দৃষ্টি

দৃষ্টি

আশিস আর রজতাভ’র কলেজ লাইফের বন্ধুত্বটা সপরিবারে বেড়ানোর ফলে আরও পোক্ত হয়েছে। ফলে দুই মিসেসও যেমন বন্ধু হয়ে গেছেন, পুপু আর তার বুবুনদাদাও পিঠোপিঠি খেলার সঙ্গী। এবারে গোয়া এসে সারাদিন হুটোপাটির পর সন্ধেবেলা, যখন বাবা মায়েরা সান্ধ্য আড্ডার আসর জমালেন, তখনও দু’জনে লাফাতে লাফাতে পাশের হলটায় দৌড়োল খেলবে বলে।

বড়ো হলটা ডাইনিং এর জানলা দিয়ে পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। তবু মিসেস বসু মনে করিয়ে দেন, “একদম সামনেই থাকবে, চোখের আড়াল হবে না!”

খেলা জমেছিল খুব। অনেকক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করে হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছিল দুজনে। এসির মধ্যেও ঘামে গলা পিঠ ভিজে গেছে। পুপু এমনিতেই চঞ্চল, হাতে পায়ে দুরন্ত। হাঁপাতে হাঁপাতেও তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছিল সে এক পায়ে।

“লুকোচুরি খেলবি?”

এখানে? খেললেই হয়। এত চেয়ার টেবিল সোফা, দরজার আড়াল আছে। ভালোই জমবে।

“তুই যা লুকো, আমি টেন কাউন্ট করে আসছি।”

বুবুন দেওয়ালের দিকে ফিরতেই পুপু ধাঁ করে দৌড়য়। এই সোফাটার পিছনে? না দেখে ফেলবে এক্ষুণি। ওদিকের দরজাটার আড়ালে? এই রে! ফাইভ অবধি বলে ফেলেছে! ছোট্ ছোট্… দরজাটা একটা করিডোরে খুলেছে। পাশে বিশেষ জায়গা নেই, দরজার পাল্লা সোজা না রাখলে তো ধরে ফেলবে।

আরে! পাশের এই দরজাটার পিছনে অনেকটা জায়গা তো! ছোট্ট অ্যান্টিরুম একটা মনে হচ্ছে। কিন্তু অন্ধকার যে!

“নাইন… টেন… কা-মিং!”

বুবুনের গলা ভেসে আসতেই সুট্ করে দরজাটা খুলে ঢুকে পড়ে পুপু। উত্তেজনায়, আর হাসি চাপার প্রবল চেষ্টায় কাঁপতে থাকা ছোট্ট মেয়েটার কানে মৃদু ‘ক্লিক্’ আওয়াজটা পৌঁছয় না।

গল্পগুলো ক্রমশ মুচমুচে হচ্ছিল। আপাতত মিসেস দে’র ভাই আর ভাই-বউয়ের ইউরোপ ট্যুরের ধারাবিবরণী হাঁ করে গিলছিলেন মিসেস বসু। পাশের টেবিলে দ্বিতীয় পেগের সাথে সাথে গল্প গিয়ে পৌঁছেছিল কমনরুমের বজ্জাতি আর থার্ড ইয়ারের কমলিকার নামে প্রচলিত জোকে।

বুবুনের ধরা গলার ‘মা’ ডাকটা তৃতীয় বারে শুনতে পেলেন মায়েরা। ফ্যাকাশে ভীতু মুখটা দেখেই সবাই ধড়মড় করে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন; “পুপুকে পাচ্ছি না” শোনামাত্র হুলুস্থুল পড়ে গেল।

আধ ঘন্টার মধ্যে হোটেল তোলপাড় হয়ে গেল, কিন্তু পুপুকে পাওয়া গেল না।

দরজা বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও ফিকে আলো আসছে ঘরটার পিছন দিক থেকে। প্রাথমিক উত্তেজনা কমলে চারদিকে চোখ চালায় পুপু।

দু’দিকে দেওয়াল-জোড়া তাক। রাশিরাশি শিশি-বোতল। থরে থরে তোয়ালে ভাঁজ করে রাখা। একটা কোণায় গাদাখানেক মপার। চারটে বালতি। আরো কিছু কার্ডবোর্ডের বাক্স।

মোক্ষম লুকিয়েছে! বুবুন কিছুতেই ওকে খুঁজে পাবে না। এইত্তো কতক্ষণ হয়ে গেল, সাড়াশব্দই নেই।

কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল না? একা-একা ভয় করছে যে পুপুর এবার! বেরিয়ে দেখবে? আচ্ছা, পুরো না হলেও একটুখানি মুখ বার করে দেখে নেওয়া যাক।

দরজাটা কী ভারী! ওর ছোট্ট-ছোট্ট হাত টেনে খুলতেই পারছে না। প্রাণপণে টান দেয় পুপু। দরজা এক বিন্দুও নড়ে না।

আরো খানিকক্ষণ টানাটানি করার পর পুপু টের পায় দরজাটা ভিতর থেকে খুলবে না। ওটা লক হয়ে গেছে। সারা গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা মাম্মা বই পড়ে শুনিয়েছিল। আজ টের পেল।

“মাম্মা! মাম্মা! মাম্মা!”

চিৎকার করতে করতে গলা শুকিয়ে কাঠ। পুপু কখন যে উবু হয়ে বসে পড়েছে এক কোণে, নিজেও খেয়াল করেনি।

পাশের তাকের রাশি রাশি ফিনাইলের বোতলগুলো আবছা অন্ধকারে একদম সৈন্যের মত লাগে। যেন এক্ষুণি কেউ বলবে “আগে বাড়ো” আর তারা জয়দাদাদের বাড়ির অসভ্য কুকুরটার মত ঝাঁপিয়ে পড়বে পুপুর ওপর।

ঠেস দিয়ে রাখা মপারটা হ্যারি পটারের ঝাঁটার মত লাগছে। উড়ে আসে যদি!

“ও মাম্মা!” পুপুর গালে শুকনো জলের দাগ বেয়ে আবার জলের ফোঁটা গড়ায় এঁকাবেঁকা।

ঠকাস!

উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবার জবুথবু বসে পড়ে পুপু। ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেছে আওয়াজ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে।

না, আওয়াজটা দরজায় হয়নি যেমন ও ভেবেছিল। ঘরের ভিতর দিকে হয়েছে।

এখন, আরও খচমচ করে কিছু আওয়াজ হচ্ছে ঘরের মধ্যে। মাগো!

মুখে দুহাত চাপা দিয়েও অস্ফুট চিৎকারটা পুরো থামাতে পারল না পুপু। ওর গায়ে মাথায় পিঠে যেগুলো এসে পড়েছে, সেগুলো সেই ফিনাইলের বোতল।

হালকা একটা আওয়াজ। একটা মৃদু আলো।

একটা ভয়াবহ দানবাকৃতি চেহারা, গা মাথা ঢাকা কালো আবরণ, ঝুঁকে ওর দিকে চেয়ে আছে নিথর দৃষ্টিতে!

বুবুন খবর দেবার আধ ঘন্টা পর দরজাটা ভেঙেছিল হোটেলের লোকজন। ছোট অ্যান্টিরুমটার এক দিকের দেওয়ালের তাক লণ্ডভণ্ড, গড়াগড়ি খাওয়া ফিনাইলের বোতল আর মপারের মধ্যে ছোট্ট পুপু অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল।

না, কোনো চোট-আঘাত লাগেনি ওর। মায়ের কোলে অল্প শুশ্রূষাতেই জ্ঞান ফিরে এসেছিল পুপু’র। ইশ্, ওই নোংরা কাদা কাদা ছাপ, কাদামাটির ডেলা পড়ে থাকা মেঝের মধ্যে মেয়েটা এতক্ষণ শুয়ে ছিল! মিস্টার শিন্ডে কড়া ম্যানেজার, ডিউটিতে থাকা দেওকী আর সায়না খুব বকুনি খেয়েছিল কাজে ফাঁকি দিয়েছে বলে।

*****

ছোটবেলার এই ঘটনাটা পুপু, মানে মণিদীপার জীবনে ভয়ংকর প্রভাব রেখে গেছিল।

শুরুতে ছিল ভয়। বন্ধ জায়গার ভয়। একা ঘরে থাকার ভয়। লিফটে উঠতে আতঙ্ক। কিন্তু তারপর একটা ব্যাপার হল। ভয় পেতে-পেতে কেমন বিরক্তি ধরে গেল। হয় না, সীমা পেরিয়ে গেলে?

তারই সঙ্গে চাপল অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়া আর সিনেমা দেখার নেশা। অলৌকিক বলে যে কিছু হয় না, ও-সব ভাবনা যে স্রেফ অবাস্তব— তাই নিয়ে হাসিঠাট্টা করার সাহসও এল। এল যুক্তি দিয়ে সব তুচ্ছ করে দেবার জেদ।

এসব নিয়ে তর্ক করে আধা জীবন কেটে গেছিল। কিন্তু মাঝবয়েসে ট্রান্সফার নিয়ে আত্মজনহীন শহর পুনে-তে আসার পর ব্যাপারটা বদলে গেল। এক আড্ডায় বস মোহিত পাঞ্চাল খেপে উঠে বলে বসলেন, ভূতপ্রেত যদি নাই থাকে তো তাঁর শখ করে কেনা চারতলার ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে কেন? তিনি কি শখ করে গ্রাউন্ড ফ্লোরের ফ্ল্যাটে এত ভাড়া গুনছেন? কিছু যদি নাই থাকে, তাহলে কেন কেউ ওখানে রাত কাটাতে পারে না? সব ভাড়াটেই রাত্রে উল্টাসিধা আওয়াজ শুনে ভয়ে পালায় কি এমনি-এমনি?

যুক্তি সাজিয়েছিল মণিদীপা। হয়তো বাইরের আওয়াজ কোনোভাবে ঘরে আসে। নইলে কোনো ফল্টি গ্যাজেট, অথবা হাওয়া চলাচলের কোনো অদ্ভুত রাস্তার ফলেই হয় শব্দগুলো।

কিন্তু পাঞ্চালের এমনিতেই গোঁয়ার বলে বদনাম আছে। দুম করে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন ভদ্রলোক— মণিদীপা এক রাত ওই ফ্ল্যাটে কাটিয়ে দেখাক।

ঝোঁকের মাথায় চ্যালেঞ্জটা নিয়েও নিয়েছিল মণিদীপা। রকেটকে সদ্য কিনেছে তখন। তেজি অ্যালশেসিয়ান। তাকে নিয়ে বেলাবেলি পৌঁছে গেল ফ্ল্যাটে।

ব্যাপারটাকে মণিদীপা এখনও স্রেফ লাক বলে। জানলা বন্ধ করার সময়েই একটা কাক পাল্লায় এসে বসতে যাচ্ছিল। ঝট করে হাতটা টেনে নিতে গিয়ে হাতের পাতলা রিস্টলেটটার খোঁচামুখটায় আটকে উঠে না এলে, ফ্রেম বরাবর সেঁটে আটকানো অত সরু তার চোখেও পড়ত না।

তার ধরে-ধরে লুকোনো স্পিকার, সেখান থেকে আরও এগিয়ে পাশের ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে সেটার বেরিয়ে আসা— এগুলো বের করা স্রেফ জলভাত হয়ে গেছিল। স্পিকার খুলে রেখে আরামসে এক ঘুমে রাত কাবার করেছিল মণিদীপা। তারপর সকালে মিস্টার পাঞ্চালকে ফোন করে ডেকে এনে, ব্যাপার দেখিয়ে-বুঝিয়ে রকেটকে নিয়ে কেটে পড়েছিল মণিদীপা। ভূতের ভয়ে বাধ্য হয়ে কম দামে ফ্ল্যাট বেচলেই কেনার জন্য মুখিয়ে ছিল পাশের ফ্ল্যাটের মালিক। ব্যাপার বুঝতে পাঞ্চালের কিছুমাত্র সময় লাগেনি এরপর।

এরপরেই বেশ একটা নাম হয়ে গেছিল অফিসে সাহসী বলে। ও নাকি ভূত তাড়াতে পারে— এমনটাও রটেছিল এরপর। উদ্ভট সব আবদারও আসছিল ওর কাছে। কার মামার বাড়িতে রাতে ঢিল পড়ছে। কার গ্রামের বটগাছের নিচে রাত কাটালে নির্ঘাৎ মৃত্যু। কোথায় নাকি রাত বিরেতে আগুন জ্বলে উঠছে। ভয়ংকর হানাবাড়ি, গা হিম করে দেওয়া শ্মশান, ভুলভুলাইয়ার মাঠ— সর্বত্র ঘটল মণিদীপা’র পদসঞ্চার। আর তার পরেই দনাদ্দন ফেটে যেতে লাগল এতদিন ধরে ফোলানো গল্পের বেলুনগুলো।

ঢিল না কচু, হাওয়ায় ছাতে গাছের ডাল লাগছে, মামাবাবুর নতুন বউ রোজ তাতেই মুচ্ছো যাচ্ছেন। ডাল কেটে দিতেই তিনি নিশ্চিন্তে রান্নাবাড়ি করে বাঁচলেন।

বটগাছটা তো নেহাৎ সময় নষ্ট। অফিসের দুই ষন্ডা আর ওরা মিলে সেই রাতটা গাছতলায় কাটানোয় নেশাখোর গেঁজেলগুলোর সে রাতের আড্ডা মাটি হল!

আগুনের জন্য ‘অকুস্থলে’ যেতেও হল না, অফিসে বসেই বলে প্রমাণ করে দিল— ওটা আলেয়া।

হানাবাড়ির চারদিকে সাপের আখড়া ছিল। সেখানে মারা যাওয়া লোক দুটোকে যে সাপেও কেটে থাকতে পারে, সেটা গ্রামের কেউ অস্বীকার করতে পারল না।

শ্মশানে অবশ্য যাবার সুযোগ হয়নি। তবে হাতে কম্পাস থাকলে ভুলভুলাইয়া যে ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারে না, সেটা বেশ করে প্রমাণ করে এসেছে।

কেমন একটা উদ্দীপনা এসে গেছিল। এদ্দিন ধরে বাড়ি-অফিস, নিজের বই পড়া আর গান শোনার বাইরে একক জীবনে খুব একটা কিছু ছিল না। ওই রকেটের সঙ্গে খেলা, কি মাঝেমধ্যে সিনেমা দেখতে যাওয়া। এই ঘটনাগুলো, দু’ বছর ধরে টুক-টুক করে কেমন একটা আলাদা পরিচিতি হওয়া— এগুলো বাঁচার আলাদা নেশা এনে দিল। এখন মন খোঁজে কখন কোথায় আবার এমন ছুটে গিয়ে রহস্যভেদ করা যায়।

তবে ঝোঁকের মাথায় আজ রকেটকে বাদ দিয়ে আসাটা বেশ ভুল হয়েছে, মানতে বাধ্য হয় মণিদীপা। এমন হবে জানলে অবশ্যই ও রকেটকে নিয়ে আসত। আসলে ভূত ভাগানোর প্ল্যান করে তো আসেনি এবার। এসেছিল টিমমেট মিনাল পাটিলের বিয়ে খেতে।

মেয়েটা ওর থেকে অনেক ছোটো হলেও মণিদীপা’র খুব ন্যাওটা। এত করে বলেছিল বলে ‘না’ করতে ইচ্ছে করেনি। রত্নাগিরি থেকে আরো খানিকটা এগিয়ে মিনালের গ্রাম। যেতে-আসতে দু’দিনের মামলা। মণিদীপার প্রতিবেশী জোহান আঙ্কল কুকুর ভালবাসেন। আগেও এক-দু’রাত মণিদীপা অফিসের কাজে বাইরে গেলে উনি রকেটকে সামলে রেখেছেন। তাই সব ব্যবস্থাও হয়ে গেছিল।

গতকাল রাতে অফিস সেরে বিয়েবাড়ি পৌঁছে গেছে। প্রচণ্ড আপ্যায়ন করেছে মিনালের বাড়ির লোকে। পরদিন বিয়ে, কিন্তু মারাঠি বিয়ের অনুষ্ঠান দিনের আলো থাকতে থাকতেই মিটে গেছে। রাতে স্বাভাবিকভাবেই কেউ ওকে ফিরে যেতে দেয়নি। পরদিন সকালের বাসে ফেরাই ঠিক ছিল, কিন্তু ঝামেলা পাকাল বরবাবাজির চালিয়াতি স্বভাব।

মিনাল স্বভাবসিদ্ধ প্রগলভতায় সবার সামনেই মণিদীপার কীর্তির কথা শোনাচ্ছিল। মিনালের বাড়ির লোক হয়তো আগে শুনেছে, তারা চমকায়নি। কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে ব্যাপারটা তাজ্জব লাগছিল। ফলে এক সময় দেখা গেল, উপস্থিত মহিলামহল মণিদীপার চারদিকে গল্প শোনা আর প্রশ্ন নিয়ে মত্ত। এদিকে বর যে একা বসে মশার কামড় খাচ্ছে, সেটাও তাদের খেয়াল নেই তখন! বরের যদি এরপর বর্বর রাগ হয়েই থাকে, দোষ দেওয়া যায় কি? দুম করে সে বলে বসল— এসব ঝুট, একজন বংগালি আওরতের এত সাহস হতেই পারে না। সত্যি সাহস থাকলে করে দেখাক, নইলে সে বিশ্বাস করবেই না।

ছোকরার সাইজ মণিদীপা’র অর্ধেক, বলতে নেই সে চিরকালই একটু শক্তপোক্ত ভারী চেহারার। তার ডেঁপোমি দেখে মণিদীপা’র মাথা থেকে পা জ্বলে গেছিল। কিন্তু বিয়ের বর বলে কথা! তাই মিষ্টি করেই জানতে চেয়েছিল, সাহসিকতার প্রমাণ দেওয়ার জন্য ওকে কী করতে হবে?

কেন, আজ রাতটা কাটিয়ে আসুক না তাদের গ্রামের ডিসুজা হাউসে! এই তো পাশেই। অত বড়ো একটা প্রপার্টি, সাহেবি আমলে বানানো। সে ছোটোবেলায় শুনেছে, বিশাল বড়লোকের বাড়ি ছিল। অনেক দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্টের মালিক। সে মারা যাওয়ার পর কীসব মামলা-মোকদ্দমা হয়ে আর কেউ আসেনি। পড়ে আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, কেউ ওখানে রাত কাটাতেও পারেনি। যে-ই যেত, সে-ই গায়েব হয়ে যেত! ফলে, গত বিশ বছরে আর কারো হিম্মত হয়নি ওখানে পা রাখতে।

মিনাল শুরুতে ফোঁস করে উঠতে গেছিল। কিন্তু ডিসুজা হাউসের নাম শোনামাত্র সেও কেমন চুপসে গেল। আর তাতেই গোঁ চেপে গেল মণিদীপা’র।

মিনাল ওর এত কিছু জেনেও ভরসা পাচ্ছে না? তবে তো যেতেই হয়!

লোকে বাধা দিতে চেয়েছিল। মিনালের মা তো কান্নাকাটি লাগিয়ে দিয়েছিলেন। বর বেচারিও অপ্রস্তুত হয়ে গেছিল। কিন্তু সবাইকে বলে আর বুঝিয়ে, রাতের খাবার খেয়ে, লাঠি, টর্চ, কম্বল আর খাবার জল নিয়ে, মোবাইল ফুল চার্জ করে রওনা হল মণিদীপা। তারপর কয়েকজন বরযাত্রী’র সঙ্গে সেই অভিশপ্ত ডিসুজা হাউসে এসে হাজির হল ও।

বাড়িটা দেখে অট্টহাস্য করতে ইচ্ছে করছিল। এটা ভূতের বাড়ি? হ্যাঁ, পরিত্যক্ত, অযত্নের আগাছা-লাঞ্ছিত, নোংরা, একটু ভাঙাচোরাও। কিন্তু তাও কী রাজকীয় বাড়ি! সারিয়ে নিলে অনায়াসে একটা রিসর্ট হতে পারে।

একটা ঘর দেখেশুনে বেছে নিয়ে মণিদীপা আস্তানা গেড়ে বসল। সঙ্গী ভদ্রলোকেরা একটু তা-না-না করেই বিদায় নিলেন। পোঁ-পাঁ পালালেন বলাই উচিত!

মিনিট দশেক পর রকেটের জন্য মন কেমন করতে লাগল মণিদীপা’র। বড্ড একা-একা লাগছে। এসব পুরোনো বাড়িতে যেমন হয়, এলোমেলো হাওয়া বইছে ফাটল ফোকর দিয়ে। অনভিজ্ঞ লোক সেইসব আওয়াজেই নিতান্ত কাতর হয়ে পড়তে পারে।

রাতজাগা কোন একটা পাখির আচমকা আচমকা ক্যাঁ-ক্যাঁ ডাক শোনা গেল। প্যাঁচাই হবে।

টপ টপ টপ…! এটা আবার কী শুরু হল? জল পড়ছে কোথাও থেকে। কোনো কল হবে। রাত্রে হয়তো প্রেশার বাড়ল বলে এতক্ষণে তাতে জল এল।

কম্বলটা পেতে শুয়ে পড়ে মণিদীপা। টর্চ আর লাঠি হাতের একদম নাগালেই আছে। সাপের সময় নয় এখন, কাজেই সে চিন্তা নেই। ঘর মোটের ওপর পরিষ্কারই ছিল, বিছে-টিছেও থাকবে না। দরজা আধভেজা করে রেখেছে বটে, কিন্তু পুরো বন্ধ করে দিলে একা বন্ধ ঘরে আবার সেই…!

ধ্যাত্তেরি! বহুকাল বাদে আবার এই চিন্তাটা এল। আসলে মাঝেমাঝে চিন্তাটা ফিরে আসে ঠিকই, রাত্রে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নও দেখে উঠে পড়ে এখনও। কিন্তু রকেটের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই শান্তি।

ঘুমে ডুবে যায় মণিদীপা। বেশ ধকল গেছে সারাদিন।

টপ টপ টপ…!

আরে দূর বাবা! কলটা কেউ বন্ধ কর না! কে আর করবে? নিজেকেই উঠতে হয়। তক্ষুনি ও টের পায়, ভীষণ শীত করছে। এত ঠান্ডা পড়ে এখানে রাতের দিকে?

কম্বলটাই তুলে গায়ে জড়িয়ে নেয় অগত্যা, সঙ্গে আর কিছু তো নেই। এবার কী যেন? ও হ্যাঁ, সেই জল পড়া।

কিন্তু সে আওয়াজ তো আবার বন্ধ হয়ে গেছে!

অদ্ভুত অন্ধকার হয়ে গেছে, কিচ্ছু আন্দাজ পাচ্ছে না। পা বাড়াতেই পায়ের এক ধাক্কায় টর্চটা গড়গড় করে বেড়াতে চলে গেল। ধুত্তোর!

দরজা এদিকেই ছিল। ওটা বোধহয় হাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে। খুলে দিলে কি একটু আলো আসবে?

আন্দাজে আন্দাজে ঠিক তিন পা ফেলেছিল, তারপরই পায়ের নীচের মাটি একদম আচমকা নেই হয়ে গেল!

হুড়মুড় করে যেখানটায় এসে পড়ল, সেটা ভাগ্যিস বাঁধানো চাতাল নয়। হাড়গোড় ভেঙে একশা হত তাহলে। তার বদলে ভেজা-ভেজা নরম মাটির স্পর্শ পেল মণিদীপা। ব্যথা লেগেছে, কিন্তু মারাত্মক নয়।

মাথার ওপর একটা অদ্ভুত ফ্যাঁশশশ আওয়াজ হয়ে অন্ধকার নেমে এল।

না, পুরো অন্ধকার না। হাল্কা আলো আছে। একটা জল ফুরোনো কুয়োর তলায় দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে। চারদিকে পাথরের দেওয়াল। শ্যাওলা পড়া।

দেওয়ালের গায়ে ব্যস্তভাবে হাতড়াতে থাকে ও। বড্ড বদ্ধ জায়গা। শ্বাসকষ্ট শুরু হবে জলদি বেরোতে না পারলে। বুকের ধুকপুক নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে, মানে প্যানিক অ্যাটাক আসতে আর দেরি নেই।

উফ্, কী ঠান্ডা এখানে! কম্বল দিয়ে মাথা পেঁচিয়ে নেয় মণিদীপা। কেন যে পাকামি মেরে এক্ষুনি আসতে গেল! পরে রকেটকে নিয়ে এলে হত। ভাবতে-ভাবতেই একজায়গায় পাথরের বদলে হাতে কাঠ ঠেকে। আলগা, ঠেলতেই ভেতর দিক ফাঁক হয়।

ওর গলে বেরোনোর পক্ষে যথেষ্ট বড়ো ফাঁক। জয়ত্তারা!

মণিদীপা ভেবেছিল, মুখটা বের করে দেখে নেবে বাইরে কী আছে। কিন্তু একে তো এই বদ্ধ জায়গার আতঙ্ক ওর মধ্যে এর মধ্যেই জমে উঠেছিল। তার ওপর ফাঁকের ধারটা ছিল পিছল। ব্যালেন্স রাখতে না পেরে হুড়মুড় করে ও বস্তার মতো বাইরে এসে আবার নীচে পড়ল। তক্ষুনি একটা ধাতব লাঠি সোজা এসে ওর মাথার মধ্যিখানে আঘাত করল।

রীতিমতো ব্যথা লেগেছিল। আততায়ী কে বোঝার কোনো সুযোগ ছিল না। তবে ওর ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে দিচ্ছিল, ধারেকাছে আরও কেউ আছে।

নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ করে, কান খাড়া করে আরেকটা শ্বাসপ্রশ্বাসের মৃদু শব্দ শুনতে পেল ও। পরবর্তী কর্তব্য স্থির করে ফেলল মণিদীপা। যে-ই থাকুক না কেন, সে অন্ধকারে ওকে দেখতে পাচ্ছে। নইলে এমন নিখুঁত ভাবে মাথার ঠিক পিছনে মারতে পারত না। কিন্তু সে ওকে ভয়ও পাচ্ছে। সেইজন্য আচমকা আক্রমণ করে আহত করে ফেলেও, সামনে আসছে না। নিশ্চয় দূর থেকে নজর করছে।

খুব আস্তে আস্তে, একটুও আওয়াজ না করে উঠে দাঁড়ায় মণিদীপা। রকেট নেই, কিন্তু ক্যারাটে শেখাটা তো ভুলে যাবে না। অন্ধকারেই, আন্দাজমতো আরও কয়েক পা এগোয় ও।

ধাক্কা খাবার কপাল আজ। এরকম আচমকা শূন্যে ঝুলন্ত কিছু আশা করেনি ও। গাছ-টাছ এত অন্ধকারেও ঠাওর করা যায়। কিন্তু এটা একটা জমাট বাঁধা অন্ধকারের মতো কী জানি। কাঁধে ধাক্কা লাগতেই দুমদাম করে কী-সব ভেঙেচুরে পড়ল।

আর লুকোনোর চেষ্টা করে লাভ নেই। আততায়ী এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে, ও কোথায় রয়েছে। চট করে মোবাইল বার করে আলো ফেলে সামনে।

বহুকাল আগের এক সন্ধ্যার মতো হিমেল আতঙ্ক মণিদীপার সারা শরীর বেয়ে শুঁয়োপোকার মতো চলাচল করতে থাকে। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে। বুকের মধ্যে বোমার মতো ফেটে পড়তে থাকে অবর্ণনীয় আর্তনাদ।

কুয়ো থেকে বাইরে বেরোয়নি সে। মণিদীপা দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট অ্যান্টিরুমের মধ্যে। ঘরটার দেওয়াল-জোড়া তাক। তাতেই ও ধাক্কা খেয়েছিল, তাই মেঝেতে পড়ে আছে গাদা গাদা সাবান আর ফিনাইল। তাদেরই মধ্যে শুয়ে আছে একটা মপার।

না! হতে পারে না!

চিৎকারটা ভেতরেই থেকে যায়। কান ঝাঁ-ঝাঁ করে, গলা দিয়ে এত্তটুকুও আওয়াজ হয় না। মন উন্মাদের মতো বোঝাতে থাকে— এটা স্বপ্ন, এটা হচ্ছে না…!

ঘরের কোণা থেকে একটা চাপা আওয়াজ ভেসে এল না?

শকের চোটে আর কারও উপস্থিতির কথা ভুলেই গেছিল মণিদীপা। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে ও আলো ফেলল সেইদিকে।

মুখে দু’হাত চাপা, দৃশ্যত থরথর করে কাঁপছিল বছর সাতেকের মেয়েটা। তার পরনে সাদা লেসের আকাশনীল ফ্রক, দুদিকে দুটো বিনুনি। যে চোখ দু’টো একরাশ আতঙ্ক নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে, বিস্ফারিত হলেও তাদের খুব ভাল করে চেনে মণিদীপা।

আজন্ম আয়নায় এ দুটো চোখই দেখে এসেছে সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *