বাতিঘর

বাতিঘর

মুম্বাই থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা দিলেই হল। ঘন্টা দুইয়ের মধ্যে কোঙ্কন উপকূল একের পর এক নামবাহারি সৈকত নিয়ে লা-জবাব ছুটি কাটানোর মুড বানিয়ে দেবে। পরপর আসবে কিহিম, কাশিদ, দিভেগড়, হরিহরেশ্বর, মরুদ-জাঞ্জিরা, ভেলনেশ্বর, জয়গড়, গণপতি ফুলে, মালভন-তারকার্লি হয়ে সোজা পাঞ্জিম। সমুদ্রসৈকতের কালচে বাদামি বালি থেকে আস্তে-আস্তে হলদে থেকে সোনালি হয়ে সাদা হয়ে উঠবে।

এদের প্রত্যেকটিই একেবারে টিপিকাল আলসেমি মাখা কোঙ্কনি বিচ। বালি আর জল গলা জড়াজড়ি করে পড়ে আছে। কাছে কোথাও পুরোনো ফোর্ট, কোথাও গণেশ মন্দির, কোথাও বা চার্চ। সারাদিন আয়েস করে জলকেলি করো। তারপর জম্কে সামুদ্রিক মাছ দিয়ে ভাত খাও, লাল-লাল, ঝাল-ঝাল। যত দক্ষিণে যাওয়া যায়, রান্নার স্বাদ ততই পালটায়। শুকনো লঙ্কার ঝালের সঙ্গে নারকেলের মিষ্টত্ব মিশে যায় তত বেশি করে। আয়েসে দিন কাটাও, আর সন্ধেয় বিয়ারের বোতল কি নারিয়েল পানি নিয়ে বসে বসে সূর্যাস্ত দেখো।

তারপর কী হবে সেটা ডিপেণ্ড করছে সঙ্গে কে বা কারা আছে তার ওপর।

আমার বাংলা নিয়ে ভ্রূ কুঁচকোবেন না। মা বাতিকগ্রস্তের মতো বাংলা-বাংলা করত বলে বাংলা শিখেছি। বাড়িতে কিছুতেই হিন্দি বলতে দিত না বলে মোটামুটি বলতে পারি ভাষাটা। নইলে আজন্ম মুম্বইয়ের ছেলে আমি, হিন্দি বা মারাঠিতেই গল্প বলতাম আপনাদের।

তবে আজ একটু বেশিই ভালো বাংলা বলছি। আসলে, রেগে আছি তো!

রাগব না কেন বলবেন? শালা! এত করে পটিয়েপাটিয়ে এবার কলেজের পোস্ট-এক্সাম ব্রেকে ঘুরতে এলাম— আমি, দীপ্তি, শচীন আর তার দিদি সুবর্ণা। তখনই শচীনকে বলেছিলাম, “দিদি এলে মুশকিল হবে।”

সে বলে, “কিস্যু অসুবিধে হবে না তোদের, আমার দিদি খুব কুল।”

তা দেখেও তাই মনে হয়েছিল। টাইট টি-শার্ট, শর্টস, সানগ্লাসে পুরো বিচের চোখ টানতে পারে। শুরুতে বেশ একটু গা গরম লাগছিল দেখে, মিথ্যে বলব না। কিন্তু তারপর বুঝলাম, কুল নয়। তিনি একেবারে আমড়া!

যখনই আমি আর দীপ্তি একটু একা কথা বলছি, তিনি এসে হাজির হচ্ছেন। মেয়েটা আবার আমাদের গায়ে-পিঠে হাত না রেখে কথা বলতে পারে না। যেমন বোকা বোকা কথা, তেমনি হিঁ-হিঁ করে ন্যাকা হাসিতে ঢলে পড়া। এতে দীপ্তি আমার ওপর এত রেগে গেল কেন বলুন তো?

ভুলের মধ্যে আমি বলে ফেলেছিলাম, “আরে ইয়ার! শি ইজ ভেরি হট। সো হোয়াট? তু ভি ড্রেস আপ কর না। তেরেকো ভি মস্ত্ লগেগা।”

ব্যস! আমি নাকি ওই ঢ্যাঁড়শসুন্দরীর প্রশংসা করেছি। দীপ্তিকে হট নয় বলেছি। দীপ্তি সাজগোজ করতে পারে না বলেছি। আরো কী কী করে ফেলেছি রাম জানে! তারপর দীপ্তি আমাকে যা মুখে এল সব শোনাল। আর সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানেন? এত কিছুর পর ওই মেয়েটার সঙ্গেই গলা জড়াজড়ি করে শপিং করতে আর বিচে বেড়াতে চলে গেল!

শচীনটা অবধি দিদির পোঁ ধরে গেল ব্যাগ বইতে। আমায় ডেকেছিল দিদিমণি। যাইনি।

এই এতক্ষণে একটা জানলা পেয়েছি একটা। দাঁড়াই একটু। হাঁফ ধরে যাচ্ছে এবার।

ট্রিপটা ভালোভাবেই শুরু হয়েছিল। আমরা অবশ্য কোস্ট ধরে গাড়িতে আসিনি। দাদার স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছি বৃহস্পতিবার বিকেলে, পাঞ্জিম নেমেছি শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটা। উঠেছি আগে থেকে বুক করে রাখা সি-ভিউ হোটেলে। শুক্র শনি রবি তিনদিনে পাঞ্জিম, ডোনা পাওলা— সব দেখে নিয়েছি। গতকাল, মানে সোমবার কেটেছে কাছের সান জ্যাসিন্তো আয়ল্যান্ড দেখতে গিয়ে।

আয়ল্যান্ডটা খুব সুন্দর কিন্তু! সিলভার গেট নামের একটা ব্রিজ পেরিয়ে যেতে হয়। একেবারে সবুজে ঢাকা দ্বীপটা। সাদা ধবধবে একটা চার্চ আছে, তার সামনে একটা সুন্দর স্ট্যাচুও আছে। সেখান থেকে একটু দূরে আছে একটা পুরোনো লাইটহাউস। কাল সেটা দেখা হয়নি আমাদের। কাছ অবধি হেঁটে গেছিলাম। কিন্তু এত ঝোপঝাড় আর আগাছা গজিয়ে আছে চারদিকে যে তাই দেখেই ওরা কেউ আর উঠতে চাইল না। আমারও তখন খুব একটা ইচ্ছে হয়নি।

মানে, তখন তো আর ঝগড়াটা হয়নি। আজ ওরা বেরিয়ে যাবার পরই ঝোঁক চাপল। ঘরে বসে থেকে কী হবে? যাই, দেখে আসি টং-এ চড়ে কদ্দূর দেখা যায়। আগাছাই থাক আর অব্যবহৃতই হোক, জিনিসটা এখনো বেশ মজবুত আছে মনে হয়েছিল দেখে। অবশ্য ভিতরের সিঁড়ি ভাঙা থাকতেই পারত, আর সেটা হলে আমায় ফিরেই যেতে হত মাঝপথে। কিন্তু এই যে একশো তেত্রিশটা সিঁড়ি উঠলাম, এখনো অবধি কই কিছু ভাঙাচোরা দেখলাম না তো। ভিতরটা ইন ফ্যাক্ট বাইরের চেয়েও বেশি শক্তপোক্ত আছে মনে হচ্ছে। স্বাভাবিক, সমুদ্রের নোনা হাওয়া কম লেগেছে। ক্ষয় কম হয়েছে তাই।

বহু বছর ধরে এটা নাকি এমনই পড়ে আছে— অব্যবহৃত, পরিত্যক্ত। তাই তো বললেন কালকের ভদ্রলোক। কাল সন্ধেবেলা ঘরের সামনে, রাস্তার ধারের বেঞ্চে বসে “লাইটহাউসটা দেখা হল না” গোছের কথা হচ্ছিল আমাদের মধ্যে। তখনই উনি সামনে দিয়ে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। উনি মানে হোটেলের রিসেপশনিস্ট ভদ্রলোক। দোহারা বয়স্ক চেহারা, চুল পাতলা, মুখে সমুদ্রহাওয়ার আঁকিবুঁকি ভরা।

“ওখানে না গিয়ে ভালো করেছ, বাচ্চেলোগ। বহু বছর পড়ে আছে অমন, ব্যবহার হয় না। কেউ নেই দেখভাল করার। ট্যুরিস্টরা কেউ যায় না।”

একটু থেমে যোগ করেছিলেন, “না যাওয়াই মঙ্গল।”

তখনই কেমন খটকা লেগেছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কেন আঙ্কল? ভেঙে পড়ার ভয় আছে নাকি?”

“না। তা নয়। তবে… সাপখোপ, বিচ্ছু— কোথায় কী আছে ঠিক নেই। কী দরকার যাওয়ার?”

কোথাও যেন একটা অস্বস্তি ছিল। কথায়? চাউনিতে? কী জানি।

“ইশ্, লাইটহাউসটা চালু থাকলে রাত্রে কী সুন্দর আলো দেখা যেত!” বলে উঠেছিল শচীন।

“চালু নহিঁ হ্যায়। পর লাইট কভি-কভি দিখতা হ্যায়।”

এরকম উদ্ভট হেঁয়ালি শুনে পাগলের প্রলাপ ভেবে হো-হো করে হেসে ফেলেছিলাম আমরা। বেশ বিরক্ত হয়ে হেঁটে চলে গেছিলেন ভদ্রলোক।

ভুলেও গেছিলাম কথাটা। আজ এখন, এই লাইটহাউসের মাঝমধ্যিখানের ছোট্ট জানলায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল। অমন না হেসে, কাল পুরোটা শুনলেই হত। কথাটা সত্যি হতেও তো পারে। অসম্ভব কি একদম?

পুরোনো কলকব্জা, কোথাও হয়তো কিছু ঢিলে হয়ে আছে। হয়তো সেরকম জোরে কোনো বিশেষ দিক থেকে হাওয়া দিলে কানেকশন জুড়ে গিয়ে আলোটা জ্বলে ওঠে। সে ব্যাপারটা ধরে ফেলতে পারলে মন্দ হয় না! এরকম একটা ‘মিস্ট্রি অফ দ্য লাইট অ্যাট নাইট’ গোছের রহস্য সমাধান করে ফিরি যদি, দীপ্তি কি যথেষ্ট ইম্প্রেসড হবে না?

না, উঠি আবার। আলো পড়ে আসার আগে বেরিয়ে যেতে হবে। যা জঙ্গল চারদিকে!

সেই জানলাটা থেকে আরো একশো চব্বিশ সিঁড়ি উঠে তবে চূড়ায় পৌঁছেছি। একদিনে দুশো সাতান্ন সিঁড়ি ভাঙা মুখের কথা নয়! হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছিলাম কুত্তার মত জিভ বার করে। কিন্তু সে ক্লান্তি দু মিনিটে হাওয়া হয়ে গেল ওপরে উঠে! এমন দৃশ্য আমি আজ অবধি কখনও দেখিনি।

একটা সরু গোল বারান্দা আছে লাইটহাউসটা ঘিরে। তুমুল হাওয়া দিচ্ছে। পিছনদিকে লাইটহাউসের দেওয়ালটুকু বাদ দিলে, দু’দিকে যতটা চোখ যায় ততখানি শুধু সমুদ্র আর আকাশ। নীল আকাশ, নীল জল। নিরিবিলি সমুদ্রের বুকে আলতো করে বয়ে যাচ্ছে আরব সাগরের আয়েসি ঢেউ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম দৃশ্যটা। আমার ঠিক সামনে, একটু বাঁদিক ঘেঁষে, সূর্য ক্রমে কমলা থেকে গোলাপী হচ্ছিল।

গোলাপি?!

মার্ ডালা! এতটা নামতে হবে যে এখন আমায়! সূর্য ডোবার আগে বেরিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম। চারদিকে কোথাও আলো নেই তো। এতক্ষণ ধরে এই সিনারি দেখতে গিয়েই বিপদ হল দেখছি।

হুড়মুড় করে নামতে শুরু করেই বিশাল হোঁচট খেলাম। দেওয়াল ধরে সামলানোর পর টের পেলাম, বুক ধড়ফড় করছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। সামলাতে না পারলে আজ আর দেখতে হত না। এই খাড়াই সিঁড়ি ধরে এতখানি গড়ালে মাথা ফাটত, হাত পা ভাঙতই।

ব্রিদ-ইন ব্রিদ-আউট। ব্রিদ-ইন ব্রিদ-আউট। বেশ কিছুক্ষণ এই করে নিজের ওপর একটু কন্ট্রোল আনি। ভয় কমতেই নিজের ওপর রাগ হতে শুরু করল। সঙ্গে টর্চ না নিয়ে, মোবাইলে চার্জ কম জেনেও গাড়োলের মতো এখানে ঢুকতে কে বলেছিল আমাকে? পুরোটা নামার আগেই সূর্য ডুবে যাবে মনে হচ্ছে। মানে অন্ধকারে নামতে হবেই।

তবে ওঠার সময়েই দেখে নিয়েছিলাম— সিঁড়ি পরিষ্কার, ফাটা ভাঙা নেই, সমান উঁচু নীচু। টাওয়ারের মধ্যে হাওয়াও চলছে। তাই অন্ধকার হয়ে গেলেও দেওয়ালে হাত রেখে নেমে যেতে পারব। মোবাইলটা আপাতত পকেটে থাক, বেরিয়ে বার করব। ঝোপঝাড়ে বরং আলোটা বেশি কাজে আসবে। ঘাবড়ানোর তো কিচ্ছু নেই!

যুক্তিটা আরো দুবার মনে-মনে আউড়ে নিজেকে শান্ত করলাম। তারপর পা বাড়ালাম। যেটুকু প্যানিকড লাগছিল তা কাটানোর জন্য আবার সিঁড়ি গোনায় মন দিলাম। এক…দুই… তিন….

এই নিয়ে তিনবার চেষ্টা করল দীপ্তি। অর্ণবকে ফোনে পাওয়াই যাচ্ছে না। যা রাগী ছেলে, দিয়েছে হয়তো সুইচ অফ করে। রেকর্ডেড মেসেজ অবশ্য বলছে ‘আউট অফ কভারেজ এরিয়া’, মানে ও যেখানে আছে সেখানে নেটওয়ার্ক নেই। কে জানে কোথায় গিয়ে বসে আছে।

মুখ তুলে ও দেখল, সুবর্ণা আবার একটা টি-শার্টের দোকানে ঢুকছে। কত কিনবে রে বাবা?

“দীপ্তি, ইয়ে দেখ্! ইয়ে কালার চাহিয়ে থা না তুঝকো?”

হুঁশ আছে তো মেয়েটার! দীপ্তি সব দোকানে এই রংটাই খুঁজছিল আজ। ফোন ব্যাগে ঢুকিয়ে দৌড়ে যায় সে।

*****

দেওয়ালের ছোট্ট ফাঁকগুলো দিয়ে পড়ন্ত আলোর আভাস আসছিল। সেটা কমতে-কমতে একেবারেই গায়েব হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হল। জমাট অন্ধকার কাকে বলে, সেটা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি এবার। চোখ খুলে রাখি বা বন্ধ— একই ব্যাপার। তবে তাতে আমার নামতে অসুবিধে হচ্ছে না। ডানহাত দেওয়ালে রেখে পা ঘষে ঘষে দিব্যি নেমে যেতে পারছি। গোনা একবারের জন্যও বন্ধ করিনি। অন্ধকারে ওটাতেই কন্সেনট্রেট করতে হচ্ছে ফোকাস ধরে রাখার জন্য। সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে— আমি জানি। বেরিয়ে সাবধানে আগাছা ভরা জায়গাটা পেরোতে হবে শুধু।

একশো একুশ… একশো বাইশ…

এতক্ষণ অন্ধকারে নামার পর হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখে চোখ কেমন ধাঁধিয়ে গেছিল। কেঁপে উঠেছিলাম পুরো। পরক্ষণেই আলোটা সরে গেল সামনে থেকে।

ব্যাপারটা কী হল? ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আলোটা দ্বিতীয়বার ঘুরে আসাতে বুঝলাম।

লাইটহাউসের চূড়ায় আলো জ্বলে উঠেছে। শুধু জ্বলেনি, সে আলো ঘুরে ঘুরে বিম পাঠাচ্ছে চারদিকে। জানলা দিয়ে সেই বিমই চোখে পড়েছিল আমার। ইশ! আরেকটু থাকলে মিস্ট্রিটা সত্যিই সল্ভ করে ফেলতে পারতাম।

আলোর রশ্মিটা আবার সামনে দিয়ে ঘুরে গেল।

যাকগে, এই নিয়ে ভেবে লাভ নেই। সেই জানলাটায় পৌঁছে গেছি মানে আদ্ধেক প্রায় মেরে দিয়েছি। বাকিটা নেমে পড়া যাক। তবে দীপ্তি খুব ইয়ে তো! সারা বিকেলে একটাও কল করল না!

*****

অন্ধকার নেমে এসেছে। ট্যুরিস্টরা কেউ-কেউ ফিরে এসেছে অলরেডি। বাকিরা ফিরবে আরো রাত্রে। রেস্টুরেন্টে ব্যস্ততা বাড়তে শুরু করবে আর ঘণ্টাখানেক পর থেকেই। জোসেফ ডি কুনহা এই সময়টায় একটু হাঁটতে বেরোন। এই রিসর্টের আশেপাশেই, চারদিকে একটা বড়ো চক্কর কেটে আসেন। বয়স পঞ্চান্ন ছাড়াল, এখন নিয়মিত এটুকু এক্সারসাইজ না করলে আর শরীর টিঁকবে না।

পঁচিশ বছরের ওপর হয়ে গেল এই চাকরি। জয়েনিং এখানে, তারপর মাঝে চাকরি পালটে গেছিলেন রত্নাগিরি, সেখান থেকে হরিহরেশ্বরে। মহারাষ্ট্রে মন টেকেনি, দশ বছর হ’ল আবার ফিরে এসেছেন এখানে। সিনিয়র ম্যানেজার এখন, শখ করে রিসেপশনেও বসেন সকালের দিকটা। নিজের একতলা বাড়ি করেছেন কাছেই। আশপাশের সব জায়গা হাতের তালুর মত চেনেন তিনি। তেমনই সমৃদ্ধ তাঁর স্থানীয় গল্পগাছার ভাণ্ডার। তবে আজকালকার ছেলেছোকরারা বুড়োর বকবকানি শুনতে চায় না।

কাল এমন এক দলের সঙ্গে যেচে কথা বলতে গিয়েই সেটা আবার টের পেয়েছেন জোসেফ। আরেকটু হলেই কাল ওদের কাছে বুড়ো জেলে সালভাদরের কাছে শোনা দ্বীপের লাইটহাউসের অতৃপ্ত আত্মার গল্প বলে ফেলছিলেন। সে গল্প সালভাদর শুনেছে তার বাবার কাছে, সে আবার শুনেছে তার বাবার কাছ থেকে।

“অনেক বছর পরে পরে, কোন অশুভ তিথিতে সে আত্মা জেগে ওঠে।” চোখ গোল-গোল করে বলেছিল সালভাদর, “লাইটহাউসের সঙ্গে তার পাতালপুরের লুকোনো যোগাযোগের দরজা যায় খুলে। তার সেই নারকীয় আনন্দে সে রাত্রে লাইটহাউসের আলো জ্বলে ওঠে। গোটা দুনিয়াকে যেন সংকেত পাঠায় সেই আত্মা! সে বলে, আরো একবার কোন মূর্খ হঠকারী সেই দরজা দিয়ে রওনা দিয়েছে চির-অন্ধকারের উদ্দেশে।”

কী বলত দলটা এসব শুনলে? আরো তাচ্ছিল্যে, আরো শ্লেষে হেসে উঠত নির্ঘাত। তিনিই বা কী উত্তর দিতেন এর পর ধেয়ে আসা সব প্রশ্নের? এত বছরে তিনি নিজেও তো কখনো ওই আলো জ্বলতে দেখেননি। শুধু গল্পটা শিহরণ জাগিয়েছে। তবে তিনি তো বুড়ো, পুরোনো যুগের মানুষ। এরা স্রেফ হাসত। ঠাট্টা করত। এটুকুতেই যা করল! সামনে থেকে চলে আসার পরও ওদের হাসিটা বেশ অনেকক্ষণ শুনতে পেয়েছিলেন তিনি।

টক অফ দ্য ডেভিল! ওই তো সেই দলটা আসছে বাইরের দিক থেকে। একটা মেয়ে আবার একগাল হেসে “নমস্তে আঙ্কল” বলে গেল। কালকের হাসিটা কানে লেগে ছিল। তাই উনি শুকনো মুখে শুধু একবার নড করলেন।

দলটা পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার পর মনে হল, কাল যেন আরো একজন ছিল এদের সাথে।

যাকগে, এদের নিয়ে ভাবার মানে হয় না। পুরো হোটেলটা চক্কর মেরে পিছন দিকের জেনারেটর রুমের পাশটায় দাঁড়ালেন জোসেফ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে ভালোই লাগছিল। তবু, রাত বাড়ছে দেখে বাড়ির উদ্দেশে পা বাড়াতেই আলোটা চোখের সামনে দিয়ে ঘুরে গেল।

জোরালো সার্চলাইটের আলো!

দ্বিতীয়বার আবার সামনের তটভূমি জুড়ে বয়ে যাবার পর জোসেফ চিনতে পারলেন ওটা কোথা থেকে আসছে। সামনের সান জ্যাসিন্তো আয়ল্যান্ডের লাইটহাউসের চূড়া থেকে।

জোসেফের সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল। খুব শীত করতে লাগল ওঁর।

*****

নিকষ অন্ধকার যে এমন দম বন্ধ করে দিতে থাকে সেটা জানা ছিল না। চোখে কিছু দেখছি না, কানে কোনো আওয়াজ আসছে না। একমাত্র জানলা বহু উপরে রয়ে গেছে, তাই আর বুঝতেও পারছি না লাইটহাউসে এখনো আলো জ্বলছে কিনা। কেমন যেন অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে, যেন জ্বর আসছে। ঘষটে-ঘষটে পা ফেলছি আর যন্ত্রের মত গুনে যাচ্ছি ধাপগুলো।

একশো আটানব্বই… একশো নিরানব্বই…

কী জোর জোর খিদে পেয়েছে রে! আজ রাতে ডাবল আন্ডা পুলাও আর একটা গোটা চিকেন জাকুত্তি একা খাব। চিকেন, না প্রণ? পরে ভাবব, আগে ঘরে ফিরে স্নান করে একটা বিয়ার নিয়ে বসি তো।

*****

ঘরে এসে দীপ্তি শচীনের ফোন চেয়ে নিয়েও ট্রাই করল একবার। সেই এক কথা। এখনো বলছে নাম্বার পরিষেবার বাইরে। গেল কোথায় মক্কেল? অবশ্য এখানে ওর নিজের ফোনেও প্রায়ই সিগনাল থাকছে না। ভুলভাল নেটওয়ার্ক।

সারা সন্ধে হাঁটা হয়েছে। সেইসঙ্গে গুচ্ছ শপিং— টি-শার্ট, জাঙ্ক জুয়েলারি, বাহারি ব্যাগ। পা টনটন করছিল ওর। খেতে যাওয়ার সময় যেন ওকে ডেকে দিতে বলে হাত-পা ধুয়ে শুয়ে পড়ল দীপ্তি। তার আগে আরো একবার অর্ণবের নাম্বার ডায়াল করল ও।

এবার একটা ধাতব গলা বলল, “দ্য ডায়ালড নাম্বার ডাজ নট এক্সিস্ট।”

এই জন্য! এই জন্য ভোডাফোন ইউজ করতে চায় না দীপ্তি। যত্ত ভুলভাল মেসেজ দেয়। চাদর টেনে বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে।

*****

কেমন লাগছে তাই বুঝতে পারছি না। অসহ্য গুমোট লাগছে। এদিকে মোড় ঘুরতেই হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া এল কোত্থেকে জানি। টাওয়ারের ভেন্টিলেশন ভারি আজব কিসিমের তো! কিন্তু আর ভাবতে পারছি না। এত ক্লান্ত কোনোদিন হইনি। মাথা ঘুরছে, গা গুলোচ্ছে। খিদের চোটেই বোধহয়। শক্ত সিমেন্টের দেওয়ালের গা-ও কেমন ভিজে আর স্যাঁৎসেঁতে লাগছে। হাত ঘেমে গেছে বলেই বোধহয়।

আর পারি না, উফ্। পা দুটো যেন লোহার মত ভারী হয়ে গেছে। টেনে টেনে ঘষে ঘষে তবু নামতে থাকি। কত হল যেন?

দুশো একানব্বই… দুশো বিরানব্বই… দুশো তিরানব্বই…!

[বিদেশি কাহিনির ছায়ায়]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *