আমি তুমি সে

আমি তুমি সে

আমি কথা বলি। তুমি শোনো। সে একটু বা অনেক দূরে আছে, তাই সে শোনে না। যে কথা বলে, সে বক্তা। যে শোনে, সে শ্রোতা। আরো আছে একজন, যে বক্তাও নয় শ্রোতাও নয়। কথা বলতে হ’লে বক্তা দরকার হয়, দরকার হয় শ্রোতা। কথা বলা হ’তে পারে আরেকজন সম্পর্কে। কথা বলার সময় বক্তা নিজেকে বোঝানোর জন্যে ব্যবহার করে ‘আমি’। শ্রোতাকে বোঝানোর জন্যে ‘তুমি’। আর যে তৃতীয়জন, বক্তাও নয় শ্রোতাও নয়, তাকে বোঝানোর জন্যে ব্যবহার করে ‘সে’। এগুলোকে বলা হয় সর্বনাম। মনুষ্যসূচক সর্বনাম। মানুষের প্রতি নির্দেশ করার জন্যে ব্যবহার হয় এগুলো। বক্তা ও শ্রোতা ও তৃতীয় ব্যক্তি অনুসারে এগুলোকে ভাগ করা হয় তিনটি শ্রেণীতে। তখন আসে ‘পুরুষ’ ধারণাটি। বক্তা হচ্ছে উত্তম পুরুষ; এখন বলি, ইংরেজি পদ্ধতিতে, প্রথম পুরুষ। শ্রোতা হচ্ছে মধ্যম পুরুষ; এখন বলি দ্বিতীয় পুরুষ। আর অন্যজন হচ্ছে প্রথম পুরুষ; এখন বলি তৃতীয় পুরুষ। পৃথিবীর সব ভাষায়ই এ-তিন পুরুষের সর্বনাম আছে। আছে বাঙলায়ও।

মানসম্মান অনুসারেও আবার ভিন্ন হয় বাঙলা সর্বনাম। তবে যখন বলি ‘আমি’, তখন আমি নিজেকে সম্মানিত বা অসম্মানিত ব্যক্তি হিশেবে নির্দেশ করি না। বাঙলায় উত্তম বা প্রথম পুরুষের সর্বনাম একটিই : ‘আমি’। এটি সমান-অসম্মান নিরপেক্ষ। বক্তার গৌরব করার কোনো সুযোগ নেই বাঙলায়। তবে কোনো কোনো ভাষায় সে-সুযোগ আছে। রাজারা ব্যবহার করে একরকম সম্মানসূচক ‘আমি’। অন্যরা ব্যবহার করে সাধারণ ‘আমি’ কিন্তু বাঙলায় তার উপায় নেই। আমাদের সকলের জন্যে একটিই ‘আমি’ বক্তা শুধু নিজেকে নির্দেশ করতে পারে ‘আমি’ ব’লে।

কিন্তু শ্রোতার প্রবেশের সাথে সাথে ওঠে সম্মান-অস্থান, বা সম্ভ্রম – অসম্ভ্রমের ব্যাপারটি। আমি তিন ধরনের মানুষের মুখোমুখি হ’তে পারি। তিন ধরনের মানুষের সাথে কথা বলতে পারি। যাঁর সাথে কথা বলছি আমি, তিনি যদি বয়সে আমার বড়ো হন বা হন শ্রদ্ধেয়-সম্মানিত, তাহলে তাঁকে সম্বোধন করি ‘আপনি’ ব’লে। এ ‘আপনি’ বাঙলা ভাষায় আগে ছিলো না। সম্ভবত উনিশ শতকে এটি জন্ম নেয় বাঙলায়। সম্মানিত মানুষের সাথে কথা বলার সাথে সাথে অনেকগুলো ব্যাপার ঘ’টে যায়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বাক্যের ক্রিয়ারূপের রূপবদল। আমার শ্রোতা যদি আমার কাছে শ্রদ্ধেয়- সম্মানিত না হয়, যদি হয় আমার বন্ধু বা সমবয়স্ক বা ছোটো, আমি তাকে নির্দেশ করি ‘তুমি’ ব’লে। আর যদি সে একেবারে ছোটো হয়, আদরের হয়, তুচ্ছ হয়; তখন তাকে সম্বোধন করি ‘তুই’ ব’লে। মধ্যমপুরুষে বাঙলায় আছে তিনটি সর্বনাম। সম্মানসূচক : ‘আপনি’। সাধারণ : ‘তুমি’। আদরের বা অবজ্ঞার : ‘তুই’।

তারপর সেই তৃতীয় ব্যক্তি। তৃতীয় ব্যক্তিরাও হ’তে পারেন সম্মানিত হ’তে পারে অসম্মানিত বা সাধারণ। যদি তাঁর প্রতি সম্মান দেখাই, তাহলে তাঁকে বোঝানোর জন্যে বলি ‘তিনি’। আর যদি অমন সম্মান দেখানোর দরকার না হয়, তাহলে ‘সে’। তৃতীয় ব্যক্তিরা অনুপস্থিত থাকতে পারেন আলাপের সময়। কিন্তু তাঁদের মান-সম্মান সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয় আমাদের।

বাঙলা ভাষায় তিন পুরুষের আছে ছটি সর্বনাম। আমি। আপনি তুমি তুই। তিনি সে। এগুলোর আছে বিভিন্ন রকম রূপ। বহুবচন হ’লে এদের রূপ বদলে যায়। হয়ে ওঠে : আমরা। আপনারা তোমরা তোরা। তাঁরা তারা। বিভক্তি যোগ করলেও বিভিন্ন রূপ ধরে এগুলো। হয় : আমাকে, আমাদের, আমার। আপনাকে, আপনাদের, আপনার। তোমাকে, তোমাদের, তোমার। তোকে, তোদের, তোর। তাঁকে, তাঁদের, তাঁর তাকে, তাদের, তার। এমন সব রূপ ধরে আমাদের সর্বনামগুলো।

এগুলো চিরকাল এমন ছিলো না। শুধু ‘আপনি’ ছাড়া আর সবকটি সর্বনাম প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার সর্বনামের বিবর্তনের ফলে জন্ম নিয়েছে বাঙলায়। প্রাচীন ও মধ্য বাঙলায় এ-সর্বনামগুলোর ছিল নানা রূপ। আধুনিক কালে এগুলোর রূপ সুস্থিত হয়ে গেছে, যদিও অঞ্চলে অঞ্চলে টিকে আছে বিভিন্ন রূপে।

উত্তম বা প্রথম পুরুষের ‘আমি’। প্রাচীন ও মধ্য বাঙলায় ‘আমি’র পাওয়া যায় অনেকগুলো রূপ। প্রাচীন বাঙলায় ‘আমি’ ছিলো ‘হাঁউ’, ‘আহ্মে’, ‘অৰ্মে’। আদিমধ্য বাঙলায় ‘আমি’ ছিলো ‘আহ্মে’ ‘আহ্মি’, ‘আহ্মী’, ‘আহ্মা’, ‘মোঞ’, ‘মোঞি’ প্রভৃতি। মধ্যযুগের শেষ দিকে ‘আমি’ ছিলো ‘মো’, ‘মু’, ‘মুহি’, ‘আহ্মি’, ‘আমি’ প্রভৃতি। আধুনিক কালে চলতি বাঙলায় ‘আমি’। কিন্তু বিভিন্ন উপভাষায় আছে ‘আমি’র অনেক রূপ। যেমন : ‘মুই’, ‘হামি’, ‘হামা’ ইত্যাদি। এই ‘আমি’র রূপ প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় ছিলো কেমন? সম্ভবত এটি বৈদিক ভাষায় ছিলো ‘অস্মে’। তারপর সংস্কৃতে হয়ে যায় ‘অস্মাভিঃ’। তার থেকে প্রাকৃতে হয়ে যায় ‘অম্‌হে’ ও ‘অম্হাহি’। তার থেকে পুরোনো বাঙলায় হয় ‘অমে’, ‘আহ্মে’, ‘হাঁউ’ ইত্যাদি। কয়েকটি উদাহরণ :

“চর্যাপদ”-এ কবি ভাদেপাদ বলেছেন : ‘এতকাল হাঁউ অচ্ছিলেঁসু মোহে।’ এতোকাল আমি ছিলাম মোহে।

কবি সরহপাদ বলেছেন : ‘আম্‌হে ন জানহুঁ অচিন্ত জোই।’ অচিন্ত্যযোগী আমরা জানি না।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাওয়া যায় : ‘সুণহ সুন্দরী রাধা বচন আহ্মার’। রূপসী রাধা আমার কথা শোনো।

কৃষ্ণ বলছে : ‘এথাঞিঁ শিয়রে বাঁশী আরোপিআঁ সুতিআঁ আছিলোঁ আহ্মি।’ শিয়রে বাঁশি রেখে আমি শুয়ে ছিলাম।

‘আমি’ বললে এখন শুধু ‘আমাকে’ই বোঝায়, শুধু বক্তাকে বোঝায়। কিন্তু পুরোনো বাঙলায় ‘আহ্ম’ বোঝাতো বহুবচন। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ ‘আহ্মি’ একবচন বোঝাতে শুরু করে। তখন তৈরি করা হয় বহুবচন রূপ ‘আহ্মারা’।

মধ্যম বা দ্বিতীয় পুরুষের ‘তুমি’। প্রাচীন ও মধ্য বাঙলায় ‘তুমি’র পাওয়া যায় বহু রূপ। প্রাচীন বাঙলায় ‘তুমি’ ছিলো ‘তু’, ‘তো’, ‘তুমে’, ‘তুম্ভে’। আদিমধ্য বাঙলায় ‘তুমি’ ছিলো ‘তোঞে, ‘তুঞি’, ‘তুহ্মি’, ‘তোহ্মা’। মধ্যযুগের শেষ দিকে ‘তুমি’ ছিলো ‘তুঞি’, ‘তোহি’, ‘তোহ্মে’, ‘তোহ্মি’, ‘তুমি’ প্রভৃতি। আধুনিক কালে এসব থেকে জন্ম নিয়েছে দুটি সর্বনাম। একটি হচ্ছে দ্বিতীয় পুরুষের সাধারণ সর্বনাম ‘তুমি’। অন্যটি তুচ্ছার্থক ‘তুই’। কী রূপ ছিলো ‘তুমি’র অনেক আগে, প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায়? কেউ কেউ বলেন বৈদিক ভাষায় ‘তুমি’ ছিলো ‘যুষ্মে’। এর বিবর্তনেই জন্মেছে ‘তুমি’। ‘যুগ্মে’ হয়তো বৈদিকেই রূপ নিয়েছিলো ‘তুষ্মে’। তা প্রাকৃতে হয়ে যায় ‘তুমহে’ ও ‘তুম্হাহি’। অপভ্রংশে ‘তুম্‌হহি’। তা থেকে হয় পুরোনো বাঙলার ‘তুমে’ ‘তোহ্মি’, ‘তোহ্মে’। পরে হয় ‘তুমি’। এখন যে তুচ্ছার্থে আমরা ‘তুই’ বলি, এটি এসেছে প্রাচীন ভারতীয় ‘ত্বয়া’ থেকে।

“চর্যাপদ”-এ চাটিল্লপাদ বলেছেন :’জই তুম্‌হে-লোঅ হে হোইব পারগামী।’ যদি তোমরা সবাই পারগামী হ’তে চাও।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘তোহ্মার বচনে যমুনাক আহ্মে জাইব।’ তোমার কথায় আমি যমুনায় যাবো।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘তবে তার বাঁশী লআঁ ঘর জাইহ তুহ্মি।’ তখন তার বাঁশি নিয়ে তুমি ঘরে যেয়ো।

এখন আমরা সম্মানিতদের সম্বোধন করি ‘আপনি’ ব’লে। এটি দ্বিতীয় পুরুষের সম্মানাত্মক সর্বনাম। এটি পুরোনো বাঙলায় ছিলো না। মধ্যবাঙলায় ছিলো না। আগে রাজাবাদশাকেও ‘তুমি’ ব’লেই সম্বোধন করা হতো। কিন্তু ক্রমে সম্বোধনে সম্মান প্রকাশের প্রয়োজন পড়ে। তখন ধীরেধীরে ‘নিজ’-আর্থক ‘আপন’ থেকে বানানো হয় সম্মানসূচক দ্বিতীয় পুরুষের ‘আপনি’। ‘আপনার চেয়ে আপন যে জন তারে খুঁজি আপনায়’, ‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে’ বাক্যে ‘আপন’ বোঝায় ‘নিজ’। এটি থেকেই সম্ভবত উনিশ শতকে বিকশিত হয় ‘আপনি’।

তৃতীয় পুরুষের ‘সে’। যারা সম্মানিত নয়, তাদের নির্দেশ করার জন্যে ব্যবহার করি এটি। এটিরও ছিলো অনেক রূপ আদি ও মধ্য বাঙলায়। প্রাচীন বাঙলায় পাওয়া যায় ‘সে’, ‘সো’, ‘স’, ‘সোই’ প্রভৃতি রূপ। আদিমধ্য বাঙলায় পাওয়া যায় এর ‘সো’, ‘সেহো’, ‘সেহি’ ‘সেনা’ প্রভৃতি রূপ। মধ্যযুগের শেষ দিকে পাওয়া যায় ‘সে’,’সেহ’,’সেহি’, রূপ। এখন এর রূপ ‘সে’। এটি এসেছে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ‘সকঃ’ শব্দ থেকে। প্রাকৃতে এটি হয়ে যায় ‘সো’, ‘শে’। প্রাচীন বাঙলায় হয় ‘সো’, ‘সে’, ‘স’। তারপর এর একটিই রূপ ‘সে’।

“চর্যাপদ”-এ পাই : ‘হেরি সো মোরি তইল বাড়ী খসমে সমতুলা।’ আমার খসম-সমান সে তৃতীয় বাড়ি দেখে।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।’ কে বাঁশি বাজায় বড়ায়ি, সে কোনজন?

মালাধর বসু লিখেছেন : ‘সেহ যদি অল্পজ্ঞান করিল আমারে।’ সে যদি আমাকে অল্পজ্ঞান করলো।

তৃতীয় পুরুষের সম্মানসূচক ‘তিনি’। সম্মানিত কাউকে নির্দেশ করার জন্যে ব্যবহার করি এটি। প্রাচীন বাঙলায় এটির ব্যবহার খুব কম। প্রাচীন বাঙলায় পাওয়া যায় ‘তো’। আদিমধ্য বাঙলায় পাওয়া যায় ‘তেঁ’, ‘তেহেঁ’, ‘তেহোঁ’। মধ্যযুগের দ্বিতীয় ভাগে পাওয়া যায় ‘তেঁহ’, ‘তিঁহো’, ‘তেঁহো’, ‘তিনি’, ‘তেনি’ প্রভৃতি রূপ। আধুনিক বাঙলায় ‘তিনি’। ‘তিনি’র উৎপত্তি সম্পর্কে সন্দেহ আছে। কেউ কেউ মনে করেন অপভ্রংশের ‘তিণি’ থেকে এসেছে বাঙলা ‘তিনি’।

“চর্যাপদ”-এ পাই : ‘তে তিনি তে তিনি তিনি হো ভিন্না।’ সে তিন সে তিন–তিন অভিন্ন।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : বিরহ জ্বরেঁ তেহেঁ জরিলা।’ বিরহ-জ্বরে তিনি আক্রান্ত।

এভাবেই পেয়েছি আমরা আধুনিক সর্বনামগুলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *