জলেতে উঠিলী রাহী

জলেতে উঠিলী রাহী

জলেতে উঠিলী রাহী আধ করি তলে। লিখেছেন বড়ু চণ্ডীদাস। ‘জলেতে উঠিলী রাহী?’ জলে উঠলো রাধা? কেমন লাগে? জলে কী ক’রে ওঠে? কিন্তু কবি জলে ওঠার কথা বলছেন না। তিনি বলছেন যে রাধা জল থেকে উঠলো, অর্ধেক তার জলের ভেতরে। আমরা এখন বলি ‘জল থেকে’,’বাড়ি থেকে’। ‘থেকে’ অর্থে ছশো বছর আগে বড়ু চণ্ডীদাস ব্যবহার করেছিলেন ‘তে’। ‘তে’ একটি বিভক্তি। বাঙলায় বিশেষ্য ও সর্বনামের সাথে পদে পদে বিভক্তি বসে। ‘আমি’ আর ‘তুমি’ সর্বনাম, ‘চিন’ একটি ক্রিয়ামূল। এদের দিয়ে বাক্য বানালেই ‘আমি’ আর ‘তুমি’র সাথে গেঁথে দিতে হবে বিভক্তি। তখন রূপ বদলে যাবে সর্বনামের। ‘আমি তোমাকে চিনি’, ‘তুমি আমাকে চেনো’। ‘কে’ লাগানো হলো আর রূপ বদলে গেল ‘আমি’ ও ‘তুমি’র। বিভক্তি গেঁথে দিতে হয় বাঙলা বাক্যের বিভিন্ন পদে। বিভক্তির জন্যেই বাঙলা বাক্য বেশ নমনীয়; শব্দগুলোকে বাক্যের এদিকেসেদিকে সরানো যায়। বলতে পারি, ‘তোমাকে চিনি আমি’, ‘চিনি তোমাকে আমি’। অর্থ ঠিক থাকে, শুধু শব্দের স্থান বদলে যায়।

নানা বিভক্তি আছে বাঙলায়। বাক্যের একটি পদকে বলা হয় ‘কর্তা’। কর্তাপদে সাধারণত আধুনিক বাঙলায় বিভক্তি লাগে না। তবে লাগে বা লাগাই মাঝে মাঝে। বলি, ‘মায়ে ডেকেছে’,’পাগলে ছাগলে কতো কী বলে আর খায়।’ এখানে বিভক্তি লেগেছে ‘এ’ বা ‘য়ে’। বাক্যে একটি পদকে বলে ‘কর্ম’। কর্মে বিভক্তি লাগে। বলি : ‘তোমাকে কী যে ভালো লাগে।’ একটু গীতিময় হ’লে কেউ বলে : ‘চিনিলে না আমারে কি, চিনিলে না।’ একটু কোমল হয়ে বলি : ‘তোমায় তো চিনেছি কালেকালে।’ এখানে বিভক্তি পাচ্ছি ‘কে’, আর ‘রে’ আর ‘য়’। এক ধরনের পদকে বলি ‘করণ’। করণে বিভক্তি লাগে ‘এ’, ‘তে’। কখনো লাগেও না। কখনো ‘দ্বারা’, ‘দিয়ে’ বিভক্তির কাজ করে। বলি : ‘ছুরিতে কেটেছে’, ‘ছুরি দিয়ে কেটেছি’। অপাদানে এখন বিভক্তির বদলে ‘থেকে’ শব্দটি কাজ করে। বড়ু চণ্ডীদাস এখন লিখতেন : ‘জল থেকে উঠলো রাধা’। অধিকরণে অর্থাৎ স্থান বোঝাতে বিভক্তি লাগে ‘এ’, ‘তে’ ইত্যাদি। অনেক সময় লাগেও না।

বাঙলা ভাষার শুরু থেকেই বাক্যের বিভিন্ন পদে বিভক্তি বসছে। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায়ও বিভক্তি বসতো। বসতো প্রাকৃতেও। কিন্তু শুরু থেকে আজ পর্যন্ত বাঙলায় বিভক্তিগুলো এক নয়। নানা রকম বদল ঘটেছে তাদের। অনেক বিভক্তি হারিয়ে গেছে। জন্ম নিয়েছে অনেকগুলো। অনেক পদ আবার এমন হয়ে উঠেছে যে বিভক্তি নিতে চায় না। বিভক্তি ছাড়াই কাজ চালায়। কিন্তু বিভক্তি আছে বাঙলায়। এগুলো আবার সুনির্দিষ্ট নয়। এমন নয় যে বিশেষ পদের জন্যে বিশেষ বিভক্তি নির্দিষ্ট। বাঙলায় একই রূপের বিভক্তি বসে বিভিন্ন পদে। আবার একই পদে বসে বিভিন্ন বিভক্তি। আমাদের বিভক্তিগুলোর ইতিহাস আছে।

আজকাল বাঙলায় কর্তাপদে সাধারণত কোনো বিভক্তি বসে না। হাজার বছর ধ’রেই এ-রকম হচ্ছে। পুরোনো বাঙলা, মধ্য বাঙলায় সাধারণত কর্তাপদ বিভক্তিশূন্যই থাকতো। ব্যাকরণরচয়িতারা এ-শূন্যতার নাম দিয়েছেন ‘শূন্যবিভক্তি’। যেমন, “চর্যাপদ”-এ :

‘ভণই কাহ্ন আহ্মে ভলি দাহ দেহুঁ।’ কাহ্নপাদ বলে আমি ভালো দান দিই।

‘ভণই কাহ্ন মো-হিঅহি ণ পইসই।’ কাহ্নপাদ বলে আমার হৃদয়ে পশে না।

‘ভুসুকু ভণই মূঢ়হিঅহি ণ পইসই।’ ভুসুক বলে মূঢ়ের হৃদয়ে পশে না।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাওয়া যায় :

‘গাইল বড়ু চণ্ডীদাস বাসলীগণ।’ বাসলীভক্ত বড়ু চণ্ডীদাস গাইল।

‘কাহ্নাঞিঁক বুইল বড়ায়ি বচন মধুরে।’ বড়ায়ি কৃষ্ণকে মধুর বচন বললো।

‘সপনে দেখিলো মো কাহ্ন।’ স্বপ্নে আমি কৃষ্ণকে দেখলাম।

কর্তায় ‘এ’ আর ‘এঁ’ পাওয়া যায় আদিযুগে ও মধ্যযুগে। “চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় :

‘রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ।’ গাছের তেঁতুল কুমিরে খায়।
‘কানেট চোরে নিল অধরাতী।’ আধরাতে চোরে নিলো কানেট।
‘ভণথি কুক্কুরীপাএ ভব থিরা।’ কুক্কুরীপাদ বলে জগৎ স্থির।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাওয়া যায় :

‘গাইল বড় চণ্ডীদাসে।’ বড় চণ্ডীদাস গাইলো।

‘প্রথমত কংশে পুতনাক নিয়োজিল।’ কংশ প্রথম পুতনাকে নিয়োগ করলো।

‘তোহ্মে কেহ্নে সে বোল বোলহ আহ্মারে।’ তুমি কেনো আমাকে সে-কথা বলো।

কিন্তু এই ‘এ’ খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। আধুনিক বাঙলায় এটি তো দুষ্প্রাপ্যই, এমনকি আদি ও মধ্যযুগেও এটি বিরল।

কর্মে এখন সবচেয়ে প্রতাপশালী হচ্ছে ‘কে’। কবিতায় কিছুকাল আগেও ‘রে’ বসতো ফিরেফিরে। অনেক কর্মে কোনো বিভক্তিই বসে না। ‘আমি তোমাকে পছন্দ করি’ বলার সময় ‘তুমি’র সাথে একটি ‘কে’ গেঁথে দিতে বাধ্য হয়েছি। না দিলে বাঙলাই হতো না। বলতে তো পারি না ‘আমি তুমি পছন্দ করি’। কিন্তু বলতে পারি ‘আমি ফুল পছন্দ করি’, ‘তুমি মেঘ ভালোবাস’, আর ‘সে বাঘ মারে’। চিরকালই বাঙলায় অনেক কর্মে কোনো বিভক্তি বসে না। পুরোনো বাঙলায় কর্মে ‘এ’ আর ‘এঁ’বসতো। আদিমধ্যযুগে এদের সাথে যোগ দেয় আরো কয়েকটি কর্মবিভক্তি। বসতে শুরু করে ‘ক’ আর ‘কে’ আর ‘রে’ বিভক্তি, আর মধ্যযুগের শেষভাগে দেখা দেয় ‘ত’, ‘তে’ ও ‘কারে’ বিভক্তি। কর্মে কোনো বিভক্তি না থাকার উদাহরণ পাই “চর্যাপদ”-এ :

‘পুণ সইআঁ আপণা চটারিউ।’ পুনরায় নিজেকে নিয়ে নিঃশেষ হলাম।

“রূপা থোই নাহিক ঠাবী।’ রুপো রাখার ঠাঁই নেই।

‘লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জাণ।’ লুইপাদ বলে গুরুকে জিজ্ঞেস ক’রে জানো।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাওয়া যায় কর্মে ‘এ’ ও ‘রে’র উদাহরণ :

‘ত্রিভুবনজনমন গোচর তোহ্মাত্র।’ তিনভুবনের লোকেরা তোমাকে চেনে।

‘বুঝিবারে নারিল তোহ্মারে জগন্নাথ।’ জগন্নাথ তোমাকে বুঝতে পারলাম না।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ পাওয়া যায় কর্মপদে ‘ক’, ‘কে’ ও ‘তে’ বিভক্তি কয়েকটি উদাহরণ :

‘লক্ষ্মীক বলিল দেবগণ’। দেবতারা লক্ষ্মীকে বললো।

‘দেহ রাধা কাহ্নাইক আশ।’ রাধা কৃষ্ণকে আশা দাও।

‘থাকিব যোগিণী হঞা তোহাঁক সেবিঞা’। তোমাকে সেবা ক’রে

যোগিণী হয়ে থাকবো।

‘তোহ্মাকে মো মাইলোঁ বাণে।’ তোমাকে আমি বাণ মারলাম।

‘কহিলোঁ মো তোহ্মাতে স্বরূপ।’ তোমাকে ঠিক কথা বললাম।

করণপদে এখন বিভক্তি বসে ‘এ’ আর ‘তে’। অনেক সময় কোনো বিভক্তি লাগেও না করণে। মধ্যযুগের শেষভাগে ছিলো ‘এ’, ‘ত’, আর ‘তে’। প্রথম ভাগে ছিলো ‘এঁ, ‘এ’ আর ‘ত’। “চর্যাপদ”-এর বাঙলায় পাওয়া যায় করণের বিভক্তি ‘এঁ’, ‘এ’, ‘এতেঁ’। এই ‘এঁ’ বিভক্তিটিই মজার।

“চর্যাপদ”-এ কাহ্নপাদ বলেন : ‘দেহ-নঅরী বিহরএ একারে।’ এক নাগাড়ে দেহ-নগরে বিহার করে।

“চর্যাপদ”-এর কবি বলেন : ‘ভণই কঙ্কন কলএল সাদেঁ।’ কঙ্কনপাদ কলকল শব্দে বলে।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ বড়ায়ি বলে : ‘তোহ্মার আনুমতীএঁ মাণিকে হিরা বিন্ধে।’ তোমার ইঙ্গিতে মাণিকে বিঁধে হীরে।

অধিকরণে, স্থান বোঝাতে, এখন ‘এ’ আর ‘তে’ বিভক্তি বসে। কখনোকখনো বিভক্তি লাগেও না। আদি ও মধ্যযুগে অধিকরণের ছিলো একরাশ বিভক্তি। পুরোনো ও মধ্য বাঙলায় ‘এঁ’, ‘এ’ ছিলো। মজার হচ্ছে পুরোনো বাঙলায় ‘হি’ বা ‘হি’, আর পুরোনো ও মধ্য বাঙলার ‘ত’। যেমন :

“চর্যাপদ”-এ ভুসুকু বলেন : ‘মূঢ়া হিঅহি ণ পইসই।’ মূঢ়ের হৃদয়ে পশে না।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘বাহুত বলয় শোভে পাএত নূপুর।’ বাহুতে বলয় পায়ে নূপুর শোভে পায়।

রাধা বলে: “নিকুঞ্জত চাহা আর যমুনার তীরে।’ নিকুঞ্জে আর যমুনার তীরে খোঁজো।

এভাবেই হাজার বছর ধ’রে বদলিয়েছে আর টিকে আছে বিভিন্ন পদের বিভক্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *