1 of 2

সঙ্কেত – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

সঙ্কেত – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

কিরীটী পায়ের ’পরে পা তুলে টেবিলটার ’পরে রেখে মৃদু মৃদু নাচাচ্ছিল। খোলা জানালা পথে দিনান্তের শেষ সূর্যরশ্মি কৃষ্ণচূড়া গাছটার পত্রবহুল শীর্ষে শীর্ষে শেষ পরশটুকু দিয়ে যাচ্ছে—দৃষ্টি সেই দিকেই প্রসারিত।

আমি সেদিনকার দৈনিক ‘রাজপথ’টার পাতা উল্টাচ্ছিলাম।

হঠাৎ একসময় কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চোখ তুলে তাকালাম। কিরীটী বলছিল, ‘পাজল’ কাকে বলে জানিস সুব্রত?’

‘কাকে বলে?’ প্রশ্ন করলাম স্মিত হাস্যে।

‘পাজল—অর্থাৎ যা চিন্তাশক্তির ঘূর্ণাবর্ত রচনা করে। কিছুদিন হল, রাত্রে শৈলেশদের ওখানে আজকাল ব্রীজ খেলতে যাই—’

‘শৈলেশ! ওঃ, আমাদের নতুন ব্যারিস্টার সাহেব?’

‘হ্যাঁ, আগামী কালের উদীয়মান ব্যারিস্টার শৈলেশ বোস।’

‘মিস্টার বাসু, বার-অ্যাট-ল! তোরা জানিস না ব্রীজ খেলায় ও ভারি ওস্তাদ একজন। পনের কুড়ি দিন খেলে দেখলাম আমাদের প্রতি রাত্রেই প্রায় চার পাঁচটা করে রাবার করেছে। অদ্ভুত ক্যালকুলেশন। মনে হয় এক পিট খেলবার পরই বাকি তিন হাতের তাস ও যেন প্রত্যেকটি জেনে নিচ্ছে⋯আজও রাত্রে শৈলেশের ওখানে ব্রীজ খেলবার নেমন্তন্ন আছে।’

কিছুদিন ধরে আমিও ব্রীজ খেলা শুরু করেছি, কিরীটী সে কথা জানে। বোধ হয় ও সেই জন্যই কথাটা বললে।

কিন্তু একটু আগের ‘পাজল’ কথাটার সঙ্গে ওর কথার শেষাংশের সম্পর্কটা ঠিক কি বুঝে উঠতে পারলাম না।

জানি ওকে ভাল রকমই—নিজে থেকে কিছু না বললে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন কিছুই জানা যাবে না। বলবে তো না-ই বিরক্ত হবে।

হঠাৎ এমন সময় আবার কিরীটী নিজে থেকেই বলে ওঠে, ‘সেটাই হয়েছে আমার কয়েক দিন থেকে বর্তমান ‘পাজল’! আমি শৈলেশকে কলেজ থেকে জানি—অঙ্কে মাথা ছিল না বলেই আর্টস নিয়েছিল। তাছাড়া বুদ্ধির ব্যাপারে ও চিরদিনই একটু ভোঁতাই দেখেছি। হঠাৎ সেই শৈলেশ বিলাত ঘুরে কয়েকটা ডিনার দিয়ে বাপের পয়সায় ব্যারিস্টারির ছাপ নিয়ে এসে বুদ্ধিমান বনে গেল। how’s that! বিলেত দেশটা কি তাহলে সত্যিই মাটির নয়!’

‘অঙ্কে মাথা ছিল না বলেই যে ব্রীজ খেলতে মাথা খেলবে না, তাই বা তোর কেমন যুক্তি কিরীটী?’

‘না, ভাল ব্রীজ খেলতে হলে কেবল প্র্যাকটিসই নয়, অঙ্কশাস্ত্র জানা দরকার। বুদ্ধি বিবেচনা ও বিচারশক্তি না থাকলে ভাল ব্রীজ খেলা চলে না। শৈলেশের কোনটাই নেই—অবশ্য যদি আমার নিজস্ব বিশ্লেষণ ঠিক হয়ে থাকে। দ্যাট ইজ দ্য পাজল—ধাঁধাঁ!’ বলতে বলতে হঠাৎ কথার মোড় ঘুরিয়ে বলে, ‘তুইও ব্রীজ খেলায় বর্তমানে শুনি অনেস্টলি হাত পাকাচ্ছিস। চল না, যাবি শৈলেশের ওখানে আজ রাত্রে খেলতে? তোকে পেয়ে নিশ্চয়ই ও খুশি হবে।’

বিশেষ কোন কাজকর্ম নেই হাতে। বললাম, ‘বেশ তো!’

গাড়ি চালাতে চালাতে একসময় কিরীটী বললে, ‘একটা কথা সু’ তোকে বলা হয়নি। শৈলেশের ওখানে যে ব্রীজ খেলা হয়, সেটা ঠিক কিন্তু নট এ গেম ফর দ্য গেম’স সেক! মানে ঠিক দু’দশ টাকার খেলা নয়—একটা ‘রাবার’ মানেই পাঁচশো টাকা!’

‘বলিস কি! তাহলে বল জুয়ো খেলা?’

স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে গাড়ি চালাতে চালাতে সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কিরীটী মৃদুস্বরে বলে, ‘তা একপ্রকার জুয়োখেলাই বটে! যদিও জুয়ো ব্যাপারটাই সম্পূর্ণ আপেক্ষিক—’

‘আপেক্ষিক?’

‘তা নয়তো কি? জীবনে বেঁচে থাকবার চেষ্টা মাত্রই তো জুয়োখেলা।’

‘জুয়ো কে না খেলছে বল?’

কিরীটীর আজকের কথাটা শুনে যেন বিস্ময়ে ‘থ’ হয়ে গেলাম। কিরীটীর মুখে কোনদিন এমন কথা শুনব স্বপ্নেরও অগোচর। কারণ ওর সঙ্গে প্রথম আলাপের সময় থেকেই একটা জিনিস বরাবর লক্ষ্য করেছি, চরিত্রের দিক দিয়ে কিরীটীর একটা লৌহকঠিন নীতি আছে যা একপ্রকার দুর্ভেদ্য বললেও চলে। নীতির কোন বিকার নেই বটে, তবে মানসিক একটা অসাধারণ সত্যতা আছে। আছে একটা চারিত্রিক নিষ্ঠা। বস্তুত যার জন্য চিরদিন ওকে আমি গোপনে শ্রদ্ধা করেছি⋯আন্তরিক ভালবেসেছি। সেই কিরীটী—

যখনকার কথা বলছি, বালিগঞ্জ অঞ্চলে অভিজাত সম্প্রদায়ের সুরম্য অট্টালিকার চাপে ওদিকটা তখনো তেমন ঘিঞ্জি হয়ে ওঠেনি। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কয়েকখানা বাড়ি আর বেশির ভাগই তখন পোড়ো জমি—ধানের ক্ষেত। লেক তখনো মানুষের কল্পনার বাইরে। শৈলেশের পিতা রাধামোহনবাবু কলকাতা শহরের একজন বিখ্যাত ব্যবহারজীবী ছিলেন। জীবনে তিনি প্রচুর অর্থ উপায় করেছিলেন। একমাত্র ছেলে শৈলেশ, ইচ্ছা ছিল ছেলেকে বিলাত থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করিয়ে এনে হাইকোর্টে তার পসারটা জমিয়ে দিয়ে যাবেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আর। ছেলেকে বিলাত পাঠিয়ে বালিগঞ্জের দিকে জমি কিনে বাড়ি তৈরি শুরু করলেন।

দেখতে দেখতে চার চারটে বছর কেটে গেল। শৈলেশ ব্যারিস্টারি পাশ করে কন্টিনেন্টে তখন টুর করে বেড়াচ্ছে। এদিকে শৈলেশের বিলাত যাবার বছর খানেক পরেই শৈলেশের পিতা আকস্মিক ভাবে একদিন হাইকোর্টের মধ্যেই পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। পুত্রস্নেহে অন্ধ পিতা দূরপ্রবাসী পুত্রকে এ দুঃসংবাদ দিয়ে ব্যস্ত করতে চাইলেন না। শৈলেশের বয়স যখন মাত্র বারো বছর, তখনই তার মাতৃবিয়োগ হয়েছিল। রুগ্ন অসুস্থ শৈলেশের পিতার বাড়িতে অনেক দাসদাসী আছে বটে, কিন্তু সত্যিকারের আপনার জন কেউ ছিল না। দূর সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনের দল এসে শৈলেশের পিতার চারপাশে ভিড় করে দাঁড়াল।

ক্রমে নতুন বাড়িও নির্মাণ শেষ হল। আত্মীয়ের দল রুগ্ন শয্যাশায়ী শৈলেশের পিতাকে নিয়ে নতুন বাড়িতে উঠে এল।

দীর্ঘকাল শয্যাশায়ী থেকেও ত্রুটি কোথাও রাখেননি ভদ্রলোক। আগের মতই সব চলতে থাকে।

দীর্ঘ চার বছর পরে শৈলেশ যেদিন বম্বেতে এসে জাহাজ থেকে নামল, সেই দিনই দীর্ঘ অদর্শনের তীব্র ক্ষুধা বুকে নিয়েই তার পিতার শেষ নিশ্বাস বায়ুস্তরে মিলিয়ে গেল।

তারপর লোকে দেখলে ও জানলে, সদ্য বিলেত-প্রত্যাগত নব্য ব্যারিস্টার মিঃ শৈলেশ বাসু প্র্যাকটিস শুরু করেছে হাইকোর্টে। এবং সেই সঙ্গে সঙ্গেই অন্দর থেকে ক্রমে একজন দুজন কবে আত্মীয়ের দল অগস্ত্য যাত্রা করতে লাগল নিঃশব্দে।

অকৃপণ ভাবেই খরচ করে অতি আধুনিক কেতায় তৈরি হয়েছিল জাহ্নবী-ভবন।

বাড়ির জাঁক-জমক, শৈলেশের চালচলন দেখে বহু লোকেরই ঈর্ষার উদ্রেক যে হয় একথা সকলেই জানে।

পাঁচ মুখে প্রকাশ্যেই শৈলেশের ধন-দৌলতের কথা আলোচিত হত। ঘাগী উকিল ছিলেন শৈলেশের পিতা, বহু টাকা রেখে গেছেন, অগুন্তি। তা নাহলে এখনো এমন চালচলন বজায় রাখে কি করে? ব্যারিস্টারি করে একটি কপর্দকও আজ বছর দুই শৈলেশ যে রোজগার করেনি, তা বারের সকলেই জানতেন।

শৈলেশ কিন্তু বেপরোয়া।

বিলাত থেকে শৈলেশ আর কিছু শিখে আসুক আর নাই আসুক, ব্রীজ খেলায় সে যে একজন ওস্তাদ হয়ে এসেছে—একথাটা কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই হঠাৎ কেমন রাষ্ট্র হয়ে গেল বিশিষ্ট একটি মহলে।

নিত্য নিয়মিত শৈলেশের বাড়িতে রাতের পর রাত ব্রীজের আসর বসতে লাগল। এবং আসরে অনেকেই হানা দিতে শুরু করলে।

শৈলেশ লোকটা দেখতে অত্যন্ত সুপুরুষ। কথায় বার্তায়, চালচলনে বিশেষ কেতাদুরস্ত। আচার-ব্যবহারে আমীর বললেও চলে। আলাপ জমাতেও সে অদ্বিতীয়।

শীঘ্রই সে আধুনিক বিশেষ একটি সমাজে একটি বিশেষ স্থান করে নিল। ব্রীজ খেলার আসরটি কিন্তু আসলে ছিল প্রকাশ্যেই পুরোপুরি একটি জুয়োখেলার আসর। আসরে সকলেই তা জেনেই আসত।

শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে টাকা প্রতি রাত্রে ভোজবাজীর মত যেন ডানা মেলে উড়ে চলেছে এক পকেট থেকে অন্য পকেটে। কথাটা এ-কান ও-কান হতে হতে অকস্মাৎ কিরীটীর কানেও আসতে স্বেচ্ছায়ই গিয়ে সে একদিন আড্ডায় হাজির হল। সোল্লাসে শৈলেশ তাকে আহ্বান জানাল ব্রীজের আসরে।

দু-চারদিন আসরে নিয়মিত হাজিরা দিয়েই একটা জিনিস কিরীটী আবিষ্কার করলে—খেলাটা প্রায় প্রতি রাত্রেই এক দিকেই গতি নেয়। যে পক্ষেই শৈলেশ থাকে, অনিবার্য ভাবে সেই পক্ষেরই জিত হয়। সংক্ষেপে কিরীটী গাড়ির মধ্যেই ব্রীজ আসরের ইতিহাসটা আমাকে শুনিয়ে বললে, ‘বাকি ঘটনা তুই এবার চোখ মেলে নিজে দেখবি ও মনে মনে পর্যবেক্ষণ করবি। এই যে আমরা এসে গেছি।—বলতে বলতে একটা গেটওয়ালা বাড়ির মধ্যে আমরা এসে প্রবেশ করলাম।

সামনেই প্রকাণ্ড ঘোরানো পোর্টিকো, একপাশে টেনিস লন। পোর্টিকোর নিচে তখন খান সাত-আট নানা আকারের দামী দামী গাড়ি দাঁড়িয়ে।

গাড়ি থেকে নেমে কিরীটীকে অনুসরণ করলাম।

প্রশস্ত হলঘর। একধারে দোতলায় উঠবার সিঁড়ি।

সমস্ত বাড়িটা যেন একেবারে কবরখানার মতই স্তব্ধ! হঠাৎ গা’টা যে কেমন ছমছম করে উঠল।

প্রশস্ত হলঘরখানি সোফা ও সেটিতে সুসজ্জিত, মেঝেতে পুরু কার্পেট বিছানো, একটি মাত্র ডিম্বাকৃতি সিলিং থেকে ঝুলন্ত বাতি থেকে যে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল, অত বড় হলঘরটাকে আলোকিত করতে মোটেই সেটা পর্যাপ্ত নয়। সমগ্র ঘরখানি জুড়ে আলোছায়ার যেন একটা লুকোচুরি চলেছে।

নিঃশব্দে আমরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম।

স্বল্পালোকিত একটা টানা বারান্দা; বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছতেই বহু লোকের মিলিত কণ্ঠের মৃদু গুঞ্জন ধ্বনি কানে এসে প্রবেশ করল।

সামনেই একটা ঘরের দরজায় ঝুলন্ত পর্দার অন্তরাল থেকে মৃদু চাপা আলোর একটা ইশারা বাইরের টানা বারান্দায় এসে যেন অনধিকার প্রবেশ করেছে। প্রথমে কিরীটী ও পশ্চাতে আমি পর্দা সরিয়ে নির্দিষ্ট কক্ষ মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম।

‘গুড ইভনিং এভরিবডি!’ কিরীটীর মৃদু সংযত কণ্ঠস্বরে মুহূর্তে ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেরই দৃষ্টি আমাদের ওপর এসে পড়ল।

‘পরিচয় করিয়ে দিই—আমার বন্ধু সুব্রত রায়, মিলিয়নীয়ার।’ পরিচয়ের পালা সাঙ্গ হল একে একে।

এবং পরিচয়েই বুঝলাম, এখানে যারা উপস্থিত, সকলেই অর্থসম্পন্ন ও উচ্চস্তরের বাসিন্দা।

প্রথমেই পরিচয় হল রামগড়ের কুমার বাহাদুর হরিরামের সঙ্গে। বছর পাঁচেক হল বাপের মৃত্যুর পর তিনিই এখন স্টেটের সর্বেসর্বা। দ্বিতীয়, নিম্‌তের জমিদার সুখেন্দু রাণা! তৃতীয়, বিখ্যাত জুয়েলার গুর্জনওয়ালা শেঠ! চতুর্থ, মীরপুর স্টেটের সেক্রেটারি ও সর্বময় কর্তা ধনপতি ঘোষাল। এরা ছাড়া বাকি সব কেউ বিখ্যাত অ্যাডভোকেটের পুত্র, কেউ বিজনেসম্যান, কেউ ব্রোকার ইত্যাদি।

সকলেরই হাতে কফির পাত্র—ঘরের এক পাশে একটা টেবিলে ‘বুফে’ সাজান, নানা প্রকারের দেশী বিলিতি খানা সুসজ্জিত। কেউ কেউ খাচ্ছেনও কফি পানের সঙ্গে সঙ্গে। আলাপ আরো কিছুক্ষণ চলল।

তারপর সকলে উঠল—এবারে ব্রীজ খেলার ঘরে।

এটা একটা অ্যান্টি-রুম বললেও চলে—নাতিপ্রশস্ত।

ঘরের মধ্যখানে একটি সুদৃশ্য চকচকে চৌকা টেবিল। টেবিলের ‘পরে সবুজ বনাত, তার ওপরে পাতা একটি সরু গ্লাস। টেবিলের চারপাশে আটখানা সবুজ রঙের চামড়ার গদী মোড়া উজ্জ্বল পালিশ। করা চেয়ার।

মাথার উপরে সিলিং থেকে ডিম্বাকৃতি সবুজ সেডে ঢাকা একটি অত্যন্ত শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আলো ঝুলছে—আলোর ডুমটি এমনিভাবে লাগান, যাতে করে কেবলমাত্র টেবিলের ’পরেই আলো পড়ছে, বাকি ঘরটিতে একটা আবছা আলো-আঁধারী।

সমস্ত ঘরখানা জুড়ে যেন একটা অদ্ভুত স্তব্ধতা।

প্রথমেই আজকের খেলার পার্টনার বাছাই করা নিয়ে একটু বাক-বিতণ্ডা হল, তারপর সেটা সমাধান হয়ে গেল।

কিরীটী ও রামগড়ের কুমারবাহাদুর এক পক্ষে—অন্য পক্ষে নিম্‌তের জমিদার ও শৈলেশ। খেলা শুরু হল।

কতক্ষণ খেলা হয়েছে খেয়াল নেই, টেবিলের ঠিক মধ্যস্থলে দুটি সুদৃশ্য রৌপ্য নির্মিত প্লেট ইতিমধ্যে এ সময় রাখা হয়েছিল, একটা তার প্রায় শূন্য, অন্যটায় নোটের স্তূপ জমা হয়ে উঠেছে।

আমি গভীর মনোযোগের সঙ্গে খেলার গতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম।

সত্যি! কিরীটীর কথাই ঠিক। জিত হচ্ছে বারবার শৈলেশের দলেরই। এবং আরো আশ্চর্য লাগছিল, প্রতি দানেই শৈলেশের পক্ষের হাতের তাসই যেন ভাল পড়ছে।

কেমন করে এটা সম্ভব!

অথচ তাস তো প্রতিবারেই সাফলিং চলেছে বেশ ভাল করেই। তবে?—একি রহস্য?

সে রাত্রির মত খেলা যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে মনে হল সে বিশেষ কোন কারণে যেন হঠাৎ বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে।

সমস্ত মুখে একটা চাপা আনন্দের জ্যোতি—কিরীটীর ওই ধরনের চাপা আনন্দোছ্বাসের সঙ্গে আমি অভ্যস্ত। কোন কঠিন সূত্রের মীমাংসায় সে পৌঁছেছে।

যা হোক, একটু পরেই সে রাত্রের মত খেলা সাঙ্গ হল। আজ কিরীটীর ও তার পার্টনারের হার প্রায় ১৫০০ শত টাকা করে হবে—কিন্তু মনে হল কিরীটীর তাতে তিলমাত্রও দুঃখবোধ যেন নেই।

‘রাত্রি প্রায় দেড়টা, আজ আর তোর বাসায় ফিরে কাজ নেই সুব্রত, চল, রাতটা আমার ওখানেই থাকবি।’

গাড়ি চালাতে চালাতে কিরীটী আমাকে বললে।

বুঝলাম, কোন কিছু সে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে চায়। তার প্রস্তাবে সম্মত হলাম।

সমগ্র শরীরের স্নায়ুতে স্নায়ুতে যেন কেমন একটা ক্লিষ্ট অবসাদ বোধ করছিলাম। বোধ হয় অনেকক্ষণ জেগে আছি, তাই এই অবসন্নতা। একটা লম্বা ঘুম দিতে পারলে বোধ হয় শরীরের এই অবসন্নতা যেত।

নির্দিষ্ট শয্যায় এসে শুতেই দু’চোখের পাতা অসহ্য ঘুমে যেন জড়িয়ে এল: শেষবারের মত একবার চোখ চেয়ে দেখলাম, কিরীটী নিঃশব্দে দুটি হাত পেছনের দিকে আবদ্ধ করে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে।

কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই, ঘুম যখন ভাঙল রাত্রি কিছুটা অবশিষ্ট আছে—খোলা জানালা পথে চোখে পড়ল রাত্রিশেষের ধূসর আবছা আকাশের একটুকরো।

ঘরের মধ্যে তখনও আলো জ্বলছে, এবং ঠিক আলোর সামনে টেবিলের ’পরে কি একটা বস্তু যেন কিরীটী ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্যে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পরীক্ষা করছে।

‘ব্যাপার কি কিরীটী? ঘুমোতে যাসনি তুই?’”

‘কিরে, ঘুম হল? সামান্য একটু soluble Berbitone খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লি?’

‘Soluble Berbitone?’

‘হ্যাঁ, একপ্রকার ঘুমের ঔষধ। ফারমাকোলজিতে বলে A white crystalline powder, odourless, taste bitter. Soluble in water—বাকিটা বুঝতে কষ্ট আর হবে না নিশ্চয়ই।’

চকিতে আমার সংক্ষুব্ধ চিন্তাজালের ’পরে যেন একটা আলোর ঝাপটা এসে পড়ল। পর পর অনেক কথাই মনের মধ্যে খেলে গেল, অ্যাাঁ! বলে কি?

‘তবে কি তুই বলতে চাস?’

কিরীটী আমার বক্তব্যকে শেষ না করতে দিয়েই বলে ওঠে, ‘এগজ্যাক্টলি সো!’

মাথার মধ্যে সমস্ত যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

সব কিছুই কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।

শয্যা ছেড়ে কিরীটীর পাশে উঠে এসে দাঁড়ালাম। কিরীটী ততক্ষণে আবার তার হাতের বস্তুটি নিয়ে মনোযোগী হয়ে পড়েছে।

চেয়ে দেখি, কিরীটী ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দিয়ে পরীক্ষা করছে একটা ‘তাস’।

‘কি দেখছিস, অমন করে তাসটার মধ্যে রে?’

মুখ না তুলেই মৃদু হেসে কিরীটী জবাব দেয়:

‘গোলাম টেক্কা রাজা ও বিবি
দেখিতে জানিলে শুধু নহে ছবি।
এক-দুই, তিন, চার পাঞ্জা ছক্কা
আট-নওলা-দশ-দিলে এক বাদ—ফক্কা!’

‘বুঝলাম! তারপর?’

‘চৌর্য বৃত্তিতে যে হাত আমার সাফাই বেশ—এই তাসটিই তার প্রমাণ সু—’ বলতে বলতে তাসটা তুলে একবার নাচিয়ে কিরীটী হেসে ফেলে, ‘এই তাসটা গত রাত্রে খেলার টেবিল থেকে চুরি করে এনেছি।’

‘হঠাৎ?’

‘কারণ, এই তাসটি ভাল করে পরীক্ষা করলেই সকল রহস্য পরিষ্কার হয়ে যাবে: মূল সঙ্কেতটি চোখে পড়বে।’

তাসটা কিরীটীর হাত থেকে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে উল্টে-পাল্টে দেখলাম। কিন্তু কিছুই রহস্যজনক তাসটার মধ্যে চোখে পড়ল না।

‘পেলি না কিছু?’

‘না।’

‘এই নে, ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দিয়ে আর একবার দেখ।’

আবার দেখলাম কিরীটীর নির্দেশ মত ম্যাগনিফাইং গ্লাসটার সাহায্যে, তবু কিন্তু তাসটার মধ্যে তেমন বিশেষ কিছুই দর্শনীয় খুঁজে পেলাম না। বললাম, ‘কই, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।’

কিরীটী এবারে একটা কাগজের ’পরে একটা নক্সা এঁকে বললে, ‘ভাল করে চেয়ে দেখ, তাসের পেছনে যে স্টারগুলো আছে, তাদের ঠিক ওপরে ও নিচে দুটি তারা বা স্টারের মধ্যখানে ‘এক’ সাঙ্কেতিক অক্ষরটি আছে। আজ তাস খেলবার সময় লক্ষ্য করে দেখিস, প্রত্যেকটি তাসেই ওই রকম বিভিন্ন সাঙ্কেতিক অক্ষর বসান আছে।’

দুপুরের দিকে কিরীটী ঘণ্টা কয়েকের জন্য বাইরে ঘুরে এল।

ওইদিন রাত্রেও আবার তাসের আড্ডায় গিয়ে নিয়মিত বসা হল।

রাত্রে ব্রীজের আসর যখন ভাঙল, সময় তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। কিরীটী গাড়ি চালাচ্ছে, আমি পাশে বসে।।

কিছুদূর এসে হঠাৎ রাস্তার একপাশে গাড়িটার ব্রেক কষে একটা সিগার নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করল।

পাঁচ-দশ-পনের মিনিট করে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করবার পর পর-পর তিনখানা গাড়ি আমাদের আশেপাশে এসে নিঃশব্দে দাঁড়াল।

একখানা গাড়িতে রামগড়ের কুমারবাহাদুর হরিরাম—দ্বিতীয়টায় নিম্‌তের জমিদার সুখেন্দু রাণা—তৃতীয় গাড়িতে অ্যাডভোকেট সলিল বসু। কিরীটী গাড়ি থেকে নেমে ওদের বললে, ‘গাড়ি আপনাদের এখানেই ড্রাইভারের জিম্মায় থাকবে, আমার গাড়িতে আপনারা সকলে আসুন।’

কিরীটীর আহ্বানে সকলে এসে ওর গাড়িতে উঠে বসল। কিরীটী গাড়িতে স্টার্ট দিল।

বুঝলাম, গাড়ি ঘুরে চলেছে শৈলেশের বাড়ির দিকেই।

গেট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, দরোয়ানকে ডাকিয়ে গেট খোলান হল।

কলিংবেল টিপতেই ভৃত্য একটু পরে এসেই দরজা খুলে দিল।

কিরীটীই প্রশ্ন করলে, ‘সাহেব কি ঘুমিয়েছেন?’

‘আজ্ঞে—এইমাত্র তিনি শুতে গেলেন বোধ হয়।’

‘সায়েবকে বল গিয়ে, কুমারবাহাদুর তার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান—খুব জরুরী।’

ভৃত্য আমাদের সকলকে পার্লারে বসিয়ে ওপরে চলে গেল। মিনিট দশেকের মধ্যেই শৈলেশ নিচে নেমে এল—পরিধানে স্লিপিং গাউন, মুখে পাইপ।

আমাদের সকলকে এত রাত্রে এভাবে আবার ফিরে আসতে দেখে সে যে বেশ বিস্মিতই হয়েছে, ওর চোখ মুখ দেখেই তা বোঝা গেল।

‘কি ব্যাপার কি?’

জবাব দিল কিরীটী, ‘শৈলেশ, কুমারবাহাদুরের হয়ে তোমার কাছে আমি পঞ্চাশ হাজার টাকার দাবী জানাচ্ছি।’

‘পঞ্চাশ হাজার টাকা দাবী?’ বিস্ময়ে ও যেন একেবারে হাঁ হয়ে গেছে।

‘হ্যাঁ! তুমি ব্রীজ খেলবার ছল করে অন্যায় ভাবে ওর কাছ হতে আজ পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজার টাকা ঠকিয়ে নিয়েছ।’

শৈলেশ এতক্ষণে বোধ হয় ব্যাপারটা বুঝতে পারল। বললে, ‘অন্যায় নয়, বলতে পারো জুয়ো খেলায় উনি হেরেছেন, আমি জিতেছি। জুয়ো খেলায় হার-জিত আছেই। উনি কচি খোকাটি নন, আগাগোড়াই উনি জানতেন যে জুয়ো খেলছেন। আজ যদি উনি জিততেন, আমাকে কি টাকাটা ফিরিয়ে দিতেন?’

‘Shut up you cheat!’ এবারে কুমারবাহাদুর গর্জন করে ওঠে, ‘ওর নাম জুয়োখেলা? শয়তান!’

‘ল্যাংগুয়েজ প্লীজ কুমারবাহাদুর! এটা একজন ভদ্রলোকের বাড়ি! ভদ্র আচরণ না করলে, আমি বাধ্য হব তার ব্যবস্থা করতে।’ নির্ভীক কঠিন স্বরে শৈলেশ জবাব দেয়।

‘শোন শৈলেশ! তোমার এখানে ব্রীজ খেলাটা সত্যিকারের জুয়োখেলা যদি হত, কিছু বলবার ছিল না। কিন্তু তুমি বেশ ভাল করেই জান, কি রকম চালাকি করে তুমি ব্রীজ খেলো?’

‘চালাকি কি রকম?’

‘তোমার প্রত্যেকখানা তাসের পেছনে সাঙ্কেতিক অক্ষর বসান, যার সাহায্যে তুমি প্রত্যেকের হাতের তাস না দেখেও জানতে পার।’

‘সাঙ্কেতিক অক্ষর বসান?’

‘হ্যাঁ!’ কিরীটীর কণ্ঠস্বর বজ্র-কঠিন।

‘কি পাগলের মত আবোল তাবোল বকছ, রায়?’

‘বেশ! চল, তোমার খেলার তাসগুলো ড্রয়ার থেকে বের করবে। চল, তোমার চোখের ’পরেই দেখিয়ে দেব, কি চাই আমি।’

‘বেশ, চল।’

সকলে এসে খেলার ঘরে প্রবেশ করলাম। ড্রয়ার থেকে তাস বের করা হল। কিন্তু আশ্চর্য, কোন তাসই তন্ন তন্ন করে খুঁজেও গত রাত্রের দেখা সাঙ্কেতিক চিহ্ন কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না।

সকলেই হতভম্ব।

কিরীটী নিজে আর একবার তাসগুলো দেখে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে সোজা দৃষ্টিতে তাকাল শৈলেশের দিকে: ‘শৈলেশ, আমি কিরীটী রায়! আমার চোখে ধুলো দেওয়া তোমার সাধ্যাতীত! যে তাস দিয়ে প্রত্যহ খেলা হয়, এ সে তাস নয়! কারণ আজ যে তাস নিয়ে খেলা হয়েছে, তার প্রত্যেকটিতেই প্রায় আমি নখের আঁচড় বসিয়ে দাগ কেটে দিয়েছি। বের কর সেই তাস। বের কর, কোথায় রেখেছ সেই তাস?’

মুহূর্তে দপ করে ঠিক এমনি সময় ঘরের বাতি গেল নিভে, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঘরটা যেন বিলুপ্ত হয়ে গেল চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে।

কিরীটীর নির্দেশ মত আমিও সতর্ক হয়ে গেলাম। কিরীটীর পকেটে টর্চবাতি ছিল, সে বোতাম টিপে বাতি জ্বালাল।

সকলেই হতভম্ব চকিত।

কিন্তু টর্চের আলোয় ঘরের মধ্যে কোথাও শৈলেশের টিকিটিরও দর্শন পাওয়া গেল না। হাওয়ার মতই যেন সে উবে গেছে ঘরের মধ্য থেকে।

সুইচ টিপে আবার ঘরের বাতি জ্বালানো হল। না, সত্যি শৈলেশ ঘরের মধ্যে নেই।

কিরীটীর চোখে-মুখে কিন্তু এতটুকুও উদ্বেগের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। একান্ত নির্বিকার ভাবে সে টেবিলের ড্রয়ারগুলো পরীক্ষা করতে লাগল।

তিনটে ড্রয়ারের একটায় চাবি দেওয়া। পকেট থেকে একগোছা চাবি বের করে তার মধ্যে থেকে একটা চাবি বেছে লাগাতেই চাবি ঘুরে গেল। এবং ড্রয়ার খুলতেই তার মধ্যে অভীষ্ট তাসজোড়া পাওয়া গেল।

আলোর সামনে কিরীটী তাসগুলো সকলের চোখের সামনে মেলে বললে, ‘এই দেখুন, প্রত্যেকটা তাসেরই পিছনে ওপরে-নিচে সাঙ্কেতিক অক্ষর বাসানো, এবং এই সঙ্কেতের সাহায্যেই সে সকলের ’পর খেলায় টেক্কা দিয়ে দান জিতে নিত। কিন্তু আর নয়, কাল আপনারা সকলে আমার ওখানে আসবেন, সব আমি এক্সপ্লেন করে দেব। শৈলেশ এই ঘরের মধ্যে কোন গুপ্ত দ্বারপথে নিশ্চয়ই আত্মগোপন করেছে। এখন সেই গুপ্ত দ্বারপথে খুঁজে তাকে অনুসরণ করা বৃথা। কারণ সে নিশ্চয়ই এতক্ষণ আমাদের নাগালের বাইরে। রাতও অনেক হয়েছে। কুমারবাহাদুর, কাল সকালে আমার ওখানে আসতে কিন্তু ভুলবেন না; আই উইল ডিসাইড ইওর কেস।’

সে রাত্রে কিরীটীর ওখানে ফিরে এসে বাইরে থেকেই আমাদের নজরে পড়ল, তার বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে।

‘ব্যাপার কি? এত রাত্রে তোর কাছে আবার কে এল?’

কিরীটী ঘরের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললে, ‘অনুমান যদি আমার মিথ্যে না হয়, তাহলে শৈলেশই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’

‘শৈলেশ!’

‘হ্যাঁ।’

সত্যি, বাইরের ঘরে ঢুকে দেখলাম, মুহ্যমানের মত শৈলেশই দু-হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে একটা সোফার ’পরে।

আমাদের পদশব্দে ও মুখ তুলে তাকাল। সমস্ত মুখখানায় যেন একটা সর্বহারার রিক্ততা। রক্তশূন্য ফ্যাকাশে!

হঠাৎ কিরীটিকে সামনে দেখে শৈলেশ উঠে এসে তার হাত দুটো চেপে ধরে বললে, ‘আমাকে বাঁচাও ভাই! এমনি করে আমাকে সাক্ষাৎ অনিবার্য ধ্বংসের মধ্যে ঠেলে দিও না।’

‘বস—বস শৈলেশ। সব কথা তোমার শুনব। দাঁড়াও, আগে কফি আনতে বলি—’

কিরীটী জংলীকে ডেকে তিন কাপ কফির আদেশ দিল।

সে ঘরে ফিরে আসতেই শৈলেশ কি যেন বলতে উদ্যত হতেই কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ‘First of all get your nerves strong my boy! তারপর শুনব তোমার কাহিনী।’

একটু পরেই জংলী ট্রেতে করে ধূমায়িত তিন কাপ কফি নিয়ে এল।

শৈলেশ তার কাহিনী শুরু করল: ‘তোমরা কেউ জানো না, যখন আমি বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে এলাম—’

কিরীটী মৃদু স্বরে বললে, ‘আমি জানি সেসব কথা শৈলেশ। এসে দেখলে তোমার বাবা তোমার জন্য একমাত্র কলকাতার বাড়িটা ছাড়া কিছুই রেখে যেতে পারেননি। এবং শেষের একটা বছর কেবল ঋণ করেই তোমার বিদেশের খরচপত্র চালাচ্ছিলেন।’

‘আশ্চর্য, কেমন করে জানলে?’

‘তোমার বাবার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে তোমাদের আত্মীয়স্বজনরা তোমার বাবার চারপাশে এসে স্থায়ী আসন গেড়ে ওঁকে চুষতে শুরু করে দেন—’

‘হ্যাঁ। এবং সেই সময় কোন এক ধনী মহাজনের কাছ থেকে অত্যন্ত উঁচু হারে সুদ দিয়ে বহু টাকা কর্জ করেন—’

বাইরে এমন সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল। কিরীটী সঙ্গে সঙ্গে আহ্বান জানাল: ‘আসুন মিস্টার চৌধুরী।’

ঘরে এসে প্রবেশ করলেন সি. আই. ডি. পুলিশ ডেপুটি সুপার মিঃ আর চৌধুরী।

‘ব্যাপার কি কিরীটীবাবু? এত রাত্রে জরুরী তলব কেন?’ চৌধুরী একটা সোফায় বসতে বসতে প্রশ্ন করলেন।

আড়চোখে চেয়ে দেখলাম শৈলেশের সমগ্র মুখখানা যেন ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

‘ইনিই আমাদের বন্ধু ব্যারিস্টার বাসু, মিস্টার চৌধুরী।’

সহসা একটা আর্ত অর্ধস্ফুট চিৎকার করে শৈলেশ জ্ঞান হারিয়ে সোফার ’পর এলিয়ে পড়ল।

কিরীটী ত্বরিত পদে উঠে গেলেশের কাছে গিয়ে বললে, ‘সুব্রত, শৈলেশ সেন্সলেস হয়ে গেছে দেখছি। চট করে এক গেলাস জল নিয়ে আয়।’

আমি জল আনতে ছুটে গেলাম।

পরের দিন সকাল।

কিরীটীর বাইরের ঘরে আমরা সকলে বসে। ইতিমধ্যে শৈলেশ অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে।

কিরীটী বলছিল, ‘ভাগ্যের বিড়ম্বনা। শৈলেশকে আমি খুব ভাল করেই চিনতাম। মগজে বুদ্ধি বস্তুটা যে ওর কোন দিনই তেমন খুব ধারালো নয়, এ আমার ভাল করেই জানা ছিল। ব্রীজ খেলার আসরে প্রথমেই যখন জানতে পারলাম, নির্দোষ আমোদের মধ্যে দিয়ে বিশেষ ভাবে জুয়োখেলা চলছে পাকাপোক্ত ভাবে, তখন থেকেই ধরবার চেষ্টা করেছি রহস্যটা কোথায়; দু-তিনটে দিন আমার খেলা দেখতেই চলে গেল। কারণ নতুন খেলোয়াড়কে প্রথম থেকে বেশ ভাল করে একটু যাচাই না করে দেখা পর্যন্ত পাত্তা দিতে চায় না ওরা। তাই দলের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতেই দু-তিন দিন আমার চলে গেল। তারপর দেখলাম ও বুঝলাম, খেলাটা প্রায় প্রতি রাত্রে এক পক্ষীয় হয়। অর্থাৎ শৈলেশ যে দলে বসে, সে দলেরই বেশির ভাগ দিন হয় জিত। এবং জিত মানে প্রচুর অর্থাগম। কিন্তু সে বা যারাই খেলতে আসুক, কেবল জুয়ার নেশাতেই রাতের পর রাত ওখানে হাজিরা দিতে পারে না।

নিশ্চয়ই ওই খেলার নেশা ছাড়াও আরো কোন বড় রকমের আকর্ষণ আছে, যার টানে প্রত্যহ সকলে এসে নিয়মিত ওখানে হাজিরা দেয়। দেখলাম, প্রত্যহ খেলা শুরু হবার আগে নিয়মিত ভাবে কফি পান ও ‘বুফে’ ডিনার চলে। মনে হল, নিশ্চয়ই প্রাত্যহিক ওই আহার ও পান পর্বের মধ্যে কোন আকর্ষণের বস্তু আছে। খাওয়ার মধ্যে থাকতে পারে না, কারণ প্রত্যহই খাবারের মেনু অদল বদল হয়। দ্বিতীয় লক্ষ্য করলাম, কফি পানটা সকলেই বেশ আগ্রহের সঙ্গেই করে এবং কেউ কেউ দু-তিনবার পর্যন্ত কফি খায়। কফির দুটো পাত্র থাকত—একটাতে থাকত কফির মধ্যে ঘুমের ওষুধ মেশানো, দ্বিতীয় পাত্রের কফির সঙ্গে মেশানো থাকত ‘বিটার’ ও ‘জিন’ এবং কফি পরিবেশন করত শৈলেশের প্রিয় ভৃত্য নাথু। ঘুমের ওষুধটা হচ্ছে ‘সলুউবুল বারবিটোন’। দু-পাত্রের মিশ্রিত কফি খেতে খেতে ক্রমে নেশায় পরিণত হত কফি খাওয়াটা। এবং ওই কফির নেশাই ছিল আসল আকর্ষণ এখানে নিয়মিত মিলিত হবার। প্রত্যেকে নেশায় বুঁদ হয়ে বসত ব্রীজের আসরে। নেশাগ্রস্ত চোখকে ফাঁকি দেওয়া খুব সহজ, শৈলেশ তখন নেশাগ্রস্ত লোকগুলোকে হাতের মুঠোর মধ্যে এনে তাসের গায়ে লাল কালো অক্ষরে লিখিত উপর ও নিচে সাঙ্কেতিক সংখ্যাগুলোর দ্বারা অপর পক্ষের তাস জেনে নিয়ে খেলতে শুরু করত। তাস সব জানা থাকলে তাসের খেলায় জেতা বিশেষ কোন কঠিন ব্যাপার নয়। সাঙ্কেতিক অক্ষরগুলো হচ্ছে: টেক্কায়—১, King-এ ‘K’ Queen-এ ‘Q’ Jack-এ ‘J’; তারপর যথাক্রমে ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯ দশের বেলায় শূন্য—এই পর্যন্ত ছিল শৈলেশের ডিউটি। এবার এ ব্যাপারে যার আসল ব্রেন তার কথায় আসব। শৈলেশ পুওর, He was an instrument only, এবং লাভের একের তিন অংশের অংশীদার ছিল মাত্র।’

এতক্ষণ কিরীটীর কথা গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনছিলাম, চমকে তাকালাম মুখের দিকে।

‘তাই এবার আসল গল্পের মধ্যে আমরা আসছি। আগেই বলেছি, শৈলেশের বুদ্ধি বস্তুটা তেমন প্রখর ছিল না। এবং তার সেই মোটা-বুদ্ধির সুযোগ নিয়ে নিয়ে যিনি কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে এলেন, তিনি শৈলশের সামনে লোভের জাল বিছিয়ে ওকে করলেন আকর্ষণ। বললেন—’

এবার শৈলেশই বলে ওঠে, ‘সত্যি! আমাকে বললেন সব দেনা আমার তিনি শোধ করে দেবেন এবং নিয়মিত আমাকে টাকা উপায়ের ব্যবস্থাও করে দেবেন। আমার তখন ভীষণ দৈন্য অবস্থা—প্রায় উপবাসের জোগাড়। তাঁর প্রস্তাবে রাজী হওয়া ছাড়া আমার দ্বিতীয় পন্থা ছিল না; শুধু তাই নয়, যে মহাজনের কাছে বাবার সর্বস্ব বাঁধা পড়েছিল, ইনিই তিনি।

‘খেলার ছলে প্রত্যেককে নেশাগ্রস্ত করে সঙ্কেতের সাহায্যে দানের পর দান আমরা জিতে চললাম, এবং—’

‘এবং টাকার বেলায় তোমার হত মাত্র ওয়ান থার্ড শেয়ার!’ কিরীটী মৃদু হেসে বলে।’

‘হ্যাঁ।’

‘এবং যদি আমার না ভুল হয়ে থাকে, তিনিই পার্টি জোগাড় করে আনতেন—কেমন কিনা?’

‘হ্যাঁ। নাহলে তুমিই বল, কি করে ওই সব বড় বড় লোকেদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঘটতে পারে?’

খটখট করে দরজার কড়া নড়ে উঠল।

‘আসুন। সুব্রত, দরজাটা খুলে দাও।’

আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই যিনি এসে কক্ষে প্রবেশ করলেন, তাঁকে দেখে আমরা সকলেই যুগপৎ বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। মুখে মৃদু সাফল্যের হাসি: ‘এই যে মিস্টার বাসু—’

চিবিয়ে চিবিয়ে উনি বললেন।

হঠাৎ সুপার মিঃ চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আপনাকে অ্যারেস্ট করলাম—’

‘what’s all this?’ রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বললেন উনি।

‘আদালতেই সেটার ব্যাখ্যা হবে মিস্টার।’ জবাব দিলেন মিস্টার চৌধুরী।

‘কিন্তু কেন অ্যারেস্ট করছেন জানতে পারি কি?’ কণ্ঠস্বরে শ্লেষ।

‘এই যে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা, পড়ে দেখুন।’

আমরা সকলেই উঠে এলাম প্রসারিত কাগজটার দিকে। ‘রামগড়ের কুমারবাহাদুর শ্রীহরিরামকে মাদক দ্রব্যের চোরা কারবার করবার জন্যে গ্রেপ্তার করা হল—’

হুঁ! কিরীটী সত্যিই অতীব ধূর্ত, ব্রীজ খেলার ধার-কাছ দিয়েও যায়নি, একেবারে সোজাসুজি মাদক। দ্রব্যের চোরা কারবারের অভিযোগ। বজ্র আঁটুনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *