1 of 2

একটি খুন – বিধায়ক ভট্টাচার্য

একটি খুন – বিধায়ক ভট্টাচার্য

পাড়ার সবাই বলাবলি করতে লাগল জগজ্জ্যোতি জোয়ারদারের ভীমরতি হয়েছে। নইলে এই বুড়ো বয়সে সে আবার বিয়ে করতে গেল কেন? আর—সেই বিয়েই যদি করল, তবে প্রথমা-স্ত্রী মারা যাবার ত্রিশ বছরের মধ্যে করল না কেন?

কিন্তু এ ‘কেন’-র জবাব দেবে যে, সে নিজেই তো বিয়ের ঠিক একবছর পরে দেহত্যাগ করল। অতএব কারো কাছেই কোন জবাবদিহির দায় রইল না। কিন্তু প্রশ্ন এই যে, জগজ্জ্যোতি জোয়ারদারের মত একটি পাকাপোক্ত মানুষ একাজ করলেন কেন? কারণ একটা অবশ্যই ছিল। সেই কারণটাই আগে বলা যাক।

জগজ্জ্যোতির দুই মেয়ে। প্রথমা সুরবালা, দ্বিতীয়া পুরবালা। জগজ্জ্যোতি জাতে কিছু কৃপণ ছিলেন, এবং ভোরে উঠে শহরের বহুলোক তাঁর নাম করত না। কৃপণতা সম্বন্ধে তাঁর অখ্যাতি ছিল বহুবিস্তৃত। বেলা এগারোটায় যখন দুনিয়ার লোকের বাজার করা শেষ, এবং শেষবাজারের টুকিটাকি এখানে ওখানে ছিটিয়ে ছড়িয়ে আছে, ঠিক সেই সময় জগৎ আসতেন বাজারে, একটি ময়লা গামছা হাতে নিয়ে। বাঁধাকপির দর করতেন না, বাজারেই যা পড়ে থাকত সেইগুলি সযত্নে কুড়িয়ে নিতেন তিনি। বেলা বেড়ে গেল বলে যেসব চাষী গাঁয়ে ফেরার জন্যে অধীর হয়ে আছে, তাদের কাছে বেছে বেছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দশ পয়সা সেরের জিনিস চার পয়সায় কিনতেন। চাষীরা খুব রেগে গিয়ে বিক্রি করে দিত, এমনকি অনেক সময় উনি আসবেন জেনেই পোকা-কাটা বেগুন ইত্যাদি রেখে দিত তারা।

সেই জগজ্জ্যোতি জোয়ারদার তাঁর প্রথম মেয়ে সুরবালার বিয়ে বেশ ধূমধাম করেই দিলেন। তারপর এক বছরের মধ্যে ছোট মেয়ে পুরবালার বিয়েও অনুরূপ সমারোহ করেই দিলেন। দুটি জামাই তিনি দেখেছিলেন—একেবারে অনাথ দেখে। দুজন জামাই-ই শ্বশুর বাড়িতে থাকত। কিন্তু ভাগ্যের খেলা একদম বিপরীত। বিয়ের ঠিক দু’বছর ও এক বছরের মাথায় দুটি মেয়েই বিধবা হল। লোকজন আবার বলল, অসুবিধে কিছু নেই। বুড়োর মৃত্যুর পর ওই মেয়ে দুটিই তো ওই বিরাট সম্পত্তি পাবে। সেকথা একশোবার ঠিক। কারণ এই দুটি মেয়ে ছাড়া জগজ্জ্যোতির ত্রিসংসারে কেউ নেই।

কিন্তু—

একটা ‘কিন্তু’র ভূত এসে চাপল জগজ্জ্যোতির মাথায়। বেশ ছিলেন তিনি। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন অনেক বেশি বয়সে। দুটি মেয়ে নিয়ে ভারি শান্তির সংসার ছিল তাঁর। ঠিক সময়ে চা পেতেন, খাবার পেতেন, চান করতে যাবার তাগাদা পেতেন। এক কথায় কোন গোলমাল ছিল না এই পরিবারে। কিন্তু জগতের মত মানুষ গোলমাল ছাড়া বাঁচবেন কী করে? ফলে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই গোলমালের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, এবং দিন পনেরো যেতে না যেতেই সেই গোলমালটুকু তিনি নিমন্ত্রণ করে ডেকে আনলেন বাড়িতে। অর্থাৎ বিয়ে করলেন। সেও বড় মজার ঘটনা। নববধূ যখন স্বামীর পেছনে পেছনে বাড়িতে এল—সুরো আর পুরো চেয়ে দেখল যে তাদের নতুন মায়ের বয়স চল্লিশের ওপরে।

তিথি নক্ষত্র জানা নেই, তবে দিনটা ছিল রবিবার। বেলা এগারোটায় বাজার করতে গেছেন। কিছু কুড়িয়ে, কিছু কিনে, কিছু ঘাড়ভাঙা বাগ্‌দা নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে তিনি অত্যন্ত ক্লান্তি অনুভব করলেন। পথের ধারে একটা ঢাকা বারান্দায় বসে তিনি খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছেন, এমন সময় পথের ওপাশে একতলার নিচের জানলা খুলে গেল। দেখা গেল একটি প্রৌঢ়ার মুখ। তিনি কিছুক্ষণ জগৎ-এর দিকে চেয়ে থেকে, হঠাৎ হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। ধড়াস্‌ করে উঠল জগজ্জ্যোতির বুকের মধ্যে। তিনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন সেদিকে। আবার প্রৌঢ়া হাত তুলে ডাকলেন তাঁকে। এইবার জগজ্জ্যোতির মুখ দিয়ে আর্তনাদের মত বেরিয়ে এল—‘আমাকে?’

প্রৌঢ়া নিঃশব্দ ভাষায় ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললেন।

জীবনে এমন বিপদে জগজ্জ্যোতি কখনো পড়েননি। এত বয়স হয়েছে তাঁর, এর মধ্যে কোনদিন ভগবানকে ডাকেননি তিনি, কিন্তু আজ ডাকলেন। ‘হরিবোল, হরিবোল’ বলতে বলতে সামনের বাড়ির মধ্যে গিয়ে ঢুকলেন তিনি। ভিজে স্যাঁতসেঁতে উঠোনের পাশ দিয়ে—চৌবাচ্চার গা ঘেঁষে, আছাড়-খাওয়া বাঁচিয়ে ঘরের মধ্যে গেলেন। ভদ্রমহিলা একটা টুল এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বসো!’

ফ্যাঁসফেঁসে কণ্ঠস্বর। অন্ধকার ঘরে শুনলে ভয় পাবে মানুষ।

‘কী?’—টুলে বসতে বসতে ইশারায় প্রশ্ন করলেন জগৎ। অনুভব করলেন ঘাম হচ্ছে কপালে আর বুকে।

‘কেমন আছ?’—ভদ্রমহিলা হেসে জিজ্ঞাসা করলেন। সামনের দুটি দাঁত ভাঙা।

‘ভাল।’ ফিসফিস করে উত্তর দিলেন জগৎ জোয়ারদার, ‘কিন্তু আমি তো ঠিক বুঝতে পারছিনে,—আমাকে কেন,—আমাকে কীভাবে—আমাকে কী জন্যে⋯’

বাক্য শেষ হল না। বসে রইলেন জগৎ।

‘আ-আমার পোড়াকপাল! তুমি কি এখনো আমাকে চিনতে পারোনি?’

‘ন্-না তো!’

‘আমি সুকুমারী। তোমার আদরের সুকো।’

শব্দটির সুকো-হাজা কিছুই উপলব্ধি হল না জগতের। তিনি তাঁর কোটরগত চক্ষু দুটি মেলে মরা মানুষের মত চেয়ে রইলেন।

‘চেহারা এত খারাপ হয়ে গেল কী করে?’

আবার কেঁপে উঠল জগতের বুকের মধ্যে। মনে হল, তাঁর একটা চেহারা আছে, যেটা জৈব নিয়মে ভাল বা খারাপ হতে পারে। কণ্ঠস্বরের এত আত্মীয়তা সত্ত্বেও তিনি টললেন না। নির্মম সুদখোরের মত আবার ফিসফিস করে চললেন, ‘কে সুকু—মানে সুকো, আমি চিনতে পারছিনে তো! আপনি বোধ হয় কোনরকম ভুল করে থাকবেন—’

এইবার সুকুমারীর গলায় কান্না ছলছল করে উঠল। বললেন, ‘ঠিক এই ভয়ই করছিলাম। জানি, জগতে কিছু থাকে না। তাই বলে জগতের মনও থাকবে না—এটা ভাবিনি। আজ তুমি বললে, কে সুকু—সুকোকে চিনি না?’

বেশ কিছুক্ষণ ধরে তিনি কাঁদলেন। তারপর আঁচলের প্রান্ত তুলে নাকটা ঝাড়লেন। হঠাৎ কাশির বেগ আসাতে—কেশে, জানলা দিয়ে থুথু ফেলে, সামনে বসে চেয়ে রইলেন জগতের দিকে। জগতের থলের মধ্যে ঘাড়ভাঙা চিংড়িগুলোর কথা মনে হল—এরপর বাড়ি গেলে ওগুলোকে কড়া পেঁয়াজের রসে মেশালেও, বোধ করি উদরগ্রাহ্য হবে না।

‘কী? মনে পড়লো, কী?’

‘না।’—কান্নার মত শোনাল জগতের গলা এবার। একটু থেমে আস্তে আস্তে বলল, ‘আশ্চর্য! কিছুতেই কেন মনে করতে পারছি নে। আপনাকে⋯·’

‘আপনাকে না, তোমাকে। আমি সুকুমারী। একটু মনে করে দেখ তো। মৃত্যুঞ্জয় সরকারের বাড়ি ছিল, তোমার বাড়ির পাশে কিনা। আমাদের বাড়ির মধ্যে একটা বাতাবী নেবুর গাছ ছিল। নষ্টচন্দ্রের দিন—’

‘সুকো!’

চিৎকার করে উঠলেন জগজ্জ্যোতি। চিৎকারটা বেশ জোরেই হয়ে গিয়েছিল। আচমকা স্মৃতির পুনরভ্যুদয়ের ধাক্কায়। এবার ব্রীড়াবনতা হলেন সুকুমারী। এবং সেই চল্লিশোর্ধা প্রৌঢ়া কুৎসিত সুকুমারীর আনত মুখখানির দিকে চেয়ে সমস্ত কথা মনে পড়ে গেল জগজ্জ্যোতির। বাল্যকালের মধুর স্মৃতি। বাতাবী নেবু চুরি করতে গাছে ওঠা। নষ্টচন্দ্রের রাত। বন্ধুরা সব পালিয়ে গেল। সুকুমারীর বাবা লাঠি আর লণ্ঠন হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। এই সুকুমারী, ছোট্ট সুকো, তাকে বাঁচায়—গোয়াল ঘরে লুকিয়ে রেখে।

হ্যাঁ। প্রেম সেইদিনই এসেছিল। তারপরে দুজনেই যৌবনে উপনীত হয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা-শোনাও করেছে। বিয়েও করবে স্থির করেছিল—দুজনে পালিয়ে গিয়ে। পালাবার দুদিন আগে একদিন রাত্রে হঠাৎ সুকোর মা মারা গেলেন, এবং তার কে এক খুলনার মামা—পরদিন সুকুমারীকে নিয়ে খুলনা চলে গেল। যাবার আগে দেখা হল না। শুধু যাত্রার দিন ভোরবেলায় ঝগড়ু ঝাড়ুদারের ছোট্ট মেয়েটা তার হাতে একটা চিরকুট এনে দিল। তাতে লেখা ছিল : জগৎদা, মামা আমাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তুমি আমার জন্যে অপেক্ষা করো। আমি যেদিনই ফিরি-না-কেন, জানবে আমি অবিবাহিতই আছি। তোমার প্রতিজ্ঞাটুকুও এর হাতে লিখে দিও। জগৎও সেই মেয়েটার হাতেই জবাব দিয়েছিল : প্রাণের সুকু, হ্যাঁ। যখনই ফেরো না কেন, জানবে আমিও অবিবাহিত আছি।

ধড়াস করে উঠল জগতের বুকের মধ্যে। চেয়ে দেখল সুকুমারী ওর দিকে চেয়ে আছে। চোখে সেই প্রশ্ন—প্রতিজ্ঞা মত এখনো অবিবাহিতই আছ তো? পেটের মধ্যে, বুকের মধ্যে, আর মাথার মধ্যে কী যেন একটা ঘুরপাক খাচ্ছে জগতের। মাথাভাঙা চিংড়ি হাতে ধরাই রইল। ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললেন পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ জগজ্জ্যোতি। কথা বললেন সাতটা সুরে মিশিয়ে। হাউ হাউ করে যা বললেন, তার মর্মার্থ এই যে : আমি কথা রাখতে পারিনি। বাবা ধরে বেঁধে,—তবে এখন আর নেই। এখন আবার অবিবাহিতা। তুমি?

‘আজো কুমারী।’

স্থির অকম্পিত কণ্ঠে জবাব দিল সুকুমারী, জগতের চোখে চোখ রেখে।

সমারোহ কিছু হল না, কিন্তু বিয়ে হল। পাড়ার লোক প্রথমটা হতবাক হয়ে গিয়েছিল ; পরে সামলে নিয়ে বলল, বিলেতে এ-রকম হয়। এখানেও শুরু হল।

সুরো আর পুরো নতুন মাকে প্রণাম করতে যখন ওঁদের শোবার ঘরে গেল, তখন নববধূ সুকুমারী বললেন, ‘এরা কে?’

‘তোমার দুই মেয়ে। সুরো আর পুরো।’

‘এখনো পার করতে পারোনি?’

‘করেছিলাম।’ জগৎ সহজ হবার চেষ্টা করলেন, ‘করেছিলাম পার। কিন্তু কিছুদিন পরে জামাই দুটি ওপারে চলে গেল, আর মেয়ে দুটো এপারে রয়ে গেল।’

সুকুমারী ঠাট্টা বুঝতেন না একদম। স্বামীর দিকে চেয়ে জোরে বললেন, ‘ভা—লো!’ পরে কন্যাদ্বয়ের দিকে চাইলেন। পাথরের মত শক্ত মুখ। বললেন, ‘এ সব গায়ে-পড়া আত্মীয়তা আমি পছন্দ করি না। দরকার হলে আমিই ডেকে কথা বলব, তোমাদের কুটুম্বিতে করবার দরকার হবে না।’

পুরোবালা একটু রাশভারি মেয়ে। সোজা সুকুমারীর চোখের দিকে চেয়ে বলল, ‘কিছুই দরকার হত না, যদি আপনি এই জীবনের বিকেল বেলায় যেচে বাবার সঙ্গে কুটুম্বিতে না করতেন।⋯·আয় দিদি!’

সুকুমারী চুপ করে মেয়ে দুটির যাবার পথের দিকে চেয়ে রইলেন। অতএব মা আর মেয়েদের মিলন হল না। কিন্তু জগতের একপক্ষে আশ্বাসের কথা এই হল যে, কোনদিন তিনি স্ত্রীর মুখে মেয়েদের সম্বন্ধে কোন অভিযোগ শুনলেন না। অভিযোগ দূরের কথা, সুকুমারী পারতপক্ষে সুরো-পুরোর উল্লেখ অবধি করতেন না।

পয়সা অনেক করেছিলেন জগজ্জ্যোতি। মার্চেন্ট অফিসে চাকরি করে রিটায়ার করবার সময় তিনি একটা মোটা টাকা পান। টালায় পৈতৃক বাড়িটা বিক্রি করেও প্রচুর টাকা পান, তার থেকে সামান্য কিছু খরচ করে বর্তমান বাড়িটা কেনেন। সুদি কারবারটা ছিল গোড়া থেকেই, সেইটেই পরে ফুলে ফেঁপে ওঠে। জগতের ক্যাশ টাকা নিয়ে নানা রকম জনশ্রুতি আছে। কেউ বলে দু’লাখ, কেউ বলে দশ লাখ! তবে দশ লাখ না হলেও ক্যাশ টাকা কোম্পানির কাগজ ইত্যাদি যা আছে—তা যথেষ্ট।

বিয়ের পরে দেখা গেল, জগজ্জ্যোতি বাল্য বান্ধবীর প্রতিশ্রুতি রাখতে গিয়ে যে সব স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার একটাও মিলছে না। চল্লিশের ওপর বয়স বেশি হওয়াতে সুকুমারীর মনটা কাঠ হয়ে গিয়েছিল। ফলে জগতের মনের মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টাই একটা অশান্তি থেকে গেল। সর্বদাই কেমন যেন অন্যমনস্ক থাকতেন জগৎ ।একদিন কোথায় যেতে গিয়ে ট্রাম থেকে পড়ে গেলেন তিনি। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এলেন দিন দশেক পরে, এবং নিজের অ্যাটর্নি এবং বন্ধু বিশ্বমোহন বিশ্বাসকে একটা উইল করতে বললেন। কি কি শর্ত থাকবে—সব বিশ্বমোহনকে বলে দিলেন তিনি। তাঁর আর এক বন্ধু ছিলেন ডাঃ ধীরেন তালুকদার। ধীরেন তালুকদার মারা যাবার পর তাঁর ছেলে মনোতোষ তালুকদার এখন জগতের ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান। মনোতোষের বয়স বছর বত্রিশ। মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে এখন কলকাতাতেই প্র্যাকটিস করে। গোপন বাসনা আছে—বিলেত থেকে উপাধি নিয়ে আসার। সে অ্যাক্‌সিডেন্টের পর থেকে নিয়মিত রূপে জগতকে দেখছিল, এবং জগৎ বাড়ি আসার পরে একদিন সুকুমারীকে বলেছিল, ‘কাকাবাবুর হার্টটা খুব উইক, যে কোনদিন যে কোন মুহূর্তে বিপদ আসতে পারে।’

রেখাহীন মুখে সুকুমারী জবাব দিলেন, ‘আমি জানি মনোতোষ।’

এরপরে জগজ্জ্যোতি আর সাতদিন বেঁচেছিলেন।

শ্রাদ্ধ-শান্তি চুকে গেলে অ্যাটর্নি বিশ্বমোহন জানালেন, জগৎবাবুর উইল অনুযায়ী স্ত্রী সুকুমারী সমস্ত সম্পত্তি পেলেন। দুটি বিধবা মেয়ে সুরবালা আর পুরবালা আপাতত মাসিক পঁচিশ টাকা করে মাসে হাতখরচ পাবেন আর খাওয়া-পরা পাবেন। তবে সুকুমারীর মৃত্যুর পর সমস্ত সম্পত্তি পাবে দুই বোন। তখন যদি কোন মেয়ে পুনর্বিবাহ করে, তাহলেও সে এই উইল অনুসারে সম্পত্তির অর্ধেক পাবে। হিসেব করে দেখা গেল, জগৎ অনেক সম্পত্তি রেখে গেছেন। কলকাতায় চারখানা বাড়ি, একটা বস্তি এবং নগদ প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ টাকা।

বাড়িটা দু’ মহল। সামনের মহলে দু’খানা ঘর। একখানা নিচে, একখানা ওপরে, সেই দু’ খানা অধিকার করলেন সুকুমারী। তারপর উঠান। উঠানের পরে একতলায় তিনখানি ঘর। সেই তিনখানিতে রইল সুরবালা আর পুরবালা। তৃতীয়টিতে নবনিযুক্ত বাচ্চা চাকর পাঁচু।

সেদিন সকালে রান্না হয়ে গেছে। দু’বোন বসে লুডো খেলছিল। বাচ্চা দেখে একটা চাকর রাখা হয়েছিল। খাওয়া-পরা বাবদ পনেরো টাকা মাইনে। তিনজন পাঁচ টাকা করে দেবে স্থির হয়েছে।

হঠাৎ সেই বাচ্চা চাকর পাঁচু এসে সুরোকে বলল, ‘বড়দিদি, তোমাদের দুজনকে ওপরে ডাকছে।’

‘কে?’

‘ডাক্তারবাবু। আর সেই বুড়ো উকিল—সেও বসে আছে ঘরে।’

‘মা কোথায়?’

‘শুয়ে আছে।’

দু’বোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। কি ব্যাপার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। হঠাৎ সকাল বেলায় এ-ডাক কেন?

‘মার বোধ হয় শরীর খারাপ হয়েছে।’ বলল পুরবালা।

‘শরীর খারাপ হলে ডাক্তার আসবে, অ্যাটর্নি আসবে কেন?’ সুরবালা প্রশ্ন করল।

‘চল না, গিয়েই দেখা যাক।’

দুজনে রওনা হল সুকুমারীর ঘরের দিকে। বোঝা গেল ভয় পেয়েছে ওরা। পাবারই কথা। সুরবালার বয়স পঁচিশ, পুরবালার কুড়ি। ভয় না পাবার মত মন তৈরি এখনো হয়নি ওদের। তাছাড়া জীবনে এতই বঞ্চিত হয়েছে ওরা, প্রথম—কৃপণ বাপের অধীনে থেকে, দ্বিতীয়—স্বামীর মৃত্যুতে, তৃতীয়—হাড়-চামড়া সর্বস্ব, পাথুরে মুখ, সুকুমারীর অভিভাবিকাত্বে।

ওপরে এল ওরা।

দুটো চেয়ারে বসে আছেন বিশ্বমোহন আর ডাঃ মনোতোষ তালুকদার। সুকুমারী শুয়ে আছেন বিছানায়। থমথম করছে ঘরের আবহাওয়া। শুকনো মুখে সুরো আর পুরো দুটো মোড়ায় বসে পড়ল।

গলাটা একটু পরিষ্কার করে নিয়ে বিশ্বমোহন বললেন, ‘মিসেস জোয়ারদারকে খাবারের সঙ্গে কে বিষ দিয়েছিল, তোমরা বলতে পারো?’

‘বিষ!’ দুই বোন অস্ফুট চিৎকার করে উঠল।

‘অতটা অবাক হলে তো চলবে না।’ ডাঃ তালুকদার বললেন, ‘মিসেস জোয়ারদারের শরীরে বিষক্রিয়ার লক্ষণ ফুটে উঠেছিল। ঠিক সময়ে খবর দেওয়াতে কোন রকমে বেঁচে গেলেন এ যাত্রা। কিন্তু বিষটা দিয়েছিল কে?’

‘কী করে বলব?’ সুরবালা বলল।

‘কিন্তু বলতেও তো হবে। ওঁর খাবার যা আসে—তোমরা দুই বোনের একজন রান্না করে পাঠাও কিনা?’

‘পাঠাই।’ পুরো বলল।

‘তাহলে এ বিষ তোমাদের একজন দিয়েছে।’

‘কী বলছেন আপনি?’ সুরবালা চেঁচিয়ে উঠল, ‘মাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে আমাদের লাভ?’

‘লাভ—’, টেনে টেনে বললেন বিশ্বমোহন। ‘লাভ তো তোমাদেরই মা। ওঁর মৃত্যু হলে এই সম্পত্তির মালিক হবে তোমরা। তোমার বাবার উইল অনুসারে মায়ের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তো কিছুই পাচ্ছ না।’

‘নাই বা পেলাম। আমাদের অভাব তো কিছু নেই।’

দুজনে চুপ করে চেয়ে রইলেন দু’বোনের মুখের দিকে।

হঠাৎ ডাক্তার বললেন, ‘এমনিতে স্বীকার না করলে আমি পুলিশে খবর দেব।’

‘তাই দিন। চিৎকার করে উঠল পুরবালা, ‘পুলিশ যদি আসে, পুলিশই আসুক। আপনারা তাহলে এমনভাবে বিরক্ত করছেন কেন আমাদের?’

‘বিরক্ত করছি এইজন্যে যে, যদি তোমরা স্বীকার করতে, তাহলে হ্যাঙ্গামা অনেক চুকে যেত।’

‘না।’ শক্তগলায় জবাব দিল পুরবালা, ‘হ্যাঙ্গামা চুকিয়ে দরকার নেই। আপনি পুলিশ ডাকুন। পুলিশ যদি মনে করে আমরা মাকে বিষ দিয়েছি, তাহলে যেন ফাঁসি দেয় আমাদের দুজনকে। আপনারা আর বসে বসে দগ্ধাবেন না।’

‘ভারি দুঃখের কথা মা! ভারি দুঃখের কথা। সম্পত্তি আজ না হয় কাল তোমরা পাবেই। তার জন্যে শুধু শুধু—’

‘আমরা যাই এবার?’ উঠে দাঁড়াল পুরবালা, ‘পুলিশ এলে ডেকে পাঠাবেন। আয় দিদি।’

খুব লেগেছিল পুরবালার। জীবনের অত ঘোর-প্যাঁচ তার জানা নেই। বিশেষ করে সেই মানুষটার কাছ থেকে অভিযোগ এল, যাকে সে ভালবাসে। আজ নয়, ছেলেবেলা থেকে। ওই ডাক্তার মনোতোষ, তার খেলার সাথী। তার মুখ থেকে এমন রূঢ় কথা শোনবার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।

সুরো তখনো বসে আছে দেখে পুরো বলল, ‘আয় দিদি! এখানে বসে বসে এই মিথ্যে কথা শোনার কোন মানে হয় না। ডাক্তারবাবু পুলিশে খবর দিন, তারপর আসা যাবে।’ এই বলে সুরবালার হাত ধরে টেনে তাকে দাঁড় করিয়ে নেমে যাবার জন্য পা বাড়াতেই—

ঘরের এককোণ থেকে একটা মিষ্টি আওয়াজ ভেসে এল, ‘একটু দাঁড়ান।’

চমকে দুই বোন ফিরে দাঁড়াল। এতক্ষণ দেখতেই পায়নি—ঘরের কোণে, খাটের ওপাশে মেঝের উপর বসে পড়ে এতক্ষণ যেন কী খুঁজছিলেন তিনি। এইবার উঠে দাঁড়িয়ে ডেকেছেন ওদের। অপূর্ব সুন্দর যুবক। বলিষ্ঠ গঠন। মুখে একটা শিশুর সারল্য। বয়স হবে বছর ত্রিশের মধ্যে।

‘তুমি কি কিছু জিগ্যেস করবে বিরোচন?’

‘হ্যাঁ, কাকাবাবু।’

‘তোমার পরিচয় দিই ওদের তাহলে। ইনি হচ্ছেন ব্যারিস্টার বিরোচন মজুমদার। বড়লোকের ছেলে। বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারি পাশ করে এসেছেন। তাছাড়া আরো একটা বিশেষ গুণ আছে এঁর। সখের গোয়েন্দাগিরি খুব ভাল করেন। এর জন্যে ব্যারিস্টারি পাশ করবার পরেও বিরোচন দু’বছর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ট্রেনিং নিয়েছিল।’

‘আপনার সঙ্গে পরিচয় হল কী করে?’ ডাক্তার মনোতোষ বলল।

‘ওর বাবা আমার বাল্যবন্ধু। ওর বোনের পাকা দেখা কালকে। আমায় নিমন্ত্রণ করতে এসে যখন শুনল এই ঘটনার কথা, তখন নিজেই বলল কাকাবাবু, আমি সঙ্গে থাকলে অসুবিধে হবে? তাছাড়া জানো ডাক্তার, বিরোচন এর মধ্যে খুব নাম করে ফেলেছে। সেদিন ডেপুটি কমিশনার আমাকে বলছিলেন যে, বিরোচন সাহায্য না করলে স্টিভেনসন হত্যার কোন কিনারাই হত না। দলটা ছিল ইন্টারন্যাশনাল গ্যাং।’

‘আচ্ছা বিরোচনবাবু?’

‘আজ্ঞে ।’

‘এই ব্যাপারটা আপনার কীরকম মনে হচ্ছে বলুন তো? মেয়ে দুটি তো অস্বীকার করছে।’

‘তাই তো শুনলাম।’

সুরো আর পুরো চুপ করে চেয়ে আছে বিরোচনের মুখের দিকে। অমন সুন্দর মুখখানায় কোন রেখা পড়ে না।

‘একটু ভেবে দেখা যাক না।’ বিরোচন পুরোর মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল।

সুকুমারী এতক্ষণ পরে চোখ চাইলেন। বললেন, ‘ডাক্তার, ভারি দুর্বল লাগছে আমার।’

‘তা একটু লাগবে। মিক্সচারটা একদাগ খান।’

এই বলে ডাক্তার নিজেই একদাগ ঢেলে সুকুমারীকে খাইয়ে দিলেন।

‘মিসেস জোয়ারদার, আপনাকে আমি দু’একটা কথা বলি, আপনাদের রান্না কি এক জায়গায় হয়?’

‘হ্যাঁ।’

‘আজ থেকে আপনি সব আলাদা করে নিন। কেমন?’

‘বেশ।’

‘হ্যাঁ। আপনি আপনার রান্নাটাও নিজে করে নেবেন। আর খাবার জলটাও নিজে তুলে নেবেন। কেমন?

‘ভাল। তাই হবে।’

ঘরের চারদিকটা আর একবার ভাল করে দেখে নিয়ে বিরোচন বলল, ‘দোকান থেকে মিষ্টি-টিষ্টি আনান কি মাঝে মাঝে?’

‘হ্যাঁ। খেতে ইচ্ছে হলে পাঁচুকে দিয়ে⋯’

‘না।’ বিরোচন জবাব দিল, ‘কাউকে দিয়ে নয়। খেতে খুব ইচ্ছে করলে বরং বাড়ি থেকে দু’পা বেরিয়ে গিয়ে নিজে কিনে আনবেন, তবু⋯’, এই অবধি বলে সুরো আর পুরোর দিকে চেয়ে বিরোচন প্রশ্ন করল, ‘আপনারা বলছেন, এই বিষ দেওয়া সম্বন্ধে কিছু জানেন না?’

‘আজ্ঞে না।’ পুরো বলল, ‘রান্না বেশির ভাগ দিনই আমি করি। এক-আধদিন না পারলে পুরো করে। তাছাড়া, মাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলব—একথা তো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি নে।’

বলতে বলতে কেঁদে ফেলল সুরো।

‘আমি এত সহজে মরব না। আমার বাবা মারা গেছেন বিরাশি বছরে, মা গেছেন আটাত্তরে, ঠাকুরমা একানব্বই বছরে আর আমার দাদামশায় সাতানব্বুইয়ে। আমি এত অল্পবয়সে মরে যাব? ভুলেও ভেবো না।’ হাঁপাতে হাঁপাতে বললে সুকুমারী, ‘বরং তোমরাই আমার আগে যাবে, বুঝেছ?’

ডাক্তার হেসে উঠল। বলল, ‘যাকগে, যাকগে। আপনি বেশি কথা বলবেন না। হার্ট উইক আপনার। চলুন, এবার তাহলে যাওয়া যাক।’

সবাই উঠে পড়লেন। বিশ্বমোহন দরজার কাছে গিয়ে ফিরে বললেন, ‘সুরো-পুরো! তোমরা অস্বীকার করেছ, কিন্তু মিসেস জোয়ারদারের শরীরে বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা গেছে। কাজেই বিষ যে দেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এযাত্রা ডাক্তারের তৎপরতায় উনি বেঁচে গেছেন, কিন্তু তোমাদের আমি আবার সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছি। আর কখনো ভুলেও একাজ করো না। একটা মানুষকে মেরে ফেললেই কি তার সম্পত্তি পাওয়া যায়? বিশেষ করে সেই মৃত্যুতে যদি কোনরকম খুনের গন্ধ থাকে?’

নিঃশব্দে বসে বসে কাঁদছিল দুই বোন। সবাই বেরিয়ে যেতেই সুরো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমার চাল-ডাল, তরি-তরকারি কি এই ঘরে পাঠিয়ে দেব মা?’

‘থাক। আর অত যত্ন করতে হবে না। এখন চলে যাও এঘর থেকে।’

তিন-চার দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠলেন সুকুমারী। খাওয়া-দাওয়া সম্পর্কেও তিনি অতিমাত্রায় সতর্ক হয়ে উঠলেন। নিজে বাজার যেতেন, তরি-তরকারি, চাল-ডাল, তেল-নুন সব নিজের হাতে কিনতেন। বাড়ি ফিরে কয়লা ভাঙতেন নিজে, উনুন ধরাতেন। রান্না করে, খেয়ে বাসনগুলি পর্যন্ত নিজেই মেজে নিতেন।

পুরবালা একদিন ডেকে বলল, ‘মা, কয়লা ভাঙা, উনুন ধরানো আর বাসন মাজার মধ্যে তো কেউ বিষ মিশিয়ে দিতে পারে না। ওগুলো নাহয় আমরাই করে দেব। তুমি বুড়ো মানুষ।’

‘না!’ চেঁচিয়ে উঠলেন সুকুমারী, চুয়াল্লিশ বছরে কেউ বুড়ো হয় না। আমরা দীর্ঘজীবীর বংশ, বুঝেছ? অত সহজে আমাদের কেউ বুড়ো হয়নি, মরেনি! যাও, নিজের কাজে যাও। আর আত্মীয়তা করে কাজ নেই।’ বলতে বলতেই রাগ বেড়ে গেল সুকুমারীর, ‘আমায় বিষ খাইয়ে মারবে না? কই, এবার খাওয়াও বিষ!’

সত্যি কথা বলতে, বিষকে সুকুমারীর ভীষণ ভয়। যে কষ্ট সেদিন তিনি পেয়েছেন, তা বলবার নয়। সমস্ত শরীরের মধ্যে কীরকম যেন আগুনের মত জ্বলতে থাকে। গা বমি-বমি করতে থাকে, মাথাটা মনে হয় যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ে যাবে। আর খালি ঘুম আসে। ঘুমুতেও ভয় করে—মনে হয়, যদি এ ঘুম না ভাঙে আর?

কিন্তু এত সাবধানতা সত্ত্বেও আবার একদিন বিষক্রিয়ার লক্ষণ দেখা গেল। ছুটে এলেন ডাক্তার মনোতোষ, বিশ্বমোহন অ্যাটর্নি, এবং বিরোচনও টেলিফোনে খবর পেয়ে চলে এল তৎক্ষণাৎ। আবার শুরু হল যমে-মানুষে টানাটানি। ডাক্তার যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে চিকিৎসা শুরু করে দিলেন। ঘণ্টাখানেক পরে একটু একটু করে আরোগ্যের পথে এগোতে লাগলেন সুকুমারী।

এক ফাঁকে বিশ্বমোহন বিরোচনকে নিয়ে বাড়ির মধ্যে গিয়ে, মেয়ে-দুটির সঙ্গে দেখা করে এলেন। সংবাদ শুনে তারা হতবাক হয়ে স্থাণুর মত বসে রইল।

বিশ্বমোহন চাপা গলায় বললেন, ‘নিশ্চয় কিছু একটা হচ্ছে, সুরবালা!’

‘কী হচ্ছে?’ সুরো ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল।

‘কিছু একটা হচ্ছেই। হয় উনি যখন বাজারে যান, অথবা বাইরে বেরোন, সেই সময় তোমাদের দু’ বোনের একজন গিয়ে—ওঁর রাখা খাবারের মধ্যে কিছু মিশিয়ে দিয়ে আসো, কিংবা⋯’

কিংবার পরে কোন কথাই এল না বিশ্বমোহনের। চুপ করে বিরোচনের দিকে চেয়ে রইলেন। সে বাড়ির উঠোনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে কী যেন দেখছিল। একটু পরে ফিরে এসে বলল, ‘কাকাবাবু, চাল-ডাল, তরি-তরকারির মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিলে—সেদ্ধ হবার পর তার রঙ এমন বদলে যাবে, সেটা যিনি খাবেন তাঁর চোখে না পড়েই পারে না। তাছাড়া, অন্যরকম গন্ধও বেরোবে তা থেকে।’ এই বলে পুরবালার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, ‘বাইরে বেরোবার সময় উনি ঘরে তালা দিয়ে যান, না?’

‘হ্যাঁ।’ জবাব দিল পুরবালা, ‘প্রকাণ্ড একটা বিলিতি তালা লাগিয়ে মা বেরিয়ে যান।’

‘আর, এই জলের পাইপ?’

‘কী জলের পাইপ?’

‘বলছি, জলের পাইপ কি এই একটাই? এই পাইপই তো ওপরে গেছে?’

‘হ্যাঁ।’ সুরবালা উত্তর দিল, ‘তবে ওপরের পাইপে জল ওঠে না বলে—মা নিচে থেকে জল ভরে নিয়ে যান।’

‘ও!’ বিরোচন কী ভাবল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘চাকরটা বোধ হয়, ওপরে কলসিটা দিয়ে আসে?’

‘না, না।’ পুরো বলল, ‘মা নিজে দাঁড়িয়ে থাকেন। জল ভরা হলে কলসি নিয়ে ওপরে চলে যান। আমরা কতদিন বলেছি, কিন্তু উনি তাতে রেগে ওঠেন।’

বিরোচন চুপ করে চেয়ে রইল। তারপর বলল, ‘চাকরটাকে একবার ডাকুন দিকিনি?’

একটু পরেই পাঁচু এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বিরোচন প্রশ্ন করল, ‘কি নাম তোমার?’

‘আজ্ঞে পাঁচু মাইতি। ভাল নাম পঞ্চানন মাইতি।’

‘বাড়ি কোথায়?’

‘মেদিনীপুর।’

‘মেদিনীপুরে—কোথায়?’ বিরোচনের গলা শক্ত।

‘আজ্ঞে, আলুকরণবার গেরামে। পাঁশকুঁড়ো থেকে নেমে যেতে হয়।’

‘কতদিন চাকরি করছ এখানে?’

‘কর্তা মারা যাবার পরদিন থেকে।’

‘বুড়িমার কী কাজকর্ম কর তুমি?’

‘আজ্ঞে, কিছু না। উনি তো কিছু করতে দেয় না। আমি করতে গেলে ধমকে তাড়িয়ে দেয়।’

‘বুড়ি মা যখন ঘরে ছিলেন না, সেই সময় ঘরে ঢুকে ওঁর জলের কলসিতে কোন গুঁড়ো ঢেলে দিয়ে এসেছিস, না?’

কিছুক্ষণ বিরোচনের দিকে চেয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল পাঁচু। তার দিকে বোকার মত চেয়ে রইল দু’বোনে।

‘চলুন কাকাবাবু, ওপরে যাই আমরা।’

‘চল বাবা। এ তো বড় আশ্চর্য ঘটনা। ভৌতিক ব্যাপার নাকি?’

‘বোধ হয়।’

বিরোচন অন্য কথা ভাবছিল, তাই বেশি কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল।

অনেকটা সামলে উঠেছেন সুকুমারী। নিশ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ডাক্তার চাপা গলায় প্রশ্ন করল, ‘কিছু সুবিধে হল? পেলেন কিছু?’

‘নাঃ!’ বলল বিরোচন, ‘খুবই আশ্চর্য ঘটনা। বিষ যেখান থেকে আসতে পারে, সেসব জায়গা বেশ ভাল করে দেখে এলাম। মনে তো হয় না যে, মেয়ে দুটি বিষ দিচ্ছে। অথচ—আপনি দয়া করে একটা কাজ করবেন ডাক্তারবাবু?’

‘বলুন!’

‘মিসেস জোয়ারদার সুস্থ হলে ওঁকে বলবেন, কাল-পরশুর মধ্যেই উনি যেন রাজমিস্ত্রী ডেকে ঘরটাকে পার্টিশন করে নেন। অর্থাৎ ওঁর থাকার জায়গাটুকু বাড়ির থেকে আলাদা হয়ে যাবে। জলের কলটা সম্পূর্ণ একটা আলাদা লাইনে করে নিতে বলবেন। একটা স্টোভ কি কুকার কিনতে বলবেন। চাল-ডাল-তরকারি যা কিছু সব যেন উনি পটাস-পারম্যাঙ্গানেটের জল দিয়ে ধুয়ে নেন।’

‘বলব, নিশ্চয় বলব।’

‘আমি আরো একটু ভাবি।’ এই বলে বাড়ি থেকে যাবার সময় বিরোচন আবার সুরো-পুরোর সঙ্গে দেখা করল। বলল, ‘আপনারা তো ওপরে যান না?’

‘না।’

‘আপনার মার সঙ্গে পাড়া-প্রতিবেশীরা কেউ দেখা করতে আসেন কিনা বলতে পারেন?’

‘না। কেউ আসেন না।’

‘ঠিক জানেন?’

‘ঠিক জানি।’ সুরবালা জবাব দিল, ‘মা যতক্ষণ ঘরে থাকেন, দরজা বন্ধ করে থাকেন। যখন বেরোন—একলা, ফিরেও আসেন একলা।’

‘ও! আচ্ছা, আমি যদি আপনাদের দু’বোনকে দু-একটা ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করি, রাগ করবেন কি?’

‘না, না, রাগ কেন করব? বলুন না, কী বলবেন!’

‘আপনারা দুজনেই বিধবা, না?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

একটু থেমে বিরোচন বলল, ‘অল্প বয়েস আপনাদের। সামনে অনেকখানি ভবিষ্যৎ। মাঝে মাঝে কিছু ভাবেন না যে কি করে কাটবে এই দিনগুলো?’

‘ভাবি বৈকি।’ বলতে বলতে দু-চোখের কোলে জলের আভাস ফুটে উঠল সুরবালার, ‘তাই তো ভেবেছিলাম যে পুরোর আবার বিয়ে দেব। কিন্তু মাকে নিয়ে যে গোলমাল শুরু হল, আর বোধ হয় সে-কথা ভাবাও যাবে না। কাজেই যা কপালে আছে, হবে।’

‘বাবা আপনাদের এই সম্পত্তি কি ভাবে ভাগ করেছেন?’

‘আমরা মাসে মাসে দুজনে খাওয়া-পরা ছাড়া নগদ পঁচিশ টাকা করে পাব। মা যেদিন থাকবেন না, সেদিন এই সম্পত্তি—বাড়ি-ঘর, টাকাকড়ি আমরা পাব।’

আরো কিছুক্ষণ চুপ করে ওদের দিকে চেয়ে রইল বিরোচন। তারপর হঠাৎ এক সময় যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে বলল, ‘আচ্ছা, চলি। নমস্কার।’

সুকুমারী সেরে উঠে বিরোচনের কথামতো সব কিছু করলেন। পাঁচিল দিয়ে ওপর-নিচ ঘিরে দেওয়া হল। আলাদা জলের পাইপ হল। এমন ভাবে দুটো মহল বিচ্ছিন্ন করা হল, যাতে মা-মেয়ের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়।

সুকুমারী খুব ভোরে ওঠেন। বিছানায় বসে স্বামীর দেওয়া গুরুমন্ত্র কিছু জপ করেন। তারপর ছাদের কোণে ঘেরা জায়গাটুকুতে বসে মাথা ধোয়া অথবা চান করা সারেন। ইদানীং প্রত্যেকদিনই বিকেলের দিকে শরীরটা খারাপ হচ্ছে। বিকেলের দিকে মনোতোষ আসে, নানাপ্রকার ওষুধপত্র দিয়ে যায়। রোজই আসে সে।

আর একজন আজকাল প্রত্যহ আসে। সে হচ্ছে বিরোচন। সে সুকুমারীর কাছেও বসে। তারপর নেমে গিয়ে দুই বোনের সঙ্গেও গল্প-টল্প করে চা-জলখাবার খেয়ে বাড়ি যায়। আবার কোন কোনদিন দেখা যায়, বাড়ির মধ্যে না ঢুকে বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে এবং চুপ করে চেয়ে আছে বাড়িটার দিকে। এক-আধ দিন মনোতোষের সঙ্গে দেখা হয়। রোগীর স্বাস্থ্য নিয়ে আলাপ হয়। মনোতোষ সুকুমারীর চিকিৎসা নিয়ে রীতিমত বিরক্ত হয়ে উঠেছে। একদিন বলল, ‘বিরোচনবাবু, যা শিখেছি, এবার ভুলে যাব। আপনি বিশ্বাস করুন, এই বিকেলে শরীর খারাপ হওয়া নিয়ে আমি ডাক্তারি শাস্ত্র তচনচ করে ফেলেছি। এক্সরে করেছি, এ ছাড়া স্পুটাম থেকে শুরু করে যাবতীয় পরীক্ষা শেষ করেছি।’

‘কী মনে হচ্ছে?’

‘মিস্‌টিরিয়াস্! বিষক্রিয়া কিন্তু চলছেই বলে আমার হয়। আজ তো ওঁর খাওয়া-দাওয়া সব বন্ধ করে ফিক্সড ডায়েট করে দিয়ে এলাম। বাজারের তেল-নুন-ঘি এ-সব কিছু খাওয়া চলবে না। শুধু ফল-টল খেয়ে কয়েকটা দিন কাটাতে বলেছি। মনে হয় এবার চেকড হবে।’

‘মেয়ে দুটি সম্বন্ধে তাহলে—’

‘সন্দেহ করছি কেমন করে, তাই বলুন। তাদের ধমক দিয়েছি, পুলিশের ভয় দেখিয়েছি, ফলে তারা মাকে দেখতেও আর আসে না। পাঁচু, সেও আর আসে না। তাহলে?’

‘আচ্ছা, এটা বিষক্রিয়া না হয়ে—ধরুন, কোন রকম পয়জনিং কিংবা কোন রকম কেমিক্যাল রিয়্যাকশন—কিংবা—’

‘হ্যাঁ। কিন্তু সোর্সটা কোথায়? তেল নুন ঘি দালদা, সব ঠিক ওই একই কারণে বন্ধ করে দিলাম।’

‘দেখুন, কী হয় এবার।’

‘আমি খুব হেল্‌পলেস ফীল্ করছি। ঠিক কি করব, ভেবে পাচ্ছি নে।’

‘ন্যাচারালি!’ বলল বিরোচন, ‘আচ্ছা ডাক্তারবাবু, আমাকে কেউ বিষ দিচ্ছে, এই ভয় কিংবা ভাবনা থেকে সিম্পটম গ্রো করতে পারে না?’

‘হ্যাঁ, তা পারে। বিশেষ বিশেষ কতকগুলি রোগ এই নার্ভাসনেস থেকে আসতে পারে, কিন্তু বিষের ক্রিয়া⋯হয় কি জানেন, এই যে একটু একটু জ্বর, কখনো কখনো গা বমি-বমি, অত্যন্ত দুর্বলতা, হঠাৎ একদিন এটা বেড়ে গিয়ে, বিষের সমস্ত ক্রিয়া ফুটে ওঠে—অজ্ঞান হয়ে যান, তখনই শুরু হয় লাইফ অ্যান্ড ডেথ কোয়েশ্চেন। আর পারা যাচ্ছে না মশাই। টায়ার্ড ফিল্‌ করছি।’

জগৎ-সংসার যেমন চলছে, ঠিক তেমনি চলতে লাগল, মাঝখান থেকে বিরোচনের ঘুম চলে গেল। সে অফিসে যায়, কাজ করে, বাড়ি ফিরে কোনদিন ক্লাবে যায়, কোনদিন সুকুমারীর কাছে যায়, আবার বাড়ি ফিরে চুপ করে নিজের শোবার ঘরে বসে বসে কী যেন ভাবে।

পালে বাঘ পড়ল। কিছুতেই কিছু হল না। আবার একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন সুকুমারী। মনোতোষ এবং আরো দুজন বড় ডাক্তার চার-পাঁচ ঘণ্টা পরিশ্রম করেও কোন ফল হল না। সুকুমারী মারা গেলেন।

বাঁচবার জন্য এত পিপাসা ছিল তাঁর, ‘মরে যাব’ এই ভয়ের ছাপটুকু মৃত্যুর পরেও যেন তাঁর মুখে লেগে রইল। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু—অতএব পুলিশে খবর দিতেই হল। পুলিশ এল, মৃতদেহ মর্গে গেল। শবব্যবচ্ছেদে পেটের মধ্যে বিষের খবর পাওয়া গেল। ফলে শ্মশান থেকেই দুই বোন থানায় গেল, থানা থেকে জেল-হাজতে।

পুলিশ যখন শ্মশানে এল দুই বোনকে গ্রেপ্তার করতে, তখন সেখানে অনেকেই উপস্থিত ছিল। সুরো আর পুরো চেয়ে দেখল, কাঠের মত, পাথরের মতো মুখ সকলের। বিশ্বমোহন মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, মনোতোষ দেখেও দেখল না। দূরে দাঁড়িয়েছিল বিরোচন। দুই বোন এগিয়ে গেল তাঁর কাছে। সুরো কেঁদে ফেলল। বলল, ‘আমাদের পুলিশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মোহনকাকা, ডাক্তারভাই কেউ বিশ্বাস করেননি আমাদের কথা। আমরা বোঝাতে পারিনি তাঁদের যে, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে, দেখা-সাক্ষাৎ না থাকলে, তাকে বিষ খাওয়ানো যায় না। কিন্তু আপনার মুখের দিকে চেয়ে আমাদের মনে হয়েছে, আমাদের বিষ দেওয়া আপনি বিশ্বাস করেননি। মায়ের এই তিন মাস অসুখের মধ্যে শুধু মানুষের মত ব্যবহার আপনার কাছেই পেয়েছি। আপনার ছোট বোন হয়তো আমাদেরই একজনের বয়সী। তাই আপনাকে দাদার মত অনুরোধ করে যাচ্ছি, আমাদের রক্ষা করবার চেষ্টা করবেন।’

পুরোও কাঁদছিল। সে অস্ফুটে বলল, ‘আমরা কোন দোষ করিনি। মা-ই আমাদের ঘৃণা করতেন। আমরা কিন্তু তাঁকে ভালোবাসতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমাদের কুকুর বেড়ালের মত তাড়িয়ে দিতেন। আপনাকে অনুরোধ করে যাচ্ছি, যদি পারেন, তবে আমাদের কলঙ্ক মোচন করবেন।’

‘কিছু ভয় নেই। কোর্টে মামলা উঠলে আমিই তো তোমাদের ব্যারিস্টার। ভয় কী?’

নিশ্চিন্ত হয়ে দু’বোন হাজতে চলে গেল।

কাগজে-পত্রে এই নিয়ে খুব হৈ চৈ হল কয়েকদিন। তারপর চুপচাপ। প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছু পেল না পুলিশ, তবু অনুমানের ওপর নির্ভর করে ক্রমাগত কোর্ট থেকে তারিখ নিতে লাগল।

দেড় মাস কেটে গেল। সবাই ভুলে যেতে বসল। কিন্তু একজন ভুলল না। সে বিরোচন। ভাবতে ভাবতে পাগলের মত অবস্থা হয়ে গেল তার। দিনরাত সে বাড়ির বাইরে থাকে। অনেক রাত্রে বাড়ি ফেরে। সারারাত্রি ঘরে পায়চারি করে। বাড়িশুদ্ধ লোক তটস্থ হয়ে উঠল। কেউ কিছু বলতে গেলে সে খ্যাঁক করে তেড়ে আসে। দিনের মধ্যে সকালের দিকে তাড়া খায় ঠাকুর। ভাত দিয়ে ডাকতে আসে। তারপর চোখের জল মুছতে মুছতে ফিরে যায়। তারপর আসে বিলি, বিরোচনের বোন। ডাকে, ‘দাদা!’

তাকায় তার দিকে বিরোচন। চায়, কিন্তু দেখে না।

‘ও দাদা!’ আবার ডাকে বিলি।

‘কী?’

‘তুমি কোর্টে যাবে না?’

‘কার কোর্ট’

‘ও দাদা!’

‘কী-ই-ই?’

‘কী বলছ! ঠাকুর ভাত দিয়েছে। চান করে বসে আছো, উঠে খেয়ে নাও।⋯’

কোনদিন ওঠে সে বোনের ডাকে। কোনদিন চিৎকার করে, বলেছি এত সকালে আমি খেতে পারব না!

‘কোর্টে যাবে না?’

‘না, ব্যারিস্টারি ছেড়ে দিয়েছি আমি।’

‘যাক, বাঁচা গেল! দুপুরে দুজনে বসে ক্যারম খেলব।’

আবার কোন কোনদিন চুপি চুপি ডাকে বোনকে। কাছে বসিয়ে সব গল্পটা বলে। তারপর বলল, ‘এবার বল তো, বিষটা এল কী করে?’

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে বিলি। তারপর বিজ্ঞের মত বলে, ‘বিষ কেউ দিতে পারে না। এটা ভদ্রমহিলার মনের ভুল। উনি বোধ হয় ভয়ে মরে গেলেন।’

ক্রমশ বিরোচনের বাড়ির লোকজন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। ওজন কমে গেল বিরোচনের। চেহারা খারাপ হয়ে গেল। সারাটা দিন বিড় বিড় করে বকে। প্রমাণ না পেলেও পুলিশ প্রাণে ধরে সুরো, পুরো আর পাঁচুকে মুক্তি দিতে পারছে না।

গভীর রাত্রি।

সন্ধ্যে থেকে জ্বর হয়েছে বিরোচনের। মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হল জ্বরটা বেড়েছে। কত জ্বর? হঠাৎ মাথার মধ্যে যেন কী একটা বেজে উঠল। দু’কান ভরে স্টিমারের বাঁশী বাজতে লাগল।

নিজের মনে চিৎকার করে বলল বিরোচন, ‘তুমি একটা গাধা, তুমি একটা উল্লুক, তুমি একটা যা-তা। ব্যারিস্টারি পাশ করেছ? পোস্তায় গিয়ে দোকান খোলো। বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রি করগে যাও! ইডিয়ট কোথাকার!’

বাইরে বেরিয়ে বিলির দরজার কাছে গেল—ডাকল না। মনের উত্তেজনায় কলঘরে ঢুকে ঝপ ঝপ করে বালতি বালতি জল মাথায় ঢালতে লাগল।

বেলা আটটা।

বিশ্বমোহনকে সঙ্গে নিয়ে বিরোচন এল মনোতোষের বাড়িতে।

মনোতোষ বাড়িতেই ছিল। বিশ্বমোহনকে বলল, ‘কী ব্যাপার? এত ভোরে?’

‘বিরোচন একটা সূত্র ধরেছে। ডাক্তার হিসেবে তোমার সেটা শোনা দরকার এবং মতামত দেওয়াও দরকার।’

‘আসুন, আসুন।’

ওরা বসল ড্রইংরুমে। চা এল। খেতে খেতে বিরোচন বলল, ‘আপনার এফ-আর-সি-এসটা দেবার জন্য বিলেতে যাবার কথা ছিল। সেটা কি পিছিয়ে গেল?’

‘না, ঠিক পিছিয়ে যায়নি। কেন বলুন তো?’

‘আমি যাব কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম, যদি যান তাহলে এক সঙ্গেই যাওয়া যাবে।’

‘ও! তাহলে তো খুবই ভালো হয়। বেশ, তাই হবে। যাবার আগে আপনাকে নিশ্চয় জানাব। যাক! কী সূত্র পেয়েছেন বলুন তো?’

‘সূত্র এমন বিশেষ কিছু নয়। ওঁর মৃত্যুর পর ওই ঘর থেকে চাল ডাল তেল নুন ঘি ইত্যাদি যা জিনিসপত্র ছিল, সবই আমি পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাই। এটা তো আপনি জানেন।’

‘জানি। কিছু পাওয়া গেল কি?’

‘না। এ ছাড়া যে জল উনি খেতেন, তাও পরীক্ষা করিয়েছি, কিন্তু কিছু না—বিষের চিহ্নমাত্র কোথাও নেই। অথচ আপনি জানেন, পোস্টমর্টেমে ওঁর পেটের মধ্যে বিষের ট্রেস পাওয়া গেছে।’

‘সে আমি জানি। কেন, একথা তো আমি বরাবর বলে এসেছি যে বিষের ক্রিয়া নিশ্চয় চলছে।’

‘আচ্ছা ডাক্তার, আপনি কি কোনদিন এই বিষক্রিয়া সম্বন্ধে চিন্তা করেছেন?’

‘চিন্তা করেছি মানে?’

‘মানে, এই বিষের সোর্সটা সম্বন্ধে ভেবে দেখেছেন?’

‘একদিন? বহুদিন—বহুদিন!’

‘কিন্তু—’

‘কিন্তু কিছুই ভেবে পাইনি। সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন রহস্যাবৃত। নার্ভাসনেসের সূত্র ধরে চিকিৎসা করেছি, এমনি অনেক উৎসাহ দিয়েছি, খাওয়া-দাওয়া স্ট্রিক্টলি অবজার্ভ করেছি, যথেষ্ট সময় নষ্ট করেছি এর জন্যে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। আমার মনে হয় পাঁচুকে দিয়ে উনি মাঝে মধ্যে মিষ্টিটা আস্‌টা আনাতেন, তার থেকে যদি—’

‘আপনার সঙ্গে পুরোবালার তো ছেলেবেলা থেকেই ভাব ছিল?’

‘হ্যাঁ। আমার খেলার সাথী।’

‘সুরোবালার কাছে শুনেছিলাম যে আপনি নাকি পুরোবালাকে বিধবা-বিবাহ করবেন, ঠিক করেছিলেন—’

‘হ্যাঁ। কথাবার্তা সবই বলে রেখেছিলাম। পুরো আমার বাল্যবন্ধু, তার জীবনটা এ ভাবে নষ্ট হতে দেওয়া উচিত নয় আমার। তাই আমি ঠিক করেছিলাম—। বাট্ ম্যান প্রোপোজেস গড ডিসপোজেস! এমন বিশ্রী কাণ্ড হল যে—কবে যে ওরা মুক্তি পাবে, আর কবে যে—’

‘অপরাধী ধরা পড়বে, তাই না?’

‘ঠিক তাই।’

‘কিন্তু আপনি একটু মনস্থির করলেই তো অপরাধী ধরা পড়ে যায় ডাক্তারবাবু!’

‘আমি মনস্থির করলে? হাউ ফানি! বেশ তো আমি মনস্থির করলে যদি ওদের উপকার হয়, আমি কেন করব না? বলুন, কি করতে হবে?’

‘যদি আপনি বলেন, এই খুনটা আপনি করেছেন।’

‘আমি! কিন্তু খুনের তো কারণ থাকা চাই। কেন খুন করলাম!’

‘এই ধরুন, সুকুমারী দেবীর মৃত্যুর পর দু’বোন সম্পত্তি পাবে। তখন ছোট বোনকে বিয়ে করে, সেই টাকাটা নিয়ে আপনি বিলেত যাবেন।’

‘চমৎকার!’ হেসে উঠল মনোতোষ। ‘কিন্তু আপনাকে কি এ-কথা আবার মনে করাতে হবে যে, বিষটা কী ভাবে দেওয়া হয়েছে—এটার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি? আমি যদি তাকে বিষ দিয়ে থাকি—কীভাবে দিয়েছি, বলুন!’

‘প্রতিদিন সন্ধ্যায় আপনি রোগী দেখতে যেতেন। ফিরে আসার সময় আপনি ওঁর টেম্পারেচার নিতেন। যে থার্মোমিটারটা মুখে দিয়ে ওঁর জ্বর দেখতেন, সেটার গায়ে বিষের মৃদু প্রলেপ থাকত। প্রতিদিন।’

এইবার মনে হল মনোতোষ চেয়ার থেকে পড়ে যাবে। বিরোচন এগিয়ে গিয়ে ধরে ফেলল। বলল, ‘একটু সুস্থ হয়ে নিন মনোতোষবাবু! থানা থেকে অফিসার এসেছেন। দেখা করতে হবে তো?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *