কুল-দেওতা
খুব যত্ন করে প্যাক করে দেওয়া বাক্সটা হাতে আঁকড়ে, ছ’ফুটের দশাসই লালমুখ সাহেবটা থ্যাঙ্কু-ট্যাঙ্কু বলে বেরোল। আমি আর হেমল এতক্ষণ ধরে যে হাসিটা চেপে রেখেছিলাম, সেটা এবার ফেটে বেরোল। হেমলের মামাজি ক্যাশ কাউন্টারে বসেছিলেন। তিনি আমাদের মতো সশব্দে না হাসলেও ঠোঁটের কোণে মিচকি হাসিটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
হেমল আমার কলেজের দোস্ত। তখন থেকেই আসা-যাওয়া এই দোকানে। তখন থেকেই মামাজি’র কাছে তালিম। আমাদের হাসি থামলে, মামাজি ড্রয়ার থেকে একশো টাকা বার করে হেমলকে দিয়ে ঠান্ডা… মতলব কোকা-কোলা নিয়ে আসতে বললেন।
কাজের ফাঁকে ওটুকু দিয়েই সেলিব্রেশন হোক।
রঘুরামের হাতের কাজ মোটেই খারাপ না। দেশে থাকতে কাঠের মিস্ত্রি হিসেবে তার নামডাক ছিল। সূক্ষ্ম কারুকার্য ফোটাতে সে ভালোই পারে। দশ ইঞ্চি মাপের ওই হাতিটা নিয়ে কোনো মেলা বা দোকানের সামনে বসলে আরামসে দু’-তিনশো টাকা দাম তো পেতই। মামাজি সেটা তেত্রিশশো টাকায় বিক্রি করলেন। তাও আবার সাড়ে তিন হাজার দাম বলে দুশো টাকা ডিসকাউন্ট দিয়ে।
“আপ আতিথি হ্যায়। য়্যু নো আতিথি? গেস্ট। গেস্ট ইজ আওয়ার গড।”
কথা বলে লোককে পটানোতে মামাজির সমকক্ষ কমই দেখেছি। পাওয়াইয়ের কাছের এই শপিং মলে ‘ইন্ডিয়ান’ জিনিসপত্রের আরো বেশ কিছু দোকান আছে। কিন্তু দাম সবচেয়ে চড়া হওয়া সত্ত্বেও মামাজি’র ‘সুন্দরম’-এর বিক্রি সবচেয়ে বেশি। আশপাশে কর্পোরেট অফিসে এত বিদেশি আসে বলে পাওয়াই এমন জিনিসের খদ্দের পাওয়ার স্বর্গ। দেশে ফেরার সময় তারা সবাই একদম ভারতীয়, অথেনটিক, সম্ভব হলে অ্যান্টিক কিছু নিয়ে যেতে চায়। মামাজি সেখানে অতুলনীয়। আজকের সাহেবকে মামাজি বোঝালেন, এই হাতিটা ভীমাশংকর মন্দির চত্বরের এক প্রহরী হাতির রেপ্লিকা। বানানোর পর এটাকে সেই ভীমাশংকর মন্দিরের পূজারীতি অনুযায়ী সংস্কার করাও হয়েছে। তাই এটা যার ঘরে থাকবে, তার কোনো বিপদ-আপদ হবে না। কী নির্বিকারে মিথ্যে বলেন ভদ্রলোক— দেখলে অবাক হতে হয়। সাহেব তার ফিয়ান্সির জন্য গিফট খুঁজছিল। এসব বাক্যবাণে একদম ধরাশায়ী হয়ে জিনিসটা কিনে ফেলল।
মামাজি পুরোটাই মিথ্যে বলেননি অবশ্য। ভীমাশংকর মন্দিরে সারাক্ষণ লোকের আনাগোনা। সেখান থেকে কে ও-সব তুলবে? শুঁড়ে পদ্মফুল ধরা হাতিটা আসলে পাথরে খোদাই করা ছিল। সেটা রাখা ছিল জঙ্গলের মধ্যে ভাঙাচোরা গোছের একটা দেউড়িতে। রঘুরাম সেটা দেখে-দেখে কাঠে খোদাই করেছে। আসল পাথরটা মামাজি’র কাছেই আছে। সেটাও বিক্রি হবে পরে, অনেক বেশি দামে। সেটা সত্যিকারের অ্যান্টিক তো! সে-সব খদ্দেরদের আমি চিনি না।
আমি, মানে রাজেশ সান্যাল। সাতাশ বছর বয়স। অরিজিনালি বাঙালি হলেও বর্ন অ্যাণ্ড ব্রট আপ ইন মুম্বই। পড়াশোনায় কখনোই খুব দড় ছিলাম না। তবে হিন্দি আর মারাঠি সমানতালে বলতে পারি। প্লাস, আমার ট্রেকিং এর শখ আছে। সবমিলিয়ে ‘স্মার্ট ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস’-এ অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে চাকরিটা জুটে গেছে। আমরা ট্যুরিস্টদের নিয়ে ঘুরতে যাই বিভিন্ন জায়গায়। সেখানে তাদের থাকা-খাওয়া, ট্রিপ প্ল্যানিং, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে দেওয়াই আমাদের কাজ। সেরকম এক দলকে নিয়ে সেবার ভীমাশঙ্কর গেছিলাম। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ট্রেক করতে-করতে চোখে পড়েছিল ঝোপেঝাড়ে ঢাকা আধখানা ভাঙা দেউড়ি। কাছে গিয়ে দেখেছিলাম, ধার থেকে আলগা হয়ে প্রায় ঝুলছে এই খোদাই করা পাথরটা।
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার অজুহাতে দলটাকে এগিয়ে যেতে বলে প্রথমেই কিছু ছবি তুলে নিলাম। তারপর ব্যাগের স্পেশাল খোপ থেকে সরঞ্জামগুলো বার করলাম। ছেনি হাতুড়ি দিয়ে অভ্যস্ত হাতে পাথরটার বাকিটুকু খসিয়ে নিতেও বেশি সময় লাগল না। তবে বাকি রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে বারবার পিছিয়ে পড়ছিলাম বলে বস মোহিতে স্যারের কাছে বকুনি খেতে হল। আসলে পাথরের টুকরোটা থাকায় ব্যাকপ্যাকটা বড্ড ভারী হয়ে গেছিল যে!
মামাজি আমাকে দু’হাজার দিয়েছিল এটার জন্য। নিজে কত হাজার, নাকি লাখ কামাবে কে জানে!
আজও জঙ্গলেই ঘুরব ঠিক করেছি। এ-তল্লাটে এই প্রথম এলাম। সাধারণ ট্যুরিস্ট এমনিতে নামকরা জায়গাগুলোয় যেতে চায়। কিন্তু পাঁচজন বয়স্ক বাঙালির এই গ্রুপটা একটু অদ্ভুত। এরা সারাক্ষণ চোখে বাইনোকুলার এঁটে পাখি বা প্রজাপতি খুঁজছে। এদের টার্গেট ছিল তুঙ্গারেশ্বর ফরেস্ট। আমরা সেই সাথে একদিনের জন্য ভাসাই-ও জুড়েছিলাম।
এই ভাসাই অঞ্চলটা আদতে ছিল গুজরাটি সুলতান বাহাদুর শাহ’র অধীন। তখন নাম ছিল সোপারা। খুব ব্যস্ত বন্দর ছিল। পর্তুগিজরা দু’-দু’বার আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল জায়গাটা। দখল করার পর তারা জায়গাটার নতুন নাম রাখে বাসিম… না, বাকিম। তারা নতুন করে দুর্গ বানায়, বন্দরটাকে আরো উন্নত করে। প্রায় দু’শো বছর পর্তুগিজ শাসনে থাকার পর মারাঠারা এটা দখল করে নেয়, তখন নাম হয় বাজিপুর। অবশেষে ইংরেজরা জায়গাটা দখল করে। নামও পালটে হয় বাসিন, যা এখন লোকমুখে ভাসাই।
জায়গাটা এমনিতে খাসা। ফোর্ট দেখে তো আমার মন নেচে উঠেছিল। এমন পুরোনো, সময় থমকে থাকা দুর্গে কি কিছুই পাব না তুলে আনার মতো? কিন্তু ঘুরেফিরে হতাশ হতে হল। একদম ল্যাপাপোঁছা জায়গা। মামাজি’র কারবারে লাগে এমন কিছুই পেলাম না। বাকি যা-যা দেখা হল সেদিন, সেগুলোও কোনো কম্মের না।
চিঞ্চোটি ফলসে এখন জল নেই তেমন। বিচগুলোও সাদামাটা। অবশেষে গতকাল ফরেস্ট আর তুঙ্গরেশ্বরের মন্দির দেখে বুঝলাম, এ ট্রিপটা শুকনোই যাবে। একদম রঙটঙ-করা চালু মন্দির, ধারে কাছে কোনো পুরোনো স্ট্রাকচারও নেই। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এই বলে যে পরের হপ্তায় জওহরের দিকে গিয়ে পথে সেই গাঁওয়ার আর্টিস্টের ঘরে যাওয়ার সুযোগ পাব। তার কাছ থেকে একশো-দেড়শো টাকায় চমৎকার ওর্লি পেইন্টিং নিয়ে আসব। পার পেইন্টিং দুশো দেন মামাজি, তারপর রঘুরামের তৈরি ফ্রেমে ভরে সেগুলো সাতশো-হাজারে বেচে দেন।
আজ জঙ্গলটা একাই একটু দেখব বলে ঠিক করেছিলাম। এই দলটা নিজেরা ঘুরতেই পছন্দ করে, আমরা সঙ্গে থাকলে অখুশি হয়। তাছাড়া কাল মোটামুটি সবই দেখানো হয়ে গেছে। আজ লাঞ্চের পর তাই মোহিতে স্যার আর পিটার মিটিং স্পটে শতরঞ্জি পেতে বসে পড়ল। সবাইকে বলা হল, পাঁচটার মধ্যে ফিরে আসতে হবে। দলটা একদিকে চলে গেল। স্যারের পারমিশন নিয়ে আমিও অন্য দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেলাম।
পাহাড় জঙ্গলের মাঝে গেলে আমার ট্রেকার-সত্ত্বাটা জেগে ওঠে। চোখ মেলে দেখে নিই, ঘন জঙ্গলের বড়ো-বড়ো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আলো পড়ে মাকড়শার জালের মতো খোপ-খোপ হয়ে আছে মাটিতে। ফিনফিন করে ফড়িং আর কী সব পোকা উড়ছে। আসলে দুপুরের পরেই জঙ্গল ঝিম মেরে যায়। বিশ্রামের সময় এটা সবার। আবার হাঁকডাক শুরু হবে সূর্য ডোবার আগে, ঘরে ফেরার পালা তখন। তারপর আঁধার নামবে, যত নিশাচর তখনই জেগে উঠবে মাটিতে আর ডালে। আমার কিন্তু এই ঝিমন্ত জঙ্গলই বেশ লাগছিল। তাই ঝরা পাতা, কুমোর পোকার খুঁড়ে তোলা মাটির ঢিবি, টুপটাপ ঝরে পড়া সাদা সজনে ফুলের মতো ফুল— সব মাড়িয়ে আরো গভীরে ঢুকছিলাম। রোদ ঢোকার রাস্তা পায় না বলেই বোধহয় ভেতরটা এত ঠান্ডা লাগছিল। তাও একটা সময়ের পর ক্লান্ত লাগল। একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে একটু জিরিয়ে নিলাম।
আপনমনে আবার কিছুদূর এগোনোর পর ঘড়ি দেখলাম। চারটে বেজে কাঁটাটা অনেকটাই এগিয়ে গেছে দেখে বুঝলাম, এবার ফিরতে হবে। কিন্তু পেছনে ফিরতেই খেয়াল হল, যে সরু পথ ধরে মূল রাস্তা থেকে উঠে এসেছিলাম, সেটা কখন যেন ফুরিয়ে গেছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেটা স্রেফ এবড়োখেবড়ো ঘাসজমি।
যাচ্ছলে! এতদিনের এত ট্রেকিঙের পরও পথ ভুল করলাম! দিকের আন্দাজও গুলিয়ে গেছে। পুরো আনাড়ির মত এলোপাথাড়ি হেঁটেছি নির্ঘাত! পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলাম, কোনো সিগনাল নেই। এই জঙ্গলে ঢোকার পর থেকেই টাওয়ার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন কী করব?
আন্দাজে, একটা দিক ঠিক করে পা চালাই। পাঁচটার মধ্যে মিটিং পয়েন্টে ফিরতে পারব কি না, জানি না। না পারলে খুবই মুশকিল। আমায় ফেলে রেখে ওরা চলে যেতে পারবে না। আবার বেশি দেরি হলে ট্যুরিস্টরা বিরক্ত হবে, কোম্পানির হবে বদনাম। হাঁটার গতি বাড়াই। ফোনটা বারবার এদিক-ওদিক ধরে দেখি টাওয়ার ধরে কি না। এভাবেই চলতে-চলতে মনে হয়, যেন একটা ক্ষীণ পায়ে-হাঁটা পথ দেখতে পাচ্ছি। এদিক দিয়ে আসিনি সেটা বুঝলেও আমার তখন খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো মনের অবস্থা। প্রায় দৌড়ে উঠে আসি সেই শুঁড়িপথ ধরে একটা টিলার মতো ঢিবির ওপর।
সামনে একটা বহু, বহু প্রাচীন অশ্বত্থ গাছ। হাওয়ায় তার পাতার টিকিগুলো কাঁপছে। কিন্তু সে-সব পেরিয়ে আমার অভিজ্ঞ চোখ আটকে গেল গাছটার পিছন দিকে। কালো পাথরের একটা স্তূপ দেখা যাচ্ছিল গাছের আড়ালে। এই কালো দিয়েই এই অঞ্চলের দুর্গগুলো, এমনকি ভাসাই ফোর্টও বানানো হয়েছিল। গাছটা বেড় দিয়ে এগোই। দেরি হচ্ছে বুঝেও জিনিসটা একবার না দেখে তো চলে যেতেও পারব না।
খুবই অপটু হাতে জোড়াতাড়া দেওয়া একটা স্ট্রাকচার। দু’পাশে খানিকটা সিঁদুরের মত কিছু লাল রঙ মাখানো দেখে মনে হচ্ছে কোনো ধর্মস্থান। এই জিনিসটার তো এদেশে কমতি নেই! হবে নুড়িপাথরের শিবলিঙ্গ বা কোনো ধ্যাবড়া হনুমানের মুখ।
ফিরে যাওয়ার জন্য ঘোরার আগে স্রেফ অভ্যাসের বশে ঝুঁকে ঘুপচি ফোকরের মধ্যে নজর চালিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
এটা কী?
“ইও পোড়! তেটে কেটে চাললোও?”
ক্যানকেনে আনুনাসিক গলায় আচমকা চিৎকার শুনে সত্যিই আঁতকে উঠেছিলাম। বাড়ানো হাতটা চট করে টেনে নিয়ে পিছন ফিরি। এক দেহাতী বুড়ি। সাদা শণের নুড়ি চুল, তবে পরিপাটি। মলিন পেঁয়াজ রঙের শাড়ি হাঁটুর ওপর কাছা দিয়ে পরা। চোখে খর দৃষ্টি।
আমার শহুরে চেহারা দেখেই হয়তো সুর একধাপ নামল বুড়ির। সে শুধোল, “তুমহি কুনি? কাসালা আলে?”
মহিলা নির্ঘাত কোলি, মানে এদিকের মৎস্যজীবী আদিবাসী সম্প্রদায়ের। খানিক আগেই কুপারি ভাষা বলছিল। ওটা একদমই বলতে পারি না, ভালো বুঝিও না। তবে পরের কথাটা মারাঠিতে ছিল। অল্প কথায় তাকে বোঝালাম, পথ হারিয়ে ফেলেছি। ওয়াচ টাওয়ারের কাছে যেতে চাই।
বুড়ি’র চোখের চাউনিও নরম হয় এবার। সাহস করে, হাত দিয়ে দেখিয়ে জানতে চাই, এটা কি কোনো দেবতার মন্দির?
“হা, আমচি কুল-দেওতা আহে।” বুড়ি’র গলায় গর্ব ঝরে পড়ে।
কত পুরোনো মূর্তি— এই প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য ঠিকঠাক কিছু জানা গেল না। বুড়ি মাথা দুলিয়ে মারাঠি-কুপারি মিশিয়ে যা বলল, তার কোনো মাথামুন্ডু নেই। চন্দ্র-সূর্য সৃষ্টি হবার আগে থেকেই নাকি এই দেবতা এখানে বিরাজ করছেন। এই নিয়ে বলতে দিলে বুড়ি অনন্তকাল ধরে বকেই যাবে। তাকে থামিয়ে দিয়ে ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছোবার পথনির্দেশ ভাল করে বুঝে নিলাম। যা বুঝলাম তাতে এই টিলা থেকে নেমে পশ্চিম দিকে সোজা গেলেই জায়গাটা পেয়ে যাব। রাস্তা সঠিকভাবে বুঝে নেওয়ার পর বললাম, “মালা পানি পাইজে, তাই।”
জল খেতে চাইলে দেয় না, এমন পাষণ্ড এদেশে বিরল। বুড়িও অশথ গাছের অন্যদিকে তার ঘর থেকে জল আনতে গেল। সে চোখের আড়াল হওয়ামাত্র আমি সক্রিয় হয়ে উঠলাম। বুড়ি’র যেতে-আসতে যেটুকু সময় লাগবে সেটাই আমার কাজের জন্য যথেষ্ট।
আধঘণ্টা বাদে জিপের পিছনে মাথা হেঁট করে বসেছিলাম। মোহিতে স্যারের রাগ সহজে পড়ে না। সারা রাস্তা ধুম বকুনি খেতে-খেতে এলাম। অমন একা-একা রাস্তা ছেড়ে বেমক্কা জঙ্গলে ঢুকে যাওয়াটা খুবই অন্যায় হয়েছে— কথাটা সত্যি। তার ওপর আমার পৌঁছোতে দেরি হয়েছিল বলে দাঁড়িয়ে থেকে-থেকে ট্যুরিস্টদের মুখভার। হোটেলে ফিরেও স্যারের রাগ কমল না। আমায় বললেন সোজা রুমে চলে যেতে, না ডাকলে যেন না আসি আপাতত। এক ম্যাডাম নাকি ভারি চটেছেন আমার ওপর। কী এক স্পিসিসের ভালো ছবি তুলতে না দিয়েই তাঁকে বাকিরা ধরে এনেছিলেন লেট হচ্ছে বলে। তারপর এসে খামোকা দাঁড়াতে হয়েছে আমার জন্য। কাজেই স্যার আর পিটার মিলে এখন ড্যামেজ কন্ট্রোল করবে, আমি যেন ম্যাডামের সামনে না যাই।
আমার তাতে সুবিধেই হল। আমার আর পিটারের একটা ডাবল রুম। ঢুকে লক করে দিলাম। তারপর বিছানায় বসে সন্তর্পণে ওটা বার করলাম।
একটা আধহাত মতো সাইজের, মলিন মাটিমাখা ধাতব মূর্তি। কী ধাতু কে জানে, রীতিমতো ভারী। সোনা নয়, পিতল হতে পারে। শরীরের নীচের অংশে মূর্তিতে যেমন থাকে তেমন প্যাঁচানো অধোবাস, খালি গায়ে ও হাতে অলংকার। কিন্তু বৈশিষ্ট্য আছে মুখটায়। তীক্ষ্ণ চঞ্চুর মতো নাকে মুখ প্রায় ঢাকা। গোল-গোল দুই চোখে ক্ষুধিত দৃষ্টি। পিঠে আবার লুটিয়ে পড়া অঙ্গবস্ত্র, যাকে ক্লোক না কেপ কী জানি বলে। রোমান প্রভাব আছে নাকি? এতশত আমি ভাল জানি না, তবে এটা জানি যে দাঁও মেরেছি। মামাজি এ-জিনিস লুফে নেবেন।
“নোকো! স্পর্শ্ নোকো!”
কানে… না, মনে আবার চিৎকারটা ভেসে এল।
মূর্তিটা খোঁদলের মধ্যে একটা বেসে আটকানো ছিল— এটা বুঝতে পারিনি। খানিকটা চাড় দিতেই খুলে এল অবশ্য। কিন্তু ওই করতে গিয়ে কখন যে বুড়ি ফিরে এসেছে বুঝতে পারিনি। বাধ্য হয়েই, ক্যারাটে শেখা ক্ষিপ্রতায় হাত চালাতে হয়েছিল। এক ঘায়েই লুটিয়ে পড়েছিল শরীরটা। আশা করি মরে যায়নি।
যত্ন করে একটা টি শার্টে মূর্তিটা জড়িয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিই। টিভি চালিয়ে খাটে আধশোয়া হই তারপর।
এ জিনিস মামাজি লাখে বিক্রি করবে। টেন পারসেন্ট চাইব? নাকি টুয়েন্টি?
পাথরের গুহাটা যেমন অন্ধকার, তেমন সরু। মন বলছে, আমাকে এগোতেই হবে। পিছোলে বিপদ। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না, তাই অসমতল জমিতে পা ঘষে-ঘষে এগোচ্ছি। একটা উঁচু জায়গায় পা পড়তেই টলে উঠলাম। হাত বাড়িয়ে পাশের দেওয়াল ধরে ভারসাম্য ফেরালাম। দেওয়ালটা পাথরের, ভিজে-ভিজে, শ্যাওলা পড়া।
বাদুড়… বা চামচিকের উগ্র গন্ধে নাক জ্বলছে। ফিরে যাব? আচমকা মুখের ওপর ঝপাং করে কি যেন আছড়ে পড়ল!
ধড়মড় করে উঠে বসলাম। স্বপ্ন দেখছিলাম এতক্ষণ! সারা গা ভিজে গেছে ঘামে। এত হাঁপাচ্ছি, যেন অনেকটা দৌড়ে এসেছি। কী জীবন্ত স্বপ্ন! বাঁ গালটা এত জ্বালা করছে, যেন সত্যিই কারও থাপ্পড় খেয়েছি ওখানে। ঢকঢক করে জল খেয়ে কিছুটা ঠান্ডা হওয়া গেল।
এই রে! ন’টা বেজে গেছে এর মধ্যেই? জব্বর খিদে পেয়েছে। পথ হারানোর চক্করে তো বিকেলের প্যাক করে নিয়ে যাওয়া টিফিনটাও খাইনি। এতক্ষণে নিশ্চয় রাগ পড়েছে সবার। ডিনারের জন্য নীচে যাই।
আরেহ্! মুখে চোখে জল দিতে গিয়ে মনে হল, বাঁ গালটা সত্যিই লালচে হয়ে আছে। চোখের ভুল, না মনের?
লিফটের দেওয়াল জুড়ে আয়না। সেদিকে তাকিয়েই খেয়াল হল, তাড়াহুড়োয় চুলটাও আঁচড়াইনি। সব কেমন উস্কোখুস্কো হয়ে আছে। আঙুল চালিয়ে সেটাই ঠিক করছিলাম। তখনই আলোটা হঠাৎ দপদপ করে উঠে নিভে গেল।
লিফট থেমে গেছে। কারেন্ট গেল নাকি? ব্যাক-আপ জেনারেটর আছে নিশ্চয়। অ্যালার্মটা অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে। টিপে দিই, বাকিরা জানুক আমি আটকে আছি।
আওয়াজ পেলাম না। খারাপ নাকি? তাহলে আলোটা জ্বলছে কীভাবে? এখন কতক্ষণ এই বদ্ধ জায়গায় বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, কে জানে।
বাড়ি ফিরে একবার চেক-আপ করাব। এত অস্বস্তি হচ্ছে কেন? কতক্ষণ হল আটকে আছি এখানে? কারও সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। বরং দরজায় ক’টা লাথি কষিয়ে দেখি, তাতে যদি কেউ কিছু শোনে।
আওয়াজ তো ভালোই হচ্ছে। কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না তো। তাহলে কি চেঁচাব? এদিকে দমবন্ধ ভাবটা ক্রমশ বাড়ছে। অক্সিজেন কমে আসছে বোধহয়। এই অবস্থায় চেঁচানোটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। বরং নিজেকে শান্ত রাখি। ওটাই বেশি দরকার এখন।
মাথা ঘুরছে। নাকি লিফটটাই দুলতে শুরু করেছে? দেওয়ালটা ধরতে হবে, নইলে পড়ে যাব। কিন্তু… এ তো পাথুরে দেওয়াল! ভিজে-ভিজে, শ্যাওলা পড়া।
আর্তনাদটা আপনা থেকেই গলা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আর কিছু মনে নেই।
“লিফট চালু করতে তো হার্ডলি পাঁচ মিনিট লাগল। এর মধ্যেই রাজেশ এত প্যানিকড হয়ে গেল?”
আমার পাশের সোফায় বসে নিচু গলায় পিটারের সঙ্গে কথা বলছিলেন মোহিতে। আমি আধশোয়া এখনো। লিফট কখন নীচে নেমেছিল, জানি না। দরজা খুলে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়ে তুলে আনা হয়েছে— এটুকু বুঝেছি। জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানো হয়েছে, কারণ জামার বুকের কাছটা ভেজা।
“ওর শরীরটা মনে হয় ভালো নেই।” পিটার বলছিল, “জঙ্গলেও ওরকম হল। ওকে শুইয়ে দিয়ে আসি। আপনি আর আমি মিলে এদিক সামলে নেব।”
“সেই ভালো।” মোহিতে স্যার যে সিরিয়াসলি দুশ্চিন্তা করছেন, সেটা বুঝলাম তাঁর গলা শুনেই। একবার ভাবলাম বলি, ‘আমি নীচে আপনাদের সঙ্গেই থাকব।’ কিন্তু অসম্ভব ক্লান্ত লাগছিল নিজেকে। খিদেটাও মরে গেছিল ততক্ষণে। তাই কথা বাড়ালাম না। পিটার আমাকে ঘরে পৌঁছে দিল।
“ও ঠিক আছে তো?” মোহিতে চিন্তিত গলায় জানতে চাইলেন।
“শুইয়ে দিয়ে এসেছি। খাবারও ঘরেই পৌঁছে দিতে বলেছি। তবে… অন্য একটা ব্যাপার।”
“কী?”
“ঘরে একটা বিশ্রী, বুনো গন্ধ পেলাম। চিড়িয়াখানার পাখির খাঁচার মতো। রাত্রে ঘুমোতে পারলে হয়!”
ঘুম আসছে না। খিদে পাচ্ছে। হয়তো খিদের চোটেই চোখটা খুলে গেল। একলাফে উঠে বসলাম তারপরেই!
আমার একটা টি-শার্ট মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওটা দিয়েই মূর্তিটা মুড়ে রেখেছিলাম! ছুটে গিয়ে ব্যাগ হাতড়ালাম। যা আশঙ্কা করেছিলাম, সেটাই হয়েছে। মূর্তিটা নেই!
চোর ঢুকেছিল? কিন্তু এই চারতলায় জানলা দিয়ে চোর আসবে কীভাবে? তাছাড়া জানলা খোলেও না, এসি রুম তো। তার মানে হোটেলের কেউ নিয়েছে। ডুপ্লিকেট চাবি ওদের কাছে থাকেই। কিন্তু… এত কষ্ট করে জোগাড় করা মূর্তিটা গেল?
না তো! দরজার পাশের সাইডবোর্ডেই তো ওটা রাখা দেখছি। আমিই আনমনে রেখেছিলাম নাকি? উহুঁ। তাহলে বোধহয় চোর মূর্তিটা ওখানে রেখেই পালিয়ে গেছিল। পিটার আমাকে ধরে-ধরে নিয়ে এসেছিল বলে হয়তো ওটা নিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি।
মূর্তিটা হাতে নিয়ে খাটে বসলাম। বাব্বা! এটা চুরি… আসলে বাটপাড়ি হলে সত্যিই বড্ড ক্ষতি হত। কিন্তু চোর কি মূর্তিটাকে ঘষেছিল? এটা আগের চেয়ে একটু বেশিই পরিষ্কার লাগছে কেন?
পিঠের ক্লোকটা বেশ অন্যরকম— ঢেউ তোলা ডিজাইন কাটা। খাঁজগুলো একেবারে আসলের…
আঁ!
এমন আচমকা ডানা দুটো খুলে গেল যে আপনা থেকেই গলা থেকে চিৎকারটা বেরিয়ে গেল। মূর্তিটাও পড়ে গেল হাত ফসকে।
কিন্তু… ওটা তো মাটিতে পড়েনি। গ্র্যাভিটির তোয়াক্কা না করে দিব্যি ভেসে রয়েছে বাতাসে।
যেগুলো আমি এতক্ষণ ক্লোক বলে ভাবছিলাম, সেগুলো আসলে ভাঁজ করা ডানা! এখন ওদুটো পুরোপুরি ছড়িয়ে গেছে দু’পাশে। আর… চঞ্চুর মতো নাক নয়, ওটা চঞ্চুই! ধারালো, বাঁকা।
যে চোখদুটো আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তারাও ধাতব নয়। ঘোলাটে হলুদ, জ্বলজ্বলে, শিকারি পাখির চোখ!
গরুড়?
সব ভাবনাচিন্তা চাপা দিয়ে মনের মধ্যে কেউ চেঁচিয়ে উঠল, পালাও! পালাও!
মূর্তি… না, পাখিটা আমার দিকে ডাইভ দিল! এক ঝটকায় সরে গেছিলাম। কাঁধে ডানার ছোঁয়া লেগেছিল শুধু। আর কিছু ভাবতে পারিনি। কোনোক্রমে দরজা খুলে বেরিয়ে লিফটের উদ্দেশে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়েছিলাম। লিফটে ঢুকে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপতে লাগলাম পাগলের মতো।
দরজাটা বন্ধ হল। আলো নিভে গেল তৎক্ষণাৎ।
টের পেলাম, আমি লিফটে একা নই। আরো কেউ আছে আমার সঙ্গে। জমাট অন্ধকারেও তার নড়াচড়া আমি টের পাচ্ছি। টের পাচ্ছি তার ডানা নাড়ার আওয়াজ। নাকে আসছে সেই বাদুড়ে দুর্গন্ধ।
ব্যথায় বেঁকে যাওয়া শরীরটা কোনোমতে টেনে কালো পাথরের স্তূপটার কাছে আনল আভা।
কাল বিকেলে শহুরে ছেলেটাকে দেখেই ওর মনটা ‘কু’ ডেকে উঠেছিল। চোর একটা! তবু ভালো যে মার খেয়ে ও ঘাসজমিতেই পড়েছিল। মাথাটা পাথরের কোণে লাগলে আর দেখতে হত না।
আকাশে লাল রঙ ধরছে। ‘কুল দেওতা’-র পুজোর সময় তো এটাই। ফোকরে চোখ লাগাতেই আভা’র কুঁচকে যাওয়া মুখে খুশির ছোপ ধরল।
দেবতা ফিরে এসেছেন।
আগেও এমন হয়েছে। প্রতিবারই ভোর হওয়ার আগেই ফিরেছেন তিনি।
এমনিতে দেখলে মূর্তিটার কোনো পরিবর্তন ধরা পড়বে না। কিন্তু আভা জানে, একটা ছোট্ট বদল হয়েছে মূর্তির নীচের বেদিতে। গরুড়ের নখের তলায় বন্দি সাপগুলোর দলে যুক্ত হয়েছে আরও একজন। খুব খুঁটিয়ে দেখলে ধরা পড়ে, তার চেহারাটা ঠিক সাপের মতো নয়।