হাত
ধাম্! ধাম্!! ধাম্!!
আরে! এত জোরে দরজা পেটাচ্ছে যেন ভেঙেই ফেলবে। কলিং বেল বাজছে না নাকি?
বলতে না বলতে বেল বেজে উঠল। বাজতেই থাকল পাগলা ঘণ্টির মতো। বাথরুম থেকে কোনোমতে বেরিয়ে এসেছিলেন দীপংকর। কিন্তু দরজার ওপাশে যে আছে, তার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছিল, জামাটুকু পরার সুযোগ তাঁকে দিতেও রাজি নয় সে।
আগুন লাগল নাকি বিল্ডিঙে?
রীতিমতো ছুটে এসে দরজা খুললেন দীপংকর। বেল টিপে ধরে থাকা হাতের উদ্বেগ তাঁর হাত-পায়েও সঞ্চারিত হয়ে গেছিল ততক্ষণে। দরজা খুলে চেনা মুখ দেখে নিশ্চিন্ত হওয়ার বদলে আরো ভয় পেয়ে গেলেন তিনি।
“কী ব্যাপার কানাই? এইভাবে…?”
কথা শেষ করতে পারলেন না দীপংকর। তাঁকে দেখেই মাটিতে থপ্ করে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছিল কানাই।
দীপংকরের একতলার প্রতিবেশী ডাক্তার অনিন্দ্য বসুর পুরোনো রাতদিনের কেয়ারটেকার হল কানাই। তিনি আর দোতলার ভটচাজদা ঠাট্টা করে ওকে ‘ডাক্তারের ম্যান ফ্রাইডে’ বলেন। আজ অবধি কানাইকে এরকম বিচলিত হতে দেখেননি ওঁরা কেউই।
কানাইয়ের ফোঁপানো আর জড়ানো কথা থেকে যা বোঝা গেল, তাতে দীপংকর নিজেও যারপরনাই বিচলিত হয়ে পড়লেন। ঘরের চটি পায়েই ছুটে একতলায় গেলেন তিনি। কানাইয়ের সঙ্গেই ঢুকলেন ফ্ল্যাটের একটেরে চেম্বারে। দৃশ্যটা দেখে তাঁর মাথাটা ঘুরেই গেছিল। নেহাৎ শক্ত মানুষ বলে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। তবে, ইতিকর্তব্য স্থির করে লোকাল থানায় ফোন করার সময়েও তাঁর কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল উত্তেজনা আর আতঙ্কে।
ঘণ্টাখানেক পরেও একটা ছোটোখাটো ভিড় জমেছিল বাড়িটার সামনে। ডাক্তারবাবু অনেকদিনের বাসিন্দা এ পাড়ায়, পসারও মন্দ নয়। পুলিশের জিপের পিছনের গাড়িতে সাদা চাদর ঢাকা স্ট্রেচার তোলার সময়ে ভিড়ের অনেকেই কপালে হাত ঠেকাল। গুনগুন চাপা কথাও শোনা গেল কিছু— ‘কতই বা বয়েস হয়েছিল!’ ‘দিনকাল বড়ো খারাপ। চেম্বারে কী-ই বা থাকত?’ ‘বেশ যত্ন করে দেখত কিন্তু ছোকরা।’ ইত্যাদি।
একতলার অর্ধেকটা নিয়ে গ্যারেজ, বাকি অর্ধেক জুড়ে ডাক্তারের ফ্ল্যাট। একটা মাস্টার বেডরুম, একটা গেস্টরুম— সেটাতেই পার্টিশন করে চেম্বার আর কানাইয়ের ঘর। চেম্বারের এন্ট্রি লাগোয়া গ্রিল ঘেরা বারান্দা দিয়ে। এদিকের মেইন দরজা খুলে বসার ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম ইত্যাদি।
পুরো জায়গা ঘুরে বেড়াচ্ছিল পুলিশের দল, ছবি তুলছিল তাদের একজন। চেম্বারটা দেখছিল ইন্সপেক্টর রজত জানা নিজে। আপাতদৃষ্টিতে একটাও জিনিস এদিক-ওদিক হয়নি। ডাক্তারের চেম্বারে যা-যা থাকা স্বাভাবিক, সেগুলোই ছিল ওখানে। একটা বড়ো টেবিল, তাতে প্যাড, পেন, ওষুধের স্যাম্পল, ব্লাডপ্রেশার মাপার যন্ত্র। ওপাশে গদি-আঁটা রিভলভিং চেয়ার, এদিকে এমনি চেয়ার একটা। একপাশে সোফা-সেট, সেন্টার টেবিলে কয়েকটা ম্যাগাজিন। ব্যস।
সময় নিয়ে সব খুঁটিয়ে দেখে রজত। পেনের ঢাকনাটা খুলে নীচে পড়ে আছে। এছাড়া অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়ে না। রজত এই ঘরে ঢোকার সময়ও বাকি সব স্বাভাবিক লেগেছিল। শুধু ডাক্তার বসু’র মৃতদেহ তখন ওই চেয়ারে বসে ছিল। ঘাড় পিছনে হেলানো, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে, দাঁতের চাপে জিভ কেটে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে গড়িয়ে পড়েছে চিবুক অবধি। গলায় দাগড়া দাগড়া লাল-কালো টিপে ধরার দাগ। মানুষের বদলে মুরগির গলা মনে হচ্ছিল, এমন থেঁতলে গেছিল জায়গাটা।
তিনতলার এক প্রতিবেশী ভদ্রলোক থানায় ফোন করেছিলেন। তিনি তখন বসার ঘরের সোফায় জবুথবু হয়ে বসে ছিলেন৷ কানাই নামের কাজের লোকটিও একপাশে একটা টুলে বসে ছিল। রজত দুজনের উদ্দেশেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “কেউ চেম্বারের কিছু নাড়াচাড়া করেনি তো?”
“না-না।” ভদ্রলোক বলে ওঠেন, “কেউ ঢোকেইনি ও-ঘরে। আমি তো দেখেই সঙ্গে-সঙ্গে বেরিয়ে এসেছি, কিচ্ছু ছুঁইনি। এসে, দরজা টেনে দিয়ে ঠায় বসে আছি এখানে। তারপর আপনিই প্রথম এসে ঢুকলেন।”
রজতের সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে কানাইও ঢক ঢক করে মাথা নাড়ায়। তারপর বলে, “আমি হাত দেব কী বাবু! দাদা চা খান সাড়ে এগারোটায়। তাই নিয়ে ঘরে ঢুকে টেবিলে রেখেছিলাম। দুপুরের রান্না নিয়ে কথা বলব বলে মুখ তুলে দেখি এই দশা! দেখেই তো হাত পা কাঁপতে লেগেছে আমার। কোনোরকমে হাতের কাপ রেখে এক দৌড়ে উপ্রে গেলাম! দোতলায় তো সব ঘরে তালা। সবাই বেরিয়ে গেছেন। তখন তিনতলায় গিয়ে এই দাদাবাবুকে ডাকলাম।”
‘দাদাবাবু’ মাথা নেড়ে সায় দেন। সামনের টেবিলে একধার করে বসানো কাপ-ডিশ, তাতে সর পড়ে যাওয়া চা, তার পাশে নীচে টুলে রাখা লাল টেলিফোন নীরবে দু’জনের কথার সাক্ষী দেয়।
“স্যার, অল ডান। আমরা কি যাব?”
“হয়ে গেছে? এগোন তাহলে, আমিও আসছি।”
নিঃশ্বাস ফেলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয় রজত। বাইরের লোকই মনে হচ্ছে। কিন্তু মোটিভের জায়গায় ধোঁয়াশা। পেপারওয়ার্ক করতে হবে এবার।
“তুমি কিন্তু একদম বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না।” কড়া গলায় বলল রজত, “তোমার দেশের ঠিকানা, আধার কার্ড, ছবি, টিপছাপ— সব নিয়ে নিয়েছি। পালালেই ধরে ফেলব কিন্তু।”
“না বাবু! আমি কোথাও যাব না।”
বেরিয়ে এসে বাইকে স্টার্ট দিয়েও ভ্রূকুটি যায় না রজতের। ডাক্তারের চোখ দুটো কিছুতেই ভুলতে পারছে না ও। এমন নিখাদ আতঙ্ক ছিল ওই দৃষ্টিতে! আর গলাটা?! তার মতো সাত বছর ধরে নিয়মিত খুন-জখম দেখা পুলিশেরও নার্ভে চাপ পড়ে গেছিল গলাটার ওই দৃশ্যত দুমড়ে-মুচড়ে পিষে যাওয়া দশা দেখে।
কীসের দাম চোকাতে হল ডাক্তারকে? কে হতে পারে এই অসমশক্তিধর আততায়ী?
*****
জ্ঞানটা ঠিক করে ফিরতে যা দেরি। পরক্ষণেই ছটফট করে উঠল রোগী। একপাশে বসে থাকা সিস্টার হাঁকপাঁক করে ছুটে এল। তার চিৎকারে পাশের ঘর থেকেও ছুটে এল আরেক সিস্টার। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। বিশাল লম্বা-চাওড়া পেটানো চেহারার লোকটির গায়ের জোর অমানুষিক। সিস্টাররা এসে পৌঁছোনোর আগেই এক ঝটকায় দু’দিক থেকে আটকে রাখা স্ট্র্যাপগুলো ছিঁড়ে ফেলে সে নিজের দুই হাত তুলে ধরেছে চোখের সামনে।
এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত সব চুপ রইল। তারপর “হাআআআআআআআ” করে একটা জান্তব চিৎকার সারা ফ্লোর কাঁপিয়ে আছড়ে পড়ল বাতাসে। সেই ভয়ানক চেঁচানির ধাক্কায় হাসপাতালের ফ্যাকাশে সাদা দেওয়ালগুলো অবধি কেঁপে উঠল। আশপাশের ঘরগুলোয়, বড়ো হলের সারি-সারি লোহার খাটে একা বা বেড শেয়ার করে শুয়ে থাকা মলিন পোশাকের লোকগুলো আঁতকে উঠল। যারা ঘুমিয়ে ছিল তাদের ঘুম গেল ভেঙে।
টহল দেওয়া শেষ করে ডাক্তার অনিন্দ্য বসু সদ্য স্টাফ রুমে গিয়ে গায়ের সাদা কোটটা খুলতে যাচ্ছিলেন। চিৎকারটা সেখানেও এসে ধাক্কা দিল। এতই হিংস্র, এতই বিক্ষুব্ধ সে আওয়াজ যে স্থানু হয়ে গেলেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসা বা দাঁড়ানো ডাক্তারেরা। ডাক্তার বসু আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, ওটা কার গলা। ঝট করে কোট পরে নিয়েই সেই স্পেশাল কেবিনের দিকে দৌড় মারলেন তিনি। পিছনে পিছনে ছুটলেন আরো দুই জুনিয়র ডাক্তার।
প্রতাপের জ্ঞান ফিরলে যে এমনই কিছু একটা হবে তা আশা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু ঘরের দরজা পেরিয়েই যা দেখলেন তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না অনিন্দ্য। খাটের সামনে যেন তুফান চলছে। একটা ছ’ ফুট লম্বা বিশাল দানব তাণ্ডব করছে সেখানে। পরনে ওটির সবুজ দড়ি বাঁধা পোশাক। কাটা মুরগির মতো ধড়ফড় করছে তার মাথা, হাত, পা। ছিটকে পড়ছে পাশের টেবিলের ওষুধপত্র, খাবার জল, স্ট্যান্ডে লাগানো ড্রিপের সরঞ্জাম। একজন সিস্টার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছেন, কপালে লাল হয়ে আলুর মতো ফোলা। অজ্ঞানই হয়ে গেছেন বোধহয়। আরেকজন ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে বলির পাঁঠার মতো কাঁপছেন।
এক পলকে দৃশ্যটা দেখে নিয়েই পকেট থেকে ফোন বার করে ইমার্জেন্সি সিকিউরিটি নাম্বারে ফোন করলেন অনিন্দ্য। পিছনে আসা জুনিয়র রোহন আর ঈশানী ততক্ষণে “গার্ড-গার্ড! হেল্প!” করে বিশাল শোরগোল তুলে ফেলেছে। তাতে আরো কয়েকজন নার্স, ঝাড়ুদার, ওয়ার্ড-বয় গোছের কর্মী জড়ো হয়ে গেছিল কেবিনের সামনে। তাদের ঠেলেঠুলে অচিরেই এসে হাজির হল দুই ষণ্ডা গার্ড। কিন্তু তারপরেও, এই এতজন মিলেও, সে লোকটাকে পাকড়াও করে শোয়াতে প্রায় কালঘাম ছুটে গেল সবার। ততক্ষণে সব তছনছ হয়ে গেছে ঘরের।
মনের জোরে হাত স্টেডি রাখলেন অনিন্দ্য। তারপর কড়া ডোজের ঘুমের ইঞ্জেকশনটা পুশ করলেন। ভারী শরীরটা নেতিয়ে পড়ার পর তবে তাঁর নিজের শ্বাস স্বাভাবিক হল। ওয়ার্ড বয়-রা মাটিতে পড়ে থাকা নার্সকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে গেল। সবাই ঘর ছাড়ল একে-একে। শুধু দরজার পাশে সারাক্ষণ যার বসে থাকার কথা, সেই সাদা পোশাকের পুলিশটি গুটি গুটি পায়ে আবার তার টুলে গিয়ে বসল। মোক্ষম মুহুর্তেই সে বেচারার পিসাব পেয়ে গেছিল। তবে চিৎকার শুনে ছুটে আসার পর সেও হাত লাগিয়েছিল অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য। চোখের নীচে গভীর কালশিটেটাই তার প্রমাণ।
বেরোনোর আগে আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে রোগীর বিছানার পাশে গেলেন অনিন্দ্য। অঘোরে ঘুমোচ্ছে এখন সে। রোদে পোড়া তামাটে মুখ, নাক-মুখ রীতিমতো ধারালো। ভ্রূর উপরে একটা গভীর ক্ষত চুলের গোড়া অবধি চলে গেছে কপাল বেয়ে।
প্রতাপ কুমার সিং। গতকাল রাত্রে হাসপাতালের খাতায় এই নামই লেখা হয়েছিল। তবে ওর পরিচিতরা কেউ এই নামে চিনবে না ওকে। পুলিশের খাতায় লেখা আছে পরতাব, পেটো পরতাব। পাইকপাড়া অঞ্চলের অন্যতম ত্রাস। ভ্রূর উপরের ক্ষতটা ছুরি নিয়ে মারামারির চিহ্ন। এরকম আরো অজস্র ক্ষত আছে সারা গায়ে, আজই দেখেছেন।
এখন ঘণ্টাচারেক নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। থানা থেকে ফোন এসেছিল এইমাত্র। নির্ঘাত মার-খাওয়া কনস্টেবলটিই খবর দিয়েছে। ওসি জানিয়েছেন, একটু পরে তিনিই আসছেন হ্যান্ডকাফ নিয়ে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একে রিলিজ করে নিয়ে যেতে বলতে হবে।
সামান্য ঝুঁকে, হাতের নতুন বাঁধনগুলো নেড়েচেড়ে দেখলেন একবার অনিন্দ্য। পাথরের মতো মজবুত হাতের গোছ। কনুই থেকে সুন্দর ডৌলে কবজি অবধি যেন কোনো ভাস্কর্য রক্তমাংসের রূপ পেয়েছে।
তার পর ফাঁকা। কিছু নেই।
না, ভুল বলা হল। ব্যান্ডেজ আছে। রক্তের ছোপ লাগা সাদা ঢেলার মত দুটো ব্যান্ডেজ দুই হাতে। ভোর থেকে অপারেশন চালিয়ে দুটো হাতের পাতাই পুরো বাদ দিয়ে দিতে হয়েছে। গ্যাংগ্রিন সেট করে গেছিল।
*****
তিনদিন পরে সুপার মৈত্রেয়ীদির ঘরে বসে ছিলেন অনিন্দ্য। ওসি সুরজিৎবাবুও ছিলেন সঙ্গে।
“আর কিছু নোট করার মতো আছে কি ডাক্তারবাবু?”
“নাহ! এমনি তো সব প্যারামিটার ঠিকই আছে। হেলথ স্ট্রং তো, রিকভারি ভালোই হচ্ছে। তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে।”
“কিন্তু নুলো হয়ে।“
একটু নড়েচড়ে বসে অনিন্দ্য, গলার স্বরে অল্প ক্লান্তি মেশে।
“হ্যাঁ, ওটা তো বললামই আপনাকে। কিচ্ছু করার ছিল না। দিন বারো আগে যখন ওই বেলগাছিয়ার বস্তিতে মারপিট বোমাবাজিটা হয়েছিল বললেন, তখনই চোট পেয়েছিল নির্ঘাৎ। তখনই যদি আসত, হয়তো হাত বাঁচাতে পারতাম।”
“এদের সে বোধ থাকলে তো হয়েই গেছিল ডাক্তারবাবু! সেদিন রামাইয়ার হাতে বেধড়ক মার খেয়েছিল ও। হেরে যাচ্ছে বুঝতে পেরে পালিয়ে গেছিল স্রেফ। গা ঢাকা দিয়েছিল পার্ক সার্কাসের বস্তিতে বন্ধুর বাড়ি। আরে আমাদের কাছে সব খবর থাকে, যাবি কোথায়! ক’দিন সময় লেগে গেল খুঁজে বার করতে, কিন্তু ধরা পড়লই! আমরা হানা দিয়ে দেখি, মাল ধুম জ্বরে কোঁকাচ্ছে। হাতে ঘা ভর্তি। মাছি থিকথিক করছে। দুর্গন্ধে বমি এসে যায়!”
“আর ৪৮ ঘন্টা ওভাবে পড়ে থাকলেই মারা যেত শিওর। আপনারা তুলে আনলেন বলে প্রাণে বেঁচে গেল অন্তত।”
মৈত্রেয়ীদি এতক্ষণে মুখ খোলেন, “ডিসচার্জ তো তাহলে আপনিই নেবেন?”
“হ্যাঁ, সে তো বটেই। কবে ছাড়ছেন ডাক্তারবাবু?”
অনিন্দ্য একটু ইতস্তত করে বলল, “আরেকটা দিন একটু দেখে নিই, জানেন। কাল দুপুরে নিয়ে যান। জেলে যাবে, না জামিন? সেইমতো ওষুধ দিয়ে দেব সঙ্গে।”
মুখ টিপে হাসলেন সুরজিৎবাবু। তারপর বললেন, “সব তো আপনাদের বলতে পারব না। তবে যা বুঝছি, ইনি এখন আউট-অফ-ফেভার। রামাইয়া এদিকের উঠতি হিরো। কাজেই, একে হাজতে ঘানি ঘোরাতেই যেতে হবে। ওহো! সেটাও তো আর পারবে না।”
নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে ওঠেন ওসি।
*****
একজন নার্স এবং সেই পুলিশের লোকটি পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে সতর্ক ভাবে। প্রতাপের দুই হাতই কনুইয়ের কাছে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকানো বেডের রেলিং-এ। সতর্কতার খাতিরে একটা পা-ও। তবু, বেডের পাশে দাঁড়িয়ে প্রেশার মাপার সময়ে নিজের রক্ত চলাচলের গতি বেড়ে যাচ্ছে টের পাচ্ছিলেন অনিন্দ্য। ঠায় তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে যে চোখজোড়া, বাঘের হলুদ চোখের নির্মম করাল দৃষ্টির সঙ্গেই একমাত্র তার তুলনা চলে।
“এই ডাগদার? এই কুত্তি, বল না! এই ডাগদারটা তো?”
হুংকারে নার্সটি তো বটেই, অনিন্দ্যরও হাত কেঁপে ওঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নার্সটির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, ভয়ে মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
বেচারি। এমন একটা জানোয়ারের কাছে ডিউটি করা যে কত চাপের তা না বোঝার মতো হৃদয়হীন ডাক্তার অনিন্দ্য বসু নন। প্রতাপের চোখে চোখ রেখে খুব ঠান্ডা গলায় তিনি বললেন, “এখানে একটাও বাজে শব্দ উচ্চারণ করবে না। নার্সদের সঙ্গে অসভ্যতা করলে এমন ইঞ্জেকশন দেব যে জীবনে আর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোবে না। কী জানতে চাও, আমাকে বলো।”
সটান শুয়ে থাকা শরীরটা একটুও কাঁপল না। শুধু ভারী মুখের পেশিতে হিল্লোল খেলে গেল। চোখের পাতা পড়ল না। বরং আগুন ধক-ধক করে লাফিয়ে উঠল সে চাহনি থেকে।
“কোন বাঞ্চোৎ আমার হাত নুলো করে দিয়েছে? কার কথায়?”
ঘাড় শক্ত হয়ে উঠল অনিন্দ্যর। চোখের পাতা না ফেলে সেও চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিল, “তোমার হাত আমি কেটে বাদ দিয়েছি। হাত না কাটলে জানে মারা যেতে সে হুঁশ আছে? রক্ত বিষিয়ে গেছিল পুরো।”
“ঝুট!”
চিৎকারটা যত জোরে হল, পরের কথাগুলো ততটাই আস্তে বেরোল।
“ও দারোগার বাচ্চার সঙ্গে রামাইয়া সাঁট করেছে। আমি জানি! টাকা খেয়ে, ওকে তুলবে বলে আমার হাত কাটিয়ে দিল হারামিরা। আমি জানি।”
“চুপ! মুখ খারাপ করতে বারণ করেছি তোমায় এখানে।“
“তুই চুপ যা, হারামজাদা! টাকা খেয়ে আমার সর্বনাশ করলি। তোকে আমি ছাড়ব ভেবেছিস?”
ধৈর্য ফুরিয়ে আসছিল অনিন্দ্যর। উত্তরটা স্বভাববিরুদ্ধ রুক্ষ ভঙ্গিতেই বেরিয়ে এল, “বেশ তো, ছাড়তে হবে না। যা পারিস করে নিস, আগে তো জেলের ঠেলা সামলা!”
চুপ করে গেল লোকটা। জব্দ হয়েছে এবার। বাকি কাজ সেরে, নার্সের হাতের কাগজে সই করে বেরোতে যাচ্ছিলেন অনিন্দ্য। দোরগোড়ায় পা-টা থেমে গেল পিছন থেকে ভেসে আসা হিসহিসে সুরে বলা কথাগুলোয়।
“হাত কেটেছিস, মাথা নয়। আজ হোক, দশ বছর পরেই হোক, তোর লাশটা আমিই ফেলব, দেখে নিস!”
এর দু ঘন্টা পরে পুলিশের গাড়িতে ওঠা অবধি প্রতাপ আর একটা কথাও বলেনি।
*****
সুরজিৎবাবু’র আন্দাজ অভ্রান্ত ছিল। প্রতাপকে এবার আর কেউ জামিনে ছাড়াতে এল না। কেস কোর্টে উঠল। কয়েক মাস ধরে মামলা চলাকালীনই তার দল ভেঙে গেল। রামাইয়া বকলমে প্রোমোটার হয়ে বসল। প্রতাপের সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক আশ্রয় নেতাটিও দলীয় মন কষাকষির জেরে অন্য কোনো জেলার দায়িত্ব নিয়ে কলকাতা ছাড়লেন। মোটমাট, এক গাদা ধারায় জড়িয়ে প্রতাপের শেষ অবধি ছ বছর জেল হয়ে গেল।
কলকাতার জেলেই থাকার কথা তার। সেই মতো দমদমে নিয়েও যাওয়া হয়েছিল কোর্ট থেকে। চুপচাপ ওখানে কাটিয়েই বেরিয়ে আসতে পারত হয়তো। কিন্তু বাদ সাধল ঐ কাটা হাত জোড়া।
একসঙ্গে লাইন দিয়ে খাবার সময়ে প্রথম-প্রথম সবাই হাঁ করে চেয়ে থাকত। তারপর শুরু হল নিজেদের মধ্যে ফিসফিসানি, এর ওর গা ঠেলে দেখানো, হাসাহাসি। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল খুব শিগগিরই। প্রতাপের চেনা কেউ থাকলে, বা ও যদি কথাবার্তা বলে দু চারটে দোস্ত বানিয়ে নিতে পারত, তাহলে হয়তো এগুলো কমে আসত। তার বদলে অন্য কয়েদিরা কী দেখত? একটা হুমদো চেহারার লোক রোজ ঘাড় হেঁট করে আসছে। কারো দিকে না তাকিয়ে নুলো দিয়ে বাটি ধরে কসরৎ করে খাচ্ছে। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে জবাবও দিচ্ছে না। খাওয়া কোনোমতে শেষ হলেই উঠে চলে যাচ্ছে।
এগুলো, বাকি খুনে গুন্ডা-মস্তানদের কাছে ‘অহঙ্কার’ ছাড়া আর কী-ই বা মনে হতে পারত?
সেদিনও প্রতাপ সবে এসে ওর নির্দিষ্ট জায়গায় বসতে যাবে। হুট করে দৌড়ে এসে বকাই সেখানে বসে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে দূরের জটলাগুলো থেকে ভেসে এল সিটি, হাসির হররা, হাততালি।
প্রতাপ এই প্রথম চোখ তুলে তাকাল বকাইয়ের দিকে। একটা কমবয়েসী ফচকে ছেলে। মুখে ব্রণ, চুলে পনিটেল।
“ওয়ে ব্বে! শুভোদিষ্টি করছিস নাকি রে!”
পঞ্চার গলায় কথাটা ভেসে আসতেই নববধূর মতো লজ্জা পাবার ভান করল বকাই গালে হাত দিয়ে। সারা ঘর জুড়ে তুমুল হাসির শোরগোল ওঠে। প্রতাপের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, নিঃশ্বাসের গতি বাড়ে। মুখ ফিরিয়ে অন্য কোথাও বসার জায়গা খোঁজে সে।
“আরে নুলোকাত্তিকের তোকে পছন্দ হল না যে! মুখ ফিরিয়ে পালাচ্ছে!”
এক ঝটকায় মুখ ফিরিয়ে গর্জে ওঠে প্রতাপ, “পরতাব পালায় না বেজন্মার দল। মুখ সামলে কথা না বললে…!”
ঘরের বাতাস থমথমে হয়ে উঠল মুহূর্তের মধ্যে। এক-দুজন করে উঠে এসে ওকে ঘিরে দাঁড়াল বেশ কয়েকজন। তাদের চোখ, মুখ, দাঁড়ানোর ভঙ্গি— এ-সবই বলে দিচ্ছিল, এরা সবাই পুরোনো পাপী। জেল খেটে-খেটে গায়ে চড়া পড়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে এই জীবনের ঘাঁৎঘোত জানা থাকার ঔদ্ধত্য। হাজার মস্তানি করলেও জেলকে এতকাল কাঁচকলা দেখিয়ে এসেছে প্রতাপ। এ-রকম বাঘবন্দি দশা হয়ে সেও কিছুটা বেকুব বোধ করছিল।
মারটা আচমকাই শুরু হয়েছিল। নাকে ঘুষি, পিঠে লাথি— সব একসঙ্গে পড়তে থাকায় আত্মরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিতে হাত তুলে মুখ আড়াল করেছিল প্রতাপ। কাটা জায়গায় তীব্র ব্যথায় চমকে উঠে দেখল একটা কালো হাত সাঁ করে সরে গেল। হাতের মালিক বকাই তার ব্রণ মুখ নিয়ে বিশ্রীভাবে হাসছিল ওর চমকানো দেখে। সাপের ছোবলের মতো সে আবার হাত চালাল ওর চোখের সামনে। প্রতাপ বিস্ফারিত চোখে দেখল আঙুলের ভাঁজে লুকোনো ব্লেডের ঝলক। তারপরই পিঠে একাধিক লাথি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে-যেতে ওই বকাইকেই গলা জাপটে ধরে নিজেকে সামলাল প্রতাপ।
তারপর শুরু হয়েছিল চরম হুড়োহুড়ি। প্রতাপের মুখে-পিঠে-পায়ে বন্যার মতো আছড়ে পড়েছিল মার। অকথ্য গালাগালি আর চিৎকারের মধ্যে বকাইয়ের কোঁকানোর আওয়াজ কারো কানে যায়নি। অ্যালার্ম বেজে ওঠার পর পুলিশেরা দৌড়ে এসে যখন অচৈতন্য প্রতাপকে ধরে তুলল, তখন বকাইয়ের আর্তনাদে কান পাতা দায়।
দুজনকেই হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছিল। প্রতাপের সর্বাঙ্গে কালশিটে আর কাটা দাগ। বকাইয়ের কাঁধের হাড় ডিসলোকেট হয়ে গেছিল দুই হাতের পেষণে।
*****
বহরমপুর জেলের ভারী দরজাটা একটু-একটু করে খুলে যাচ্ছিল। সারা রাস্তা ঝিমিয়ে বসে থাকা বন্দিটি মাথা উঁচিয়ে, চোখ খুলে দেখেছিল আশপাশ। জিপ থেকে নামার পর কন্সটেবলদের পিছু-পিছু পা টেনে চলে যাওয়ার সময় অবশ্য সে কোনোদিকে তাকায়নি।
এ-রকম দু’হাত-কাটা অপরাধী আগে দেখেনি বিশ্বেশ্বর। কী যেন আছে লোকটার মধ্যে। প্রতিবন্ধী, চোখে চোখ রাখে না, চুপচাপ— তবু গা শিউরে ওঠে কেমন লোকটাকে দেখলে। মরুকগে! ওর কাজ শেষ। কাগজপত্র ঠিক করে গুছিয়ে নিয়ে লাফ মেরে জিপে উঠে পড়ল হাবিলদার বিশ্বেশ্বর জানা।
মাথা নিচু রাখলেও প্রতাপের চোখ কিন্তু সবই দেখে নিচ্ছিল। চৌকো উঠোন, এক পাশে কিছু ফুলগাছ। অফিসঘর, জলের পাইপ, বেসিন। পেছনে বাগান? না, ছোট্ট সবজিক্ষেত। ওর গন্তব্য হল এদিকের প্যাসেজ পেরিয়ে ওপাশের কুঠুরিগুলোর কোনো একটা।
এগুলো বোধহয় পুরোনো স্ট্রাকচার। মোটা মোটা দেওয়ালের গাঁথনি, নিচু ছাত। দিনের বেলাতেও প্রায় অন্ধকার। প্রায় সবই ফাঁকা পড়ে আছে। একদম শেষের দিকে একটা কুঠুরির দরজা খুলে লোকগুলো ওকে ঢুকতে বলল। পা ঘষে ঘষে ঢুকল প্রতাপ। কিছুই প্রায় চোখে পড়ে না— এমন অন্ধকার! চোখ সয়ে যাওয়ার আগেই নাকে ধক্ করে ধাক্কা মারল একটা গন্ধ। ভেজা, ছাতাপড়া, নোংরা মাটির গন্ধের সঙ্গে, ধূপধুনো আর মাছের আঁশের গন্ধ মেশালে যেমন হয়— তেমন। গা গুলিয়ে উঠল ওর। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, পিছনের দরজায় তালা দিয়ে চলে গেছে ওরা।
কী একটা ভয় গ্রাস করল প্রতাপকে। প্রায় ছুটে গিয়ে পিছনদিকের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল ও। পরিষ্কার, চুনকাম-করা সাদা আর সমান দেওয়ালের পাশে গিয়ে একটু স্বস্তি পেল। গন্ধের তীব্রতাও যেন একটু কম লাগল।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই টের পেল প্রতাপ, জ্বর আসছে আবার। গলা শুকিয়ে কাঠ, শীত করছে, চোখের সামনে দেওয়ালগুলো কাঁপছে যেন। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মাটিতে বসে পড়ে সে। অবসন্ন শরীরটা হেলিয়ে দেয় পিছনে।
ঘুমিয়েই পড়েছিল। রাত্রের খাবার নিয়ে এসে ডাকল পুলিশটা। উঠে দাঁড়ানোর মতো জোর নেই বলে ঘষটে-ঘষটে এগিয়ে এল প্রতাপ। ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে ঝুঁকে পড়ে কানাতোলা সানকির দ্রব্যটায় মন দিল সে।
“চুঃ চুঃ…!”
উপুড় হয়ে ঝুঁকে, থালায় মুখ নামিয়ে সরাসরি খাওয়ার ভঙ্গিমাটা দেখলে কুকুর মনে হতেই পারে। ওর নিজেরও প্রতিবার নিজেকে কুত্তাই লাগে। তাই বলে শালা খানকির বাচ্চা পুলিশটার এত স্পর্ধা?
ঝট করে মাথা তোলে প্রতাপ। মুখে-নাকে লপসি মাখা, চোখে আগুন।
এ কী! কেউ নেই তো প্যাসেজে। কিন্তু ও যে স্পষ্ট শুনল?
আবার সেই গন্ধটা নাকে ফিরে আসে। তারপর এক অনৈসর্গিক তীক্ষ্ণ, খসখসে গলায় চিৎকার করে ওঠে কেউ, “ওরে আয়! আয় রে আমার জীয়নকাঠি! আমি যে তোর অপেক্ষায় বসে আছি বাপ্!”
কী ভয়ানক লালসা মেশানো গলা! কী সাংঘাতিক দাপট সেই আহ্বানে। প্রতাপের মতো কঠিন লোকেরও অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল সেটা শুনে।
“ওরে এলি? চেয়ে দ্যাখ আমার দিকে! তোর জন্যই তো পরাণডা ধরে রাখা অ্যাদ্দিন।”
এইবারে প্রতাপ দেখতে পায়। প্যাসেজের ওপারে, গরাদের পিছনের অন্ধকারে একজোড়া চোখ অঙ্গারের মতো জ্বলছে যেন! আস্তে-আস্তে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার গরাদ আঁকড়ে ধরে থাকা, শিরা-ওঠা কঙ্কালসার হাত। একটু-একটু করে প্রতাপ দেখতে পায় তার কাঁধ অবধি ঝুলে পড়া সাদা পাকানো চুল। ঢালু, টাক-পড়া কপাল, বাঁকা আর মোটা নাক— এও এবার প্রকট হয়। প্রতাপের চোখে চোখ পড়তেই একটা প্রবল উল্লাসের ক্রূর হাসি ফুটে ওঠে সেই জীবন্ত প্রেতাত্মার মুখে।
“কে তুমি? কী চাও?” অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল প্রতাপের মুখ দিয়ে।
“তুই কী চাস?” নিচু স্বরে, প্রশ্ন ফিরে এল তার দিকে, “বল। যা চাইবি, তাই পেয়ে যাবি। মনে রাখিস।”
“মানে?”
“কী চাই তোর? বল না!”
প্রতাপের ধন্ধ লাগে। কী চাইবে? জেল থেকে মুক্তি? টাকা পয়সা? আগের মত অবাধ ক্ষমতায় বিচরণ? নাকি… নিজের হাতের দিকে অজান্তেই চোখ চলে যায় তার।
প্রতিশোধের বাসনাটা হু হু করে ওঠে মনের মধ্যে।
“তাই তো? তাই-ই তো? পাবি। দিতে পারি কিন্তু!”
প্রতাপের সব হিসেব গুলিয়ে যায়। অধীর আগ্রহে সেও এবার গরাদে মুখ ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি পার? পারবে ঠিক করে দিতে?”
“ঠিক হবে না। কিন্তু তুই যা চাইছিস তা হবে। নে ধর!”
ম্যাজিকের মতো মুখ থেকে কী একটা বের করে লোকটা। ঘষষষষষ্ করে আওয়াজ তুলে সেটা গড়িয়ে আসে ওর দিকে প্যাসেজ পার করে।
আঁকুপাঁকু দুই নুলোয় সেটা ধরে প্রতাপ। ভিতরে নিয়ে আসে খুব সাবধানে।
একটা পাথর। ম্যাড়মেড়ে লাল, মসৃণ, ডিমের মতো শেপ।
“ওটা খেয়ে ফ্যাল!” জলদগম্ভীর গলায় হুকুম আসে।
“পাথর… খাব?”
হা হা করে হেসে ওঠে লোকটা। বলে, “পাথর নয়। ও একরকম বীজ। সব প্রাণ বীজ থেকে শুরু হয় তা জানিস? মদ্দলোকে মেয়েমানুষের পেটে বীজ ফেললে তবে বাচ্চা গজায়, জানিস?”
“খেয়ে ফ্যাল! পুলিশগুলো এসে পড়বে এক্ষুনি! খা বলছি!”
সম্মোহিতের মত জল দিয়ে জিনিসটা খেয়েই নেয় প্রতাপ। কিসের বীজ? জানা হল না।
রাতের টহল দিল যখন সান্ত্রী তখন দুই কয়েদীই অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
*****
পরদিন প্রতাপের ঘুম ভাঙল লোকজনের কথায়। প্যাসেজে বেশ কিছু পুলিশ আর একজন সাদা কোট পরা লোক, সম্ভবত ডাক্তার, কিছু বলছিল।
“নাহ্! কিছু করার নেই। নিয়ে যাও।”
সাদা কোট পরা লোকটা চলে গেল। আরো কয়েকজন পুলিশ গেল তার পিছু পিছু। প্যাসেজটা খালি হল এতক্ষণে। প্রতাপ দেখতে পেল, উলটোদিকের কুঠুরির দরজা খোলা। মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে লোকটা, সাদা চুলগুলো এলিয়ে আছে, সম্পূর্ণ উলঙ্গ। জেলের জামাগুলো একপাশে জড়ো করা।
“কী হল?” কাছে দাঁড়ানো পুলিশটাকে জিজ্ঞাসা করল প্রতাপ।
“মরেছে আপদটা। ভুগছিল তো।”
“কীসে মরল?”
“কে জানে! বুড়ো হয়েছিল, ভুগছিল। তার ওপর অত অনাচার!”
“অনাচার?”
এবার প্রতাপের দিকে ভালো করে তাকায় পুলিশটা। একে আগে দেখেনি প্রতাপ।
“অ! বাইরের মাল। তাই ভাবি, দিগেন মহান্তকে আবার কে না চেনে? বড়ো ঝাড়ফুঁকওয়ালা তান্ত্রিক ছিল তো মালটা। কত কী অখাদ্য-কুখাদ্য খেত সাধনার নামে, তার ঠিক নেই। তেমনি মেয়েখেকো ছিল। সব সমস্যার সমাধানে ঢ্যামনাটার কুমারী মেয়ে লাগত। গেঁয়ো লোকগুলোরও বলিহারি, নিজের বাড়ির মেয়েগুলোকে দিয়েও যেত!”
“তারপর? জেল হল কেন?”
“একটা একদম কচি মেয়েকে…! সামলাতে পারেনি মেয়েটা। মরেই গেছিল। সেই সময়েই কলকাতার একদল বাবুরা কুসংস্কার-বিরোধী প্রচারে এসেছিল। তাদের কাছে ধরা পড়ে গেল। নেহাত বুড়ো বলে ফাঁসি হয়নি।”
অন্য পুলিশগুলো একটা চালি মতো জিনিস নিয়ে ফিরে এসেছিল ততক্ষণে। ধরাধরি করে বুড়োকে তাতে চাপানো হল। সাদা কাপড় দিয়ে শরীরটা ঢাকা হল।
প্রতাপ চুপচাপ দেখছিল। কথাগুলো শুনে অবধি ওর গা ঘিনঘিন করছিল। আবার কাল রাত্রের কথোপকথন মনে করলে গায়ে কাঁটাও দিচ্ছিল। লোকটা শুধুই ফেরেব্বাবাজ বদমাশ ছিল কি?
বিকেলের দিকে এক মরণপণ আর্তনাদে কেঁপে উঠল জেল চত্বর। যেন কোনো মানুষের গা থেকে জীবন্ত ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। আওয়াজের উৎস খুঁজে দৌড়ে এসে পুলিশেরা দেখেছিল, প্রতাপ মাটিতে পড়ে মৃগীরোগীর মত হাত পা খিঁচোচ্ছে। সে অজ্ঞান, মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে।
তার আধঘণ্টা আগেই দিগেন মহান্তর শরীরটা চুল্লিতে ঢোকানো হয়েছিল।
সব মিটিয়ে থানার গাড়ি তখন বেরিয়ে গেছে। যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে, বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বোতল থেকে জল খাচ্ছিল রজত। হঠাৎ দেখল, প্রতাপ ওর দিকেই এগিয়ে আসছে।
এ আবার কী চায়?
“আপনি এখনো যাননি স্যার?”
“এই যাব। তুমি এখনো এখানে কেন? বাড়ি চলে যাও!”
“হ্যাঁ স্যার। আপনাদের অনেক মেহেরবানি স্যার। ছুটে গেলাম তাড়াতাড়ি।“
নুলো দুটো জড়ো করে দাঁড়িয়ে রইল লোকটা, মুখ কৃতজ্ঞতায় কাঁচুমাচু। রজতের একটু মায়া-ই হয় এইবার। সদ্য জেল থেকে বেরিয়ে এরকম হুজ্জুতিতে ফেঁসে যাওয়া নেহাৎ খারাপ কপালেরই লক্ষণ!
তবে ওর ছাড়া পাওয়াতে রজতদের কোনো কৃতিত্ব নেই। খোঁজখবর নিয়ে, অ্যাপয়েন্টমেন্টের খাতা থেকে ঠিকানা জোগাড় করে প্রতাপ সিংকে তুলে আনার সময়েই পুলিশ বুঝেছিল, এ কেস ধোপে টিকবে না। তাই হল। কোর্টে দাঁড়িয়ে প্রতাপ বারবার কসম খেয়ে বলল যে সে এই খুনের ব্যাপারে কিছু জানে না। এই ডাগদারবাবু তার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন আর খুব যত্ন করেছিলেন, যখন সে হাসপাতালে ছিল। তাই ছাড়া পেয়ে খোঁজ করে এর কাছেই গেছিল সে— যদি কিছু নকলি হাত ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।
হাউমাউ করে ডাক্তারের প্রশস্তি করেছিল প্রতাপ। না-দেখা খুনির উদ্দেশে প্রচুর অভিশম্পাত দিয়েছিল। বলেছিল, ও বেরিয়ে যাওয়ার পরেই নির্ঘাত সে ঢুকেছিল। সবচেয়ে বড়ো কথাটা, জড়ো হয়ে থাকা কাটা হাতদুটোই চিৎকার করে বলে দিচ্ছিল, এ খুনি হতে পারে না!
অজ্ঞাতপরিচয় খুনির ওপরেই দায় চাপিয়ে আপাতত কেস ক্লোজ করা হয়েছে।
“তুমি কাল বরং হসপিটালেই যেও। আরো অনেক ডাক্তার আছেন ওখানে, ওঁরা বলে দেবেন যাতে নকল হাতের ব্যবস্থা হয়।”
কথাটা বলেই পিছন ঘুরে বাইকের দিকে পা বাড়িয়েছিল রজত। ব্যাপারটা তখনই ঘটল। পড়ে থাকা একটা ব্যান্ডেজ না কীসের কৌটোয় পা পড়ল তার। মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ছিল ও আরেকটু হলেই। তখনই পিছন থেকে দুটো বলিষ্ঠ হাত রজতকে ধরে ফেলল।
কানের কাছে রজত স্পষ্ট শুনল ঘষা, ভারী, ধারালো গলাটা, “দেখে স্যার! দেখে চলুন!”
টাল সামলে পিছন ফেরার আগেই রজতকে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেছিল প্রতাপ। গেটের কাছাকাছি গিয়ে সে একবার ফিরে তাকাল। রজতের সঙ্গে চোখাচুখি হতেই একটা ধূর্ত বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। তারপরই গেট পেরোনোর জন্য আরো জোরে পা চালাল সে।
পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রজত। সারা গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে তার, কপালে সারি সারি ঘামের ফোঁটা ফুটে উঠেছে। ওর দশ হাতের মধ্যে অন্য কেউ এখনও নেই, আর তখনও কেউ ছিল না।
প্রতাপ ছাড়া!
পড়তে পড়তে চোখের কোণে ও প্রতাপেরই কালো পাঞ্জাবি ঢাকা হাত এগিয়ে আসতে দেখেছিল। অথচ, ওর পেটের উপর ও স্পষ্ট অনুভব করেছিল দুটো হাত, হাতের পাঞ্জা, দু’হাতের দশটা আঙুল।
পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি ও?
রাস্তার ভিড়ে লম্বা-চওড়া কালো পাঞ্জাবিটা তখনো দেখা যাচ্ছিল। স্প্রিন্ট টানার মত সেদিকে দৌড়োল রজত। কী করে যেন টের পেল কালো পাঞ্জাবি। সেও বাঁদিকে ছুট মারল।
রজতের সঙ্গে দূরত্ব কমে আসছে বুঝেই হয়তো ভিড়ের মধ্য দিয়েও রাস্তা পার করতে গেছিল প্রতাপ। দুদ্দাড় করে ছুটে আসছিল দুটো মিনিবাস। তাদের একটা স্পিড বাড়িয়ে প্রায় উড়ে চলে গেল ওর পাশ দিয়ে। অন্যটার চালক প্রাণপণে ব্রেক কষেও বাসটা থামাতে পারল না।
ব্রেকের ব্রিশ্রী শব্দ আর তারপরেই ওঠা বিকট কোলাহল রজতের কানে গেছিল। ওদিকে এগিয়ে যেতে-যেতেই ও আন্দাজ করেছিল, ভালো কিছু দেখবে না।
মাথাটা ফেটে ঘিলু গড়িয়ে পড়েছিল রাস্তায়। নিথর দৃষ্টি। পেটো পরতাবের ইহলোকের খেল খতম হয়ে গেছে— এটা বোঝাই যাচ্ছিল।
পরক্ষণেই, ঘিরে দাঁড়ানো জনতার প্রত্যেকের মতোই আঁতকে উঠল রজত। ওদের সবার চোখের সামনে ধড়ফড় করে উঠল প্রতাপের মাথা থ্যাঁতলানো শরীরটা। ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে গিয়ে আবার জোড়া লাগল সেটা।
পুলিশ আর সাধারণ মানুষের নার্ভের তফাত থাকেই। প্রাথমিক শকটা সামলে পায়ে-পায়ে প্রতাপের দেহের দিকে এগিয়ে গেল রজত। সে যা দেখছিল তা একেবারেই অবিশ্বাস্য! উবু হয়ে দেহের পাশে বসে পড়তে বাধ্য হল সে। রজত দেখছিল, তার সামনে রক্ত-ঘিলু মাখামাখি রাস্তায় পড়ে আছে অন্য একটা মৃতদেহ।
তার হাত আর নুলো নয়। শরীর শুকনো দড়িপাকানো। কপালে ঢালু টাক আর কাঁধ অবধি লম্বা সাদা চুলও সেখানে স্পষ্ট। আর… তার চোখ খোলা!
সে চোখের মণি নড়ে উঠল এবার। রজতের চোখে সটাং চোখ রাখল ওটা।
রজত কিছু বোঝার আগেই বন্দুকের গুলির মতো কিছু একটা ছুটে এল পড়ে থাকা শরীরের মুখ থেকে। অবাক বিস্ময়ে হাঁ হয়ে থাকা তার মুখে ঢুকে গেল সেটা। ঘটনাটা এত আচমকা ঘটল যে কিছু বোঝার আগেই রজত ঢোঁক গিলে ফেলল। লিচুর বিচির মতো সাইজের কিছু একটা পিচ্ছিল, শক্ত জিনিস ওর গলা দিয়ে নেমে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা টের পেলেও আটকাতে পারল না সে। মাথা ঘুরে পাশে ঢলে পড়ল রজত।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড সব স্থির হয়ে রইল। তারপর রজত উঠে বসল আস্তে-আস্তে। কেউ একজন কাঁধ ধরে ওকে উঠে বসতে সাপোর্ট দিল। আরো অনেক লোক ততক্ষণে এগিয়ে এসেছিল ওদিকে। পড়ে থাকা শরীরটাকে ঘিরে দাঁড়াচ্ছিল তারা।
ছ’ ফুট লম্বা, পেটানো শরীর, কপালে কাটা দাগ এবং দু’ হাত কাটা অবস্থায় রাস্তায় পড়ে ছিল প্রতাপ সিং।