এইট-সি

এইট-সি

ট্যাক্সিটা গেটের পাশে দাঁড় করাতেই খাকি পোশাকের সিকিউরিটি গার্ড এসে দাঁড়াল সামনে।

“কাল পাটিল সাব নে বোলকে গ্যায়া না? নিউ টেনান্ট?”

“জি। আইয়ে সাব।”

সোহমের সঙ্গে হাত লাগিয়ে ভারী স্যুটকেস দুটো নামিয়ে ফেলল গার্ডটি। কিটব্যাগ দুটোও নামাল। ল্যাপটপের ব্যাকপ্যাক পিঠে ফেলে, ভাড়া মিটিয়ে গার্ডের ডেস্কে এসে দাঁড়াল সোহম।

“সাব, এত কিছু তো একসঙ্গে লিফটে যাবে না। আপনি কিছু নিয়ে যান। আমি না হয় বাকি দিয়ে আসছি।”

খুশি হয় সোহম। ভালো তো লোকটা।

“পতা হ্যায় না, কিধার লে জানা হ্যায়? এইট-সি।”

ঝুঁকে স্যুটকেস আর ব্যাগগুলো গুছিয়ে রাখছিল গার্ডটি। সে হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর টুপি খুলে, সেটা আবার পরার সময় অন্যদিকে তাকিয়ে একগাদা কথা বলল। তাদের মর্মার্থ, তার পক্ষে বেশিক্ষণ ডেস্ক ছেড়ে যাওয়া মুশকিল। সাব যদি নিজেই আরেকবার এসে নিয়ে যান তো ভালো হয়।

সোহম আড়চোখে দেখল, এক বয়স্কা, কড়া হেডমিস্ট্রেসের মতো চেহারার মহিলা পিছন থেকে এসে হাজির হয়েছেন। সম্ভবত তাঁকে দেখেই গার্ডের এই মত পরিবর্তন। গৃহপ্রবেশের আগেই মেজাজটা একটু খিঁচড়ে গেল তার। একটা কিটব্যাগ আর একটা স্যুটকেস লিফটে ঢোকাল কষ্ট করে। একে জায়গা খুব কম, তার ওপর সেই মহিলাও ঢুকলেন।

মহিলা বেশ কটমট করে ওর দিকে চেয়ে আছেন বলে সোহমের অস্বস্তি হচ্ছিল। তাও ও ভাবল, নতুন পড়শির সঙ্গে আলাপ করে নেওয়াই ভালো।

“নমস্তে আন্টি, আই অ্যাম সোহম মণ্ডল। নিউ টেনান্ট হিয়ার।”

“নমস্তে বেটা। ম্যায় মিসেস গ্যাডগিল। ফ্ল্যাট নাম্বার টেন-এ। আপকা?”

সোহম ‘এইট-সি’ বলামাত্র মহিলা হিঁক করে যে আওয়াজটা করলেন সেটার জন্য ও মোটেই প্রস্তুত ছিল না। হেঁচকি উঠে গেল নাকি? তখনই লিফটটা এইটথ ফ্লোরে এসে দাঁড়াল। ব্যাগপত্র নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। লিফটের বন্ধ হতে থাকা দরজার ফাঁক দিয়ে সোহম দেখল, মহিলা কেমন তীব্র, উদ্ভ্রান্ত চোখে ওর দিকে চেয়ে আছেন।

ফ্ল্যাটে ঢুকেই ও একেবারে খুশিয়াল হয়ে উঠল। এমন বাজেটে মুম্বইতে এত সুন্দর ফার্নিশড ফ্ল্যাট, ভাবা যায়? ঠিক ওর ব্যাচেলর সংসারের যেমন দরকার— সাজানো গোছানো বেডরুম, মডিউলার কিচেন, সোফা সেট টিভি দেওয়া লিভিং রুম। উপরি পাওনা হল চেম্বুর এলাকার এমন চমৎকার একটা ভিউ।

ব্রোকার মিস্টার পাটিলকে বার বার প্রশ্ন করেছিল সোহম। কোন গণ্ডগোল আছে কি? জল চলে যায়? কারেন্ট থাকে না? লিফট খারাপ হয়? বর্ষায় দেওয়ালে সিপেজ হয়? উপরের ফ্ল্যাটে ধুপধাপ করে নাচ প্র‍্যাকটিস হয়? ডাম্পিং গ্রাউন্ডের দুর্গন্ধ বা ধোঁয়া আসে?

সবেতেই ডুগডুগ করে মাথা নেড়ে না বলে গেছে পাটিল। কিচ্ছু প্রবলেম নেই, ফ্ল্যাট “মস্ত্ আহে।” তাহলে এত কম ভাড়া কেন? সে মালিকের মর্জি। বিরাট বড়ো লোক, তাই এই নিয়ে কথা বলা সে পছন্দ করে না।

এর পর আর কথা বাড়ানো যায় না। সোহমও এত ভালো দাঁও মারার সুযোগটা ছাড়েনি। কাল সন্ধেবেলা ব্রোকারের অফিসে সব সইসাবুদ মিটে যেতেই ও আর দেরি করেনি। সোমবার হলেও রীতিমতো ছুটি নিয়ে আজই মালপত্র নিয়ে উঠে এসেছে।

এই যাহ্! গা এলিয়ে বসে থাকলে হবে? অন্য ব্যাগগুলো আনতে হবে না? চাবি হাতে নিয়ে বেরিয়ে দরজা টেনে দিল সোহম।

দরজাটা বন্ধ করার কয়েক সেকেন্ড আগে ওর হঠাৎ মনে হল, ছায়ার মতো কী একটা যেন সাঁৎ করে চলে গেল ঘরের মধ্যে। আবার দরজা খুলে মাথা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখল সোহম। কই, কিচ্ছু তো নেই। মনের ভুল হবে, বা পর্দার ছায়া। নতুন জায়গা তো।

ব্যাগ তুলে এনে, মনের আনন্দে সংসার পাততে থাকে সোহম।

*****

নতুন জায়গায় এক সপ্তাহ কেটে যায় সোহমের। ঘর মোছা আর বাসন মাজার ‘বাই’-ও পেয়ে গেছে সেই গ্যাডগিল আন্টির কল্যাণে। অমন কটমট করে তাকালেও মানুষটা মন্দ না। আসার দু’দিন পরেই অফিস-ফেরত সোহমকে কফি খেতে একদম ধরেই নিয়ে গেলেন মহিলা। কফির সঙ্গে ঘরে বানানো নিমকি, বাই এর ফোন নাম্বার আর মিস্টার গ্যাডগিলের একটানা স্মৃতিচারণ। মূলত শেষেরটার ভয়েই সোহম পরের তিনদিনই বেশ রাত করে ফিরল অফিস থেকে। মোটের ওপর ওর ভালোই লাগছিল এই নির্বান্ধব পুরীতে একটু আদর-যত্ন পেয়ে।

সেদিন আসার সময়ে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিলেন আন্টি, “রাত্রে ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে তো? কিছু ডিস্টার্ব করছে না তো?”

একদম ডিসটার্ব হচ্ছে না শুনে দু’জনেই এত খুশি কেন হলেন সেটাও রহস্য।

অবশেষে নতুন বাড়িতে প্রথম ছুটির দিন কাটানোর সুযোগ হল। সোহম ঠিকই করে রেখেছিল, আজ আর একদমই বেরোবে না। যাবেই বা কোথায়? গ্যাডগিল দম্পতি, আর উঠতে-নামতে লিফটে দেখা হলে সামান্য নড্ করা এক মিস্টার যাদব ছাড়া আর কাউকেই তো ও চেনে না। এই ফ্লোরের বাকি দুটো ফ্ল্যাটই বন্ধ। একটার মালিক বিদেশে থাকে, শুধু ডিসেম্বরে কিছুদিনের জন্য আসে। অন্যটার মালিক জনৈক শিবরাজন। তিনিও সপরিবারে গত এক বছর ধরে ব্যাঙ্গালোরে মেয়ের কাছেই আছেন। গার্ড সোনেভাউয়ের কাছ থেকে এর বেশি কিছু জানতে পারেনি সোহম। লোকটা একদমই মিশুকে নয়।

সারাদিন ভারি আরামে কাটল। দুটো নতুন বই পড়ে ছিল বহুদিন, কিছুটা করে পড়ল। জামাকাপড় কাচল। বাড়িতে ফোন করে বহুক্ষণ গল্প করল। দুপুরে পিজ্জা অর্ডার করে খেল, তারপর গান শুনতে-শুনতে ঘুমিয়েও পড়ল আয়েস করে।

ঘুম যখন ভাঙল, তখন সন্ধে হয় হয়। জানলায় দাঁড়িয়ে দেখল কার পার্কে আলো জ্বলে উঠল। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে কখন। জানলায় ঝোলানো শার্টগুলো আবার ভিজে গেছে। উঠে শার্টগুলো সরিয়ে রাতের জন্য খিচুড়ি বানাল সোহম। ওমলেটের পেঁয়াজ লঙ্কা কুচিয়ে রেখে এসে আবার বই খুলে বসল সে।

বৃষ্টিটা বেড়েছিল ইতিমধ্যে। ঝমঝম আওয়াজ আসছিল একটানা। বহুদিন পরে এমন নির্ঝঞ্ঝাট বই পড়ার সুযোগ পেয়ে মজে গেছিল সে। উঠি-উঠি করেও বাকি রান্নাটুকু সেরে খেয়ে নিতে ইচ্ছে করছিল না। আলসেমি একটা অজগরের মতো পেঁচিয়ে ধরছিল তাকে।

ঠক্ ঠক্ ঠক্!

প্রথমে খেয়াল করেনি সোহম। একটু পর, আরেকটু জোরে, বৃষ্টির আওয়াজ ছাপিয়ে আবার দরজায় আওয়াজ হল— ঠক্ ঠক্ ঠক্!

বই রেখে উঠে বসতেই হল। এ আবার কী? কলিং বেল বাজছে না? ওহ্ না, তাই তো!

কাল সন্ধেবেলাই বেলের ওখানে কী যেন শর্ট সার্কিটের মত চিড়িক মারছিল বটে। দেহ রেখেছে তবে সেটা। আগে খেয়াল করলে আজই সারিয়ে নেওয়া যেত। এইসব ভাবতে-ভাবতে দরজা খুলে হুব্বা হয়ে গেল সোহম।

খাঁ খাঁ করছে বাইরেটা। দুই ফ্ল্যাটে যথারীতি তালা। লিফটের দরজা বন্ধ।

যে এসেছিল, সে কি চলে গেল দেরি দেখে? যাকগে, আসবে না হয় আবার। দরজা বন্ধ করে সোফায় ফেরত যায় সোহম। যুত করে সবে বসেছে, অমনি আবার সেই ঠকঠকানি।

দুচ্ছাই! আবার গিয়ে দরজা খুলল। আবার সেই, কোথাও কেউ নেই।

এবার মেজাজটা রীতিমতো গরম হয় সোহমের। তখন জানলা দিয়ে কটা বাচ্চাকে নীচে ক্রিকেট খেলতে দেখেছিল না? নির্ঘাৎ তাদের কারো বদমাইশি এটা। নতুন লোক এসেছে জানার পর থেকে হয়তো এই প্রথম সুযোগ পেয়েছে ওকে জ্বালানোর।

‘দেখাচ্ছি মজা!’

দরজা বন্ধ করে তার ঠিক পিছনে জিম করা পাঁচ দশের সুগঠিত শরীরটা টান টান করে অপেক্ষা করে সোহম। আসুক এবার।

ঠক্ ঠক্…

অরণ্যদেবের গতিতে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সোহম। কিন্তু সবই বৃথা। এবারেও ধরতে পারে না বিচ্ছুটাকে। দরজাটাকে স্টপার দিয়ে আধখোলা করে রেখে দৌড়ে সিঁড়ির ওপর-নীচ দেখে আসে সে। কাজটা যেই করে থাকুক না কেন, সে খুব চালাক। কোথাও কোনো চিহ্ন রাখেনি সে।

‘গার্ডকে বলে আসা যাক।’ ভেবে দরজায় চাবি এঁটে নীচে চলল সোহম। কিন্তু লিফটে চেপে নেমে দেখল ডেস্ক ভোঁ-ভাঁ করছে। সোনেভাউ গেল কই? ও অবশ্য এই সময়টায় খেতে যায়। তাহলে?

হঠাৎ খেয়াল হয় সোহমের, মিস্টার গ্যাডগিল তো সোসাইটির কমিটি মেম্বার। ওঁকেই বলে আসা যাক তাহলে। রাত হয়েছে বটে, তবে ওঁরাই বলেছিলেন যে রাত বারোটার আগে নাকি ঘুমোন না। ‘টেন-এ’-র দরজায় বেল বাজানোর পর অবশ্য একটু লজ্জা হতে লাগল সোহমের। কী এমন জরুরি ব্যাপার ছিল এটা? কাল এলেও তো হত। কিন্তু ততক্ষণে দরজা খুলে দিয়েছেন আন্টি।

কী অদ্ভুত আলো এদের ঘরে! নীলচে সবুজ সেই আলোয় বৃহৎ অক্টোপাসের মতো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দু’জন। গেঞ্জি-পাজামা পরে, বাঁধানো দাঁত খুলে রেখে ফোকলা মুখে মিস্টার গ্যাডগিল। আন্টির চুল চুড়ো করে বাঁধা, পরনে হাউসকোট, চোখে সেই প্রথমদিনের মতো তীব্র কটমটে চাউনি।

আমতা-আমতা করতে থাকে সোহম। ওকে চমকে দিয়ে আন্টি ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞেস করেন, “এসেছে? সে এসেছে তো?”

“কে? কোথায়? কে আসবে?” নিজের কানেই অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ শোনায় সোহমের গলা।

“সে কে, তা কী করে জানব?” হিসহিস করে ওঠেন মিসেস গ্যাডগিল, “কিন্তু সে এসেছে বুঝতে পারছি! এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম।”

“লেকিন ইনহোনে ইতনা কুছ কিয়া তো থা।” মিস্টার গ্যাডগিল দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন, “অব অউর নহিঁ আনা চাহিয়ে থা।”

“রাখো তোমার ইতনা কুছ!” ঝাঁঝিয়ে ওঠেন মিসেস গ্যাডগিল, “লড়কার মুখ দেখে বুঝতে পারছ না, সে আবার ফিরে এসেছে?”

সোহম এবার বিনা আহ্বানেই ঘরে ঢুকে সোফায় বসে পড়ে। মিস্টার গ্যাডগিল ওর দিকে জলের বোতল বাড়িয়ে দেন। ঢকঢক করে জল খেয়ে আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত বলে সোহম।

খুব ধীরে-ধীরে মাথা নাড়েন মিস্টার গ্যাডগীল। তারপর বলতে থাকেন।

“অভিশপ্ত ফ্ল্যাট ওটা। শুরু হয়েছিল বছরতিনেক আগে। এই তোমার মতোই একজন ছেলে প্রথম ভাড়াটে ছিল। কী যেন দূর সম্পর্কের রিলেটিভ ছিল বাড়িওলার। ড্রাগ ধরেছিল। এমন হল শেষে যে ভাড়া দিতে পারছে না। বাড়িওলা একদিন আমাদের সবার সামনে খুব যা তা বলল ওকে। খুব ইন্সাল্ট করল বাপ-মা তুলে। পরদিন ভোরে সে ছেলে জানালা দিয়ে ঝাঁপ মেরে সুইসাইড করল।”

আন্টি খরখর করে বলে উঠলেন, “ইয়ে তো বস স্টার্টিং থা।”

“বছরখানেক ফ্ল্যাট খালি ছিল।” মাথা দুলিয়ে বললেন মিস্টার গ্যাডগিল, “তারপর এক সালের মধ্যে তিনজন ভাড়াটে এল আর গেল। প্রথমে এল এক কাপল। আমাদের চেয়ে কিছু কম বয়স, সদ্য রিটায়ার করেছে। এসে ব্যাপারটা নিয়ে শুনল। তারপর তিন দিনের মধ্যে সে লেডি পাঁচবার ফিট হয়ে গেল। রিস্ক না নিয়ে, টাকা লস করেই তারা চলে গেল এক সপ্তাহ বাদে।

তারপর এল এক উঠতি মডেল। যেমন তার সাজগোজ তেমনি ঝগড়ুটে। সে ছিল দু’ সপ্তাহ। প্রচুর ঝামেলা তার মধ্যেই। কে একটা ছেলে আসত নাকি সময়ে-অসময়ে। তারপর হঠাৎ একদিন সে মেয়ে দুপাট্টা গলায় দিয়ে ফ্যান থেকে লটকে গেল। সে মেয়ের সঙ্গে আমাদের কোনো কথা হয়নি। আসলে প্রথম দিনেই গাড়ি রাখার জায়গা নিয়ে আমার মিসেসের সঙ্গে একটু ক্ল্যাশ হয়ে গেছিল।

এ বাড়ির অর্ধেক বাসিন্দা বিদেশে থাকে। শিবরাজনরা তারপরেও কিছুদিন ছিল। পরে তাদের সঙ্গে কিছু হয়েছিল কি না, জানি না। তবে তারাও ক’দিন পর মেয়ের কাছে চলে গেল।”

রুদ্ধশ্বাস হয়ে সব শুনছিল সোহম। পাটিল নিশ্চয় এ-সব জানত। কিন্তু ও ভয় পাবে ভেবে বলেনি। ও বলল, “তারপর কী হল?”

“তার কিছুদিন পর আরেক ভদ্রলোক এলেন। উনি স্টক মার্কেটে কাজ করতেন। কারো সঙ্গে কথা বলতেন না বিশেষ। আমরা একবার কথা বলতে গেছিলাম, পাত্তাই দেননি।”

“সেও সপ্তাহদেড়েক টিকেছিল। ডাক্তার অবশ্য বলেছিলেন, হার্ট অ্যাটাক।” আন্টির মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেল, ডাক্তারকে উনি বিশ্বাস করেননি।

আঙ্কল আবার বিড়বিড় করলেন, “তারপর তো এত যাগযজ্ঞ হল। এত পূজাপাঠ। তবু… সে ফিরেই এল!”

এবার একটু ধাতস্থ লাগে সোহমের। কেসটা বোঝা যাচ্ছে। একটু জোর দিয়েই ও জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা আন্টি, এই কমপ্লেক্সে এমন কোনো দুষ্টু বাচ্চা নেই যে এটা করতে পারে?”

একটু থতমত খান দু’জনেই। মুখ চাওয়াচাউয়ি করে আন্টি দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলেন, “এইট-বি-র বিট্টু বলে ছেলেটা মহা বদ। ক্লাস সিক্সে পড়লেও দস্যিপনা কম নয়। কালকেই মেহতা ম্যাডামের বেড়ালটাকে কী পরিমাণ জ্বালাচ্ছিল!”

নিশ্চিন্ত হয়ে উঠে পড়ল সোহম। আচ্ছা লোকের পাল্লায় পড়েছিল যাহোক। কিছু সমাপতন, কিছু অপঘাত মৃত্যু একই ঘরে। তাই নিয়ে এই ঘরে বসে বোর হওয়া বুড়ো-বুড়ির মেলোড্রামা। ধুর-ধুর!

নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসতে-আসতে সোহমের মনে হল, সবক’টা মৃত্যুই এই শহরের রাক্ষুসে গতির গ্রাস। প্রথমজন গেছে অসুস্থ জীবনযাপনের ফলে। পরের জন এদেরই মতো কল্পনাপ্রবণ, গল্প শুনেই অজ্ঞান হয়েছে। মেয়েটার তো ভুলভাল লাইফ ছিল, এরা এভাবেই মরে। আর শেষেরটা পিওর কাজের স্ট্রেস হবে। সেই তুলনায় ও নিজে খুব মেপে জীবন কাটায়। বই পড়া, গান শোনার মতো সুস্থ বিনোদন আছে ওর। একটা ভালো চাকরি করে। নিয়মিত শরীরচর্চা করে। ওর নার্ভ এত দুর্বল নয় যে এ-সবের শিকার হবে।

লঘু পায়ে এসে ঘরের দরজায় চাবি ঢোকায় সোহম। ঘরের আলো যেমন রেখে গেছিল সেভাবেই জ্বলছিল। দরজাটা অনাবশ্যক জোরে বন্ধ করতে গিয়েই বিপত্তিটা হল। গোল নবটা খুলে বেরিয়ে এল হাতের মধ্যে।

ধুত্তোর! বাড়ির মালিক যাগযজ্ঞ না করিয়ে মেইনটেনান্সটা ঠিক করে করালে কাজে দিত। বিরক্তিতে নবটা ছুঁড়ে ফেলে সোহম। ঠিক বেলের জায়গায় গিয়ে লাগে সেটা। জোরালো একটা চিড়িক মেরেই ঘরের সব আলো নিভে যায়।

যাব্বাবা!

অন্ধকার হলেই স্নায়ু খাড়া হয়ে ওঠা বোধহয় মানুষের সহজাত। একবার শিউরে উঠেই নিজেকে শক্ত করে সোহম। যত্ত ছেলেমানুষি। জানলা দিয়ে চাঁদের আলো আসছে, আবছা দেখা যাচ্ছে সব। দিব্যি রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কাল দেখা যাবে এসব সারাই। ছুটি নিতে হবে মনে হচ্ছে। পায়ে পায়ে ঘরের মাঝখানে পৌঁছে গেছিল ভাবতে ভাবতে, হঠাৎ থমকে থেমে আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে সোহম।

ঠক্ ঠক্ ঠক্!

সেই দরজায় নক করার আওয়াজটা এসেছে আবার। তফাতের মধ্যে, আওয়াজটা এবার আসছে তার শোয়ার ঘরের বন্ধ পাল্লার ওপার থেকে!   

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *