1 of 2

স্বামীজী আর অনুকূল বর্মা – কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

স্বামীজী আর অনুকূল বর্মা – কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

অনুকূল বর্মা তাঁর সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপর ঝুঁকে, পুরু ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে একটা চিঠির লেখাগুলো খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। দাঁত দিয়ে কামড়ে-ধরা তাঁর অদ্ভুত গড়নের মোটা পাইপ থেকে সামান্য ধোঁয়া উঠছিল।

এমন সময় তাঁর সেক্রেটারি মাধবী এক মহিলাকে নিয়ে ঘরে এসে বলল, ‘জেঠু, এঁকে মনে আছে?’

মাধবী অনুকুল বর্মার দূর সম্পর্কের ভাইঝি। তাঁর কাছেই মানুষ। ইতিহাসে এম-এ পাশ করে শর্টহ্যাণ্ড আর টাইপিং শিখে অনুকূল বর্মার সেক্রেটারির কাজ করে।

যে মহিলাটিকে নিয়ে মাধবী ঘরে এল, তার মুখটা ভালমানুষ-ভালমানুষ। দোহারা চেহারা।

ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা টেবিলে রেখে মুখ থেকে পাইপ নামিয়ে, মৃদু হেসে অনুকূল বর্মা প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার ঝুমড়ুর খবর কী, কমলা? তোমার সঙ্গে নতুন কোন ক্রিমিন্যাল অ্যাকটিভিটিতে সে আবার জড়িয়ে পড়েনি তো?’

ঝুমড়ু কমলার পমেরানিয়ান কুকুরের নাম। বছর দুয়েক আগে এক কুকুর-চুরির তদন্ত করতে গিয়ে অনুকূল বর্মা ঝুমড়ুর সন্ধান পান, আর সেই সঙ্গে বাঁচান এক মহিলার জীবন।

প্রশ্ন শুনে লজ্জিত হয়ে হেসে কমলা বলল, ‘ঝুমড়ু খুব ভাল আছে, অনুকুলবাবু। দিনকের দিন যেন আরো চালাক হয়ে উঠছে। একেক সময় আমার তো মনে হয় সে কুকুর নয়—একটা মানুষ!’

মৃদু হেসে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘আমারও তাই মনে হয়। এবার তোমাদের খবর বলো। তোমার দিদি উৎপলা কেমন আছে?’

‘আপনার দয়ায় সময় মত দিদির অপারেশন করতে পেরেছিলাম। দিদি ভাল হয়ে গেছে। আপনার সেই দেড় হাজার টাকার চেকটা না পেলে কী যে হত জানি না।’ তারপর একটু ইতস্তত করে কমলা বলল, ‘সেই দেড় হাজার টাকা আজ শোধ করে দিতে এসেছি—’

সামান্য চমকে উঠে অনুকূল বর্মা বললেন, ‘মানে—?’

‘আপনার আশীর্বাদে দিদি হরিয়ানা লটারির দেড় লাখ টাকা পেয়েছে। আমরা একটা বাড়ি কিনেছি। দোতলায় থাকি। একতলার দুটো ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে যা পাই, তাতে আমাদের দুটো প্রাণীর খরচ মোটামুটি ভালই হলে। সেই খিটখিটে মিসেস সাহার চাকরি আমি ছেড়ে দিয়েছি। সন্ধ্যেয় এক বুড়ো ভদ্রলোককে ঘণ্টা দুয়েক আমি এখন বই পড়ে শোনাই। তিনি মাসে তিরিশ টাকা করে দেন। কিন্তু টাকার জন্যে এ চাকরি নিইনি। আসলে কিছু না করে আমি থাকতে পারি না।’

চেয়ারে হেলান দিয়ে পাইপটা নতুন করে ধরিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে অনুকূল বর্মা হেসে বললেন, ‘দিয়ে নিলে কী হয় ভুলে গেছ? তাছাড়া ও-টাকা আমার নয়। একটা জোচ্চোর আর ক্রিমিন্যালের টাকা। একটা ভাল কাজে ওটা খরচ হয়েছে। আশা করি, তাতে লোকটার পাপ কিছু কমবে।’

তারপর খানিক থেমে বললেন, ‘তোমাদের খবর শুনে খুশি হলাম। টাকা ফেরৎ দেবার কথা ভুলে যাও। মাধু-মা’র সঙ্গে খানিক গল্প-টল্প কর। আশা করি সে তোমাকে চা-টা খাওয়াবে।’

মাধবী বুঝল, অনুকূল বর্মা নিজের কাজে মন দিতে চান। তাই সে হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই। চলুন, আমরা পাশের ঘরে যাই।’

কমলা কিন্তু গেল না। একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আরেকটা কথা ছিল, আমি নতুন একটা দুর্ভাবনায় পড়েছি। আপনার যদি সময় হয় তাহলে বলি—’

অনুকূল বর্মা বললেন, ‘কমলা, তুমি ভারি বুদ্ধিমতী মেয়ে। তুমি যখন দুর্ভাবনায় পড়েছ, তখন মনে হয় ব্যাপারটা নিশ্চয়ই সীরিয়াস। সামনের চেয়ারটায় বসে তোমার দুর্ভাবনার কথা গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত গুছিয়ে বল।’

পাশের ঘর থেকে মাধবী তার শর্টহ্যাণ্ডের খাতা আর পেনসিল এনে কমলার পাশে বসল।

খানিক চুপ করে থেকে মনে মনে ভাবনাগুলো যেন গুছিয়ে নিয়ে কমলা বলতে শুরু করল :

‘আমি যে ভদ্রলোককে বই পড়ে শোনাই, তাঁর নাম শিবতোষ বোস। তিনি বড়লোক নন। ছোট সরকারী কাজ করতেন। সামান্য পেনসন পান। বিয়ে-থা করেননি। আত্মীয়স্বজন বলতে তাঁর মামার একমাত্র বিধবা মেয়ে তরুণা। খুব বড়লোকের বাড়িতে তার বিয়ে হয়েছিল। অগাধ সম্পত্তির মালিক। আমারই বয়সী। ভারি সুন্দর তার চেহারা। আরো সুন্দর তার ব্যবহার। এমন ভালমানুষ ধরণের যে খানিকটা বোকা-বোকা বলে মনে হয়। শিবতোষবাবুকে রোজ সে দেখতে আসত নিজের বিরাট গাড়িতে। তরুণার সঙ্গে সেখানেই আমার আলাপ। ক্রমে সেই আলাপ বন্ধুত্বে পরিণত হয়। অল্প বয়সেই সে বিধবা হয়। ছেলেপুলে নেই। তার বিরাট বাড়িতে অনেক ঝি-চাকর, দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন, আর তার শ্বশুরের আমলের বুড়ো এক সরকারমশাই। তিনিই সম্পত্তির দেখাশোনা, মালপত্রের তদারক, বাড়িভাড়া আদায়-টাদায়—সবকিছু করেন। ভারি বিশ্বাসী আর ভাল লোক ; তবে মমাটেই বোকাসোকা নন।

‘তরুণার জীবনে শখ বলতে কিছু নেই। সেটাই তার সম্বন্ধে আমার অস্বস্তির কারণ। বছরে তিন-চারবার সে তীর্থে তীর্থে ঘোরে সরকারমশাইয়ের সঙ্গে। নতুন সাধু-সন্ন্যেসীর খবর পেলে সে ছুটে যায়। কিন্তু কোথাও অব মন টেঁকে না। আমাকে বলে, সব সময় সে যেন কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কী যে খুঁজছে, জানে না। অন্তত মাস চারেক আগে পর্যন্ত জানত না—’

বাধা দিয়ে অনুকূল বর্মা প্রশ্ন করলেন, ‘মাস চারেক কেন?’

‘কারণ মাস চারেক আগে স্বামী সহজানন্দের খোঁজ সে পায়। বারাসতে পঞ্চাশ বিঘে জায়গা জুড়ে স্বামীজীর বিরাট আখড়া। আগে সেখানে তরুণা যেত সপ্তাহে দু-তিনবার। তারপর দৈনিক। এখন সপ্তাহে দু-তিন দিন আখড়াতেই থাকে।’

স্বামীজীর চেলা কি সবাই মহিলা?’ পাইপে তামাক ভরতে ভরতে অনুকূল বর্মা প্রশ্ন করলেন।

‘প্রায় সবাই। আর—’একটু ইতস্তত করে কমলা থেমে গেল।

‘আর তাঁর চেহারাটা খুব সুন্দর!’ অনুকূল বর্মা কমলার কথাটা শেষ করে দিলেন। পাইপের পাশে তাঁর ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল :‘এরকম সুন্দর চেহারার সাধু-সন্ন্যেসী আর তাঁদের মহিলা শিষ্যাদের কথা তো নতুন নয়! কিন্তু তোমার দুর্ভাবনার কারণ কী?’

‘কারণ তরুণার ভাসা ভাসা সুন্দর চোখ দুটোর বিহ্বল চাউনির জন্যে। সে বলে স্বামীজীই স্বয়ং ভগবান। তাঁর অসাধ্য কিছু নেই। এ জীবনেই তিনি অনন্ত জীবনের স্বাদ দিতে পারেন, অনন্ত আনন্দের স্বাদ দিতে পারেন। সেই স্বাদ তরুণা নাকি পেয়েছে। এসব কথা তরুণা যখন বলে, তখন তার চোখ দুটো দেখে মনে হয় সুস্থ মানুষের চোখ নয়। তরুণার চাউনির জন্যে আমার যে অস্বস্তি হতে শুরু করে সেকথা ঠিক। শুধু আমার অস্বস্তির জন্যে আপনার কাছে আসতাম না। আমি এখন রীতিমত ভয় পেয়ে গেছি!’

‘ভয়! ভয় কেন?’

‘কারণ তরুণার সরকারমশাই আমার বাড়িতে এসে বলেছেন, তরুণা একটা উইল করার জন্যে তাদের উকিলবাবুকে ডেকেছে। তার যাবতীয় সম্পত্তি সে স্বামীজীকে দিতে চায়—’

‘তরুণার সম্পত্তি। সেটা যাকে ইচ্ছে দেবার তো তার অধিকার আছে!’

‘তা আছে মানি। কিন্তু আমার ভয়ের কারণ সেটা নয়— ’

‘থামলে কেন? বলে যাও—’

‘স্বামীজীর শিষ্যারা সবাই বড়লোক। গত বছর সেই রকম চারজন শিষ্যা মারা গেছেন। তাই আমার ভয় তরুণার জন্যে।’

‘কী ভাবে সেই সব মহিলাদের মৃত্যু হয়? তাঁরা কি কেউ খুন হয়েছিলেন! নাকি কোন রকম দুর্ঘটনায় মারা যান?’

‘না, না। নানা অসুখে তাঁরা মারা যান। একজন মারা যান নিউমোনিয়ায়। আর তিনজন মারা যান গ্যাস্ট্রিক আলসারে। স্বামীজীর আখড়ায় কেউ মারা যাননি। তাঁদের মৃত্য হয় নিজেদের বাড়িতে।

—কিন্তু কেন জানি না, অনুকূলবাবু, এই সব খবর শুনে পর্যন্ত তরুণা সম্বন্ধে আমার দারুণ ভয় হচ্ছে!’

টেবিলের একটা কোণ শক্ত করে চেপে ব্যাকুল দৃষ্টিতে কমলা তাকাল অনুকূল বর্মার দিকে।

চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন অনুকূল বর্মা। ঘরের মধ্যে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন।

হঠাৎ থেমে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘যে-সব মহিলা মারা গেছেন, তাঁদের নাম-ঠিকানা আমাকে দিতে পারো?’

কমলার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। সে বলল, ‘আমি জানতাম, তাঁদের নাম-ঠিকানা, আপনি জানতে চাইবেন। আমি আগেই জোগাড় করে রেখেছি। এই নিন।’

কমলা তার ব্যাগ থেকে একটা ভাঁজ-করা কাগজ অনুকূল বর্মার দিকে এগিয়ে দিল।

চেয়ারে বসে কাগজটা খুলে মন দিয়ে সেই মহিলাদের নাম-ধাম তিনি পড়লেন।

কী যেন খানিক ভাবলেন।

তারপর খুব গম্ভীর গলায় ধীরে ধীরে বললেন, ‘তুমি ভারি বুদ্ধিমতী! আমি জানি, তোমার সাহসেরও অভাব নেই। আর তুমি খুব ভাল অভিনয় করতেও পার। —একটা কাজ করতে পারবে? —কিন্তু আগে থেকেই সাবধান করে দিচ্ছি, এই কাজটার মধ্যে বেশ খানিকটা কিন্তু বিপদের ঝুঁকি আছে।’

মাথা ঝাঁকিয়ে কমলা বলল, ‘ভয়-ডর আমার খুব কম। তাছাড়া, তরুণার জন্যে সবকিছু আমি করতে পারি।’

আগেকার মতই গম্ভীর গলায় অনুকূল বর্মা ধীরে ধীরে বলে চললেন, ‘ব্যাপারটা ভাল করে জানতে হলে এই স্বামীজীর শিষ্যা তোমাকে হতে হবে। কথায় কথায় স্বামীজীকে জানাবে লটারিতে তুমি দেড় লাখ টাকা পেয়েছ। জানাবে কলকাতায় তোমার দোতলা বাড়ি আছে। কিন্তু প্রথম দরকার তরুণার সঙ্গে তর্ক করা। তাকে বলা—স্বামীজী একটা বোগাস, জোচ্চোর! তোমার কথা শুনলে, তরুণা নিশ্চয়ই চেষ্টা করবে তোমার মত পাল্টাতে। নিশ্চয়ই তোমাকে বলবে, তার সঙ্গে স্বামীজীর আখড়ায় যেতে। গজগজ করতে করতে যেতে তুমি রাজী হবে। আখড়ায় যাবে। তারপর এমন ভাব দেখাবে—স্বামীজী তোমাক মোহিত করে ফেলেছেন।’

কমলা বলল, ‘আপনার কথামত কাজ করা মোটেই শক্ত নয়। অনায়াসে পারব।’

পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে অনুকূল বর্মার কথা হচ্ছিল। তিনি বললেন, স্বামী সহজানন্দর কথা আমি বিলক্ষণ জানি। লোকটা আমার দু’চক্ষের বিষ। কিন্তু একটা ইন্টারেস্টিং খবর জানেন?—লোকটা পণ্ডিত! কেমিস্ট্রিতে আমেরিকার ইয়েল য়ুনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট পেয়েছিল। আসল নাম অজয় গুপ্ত। বারাসতে তার আখড়ার মধ্যে চমৎকার একটা ছোট ল্যাবরেটরি আছে। অবসর সময় সেখানে সে রিসার্চ করে। তার রিসার্চের প্রবন্ধ বিদেশের নানা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। অনেক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক তার কাজের তারিফ করেছেন। লোকটা হঠাৎ স্বামীজী সাজলো কেন—সেটাই হেঁয়ালি। সে যে সত্যিকারের ক্ষমতাবান বৈজ্ঞানিক সেকথা যেমন ঠিক, তেমনি ধনী মহিলাদের এই জীবনে অনন্ত জীবন, অনন্ত আনন্দ দেবার প্রতিশ্রুতিও বিরাট একটা বুজরুকি। মেয়েরা তার জন্যে পাগল। এ-কথা স্বীকার না করে উপায় নেই—লোকটার দারুণ হিপনোটিক পাওয়ার আছে।’

‘হালে যে-চারজন মহিলা মারা গেছেন, যাঁদের নাম-ঠিকানা আপনাকে দিয়েছিলাম—তাঁদের সম্বন্ধে খবর নিয়েছিলেন?’

নিয়েছিলাম, মিস্টার বর্মা। কিন্তু তাঁদের মৃত্যুর মধ্যে সন্দেহজনক কিছু নেই। সুভদ্রা যোশী মার যান টি-বি’তে। সহজানন্দের শিষ্যা হবার অনেক আগেই তাঁর টি-বি হয়েছিল। ডাক্তাররা মনে করেন, তিনি সেরে গেছেন। হঠাৎ অসুখটা কেন যে রিল্যাপস্‌ করল স্পেশালিস্টরা বুঝতে পারছেন না। সুষমা রায় মারা যান টাইফয়েডে। নন্দিতা আর শ্যামলী দেবী মারা যান গ্যাস্ট্রিক আলসারে। সবাইকারই মৃত্যু হয় নিজেদের বাড়িতে। স্বামীজী কিংবা তার আখড়ার সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।’

একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন অনুকূল বর্মা। বললেন,‘সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যাচ্ছে না বলেই আমার দুর্ভাবনা।’

হেসে উঠে পুলিশ কমিশনার বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, মিস্টার বর্মা। আমার মনে হয়, অযথা, সন্দেহ আর দুর্ভাবনা করা আপনার একটা বাতিক।’

কমলা বলল, ‘একটা কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে, তরুণা—স্বামীজীর এই মঠে এসে বাস্তবিক অমি ভারি শান্তি পেয়েছি।’

তরুণার ভাসা-ভাসা চোখ দুটো উৎসাহে জ্বলজ্বল করে উঠল। সে বলল, সে-কথা আগেই তোমাকে বলি নি?’

‘গতকাল সন্ধ্যেয় প্রার্থনা-সভায় অনন্ত জীবন আর অনন্ত আনন্দের কথা স্বামীজী ভারি সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছিলেন।’

‘জানতুম—এখানে এলে, স্বামীজীকে দেখলে, তাঁর বক্তৃতা শুনলে, মোহিত না হয়ে কেউ পারে না। আজ পূর্ণিমা। প্রতি পূর্ণিমার রাতে স্বামীজী উৎসব করেন। সেই উৎসবে অনন্ত আনন্দের স্বাদ তিনি আমাদের দেন। আজ সন্ধ্যেয় সেই আনন্দ পাবার পর, তোমার মন থেকে সব রকম অবিশ্বাস মুছে যাবে।’

‘সেই আনন্দের স্বাদ পাবার জন্যে, সত্যি, স্বীকার করছি, ভারি আগ্রহ নিয়ে আমি অপেক্ষা করছি।’

বারাসতে স্বামী সহজানন্দের মঠে দিন পাঁচেক আগে কমলা এসেছিল।

স্বামীজীকে সে বলেছিল, ‘আমি গোঁড়া হিন্দু পরিবারের মেয়ে। আপনাকে বলে রাখা ভাল, আপনি যে নতুন ধর্ম প্রচার করছেন, তাতে আমার আদৌ কোন বিশ্বাস নেই। তবে তরুণা আমার বিশেষ বন্ধু। তার অনুরোধেই সব কিছু দেখতে এসেছি।’

স্বামীজী মধুর হেসে বলেছিলেন, ‘কমলা দেবী, আপনি তরুণার বন্ধু। তাই আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। শুধু বিশ্বাস করুন, আমি বুজরুকি করছি না। যে ধর্ম প্রচার করছি, সেটা স্বপ্নে ভগবান আমায় আদেশ দিয়েছেন। আমার মঠের দরজা সবাইকার জন্যেই খোলা। আপনি হিন্দু মুসলমান, ক্রিশ্চান, বৌদ্ধ—যাই হোন না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। আপনি থাকুন, আপনি দেখুন, আপনি শুনুন—এর চেয়ে আমার বেশি বলার কিছু নেই।—আমার পিতার এই আশ্রমে বহু প্রাসাদ আছে জানবেন।’

তরুণাকে কমলা তারপর বলেছিল, ‘স্বামীজীর চেহারা বাস্তবিকই ভারি সুন্দর। এ-রকম সৌম্য পুরুষ কখনো দেখি নি।’

উৎসাহিত হয়ে তরুণা বলেছিল, ‘বলি নি?’

সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। শরতের পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে-বাতাসে আলোর বন্যা এনেছে। প্রার্থনা সভার মঞ্চের সামনে জমায়েত হয়েছে মঠের শিষ্য-শিষ্যারা। শিষ্যাদের সংখ্যাই বেশি।

মঞ্চের ওপর স্বামী সহজানন্দ এসে দাঁড়ালেন। পরনে তাঁর সিল্কের সোনালি আলখাল্লা। তিনি হাত তুলতে সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল। তিনি বললেন, ‘আমার হরিণরা কোথায়?’

ভক্তের দল একসঙ্গে বলে উঠল ; ‘স্বামীজী, আমরা হাজির।’

‘তোমাদের হৃদয় মুক্ত কর। আনন্দ নাও। আনন্দ নাও। আজ আনন্দের উৎসব।’

‘আজ আনন্দের উৎসব।’

‘আজ শান্তির উৎসব।’

‘আজ শান্তির উৎসব।

‘কোন দুঃখ নেই। কোন বেদনা নেই। শুধু আনন্দ।’

‘শুধু আনন্দ⋯’

‘আমার হরিণদের ক’টা করে দেহ?’

‘রক্তমাংসের দেহ। পাপের দেহ। আলোর দেহ।’

‘কী দিয়ে দীক্ষা নেবে?’

‘রক্ত দিয়ে।’

‘দীক্ষা নিতে তোমরা প্রস্তুত?’

‘আমরা প্রস্তুত।’

‘গেরুয়া কাপড় দিয়ে নিজেদের চোখ তোমরা বাঁধো। তারপর সব হাত বাড়িয়ে দাও।’

ভক্তের দল নিজেরাই নিজেদের চোখ বাঁধল। তারপর বাড়িয়ে দিল তাদের ডান হাত।

কমলাও—

স্বামীজী এলেন তার কাছে। তুলে নিলেন তার হাত। কমলার মনে হল তার হাতে যেন ছুঁচ ফুটল।

স্বামীজী বললেন, ‘রক্ত দিয়ে তোমার দীক্ষা হল।’

তিনি সরে গেলেন।

খানিক পরে তাঁর আদেশ হল : ‘চোখ খোল। হৃদয় খোল। আনন্দ নাও। আনন্দ⋯শুধু আনন্দ⋯’

কমলা চারদিকে তাকাল। জ্যোৎস্নার বন্যায় আকাশ বাতাস পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সে পুকুরপাড়ে ঘাসের ওপর গিয়ে বসল। তারপর হঠাৎ উদ্দাম আনন্দে ভরে গেল তার দেহ-মন।

জীবন কী আশ্চর্য সুন্দর সে নিজে কি আশ্চর্য সুন্দর⋯ অসীম তার ক্ষমতা⋯·সবকিছু সে করতে পারে⋯·পৃথিবী থেকে সে মুছে দেবে যুদ্ধ আর অ্যাটম বোমার আতঙ্ক⋯দূর করবে সে অগণিত মানুষের দারিদ্র্য ⋯পৃথিবীতে অসুখ বলে কিছু থাকবে না⋯জীবনে দুঃখ বলে কিছু থাকবে না⋯নতুন একটা পৃথিবী সে গড়বে⋯সে পৃথিবীতে শুধু আনন্দ—আনন্দ আর আনন্দ⋯

কমলার যখন ঘুম ভাঙল, শরীরটা তার আড়ষ্ট। হাতঘড়িতে দেখল রাত প্রায় বারোটা।

সে চমকে উঠল। তিনঘণ্টা ধরে সে স্বপ্ন দেখেছে! কিন্তু অবাক না হয়ে সে পারল না। মানুষকে আনন্দ দেবার কী আশ্চর্য ক্ষমতা স্বামীজীর!!

অনুকূল বর্মা বললেন, ‘যা যা বলছি, নির্ভুল ভাবে সেগুলো করতে পারবে তো, কমলা?’

কমলা বলল, ‘নিশ্চয়ই।’

স্বামীজীকে বলেছ লটারিতে টাকা পাবার কথা?’

‘বলেছি।’

‘বলেছ উইল করে তোমার সব টাকা মঠকে দিতে চাও?’

‘বলেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন অনুকূলবাবু, স্বামীজী টাকা-পয়সা সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন। আমাকে বলেছেন, ‘যা পারো দিও। কিছু না দিলেও এসে যায় না। তোমাকে আমি শিষ্যা করে নিয়েছি।’

অনুকূল বর্মা মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার স্বাস্থ্যের কথা বলেছ?’

‘বলেছি ছেলেবেলায় আমার টি-বি হয়েছিল। কশৌনির স্যানেটোরিয়ামে চিকিৎসার পর ভাল হয়ে গেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না আমাকে দিয়ে এই মিথ্যে কথাটা বললেন কেন? আমার লাংস তো সম্পূর্ণ সুস্থ!’

‘বিশ্বাস কর কমলা, এটা বলা দরকার ছিল। তরুণা সম্বন্ধে যা বলতে বলেছিলাম, স্বামীজীকে বলেছ সেকথা?’

‘বলেছি তার এক মামাশ্বশুর তার স্বামীর চেয়েও ধনী। তিনি খুব অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে বেশিদিন তিনি বাঁচবেন না। তিনি মারা গেলে তাঁর সমস্ত সম্পত্তিও তরুণা পাবে।’

‘খুব ভাল। আশা করি তরুণার শিগগির কোন বিপদ হবে না।’

‘সত্যি সত্যি তার বিপদ ঘটতে পারে বলে মনে করেন?’

‘সেটা জানবার চেষ্টাই তো করছি। ভাল কথা, মঠে পরিমল বলে কাউকে দেখেছ?’

‘তাকে না দেখে উপায় কি? লোকটা সবুজ লুঙ্গি আর টকটকে লাল ফতুয়া পরে। গাজর ছাড়া আর কিছু খায় না। কিন্তু স্বামীজীর ওপর তার প্রচণ্ড ভক্তি।’

‘চমৎকার! সবকিছু ঠিক ঠিক চলছে। এখন শুধু আগামী পূর্ণিমার উৎসবের জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

আবার পূর্ণিমা এসেছে। আকাশে-বাতাসে বইছে আলোর বন্যা। প্রার্থনা-সভার মঞ্চের সামনে জমায়েৎ হয়েছে মঠের শিষ্য-শিষ্যার দল। তাদের মধ্যে পনেরো জন নতুন শিষ্য। আজ তারা রক্ত দিয়ে প্রথম দীক্ষা নেবে।

সোনালি সিল্কের আলখাল্লা পরে স্বামী সহজানন্দ এসে দাঁড়ালেন মঞ্চের ওপর।

তাঁর মিষ্টি রিনরিনে স্বর শোনা গেল।

‘দীক্ষার জন্যে তোমরা প্রস্তুত?’

‘আমরা প্রস্তুত।’

‘নিজেদের চোখ বেঁধে ডান হাত বাড়িয়ে দাও।’

কমলার পাশে সবুজ লুঙ্গি আর লাল ফতুয়া পরে দাঁড়িয়ে ছিল সেই ভক্ত পরিমল, গাজর ছাড়া অন্য কিছু যে খায় না।

মঞ্চ থেকে নেমে ভক্তদের মধ্যে স্বামীজী ঘুরতে লাগলেন।

পরিমলের হাতে ছুঁচ ফুটতে ভাবাবেগে অস্ফুট স্বরে সে বলে উঠল, ‘আনন্দ—আনন্দ⋯’

কমলার হাত তুলে নিলেন স্বামীজী।

হঠাৎ একটা বজ্র কঠিন স্বরে সবাই চমকে উঠল, ‘থামুন—’

তারপর ধস্তাধস্তির শব্দ। স্বামীজীর ক্রুদ্ধ হুঙ্কার। ভক্তের দল চোখের বাঁধন খুলে দেখল একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য—সেই সবুজ লুঙ্গি পরা পরিমল আর নতুন একজন ভক্ত স্বামীজীকে চেপে ধরেছে।

পরিমল বজ্র কঠিন স্বরে বলে চলল, ‘আপনাকে গ্রেফতার করা ওয়ারেন্ট আমার কাছে আছে—’

সেই সঙ্গে দেখা গেল মঠের ফটক দিয়ে ইউনিফর্ম-পরা একদল লোককে এগিয়ে আসতে।

এক ভক্ত চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী সর্বনাশ! এরা পুলিশ! স্বামীজীকে যে ধরে নিয়ে যাচ্ছে⋯’

ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর পরিমল রায় মাটি থেকে হাইপোডার্মিক সিরিঞ্জটা তুলে সাবধানে রুমাল দিয়ে জড়াতে লাগলেন। স্বামীজীর হাত থেকে সেটা খসে পড়েছিল।

পুলিশ কমিশনার বললেন, ‘আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন, কমলা দেবী। আপনার সাহায্য না পেলে ধড়িবাজ অজয় গুপ্তকে আমরা ধরতে পারতাম না। লোকটার ওপর অনেক দিন থেকেই আমাদের নজর ছিল।’

অনুকূল বর্মা বললেন, ‘আমি জানতাম, কমলা খুব ভাল অভিনয় করতে পারে। আর তার সাহসেরও অভাব নেই। কমলাকে একটা মারাত্মক বিপদের ঝুঁকি নিতে বলার পর থেকে আমার মনে শান্তি ছিল না।’

কমলা বলল, ‘এখনো আমি ভাল করে কিছু বুঝতে পারছি না। সিরিঞ্জটায় কী ছিল?’

অনুকূল বর্মা গম্ভীর স্বরে বলে চললেন, ‘অজয় গুপ্ত একদিকে যে-রকম জিনিয়াস, অন্যদিকে সে-রকমই ভয়ঙ্কর ক্রিমিন্যাল। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিখুঁতভাবে মার্ডার করে ধনী মহিলাদের সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়। আশ্রমের মঠে নানা ভয়ঙ্কর রোগ জীবাণু সে কালচার করত। উৎসবের দিন ভক্তদের হাতে সামান্য ডোজে ভাং সে ইনজেক্ট করে দিত। তার ফলে ভক্তদের মনে একটা অদ্ভুত আনন্দের মোহ কিছুক্ষণের জন্যে জন্মাতো। এই নেশার দরুণ শিষ্য-শিষ্যারা তাকে ছেড়ে যেত না। কিন্তু তার আর একটা উদ্দেশ্যও ছিল। সেটা হল, ধনী বিধবা মহিলাদের মার্ডার করে তাদের বিষয়-সম্পত্তি হাতানো। তার অসাধারণ সুন্দর চেহারা, আশ্চর্য বক্তৃতা দেবার ক্ষমতায় মহিলারা মুগ্ধ হত। আনন্দের স্বাদ পেয়ে কৃতজ্ঞতায় নিজেদের যথাসর্বস্ব তাকে লিখে দিত। তারপর একে-একে মৃত্যু হত তাদের। তাদের মৃত্যু হত নিজেদের বাড়িতে। ডাক্তার মনে করত নানা অসুখে ভুগে তাদের মৃত্যু হয়েছে।—ব্যাপারটা সহজ করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি।—ধর ব্যাসিলাস কোলি কমিউনিস। সেটা ইনজেক্ট করলে কিছুকাল পরে হয় আলসার আর কোলাইটিস। টাইফয়েডের জীবাণু ইনজেক্ট করলে হয় টাইফয়েড। নিউমোকক্‌কাস্‌ জীবাণু দিলে হয় নিউমোনিয়া। ওল্ড টিউবারকিউলিন দিলে সুস্থ লোকের কিছু হয় না, কিন্তু আগে যে টি-বি’তে ভুগেছে, তার হয় টি-বি। ধনী মহিলাদের এই সব জীবাণু সে ইনজেক্ট করত। লোকটার শয়তানীর কথা ভেবে দেখ। শহরের নানা জায়গায় নিজেদের বাড়িতে মহিলারা মারা যেতেন। আলাদা-আলাদা ডাক্তার তাঁদের চিকিৎসা করতেন। অজয় গুপ্তকে কে সন্দেহ করবে?’

পুলিশ কমিশনার বললেন, ‘এ-রকম শয়তান ক্রিমিন্যাল ইতিহাসে খুব কমই দেখা গেছে।’

অনুকূল বর্মা বলে চললেন, ‘ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর পরিমল রায় তাকে যখন অ্যারেস্ট করেন, তখন সিরিঞ্জের মধ্যে ছিল ওল্ড টিউবারকিউলিন। তুমি কখনো টি-বি’তে ভোগোনি। তাই সেটায় তোমার ক্ষতি হত না। সে-কারণেই তোমাকে বলেছিলাম বলতে যে, আগে তুমি টি-বি’তে ভুগেছ। কিন্তু সব সময়েই আমি দারুণ আতঙ্কে ছিলাম।—লোকটি যদি অন্য কোন জীবাণু তোমাকে ইনজেক্ট করে—’

পুলিশ কমিশনার বললেন, ‘আপনার সাহস, আপনার অভিনয়, আপনার বুদ্ধি—সব কিছুর জন্যে আমরা কৃতজ্ঞ। আবার আপনাকে আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।’

শিশুর মত হেসে উঠল কমলা। বলল, ‘আমাকে লজ্জা দেবেন না। আমি যদি আমার বন্ধু তরুণার জীবন বাঁচাতে পেরে থাকি, মনে করব সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। কিন্তু স্বামীজী—মানে, ডাক্তার অজয় গুপ্তকে শাস্তি দেবার সব রকম প্রমাণ আপনাদের আছে কি?’

পুলিশ কমিশনার বললেন, ‘কমলা দেবী,আপনি শুধু আপনার বন্ধুর জীবন বাঁচান নি। অনেক মহিলার জীবন বাঁচিয়েছেন।—আর প্রমাণের কথা বলছেন? হ্যাঁ, অনেক প্রমাণ আমরা পেয়েছি। মঠের সমস্ত ল্যাবরেটরি বিশেষজ্ঞরা এখন পরীক্ষা করছেন। প্রমাণের অভাব হবে না।—একটা কথা। সবচেয়ে দুঃসাহসী কাজের জন্যে পুলিশের একটা মেডেল আছে। আপনাকে সেটা দেওয়া হবে।’

আবার ছেলেমানুষ মেয়ের মত কমলা হাসল। বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ। নিশ্চয়ই নোব। আমার ঝুমড়ু সেটা পরবে।’ কমলা হেসে নমস্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পুলিশ কমিশনার অনুকূল বর্মার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, ‘মহিলা সুস্থ আছেন তো? ঝুমড়ু কে?’

অনুকূল বর্মা বললেন, ‘কমলার মত মেয়ে হয় না। ঝুমড়ু তার পমেরানিয়ান কুকুর। সেটা মস্ত বড় কাহিনী। আপনাকে বলা হয় নি।—একদিন বলব।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *