1 of 2

সন্দেহ – গজেন্দ্রকুমার মিত্র

সন্দেহ – গজেন্দ্রকুমার মিত্র

চায়ের দোকানে কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের রহস্যময় মৃত্যুর কথা আলোচনা হচ্ছিল।

দোকানের মালিক বিমলদা বললেন, আমার মনে হয় আত্মহত্যা।

আমি আর এক কাপ চা ফরমাশ করে বললাম, আত্মহত্যা বলে মনে হয় না ঠিক—দুর্ঘটনা বলেই বোধ হয়। কোন রকমে মাথায় ধাক্কাটাক্কা লেগে—

ওপাশে একটি সাতাশ-আটাশ বছরের যুবক বসে চা খাচ্ছিল। শ্যামবর্ণ, ঈষৎ কোঁকড়া চুল, মুখের ভাব কঠিন, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সে হঠাৎ চায়ের কাপ ঠেলে দিয়ে বলল, অ্যাকসিডেন্টও নয়, আত্মহত্যাও নয়, খুন, সোজাসুজি খুন!

কথাটা কারও পছন্দ হল, কারও বা হল না! নিজের নিজের মতামত নিয়ে, তর্ক করতে করতে একদল লোক বের হয়ে গেল। দোকান একটু ফাঁকা হতেই আমি সেই ছোকরার কাছে ঘেঁষে বসলাম। সে যেমন জোরের সঙ্গে কথা বলল, শুনে মনে হয় আর যাই হোক, খুব তলিয়ে না বুঝলে এমন করে কেউ কথা বলতে পারে না!

বিমলদাও হাতের কাছে খরিদ্দারের ভিড় না থাকায় সামনের চেয়ারে এসে বসে পড়ে বললেন, কিসে বুঝলেন?

সে বলল, খুনের ব্যাপারটা সব শুনেছেন তো? ঘটনাটা—সব কিছু?

বিমলদা বললেন, কতক কতক শুনেছি—

বক্তা যুবকটি আর এক কাপ চা দিতে ফরমাশ করে বলল, মরেছে যে বুড়ি তারই বাড়ি ওটা, রাস্তার ধারে একতলার ঘরটায় দোকান আছে, বইয়ের দোকান। ওরই ওপরে যে ঘরটা, সেটায় এক ছোকরা আর্টিস্ট ফোটোগ্রাফীর দোকান করেছিল, আর দোতলায় ভেতরের ঘরে বুড়ি থাকত নিজে, ঠিক তারই নিচের ঘরে ওর ভাঁড়ার আর রান্না দুই-ই চলত। ঝি চাকর রাখত না পয়সা খরচের ভয়ে, বাড়ির পাট-ঝাট নিজেই করত। ভয়ানক পয়সার মায়া ছিল, সেই জন্যেই গেরস্ত ভাড়াটে দেয়নি, ভাড়া কম পাবে বলে।

পয়সা কিছু জমেও ছিল। কেউ বলে বিশ হাজার, কেউ বলে দশ হাজার, কিন্তু সম্প্রতি পুলিশ খবর নিয়ে জেনেছে যে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে ছিল হাজার পাঁচেক টাকা আর পোস্ট অফিসে ক্যাশ সার্টিফিকেট ছিল হাজার চারেকের। আত্মীয়স্বজন কেউ কোনদিন দেখা যায়নি, তিনকূলে কেউ আছে বলেও জানা নেই। বত্রিশ বছর বয়সে বিধবা হয়েছিল, সেই থেকে এই অবধি ওই বাড়ি আগলে পড়ে আছে। বাড়ির আয়েই ওর খরচ চলত। মিতব্যয়ী বলে টেক্স দিয়ে বাড়ি সারিয়েও টাকা জমাতে ওর অসুবিধা হয়নি। আরও জমানো উচিত ছিল। কিন্তু ও বলত যে কে ওর এক বোনপো আছে, সে-ই মাঝে মাঝে জোর করে কিছু টাকা নিয়ে যায়।

বিমলদা বললেন, বোনপো? তবে যে বললেন তিনকূলে কেউ নেই?

—কেউ নেই একথা তো বলিনি, কেউ আছে বলে জানা নেই তাই বলেছি। ওই বোনপোকে কেউ দেখেনি, বুড়িও বিশেষ তার কথা কাউকে বলত না। শুধু আর্টিস্ট ভাড়াটে ওর কি যেন নাম—সুধাংশু—হ্যাঁ সুধাংশুই, পুলিশের কাছে ওই বোনপোর কথা বলেছে। কিন্তু ওর কথা পুলিশ বিশ্বাস করেনি। সুধাংশুই খুনের চার্জে ধরা পড়েছিল কিনা।

আমি বললাম, কেন? বিশেষ করে ওকেই ধরলে কেন?

—বলছি। সুধাংশু ছেলেটি অন্য ভাড়াটের মতো বাইরে বাইরে এসে চলে যেত না, সে বুড়ির সঙ্গে খুব ভাব করে নিয়েছিল, ওকে মাসিমা বলে ডাকত এবং ইদানীং এমন হয়ে গিয়েছিল যে এটা ওটা বাজার থেকে কোন ভাল জিনিস এনে দেওয়া, সঙ্গে করে থিয়েটার বায়স্কোপ নিয়ে যাওয়া, খুব ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতোই ব্যবহার করত। বুড়িও ওকে খুব ভালবাসত এবং বিশ্বাস করত। ভাল কিছু রাঁধলে বা পিঠে তৈরি করলে সুধাংশুর জন্যে রেখে দিত। খুনের দিনও বিকেলে বুড়িকে নিয়ে ও থিয়েটার দেখতে গিয়েছিল—স্টার থিয়েটারে মন্ত্রশক্তি প্লে—ফিরতে রাত একটা কি দেড়টা হয়েছিল। দুটোর সময় ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুধাংশু নিজের বাড়িতে গেছে—এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওদেরই পাড়ার বিশ্বপতিবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তিনি বাড়িতে স্ত্রীর ব্যথা ওঠায় দাই ডাকতে গিয়েছিলেন বুড়ির বাড়ির পাশে।

⋯তার পরের দিন এগারোটায় স্টুডিও খুলতে এসে সুধাংশু ওপরে উঠে গিয়ে বুড়ির ঘরের দোর ভেজানো দেখে একটু আশ্চর্য হয়ে ডেকেছে ওকে, কিন্তু সাড়া পায়নি। সদর দোর খোলা, সিঁড়ি উঠান ধোওয়া মোছা সব পরিষ্কার, তার মানে বুড়ি সকালে উঠেছিল নিশ্চয়ই—অসুখ করলে উঠতে পারত না। তবে এমন সময় শুয়ে কেন? তারপর মনে হয়েছে যে আগের দিন রাত জেগেছে বলে বোধ হয় সকাল করে রান্না খাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছে। সেইজন্য তখন আর ডাকেনি। নিজের স্টুডিওতে বসে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু চারটে বেজে গেল যখন, তখন একটু আশ্চর্য হয়ে গেল—সাড়ে তিনটের সময় বুড়ি রোজ নিজে চা খেত আর ওকে দিয়ে যেত, আজ সে নিয়মের ব্যতিক্রম হতে দেখে একটু বিচলিত হল—এতক্ষণ বুড়ি রাত্রেও ঘুমোয় না—তার উপর দিনের বেলা এত ঘুম!

⋯সুধাংশু তখন বেরিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে ওকে ডেকেছে দু-তিন বার, তাতেও সাড়া না পেয়ে জোরে ডাকে, তাতেও কোন উত্তর না পেয়ে দোর ঠেলেছে, দোর ঠেলতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারে। দক্ষিণের জানলার ধারে মেঝের উপর পড়ে আছে বুড়ি, মুখে মাছি ভন্‌ভন্‌ করছে। প্রথমে মনে করেছিল অজ্ঞান হয়ে আছে, কিন্তু তারপরই গায়ে হাত দিয়ে গা ঠাণ্ডা দেখে চিৎকার করে ওঠে। বাইরে এসে বইয়ের দোকানের লোকজনকে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর পুলিশ এল, ডাক্তার এল। মাথায় একটা কঠিন কিছু আঘাত পেয়ে খুলি ভেঙে প্রাণ বেরিয়েছে। সে আঘাত পিছন থেকেও কেউ করতে পারে, কিম্বা বুড়ি জানলার ধারে মেঝেয় বসে কিছু করতে করতে হঠাৎ মাথা তুলতে গিয়ে কপাটের একটা পাল্লা মাথার পিছনে লেগে যেতেও পারে।

বিমলদা অসহিষ্ণু ভাবে বললেন, এক্ষেত্রে তাহলে সুধাংশুকে ধরলে কেন?

বক্তা চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে পেয়ালাটি সরিয়ে রেখে বলল, বুড়ি কিছুদিন ধরে নাকি খুব ভয়ের মধ্যে ছিল। ওর সেই বোনপো নাকি বলেছিল যে ওকে হাজার পাঁচেক টাকা না দিলে সে ওকে খুন করে ফেলবে। এ সবই সুধাংশু বলছে অবশ্য ; বুড়িও কিছুদিন যাবৎ কাশীবাস করবে স্থির করেছিল। সেই অনুসারে বুড়ি সুধাংশুর বাপের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে, সে যথাসর্বস্ব সুধাংশুর নামেই লেখাপড়া করে দেবে, ওরাই ওর বাড়ি ঘর দোর দেখাশুনা করবে⋯শুধু বুড়ি যত দিন বাঁচবে, যেখানেই থাক না কেন ওর সব খরচ এরা পাঠিয়ে দেবে। সুধাংশুর বাপ অ্যাটর্নি, তাঁরই অফিসে গিয়ে চুপিচুপি ঘটনার দিনই দলিলে সই করে দিয়ে আসে। কাউকে না জানিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল ওর সেই বোনপোর ভয়ে।⋯

বিমলদা বললেন, সুধাংশুই তো যথাসর্বস্ব পেত, তবে ও খুন করবে কেন?

—যত তাড়াতাড়ি পায় এই জন্যে।⋯তা ছাড়া বুড়ির কাছে পুরোন গয়না, মোহর যা কিছু ছিল তাও সেদিনই ও বেচে আসে, বিদেশ যাবার আগে হাতে নগদ টাকা কিছু করা দরকার বলে। প্রায় সাত-আটশো টাকা হবে। সে টাকাটা পুলিশ পায়নি খুঁজে—এবং সে টাকার কথাও সুধাংশু ছাড়া আর বিশেষ কেউ জানত না।

⋯কিন্তু সুধাংশু আজ মুক্তি পেয়েছে।

আমি ও বিমলদা প্রায় এক সঙ্গেই বলে উঠলাম, কি করে?

—হ্যাঁ, আজই রায় বেরিয়েছে। ওর বিরুদ্ধে এমন ভয়ানক সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও ওর বাপের তদ্বিরের ফলে ও মুক্তি পেয়ে গেল। বুড়ির সামনের বাড়ির লোকেরা সাক্ষী দিয়েছে যে খুন রাত্রি দুটোর সময় নাকি কিছুতেই হতে পারে না, যেহেতু তারা আজ সকালে বেলা সাড়ে ছটার সময় ওকে নিয়মিত সদর দোর খুলে জল ছড়া ঝাঁট দিতে দেখেছে। যেমন অন্য দিনও একখানা খয়ের রঙের গায়ের কাপড় গায়ে দিয়ে প্রথমে সদর দোরে জল দিত, তারপর খ্যাংরা দিয়ে পথটা আর উঠোনটা ধোয়া-মোছা করত তা করতে দেখেছে। ওরা আর ওদের পাশের বাড়ির লোকেরা সকলেই এই কথা সাক্ষ্য দিয়েছে।

সেদিনই সুধাংশু সকালবেলা ভবানীপুরে আশুবাবুর বাড়িতে ফোটো তুলতে গিয়েছিল এক বর-কনের, একথাও প্রমাণ হয়ে গেল। সেখানে প্রায় সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত ওর দেরি হয়, তারপরই বাড়ি এসেছে, স্নান করেছে, খেয়েছে—ওর এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছে, তারপর স্টুডিওতে এসেছে এগারটার সময়। এ পর্যন্ত ভাল ভাবেই প্রমাণ হয়ে গেছে⋯কাজেই ডাক্তারেরা যখন একবাক্যে বলেছেন যে যত পরেই মৃত্যু হোক আটটার আগে নিশ্চয়ই হয়েছে, তখন সুধাংশু কি করে খুন করতে পারে? সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত সে আশুবাবুদের বাড়িতেই ছিল।⋯

⋯সুতরাং বিচারকেরা অনুমান করলেন যে জানলা থেকে আঘাত লেগেই মৃত্যু হওয়া সম্ভব।

আমি বিজয়গর্বে বললাম, আমিও তাই বলছিলাম।

বিমলদা বললেন, তবে আপনি বলছিলেন ‘সোজাসুজি খুন’ কেন?

ছোকরা একটা সিগারেট বার করে ধরিয়ে বলল, কিন্তু টাকাগুলো? গয়না-বেচা টাকাগুলোর কি হাত-পা হল? যদি অ্যাকসিডেন্টই হয়, টাকাগুলো কোথা যাবে?

বিমলদা এবং আমি উভয়েই দস্তুরমতো দমে গেলাম। বললাম, আপনি কি অনুমান করেন?

—আমার বিশ্বাস সেই বোনপোই খুন করেছে। বুড়ি যে উইল করেছে তা জানতে পারা তার পক্ষে কিছুই আশ্চর্য নয় এবং সেদিন গয়না আর মোহর বেচে যে টাকা এনেছে এটাও তার পক্ষে জানা অসম্ভব নয়। এমনি মরে গেলে তো এক পয়সা পাবে না স্থির হয়েই গেল, কাজেই ওই সাত-আটশো টাকা যদি কোন রকমে হাতছাড়া হয়ে যাবার আগে বাগাতে পারে সেই মতলবই ছিল। ধরুন বাড়ি ঢোকবার সুযোগেরও অভাব হয়নি। ওরা যখন রাত দেড়টার সময় থিয়েটার থেকে এসে দোর খুলে ভেতরে গেছে, সেই সময় সে স্বচ্ছন্দে ঢুকে পড়তে পারে। ওপরে সুধাংশু মিনিট দশেক ছিল একথা সে নিজ মুখেই বলেছে। সেই সময়টা তার পক্ষে নিচে বা ওপরে কোথাও লুকিয়ে থাকা মোটেই অসম্ভব নয়—পায়খানাতেও ঢুকে থাকতে পারে। যাই হোক⋯তারপর সুধাংশু চলে গেলে বুড়ি হয়তো দোর বন্ধ করে ওপরে এসে খাওয়াদাওয়া সেরে শোবার উদ্যোগ করছিল, সেই সময় মনে করুন সে পেছন দিক থেকে এসে যদি কোনও একটা জিনিস দিয়ে আঘাত করে থাকে⋯হয়তো তার একেবারে খুন করবার উদ্দেশ্য ছিল না, মনে করেছিল এমনি একটু জখম হবে বা অজ্ঞান হয়ে পড়বে⋯কিন্তু বুড়ি ওই এক আঘাতেই শেষ হয়ে গেছে। তারপর টাকাটা খুঁজে নেওয়া তার পক্ষে এমন আর আশ্চর্য কি?

আমি বললাম, কিন্তু সামনের বাড়ির লোকেরা যে সকালে দেখেছে ওকে—

—ওকেই যে দেখেছে তার তো কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না! ধরুন সেই খুনী বোনপোই হয়তো টাকা খুঁজতে খুঁজতে ভোর হয়ে গেছে দেখে, সে সময়ে বাড়ি থেকে ওকে বেরোতে দেখলে সন্দেহ হতে পারে মনে করেছিল, তাই নিজেই মাসির একটা থান পরে আর গায়ের কাপড় জড়িয়ে ধোয়া-মোছা বাসন মাজা সব করেছে। মাথা গা যতদূর সম্ভব ঢাকা ছিল—শীতকাল, কেউ সন্দেহ করেনি—কাজেই ভাল করে কেউ দেখতেও পায়নি। সুতরাং দূর থেকে ওর মাসিকেই মনে করেছে। তারপর বাড়ির মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। বেলা হতে, সুধাংশু স্টুডিও খুলতে, যখন বাইরের লোক ভেতরে ঢোকা বা বাইরে যাওয়া মোটেই আশ্চর্য নয়, সেই সময় এক অবসরে বেরিয়ে গেছে। এ রকম তো হতে পারে? পুলিশের মাথায় অবিশ্যি এত কথা যাবে না, এ সে আগেই জানত⋯

আমি এবং বিমলদা কিছুক্ষণ দূরে—রাস্তার ওপারে চেয়ে রইলাম। শেষের কথাগুলি এত বিস্ময়কর যে আমরা দুজনেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে অন্তত তখন যেন ঘটনাটা বায়স্কোপের ছবির মতো সরে সরে যাচ্ছিল⋯তারপর একটু পরেই আমাদের দুজনের মনে একটা সন্দেহ দেখা দিল। ফিরে পাশের চেয়ারের দিকে চেয়ে দেখি চেয়ার খালি—ছুটে রাস্তায় বার হয়ে এলাম, যতদূর দৃষ্টি চলে বক্তার চিহ্নমাত্র নেই, যেন মন্ত্রবলে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।

বিমলদা বললেন, অ্যাঁ, চোখের সামনে দিয়ে পালিয়ে গেল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *