আ কালো অ শাদা ই লাল

আ কালো অ শাদা ই লাল

যখন ‘আ’ বলি তখন কি কোনো রঙ ভেসে ওঠে চোখের সামনে? কোনো রঙ জ্বলজ্বল ক’রে ওঠে ‘অ’ বললে? ‘ই’ বললে? ‘উ’ বললে? সবুজ নীল রঙ আছে কি ‘ক’র ‘খ’র ‘গ’র? আমরা যারা খুব বাস্তব মানুষ তারা ‘আ’ বললে একটি ধ্বনি শুনি। ‘ই’ বললে আরেকটি ধ্বনি শুনি। কোনো রঙ ভেসে ওঠে না চোখের সামনে। কানে গুঞ্জন করে ধ্বনি। বাস্তব পেরিয়ে গিয়েছিলেন সবুজ চোখের এক কিশোর-তরুণ কবি। জাঁ আর্তুর র্যাবো। ফরাশি কবি। ওই কবি লিখেছিলেন : ‘আবিষ্কার করেছি আমি স্বরবর্ণের রঙ! –আ কালো, অ শাদা, ই লাল, উ সবুজ।’ তার চোখে এক একটি ধ্বনি দেখা দিয়েছিলো এক একটি রঙ নিয়ে। ধ্বনি দেখা যায় না; কিন্তু লেখা যায়। একটি ধ্বনি আছে বাঙলায়, তার চিহ্ন ‘অ’। আরেকটি ধ্বনি আছে, তার চিহ্ন ‘ক’। আরো বহু ধ্বনি আছে, তাদের লেখা হয় একএকটি চিহ্নে। ওই চিহ্নগুলোকে আমরা বলি ‘অক্ষর’। আবার কখনো বলি ‘বর্ণ’। সবগুলো অক্ষরকে একত্রে বলি ‘বর্ণমালা’, বর্ণে বর্ণে গাঁথা মালা।

ছোটো বয়সে যখন অক্ষর বা বর্ণ শিখতে শুরু করি, তখন হাতে পাই কী সুন্দর সুন্দর বই! তাতে একএকটি বর্ণ কী বড়ো। আর কতো ছবি। ‘অ’র পাশে অজগরের ছবি। ‘আ’র পাশে ছবি রঙিন আমের। অক্ষরগুলো কত বড়ো আর কত রঙ বা বর্ণ তাদের। বাঙলায় আমরা অক্ষরকে বর্ণ বলি। বর্ণ শব্দের অর্থ ‘রঙ’। সেই পুরোনো কালে যখন লেখা শুরু হয়েছিলো তখন বিভিন্ন রঙ দিয়ে আঁকা হতো অক্ষরগুলো। বর্ণ দিয়ে লেখা হতো অক্ষর। তাই অক্ষরের নাম হয় বর্ণ অর্থাৎ রঙ। পৃথিবীর বহু ভাষায় অক্ষর বোঝানোর জন্যে যে-শব্দটি আছে, তার অর্থ রঙ। বাঙলায়ও তাই। এখনো তো কতো রঙে চিত্রিত হয় অক্ষর। কালোতে, লালে। সবুজে, নীলে। কবি মধুসূদনের বর্ণনা ধার ক’রে বলতে পারি, আমাদের অক্ষরগুলো ‘রঞ্জিত রঞ্জনরাগে’। অর্থাৎ রঙে রঙে রাঙানো।

আমাদের বর্ণগুলো কোথা থেকে এসেছে? চিরিদিনই কি এরা এরকম? চিরকালই কি বাঙালি এভাবেই লিখে আসছে বাঙলা ভাষা? বাঙলা অক্ষরগুলো কোণঅলা, অনেকটা ত্রিভুজের মতো। গোলগাল নয়। একএকটি অক্ষর ফলের মতো ঝুলে থাকে ‘মাত্রা’ থেকে। মাত্রা নেই এমন অক্ষর আছে মাত্র গুটিকয়। লেখার সময় ঘটে কতো ঘটনা। ব্যঞ্জনবর্ণগুলোর চেহারা প্রায় সব সময়ই ঠিক থাকে। বেশি বদলায় না। কিন্তু স্বরবর্ণগুলোর রূপ বদলে যায় ঘন ঘন। ছিলো ‘ই’; কিন্তু হয়ে যায় ‘ ি’ ছিলো ‘আ’; কিন্তু হয়ে যায় ‘ া’। ছিলো ‘উ’; কিন্তু হয়ে যায় ‘ ু’। ছিলো ‘ও’; কিন্তু হয়ে যায় ‘ো’। ছিলো ‘ঔ’; কিন্তু হয়ে যায় ‘ৌ’। আর এরা ব্যঞ্জনবর্ণের বাঁয়ে বসে। ডানে বসে। ওপরে বসে। নিচে বসে। বাঁয়ে-ডানে- ওপরে-নিচে ব’সে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে এক একটি ব্যঞ্জনবর্ণকে।

কোথা থেকে এসেছে এরা? ভারতের একটি প্রাচীন লিপির নাম ব্রাহ্মীলিপি। ভারতের মানুষের নানা অদ্ভুত বিশ্বাস ছিলো, এখনো আছে অনেকে মনে করতো ওই ব্রাহ্মীলিপি একেবারে ব্রহ্মার সৃষ্টি। কিন্তু এ-লিপি কয়েক হাজার বছর আগে সৃষ্টি করেছিলো ভারতবাসীরাই। এ-লিপির বিবর্তনের ফলেই উদ্ভূত হয়েছে বাঙলা লিপি বা অক্ষর বা বর্ণমালা। কেউ কেউ মনে করেন যে ষষ্ঠ শতকের দিকে বাঙলা, বিহার, ওড়িষ্যা অঞ্চলে প্রচলিত ছিলো ওই লিপির একরকম বিবর্তিত রূপ। এ-রূপকে বলা হয় গুপ্তলিপির পূর্বদেশীয় রূপ। এ-গুপ্তলিপি আবার এসেছে কুষাণ লিপি থেকে। কুষাণ লিপি এসেছিলো ব্রাহ্মীলিপি থেকে। দশম শতকের দিকে ব্ৰাহ্মীলিপি বদলে হয়ে ওঠে বাঙলা লিপি। তারপর কতো বদল ঘটেছে বাঙলা লিপির। তখন তো ছাপাখানা ছিলো না। হাতে লেখা হতো পুথি। মানুষে মানুষে পার্থক্য ঘটে অক্ষরের রূপে। পুরোনো অক্ষরে পাওয়া যায় কতো রকমের অ, কতো রকমের আ, ক খ গ ঘ। হাতে হাতে বদলে আঠারো শতকের শেষ দিকে, ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে, বাঙলা বর্ণমালা ঢালাই হয় ধাতুতে। মুদ্ৰাযন্ত্রে ওঠে বাঙলা অক্ষর। বই ছাপা শুরু হয় বাঙলা বর্ণমালায়। যন্ত্ৰ তো নানা রকম করে না কোনো কিছুকে। যন্ত্রের কাজই সব কিছুকে সুশৃ খল ক’রে তোলা। যন্ত্রে ওঠার পর থেকেই বাঙলা বর্ণ স্থির রূপ পায়। সব ‘ক’ হয়ে ওঠে একই রকম, সব ‘খ’র চেহারা এক। তবে তা হ’তে কিছুটা সময় লেগেছিলো।

আগে এ-দেশে ছাপাখানা ছিলো না। ইউরোপে পনেরোশতকে প্রতিষ্ঠিত হয় ছাপাখানা বা মুদ্রাযন্ত্র। এ-দেশেও ছাপাখানা নিয়ে আসে ইউরোপীরা। ইউরোপীরাই প্রথম ছাপে বাঙলা বর্ণমালা। প্রথমে বাঙলা বর্ণমালা ছাপা হয়েছিলো ব্লকের সাহায্যে। বিদেশে। ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম থেকে বেরিয়েছিলো চায়না ইলাস্ট্রেটা নামে একটি বই। ওই বইতে মুদ্রিত হয়েছিলো বাঙলা বর্ণমালার নমুনা। অ্যালফাবেটুম বেংগুলিকুম নামে এ-বইতে বাঙলা বর্ণের যে-তালিকা ছাপা হয়েছে, তা দেখতে অনেকটা কাকের পা বকের পা। ১৭৪৩-এ লাইডেন থেকে বেরিয়েছিলো “ডিসারতিও সিলেকটা” নামে একটি বই। এ-বইতে আছে বাঙলা বর্ণমালার নমুনা। খুব চমৎকার এ-অক্ষরগুলো। মুগ্ধ চোখে দেখতে হয়। আরো কয়েকটি বইয়ে ছাপা হয়েছিলো বাঙলা অক্ষর, ব্লকে বা ধাতুফলকে।

১৭৭৮। অবিস্মরণীয় বছর বাঙলা লিপি ও ভাষার ইতিহাসে। এ-বছর হুগলি থেকে বেরোয় বাঙলা ভাষার প্রথম বিস্তৃত ব্যাকরণ। ব্যাকরণরচয়িতা ন্যাথনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। বইটি লেখা ইংরেজিতে। কিন্তু হ্যালহেড তাঁর বইয়ের বাঙলা উদাহরণগুলো ছেপেছিলেন বাঙলা অক্ষরে। ওই উদাহরণ ছাপতে গিয়েই সূচিত হয় বাঙলা বর্ণমালার আধুনিক কাল। আগে ব্লকে ছাপা হয়েছিলো বাঙলা বর্ণমালা; আর গুটিকয় শব্দ। এবার ছাপতে হয় পুরো বাক্য। পাতার পর পাতা। বই ছাপতে দরকার হয় টাইপ, ধাতব অক্ষর। ধাতব বর্ণ। এক একটি পৃথক পৃথক। হ্যালহেডের এ গ্রামার অফ দি বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ-এর জন্যে বানানো হয় ধাতব অক্ষর। অক্ষর বানান চার্লস উইলকিন্স। তাঁকে সাহায্য করেন একজন কর্মকার, পঞ্চানন কর্মকার। হ্যালহেডের বইয়ের জন্যে যে-টাইপ বানানো হয়েছিলো, তা ছিলো খুবই চমৎকার। তার বাঙলা বর্ণগুলো অত্যন্ত সুশ্রী। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আকারে একটু বড়ো। কিন্তু কিছু অক্ষর এখনকার মতো নয়। কিন্তু উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকারই অনেকটা চিরকালের জন্যে স্থির ক’রে দেন বাঙলা বর্ণের মুখের রূপ। এরপর মুদ্রাযন্ত্রের প্রয়োজনে ও উৎসাহে সুশ্রী থেকে সুশ্রীতর হয়ে উঠেছে বাঙলা অক্ষর। দেখা দিয়েছে মনো ও লাইনো রূপসী অক্ষর। তৈরি হয়েছে গুটিকয় নতুন অক্ষর। যুক্তাক্ষর নানাভাবে যুক্ত হয়েছে মনো ও লাইনোর শাসনে ও স্নেহে। তবু তাদের শরীরে ছোঁয়া লেগে আছে পঞ্চানন ও উইলকিন্সের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *