1 of 2

হাওয়াই চটির সন্ধানে – হিমানীশ গোস্বামী

হাওয়াই চটির সন্ধানে – হিমানীশ গোস্বামী

গোয়েন্দা দাঁ-এর গোড়ালির ব্যথায় আবার কষ্ট হচ্ছিল, তবে এবারে ততটা মারাত্মক নয়। এমনিতে হয়তো ঘন্টাখানেক হাঁটলেন, কোনও ব্যথা নেই, কিছু নেই, কিন্তু হঠাৎ ব্যথায় থমকে পড়েন। দু’ তিন মিনিট হাঁটতেই পারেন না আর। তারপর এমনিতেই ব্যথাটা চলে যায়। এই কারণে গোয়েন্দা দে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন, প্রতিদিন সকালে এবং বিকেলে অন্তত দেড় মাইল হাঁটার। গোয়েন্দা দাঁ বলেছিলেন, পাগল নাকি মশাই, এই গরমের মধ্যে গলদঘর্ম হয়ে হাঁটা আমার পোষাবে না। তার চাইতে গোড়ালির ব্যথাটা থাক—আর বয়স তো কম হল না, এই রকম একটা না একটা কিছু এখন হতেই থাকবে। গোয়েন্দা দে বলেছিলেন, ওসব কথা বলবেন না। হতেই থাকবে—এরকম কথা তো সংগ্রামীর কথা নয়। প্রকৃতিকে জয় করাই প্রগতিশীল মানুষের কর্ম, প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ নয়।

ফলে নিজেকে প্রগতিশীল বলে পরিচয় দিতে গোয়েন্দা দাঁ রোজই বেড়াচ্ছেন। ঘোর গরমে, কখনও বৃষ্টিতে। তার সঙ্গে চলেছে ওষুধও—এবং মনে হচ্ছে যেন ব্যথাটা আর তেমন নেই। তবে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে গোয়েন্দা দাঁ সঙ্গে নিয়েছেন গোয়েন্দা দে-কেও। রাজী করিয়েছেন তিনি তাঁকে। তাঁর যুক্তি এই যে হাঁটলে যদি অসুস্থ গোড়ালির উপকার হয় তাহলে সুস্থ গোড়ালিও অসুস্থ হতে পারবে না।

তাঁরা রোজই একটা চায়ের দোকানে সকাল প্রায় সাড়ে ছ’টায় মিলিত হন। সেখানে এক এক কাপ চা পানান্তে তাঁরা হাঁটতে থাকেন অনির্দিষ্ট ভাবে। কখনও মাত্রা মতই হাঁটেন, কখনও একটু বেশি হেঁটে ফেলেন। এই রকম ভাবেই চলছিল। গোয়েন্দা দাঁ-ও ভাবছিলেন তাঁর গোড়ালির ব্যথা প্রায় নেই বললেই চলে—সত্যি, গোয়েন্দা দের ওষুধের বাহাদুরি আছে বলতেই হবে।

সেদিন সকাল বেলা চায়ের দোকান—দোকানের নাম একটু আধুনিক বলেই মনে হবে—চা-স্পৃহ, কিন্তু দোকানটি অন্তত পঞ্চাশ বছরের পুরোন। যাঁরা এই দোকানটি প্রথমদিকে দেখেছেন তাঁরা বলেন দোকানটির কোনো উন্নতি হল না। সেই একই ভাবে চলেছে। এমনকি মনে হয় সেই পুরোন সাইন বোর্ডটিও রয়েছে—আর পুরোন মালিক বসন্তবাবুই হাল ধরে রয়েছেন। বসন্তবাবু বুড়ো হয়েছেন আজ—তবে তাঁর অবস্থা অসচ্ছল নয় কোনমতেই। দোকানটি দেখে যে যাই বলুন এই দোকানের চা যাঁরা একবার চেখেছেন, তাঁরা এর মায়া কাটাতে পারেন না। দাম একটু বেশিই দিতে হয়। আর এই দোকানের বিশেষত্ব হল কবিরাজি কাটলেট। রোজ গোনা একশো কাটলেট বানান। কেবল শনি এবং রবিবারে কিছু বেশি। এত ভাল কাটলেট নাকি এ অঞ্চলে আর কেউ বানাতে পারে না। কিন্তু বসন্তবাবু কিছুটা নির্লোভ। অনেকেই তাঁকে উপদেশ দিয়েছেন দোকান ঘরটিকে কয়েক হাজার টাকা খরচ করে আধুনিক করতে। বেশ কিছু তাহলে ব্যয় হবে বটে, কিন্তু পাঁচগুণ মুনাফা ঘরে উঠবে। কিন্তু বসন্তবাবু নির্বিকার! এই বসন্তবাবুর সঙ্গে গোয়েন্দা দে এবং দাঁ-এর পরিচয় অনেকদিন থেকেই। এই অঞ্চলে যখন গোয়েন্দা দে বাড়ি করেন তখন থেকেই—তা সেও তো প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল!

এই দোকানে সকালে আসবার পথেই সেদিন ঘটনাটা ঘটল। গোয়েন্দা দাঁ একটা গলির ভেতর দিয়ে শর্টকাট করছিলেন, এমন সময় তিনতলা এক বাড়ির জানলা থেকে একপাটি চটি সপাটে এসে পড়ল তাঁর সামনে। আর একটু হলেই গোয়েন্দা দাঁর মাথায় কিংবা গায়ে সে চটি পড়ত। গোয়েন্দা দাঁ একটু চমকে গিয়ে তাকালেন উপরের দিকে—কিন্তু ঠিক কোন জানলা দিয়ে এই চটির অধঃপতন হল তা তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন হয়তো চটির মালিক এখুনি নিচে নেমে আসবেন চটি উদ্ধারের জন্য। কিন্তু সেরকম কিছু হল না। নির্জন গলিতে দু মিনিট দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি—এমন সময় দরজা খুলে গেল অকস্মাৎ তাঁর ডান দিকে। এক পালোয়ান গোছের যুবক হেঁড়ে গলায় জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই মশাই আপনার?

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, কাউকে আমার দরকার নেই—আমি কেবল জানতে চাই আমার সামনে একপাটি চটি কে ছুঁড়ল? মনে হয় তিনতলার কেউ হবে!

তখন সেই পালোয়ান বলল : তিনতলার কেউ হবে? বললেই হল—এর কোন প্রমাণ দাখিল করতে পারেন?

কথাবার্তা শুনে আরও কিছু লোকসমাগম হল। ঝট্‌পট্‌ জানলা কিছু খুলল এদিক-ওদিক। দরজা খুলেও কেউ কেউ এল। একজন বলল, কি মশাই, ব্যাপার কি? হল কি? একজন বলল, লোকটা গুপ্তচর হতে পারে। আজকাল তো গুপ্তচর সর্বত্র—এমন কি হাওড়ার গণ্ডগ্রামে পর্যন্ত গুপ্তচরদের দেখা মিলে যায়।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, দেখুন—ব্যাপারটা কিছুই নয়। আমি এই গলি দিয়ে শর্টকাট করে চা-স্পৃহতে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ উঁচু থেকে একটা চটি আমার সামনে এসে পড়ল। আর একটু হলেই আমার গায়ে বা মাথায় পড়ত। আমি থমকে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম এরকম ভাবে চটি কেউ ছুঁড়ে থাকলে সেটা খুব অন্যায়।

—তা আপনাকে কে চটি ছুঁড়বে বলুন?

—আহা, আমাকে নয়। আমাকে লক্ষ্য করে ছোঁড়েনি কেউ—চটি কেউ উপর থেকে ফেলেছে এটাই হল ঘটনা। কেন ফেলেছে তা আমি বলছি না, আমি বলতে চাই, যেই ফেলুক তার এভাবে ফেলা উচিত হয়নি।

মানে আপনি এই পাড়ায় জ্ঞান দিতে এসেছেন?—একটি ছোকরা প্রশ্ন করল।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, দেখুন—আমার অন্যায় হয়েছে। উপর থেকে জঞ্জাল, নোংরা, পাথর, ইট—এ সবই আপনারা ফেলবেন নিশ্চয়, পাড়াটা যখন আপনাদের। কিন্তু আমি তো এ পাড়ার নই, আমার পক্ষে এসব অভ্যেস নেই।

কেবল একজন বয়স্ক লোক বললেন, যান মশাই, সময় নষ্ট করবেন না, চলে যান।

খুব মন খারাপ করে গোয়েন্দা দাঁ হাঁটতে লাগলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন—এসব হচ্ছে কি? সমাজ আজ কোথায় চলেছে? কোন লোককে কেউ সম্মান করে না। তাঁর মন খুবই ভারী হয়ে উঠল। একটু পরই অবশ্য তিনি পৌঁছে গেলেন চা-স্পৃহতে। সেখানে যেতেই গোয়েন্দা দে ঘড়ি দেখে বললেন, ব্যাপার কি, সাড়ে ছ’ মিনিট লেট?

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, এক পাটি চটি।

তারপর সংক্ষেপে ঘটনাটা বললেন। চা-স্পৃহর মালিক বসন্তবাবু বললেন, এরকম ছোটখাটো ঘটনায় আজকাল খুন পর্যন্ত হচ্ছে। এই তো সেদিন···।

কিন্তু ইতিমধ্যে দোকানের সামনে একটা ক্রিম রঙের অ্যামবাসাডর গাড়ি এসে থামল। তা থেকে প্রথমে নামল গোয়েন্দা দাঁ-এর ভৃত্য সখারাম। তারপর নামলেন এক বিরাটবপু ভদ্রলোক। গরমকালেও তাঁর গায়ে হালকা কাপড়ের কোট, শার্ট এবং ট্রাউজার। তার উপর ঝক্ঝকে একটা টাই। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।

সখারাম গোয়েন্দা দাঁকে বলল, আপনার খোঁজে এসেছিলেন। ইনি বললেন খুব জরুরী ব্যাপার, তাই নিয়ে এসেছি।

চায়ের দোকানের মধ্যে ভদ্রলোক ঢুকেই একটা চেয়ারে বসে পড়লেন।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আমার নাম দাঁ, আমার কাছে আপনার কী প্রয়োজন?

ভদ্রলোক বললেন, ব্যাপারটা একটু গোপনীয়।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আমি পরিচয় করিয়ে দিই, আমার সহকর্মী এবং বন্ধু গোয়েন্দা দে।

নমস্কার।—ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম আপনারা শুনে থাকবেন—আমার নাম রণজিৎ পাণ্ডা। পাণ্ডা শূ আমারই প্রতিষ্ঠান। গত দশ বছর ধরে কলকাতার আশেপাশে জুতোর চারটে কারখানা চালাচ্ছি। ভগবানের দয়ায় আমার প্রতিষ্ঠানের জুতোর কদর হয়েছে। কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়—আসাম, উড়িষ্যা, বিহার থেকে শুরু করে জম্মু-কাশ্মীর পর্যন্ত আমার জুতো চালান যায়। এবছর দশ হাজার জোড়া উৎকৃষ্ট মানের চামড়ার জুতো জাপানে পাঠিয়েছি—সেখান থেকে নতুন অর্ডার এসেছে পঞ্চাশ হাজার জোড়ার। এত সাফল্য আমার আসবে আমি চিন্তাও করতে পারিনি। আজকাল অবশ্য চামড়ার জুতোর দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়ায় দেশের মধ্যে নকল চামড়ার জুতোই চলছে বেশি। সে জন্যে দেশের মধ্যে বিক্রি করার জন্য পলিথিন জাতীয় জিনিসের তৈরি জুতো, চটি ইত্যাদি চলেছে খুব। আমরাও ক্যানিং-এর কাছে একটা কারখানা বসিয়েছি। কেবল পলিথিনের চটি জুতো বানানোর। কাঁচা মাল হাতে থাকলে তৈরি করার হাঙ্গামা কম। বড় বড় শিট থেকে প্রয়োজন মত কাটাকুটি করে দৈনিক দু’হাজার থেকে তিন হাজার জোড়া চটি ওখানে তৈরি হয়। আমরা বোধ হয় সবচেয়ে কম লাভে চটি বিক্রি করে থাকি। হরে দরে জোড়া প্রতি কুড়ি থেকে ত্রিশ পয়সা শেষ পর্যন্ত লাভ থাকে।

—ট্যাক্সের পর না আগে?—গোয়েন্দা দাঁ হেসে জিজ্ঞেস করলেন। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই একটু উচ্চকণ্ঠে বললেন, বসন্তবাবু, এঁর জন্যে এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা করুন। সঙ্গে একটা কি দুটো টোস্ট? না? বেশ, এক কাপ চা-ই হোক।

রণজিৎ পাণ্ডা বললেন, ট্যাক্সের পর।

গোয়েন্দা দা বললেন, মন্দ কি। প্রতিদিন আড়াই হাজার জোড়াও যদি বিক্রি হয় তাহলে মাসে আয় আঠারো হাজারেরও বেশি, তাই না?

আজ্ঞে তা হয়। তবে এছাড়া আমার অন্যান্য কারখানা থেকেও আয় হয়। সব সমেত মাসে দু’তিন লাখ টাকা লাভ থাকে। কিন্তু এই ব্যবসায়ের একটা মজা এই যে এখানে থেমে থাকা চলে না। আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজন কতই বা হতে পারে। দৈনিক দুশো টাকা হলে বেশ ভালভাবেই চলে যায়। খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো—এ সমস্তই ওই টাকায় হয়ে যায়। ওর চাইতে কমেও অসুবিধে বিশেষ হয় না। আমি তো কানপুরে একটা ট্যানারিতে কাজ শুরু করেছিলাম মাসিক দুশো টাকায়। তবে তা বছর পনেরো আগেকার কথা। কিন্তু এখন নানারকম দায়িত্ব ঘাড়ে পড়েছে। আমার কারখানায় কাজ করে প্রায় ছ’শো লোক। আরও লোক নিতে হবে—আরও বড় করতে হবে ; এসবই ব্যবসায়ের অঙ্গ। দু’ একটা আধুনিক যন্ত্র কিনতে হবে—সেজন্য কয়েক কোটি টাকা দরকার, সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমার অবস্থা তেমন ভাল বলা যায় না।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আপনার সমস্যা কি?

রণজিৎবাবু বললেন, এসব শুনে মনে হচ্ছে সমস্যা আমার কিছু নেই! মনে হতেই পারে, কিন্তু যা বললাম, সমস্যা সেটাই। আমাকে আমার প্রতিষ্ঠান ‘পাণ্ডা-শূ’কে আরও বড় করতে হবে। ধার নিতে হবে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির কাছ থেকে। হয়তো সাধারণের কাছ থেকেও ধার করতে হতে পারে। কিন্তু যার শোধ করার সামর্থ্য নেই, ধার কেউ তাকে দেয় না। বাজারে যদি একবার রটে যায় আমার অবস্থা ভাল নয়—তাহলেই ঝামেলা।

—তা আপনার তো সে ভয় নেই, কি বলেন?—গোয়েন্দা দে প্রশ্ন করলেন।

—ছিল না। এতদিন ছিল না। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে একটা জিনিস লক্ষ্য করে অবাক হচ্ছি।

বরাকরওয়ালার নাম শুনেছেন আপনারা?

—বরাকরওয়ালা?-গোয়েন্দা দাঁ প্রশ্ন করলেন। তারপর মাথা চুলকে বললেন, মনে হয় হাওড়া যাওয়ার পথে স্ট্র্যান্ড রোডে একবার বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম বিরাট এক সাইন বোর্ডে, মনে পড়ছে যেন গেঞ্জির বিজ্ঞাপন ছিল সেটা।

একথায় রণজিৎ পাণ্ডার বেশ ভক্তি হল মনে। তিনি বললেন, ঠিক কথা! ওই লোকটি বছর তিনেক আগে গেঞ্জি জাঙ্গিয়ার সঙ্গে জুতোর ব্যবসায়ে নেমে পড়ে। বেশ কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে হাওড়ার ওদিকে কোথায় একটা কারখানাও করে। কিন্তু আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠে না। ওই যে, বললাম না আমি লাভ রাখি কম। অত কম লাভে অনেক জোড়া জুতো বিক্রি না হলে পোষায় না। বরাকরওয়ালার বড়া-শূ আমার কাছে মার খেতে খেতে প্রায় উঠেই গিয়েছিল।

—তবে আর কি?—গোয়েন্দা দাঁ বললেন।

রণজিৎবাবু বললেন, কিন্তু সম্প্রতি সে আমাকে জুতোচ্ছে!

—মানে?-গোয়েন্দা দে প্রশ্ন করলেন।

—মানে বরকরওয়ালা আমাকে মারছে। আমি যে চটি জুতো সাড়ে আট টাকায় হোলসেল করি, বরাকরওয়ালা সেই কোয়ালিটির চটি জুতো দিতে পারে ছ’ টাকায়! কোনও হিসেবেই ওই দামে চটি বিক্রি করা সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, দিনে এক লক্ষ জোড়া তৈরি করা যায় এমন আটোম্যাটিক কারখানা থাকলে অবশ্য স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু ভারত সরকার সে রকম কারখানা করতে দেবেন না। তাতে এখন যেখানে পাঁচ হাজার লোক কাজ করছে সেখানে দরকার হয় মাত্র দুশো লোক! এছাড়া যে কাঁচা মাল হাওয়াই চটি তৈরিতে লাগে তা আনতে ট্যাক্সও দিতে হয় বেশ ভারী ধরণের। যাই হোক, ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই যে আমি বরাকরওয়ালার কাছে মার খাচ্ছি। যে মার খাওয়ার কোন কারণ নেই। আমি যত কম দামে জুতো দিতে পারি, আমি গ্যারানটি দিয়ে বলতে পারি, তত কম দামে আর কেউ দিতে পারবে না। অথচ মজা দেখুন, কার্যত তাই হচ্ছে। ফলে গত কয়েক মাস হল আমার তৈরি জুতোর বাজার চলে যাচ্ছে। আমি যে সব সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নিয়েছিলাম সেগুলি পিছিয়ে যাচ্ছে। বাজারেও গুজব ছড়ানো হয়েছে আমার কারখানা নাকি উঠে যাবে! কেবল কি হাওয়াই চপ্পলে? অন্যান্য জুতোতেও দেখছি বরাকরওয়ালা আমাকে দামে মারছে। এরকম ভাবে কয়েক মাস চললে তামাকে ডুবতে হবে।

—এখন আমাদের কী কৰ্তব্য? আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আজকাল আমরা কোন কাজ একা নিই না। শরীরে এবং মনে কুলোয় না। ফলে দুজনকেই এক যোগে আপনাকে নিয়োগ করতে হবে। বুঝতে পারছি আপনি জানতে চান বরাকরওয়ালার জুতোর দাম কমানোর রহস্য। আপনি জানতে চান। জুতো তৈরি করতে বরাকরওয়ালা কি কি যন্ত্র ব্যবহার করে। কী কাঁচামাল ব্যবহার করে। সে কাঁচামাল বিদেশ থেকে কত দামে কেনে। সে কোন গোপন ফরমূলা আবিষ্কার করেছে কিনা, যার সাহায্যে সে জুতোর দাম কমের দিকে রাখতে পারে? এই তো?

—ঠিক ধরেছেন। এইগুলোই মোটামুটি আমার জানা দরকার।

গোয়েন্দা দে বললেন, বরাকরওয়ালার কারখানায় কাজ করে এমন কাউকে ধরতে পারলে কাজটা সহজ হয়।

রণজিৎবাবু বললেন, সে চেষ্টাও করেছি। আমোদ রায় নামের একজন বরাকরওয়ালার কারখানায় কাজ করত। তাকে আমি ইনফরমার হিসেবে কিছু টাকাও দিচ্ছিলাম। সে দু’তিনটে তুচ্ছ খবরও এনে দিয়েছিল, কিন্তু কারখানায় কাজ করতে করতে হঠাৎ একটা দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়—কয়েকদিন আগে কাগজে ছোট করে একটুখানি বেরিয়েছিল।

—কী বললেন? দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল?—গোয়েন্দা দে প্রশ্ন করলেন।

—মনে হচ্ছে কথাটা আপনার ঠিক যেন বিশ্বাস হচ্ছে না? রণজিবাবু প্রশ্ন করলেন।

—ঠিক ধরেছেন। বিশ্বাস হচ্ছে না। গোয়েন্দা দে বললেন। আপনার হয়ে কাজ করছে এমন সন্দেহ হওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়েছে এটাও তো হতে পারে।

—হতে পারে । —রণজিৎবাবু বললেন’। সে ব্যাপারে আমার কোন উৎসাহ নেই। এখন আমার জানা দরকার সস্তায় জুতো উৎপাদন রহস্য।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, কিন্তু আমাদের যদি অস্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু হয় তা নিয়ে আপনার কোনও মাথাব্যথা নেই?

রণজিৎবাবু বললেন, আমার কৌতুহল আছে, কিন্তু ঠিক যাকে বলে ইন্টারেস্ট, তা নেই। যতদূর জানি সে একটা বৈদ্যুতিক মেশিন সারাচ্ছিল—সেটাকে হঠাৎ কে চালু করে দেয়। কিন্তু কে যে করে তা কেউ জানে না। পুলিশ কারখানায় বহু লোককে প্রশ্ন করেও জবাব পায়নি। যাই হোক্, সেই বিদ্যুতের আঘাতে সঙ্গে সঙ্গে আমোদের মৃত্যু হয়। এখন, হতে পারে সে আমার জন্য কিছু খবর সংগ্রহ করছে এমন কথা কাউকে হয়তো কখনও বলে ফেলেছিল, সে কথা যথাস্থানে গিয়ে পৌছেও ছিল— এবং তারপর ওই বৈদ্যতিক ‘দুর্ঘটনা’ ঘটানো হয়েছিল। কিন্তু তাতে আমার স্থান কোথায়? তা ছাড়া, একথা প্রমাণ করাও কঠিন। এ তো পুলিশ কেস। পুলিশ যা করবার করেছে।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, তবু পুলিশকে সন্দেহের কথা জানালে পুলিশ ব্যাপারটা অন্যভাবে অনুসন্ধান হয়তো করত। কিন্তু তা আপনি করছেন না, বা করতে চান না।

রণজিৎবাবু বললেন, এখন মনে হচ্ছে আমার সেটা করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা ব্যবসায়ী—আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে যতক্ষণ না হাত পড়ছে ততক্ষণ ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো পোষায় না।

তারপর নিজেই হাসতে হাসতে বললেন, ব্যবসায়ীরা চামার হয় তা তো জানেনই। কথাটা সত্যিই মশাই। যাক, আপনাদের কাছে আমার এই নিবেদন যে বরাকরওয়ালা কি করে জুতো সস্তায় বেচে সেটা বার করে দিন, তার জন্য আমি পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে রাজী। আপনারা রাজী হলে অগ্রিম দশ হাজার টাকা দিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়েই এসেছি।

দশ হাজার শুনে গোয়েন্দা দে এবং গোয়েন্দা দাঁ দুজনেই প্রায় আঁতকে উঠলেন। তবে বহুদিনের অভ্যেস—চট্ করে সামলেও নিলেন। গোয়েন্দা দাঁ বললেন, নগদ?

—নগদ। রণজিৎবাবু জানালেন।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আপনার কেসটা আমরা নিলাম, অর্থাৎ কিনা—গ্রহণ করলাম।

বড়া-শূ কারখানা হাওড়ার একটি অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায়। অপেক্ষাকৃত নির্জন, এখানে ওখানে নারকেল গাছ, পুকুর। তারই মাঝে কুটির, আবার বেশ প্রাসাদের মতো আধুনিক বাড়িও এরই মধ্যে চোখে পড়ে। এরই মধ্যে বড়া-শূ কোম্পানির কারখানা গজিয়ে উঠেছে। কোনও মতে সরু রাস্তা দিয়ে একটি লরি যেতে পারে। কারখানার মধ্যে একটা বড় পুকুর। কারখানা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। গেটে দারোয়ানের পাহারা। কিছু দূরে একটি ছোট বাড়ি। বাড়ির গেটে চমৎকার ঝুমকো লতা, দু-একটি তেঁদু গাছ। এ ছাড়া নানা ফুলের গাছ। এই গরমকালেও এক ব্যক্তি রোদ্দুরে একটা রবারের পাইপ নিয়ে গাছের গোড়ায় জল দিচ্ছেন। গোয়েন্দা দে এবং গোয়েন্দা দাঁ স্থির করলেন ওই ভদ্রলোকের সঙ্গেই প্রথমে কথাবার্তা বলা যাক। ভদ্রলোককে গোয়েন্দা দে এবং দাঁ প্রথমে প্রশ্ন করে জেনে নিলেন তিনি সরকারি কর্মচারী ছিলেন একদা, সম্প্রতি কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর করে এখানে বসবাস করছেন। নাম ভবভূতি ঘোষ। বড়া-শূ সম্পর্কে তাঁর যথেষ্ট অভিযোগ। আবাসিক এলাকায় কারখানা করতে অনুমতি দেওয়াতে তিনি সরকারের উপরও খাপ্পা। তাঁর অবশ্য আশা কারখানাটি উঠে যাবে—কেননা, প্রায় দুশো লোকের কারখানায় ক্রমাগত ছাঁটাই হতে হতে সেখানে এখন মাত্র চব্বিশ জন লোক কাজ করছে। উৎপাদন প্রায় নেই বললেই চলে। আগে দৈনিক দশ লরি জুতো তৈরি হত, এখন তা দাঁড়িয়েছে সপ্তাহে চার পাঁচ লরি। না, আধুনিক যন্ত্রপাতি তো নেই-ই, বরং কয়েকটা ইউনিটের মধ্যে একটা ইউনিট সম্প্রতি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ছ’টি ইউনিটের মধ্যে আরও কিছু ইউনিটের বিক্রির জন্যে নাকি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে।

ভবভূতিবাবু গোয়েন্দা দে এবং গোয়েন্দা দাঁ-এর পরিচয় পেয়ে তাঁর চমৎকারভাবে সাজানো বৈঠকখানায় বসিয়ে চা এবং বাড়িতে তৈরি কেক দিয়ে আপ্যায়ন করে খবরগুলো দিলেন। এ খবরের সবই সত্য, কেননা তাঁর ভাই-এর ছেলে সম্বুদ্ধ বছরখানেক আগে বড়ো-শূ-এ কাজ নিয়েছিল। মাস দেড়েক হল তার কাজ হঠাৎ নট হয়ে গেছে। হ্যাঁ, সম্বুদ্ধর সঙ্গে আমোদ রায়ের বন্ধুত্ব ছিল। সম্বুদ্ধর ধারণা বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়। এই নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ হয়েছিল। দু’দিন কারখানায় কোনও কাজ হয়নি। তবে বরাকরওয়ালা দরাজ হাতে ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। মাসে যে পেত সাড়ে পাঁচশো টাকা, তার আকস্মিক মৃত্যুতে তিনি পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা। ভবভূতিবাবুর ধারণা, পুলিশও হাতে কিছু পেয়েছে, কেননা এ নিয়ে কোনও রকম বিশেষ তদন্তই হয়নি।

ভবভূতিবাবু বললেন, বুঝলেন—এই ভারত নামক গণতন্ত্রে যা চলছে তা যদি প্রকাশ পেত তাহলে লজ্জায় লিঙ্কন এবং গান্ধী পরলোকেও বিষ খেতেন। বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হা হা করে হেসে, উঠলেন।

সম্বুদ্ধর সঙ্গে কথা বলা যাবে কিনা প্রশ্ন করলে ভবভূতিবাবু জানালেন সে এখানেই ছিল কিছুদিন পর্যন্ত, কিন্তু এখন চাকরি নেই বলে চলে গেছে জলপাইগুড়িতে। সেখানে তার মামা এক চা-বাগানে রয়েছেন। হয়তো কিছু সুবিধে হতে পারে সেখানে চাকরির।

তারপর হঠাৎ ভবভূতিবাবু বললেন, আচ্ছা মশাই বলতে পারেন, কবে আমাদের দেশের যুবকেরা মানুষের মত বাঁচতে পারবে?

এর উত্তর, বলা বাহুল্য, গোয়েন্দা দে এবং গোয়েন্দা দাঁ দিতে পারলেন না। তাঁরা ভবভূতিবাবুকে প্রভূত ধন্যবাদ দিয়ে সম্বুদ্ধর ঠিকানা নিয়ে প্রস্থান করলেন। গোয়েন্দা দে-র ইচ্ছে ছিল জুতোর কারখানা একটু দেখে যেতে, কিন্তু গোয়েন্দা দাঁ বললেন, ঝট্‌ করে কারখানায় ঢুকে কি আর জানা যাবে। বরং কারখানায় আমরা গেলে বরাকরওয়ালা সাবধান হয়ে যাবে। গোয়েন্দা দাঁ বললেন, জানেন, আমার ধারণা বরাকরওয়ালাই আমোদ রায়কে খুন করিয়েছে ; কিংবা হয়তো নিজেই করেছে। নইলে কেউ একজন কর্মচারীর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়?

গোয়েন্দা দে বললেন, ঠিকই তো। কথাটা ঠিকই বলেছেন তো—সেটা তো আমার খেয়াল হয়নি!

গোয়েন্দা দাঁ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, কোনও মালিক এরকম অদ্ভুত কাণ্ড করে না। যে কর্মচারীর মাস-মাইনে অত কম, তার মৃত্যুতে বরাকরওয়ালার অত টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার একটিই অর্থ দাঁড়ায়—আর তা হল আমোদ রায়ের এই আকস্মিক মৃত্যু আসলে হত্যাই। আমোদ একটু বোকামি করে ফেলেছিল নিশ্চয়। সে যে রণজিবুর চর সেটা হয়তো জানতে পেরেছিল বরাকরওয়ালা। যাই হোক, চলুন এবার একটু জলপাইগুড়ি ঘুরে আসি। দমদম থেকে এক ঘণ্টাও লাগবে না। আগামীকাল সকালের দিকে একটা ফ্লাইট আছে—টিকিটটা আজই কিনে রাখতে হবে।

বাগডোগড়া থেকে জলপাইগুড়ি। তারপর সম্বুদ্ধর সঙ্গে সাক্ষাৎকার। কিন্তু বিশেষ কিছুই জানা গেল না। সে কেবল বলল, কারখানার উৎপাদন কমছিল দারুণভাবে, সেই কারণে ব্যাপক হারে শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছিল। তা ছাড়া, বরাকরওয়ালার বড় ভাইয়ের হংকং-এ কাপড়চোপড়ের বড় ব্যবসা আছে, সেজন্য বরাকরওয়ালা সেখানে মাঝে মাঝে যেত। না, সম্বুদ্ধ এখনও কোনও কাজ পায়নি। সে ভাবছে চোরা কারবারীদের সঙ্গে মিলেমিশে বিদেশী ট্রাজিসটর, রেডিও, ঘড়ি ক্যালকুলেটর ইত্যাদির ব্যবসা করবে কিনা।

—এই ভাবেই দেশটা নেমে যাচ্ছে। আসবার সময় বিমানে গোয়েন্দা দে বললেন গোয়েন্দা দাঁকে।

—কী হতে পারত এই দেশ! আক্ষেপ করলেন গোয়েন্দা দাঁ।

গোয়েন্দা দে হঠাৎ গোয়েন্দা দাঁকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মশাই, আপনার সামনে যে চটি জুতো এসে পড়েছিল তিনতলা থেকে সেটা বাঁ পায়ের, না ডান পায়ের?

—কে জানে। ঠিক খেয়াল করিনি। কিন্তু তাতে কি এসে যায় বাঁ পায়ের না ডান পায়ের?

—না, কিছু এসে যায় না। বললেন গোয়েন্দা দে।

আর কিছুক্ষণ পর গোয়েন্দা দে প্রশ্ন করলেন চটিটা কি হাওয়াই ধরণের?

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, হ্যাঁ—ঠিক তাই। কিন্তু কেন আপনার মনে ওই প্রশ্ন আসছে?

গোয়েন্দা দে বললেন, যদি একটা বড় কারখানা—বড় আধুনিক কারখানা খোলা যায় তাহলে চটির দাম কমানো যায়। আবার যদি ট্যাক্স দিয়ে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে না হয় তাহলে দাম আরো কমানো যায়, কি বলেন?

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, এ তো শিশুরাও জানে।

গোয়েন্দা দে বললেন, হুঁ, শিশুরাও জানে। তবে সব শিশুই কি জানে?

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, মানে?

গোয়েন্দা দে বললেন, বুঝলেন মশাই, ব্যাপারটা প্রচুর রহস্যময়!

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, ব্যাপারটা যে রহস্যময় সেটা তো স্পষ্ট প্রথম থেকেই। রহস্যময় না হলে আমাদের ডাক পড়বে কেন?

গোয়েন্দা দে বললেন, মক্কেলের কাছে যা রহস্যময় তা আমাদের কাছেও রহস্যময় হবে এমন কোন কথা নেই, তবে এই ব্যাপারে আছে—গভীর রহস্য!

—তার মানে আপনি একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন?

—হ্যাঁ। বুঝতে পেরেছি এই রহস্য সমাধানে আমাদের বেশ বেগ পেতে হবে। আচ্ছা, আপনি লক্ষ্য করেছিলেন কি শিলিগুড়ির একটি বাজারের প্রায় সকলেই বিদেশী চোরাই মাল বিক্রি করে?

—হ্যাঁ তা করেছিলাম বৈকি। দু’ ঘণ্টা তো ওই অঞ্চলেই ঘুরলাম।

—এবং প্রকাশ্যেই সব লেন-দেন হয়?

—সেটাও লক্ষ্য করেছি।

গোয়েন্দা দে বললেন, ওই আমরা এসে পড়লাম প্রায় —কলকাতার আশেপাশে এসে গিয়েছি। এবার আমরা অবতরণ করব। আচ্ছা, সেই পি কে ঘোষের কথা মনে আছে? বোম্বাইয়ের একটা বিজ্ঞাপন ফার্মে কাজ করতেন? তাঁর ছেলে প্রকাশ ঘোষ কলকাতার কাস্টমসের একজন বড় অফিসার না ? তার ঠিকানা জানেন?

—না, তবে বোধ হয় খুঁজে বার করা যাবে ঠিকানা। কেন, ব্যাপার কি?

গোয়েন্দা দে বললেন, কাল বিকেলে তার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে পারলে ভাল হয়।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, ঠিক আছে—আমি টেলিফোন করে ঠিকানাটা জেনে নিতে পারব কাস্টমসের, কাছ থেকে। কাল তাহলে বিকেলে আপনার বাড়িতে প্রকাশকে আসতে বলি?

গোয়েন্দা দে বললেন, তাহলে তো খুব ভালই হয়। প্রকাশ যদি ব্যস্ত থাকে ওই সময়ে তাহলে সন্ধ্যের সময়েও আসতে পারে।

গোয়েন্দা দাঁ-কে গোয়েন্দা দে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলেন। গোয়েন্দা দাঁ মনে মনে বললেন, গোয়েন্দা দে কিছু একটা হদিশ পেয়েছেন, কিন্তু কী? কী হতে পারে?

কিছুতেই তিনি আন্দাজ করতে পারলেন না।

কিন্তু ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ, বেশ কিছুদিন পর তাঁর গোড়ালির ব্যথাটা আবার চাড়া দিয়ে উঠল তিনি বাড়িতে ঢুকেই প্রায় খোঁড়া হয়ে পড়লেন। টলতে টলতে গিয়ে একেবারে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।

ডাক্তারকে ডাকা হল। ডাক্তার বললে, বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন মশাই—এই বয়সে এত দৌড় ঝাঁপ কি ভাল? কমপ্লিট রেস্ট নিন—অন্তত পাঁচ দিন । হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাচ্ছেন? খান, তবে নিজ দায়িত্বে—বলাই বাহুল্য, হেঁ হেঁ। না না, ওতে কাজ হয় না তা বলছি না, তবে কিনা বিজ্ঞানের ধারে কাছেও যায় না এমন জিনিসে·······যাই হোক ব্যাপারটা আপনার নিজের শরীর, সেটা আপনি নিজেই বুঝবেন, হেঁ হেঁ।

পাঁচদিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে শুনে গোয়েন্দা দাঁ মুষড়ে পড়লেন। তিনি বললেন, একটু আধটুও হাঁটা-চলা নয়?

—একদম নয়। —ডাক্তার বললেন, তবে কিনা ঘরের মধ্যে একটু আধটু নিশ্চয়ই হাঁটবেন। দিনে আধঘণ্টা কি এক ঘণ্টা বসতে দাঁড়াতে পারেন। বাকি সময়টা শুয়েই থাকবেন। আর এই কটা ওষুধ খাবেন নিয়মিত।

গোয়েন্দা দাঁ দেখলেন একটা বড় পাতায় ছোট করে লেখা পাঁচ রকম ওষুধের হদিশ। দেখে তিনি চোখ বুজলেন।

কিছুক্ষণ পর তিনি টেলিফোন করলেন গোয়েন্দা দে-কে। গোয়েন্দা দে বললেন, কী সর্বনাশ! অসুখ আর সময় পেল না?

পরদিন সকালে ন’টা নাগাদ গোয়েন্দা দাঁ-র ঘুম ভাঙল। ঘরে রোদের আলো ঢুকে পড়েছে। লোড-শেডিংয়ের জন্যে পাখা ঘুরছে না, তবে চমৎকার হাওয়া—ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরে ঢুকছে। মনে হয় কাছেই কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে। কয়েকটা কাক নিজেদের নাম ঘোষণা করছে—কাক্ কাক্ কাক্ !!!

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, সেটা কে না জানে—তোমরা যে কাক সে তো যে কোনও স্কুল বালকেও বলে দিতে পারে!

এত দেরিতে তাঁর ঘুম কখনওই ভাঙে না। ডাক্তারি ওষুধে নিশ্চয় ঘুম পাড়ানিয়া কিছু ছিল। আমার ঘুমের তো অভাব হয় না, তাহলে ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দেয় কেন? এসব ভারি অন্যায়। —ভাবলেন গোয়েন্দা দাঁ।

গোয়েন্দা দাঁ-গৃহিণী এই সময় ঘরে প্রবেশ করলেন। তাঁকে দেখে গোয়েন্দা দাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ভাবছিলাম আমাকে এভাবে অসহায় অবস্থায় ফেলে তোমরা কোথাও বুঝি চলে গেছ!

গোয়েন্দা দাঁ-গৃহিণী বললেন, তোমার জন্য গাঁদাল পাতা দেওয়া মাগুর মাছ আর কাঁচকলার ঝোল তৈরি হয়ে গেছে। সঙ্গে সরু আতপ চালের ভাত।

গোয়েন্দা দাঁর মুখ থেকে তৎক্ষণাৎ হাসি অন্তর্ধান করল।

বিকেলবেলা তিনি খবরের কাগজে তৈরি একটা ঠোঙা থেকে মুড়ি প্লেটে ঢালতে গিয়ে (ডাক্তার বিকেলে মুড়ি আর নারকেল ব্যবস্থা করেছেন) ঠোঙায় ছাপা একটা বিজ্ঞাপনের উপর নজর পড়ল। ভারত সরকারের শুল্ক বিভাগ বিভিন্ন সাইজের বাজেয়াপ্ত প্রায় ১০ লক্ষ বাঁ পায়ের চটি ১০ জুন রবিবার নীলাম করছেন। যাঁদের এই ব্যাপারে আগ্রহ আছে তাঁরা যেন ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ফরম সংগ্রহ করেন এবং ১৫ মের মধ্যে উক্ত ফরম জমা দেন।

বাঁ পায়ের চটি। দশ লক্ষ !! গোয়েন্দা দাঁর কাছে ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত মনে হল। বাঁ পায়ের চটি শুল্ক বিভাগ বাজেয়াপ্ত করল—কে অতগুলি বিভিন্ন সাইজের চটি আনছিল? তিনতলার জানলা থেকে ছোঁড়বার জন্য কি আজকাল বিদেশ থেকে চটি আমদানি করা হচ্ছে? কে জানে রে বাবা! এ কাগজ তো বেশ পুরোন, কেননা ঠোঙা হয়েছে যখন। এখন মে মাস। সম্ভবত এক বছরের পুরোন কাগজ। কাগজ বেশ বিবর্ণ। আরও পুরোন হতে পারে। সঠিক তারিখ জানবার জন্যে তিনি অন্য কোনও সূত্র পান কিনা দেখতে চেষ্টা করলেন। দেখলেন এক জায়গায় লেখা—‘সম্মোহন করা শিখুন। আপনি যে কোন ব্যক্তিকে, নিকট বা দূরে তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, আমাদের মন্ত্রপূত মাদুলি ধারণ করিলে তিনি আপনার কৃতদাস/দাসী হইয়া থাকিবেন।’

কিন্তু তাতে তারিখ পাওয়া গেল না। গোয়েন্দা দাঁ ভাবতে লাগলেন, মাদুলি ধারণ করবে কে, যাঁকে সম্মোহন করা হবে তিনি, না কি যিনি সম্মোহন করবেন? নাঃ, দেশটা উচ্ছন্নে গেল। আর ওই একপাটি চটির গাদাই বা কারা পাঠাল, কাকে পাঠাল। ওই অব্যবহার্য জিনিস নীলামে কেউ কিনবেই বা কেন, তাও তাঁর মাথায় ঢুকল না। আবার গোয়েন্দা দে-ই বা কেন শুল্ক বিভাগের অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন? আজই তো সেই সাক্ষাৎ। আজ, মানে এখনই—কিন্তু প্রকাশ ঘোষের সঙ্গে তো কোন রকম কথাই হয়নি তাঁর। সমস্ত ব্যাপারটাই তাঁর ভুল হয়ে গেছে। ইস। কি হবে এখন?

তিনি তাড়াতাড়ি ফোন করবার চেষ্টা করলেন গোয়েন্দা দে-কে .কিন্তু টেলিফোন অচল। ডেড! অথাৎ টেলিফোনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি তাড়াতাড়ি উঠলেন। পাছে কেউ বাধা দেয় সেজন্য একটা হাওয়াই শার্ট গায়ে পরে, পকেটে কিছু টাকা নিয়ে তিনি সুরুৎ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। ল্যাচ-তালা বন্ধ হওয়ার স্বল্প আওয়াজ হল ক্লিক!

গোয়েন্দা দে-র বাড়িতে গিয়ে দেখেন তিনি বাড়িতেই নেই। দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়া সেরে বেরিয়েছেন। তিনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে গেলেন স্ট্যান্ড রোডের শুল্ক বিভাগে। সেখানে তাঁর পরিচিত এক ভদ্রলোেক জানালেন এক বুড়ো ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রকাশ ঘোষ বেরিয়ে গেছেন দুপুরবেলা। এখনও ফিরে আসেননি।

ক্লান্ত ভাবে তিনি বাড়িতে যখন ফিরলেন, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারদিকে আলো। বাড়িতে ফিরে দেখলেন তাঁর বৈঠকখানায় বসে রয়েছেন গোয়েন্দা দে!

—মশাই, আপনি একজন প্রথম শ্রেণীর ক্রিমিনাল।—বললেন গোয়েন্দা দে। কাউকে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন? শরীর ভাল তো? আপনাকে না ডাক্তার পাঁচদিন ধরে কেবল বিশ্রাম নিতে বলেছেন?

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আপনার খবর কি বলুন। প্রকাশের সঙ্গে কথাবার্তা কি হল?

গোয়েন্দা দে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, আমার সঙ্গে প্রকাশের কথাবার্তা হয়েছে কে বলল?

গোয়েন্দা দাঁ এ কথায় একটু রহস্যময় হাসি হাসলেন। বললেন, ও সব একটু আধটু জানতে হয়।

গোয়েন্দা দে বললেন, আরে মশাই, ওখানে গিয়ে দেখি গুদামঘরে এক পাটি জুতোর পাহাড়। বাঁ পায়ের পাঁচ লক্ষ হাওয়াই চটি। প্রায়ই নাকি চটি জাহাজে আসে আর··· ।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, নীলাম হয়। নীলামে নিশ্চয় হাজার খানেক কি দু’ হাজার টাকার বেশি দর ওঠে না?

গোয়েন্দা দে বললেন, না, অত সস্তা নয়। ওজন দরেও তো মাল অনেকটাই। তবে আমার আশ্চর্য লাগে কেবল বাঁ পায়ের জুতো কে পাঠায়, কে বা নেয়, আর তা দিয়ে কীই বা হয়?

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, ওটা বোধ হয় আমি জানি। মানে আন্দাজ করেছি!

আপনি জানেন? আমি অবশ্য ভেবেছিলাম বরাকরওয়ালার কারবার হল জুতো স্মাগল করা। জাপান বা হংকং কিংবা দুবাই থেকে হাওয়াই চটি যদি কেউ স্মাগল করে তাহলে সস্তায় তা বিক্রি করা সম্ভব হয়—কেননা, ওসব জায়গায় ট্যাক্স দিতে হয় অনেক কম, উৎপাদনও লক্ষ লক্ষ জোড়া হতে পারে—মাসে নয়—হয়তো দু’তিন দিনেই। বড় বড় আধুনিক স্বয়ংক্রিয় কারখানা থেকে জুতো তৈরি হয়। কিন্তু স্থল-পথে সে সব চটি চোরাই চালানে খরচ পোষাবে না। একটা ক্যামেরা, ফাউনটেন পেন, টেপ রেকর্ডার—দু’তিন কেজির মধ্যে এগুলির ওজন—দামও হাজার টাকার কম নয়। এসব জিনিস চোরাই চালান সম্ভব দুটো পাঁচটা করে, কিন্তু হাওয়াই চটির চোরাই চালান সেভাবে করা সম্ভব নয়। অথচ আমি ভেবে দেখলাম চটিরই চোরাই চালান চলছে এবং নিশ্চয় জাহাজে। এই কারণেই আমার মনে হয়েছিল শুল্ক বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করার। মিলেও গেল হদিশ কিছু। আড়াই বছরে ছ’বার হাওয়াই চটির চালান এসেছে কলকাতা বন্দরে— কিন্তু প্রতিটি চটিই বাঁ পায়ের। আরও মজার কথা এই যে যার নামে এই চটিগুলো আসে তাকে পাওয়া যায় না। তাই কয়েক সপ্তাহ গুদাম ঘরে রেখে দেওয়ার পর আইন অনুযায়ী নীলাম করে দেওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ পাটি চটি, কিন্তু নীলামে চোদ্দ হাজার পনেরো হাজারের বেশি দর ওঠে না।

গোয়েন্দা দাঁ প্রশ্ন করলেন—কে কেনে ওই ‘চটি?

এ গোয়েন্দা দে বললেন, বিভিন্ন ব্যক্তি। খাতাপত্রের দেখলাম একবার কিনেছে সুবীর চট্টরাজ, একবার কিনেছে অরিন্দম মেটো, একবার কিনেছে স্বতন্ত্র ঘোষ··· ।

—স্বতন্ত্র ঘোষ?—গোয়েন্দা দাঁ বললেন। নামটা কেমন যেন ফিশি!

—ফিশি! মানে সন্দেহজনক, তো? আমারও সন্দেহ হয়েছিল। যাই হোক, ছ’জন লোক নীলাম থেকে বাঁ পায়ের চটি কিনেছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল—কেন?

গোয়েন্দা দে তাঁর ব্যাগ থেকে একটা কাগজে মোড়া একটা হাওয়াই চটি বার করে দেখালেন। বললেন, দেখুন।

—স্মাগল করা মাল! চাই একটা?

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, কোথেকে পেলেন এটা?

—প্রকাশের কাছ থেকে একটা চেয়ে নিলাম।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আপনি আরও কিছু দেখাবেন বলে মনে হচ্ছে?

গোয়েন্দা দে বললেন, ঠিক ধরেছেন। এই দেখুন একজোড়া ‘বড়া-শূ, কোম্পানির হাওয়াই। সাড়ে আট টাকা জোড়া, কলেজ স্ট্রীটের একটা দোকান থেকে কিনে আনলাম।

—কিন্তু দুটোর কোয়ালিটি, কাট, সবই তো এক মনে হচ্ছে?

—হবেই তো!—গোয়েন্দা দাঁ বললেন, হবেই তো। একই কারখানায় তৈরি।

গোয়েন্দা দাঁ নিবিষ্ট মনে চটিগুলো পরীক্ষা করতে করতে বললেন,দু’জোড়া জুতো এক হলেও কলকাতায় কেনা জুতোর উপর রবারের একটা চিলতে আঁটা আছে তাতে লেখা বড়া-শূ, মেড ইন ইনডিয়া।’

দুজনে মিলে জুতো পরীক্ষা করার পর গোয়েন্দা দে বললেন, আপনার ফোন ঠিক আছে?

—না

—জ্বালাল। একবার লালবাজারের অঘোরকে জানানো দরকার ছিল।

—অঘোর। অঘোর কি করবে?

—অঘোর কাল ভোরে বরাকরওয়ালার বাড়ি এবং কারখানা তল্লাসী করবে। শুল্ক বিভাগের ব্যাপারে ওই তো এখন ভারপ্রাপ্ত। খুবই সৎ অফিসার বলে খুব বদনাম তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে। দু’একবার তাঁর প্রাণনাশেরও চেষ্টা হয়েছে —এবং লজ্জার কথা, পুলিশেরই কোনও কোনও অফিসার এসব কাজের জন্য দায়ী। এসব কথা আজ জানতে পারলাম প্রকাশের কাছ থেকে। যাক সে কথা—।

—কিন্তু বরাকরওয়ালার বাড়ি তল্লাসী করে পাওয়া যাবে কি? গত দেড় বছরে কেবল বাঁ পায়ের জুতো আমদানি করে সে কি করে ব্যবসা চালাচ্ছে সেটা তো বোঝা দরকার।

গোয়েন্দা দে বললেন, সেটা ভাল করে বুঝবে অঘোর এবং তার সম্প্রদায়! আমার কাজ ক্লু জোগাড় করা।

—কিন্তু আমার মাথায় এখনও সবটা ঢুকছে না।

গোয়েন্দা দে বললেন, ব্যাপারটা আপনার মাথায় ঢুকছে না, কিন্তু ব্যাপারটা খুবই সহজ। আপনার মাথায় না ঢুকবার কারণ আপনি ক্লান্ত, অসুস্থ। তবে আপনি অনেকটাই বুঝেছেন তাও বুঝতে পারছি—কিন্তু সবটা নয়। ওটা কি বার করছেন পকেট থেকে?

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, মুড়ির ঠোঙায় এই নীলামের বিজ্ঞাপনটা ছিল।

বিজ্ঞাপনটা নিয়ে গোয়েন্দা দাঁ অনেকক্ষণ ধরে সেটা দেখলেন। তারপর বললেন, বুঝলেন—এবারে আমাদের একবার যেতে হবে বোম্বাই, কিংবা মাদ্রাজ। কিংবা দুটি জায়গাতেই। সঙ্গে অবশ্য অঘোর থাকবে।

—এ সপ্তাহে নয়। বুঝছেনই তো ডাক্তারের মানা।—গোয়েন্দা দাঁ বললেন। কিন্তু মাদ্রাজ বোম্বাইতে গিয়ে কী হবে?

—কী হবে?—গোয়েন্দা দে বললেন, কেন, ডান পায়ের চটির সন্ধানে যেতে হবে না? আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি কলকাতা বন্দর মারফত বরাকরওয়ালা যেমন বাঁ পায়ের জুতো পাঠাত এবং সস্তায় বাজিমাত করত, তেমনি বোম্বাই বা মাদ্রাজে সে আমদানি করত ডান পায়ের চটি! তারপর কোন এক জায়গায় দু’পায়ের চটি সাইজ মিলিয়ে নেওয়া এবং চটির উপর ‘বড়া-শূ, মেড ইন ইনডিয়া’ সেঁটে দিলেই নিশ্চিন্ত!

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, তাই তো, এই সহজ কথাটা তো আমার মাথায় আসেনি! কী সাংঘাতিক!! আমরা কোথায় নেমেছি বলুন তো?

গোয়েন্দা দে বললেন, এর সঙ্গে আমার ধারণা কেন্দ্রীয় কোন হোমরা চোমরা ব্যক্তিও জড়িত। নইলে এত লক্ষ লক্ষ টাকার এমন চমৎকার ব্যবসা এমন চমৎকারভাবে এতদিন চলে কি করে? আমার কেবল ভয় করছে অঘোর শেষ পর্যন্ত এই সব রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে বৃহত্তর বিপদে না পড়ে।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, এখন তাহলে কি করা যায়?

গোয়েন্দা দে বললেন, কেন্দ্রে যদি অসৎ কেউ থাকে তাহলে সৎ কাউকে বার করতে হবে। যুদ্ধ যখন হবেই, তখন পুরোপুরি করাই ভাল। বুদ্ধি কেবল বরাকরওয়ালারই থাকবে আর সকলে ঘোড়ার ঘাস কাটবে, এমন কি কথা?

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, আপনার আশাবাদ আমাকেও মাঝে মাঝে উৎসাহী করে তোলে! আপনি কি মনে করেন বরাকরওয়ালার কৌশলের কাছে আপনি পাল্লা দিতে পারবেন?

গোয়েন্দা দে বললেন, চেষ্টা তো করতে হবে। এটা আমাদের পেশা। সেখান থেকে পিছিয়ে আসাও তো পরাজয় স্বীকার করার সামিল। যাই হোক—টেলিফোন নয়, আমি সোজা লালবাজার যাচ্ছি। হয়ত মন্ত্রী পর্যায়েও কথা বলতে হতে পারে। আমি চললাম।

গোয়েন্দা দাঁ তাঁকে আশীর্বাদের ভঙ্গি করে বিদায় দিলেন।

পরদিন দুপুরে গোয়েন্দা দাঁ যখন খেয়ে দেয়ে পাখার হাওয়া খাচ্ছেন এমন সময় গোয়েন্দা দে এলেন। তাঁর মুখ বিষনণ্ণ। গোয়েন্দা দে বললেন, প্ল্যান মতো সব হয়েছে তো?

—অনেকটাই হয়েছে। বরাকরওয়ালার বাড়ি এবং কারখানা তল্লাসী চালিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকার অবৈধ লেনদেনের কাগজপত্র উদ্ধার করেছে। চুয়াল্লিশ লক্ষ টাকা হিসাব-বহির্ভূত পেয়েছে নগদে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে জুতো আমদানির বিরাট চক্রও আবিষ্কার করা হয়েছে—এখনও তদন্ত চলছে। কাগজপত্র পরীক্ষা করতেই দিন দশেক লেগে যাবে। কিন্তু···

—কিন্তু কি?

—কিন্তু আসল পাখি বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে।

—অথাৎ, কাল রাত থেকেই বরাকরওয়ালা বেপাত্তা হয়ে গিয়েছে।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, বুঝলেন তো কলকাতার পুলিশেরই কেউ জানিয়ে দিয়েছে। সরকারের সাধ্য কি এরকম ঘুঘুকে জব্দ করে।

গোয়েন্দা দে বললেন, তবে ওঁর সম্পত্তি তো বেহাত হয়ে যাবে যদি তিনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দর্শন না দেন। বোধ হয় কয়েক কোটি টাকারই সম্পত্তি হবে, অনুমানে যা বোঝা যাচ্ছে।

গোয়েন্দা দাঁ বললেন, তাতে কি হয়েছে—স্বনামধন্য ব্যক্তিদের কাছে ওই টাকা পুনরুদ্ধার করা কি খুব কঠিন হবে? আইনের নানা ফাঁক আছে। তাছাড়া অপরাধও তো এক রকম নয়। জুতোয় না হলে ভেজাল ঘি, ভেজাল ঘি না হলে নোট জাল—কত রকম ক্ষেত্র রয়েছে। ওদের পক্ষে আবার কিছু করা, করে সফল হওয়া অসম্ভব হবে না।

—হবে না?

—না। আমি গ্যারানটি দিতে পারি।

গোয়েন্দা দে বললেন, তবু আমি নিরুৎসাহ হব না। নিরুৎসাহ হওয়ার অর্থই তো মৃত্যু।

—আপনি এখন কি করবেন তাহলে?

—প্রথমেই রণজিৎ পাণ্ডার কাছ থেকে কিছু টাকা আদায়। তারপর পুলিশের সঙ্গে পরামর্শ করে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ—আমার ধারণা বরাকরওয়ালা এদেশ থেকে কেটে পড়বার চেষ্টা করবে।

—তাহলে বিমানবন্দরগুলিকে সতর্ক করে দেওয়া ভাল, নয় কি?

গোয়েন্দা দে বললেন, বরাকরওয়ালা যে বিমানবন্দর দিয়েই সরে পড়বে এমন তো কোনও গ্যারানটি নেই। ভারতের সীমান্ত রয়েছে হাজার হাজার কিলোমিটার ব্যাপী—যে কোনও একটি ছোট্ট ফাঁক দিয়ে গলে গেলেই হল। যেমন ধর যশোহর সীমান্ত।

কিন্তু ওপারের পুলিশ, তারা ধরবে না?

গোয়েন্দা দে হাসলেন। বললেন, এপারের পুলিশ আর ওপারের পুলিশ কি আলাদা ভাবে গড়া নাকি? তাদের কাছে কি কারেন্সি নোট লোভনীয় নয়? কী যে বলেন মশাই এই বয়সে।

গোয়েন্দা দে ঘড়ি দেখলেন। বললেন, হ্যাঁ আজই—আরও হাজার দশ বারো টাকা বাগানোর চেষ্টা করতে হবে। ওঁর জুতোর কমপিটিশন আপাতত আর রইল না, সেটা তাঁর কাছে বড় কথা। তবে এখনও সময় আছে হাতে ঘণ্টা চারেক। এর মধ্যে দু’ এক বাজি দাবা হবে নাকি?

—দাবা?—একথায় গোয়েন্দা দাঁ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। কিন্তু তাঁর কেবলই মনে হতে লাগল, —সেদিন যে গলির মধ্যে তাঁর সামনে এসে পড়েছিল এক পাটি চটি, সেটা বাঁ পায়ের না ডান পায়ের—কিছুতেই মনে আনতে না পেরে তাঁর কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *