গঙ্গা জউনা মাঝে রে বহই নাঈ

গঙ্গা জউনা মাঝেরে বহই নাঈ

গঙ্গা যমুনার মাঝে নৌকা বয় রে। হাজার বছর আগে যদি এ-কথাটি বলতে হতো আমাকে, তাহলে বলতাম : গঙ্গা জউনা মাঝেঁরে বহই নাঈ; যেমন বলেছিলেন বাঙলা ভাষার প্রথম যুগের এক কবি ডোম্বীপাদ। ওই আদি বাঙলা ভাষা হারিয়ে গিয়েছিলো। আশি বছর আগেও কোনো বাঙালি জানতো না কেমন ছিলো প্রথম যুগের বাঙলা ভাষা। মানুষের মুখের কথা তো খাঁচা-ছেড়ে-উড়ে-যাওয়া পাখির মতো, যে-পাখি আর কখনো খাঁচায় ফিরে আসে না। কথা বলার সময় মুখ থেকে মুখর হয়ে ওঠে যে-ধ্বনিগুলো, সেগুলো মিলিয়ে যায় আকাশেবাতাসে। কেউ আর তাদের ফিরিয়ে আনতে পারে না। কিন্তু যদি লিখিত হয়ে যায় কথাগুলো, তাহলে তা টিকে থাকে বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী। প্রাকৃত থেকে, হাজার বছর আগে কোনো এক সময়ে, বঙ্গীয় ভূখণ্ডে যখন জন্ম নিয়েছিলো বাঙলা ভাষা, ধ্বনিত হয়ে উঠেছিলো তার স্বর আর ব্যঞ্জন, ঠিক তখনি কেউ সে-ভাষা লিখে ফেলে নি কাগজে বা গাছের বাকলে বা ভূর্জপত্রে। তাই প্রথম যুগের বাঙলা ভাষা মিশে গেছে আকাশেবাতাসে। তারপর এক সময় বুকের গান বাঙলা ভাষায় ধ্বনিত করতে শুরু করেন আমাদের প্রথম কবিরা। কিন্তু সেটা তো লেখার সময়, ছাপাখানার সময় ছিলো না। অনেক কবি হয়তো লিখতেই জানতেন না, কিন্তু বুক থেকে তাঁদের গান উঠতো। তাঁদের চোখ ছবি দেখতো। এক সময় তাঁদের গান লিখিত হয়। বাঁধা পড়ে কালি আর কাগজের বা অন্য কিছুর সোনার খাঁচায়। বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে বন্ধনহীন বাঙলা ভাষা। সেই আদিম রহস্যময়, সুদূর, আলোআঁধারজড়ানো বাঙলা ভাষার কথা কেউ জানতো না ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের আগে। হারিয়ে গিয়েছিলো আদি বাঙলা ভাষা। বিদেশে লুকিয়ে ছিলো কোনো আবিষ্কারকের প্রতীক্ষায়।

একজন অমর হয়ে গেছেন ওই আদি বাঙলা ভাষা আবিষ্কার ক’রে। তিনি মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি সেই ভাগ্যবান, যাঁর চোখ প্রথম দেখতে পেয়েছিলো প্রথম যুগের বাঙলা ভাষার মুখ। যেনো তাঁরই প্রতীক্ষায় ছিলো বাঙলা ভাষা। ১৯০৭ অব্দে নেপালে যান মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। নেপাল রাজদরবারের গ্রন্থশালায় তিনি আবিষ্কার করেন চারটি পুথি। ওই পুথিগুলো তিনি ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ থেকে প্রকাশ করেন “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা” নামে। এ-বইটিতে সংকলিত হয়েছিলো চারটি বই। বইগুলো হচ্ছে “চর্য্যচর্য্যবিনিশ্চিয়”, সরোজবজের “দোহাকোষ”, কৃষ্ণাচার্যের “দোহাকোষ”, ও “ডাকার্ণব”। এ-গুলোর মধ্যে “চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়”-এর গানগুলোই লেখা হয়েছিলো আদি যুগের বাঙলা ভাষায়। “চর্যাচর্য্যাবিনিশ্চয়” নামটি দিয়েছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তাঁর এ-বই প্রকাশের পর সাড়া প’ড়ে যায় বাঙলার পণ্ডিতসমাজে শিহরিত, বিস্মিত, উল্লসিত হন তাঁরা। কেননা বাঙলা ভাষার এতো পুরোনো নমুনা আর আগে দেখা যায় নি। “চর্যাচর্য্যবিনিশ্চয়”-এর নানা রকম নাম প্রস্তাব করেছেন পণ্ডিতেরা। কেউ বলেছেন এর নাম হওয়া উচিত “চর্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়”। কেউ বলেন এর নাম “চর্যাগীতিকোষ”। এখন এ-গানগুলো “চর্যাপদ” নামেই পরিচিত ও প্রিয়।

“চর্যাপদ” আদিযুগের বাঙলা ভাষায় লেখা কয়েকজন কবির গীতবিতান। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কার ও প্রকাশ করেছিলেন যে- চর্যাপদগুচ্ছ, তাতে ছিলো ছেচল্লিশটি পুরো আর একটি খণ্ডিত পদ। অর্থাৎ‍ মোট সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ বা গান ছিলো তাঁর চর্যাপদে। পরে প্রবোধচন্দ্র বাগচী এ-গানগুলোর একটি তিব্বতি অনুবাদ আবিষ্কার করেন। তাতে মনে হয় চর্যাপদের মোট গানের সংখ্যা ছিলো একান্ন। কয়েকটি পদ হয়তো নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। এখন বিভিন্ন চর্যাপদ সংকলনে পাওয়া যায় পঞ্চাশটি পদ। এ-পদগুলো লিখেছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকেরা সিদ্ধাচার্যেরা। তেইশজন সিদ্ধাচার্য লিখেছিলেন এ-গানগুলো। এ-গানগুলোর ভাষা যেমন সূদূর, ভাব যেমন রহস্যময়, তেমনি সুদূর-রহস্যময় বাঙলা ভাষার প্রথম কবিদের নামগুলো। তাঁদের নাম এমন : কাহ্নপা, লুইপা, কুক্কুরীপা, বিরুআপা গুডরীপা ভুসুকুপা, সরহপা, শবরপা প্রভৃতি। সবচেয়ে বেশি গান লিখেছেন কাহ্নপা, যাঁর অন্য নাম কৃষ্ণাচার্য বা কৃষ্ণাচার্যপাদ বা কৃষ্ণবজপাদ। তিনি লিখেছেন তেরোটি গান। আর ভুসুকুপা লিখেছেন আটটি গান। অন্যরা কেউ একটি কেউ দুটি গান লিখেছেন। ‘চর্যা’ শব্দের অর্থ হলো ‘আচরণ’। এ-গানগুলোতে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যেরা ধর্মের গূঢ় কথা বলেছেন, নির্দেশ করেছেন বিধিনিষেধ; অর্থাৎ সাধনার জন্য করতে হবে কী আচরণ, আর কী আচরণ পরিহার করতে হবে। তাই এগুলো তান্ত্রিক গাথা। সাধারণ পাঠক বা শ্রোতার জন্যে এগুলো রচিত নয়। শুধুমাত্র দীক্ষিতদের জন্যেই এ-রহস্যময় গানগুলো।

এ-গানগুলো মূল্যবান প্রাচীন বাঙলার সমাজের ছবির জন্যে; এবং কবিতার জন্যে। আমাদের প্রাচীনতম কবিদের বুকে কবিত্বের কোনো অভাব ছিলো না। তাঁদের আবেগ কবিতা হয়ে উঠেছে, তাঁদের দেখা দৃশ্য চিত্ররূপময় হয়ে উঠেছে গানেগানে। মণিমাণিক্যের মতো তাঁরা কবিতাকে সাজিয়ে দিয়েছেন উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষায়। এ-সবের জন্যে চর্যাপদ সোনার মতো দামি। কিন্তু তারচেয়েও বেশি দাম এর ভাষার জন্যে। কবিতা তো আরো পাওয়া যায়, ছবিরও অভাব নেই। উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা তো ছড়িয়ে আছে বাঙলা কবিতার পদেপদে। কিন্তু এ-ভাষা আর পাওয়া যাবে কোথায়? কোথায় পাওয়া যাবে প্রথম বাঙালিদের কণ্ঠস্বর? কোথায় আর পাওয়া যাবে জন্মকালের বাঙলা ভাষার রূপ? কোথায় পাওয়া যাবে, এ- পঞ্চাশটি পদে ছাড়া? ভাষার জন্যে চর্যাপদ মাণিক্যের চেয়েও মূল্যবান।

চর্যাপদ পড়ার সময় মনে হয় যেনো হাজার বছরেরও আগের কারো কথা শুনছি। তাঁর কথা সবটা বুঝে উঠতে পারি না। আমার কথাও বুঝতেন না ওই কবিরা। আমি বলি : ‘গঙ্গাযমুনার মাঝে নৌকা চলে।’ তিনি বলেন : ‘গঙ্গা জউনা মাঝে রে বহই নাঈ।’ আমি বলি : ‘সোনায় ভরা আমার করুণা নৌকো।’ তিনি বলেন : ‘সোনে ভরিলী করুণা নাবী।’ আমি বলি : ‘অন্ধকার রাত, ইঁদুর চরছে।’ তিনি বলেন : “নিসি অন্ধারী মূসার চারা।’ এভাবে তাঁর কথা আর আমার কথার মাঝে অনেকটা মিল আর অনেকটা অমিল। চর্যাপদ পড়ার সময় মনে হয় আমি যেনো স্বপ্নে কারো কথা শুনছি। তাঁর কথায় ছড়িয়ে গেছে আমার বাঙলা ভাষা। কিছুটা বুঝতে পারি আর অনেকটা বুঝতে পারি না। না পারারই কথা। কেননা এ তো হাজার বছরের আগের বাঙলা ভাষা।

দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে বাঙলার আদিকবিরা আদি বাঙলা ভাষায় রচনা করেছিলেন এ-রহস্যময় আদিম সৌন্দর্যময় কবিতাগুচ্ছ। তাঁদের ভাষা বুঝতে পারি না; ভাব বুঝতে পারি না। চর্যাপদের কবিরাও জানতেন, তাঁরা যে-কথা বলেছেন তা খুবই কঠিন, সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। কবি কুক্কুরীপা তো স্পষ্টই বলেছেন যে তাঁর কথা ‘কোড়ি-মাঝে’ একু হিঅহি সনাইউ’; অর্থাৎ কোটিকের মাঝে গোটিকের মর্মে পশে তাঁর কথা। তাঁকে বুঝতে পারে এক-আধজন। কবি ঢেণ্টণপাও বলেছেন যে তাঁর গান বোঝে খুব কম লোকেই—’ঢেণ্টণ-পাএর গীত বিরলে বুঝই।’ কিন্তু এ তো ভাবের কথা। বেশ কঠিন তান্ত্রিক ধর্মীয় ভাবের কথা বলেছেন ঘরছাড়া সমাজছাড়া ওই সাধক কবিরা। তাঁদের ভাব বুঝতে হ’লে ঘর ছাড়তে হবে সমাজ ছাড়তে হবে। দীক্ষিত হ’তে হবে তাঁদের ধর্মে। কিন্তু ভাষা?

চর্যাপদের ভাষার মুখোমুখি বেশ বিচলিত বোধ করেছিলেন আবিষ্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীও। পুথি খুলেই যেনো একগুচ্ছ প্রহেলিকায় বিহ্বল হয়েছিলেন শাস্ত্রী। তিনি ভালোভাবেই বুঝেছিলেন যে চর্যাপদের ভাষা পুরোনো বাঙলা। কিন্তু বড়োই রহস্যময়;–কিছুটা বোঝা যায় কিছুটা বোঝা যায় না। তিনি এ-ভাষার নাম দিয়েছিলেন ‘সন্ধ্যাভাষা’। তাঁর মতে, ‘সন্ধ্যাভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায় কতক বুঝা যায় না।’ তিনি এ-ভাষাকে আলোআঁধারজড়ানো রহস্যময় সন্ধ্যার সাথে তুলনা করেছিলেন। তাঁর উপমার শোভায় আলোড়িত হয়েও কেউকেউ একে আলোআঁধারি ভাষা ব’লে মেনে নেন নি। তাঁদের মতে ‘সন্ধ্যাভাষা’ হচ্ছে সে-ভাষা, যার অর্থ গভীরভাবে অনুধ্যান ক’রে বুঝতে হয়। অর্থাৎ এ হচ্ছে এক রূপক ভাষা। আমরা প্রতিদিন যে-সব কথা বলি, তাতে কোনো রূপক নেই। আমরা এক কথা ব’লে অন্য কিছু বোঝাতে চাই না। নৌকো বললে নৌকোই বোঝাই, হরিণ বললে হরিণ। গাছ বললে গাছ বোঝাই, নদী বললে নদী। কিন্তু ওই কবিরা বলতেন নৌকো, বোঝাতেন অন্য কিছু; বলতেন গাছ, বোঝাতেন শরীর।

তাই এ-ভাষা রূপক, রহস্যময়, বোঝা-না-বোঝার মেঘরোদজড়ানো। একটি পদ পড়া যাক :

নগর বাহিরেঁ ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ।
ছই ছোই যাই সো বাহ্ম নাড়িআ ॥ধ্রু॥
আলো ডোম্বি তোএ সম করিবে ম সাঙ্গ।
নিঘিণ কাহ্নপালি জোই লাঙ্গ ॥ধ্রু॥
এক সো পদমা চৌসডী পাখড়ী।
তাহঁ চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী ॥ধ্রু॥
আলো ডোম্বী তো পুছমি সদভাবে।
আইসসি জাসি ডোম্বী কাহরি নারেঁ ॥ধ্রু॥
তান্তি বিকণহ ডোম্বী অবরনা চঙ্গতা।
তোহোর অন্তরে ছাড়ি নড়এত্তা ॥ধ্রু॥
তু লো ডোম্বী হাউ কপালী।
তোহোর অন্তরে মোএ ঘলিলি হাড়েরি মালী ॥ ধ্রু॥
সরবর ভাঞ্জীঅ ডোম্বী খাঅ মোলাণ।
মারমি ডোম্বী লেমী পরাণ ॥ধ্রু॥

এটি কবি কাহ্নপাদের একটি পদ। পুরোনো বাঙলা ভাষায় পণ্ডিত নন এমন কারো পক্ষেই এটি পরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। পণ্ডিতেরাও যে সবাই একইভাবে পদটি বোঝেন, তাও নয়। তাঁদের মধ্যেও রয়েছে নানা রকম মত। যেমন প্রথম পংক্তির ‘বাহিরেঁ’ শব্দটি কারো মতে ‘বারিহিরেঁ’, কারো মতে ‘বাহিরিরেঁ’। এমন মতভেদ আছে পদটির বেশ কয়েকটি শব্দ সম্পর্কেই। আর অর্থ সম্পর্কে তো মতভেদ বেশ প্রকাণ্ড। তারপর আছে পদটির রূপকার্থ—সে-অর্থ যা শুধু শব্দের অর্থে ধরা পড়ে না। আধুনিক বাঙলায় অনুবাদ করলে পদটি নেবে এমন রূপ :

নগরের বাইরে, ডোম্বী, তোমার কুঁড়েঘর।
তুমি ব্রাহ্মণ নেড়াকে ছুঁয়েছুঁয়ে যাও।
ওগো ডোম্বী আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
আমি ঘৃণাহীন কাহ্ন—কাপালিক, যোগী ও উলঙ্গ।
একটি সে পদ্ম, তার চৌষট্টি পাপড়ি।
তাতে চ’ড়ে নাচে ডোম্বী বেচারী।
ওগো ডোম্বী তোমাকে সদভাবে জিজ্ঞেস করি।
কার নৌকোয় তুমি আসা-যাওয়া করো?
ডোম্বী তুমি তাঁত আর চাঙ্গারি বিক্রি করো।
তোমার জন্যে ছাড়লাম নটসজ্জা।
তুমি তো ডোম্বী আর আমি কাপালিক।
সরোবর ভেঙে ডোম্বী তুমি মৃণাল খাও।
তোমার জন্যেই আমি নিয়েছি হাড়ের মালা।
আমি ডোম্বীকে মারি, প্রাণ নিই।

আধুনিক অনুবাদে হয়তো বোঝা যাচ্ছে কথাগুলো। কিন্তু তার ভেতরের ভাব ধরা পড়ছে না। তাই হেঁয়ালি, বলবো কী চমৎকার হেঁয়ালির, মতো মনে হচ্ছে কথাগুলো।

চর্যাপদের ভাষা যে বাঙলা তা পণ্ডিতেরা প্রমাণ করেছেন এ-ভাষার ব্যাকরণ তন্নতন্ন ক’রে ঘেঁটে। তবে অন্যরাও, যেমন হিন্দিভাষী, মৈথিলিভাষী, ওড়িয়াভাষীরাও, দাবি করেছে চর্যার ভাষাকে নিজেদের ভাষা ব’লে। এমন দাবির কারণ দশম-দ্বাদশ শতকে বাঙলা-হিন্দি-ওড়িয়া ভাষা সবে জন্ম নিচ্ছিলো, আর তাদের মাতৃভাষার মধ্যে মিল ছিলো খুবই। আসামি ভাষা ও বাঙলার মধ্যে তো ঘনিষ্ঠ মিল ছিলো ষোলো শতক পর্যন্ত। চর্যাপদের ভাষাকে যে আমরা বাঙলার আদিরূপ ব’লে মানি, তার কারণ এ- ভাষার সাথে পরবর্তী কালের বাঙলা ভাষার মিল খুবই গভীর। ওই মিল আকস্মিক হ’তে পারে না। চর্যাপদের শব্দরাশির বহু শব্দ এখন আর আমরা ব্যবহার করি না। আর প্রায় সমস্ত শব্দেরই রূপ বদলে গেছে এক হাজার বছরে। তবু আদি বাঙলা ভাষা ও আধুনিক বাঙলা ভাষার রক্তের সম্পর্ক নষ্ট হয় নি। সম্পর্কটা ধরা পড়ে চর্যাপদের ভাষার ব্যাকরণ আলোচনা করলেই। ব্যাকরণ ব্যাপারটি বেশ ভয়ানক; তবুও দু-একটি জিনিশ সাহস ক’রে দেখে নেয়া ভালো।

আধুনিক বাঙলায় আমরা সম্বন্ধপদে অর্থাৎ অধিকার বা সম্বন্ধ বোঝানোর জন্যে বিশেষ্য, সর্বনাম ইত্যাদির সাথে যোগ করি ‘র’, ‘এর’। বলি : ‘আমার আকাশ’, ‘কবির কবিতা’, ‘মায়ের মন’। চর্যাপদের বাঙলায়ও পাওয়া যায় ‘এর’, ‘অর’। কবি কুক্কুরীপাদ লিখেছেন : ‘রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ’, অর্থাৎ ‘গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়’। কবি ভুসুকুপাদ লিখেছেন : ‘হরিণা হরিণির নিলঅ ণ জাণী’। এর অর্থ হলো : ‘হরিণ জানে না হরিণীর ঘর।’ ‘রুখের তেন্তলি’, ‘হরিণির নিঅল’ প্রভৃতি পদে যে-চিহ্ন দেখি, তা পাওয়া যায় আধুনিক বাঙলা ভাষায়ও। ক্রিয়ার কাল প্রকাশের রীতি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন রকম। যখন বলি : ‘স্মিতা খাচ্ছে’, তখন স্মিতার খাওয়ার ক্রিয়াটি বর্তমান কালে ঘটছে ব’লে বোঝায়। যদি বলি : ‘স্মিতা খাবে’, তখন ক্রিয়াটি ভবিষ্যতে ঘটবে ব’লে বোঝায়। আর যদি বলি : স্মিতা খেলো’, তখন বোঝায় যে খাওয়ার ক্রিয়াটি একটু আগে শেষ হয়েছে। সাধু বাঙলায় ক্রিয়ার অতীত কাল বোঝানোর জন্যে ক্রিয়ামূলের সাথে ‘ইল’ যোগ করা হয়। যেমন : ‘লক্ষ্মণ কহিল’, ‘তাহারা আসিল’, ‘চোরে নিল’। কবি কুক্কুরীপাদ একটি আবেগাতুর বউর কথা লিখেছেন, যে রাতে জেগে থাকে, অথচ বিস্ময়করভাবে তার কানের দুল চুরি হয়ে যায়। তিনি বলেছেন : ‘কানেট চোরে নিল কা গই মাগঅই।’ অর্থাৎ তাঁর কানেট নিলো চোরে এখন সে তা কোথায় খুঁজবে? ভবিষ্যৎকালে সাধুভাষায় ক্রিয়ামূলের সাথে যোগ করা হয় ‘ইব’। যেমন : ‘আমি করিব’, ‘আমি নাচিব’। চর্যাপদের ভাষায়ও তা দেখা যায়। কাহ্নপাদ লিখেছেন : “শাখি করিব জালন্ধরি পাত্র’, অর্থাৎ সাক্ষী করবো জালন্ধরিপাদকে। এভাবে খুঁজেখুঁজে পাই আধুনিক বাঙলার সাথে হাজার বছর আগের বাঙলার সম্পর্ক।

চর্যাপদের কিছু শব্দ, যেগুলোকে অদ্ভুত মনে হয় আমাদের কাছে, তুলে দিচ্ছি এখানে। বন্ধনির ভেতরে দেয়া হলো অর্থ। অকিলেসেঁ (অক্লেশে : বিনা পরিশ্রমে), অচ্ছহুঁ (আছি), অদ্‌ভূঅ (অদ্ভুত), অবণাগবন (আনাগোনা), আইলেসি (এসেছে), উইএ (উদিত হয়), উএস (উপদেশ), উঞ্চা উঞ্চা (উঁচু উঁচু), করুণা নাবী (করুণা নৌকো), কল-এল-সাদেঁ (কলকল শব্দ), কাআবাকচিঅ (কায়বাকচিত্ত), কেডুআল (দাঁড়), গঅণ (আকাশ), গুহাড়া (অনুরোধ), ঘলিলি (নিলাম), চউকোড়ি (চোর কোটি), ছুপই (ছোঁই), জাণহুঁ (জানি), জোহ্না (জ্যোৎস্না), ণাণা (নানা), ণাবড়ি-খণ্ডি (ছোট নৌকো), তংত্রী (তন্ত্রি), তিঅধাউ (তিন ধাতু), দুলি (কচ্ছপ), নঅ বল (দাবা খেলা), নঈ (নদী), নাচঅ (নাচে), নাবী (নৌকো), পঁউআ-খালে (পদ্মার খালে), পিবই (পান করে), পীছ (পুচ্ছ), বিআলী (বিকেল), বেন্টে (বাঁটে), ভণই (বলে), মরণঅঅণা (মরণ ও জীবন), মহাসুহ (মহাসুখ), রুখের (গাছের), ষবসলী (অতিদুঃখ), ষামায় (ঢোকে), সাসু ঘরেঁ (শাশুড়ীর ঘরে), হাউঁ (আমি), হিঅহি (হৃদয়ে), হিণ্ডই (ঘুরে বেড়ায়), হোহু (হও)।

চর্যাপদের গানগুলোতে খচিত হয়ে আছে আদিযুগের বাঙলা ভাষার পরিচয়। চর্যাপদের বাইরে পুরোনো বাঙলা ভাষার কিছু শব্দ পাওয়া গেছে আরেকটি গ্রন্থে। ১১৫৯ খ্রিস্টাব্দে সর্বানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন সংস্কৃত অভিধান অমরকোষ-এর টীকা। ওই টীকার নাম টীকাসৰ্বস্ব। সংস্কৃত অভিধানের বাঙালি টীকাকার সংস্কৃত শব্দের প্রতিশব্দরূপে ব্যবহার করেছিলেন তিনশোর মতো দেশি শব্দ। তাঁর টীকায় পাওয়া যায় ফড়িঙ্গ (ফড়িং), ডাশ (ডাঁশ), ডাঢ়কাক (দাঁড়কাক), বেঙ্গ (ব্যাঙ), চাল (চাল), টোপর (টোপর), সিঙ্কল (শেকল) প্রভৃতি শব্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *