1 of 2

সার্জেন্ট মুখার্জি – হেমেন্দ্র মল্লিক

সার্জেন্ট মুখার্জি – হেমেন্দ্র মল্লিক

চার-পাঁচ ঘণ্টা গভীর চিন্তার পরে কমল সিং মনস্থির করল। বন্ধু ইয়াকুব আলিকে বিদায় দেওয়া ভিন্ন তার আর কোন পথ খোলা নেই জীবনে নিরাপদ বা নিশ্চিন্ত হবার! আগের অনেক অপরাধ তার ক্ষমা করা হয়েছে, কিন্তু এবারে ইয়াকুবকে একেবারে চুপ করাতে না পারলে আর কোন উপায় নেই তার নিজের প্রাণ বাঁচাবার।

ইয়াকুব আলিকে হত্যা করতেই হবে। না করলে সরকারি সাক্ষী হয়ে সে নিজেই কমল সিংয়ের প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা করবে এটা পরিষ্কারই বোঝা গেছে। না, আর কোন রাস্তা নেই—

অনিচ্ছা সত্ত্বেও কমল সিংকে একথা স্বীকার করতে হল।

গা-ঝাড়া দিয়ে সে আরাম কেদারা থেকে উঠে পড়ল ও দেশলাইয়ের গায়ে একটা সিগারেট ঠুকতে ঠুকতে জানলার কাছে গেল। রাস্তায় আলো জ্বলে উঠছে—আন্দাজ সাতটা হবে। আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই ইয়াকুব ফিরবে। তার ঘরের সামনের বারান্দা দিয়ে যাবে—একুশ নম্বর, অর্থাৎ তার নিজের ঘরে। তারপর, সমস্ত রাত্রির মত তৈরি হয়ে বার হওয়ার আগে সকলের অলক্ষ্যে সে একবার ঢুকবেই কমল সিংয়ের ঘরে। রোজই ঢোকে। এবং সকলের অলক্ষ্যেই। গত দেড় বৎসর একসঙ্গে কাজ করার একটা মস্ত চুক্তি ছিল দুজনের যে, কোথাও কারও সামনে কেউ কাউকে কখনো সম্ভাষণ করবে না। পরিচিতের সূত্র ধরে পুলিশ অনেক সময় অনেক কাজ হাসিল করে নেয়। দুজনে পরস্পরের সম্পূর্ণ অপরিচিত—এটা জানাজানি থাকলে একজন হাজার বিপদে পড়লেও অন্যের চক্ষে সেটা কিছুই ভাবনার কথা হবে না; এবং এ ব্যবস্থা কার্যকরী হয়েছে কয়েকবারই।

কমল সিং জানলা ছেড়ে ঘরের মধ্যে এল। চেয়ারখানা টেবলের একেবারে কাছে এনে রাখল সে। মানে, প্রাণহীন দেহখানা সশব্দে মাটিতে পড়ে যায়—এটা তার পছন্দ নয়। তাছাড়া, মেঝেয় রক্তের দাগ বা অন্য কোন চিহ্ন থাকাটাও মোটেই সুবিধার নয় তো।

পিস্তলের শব্দ?

না, সেদিকেও কমল সিংয়ের কোন দুর্ভাবনা নেই। নিজের ঘরে অথবা সঙ্গে কখনো সে কোন অস্ত্র রাখে না, বিশেষ দরকার না হলে। আজও নেই। ইয়াকুব আলির পিস্তল যে জামার বোতামের মতই তার চিরসাথী, একথা কমল সিং জানে এবং এও জানে যে সেটা বোবা, মানে তাতে শব্দ হয় না।

না, কমল সিংয়ের ইতস্তত করার কোনই কারণ নেই। আয়োজন এত সাদাসিধে যে তাতে যেমন কোন জটিলতা নেই, তেমনি কোন দিক থেকেই কোন সন্দেহেরও অবকাশ নেই! বড় বড় ওস্তাদরাও এই কথাই বলেন। সোজাসুজি কাজই ভালো—ঘোর-প্যাঁচ যত থাকবে, পুলিশ ততই সন্দেহের ছিদ্র পাবে।

পোড়া সিগারেটটা ফেলে দিয়ে কমল সিং আবার সেই চেয়ারখানার সামনে নিজের চেয়ারটা এনে বসে পড়ল। ইয়াকুব আলির জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া এখন তার অন্য কাজ নেই। স্টেজও তার জন্যে একেবারে প্রস্তুত রইল। ঘরে ঢুকে অন্য দিনের মত সামনের চেয়ারে সে বসবেই। ডান দিকের পকেট ও পকেটের মধ্যে তার পিস্তল সবই কমল সিংয়ের নাগালের মধ্যেই থাকবে⋯

কমল সিং উৎকর্ণ সজাগ হয়ে উঠল। আসছে⋯হ্যাঁ, এটা ইয়াকুব আলির পদশব্দই বটে⋯এই দিকেই আসছে⋯কমল সিং উত্তেজিত হয়ে উঠল।

না, সে সোজা নিজের ঘরের দিকেই গেল। তার মানে আরও কুড়ি-পঁচিশ মিনিট। হাতঘড়িতে কমল সিং দেখল—সওয়া আটটা⋯পরম নিশ্চিন্ত ভাবে সে আর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে একটু আরামের ভঙ্গিতে চেয়ারে দেহ এলিয়ে দিল⋯

কতক্ষণ এইভাবে সে বসেছিল ঠিক খেয়াল ছিল না। হঠাৎ⋯

ঘরে আছো ওস্তাদজী?

চমকিয়ে উঠে বসে কমল সিং দেখল ইয়াকুব আলি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছে⋯এ বিষয়ে জানাশোনার মধ্যে ইয়াকুব আলির জোড়া ছিল না।⋯

হাসতে হাসতে সে বললে, কি হে, আর কারও আসবার কথা আছে নাকি? অত চমকিয়ে উঠলে কেন?

কমল সিং মনে মনে অপ্রস্তুত বোধ করল। অতখানি চমকিয়ে উঠল কেন সে? ইয়াকুব আলিকে অতটা হাসতে দেওয়া তার পক্ষে একেবারেই উচিত হয়নি। গম্ভীর স্বরে সে বললে, হ্যাঁ, চমকিয়েছি বটে, তার কারণও আছে। এখুনি বুঝতে পারবে। সঙ্গে ঘোড়া আছে তো? আজ একটু পরেই হয়তো দরকার হবে সেটার।

ট্রাউজারের পাশ পকেটে চাপড় মেরে ইয়াকুব সোৎসাহে বললে, একটা হাত-পা ফেলে আসা যায়, কিন্তু ঘোড়া—সে যে আমার গার্ড, তাকে কোথায় রেখে আসব আবার? ঘাবড়াও মাৎ ওস্তাদজী⋯সব ঠিক হ্যায়⋯

সন্দিগ্ধ স্বরে কমল সিং বললে কীছু ঠিক নেই ইয়াকুব,দরজায় খিল দিতেই তো ভুলে গেলে⋯তোমার ভুলের জন্যেই দেখছি সর্বনাশ হবে শেষ পর্যন্ত⋯কই, দেখি তোমার ঘোড়া সব ঠিক হ্যায় কিনা⋯

কিন্তু ইয়াকুব আলিও পুরাতন বন্ধু। কুটিল হাসির রেখা মুখে টেনে এনে সে বলল, ঠিক আছে দোস, বডি গার্ড কি আর আমাকে ছেড়ে পরের হাতে যায় কখনো?

কমল সিংয়ের মুখাবয়ব হিংস্রভাব ধারণ করল। পিস্তলটা দেখতে দিল না কেন ইয়াকুব? তার সন্দেহ কি এর মধ্যেই জাগরিত হয়েছে? কেন তার এ সন্দেহ? নিশ্চয়ই গোপনে গোপনে সে বিরুদ্ধতা আরম্ভ করেছে, না হলে⋯এর মধ্যেই পুলিশকে কিছু বলেনি তো? তাহলে⋯আমার কাছে এ সময়ে আসবারই বা কারণ কি? কিছু চক্রান্ত নেই তো কথাবার্তায় তাকে আটকিয়ে রেখে পুলিশকে সময় দেওয়ার?

চিন্তিত ভঙ্গিতে সে বললে, তামাসা নয়, ইয়াকুব। অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠেছে। পণ্ডিতজীকে আসতে বলেছি। তাকে যদি একটু কায়দা করতে পার, তবে মাস কয়েকের জন্য দুজনেই আজ গা-ঢাকা দিতে পারি। ব্যাঙ্কের কেরানী খুন করলে খুব সহজে তার জের মিটে যাবে মনে করো না। দাঁড়াও, ফ্লাক্সটা নামাই আগে। এক ঢোক না খেলে বুদ্ধি খুলবে না⋯ইয়াকুব আলির গ্লাস বার বার ভর্তি করতে করতে কমল সিংহ মতলব স্থির করে ফেলল। একটু নেশা, একটু অসাবধান ও আলগা হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে শেষ করে ফেলতে হবে! ইয়াকুবকে জীবন্ত এ-ঘর থেকে ফিরে যেতে দেওয়া মানে নিজেই মৃত্যুদণ্ডকে আগিয়ে আনা! বিশ্বাসঘাতকতা করেই হোক বা যে কোন উপায়েই হোক, তার মত পুরাতন সঙ্গী যখন একবার পুলিশের দলে গিয়ে ভিড়েছে, তখন নিজের নিরাপত্তার জন্যে সে সবই করতে পারে।

ইয়াকুবের পাশেই দাঁড়িয়ে সে চতৰ্থবার ফ্লাস্ক থেকে তার গ্লাস ভর্তি করল। পাশ পকেটে তার পিস্তল—বোবা পিস্তল—সে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিল। কাছে, খুবই কাছে⋯কিন্তু তবুও কত দূরে⋯

এক চুমুক খেয়ে ইয়াকুব বললে, চমৎকার ফ্লাক্সটা তো! এটা আবার লুঠ করলে কোথায়—দেখিনি তো?

হ্যাঁ, ফ্লাক্সটা চমৎকারই বটে। জার্মান সিলভারের গায়ে কমল সিংয়ের নামের আদ্যক্ষর দুটি মোনোগ্রাম করা! উঁচু উঁচু গায়ে গায়ে জড়ানো দুটি অক্ষর। কমল সিং বললে, হ্যাঁ, ওটা বেশ জিনিস; উপহারের, গত জন্মদিনে কামলা বাঈ ওটা দিয়েছে আমায়।

ভীষণ চমকিয়ে ইয়াকুব বলে উঠল, কামলা বাঈ?

কক্ষমধ্যে বজ্রপাত হল যেন…

এক লাথি মেরে চেয়ারখানা সরিয়ে দিয়ে ইয়াকুব লাফ দিল। অসংযত ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আক্রোশের ফাঁকে ফাঁকে কেবল ওইটুকুই বার বার শোনা গেল।

কামলা বাঈ! বেইমান কোথাকার!

কিন্তু কমল সিং প্রস্তুত ছিল পূর্ব থেকেই। ইয়াকুব হাজার জোয়ান হলেও প্রস্তুতি ও আয়োজনটা তারই ছিল অধিক। চক্ষের নিমেষে ফ্লাক্সখানা তুলে নিয়ে ইয়াকুবের কপালে লক্ষ্য করে সজোরে বসিয়ে দিলে কয়েকবার। বেচারার ডান হাতখানা ট্রাউজারের পকেটের কাছাকাছি যেতে যেতেই যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। পরমুহূর্তে ইয়াকুবের সংজ্ঞাহীন ভারী দেহটা সশব্দে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

একলাফে নিকটবর্তী হয়ে পিস্তলটা নিজের হাতে নিয়ে কমল সিং তার অপ্রিয় কর্তব্য শেষ করে ফেললে⋯

কোন তাড়াহুড়া পছন্দ করে না কমল সিং। তাতেই ভুল হয় বেশি—একথা সে জানে। ইয়াকুবকে পরাস্ত করার উত্তেজনা দমন করে একটা সিগারেট ধরিয়ে সে চেয়ে দেখল তার প্রাণহীন বিশাল দেহটার দিকে।

তাহলে, বিশ্বাসঘাতক সে নয়? যত ক্রোধ ও প্রতিহিংসা তার ওই কামলা বাঈকে কেন্দ্র করে? তাকে ছিনিয়ে নেবার জন্যেই ইয়াকুব ইদানীং এত চুপচাপ ও সন্দেহপরায়ণ হয়ে উঠেছিল?

কামলা বাঈ?

নিশ্চয়ই তার কাছ থেকে বিশেষ আশা ও উৎসাহ সে পেয়ে থাকবে⋯নাহলে দু’ বছরের সঙ্গী⋯কামলা বাঈ⋯

হঠাৎ উঠে পড়ে কমল সিং কামরার দরজা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখল⋯হ্যাঁ—চতুর্দিক মনের মতই বটে⋯আর দেরি করা কোন মতেই উচিত নয়⋯একুশ নম্বরের কামরা কতটাই বা!

গা থেকে জামা খুলে ফেলল কমল সিং। কাপড়ে রক্তের ছাপ লাগাতে তার কোন ইচ্ছে নেই। তারপর আর একবার বারান্দায় গিয়ে সবটা ভাল করে তদারক করে এসে অবলীলাক্রমে ইয়াকুবকে কাঁধে তুলে ফেলল⋯একুশ নম্বরের কামরার মধ্যে তাকে মেঝের ওপরে শুইয়ে দিয়ে এবং পিস্তলটা তার হাতের কাছে রেখে কমল সিং দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল।

ঘণ্টা খানেক পর⋯

নিচের হোটেল থেকে খাওয়া-দাওয়া সেরে কমল সিং খবরের কাগজখানা নিয়ে বিছানায় শুয়ে সিগারেট টানছে।

আজকের রাতটার জন্য কোথাও সরে পড়ার কথাটা তার মনে হয়েছিল একবার। মানে, ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত থাকার যুক্তি হিসাবে⋯কিন্তু একটু চিন্তা করে সে এ-যুক্তিটাকে গ্রহণ করলে না। যে লোক প্রত্যহ রাত্রে নিজের ঘরে থাকে, ঠিক ঘটনার রাত্রিতেই সে বাইরে কাটায় কেন? যে কোন লোকেরই এ-প্রশ্ন মনে উদিত হতে পারে।

রাত সাড়ে দশটা⋯

আর আধ ঘণ্টা পরেই সাবধানী ভদ্রলোকের মত আলো নিভিয়ে সে দরজায় খিল এঁটে দেবে রাত্রের মত।

কিছুক্ষণ আগে বারান্দায় একটা চিৎকার শোনা গিয়েছিল এবং হোটেলের ম্যানেজার ও অন্যান্য কর্মচারীদের ব্যস্ততা ও ছুটোছুটিও পড়ে গিয়েছিল। অতএব, পুলিশেরও সময় হয়েছে এসে পড়বার⋯

প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ এইবারই আরম্ভ হবে—এটা কমল সিং আর একবার তার মনকে শুনিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে আবার সমস্ত ঘরখানা তন্নতন্ন করে দেখল—ঘটনার এতটুকু নিদর্শন কোথাও কিছু আছে কিনা।

মদ খাওয়া গ্লাস সে ধুয়ে তুলে রেখেছে। চেয়ারগুলো টেবিলের ধারে ধারে যথারীতি সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিজের শরীরের বা জামা-কাপড়ে কোথাও কোন রক্তবিন্দু বা মারামারির অন্য কোন চিহ্ন সে তীক্ষ্ণভাবে খুঁজে দেখেছে⋯না, সেদিক দিয়ে কমল সিংয়ের কোন প্রকার চিন্তার কারণই নেই⋯তার ব্যবস্থা একেবারে নিখুঁত⋯

আরও দশ পনের মিনিট পরে⋯

দরজায় মৃদু করাঘাতের শব্দ শুনে কমল সিং বিছানায় উঠে বসল।

আবার⋯ঠক ঠক ঠক⋯

কমল সিং বলে উঠল, কে, ভেতরে এস।

সুদর্শন যুবক সার্জেন্ট ঘরে ঢুকে সহাস্যে বললেন, গুড ইভনিং কমল সিং, শুয়ে পড়েছেন নাকি?

টেবিলের ধারে চেয়ারখানা আগিয়ে দিয়ে কমল সিং বললে, ঠিক শুয়ে পড়িনি। তবে আয়োজন করছিলাম, কি ব্যাপার মিস্টার মুখার্জি?

ভ্রূ তুলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে সার্জেন্ট মুখার্জি বললেন, কেন, তুমি শোননি কি ব্যাপার? একুশ নম্বর ঘর তো বেশি দূরে নয় কমল সিং?

সন্দেহের ভঙ্গিতে কমল সিং বললে, একুশ নম্বর ঘর? সেটা তো যদ্দূর জানি এই লাইনেই। কেন? কি হয়েছে সেখানে? কিছুক্ষণ আগে একটা গোলমাল হচ্ছিল বটে, কিন্তু শরীরটা ভাল নয় বলে সমস্ত সন্ধ্যেটা আজ শুয়ে বসেই কাটাচ্ছি—উঠতে আর ইচ্ছে হয়নি। সংবাদ কি একুশ নম্বরের, মিস্টার মুখার্জি?

সার্জেন্ট মুখার্জি সাগ্রহে ঘরের চারদিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন, হঠাৎ কমল সিংয়ের দিকে চেয়ে বলে ফেললেন, একুশ নম্বরে খুন হয়েছে একজন। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তল দিয়ে। মুশকিল হয়েছে ওইখানে। একটা শব্দ নেই কিছু নেই। কোন চিহ্নই নেই তদন্ত আরম্ভ করবার।

কমল সিং মনে মনে আশ্বস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু ঘরের চারদিকে অত দেখছে কি সার্জেন্ট মুখার্জি? হুইস্কির গন্ধ পেয়েছে নাকি? কিন্তু তাতেই বা কি প্রমাণ হবে? কলকাতায় হুইস্কিখোর লোকের অভাব কি?

তবু ক্ষণকাল পরে সে একটু হেসে বললে, বড়ই মুশকিলে পড়েছেন মনে হচ্ছে, না? দাঁড়ান, একটু টনিক দিই আপনাকে⋯ব্যাপারটা একটু সোজা হয়ে যাবে তাহলে⋯

উঠে টেবিলের কাছে এসে কমল সিং ফ্লাস্কটা তুলে ধরল।

না, না, কাজের সময় এসব কক্ষণো খাইনে আমি। বাঃ, চমৎকার ফ্লাস্ক তো দেখছি এটা⋯একটু সাহায্য করবে আমায় কমল সিং? মানে, তোমার পরামর্শটা একটু কাজেরই হবে বলে আমার ধারণা⋯হেঁজিপেঁজি রাস্তার লোক তো আর নও তুমি?

সহাস্যে কমল সিং বললে, সাহায্য? কি সাহায্য?

চেয়ার থেকে উঠে পড়ে সার্জেন্ট মুখার্জি বললেন, একুশ নম্বরে এস একবার আমার সঙ্গে। আমার একলার মাথায় ঠিক খেলছে না ব্যাপারটা ভাল করে⋯

পরম আশ্বস্ত কমল সিং প্রফুল্ল স্বরে বললে, চলুন।

একুশ নম্বরের ভেতরে ও বাইরে চার-পাঁচজন কনস্টেবল পাহারায় ছিল। ঘরের মধ্যে আসতেই একজন সেলাম ঠুকে বললে, টেলিফোনে খবর আছে সাহেব⋯আপনি এলেই ফোন ধরতে বলেছে লালবাজার⋯

কমল সিংয়ের দিকে চেয়ে সার্জেন্ট মুখার্জি বললেন, টেলিফোনটা ধরে নিই কমল সিং, ততক্ষণ দেহটা একবার পরীক্ষা করে দেখ তুমি। তোমার পরামর্শ চাই আমি।

পরমুহূর্তেই কমল সিং সে রাত্রে প্রথমবার বিপদের গন্ধ অনুভব করল। টেলিফোনের কথাবার্তা কিছুই সে শুনতে পায়নি, কেবল একটি কথা ছাড়া⋯

⋯কামলা বাঈ বলেছে⋯

কমল সিংয়ের উত্তেজনা প্রবল হয়ে উঠল। কামলা বাঈয়ের সন্ধান এরা পেল কি করে? ইয়াকুবের হত্যার সঙ্গে তার যোগাযোগ এরা জানল কোথায়? কি বলেছে সে?

মুখার্জি রিসিভার রেখে কমল সিংয়ের কাছে এলেন। কমল সিংয়ের সমস্ত শরীরটা যেন আচমকা একবার বাঁশ পাতার মতই কেঁপে উঠল।

পিস্তল নয়, পিস্তল নয় কমল সিং, কপালের থেঁতলানোটা একবার দেখেছ? সাবাড় হল কিসে বলতে পার? আরে, তোমার আবার হল কি, যাচ্ছ কোথায় কমল সিং?—চৌবে পরিয়ে দাও এবার, আর দেরি করে লাভ নেই।

হাতকড়া লাগানো কমল সিংয়ের দিকে চেয়ে সহাস্যে সার্জেন্ট মুখার্জি বললেন, অনেক খুন দেখেছি, কিন্তু খুনের সঙ্গে এমন নাম সই করতে কাউকে দেখিনি আমি কমল সিং—বুঝতে পারলে না এখনো? তোমার ফ্লাস্কের মনোগ্রামটার কেমন পরিষ্কার ছাপ উঠেছে দেখেছ ইয়াকুবের কপালে? আরও শুনতে চাও? আচ্ছা, শুনেই নাও তবে। তোমরা দুজনেই আজ হুইস্কি খেয়েছ, দুটো ঘরেই গন্ধ ভুরভুর করছে। বারান্দায় ঠিক তিন ফোঁটা রক্ত পড়েছে, শেষেরটা তোমার দরজার চৌকাঠে—তাই দেখেই তোমার ঘরে আমি ঢুকি প্রথম, তারপর—হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া একটা করবেই আজ, কামলা বাঈয়ের কাছে এ প্রতিজ্ঞা করে ইয়াকুব এসেছিল⋯হ্যাঁ-হ্যাঁ, বোঝাপড়াই হল এক রকম⋯যাও, নিয়ে যাও চৌবে—নিচে ভ্যান এসে গেছে⋯তুমিও যাও সঙ্গে মিশিরজী⋯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *