আইসসি যাসি করসি

আইসসি যাসি করসি

আইসসি যাসি করছি। এমন বলতাম আমরা হাজার বছর আগে, আটশো বছর আগে। এখন বলি—আসো যাও করো। ক্রিয়া খুব মজার জটিল জিনিশ। অনেক কিছু প্রকাশ করতে হয় ক্রিয়াকে। আরো একটু যথাযথ হওয়ার জন্যে বলতে হয় : অনেক কিছু প্রকাশ করতে হয় ক্রিয়ারূপকে। ক্রিয়ারূপ। যেমন : আইসসি যাসি করসি। আসো যাও করো। পোহাইলি ভইলী লেলি। পোহালে হ’লে নিলে। নানা রকম ক্রিয়ারূপ আছে বাঙলায় : করি, করছি, করেছি। করলাম, করছিলাম, করেছিলাম। করবো। এ- রূপাগুলোর দুটি বড়ো অংশ। একটি অংশ হচ্ছে ক্রিয়ামূল, যা ক্রিয়া বোঝায়; আরেকটি অংশ বোঝায় অনেক কিছু। ‘করি’কে দু-ভাগ করলে পাই ‘কর্’ ও ‘ই’। ‘করছি’ কে দু-ভাগে ভাগ করলে পাই ‘কর্’ ও ‘ছি’। ‘করেছি’কে দু-ভাগে ভাগ করলে পাই ‘কর্’ ও ‘এছি’। এভাবেই দু-ভাগে ভাগ করা যায় ‘করলাম’, ‘করছিলাম’, ‘করেছিলাম’, ‘করবো” ও অন্য ক্রিয়ারূপগুলোকে। প্রথম ভাগটি বোঝায় ক্রিয়া। ‘কর্’, ‘ধর্’, ‘বল্’, ‘খা’ নানা রকমের ক্রিয়া। আর দ্বিতীয় ভাগটি?

ক্রিয়ারূপের দ্বিতীয় ভাগকে ব্যাকরণে বলা হয় ‘ক্রিয়াবিভক্তি’। নামটি ঠিক হয় নি। এটির নাম দেওয়া যাক ‘ক্রিয়াসহায়ক’, যা সহায়তা করে ক্রিয়াকে। অনেক ক্রিয়াসহায়ক আছে বাঙলায় : ‘ই’, ‘ছি’, ‘এছি’, ‘লাম’, ‘ছিলাম’, ‘এছিলাম’, ‘বো’, ‘ও’, ‘ছো’, ‘এছো’র মতো অনেক ক্রিয়াসহায়ক আছে আমাদের। এগুলোকে পৃথক করলে মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যায়। কিন্তু কথা বলার সময় ঠিকই ব্যবহার করি এগুলো।

কী প্রকাশ করে এ-ক্রিয়াসহায়কগুলো? উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। আমি বললাম, ‘পড়ছি’। এর প্রথম অংশ পড়ু’, দ্বিতীয় অংশটি ‘ছি’। ‘পড়ু’ বোঝায় লিখিত কিছু বিশেষ এক রকমে আয়ত্ত করা। ‘ছি’ কী বোঝায়? ‘পড়ছি’ বলার সাথে সাথে বোঝায় যে পাঠক হচ্ছি ‘আমি’। ‘আমি’ উত্তম বা প্রথম পুরুষের সর্বনাম। তাই ‘ছি’ বোঝায় বাক্যের কর্তা কোন পুরুষের। আবার পড়ছি বলার সাথে সাথে বুঝি পড়ার কাজটি ঘটছে বর্তমান কালে। তাই ‘ছি’ কাল বোঝায়। আরো বোঝায় যে পড়ার কাজটি এখনি ঘটছে। অর্থাৎ ক্রিয়ার রীতি বোঝাচ্ছে—ক্রিয়া কী রীতিতে সম্পন্ন হচ্ছে, তা বোঝাচ্ছে। তাই দেখতে পাচ্ছি বাঙলা ক্রিয়ারূপের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ ক্রিয়াসহায়ক তিন রকম ব্যাপার বোঝায়। পুরুষ বোঝায়, কাল বোঝায়, ক্রিয়ার রীতি বোঝায়।

বাঙলা ক্রিয়াসহায়কগুলো পুরুষ, কাল ও ক্রিয়ার রীতি বুঝিয়ে আসছে বাঙলা ভাষার জন্মের কাল থেকেই। কিন্তু এগুলো চিরকাল রূপে একই রকম থাকে নি। রূপ বদলিয়েছে কালেকালে। তবে রক্ষা করেছে ধারাবাহিকতা। কাল হ’তে পারে বর্তমান; হ’তে পারে অতীত; পারে হ’তে ভবিষ্যৎ। পুরুষ হ’তে পারে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়। ক্রিয়া ঘটতে পারে নানা রীতিতে এইমাত্র শেষ হ’তে পারে ক্রিয়াটি। ক্রিয়াটি এখনো চলতে পারে। চলতে পারে আরো অনেক কাল ধ’রে। এ-সবই ধরা পড়ে ক্রিয়ারূপের দ্বিতীয় অংশে, ক্রিয়াসহায়কে।

ক্রিয়াসহায়কের রূপ নানাভাবে বদলিয়েছে। ক্রিয়াসহায়ক সংখ্যায়ও প্রচুর। সবগুলোর পরিচয় এখানে দিচ্ছি না, দিলে মাথার ভেতর হৈচৈ শুরু হয়ে যাবে। কয়েকটির কথা শুধু বলি।

এখন বর্তমান কালের একটি ক্রিয়াসহায়ক হচ্ছে ‘ই’। করি, বলি, চলি, দেখি-তে, কর্, বল্, চল্, দেখ্-এর সাথে যোগ করেছি ‘ই’। পুরোনো বাঙলায়, “চর্যাপদ”-এ, ছিলো তিনটি ক্রিয়াসহায়ক। ‘ম’, ‘মি’ আর ‘হুঁ’ বা ‘হু’। এখন বলি ‘যা নিয়ে আছি’, “চর্যাপদ”-এর কবি লুইপাদ বলেছেন, ‘জা লই অচ্ছম’। ‘অচ্ছম’ এখন ‘আছি’। এখন বলি ‘জানি না’; কবি আর্যদেব বলেছেন, ‘ণ জানমি’। ‘জানমি’ এখন ‘জানি’। এখন বলি ‘দাবা খেলি’। কবি কাহ্নপাদ হাজার বছর আগে বলেছিলেন, ‘খেলহুঁ নঅবল’। ‘খেলহুঁ’ আজকের ‘খেলি’।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘গেল’, ‘কৈলঁ’। ‘ম’,’মি’,’হুঁ’ আর নেই। তাদের জায়গা দখল করেছে অন্যরা। যেখানে “চর্যাপদ”-এর কবিরা ব্যবহার করতেন ‘ম’, ‘মি’, ‘হুঁ’, আর এখন আমরা যেখানে ব্যবহার করি ‘ই’, সেখানে “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এর কালে বসতো ‘অওঁ’, ‘ওঁ/ও’,’ই/ঈ’, আর ‘ইএ’। এখনকার ‘ই’ দেখা দেয় প্রথম “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এই। এখন বলি, ‘বিশ্রাম করি’, রাধা বলেছে : ‘করো বিসরামে’। এখন বলি, ‘প্রাণ দিতে পারি তোমার কথায়’, বড়ায়ি বলেছে : ‘পরাণ দিবাক পারোঁ তোহ্মার বচনে’। এখন বলি, ‘আমি করতে পারি’। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই ‘কবিরাক পারি’। এখন বলি, ‘আমি যাই’। “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ রাধা বলেছে, ‘আহ্মে জাইএ’।

এখনকার ‘ই’র নানা রূপ ছিলো মধ্যযুগের দ্বিতীয় ভাগে। কখনো তা ‘ওঁ’, কখনো তা ‘ম’। কখনো ‘ও’, কখনো ‘হোঁ’, কখনো ‘হুঁ’, কখনো ‘উঁ’। কখনো আবার তা ‘ইএ’, কখনো ‘ই’। নানা রূপ। কবি দ্বিজ মাধব লিখেছেন, ‘বন্দম দিনকরনাথ’, ‘কহম তোমারে’। মালাধর বসু লিখেছেন, ‘কন্দর্প সমান দেখোঁ’, ‘বলহোঁ তোমারে’। চূড়ামণি দাস লিখেছেন, ‘না জানিএ না মানিএ না ভজিয়ে আন’; অর্থাৎ অন্যকে জানি না মানি না ভজি না। কৃত্তিবাস লিখেছেন, ‘বিস্তারিয়া কহ মুনি শুনিউ কথন।’

তিন পুরুষ, তিন কাল, আর ক্রিয়া ঘটার রীতি অনেক। তাই ক্রিয়াসহায়কও অনেক। সবগুলোর কথা এখানে বলার উপায় নেই। শুধু কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি, তাতেই বোঝা যাবে কালে কালে এগুলো কেমন হয়েছিলো।

“চর্যাপদ”-এ পাই : ‘আইসসি, যাসি, পুছসি, বুঝসি’। আসো, যাও, জিজ্ঞেস করো, বোঝো।

“চর্যাপদ”-এ পাওয়া যায় : ‘অচ্ছই, ভণই, জাগঅ, ভণন্তি, নাচন্তি’। আছে, বলে, জাগে, বলে, নাচে।

“চর্যাপাদ”-এ পাই : ‘বাহিউ, পোহাই, বুঝিঅ, দেখিল, ফিটলেসু’। বাইলাম, পোহালাম, বুঝলাম, দেখলাম, মুক্ত হলাম।

“চর্যাপদ”-এ পাই : ‘মারিহসি, করিহ, করিব, হোইব’। মারবে, করবে, করবো, হবে।

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘খাইলোঁ, হারায়িলোঁ, পড়িলাহোঁ, বধিল’। খেলাম, হারালাম, পড়লাম, বধলাম!

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘গেলা, কৈলেঁ, এড়ালেহেঁ, নিলেহেঁ। গেলে, করলে, এড়ালে, নিলে

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”-এ পাই : ‘করিবোঁ, জাণায়িবোঁ, কাটায়িব, দিবওঁ। করবো, জানাবো, কাটাবো, দেবো।

কতো রূপ এগুলোর। কালেকালে ধরেছে কতো না রূপ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *