হাজার বছর ধ’রে

হাজার বছর ধ’রে

কালের কুয়াশা ঘেরা এক সময়ে মাগধী প্রাকৃতের বুক থেকে উদ্ভূত হয়েছিলো বাঙলা ভাষা। তারপর কেটে গেছে হাজার বছর। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্মেছে বাঙালি, মিশে গেছে প্রকৃতির সাথে। কতো রাজা এসেছে আর মিশে গেছে আগুনে মাটিতে। নানাভাবে রূপ বদল ঘটেছে বাঙালির মাতৃভূমির। এসব নশ্বরতার মধ্যে শুধু অবিনশ্বর হয়ে আছে বাঙলা ভাষা অবশ্য বাঙলা ভাষা বলতে একটি অনন্য বাঙলা ভাষা বোঝা ঠিক হবে না। বাঙলা ভাষা-অঞ্চলে বাঙালিরা ব্যবহার করেছে বিভিন্ন রকম বাঙলা ভাষা। কিন্তু তাদের মধ্যে ছিলো আন্তর মিল। তারা একই বাঙলা ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ। বা বলা যেতে পারে বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ থেকে আধুনিক কালে জন্ম নিয়েছে এক সর্ববঙ্গীয় বাঙলা ভাষা। হাজার বছরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে মানুষ, রাজাবাদশাহ। বদলে গেছে দেশের আকৃতি। কিন্তু টিকে আছে বাঙালির ভাষা। তার কণ্ঠস্বর। বাঙলা ভাষা।

কিন্তু কিছুই চিরস্থির অবিনশ্বর নয় পৃথিবীতে। বাঙলা ভাষাও নয়। হাজার বছরে পৃথিবীর কতো ভাষা ম’রে গেছে, হারিয়ে গেছে। বহু ভাষা শুধু লাশের মতো রক্ষিত হয়ে আছে কাগজের কফিনে। কোথায় আজ ভাষার রাজারা, গ্রিক-লাতিন-সংস্কৃত? কোথায় পালিপ্রাকৃত? ওই সব ভাষা আজ শুধু পণ্ডিতদের আনন্দ। কোনো মানুষের বুক থেকে মুখ থেকে সেগুলো মুখর হয়ে ওঠে না। কিন্তু বাঙলা জীবিত ও জীবন্ত ভাষা, মুখর হয়ে ওঠে বাঙালির মুখ থেকে। বুক থেকে। রক্ত ও অস্তিত্ব থেকে। জন্মের পর কেটে গেছে তারও জীবনের হাজার বছরেরও বেশি সময়। এতো বছর ধ’রে স্থির অবিচল থাকে নি বাঙলা ভাষা। নানাভাবে বদলে গেছে তার রূপ। বদলে গেছে তার স্বর। কালেকালান্তরে নতুন থেকে নতুনতর হয়ে উঠেছে বাঙলা।

তিনিএঁ পার্টে লাগেলি রে অণহ কসণ ঘণ গাজই। “চর্যাপদ”-এ বাঙলা ভাষা ছিলো এমন সুদূর।
মুছিআঁ পেলায়িবোঁ বড়ায়ি শিষের সিন্দুর। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ বাঙলা ভাষা বেশ কাছে এসে গেছে আমাদের।
কার কিছু নাঞি লই করি পরিহার। যথা যাই তথায় গৌরব মাত্র সার। কৃত্তিবাসের “রামায়ণ”-এ (পঞ্চদশ শতকের শেষভাগ) বাঙলা আরো কাছাকাছি এসে গেছে আমাদের।
এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা কেমনে আইলে বাটে। চণ্ডীদাসের পদে বাঙলা ভাষা এমন।
তৈল বিনা কৈলঁ স্নান করিনু উদক পান শিশু কাঁদে ওদনের তরে। মুকুন্দরামের “চণ্ডীমঙ্গল”-এ (ষোড়শ শতকের শেষভাগ বা সপ্তদশ শতকের শুরুর দশক) বাঙলা ভাষা এমন।
আমি তো ধৰ্ম্মো নিন্দা করি না, ধর্ম্মের ধর্ম্মো কহি; অধম্মোরে অধৰ্ম্মো কহি। দোম আন্তনিয়োর “ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক-সংবাদ”-এ (সপ্তদশ শতক) পাই এমন বাঙলা ভাষা।
পাঁচ বৎসর পর্য্যন্ত কৌমার বলি। দশ বৎসর পর্য্যন্ত পৌগণ্ড বলি। এমন অদ্ভুত বাঙলা পাই আঠারোশতকের একটি রচনায়।

বদলে গেছে বাঙলা ভাষা। নানা রূপে। নানা সুরে। স্বরব্যঞ্জনে। বিশেষ্যবিশেষণে। সর্বনামে ক্রিয়ারূপে।

এখন যে-ধ্বনিগুলো আছে বাঙলা ভাষায়, সেগুলো এখন যেভাবে উচ্চারণ করি, হাজার বছর আগে সেগুলো অবিকল এমনভাবে উচ্চারিত হতো না। একেবারে ভিন্নভাবে যে উচ্চারিত হতো, তাও নয়। প্ৰত্যেক যুগের মানুষ একইভাবে তাদের ভাষার ধ্বনি উচ্চারণ করে না। বাঙালিরাও করে নি। তাতেই বদলে গেছে বাঙলা ভাষার ধ্বনি। পরিবর্তিত হয়ে গেছে শব্দের রূপ। হাজার বছর আগে যে-সব শব্দ ব্যবহার করতো বাঙালিরা, সেগুলোর সব আমরা ব্যবহার করি না। অনেক শব্দ ব্যবহার করি অন্যরূপে। রূপ বদলে গেছে। বিশেষ্যর বিশেষণের। ক্রিয়ার রূপ বদলে গেছে। অনেক শব্দের অর্থ বদলে গেছে। ম’রে গেছে বহু শব্দ। জন্ম নিয়েছে অনেক নতুন শব্দ। বিদেশি ভাষা থেকে শব্দ ঋণ করেছি অনেক। তাই হাজার বছরে অনেকখানি বদলে গেছে বাঙলা ভাষার শরীর। কথা বলতে হয় বাক্যে। বাক্য তৈরির নিয়মে ঘটেছে অনেক বদল। আদিযুগ থেকে মধ্যযুগ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে বাঙলা ভাষা প্রবেশ করছে নিজের রূপ বারবার বদল ক’রে। তাতে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যায় নি। নদীর মতো এগিয়েছে সামনের দিকে। নদীর উৎস থেকে মোহানা অনেক দূর, আর অনেক ভিন্ন। ঠিক তেমনি অনেক দূর আর ভিন্ন বাঙলা ভাষার উৎস ও মোহানা। কতোটা সুদূর, কতোটা ভিন্ন? তার কিছু পরিচয় নেয়া যাক এবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *