ধ্বনিপরিবর্তন : শব্দের রূপবদল

ধ্বনিপরিবর্তন : শব্দের রূপবদল

প্রাচীন ভারতীয় আর্য (বা বলা যাক সংস্কৃত) ভাষার বহু শব্দ বাঙলায় এসেছে। অনেক শব্দ এসেছে অবিকল, কোনো বদল ঘটে নি তাদের। অনেক শব্দ এসেছে রূপ বদল ক’রে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ’রে মানুষের মুখে ধ্বনি বদলে গেছে ওই শব্দগুলোর। কোনোটির শুরুর স্বরধ্বনি লোপ পেয়েছে। কোনোটিতে পুরোনো স্বরধ্বনি লোপ পেয়ে ধ্বনিত হয়েছে নতুন স্বর। ব্যঞ্জন বদলে গেছে নানাভাবে। বদলে গেছে পুরোনো আর্যভাষার যুক্তব্যঞ্জনের সজ্জা। বদল ঘটেছে প্রাকৃতের যুগে। পরিবর্তন ঘটেছে বাঙলার যুগে। বাঙলা ভাষার উদ্ভবের কালে। পরিবর্তন ঘটেছে বাঙলার মধ্যযুগে। পরিবর্তন ঘটছে এখন। এ-পরিবর্তন ঘটেছে অনেক সময় বেশ নিয়মকানুন মেনে। সূত্রানুসারে। কালিন্দী নদীর কূলে বাঁশি বেজে উঠেছিলো। ‘বাঁশি’ শব্দটিকে এখনো কেউকেউ লেখেন ‘বাঁশী’। বাঙলায় শব্দটি ‘বাঁশি’ বা ‘বাঁশী’। বাঙলা ভাষার আগের যুগ প্রাকৃতের যুগ। তখন শব্দটি ছিলো ‘বংসী’। তারও আগে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার যুগ। তখন শব্দটি ছিলো ‘বংশী’। ‘বংশী’ শব্দটি এখনো বাঙলায় কখনো কখনো ব্যবহৃত হয়। ম’রে যায় নি শব্দটি। কিন্তু এটি থেকে প্রাকৃতে যে ‘বংসী’ জন্মেছিলো, সেটি ম’রে গেছে। রাতের আকাশের রূপসীর নাম ‘চাঁদ’। পুরোনো বাঙলায় শব্দটি ছিলো ‘চান্দ’। তারও আগে প্রাকৃতের যুগে ছিলো ‘চন্দ’। আর প্রাচীন ভারতীয় আর্যের কালে ছিলো ‘চন্দ্র’। ‘চন্দ্ৰ’ এখনো বাঙলা ভাষায় উজ্জ্বল। কিন্তু ‘চাঁদ’ আছে বুকের কাছাকাছি।

‘চন্দ্র’ থেকে ‘চাঁদ’, আর ‘বংশী’ থেকে ‘বাঁশি’ জন্ম নিয়েছে নিয়মকানুন মেনে। এলোমেলোভাবে নয়। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার শব্দগুলো নানা রকম নিয়মে পরিবর্তিত হয়েছে, পরিণত হয়েছে প্রাকৃত শব্দে। তারপর আরো ধ্বনিপরিবর্তন ঘটেছে, জন্ম নিয়েছে বাঙলা শব্দ। বাঙলা ভাষার জন্মের পর শব্দের ধ্বনিপরিবর্তন থেমে যায় নি, ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘ’টে চলছে। এখনি খুঁজলে বাঙলা ধ্বনিপরিবর্তনের অনেক নিয়ম বের করতে পারি। তবে তাতে যাচ্ছি না। কিন্তু কীভাবে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার স্বর আর ব্যঞ্জন বদলে গিয়েছিলো? কী রূপ নিয়েছিলো প্রাকৃতে? কী রূপ নিয়েছে বাঙলায়? তার কয়েকটি নমুনা এখন দেখতে চাই। জানতে চাই কয়েকটি নিয়ম।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার যে-সব শব্দে যুক্তব্যঞ্জন (যেমন : ন্ম, দ্য, স্ত প্রভৃতি) ছিলো প্রাকৃতে সেগুলো হয়ে যায় যুগ্মব্যঞ্জন (যেমন : ম্ম, জ্জ, খ, প্রভৃতি), এবং বাঙলায় সেগুলো হয় একক ব্যঞ্জন (যেমন : ম, জ, থ প্রভৃতি)। সাথেসাথে আরো একটি ব্যাপার ঘটে। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় ও প্রাকৃতে যুক্ত ও যুগ্ম ব্যঞ্জনের আগে যেখানে ছিলো ‘অ’ বাঙলায় সেখানে হয়ে যায় ‘আ’। কয়েকটি উদাহরণ দিলে বোঝা সহজ হবে।

প্রাভাআপ্রাকৃতপ্রাচীন বাঙলাআধুনিক বাঙলা
জন্মজন্মজাম
অদ্যঅজ্জআজিআজ
অষ্টঅট্‌ঠআঠআট
হস্তহত্থহাথহাত

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় ‘জন্ম’ শব্দে ‘ন’ ও ‘ম’ যুক্ত ছিলো, ‘জ’-র সাথে ছিলো ‘অ’। প্রাকৃতে ‘ন্ম’ হয়ে গেলো যুগ্মব্যঞ্জন ‘ম্ম’। বাঙলায় হলো ‘ম’,—একক ব্যঞ্জন। তবে সাথেসাথে ‘জ’-র সাথের ‘অ’ হয়ে গেলো ‘আ’। লেখা হলো ‘জা’। ‘জন্ম’ থেকে পুরোনো বাঙলায় জন্মেছিলো ‘জাম’ শব্দটি। তবে শব্দটি প্রমাণ করেছে যে জন্মিলে মরিতে হয়—আধুনিক বাঙলায় শব্দটি আর নেই। গোপনে অনেক আগে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে শব্দটি। কিন্তু

“চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় :

গেলী জাম বহুড়ই কইসে। জনমভর গেলাম, ফিরে আসে কিসে
ডোম্বি বিবাহিআ আহারিউ জাম। ডোম্বীকে বিয়ে ক’রে জম্ম আহার করলাম।
জাম মরণ ভব কইসণ হোই। জম্ম-মরণ-ভব কী ক’রে হয়।
“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাওয়া যায় ‘হাথ’:

আহ্মার হাথত দেহ কিছু ফুল পানে। তাকে লআঁ জাই আহ্মে রাধিকার থানে ॥ আমার হাতে কিছু ফুলপান দাও। তা নিয়ে আমি রাধিকার কাছে যাই।
হাথতে লগুড় বাঁশী বাএ সে সুরঙ্গে। হাতে সে লগুড় বাঁশি আনন্দে বাজায়।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার অনেক আদিস্বর বাঙলায় লোপ পেয়েছে। যেমন :

প্রাভাআপ্রাকৃতপ্রাচীন বাঙলাআধুনিক বাঙলা
অতসীতসীতিসি
উডুম্বরডুম্বরডুমুর
অরিষ্টরিট্‌ঠরিঠা
অলাবুলাউ

শব্দ শুরুর ‘ঋ’ বাঙলায় বদলে গেছে নানাভাবে। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার শব্দের শুরুর একলা বা ব্যঞ্জনের সাথে যুক্ত ‘ঋ’ কোথাও ‘অ’ কোথাও ‘ই’ কোথাও ‘উ’ হয়ে গেছে বাঙলায়। যেমন :

প্রাভাআপ্রাকৃতপ্রাচীন বাঙলাআধুনিক বাঙলা
ঘৃতঘিঅঘীঘি
বৃক্ষরুকখরুখ
ঋজুউজ্জুউজু

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাওয়া যায় : ‘নঠ হৈল ঘোল দুধ আর নঠ ঘী।’ নষ্ট হলো ঘোল দুধ আর ঘি।

“চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় : ‘রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ।’ গাছের তেঁতুল কুমিরে খায়।

“চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় : ‘জে জে উজুবাটে গেলা আনাবাটা ভইলা সোঈ।’ যে যে সোজা পথে গেলো তারা আর ফিরে এলো না।

‘রুখ’ আর ‘উজু’ আধুনিক বাঙলায় আর নেই।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা ও প্রাকৃতের বহু শব্দের শুরুতে যেখানে ‘অ’ ছিলো, শ্বাসাঘাতের ফলে বাঙলায় সেখানে ‘আ’ হয়ে গেছে। এমন হ’তে শুরু করে বাঙলা ভাষার জন্মের বেশ কিছুকাল পর, মধ্যযুগের শুরু থেকে।

যেমন :

প্রাভাআপ্রাকৃতপ্রাচীন/মধ্য বাঙলাআধুনিক বাঙলা
অপরঅবরআঅরআর
অবিধবাঅবিহবাআইহএয়ো
অভিমন্যুঅহিমগ্নআইহণআয়ান
অলক্তকঅলত্তয়আলতাআলতা

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”- এ পাওয়া যায় :

আঅর কাঢ়িআঁ নিল গুণিআঁ গলার। আর কেড়ে নিলো গলার হার।
কুণ্ডল নিলেক আঅর বলয়া। কুণ্ডল আর বলয় নিলো।
চিরকাল জীউ মোর সামী আইহন। চিরকাল জীবিত থাকুক আমার স্বামী অভিমন্যু।

ধ্বনিপরিবর্তনের একটি নিয়মকে বলে নাসিক্যীভবন। বাঙলায় নাসিক্যধ্বনি হচ্ছে ঙ্, ঞ, ণ, ন, ম্। এগুলো উচ্চারণের সময় নাক দিয়ে কিছুটা বাতাস বেরিয়ে যায়। অনেক শব্দে আগে এ-ধ্বনিগুলো ছিলো, কিন্তু পরে লোপ পেয়ে গেছে। লোপ পেয়েছে কিন্তু তাদের স্মৃতি একেবারে লোপ পায় নি। স্মৃতিস্বরূপ এরা আগের স্বরধ্বনিকে আনুনাসিক ক’রে দিয়েছে; অর্থাৎ ওই স্বরধ্বনির উচ্চারণের সময় বাতাস কিছুটা নাক দিয়ে বেরোয়। বাঙলায় এমন ব্যাপার নির্দেশ করা হয় চন্দ্রবিন্দু [ ঁ ] দিয়ে। একটি শব্দ ছিলো ‘চন্দ্র’, যাতে আছে ‘ন’। পরে ‘ন’-টি লোপ পায়, আগের ধ্বনিটি ‘আ’ হয়, ও আনুনাসিক হয়। ফলে জন্ম নেয় ‘চাঁদ’ শব্দটি। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বহু শব্দ এভাবে বদলে বাঙলা হয়ে উঠেছে। কয়েকটি উদাহরণ:

প্রাভাআপ্রাকৃতপ্রাচীন বাঙলাআধুনিক বাঙলা
চন্দ্ৰচন্দচন্দ, চান্দচাঁদ
চম্পকচম্পঅচম্পা, চাম্পাচাঁপা
বন্ধ্যাবঞ্‌ঝবাঁঝবাঁঝা
সন্ধ্যাসঞ্‌ঝসাঁঝসাঁঝ, সাঁজ

“চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় : ‘বলদ বিআএল গবিআ বাঁঝে।’ বলদে প্রসব করলো গাভী বন্ধ্যা।

“চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় : ‘পিঠা দুহিএ এ তিনা সাঁঝ্যে।’ পাত্র দোহন করা হয় তিন সন্ধ্যা (বেলা)।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘রাহুॐ গালিল যেন চাঁদ সুধাধার।

“শম্ভু সদৃশ তোর খোম্পা তাত দিল বেঢ়িআঁ চম্পা।’ ‘আকাশের চান্দ চাহা তাক আণি দিবোঁ।”

প্রাচীন ভারতীয় আর্যশব্দের ব্যঞ্জনধ্বনি নানাভাবে বদলে, কখনো অবিকল কখনো বিকল হয়ে, উপনীত হয়েছে বাঙলায়। একশ্রেণীর ধ্বনিকে বলা হয় স্পর্শধ্বনি। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার শব্দ শুরুর স্পর্শব্যঞ্জনধ্বনি টিকে ছিলো প্রাকৃতে, আর টিকে আছে বাঙলায়ও। কয়েকটি উদাহরণ :

প্রাভাআপ্রাকৃতপ্রাচীন বাঙলাআধুনিক বাঙলা
কর্ণকণ্ণকানকান
গাবীগাবী, গাঈগবিআ, গাইগাই
টলতিটালইটালিউটলে
ফুল্লফুল্লফুলফুল
ঠক্কুরঠক্কুরঠাকুরঠাকুর

“চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় : ‘কাজ ণ কারণ সসহর টালিউ।’ কাজ নেই কারণ নেই চাঁদকে টলানো হলো।

“চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় : মতিএঁ ঠাকুরক পরনেবিত্তা। অবস করিআ ভববল জিতা।’ মন্ত্রী দিয়ে রোধ করলাম রাজাকে। নিশ্চিতভাবে জেতা হলো ভববল(দাবা)।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘ডালী ভরী ফুল পানে। মোরে পাঠায়িল কাহ্নে।’ কৃষ্ণ আমাকে ডালা ভ’রে ফুল পান পাঠালো।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার শব্দের মধ্যে অবস্থিত ক্, গ্, ত্, দ্, র্, প্রাকৃতে লোপ পেয়েছিলো। তাই ‘পাদ’ শব্দ প্রাকৃত হয়ে গিয়েছিলো ‘পাঅ’; ‘মাতা’ হয়ে গিয়েছিলো ‘মাআ’। বাঙলায়ও তাই হয়েছে। ওইসব ধ্বনি লোপ পেয়ে বাঙলায় জন্ম নিয়েছে নতুন শব্দ। যেমন :

প্রাভাআপ্রাকৃতপ্রাচীন বাঙলাআধুনিক বাঙলা
শাবছাঅছাওছা
মুকুলমুউলমউলমউল, বৌল
পিবতিপিঅইপিয়া, পিয়েপিয়া

“চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় : ‘ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলী ডালী।’ নানা তরু মুকুলিত হলো আকাশে লাগলো ডালপালা।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘কুসুমসমূহমধু পিআ মধুমত্ত মধুকরনিকরে মধুর ঝঙ্কারে’। ফুলের মধু খেয়ে মধুমাতাল মৌমাছিরা মধুর ঝঙ্কার

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘অবুধ ছাওয়াল কাহ্নাঞিঁ মাঙ্গসি দান।’ অবোধ শিশু কৃষ্ণ তুমি দান চাও।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙলায় শব্দমধ্য এসব ব্যঞ্জনের লোপ প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। কিন্তু আধুনিক বাঙলায় ব্যঞ্জন-লোপ-পাওয়া শব্দগুলো আমরা পরিহার করি, ব্যবহার করি একেবারে প্রাচীন ভারতীয় আর্য শব্দ। “চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় “ভুঅণ’, কিন্তু এখন আমরা বলি ‘ভুবন’, পাওয়া যায় ‘সঅল’, কিন্তু আমরা বলি ‘সকল’; পাওয়া যায় ‘নঈ’, কিন্তু আমরা বলি ‘নদী”। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাওয়া যায় ‘রআনী’, কিন্তু আমরা বলি ‘রজনী’; পাওয়া যায় ‘কুয়িলী’, কিন্তু আমরা বলি ‘কোকিল’; পাওয়া যায় ‘কোঁয়ল’, এখন আমরা বলি ‘কোমল’। অর্থাৎ ধ্বনিবদল হয়ে প্রাচীন ভারতীয় শব্দ যেমন রূপ পেয়েছিলো বাঙলা ভাষায়, তাদের অনেকগুলোই আমরা ত্যাগ করেছি। ফিরে গেছি পুরোনো ভারতে, খুঁজে এনেছি পুরোনো শব্দ, যেগুলো বেশ অভিজাত। কিন্তু পুরোনো বাঙলার কবিরা ধ্বনিবদলের ফলে জন্ম নেয়া শব্দেই লিখেছিলেন চমৎকার কবিতা :

কাহ্নপাদ গর্ব ক’রেই বলেছেন : “তিণি ভুঅণ মই বাহিঅ হেলেঁ।’ তিন ভুবন আমি অবলীলায় পার হয়ে এলাম।

তিনিই আবার বলেছেন : ‘তুই লো ডোম্বী সঅল বিটলিউ।’ তুমি হে ডোম্বী সব কিছু টলিয়ে দিলে।

চাটিল্লপাদ দেখেছেন তাঁর সামনে : ‘ভবণই গহণ গম্ভীর বেগে বাহী।’ গহীন গম্ভীর ভবনদী তীব্র বেগে ব’য়ে যায়।

বড়ু চণ্ডীদাসের রাধা বলেছে : ‘শীতল মনোহর বাঁশী কে না বাএ। ডালত বসিঞাঁ যেহ্ন কুয়িলী কাঢ়ে রাত্র।’ কে বাজায় স্নিগ্ধ মনোহর বাঁশি? ডালে ব’সে যেনো কোকিল ডেকে যায়।

কৃষ্ণ বলছে : ‘দিবস রআনী এথা একোহি না জাণী নাহি লাগে রবির কিরণে।’

আরো একটি চমৎকার পরিবর্তন ঘটেছিলো প্রাচীন ভারতীয় ধ্বনির। একরকম ধ্বনিকে বলা হয় মহাপ্রাণধ্বনি। ‘প্রাণ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বাতাস, হাওয়া’। যে-সব ধ্বনি উচ্চারণ করার সময় ফুসফুস থেকে একটু বেশি বাতাস বেরোয়, সেগুলোকে বলা হয় মহাপ্রাণধ্বনি। ‘খ’ একটি মহাপ্রাণধ্বনি, ‘ধ’ একটি মহাপ্রাণধ্বনি। ‘ফ’ একটি মহাপ্রাণধ্বনি, ভ’ একটি মহাপ্রাণধ্বনি। আরো বেশ কিছু মহাপ্রাণধ্বনি আছে বাঙলায়। ছিলো প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায়। অনেকে মনে করেন প্রতিটি মহাপ্রাণধ্বনির ভেতরে একটি ক’রে ‘হ’ আছে। আসলে ওই বেশি বাতাস বা প্রাণটুকুই ‘হ’। ‘খ’-র ভেতরের বেশি বাতাসটুকু যদি বের ক’রে দেয়া যায়, তবে প’ড়ে থাকে ‘ক্’। আবার ‘খ্’-এর ভেতরের ‘ক্’-টুকুকে যদি বাদ দেয়া যায়, তাহলে থাকে ‘হ’। এভাবে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে বাঙলা ভাষায় আসতে আসতে খ্, খ্, খ্, খ্, ফ্, ভ্ প্রভৃতি মহাপ্রাণধ্বনির বেশি বাতাসটুকুই টিকে গিয়েছিলো। তাই এ-ধ্বনিগুলো পুরোনো বাঙলায় পরিণত হয়েছিলো ‘হ’ ধ্বনিতে। আধুনিক বাঙলায় ওই ‘হ’-টুকুও লোপ পেয়েছে। যেমন :

প্রাভাআপ্রাকৃতপ্রাচীন বাঙলাআধুনিক বাঙলা
সখীসহীসহিস‍ই
বিধিবিহিবিহি
শেফালিকাসেহালিআসিআলি, শেহলীশিউলি
রাধিকারাহিআরাহী, রাই
রেখারেহারেহা

চণ্ডীদাসের রাধা আকুল হয়ে উঠেছে : ‘সই কেবা শুনাইল শ্যামনাম।’

বিদ্যাপতির রাধা শান্তি পেয়ে বলেছে : ‘আজু বিহি মোহে অনুকূল হোয়ল।’ আজ বিধি সদয় হয়েছে আমার প্রতি।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ দেখি দুঃখে : ‘লোটাআঁ লোটাআঁ কান্দে রাহী।’ লুটিয়ে লুটিয়ে রাধা কাঁদে।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাওয়া যায় : ‘এড়ি জাএ গোআলিনী সহী।’ গোয়ালিনী সখী এড়িয়ে যায়।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এর বৃন্দাবনে বহু ফুল : ‘সিঅলি কুসুম্ভ ওড় রেবতী রাঙ্গনাগর।’ শিউলি জবা রেবতী রঙ্গন ফুল।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ কৃষ্ণ রাধাকে ছুঁলে মনে হয় : ‘যেহ্ন নিকষত শোভা কনক রেহা।’ যেনো কষ্টিপাথরে সোনার দাগ শোভা পায়।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় অনেক শব্দে—শুরুতে, মধ্যে, শেষে–ছিলো যুক্তব্যঞ্জনধ্বনি। বাঙলা ভাষায় এখনো অনেক শব্দে এমন যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি রয়েছে। যেমন : ‘স্পষ্ট’ শব্দের ‘স্প’-তে যুক্ত ‘স্’ আর প্’; ‘ব্যাঘ্র’ শব্দের ‘ঘ্র’-তে যুক্ত ‘ঘ্‌’ আর ‘র্’। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার যে-সব শব্দের শুরুতে এমন যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি ছিলো, প্রাকৃতে সে-সব শব্দে যুক্তব্যঞ্জন পরিণত হয় একক-ব্যঞ্জনে। অর্থাৎ থাকে একটি ব্যঞ্জন। যুক্তব্যঞ্জনধ্বনি উচ্চারণে নাকি কষ্ট হয় অনেকের। তাই কষ্ট কমানোর জন্যে যুক্তর বদলে ব্যবহার করে একক-ধ্বনি। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় শব্দশুরুর অনেক যুক্তব্যঞ্জন প্রাকৃতের ভেতর দিয়ে বাঙলায় আসতে আসতে হয়ে গেছে একক-ব্যঞ্জন। যেমন :

প্রাভাআপ্রাকৃতপ্রাচীন বাঙলাআধুনিক বাঙলা
বাহ্মণবম্‌হণ,বাম্‌হণ, বাহ্মণবামন, বামুন
হ্রদদহদহ
প্রতিবেশীপড়িবেসীপড়বেষী, পড়বেসীপড়শি
স্নেহণ্‌ণেহনেহা, নেহনাই, লাই

“চর্যাপদ”-এ কাহ্নপাদ তিরস্কার করেছেন ডোম্বীকে : ‘ছোই ছোই জাসি বাম্‌হণ নাড়িআ।’ তুমি ব্রাহ্মণ নেড়েকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও।

কবি ঢেন্টণপাদ দুঃখের সাথে গেয়েছেন : “টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী।’ টিলায় আমার ঘর, প্রতিবেশী নেই।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : “বিধি কৈল তোর মোর নেহে।’ তোমার আমার প্রীতি সৃষ্টি করেছে বিধাতা।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ রেগে উঠেছে রাধা : ‘নান্দের ঘরের গরু রাখোআল তা সমে কি মোর নেহা।’ নান্দের ঘরের গরুর রাখালের সাথে আমার আবার প্রেম কী?

এভাবে বদলে গেছে ধ্বনি, বদলে গেছে শব্দের রূপ। বিচিত্র সে-সব পরিবর্তন। নানা নিয়ম আর রীতি সে-সব পরিবর্তনের। যদি কিছুই না বদলাতো, চিরকাল যদি মানুষ ধ্বনি উচ্চারণ করতো একইভাবে, তাহলে জন্ম নিতো না বাঙলা ভাষা। আমরা এখনো বলতাম প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক ভাষা। তবে নদীতে জল যেমন স্থির নয় মানুষের মুখেও ধ্বনি স্থির নয়। চপল জিভের ছোঁয়ায় বদলে যায় চঞ্চল ধ্বনি। বদলেছে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার। বদলেছে প্রাকৃতের। শব্দ নতুন থেকে নতুন হয়ে উঠেছে। উদ্ভূ ত হয়েছে বাঙলা। বাঙলাও অবিচল স্থির নয়। বদলে যাচ্ছে তারও বহু কিছু। জটিল দুরূহ সূত্র সে-সব বদলের। সে-সবের মুখোমুখি এখন হচ্ছি না আমরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *