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন অনেকদিন হল। গ্রামমুখ্য হিসেবে তাঁর অনেক দায়িত্ব। তারই পাশাপাশি বড়ো ছেলেদু’টিকে মন দিয়ে ব্যবসা ও জীবনের নানা কূটকচালির পাঠ দেওয়ায় ব্যস্ত আছেন তিনি।

আজ ভবানী মাতার মন্দিরে শিবাজি মহারাজ আসবেন পূজা দিতে। বাবা তার দাদাদের সঙ্গে নিয়ে সেই উপলক্ষ্যে মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হতেই রঘুবন্ত চলে এসেছিল তাদের গ্রামের প্রান্তে এই বোর নদীর ধারে। অল্প জঙ্গল পেরিয়ে ভিতরে গেলে একটা সুন্দর, খোলামেলা ঘাসজমি আছে। রঘুবন্তের প্রিয়তম জায়গা ওটাই। ওই ঘাসের গালচেতে শুয়ে-শুয়ে কত যে অলস দুপুর বিকেল কেটেছে সে তার মনেও নেই। শেষে গরু-ছাগলদের ঘাস খাওয়াতে আসা কোনো রাখাল ছেলে হয়তো ওকে ডেকে নিয়ে গেছে সুয্যি ডোবার আগে।

ঘাসজমিটা একেবারে ফাঁকা দেখে রঘুবন্ত বুঝল, এও শিবাজি মহারাজের দান। তাঁর আগমন মানেই মন্দিরে ভোজ। সবাই নিশ্চয় সেখানেই গেছে। আয়েস করে একটা শিরীষের ছায়ায় শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়ে রঘুবন্ত। সামনের এই নদীর মতোই বিস্তৃত অথচ অজানা এক ভবিষ্যৎ পড়ে রয়েছে তার জন্য। কী করবে সে? বাবা চান, সেও তাদের ব্যবসার হালহকিকত বুঝে নিক। তার মন লাগে না। সেই ইচ্ছেয় ইন্ধন যুগিয়েছে শিব্বারাওয়ের একের পর এক কাহিনি। মুঘল, বিজাপুর, গোলকোণ্ডা— সবাইকে কাঁপিয়ে দিয়েছে শিবাজি মহারাজের বাহিনী। তাদের জয়গাথা যত শোনে সে, ততই তার রক্ত গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু বাবা বলেন, “এরাও আরেক দস্যুদল। খাজনার ওপর আরও খাজনা দিয়েই আমরা ফতুর হয়ে যাব। তার আগে আখের গুছিয়ে নিতে শেখ, বুদ্ধু!”

তার মন লাগে না এতে।

***

আজ গজাননের বড়ো চমক লাগছে বারবার। চরণতীর্থের শেষে পানপাতা দিয়ে পা মোছাতে গিয়ে গিয়ে হাতে খোঁচা খেলেন তিনি। এতকাল দেবীর সেবা করছেন, কখনো তো খেয়াল করেননি মায়ের পায়ের নখাগ্র এত ধারালো!

পঞ্চামৃত আর দধি সহযোগে অভিষেক সারলেন তিনি। তুপ-ভাথ, মানে ঘি-ভাতের নৈবেদ্য সাজিয়ে রেখে দিয়ে মন্দির ছেড়ে বেরোলেন গজানন। দ্বার বন্ধ করার আগে শেষ মুহূর্তে তিনি দেখলেন, থালাটি যেখানে রেখে এসেছিলেন সেখান থেকে দেবীর অনেকটাই কাছে সরে গেছে। সেই থেকে আতঙ্কে ভুগছেন গজানন। তিনি তো কিছুই টের পাননি! কিন্তু নিশ্চয় অসতর্ক কোনো মুহূর্তে তাঁর পায়ের ধাক্কাতেই এটা হয়েছে। হে মা ভবানী, পাপ নিও না মা!

ঠিক দ্বিপ্রহরে ধূপ আরতি করার জন্য কর্পূর দীপ হাতে মন্দিরকক্ষে ঢুকে স্থানু হয়ে গেলেন গজানন। পিতলের ভোগ নিবেদনের থালা শূন্য চেহারায় ঝকঝক করছে! বৃদ্ধের হাত কেঁপে দীপ মাটিতে পড়ে গেল। গত কয়েকমাস ধরেই মন্দিরে ধেড়ে ইঁদুরের উৎপাত বাড়ছে। আজ শিব্বারাও কে তাই নিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলবেন— এমনটা ভেবেও রেখেছিলেন তিনি। তার আগেই এই অনাচার হয়ে গেল! দেবীর ভোগ চেটেপুটে খেয়ে গেল পাপিষ্ঠগুলো! আজ কোন প্রসাদ তিনি তুলে দেবেন সমাগত ভক্ত আর তাদের আদরের শিবাজি মহারাজের হাতে?

পাপ, পাপ! না জানি কোন শাস্তি এবার নেমে আসতে চলেছে তাঁদের ওপর।

***

রঘুবন্ত শুয়ে শুয়ে শিবাজি মহারাজের কথাই ভাবছিল। এমন সেনানায়ক মারাঠারা বহুকাল দেখেনি। রঘুবন্ত তাঁকে দেখেনি, তবে অনেক গল্প শুনেছে। এমনকি মুঘল বাদশারাও এই ‘পাহাড়ি ইঁদুর’-কে সমীহ করে চলে। অথচ তাঁকে দেখে নাকি বোঝা মুশকিল, কতটা বিপজ্জনক তিনি। বেঁটে মজবুত চেহারা, বলিষ্ঠ কাঁধ, আজানুলম্বিত হাত— ব্যস। তার পাশাপাশি রঘুবন্তের হাত কেমন? নিজের ফ্যাকাশে পাতলা হাতের মুঠো তুলে দেখতে গিয়ে হেসেই ফেলে সে।

খুব মৃদু খসখস আওয়াজ হয় কোথাও। ঘাসজমি পেরোলে ওপাশে ঘন বন। হবে কোনো খরগোশ-টরগোশ। রঘুবন্ত চোখ বোজে।

***

গজানন বৃথাই চিন্তা করছিলেন। শিবাজি মহারাজ দুপুরের মধ্যে পৌঁছোতে পারলেন না। কোনো জরুরি মন্ত্রণায় তিনি আটকে আছেন— এমনই খবর এল। বাকি ভক্তদের দ্বিতীয়বার রান্না করা ভাতের সঙ্গে সকালের ভাজি-প্রসাদ দিয়ে মানরক্ষা করলেন তিনি। একটু কানাকানি হল এ নিয়ে। রাজার জন্য ভোগপ্রসাদ সরিয়ে রেখে সাধারণ ভক্তজনদের বঞ্চিত করা হল— এমনও ভাবল কেউ। কী আর করা!

সূর্য তখন অস্তাচলে। দীপাভিষেকের সময় হচ্ছে। এদিকে শিবাজি মহারাজ তখনো এসে পৌঁছোননি। গজানন মরমে মরে ছিলেন। আজ সকাল থেকে সবই কেমন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে!

এতদিন বর্ষাকাল চলছিল, মুঘলরা যুদ্ধ বন্ধ করে নিজেদের কোটরে চুপ করে বসেছিল। বর্ষা শেষ হয়ে দশহরা উৎসব আগতপ্রায়। এখনই মাতার মন্দিরে এমন সব অঘটন! এ কীসের ইঙ্গিত? চিন্তিত মনে মন্দিরকক্ষে প্রবেশ করেই আর্ত চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ।

বেদী শূন্য।

***

রঘুবন্ত চোখ খুলেই আঁতকে উঠল। এতখানি আঁধার নেমে এসেছে! আজ তাকে ডাকার কেউ ছিল না বলে সে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সূর্য প্রায় ডুবে গেছে। আকাশে লেগে থাকা অস্তরাগের ম্লান আভা নদীর জলে ভেসে আছে। গ্রামে যাওয়ার পথ বেশ লম্বা, সেও জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। এই অন্ধকারে সেখান দিয়ে যাওয়া মানে তো…!

প্রাণপণে দৌড় লাগাল রঘুবন্ত। এই জঙ্গলে রাখাল, কাঠকুড়ানি সবাই যাতায়াত করে ঠিকই, কিন্তু সে দিনমানে। দিনমণি ডুবলে জঙ্গলের ইজারা নেয় বন্যপ্রাণীর দল। বাঘ বা ভাল্লুক নাই থাক, শিয়াল-নেকড়ে বিরল নয় এ অঞ্চলে। তাছাড়াও আছে সাপ! ওই কথাটা মনে পড়ায় গতি কমাতে বাধ্য হল রঘুবন্ত। যতই অন্ধকার হোক, দেখে দেখে পা ফেলতে হবে।

তেমনই ফেলছিল। সন্তর্পণে, সতর্ক চোখে। চোখের কোণ দিয়ে আবছা একটা ঝলক সরে যাওয়া দেখতে পেল যেন। লহমায় ঘুরল রঘুবন্ত। কিন্তু কোথায় কী? চারদিক তেমনই খালি, তবে আগের মতো নিঃশব্দ নয় যেন আর। অনেক পাখির ডানা ঝটপটানি শোনা যাচ্ছে। গাছের উপরের ডাল থেকে শোনা যাচ্ছে বাঁদরদের ব্যস্ত হুপহাপ। রাত হচ্ছে, রাতচরাদের ঘুম ভাঙছে।

আবার এগোতে গেল যশোবন্ত। তখনই, বাজ পড়ার মতো আচম্বিতে সাক্ষাৎ মৃত্যুর দূত নেমে এল তার ঠিক সামনের গাছ থেকে।

চিতা!

দীর্ঘ, পেশল, সবল হলুদ শরীর। সর্বাঙ্গে কালো চাকা দাগ। আগুনজ্বলা হলুদ চোখের নিষ্ঠুর দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ। লেজের ডগাটুকু অবধি নিষ্কম্প। ঝাঁপ দেওয়ার জন্য তৈরি সে।

কেন যে ও বাবা দাদাদের সঙ্গে ভওয়ানী মাতার মন্দিরে গেল না! রঘুবন্ত টের পেল তার হাঁটু কাঁপছে ভয়ে। তার মন জুড়ে এল একটাই প্রার্থনা, রক্ষা করো মা গো!

ঠিক তখনই রঘুবন্তের মাথার পিছন থেকে একটা পাথর উড়ে এসে লাগল চিতার মাথায়। তার পর আরো একটা। তারপর আরো! মাথা দু’হাতে চেপে ধরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সে।

চিতাটা হতচকিত হয়ে পড়েছিল এই অতর্কিত আক্রমণে। কয়েক পা পিছিয়েও গেছিল অনর্গল পাথরের বৃষ্টি থেকে বাঁচতে। তবে শুধু পাথর নয়, এবার ধেয়ে এল অন্য কিছু। এক ভয়ংকর হুংকারে কেঁপে উঠল গোটা বনাঞ্চল। ওইরকম ক্রুদ্ধ তেজী হুংকার মানুষ বা পশু— কেউই শোনেনি তার আগে। রঘুবন্ত ত্রাসে দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে পাশের গাছের গুঁড়ির আড়ালে চলে গেল। চিতাটা পালাল না। কিন্তু তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি আর ঘনঘন ল্যাজ নাড়া বলে দিচ্ছিল যে সেও সন্ত্রস্ত।

এক মহিলা বেরিয়ে এলেন সবুজাভ অন্ধকার থেকে।

আঁটোসাঁটো মলিন লাল শাড়ি, রুক্ষ জটায় ভরা চুল চুড়ো করা। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ উল্কিখচিত হাতে ঝকঝক করছে একটা টাঙি গোছের অস্ত্র। এই মধ্যবয়সী আদিবাসী মহিলা যে এমন হুহুংকার করতে পারেন— এটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না রঘুবন্তের। কিন্তু তারপর যা দেখল তাতে তার বিশ্বাস অবিশ্বাসের সীমারেখা উড়ে গেল চিরকালের মতো।

বিদ্যুৎগতিতে মহিলা চিতাটাকে আক্রমণ করলেন। শিবাজি মহারাজের বিক্রম প্রায় কিংবদন্তি হয়ে গেছে সবার কাছে। কিন্তু তিনিও এমন আক্রমণ করতে পারতেন কিনা সন্দেহ! উদ্ভ্রান্ত চোখে রঘুবন্ত শুধু দেখল হলুদ কালো রঙের আর কালো হাতে টাঙির সোনালি ঝলকের বিস্ফোরণ। কানে শুনল শুধু সেই ভয়াল গলায় দুর্বোধ্য উচ্চারণ আর আহত চিতার যন্ত্রণার আঘাত।

কতক্ষণ হবে? হয়তো মাত্র কয়েকটি মুহূর্ত। চিতা হার মেনে যেমন আচমকা এসেছিল তেমনি আচমকা পালিয়ে গেল। আদিবাসী মহিলাটি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছিলেন। শাড়ির পাড়ের কিছু অংশ চিতার নখের আঘাতে ঝিলিমিলি ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েছে। পা ধূলিধূসরিত কর্দমলিপ্ত। একটু দম নিয়েই তিনি টাঙিটা কোমরে গুঁজে, রঘুবন্তকে হাত নেড়ে ইশারায় উঠতে বললেন। তারপর দৃঢ় রুক্ষ হাতে ওর হাত চেপে ধরে বড়ো-বড়ো পা ফেলে তিনি চললেন গ্রামের দিকে।

পাহাড়ি ঢাল বেয়ে দ্রুত নামছিল দু’জন। গ্রামে পৌঁছোবার আগের বাঁক ঘুরতে গিয়ে রঘুবন্ত দেখল, ঘনায়মান অন্ধকারকে আরো গাঢ় করে এক মেঘের পুঞ্জ ছুটে আসছে নীচের সর্পিল পথ বেয়ে। ও পথ গিয়ে থেমেছে ভবানী আঈ এর মন্দিরে। কারা আসছে বুঝতে দেরি হল না রঘুবন্তের। স্থান-কাল ভুলে উল্লাস প্রকাশ করে ফেলল সে, “শিব্বারাও!”

থেমে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন মহিলা। তারপর ওর দিকে, এই প্রথমবার তাকালেন তিনি। কালো ত্বক। উল্কির সবুজ দাগ। কানে খুব পুরোনো ঘরানার বিশাল কানবালা। ঘোর লাল চোখ। এগুলো বাদ দিলে, হুবহু তার মরা মায়ের মুখ।

অপার্থিব স্নেহময় একটা হাসি খেলে গেল সে মুখে। মাথার ওপর খুব আলতো একটা স্পর্শ পেল রঘুবন্ত। তারপর সেই পিত্তল-কঙ্কন-শোভিত হাত স্পষ্ট আঙুল বাড়িয়ে সেই অপসৃয়মান মেঘের দিকে দেখাল। পরক্ষণেই পিছন ফিরে জঙ্গলের মধ্যে অতি দ্রুত গতিতে মিলিয়ে গেল সেই মাতৃমূর্তি।

রঘুবন্তও প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল। গ্রামের দিকে নয়, মন্দিরের দিকে। মনস্থির করা হয়ে গেছে তার। দেশের এই দুর্দিনে সে কিছুতেই গ্রামের ক্ষুদ্র রাজনীতিতে জড়াবে না। দাদাদের পদাঙ্ক অনুসরণ না করে সে যোগ দেবে তার শিব্বারাওয়ের দলে। মা সেই পথই দেখিয়ে গেছেন।

***

শিবাজি ঘোড়া থেকে নেমেই বুঝলেন, কোথাও কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। আজ অবধি কখনো দেখেননি মহান্তজি এমন ম্লান বিষণ্ণ মুখে তাঁকে আপ্যায়ন করছেন। তিনি বুদ্ধিমান। কারো সামনে মুখ খোলা উচিত নয় বুঝে সবাইকে চলে যেতে বললেন। বললেন, তাঁর কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে মহান্তজির সঙ্গে। জায়গাটা নিরিবিলি হতে ছোটো থেকে দেখা পিতৃব্যতুল্য মানুষটিকে প্রশ্ন করলেন শিবাজি, “কী হয়েছে, একটু খুলে বলুন তো।”

“কী বলব, ভেবে পাচ্ছি না শিব্বা।” হাহাকার করে উঠলেন গজানন, “তুমি নিজেই দেখে এসো বরং। মাতা পরম কুপিত হয়ে আমাদের ছেড়ে গেছেন। সর্বনাশ হয়ে গেছে আমাদের!”

এতখানি অমঙ্গলজনক কিছুর আশঙ্কা করেননি শিবাজি। দুরুদুরু বুকে গজাননের পেছনে দেবীমন্দিরে ঢুকলেন তিনি। কিন্তু কই? অমঙ্গলের কোনো চিহ্ন তো দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি! কষ্টিপাথরের মূর্তি বেদীর উপর দাঁড়িয়ে তেমনি স্নেহভরা চোখে চেয়ে আছেন ভক্তের দিকে। বরং অন্যবারের চেয়ে এবার যেন সে চোখ আরো জীবন্ত, আরো বীরত্বমহিম লাগল তাঁর।

গজাননও হতবাক হয়ে চেয়ে ছিলেন। এ কী আশ্চর্য লীলা! তবে কি তাঁর দৃষ্টিভ্রম হয়েছিল? কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব? ভোগের থালা, শূন্য বেদী— পরপর এত বিভ্রম হতে পারে?

ততক্ষণে শিবাজী সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। বেরিয়ে যাওয়ার আগে লঘুহাস্যে গজাননের বাহু স্পর্শ করে বললেন, “আপনার ভুল হয়েছিল মহান্তজি। মা কখনো বিপদকালে ছেলেকে ছেড়ে যেতে পারেন? যান, নিশ্চিন্তে দেবীমার শয়নের ব্যবস্থা করে নিন। তারপর অনেক কথা আছে।”

তাই হবে। গজাননের চোখ বোধহয় এবার বার্ধক্যের অমোঘ গ্রাসে পড়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি ভাবলেন, বড়ো ছেলে চতুরানন তৈরি হয়েই আছে। ওকেই এবার মায়ের মোহান্ত করে দেবেন। শিব্বারাওকে আজই বলে রাখবেন কথাটা।

গোমুখ থেকে আনা পবিত্র গঙ্গাজল দিয়ে প্রক্ষালন পর্ব সারছিলেন তিনি। মূর্তির পায়ের কাছে এসে আবার থমকে যেতে বাধ্য হলেন গজানন। চোখ গেছে সত্যিই! এই নিয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। নইলে, মায়ের পায়ে লেগে থাকা এই এত ধুলমিট্টি সকালে কীভাবে ওঁর নজর এড়িয়ে গেল? তাছাড়া, শাড়ির নীচের অংশের অনেকটা জায়গা জুড়ে কারুকার্যও কেমন অন্যরকম লাগছে। একদিকের পাড়ে এতটা জায়গা জুড়ে এমন সরু আর বেখাপ্পা এঁকাবেঁকা দাগ আগে ছিল নাকি? দাগগুলো হলই বা কীভাবে?

দেখে তো মনে হয়, এগুলো কোনো বড়ো শ্বাপদের নখের আঁচড়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *