1 of 2

শোণিত-লেখা – অমূল্যচরণ সেন

শোণিত-লেখা – অমূল্যচরণ সেন

প্রথম পরিচ্ছেদ

আমার নাম শ্রীজগদীশচন্দ্র রায়। আমি মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীতে অধ্যয়ন করি। আর এক বৎসর পরে একজন দিগ্গজ ডাক্তার হইব, আশা করি। আমি মেডিক্যাল কলেজের সম্মুখস্থ আরপুলি লেনে— নং মেসে থাকি। সাধারণ মেস সকল যেমন হইয়া থাকে, এটাও সেই প্রকার। তবে বাটীটি ত্রিতল। বাটীটিতে ঢুকিতেই এমন দুর্গন্ধ যে অন্নপ্রাশনের অন্ন পর্যন্ত উঠিয়া যায়। কলেজের কাছে বলিয়া, আমি অন্নপ্রাশনের অন্ন কোনরূপে বাঁচাইয়া, এই চারি বৎসর কাল এখানে বাস করিতেছি। দ্বিতীয় তল অপেক্ষাকৃত ভাল। তৃতীয় তলে দুইখানি মাত্র ঘর আছে, একখানি আমার দখলে ও অপরখানি খালি আছে। আমার ঘরখানি দক্ষিণদুয়ারী, সে জন্যই অবশ্য আমি উহা লইয়াছি। এই ঘরখানির ভাড়া ও আহারাদি অনান্য খরচায় আমার মাসিক প্রায় কুড়ি বাইশ টাকা পড়িয়া যায়। মেসের অধিকাংশই ছাত্র, তবে দুই একজন নবীন কেরানীবাবুও আছেন।

আমাদের মেসের সম্মুখে একটি দ্বিতল বাটী। সে বাটীতে এক ব্যক্তি সস্ত্রীক বসবাস করেন। লোকটির চালচলন কেমন এক অদ্ভুত রকমের। লোকটি যে কখন বাহির হয় ও কখন বাটীতে আসে, তাহার ঠিক ঠিকানা সহজে পাওয়া যায় না। একদিন দেখি, এক ইহুদির বেশে বাটীতে প্রবেশ করিল। আর একদিন মুটের বেশেই হাজির। কোনদিন দেখি, মহাত্মা বেশ ফুলবাবুটি সাজিয়াছেন। কখনো বা দেখিতে পাওয়া যায়, লোকটি সর্বাঙ্গে ধুলা মাখিয়া, গায়ের জামা কাপড় ছিঁড়িয়া, ক্ষত-বিক্ষত দেহে বাটীতে উপস্থিত। আমি তো দেখিয়াই অবাক।

প্রায়ই দেখি, লোকটি সন্ধ্যার পর বাটী হইতে বাহির হইয়া যায়, আর সকালবেলা বাড়ি আসে। নিশাচরের মত কখনো দিনের বেলায় নিদ্রা যায়। আবার কখনো কখনো দিনের বেলাতেও বাহির হইয়া যায়। এই সকল দেখিয়া শুনিয়া, লোকটির চরিত্র সম্বন্ধে আমার মনে বড় সন্দেহ হইল। লোকটাকে গুণ্ডা বলিয়াই মনে হইল। লোকটার শরীরের বাঁধুনিও বেশ, দেখিলেও বোধ হয় খুব জোয়ান। লোকটা যে কি, তাহা তো ধরিতে পারিলাম না। সুতরাং ইহার সহিত ইহার স্ত্রী কিরূপ ব্যবহার করে, তাহা জানিবার জন্য আমার বড় কৌতূহল জন্মিল। লোকটি প্রায়ই রাত্রিতে বাহির হয়, হয়তো দুই একদিন বাহিরেও কাটাইয়া আইসে। আমার ঘরের রাস্তার ধারের জানালাটা খুলিলে, তাহাদের শুইবার ঘরের ভিতর পর্যন্ত দেখিতে পাওয়া যায়।

দেখিলাম, তাহাদের স্বামী স্ত্রীতে খুব ভাব। কোনদিন হয়তো লোকটি কর্দমাক্ত কলেবরে বাটীতে উপস্থিত হইল। লোকটার স্ত্রী তাহাকে কিছুই জিজ্ঞাসা না করিয়া, সযত্নে তাহার গাত্রবস্ত্রাদি ছাড়াইয়া লইল ও কর্দমাদি ধুইয়া দিল। তাহাদের পরস্পরের এই ব্যবহার দেখিয়া, আমি আশ্চর্য হইয়া গেলাম। লোকটির সহিত আলাপ করিতে আমার ভারি আগ্রহ হইল। আমি সুযোগ অন্বেষণ করিতে লাগিলাম।

একদিন লোকটি বাটী হইতে বাহির হইতেছে দেখিয়া, আমিও মেস হইতে বাহির হইলাম। বলিলাম, ‘নমস্কার মহাশয়! কোথায় যাচ্ছেন?’

তিনি বলিলেন, ‘এই বেড়াতে—চলুন একসঙ্গে যাওয়া যাক।’

আমি তো তাহাই চাই। যাহা হউক, সে দিন তো তাহার সহিত খানিকটা বেড়াইয়া আসিলাম। একদিন কোন প্রয়োজন না থাকিলেও তাহার নিকট হইতে পাঁচটি টাকা ধার করিয়া আনিলাম। দিন দুই পরে আবার টাকা কয়টি ফিরাইয়া দিয়া আসিলাম। ইহার পর হইতে মধ্যে মধ্যে তিনি আবার আমায় নিমন্ত্রণ করিতে লাগিলেন। যাহা হউক, এইরূপে তাঁহার সহিত আমার একরূপ ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়া গেল। লোকটির নাম গিরিজানাথ মুখোপাধ্যায়। বয়স পঁয়ত্রিশ বৎসর। কি কার্য করেন, জানিতে পারিলাম না। লোকটি কিন্তু বেশ অমায়িক। পূর্বে আমার যে সন্দেহ জন্মিয়াছিল, সে সন্দেহ প্রায় অপনীত হইয়া গেল। অনেকদিন হইতে দাবা খেলার উপর আমার ভয়ানক ঝোঁক। আমি প্রায়ই তাঁহাকে দাবা খেলার জন্য আমার বাসায় ডাকিতাম। তিনিও আমাকে তাঁহাদের বাটীতে লইয়া যাইতেন। এইরূপে ক্রমাগত তাঁহাদের বাড়িতে যাওয়াতে, একটি পাকা গোছের সম্পর্ক পাতাইয়া ফেলিলাম। আমি গিরিজাবাবুর স্ত্রী মনোরমা দেবীকে ‘খুড়ী’ সম্বোধন করিতে লাগিলাম। তিনিও আমাকে পুত্ৰাধিক স্নেহ করিতেন। কিন্তু গিরিজাবাবু যে কি কাজ করেন, তাহা আজ অবধিও জানিতে পারিলাম না।

একদিন রাত্রিতে আমার নিজের ঘরে নিদ্রা যাইতেছি। হঠাৎ আমার দ্বারে আঘাত হইল, তখন রাত্রি প্রায় একটা হইবে। এত রাত্রে দরজায় ঘা পড়াতে, আমি কিছু সন্দিগ্ধ হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কে মহাশয়?’

উত্তর হইল, ‘আমি—গিরিজা।’

আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলিয়া যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার কেশ কণ্টকিত হইয়া উঠিল। দেখিলাম যে, গিরিজাবাবুর মাথা ফাটিয়া গিয়াছে এবং দরদর ধারায় রক্তস্রাব হইতেছে। আমি একটু সামলাইয়া বলিলাম, ‘একি! আপনার কি হইয়াছে?’

গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘চুপ্‌! আস্তে! আমার মাথায় সামান্য একটা লাঠির আঘাত লাগিয়াছে, তুমি তো ডাক্তারি পড়, ভাল করিয়া ব্যান্ডেজ বাঁধিয়া দাও দেখি।’

আমি ভাবিলাম, লোকটা বলে কি? এই আঘাত সামান্য? আমরা হলে তো মারা যেতাম। পরে প্রকাশ্যে বলিলাম, ‘এ আঘাত সামান্য বটে! এই চেয়ারে বসুন, আমি এখনই সব ঠিক করিয়া দিতেছি।’

যাহা হউক, আঘাত তত সাংঘাতিক হয় নাই। আমি সত্বরই ব্যান্ডেজটি বাঁধিয়া দিলাম। তিনি চলিয়া যাইবার সময় বলিয়া গেলেন, ‘রাত্রের ব্যাপারটা চেপে রেখো, কেউ যেন না জানতে পারে, যা হোক, একরকম খুব পালিয়ে এসেছি,এক ঘার উপর দিয়েই গেছে।’

গিরিজাবাবু চলিয়া গেলেন, আমি আলো নিবাইয়া শয়ন করিলাম। ভাবিতে লাগিলাম, লোকটা কে? আমার বোধ হয়, নিশ্চয়ই গুণ্ডা, বাহিরে দেখায় যেন কত সাধু! যা হোক, আজ খুব জব্দ হইয়াছে। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম। পরদিন হইতে আমি তাহার সহিত পুনরায় পূর্বের মত ব্যবহার করিতে লাগিলাম। কিন্তু তাহার বিষয়ে আমার মনে কেমন একটা সন্দেহ রহিয়া গেল।

জুন মাসে একদিন আমি গিরিজাবাবুর বাটীতে বসিয়া দাবা খেলিতেছিলাম। তখন বেলা প্রায় ছয়টা হইবে। খেলা বেশ জমিয়া আসিয়াছিল। এমন সময় একটা গুণ্ডাগোছের লোক আসিয়া গিরিজাবাবুর হাতে একখানি পত্র দিল। পত্রখানি পাঠ করিয়াই, তিনি হঠাৎ লাফাইয়া উঠিলেন। পরে লোকটার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘তুমি শীঘ্র যাইয়া বল, আমি যাইতেছি।’ বলিবামাত্র লোকটা তো পাখির মত উড়িয়া গেল। পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, ‘আজ এই পর্যন্ত থাক, আমাকে এখনি যেতে হবে।’

একে তো পূর্ব হইতে তাঁহার উপর আমার বিষম সন্দেহ। তারপর একটা গুণ্ডা আসিয়া আবার পত্র দিয়া গেল! আমি তো কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। এমন জমকালো খেলাটি ভাঙাতে আমার বড়ই রাগ হইল। আমি বিদ্রূপ করিয়া বলিলাম, ‘চলুন, আমিও সঙ্গে যাইব।’

তিনি একটু চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘ক্ষতি কি—আচ্ছা এস—তাড়াতাড়ি এস।’ আমি একটা জামা গায়ে দিয়া, চাদর লইয়া চলিলাম। তিনিও সেদিন একটা জামা ও চাদর লইয়া বাহির হইলেন। বাটী হইতে বাহির হইয়া গিরিজাবাবু এত দ্রুত চলিতে লাগিলেন যে আমি প্রায় বিশ হাত পিছাইয়া পড়িলাম। আমরা বরাবর বহুবাজারের দিকে চলিলাম। আমি তাঁহার সহিত চলিতে পারিতেছি না বলিয়া, তিনি একখানি গাড়ি ভাড়া করিলেন। গাড়োয়ানকে বলিলেন, ‘ভবানীপুর জগুবাবুর বাজার, জোরে হাঁকাইয়া চল।’ খুব সত্বর যাইতে পারিলে, বকশিসের আশাও দিলেন। গাড়ি ছুটিল, আমি ভাবিতে লাগিলাম।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

গাড়িতে উঠিয়া পর্যন্ত আমি ভাবিতে লাগিলাম, ভবানীপুরে কি? কিসের জন্যই বা তাড়াতাড়ি? দুই একবার গিরিজাবাবুকে জিজ্ঞাসাও করিলাম, কিন্তু কোন উত্তর পাইলাম না। তাঁহার কুঞ্চিত ললাট ও শূন্য দৃষ্টি দেখিয়া বোধ হইল যে, তিনি কোন গুরুতর বিষয় চিন্তা করিতেছিলেন। মাঝে মাঝে বড় এক টিপ নস্য লইতেছিলেন। বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি, গিরিজাবাবু একটি পাকা নস্যখোর। গিরিজাবাবুর কোন উত্তর না পাইয়া, আমি আর তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না—নিজেই ভাবিতে লাগিলাম।

অবিলম্বে আমাদের গাড়ি জগুবাবুর বাজারের নিকট আসিয়া পড়িল। নামিয়াই দেখি যে, রাস্তা লোকে লোকারণ্য। যাহা হউক, কোনরূপে লোকের ভিড় ঠেলিয়া, ভিতরে যাইতে লাগিলাম। কতকগুলি পুলিশপ্রহরী সেইখানে পাহারা দিতেছিল। আমরা অগ্রসর হইতেছি দেখিয়া, একজন শ্বেতকায় কনস্টেবল আমাদিগকে ধাক্কা দিবার উপক্রম করিল। এমন সময়ে গিরিজাবাবু তাঁহার সঙ্কেত চিহ্ন দেখাইলেন। শ্বেতাঙ্গপ্রবর অপ্রতিভ হইয়া, তখন নিজেই ভিড় ঠেলিয়া, আমাদিগকে ভিতরে লইয়া যাইতে লাগিল। আমি তখন বুঝিতে পারিলাম, গিরিজাবাবু একজন গোয়েন্দা।

আমরা বরাবর একটি ত্রিতল বাটীর সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। দরজায় বসিয়া একজন বৃদ্ধ ভৃত্য ক্রন্দন করিতেছিল। গিরিজাবাবু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘খুন হয়েছে কোথায়?’

বৃদ্ধ উত্তর করিল, ‘আজ্ঞে,—তেতলায়!’ এই কথা বলিয়া বৃদ্ধ দ্বিগুণ স্বরে ক্রন্দন করিতে লাগিল।

‘তেতলায়’ কথাটি শুনিয়া, গিরিজাবাবু একেবারে ছুটিলেন। আমিও তাঁহার অনুসরণ করিতে লাগিলাম। উঠিয়াই দেখি যে, একটি ঘরের দরজার বাহিরে একখানি টেবিলের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া, ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহেব ব্যস্তভাবে রিপোর্ট লিখিতেছেন। আশেপাশে কয়েকজন শ্বেত কৃষ্ণ কনস্টেবল দণ্ডায়মান ছিল। আমি একটু অগ্রসর হইয়া, ঘরের ভিতর দৃষ্টিপাত করিলাম। যাহা দেখিলাম, তাহাতে আমার মস্তক ঘুরিয়া গেল। গৃহের মধ্যস্থলে একজন বৃদ্ধলোক মৃতাবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে। ঘরের ভিতর যেন রক্তের ঢেউ খেলিতেছে।

এদিকে পুলিশসাহেব গিরিজাবাবুকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, ‘গিরিজাবাবু! আপনাকে মিছামিছি কষ্ট দেওয়া হইল। কারণ এক্ষেত্রে আপনার বুদ্ধি-কৌশলের কোন প্রয়োজন হইবে না। আমরা দোষী ব্যক্তির নাম জানিতে পারিয়াছি, তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে হুকুম হইয়াছে। সে এখনই উপস্থিত হইবে।’

গিরিজাবাবু বিনম্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আপনারা কিরূপে জানিতে পারিলেন?’

উত্তরে পুলিশসাহেব বলিলেন, ‘হত্যাকারী যখন পলায়ন করে, তখন সে ভাবিয়াছিল, লোকটি মরিয়া গিয়াছে। তখনও কিন্তু লোকটি মরে নাই। মরিবার আগে অতি কষ্টে হতব্যক্তি রক্তের দ্বারা হত্যাকারীর নাম লিখিয়া রাখিয়াছে। আসুন, আপনি ভাল করিয়া পরীক্ষা করুন।’

গিরিজাবাবু ঘরের ভিতর গিয়া দেখিলেন যে, ‘রা—ম—গো—’ এই কয়েকটি বর্ণ রক্তের দ্বারা অস্পষ্টভাবে লিখিত রহিয়াছে।

পুলিশসাহেব বলিলেন, ‘রা—ম—গো—’ এই কয়টি অক্ষর রামগোপাল এই নামের পূর্বাংশ মাত্র। এই রামগোপালই হত যোগেন্দ্রনাথ সিংহ মহাশয়ের ভ্রাতুষ্পুত্র।’

গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘আমি এ বিষয়ে আপনাদের সহিত একমত হইতে পারিতেছি না।’

পুলিশসাহেব উত্তর দিলেন, ‘এখন না হইতে পারেন, কিন্তু আমি আশা করি, হত্যাকারী কোনরূপে তাহার দোষ অস্বীকার করিতে পারিবে না। ‘রা—ম—গো—’ এই তিনটি বর্ণ—তাহার বিরুদ্ধে মারাত্মক প্রমাণ। আর এ কর্ম রামগোপাল ভিন্ন অন্য কেহ করিতে পারে বলিয়া, আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ সেই এখন যোগেনবাবুর অতুল সম্পত্তির একমাত্র অধিকারী। বিশেষত এই রামগোপাল কাল রাত্রি ৯টার পর খুড়ার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিল ও অনেক রাত্রি পর্যন্ত এখানে ছিল।’

পুলিশসাহেবের সিদ্ধান্ত শুনিয়া, গিরিজাবাবু আপনা আপনি বলিতে লাগিলেন, ‘এখন সব জলের মত পরিষ্কার বুঝিতে পারিতেছি, এই রামগোপাল একটা আস্ত গাধা।’ প্রকাশ্যে বলিলেন, ‘বিষম সমস্যা,—দেখা যাইক, কিরূপ হয়।’

এই কথা বলাতে, পুলিশসাহেব গিরিজাবাবুকে বারান্দার দিকে লইয়া গেলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

গিরিজাবাবু পুলিশসাহেবের সহিত কথাবার্তা কহিতেছেন। আমিও সুযোগ বুঝিয়া, এই লোমহর্ষণ ব্যাপার ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম। ঘরের ভিতরকার জিনিসপত্রগুলি যেমনভাবে ছিল, তেমনি আছে; একটিমাত্রও স্থানান্তরিত হয় নাই। সকল জিনিসই বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দিবাশয্যা প্রস্তুত রহিয়াছে, কেহ তাহাতে নিদ্রা যায় নাই। শয্যায় যাইবার পূর্বেই, বোধ হয় বৃদ্ধ ভূমিশয্যায় চিরনিদ্রায় নিদ্রিত হইয়াছে। দেরাজ, আলমারি প্রভৃতি আসবাব সকল অতি সুন্দররূপে পালিশ করা, তাহাতে ধূলার লেশমাত্র নাই। টেবিলের উপর একটি বাতিদান, তাহাতে আর বাতি নাই, সমস্ত পুড়িয়া গিয়াছে।

গৃহের সমস্ত জিনিস দেখিয়া, আমি মৃতদেহটি ভাল করিয়া পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। এই হতভাগ্য লোকটির বয়স অনুমান সত্তর-পঁচাত্তর হইবে। খর্বকায় বৃদ্ধ হইলেও, শরীরের মাংস তত লোল হয় নাই। দেহের বাঁধুনি বেশ। অকালে হত না হইলে, হয় তো একশত বৎসর বাঁচিত। মাথায় সাদায় কালোয় মিশানো একরাশ কোঁকড়ান চুল। দাড়ি সুবৃহৎ—বক্ষস্থলের শেষ সীমা স্পর্শ করিয়াছে। আশ্চর্যের বিষয়, হত লোকটির মুখে যন্ত্রণা বা ক্লেশের চিহ্নমাত্র নাই—যেন হাসিতেছে। মুখের ভাব দেখিয়া বোধ হয় যেন কোন কথা বলিতে যাইতেছে। হত ব্যক্তির অবস্থা যতদূর বুঝিতে পারা গেল, তাহাতে বুঝিলাম যে, লোকটি আঘাত প্রাপ্ত মাত্রই মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। আঘাত প্রাপ্ত মাত্র মৃত্যু না ঘটিলে, এ ব্যক্তি ‘রা—ম—গো—’ এই অক্ষর কয়টি লিখিল কিরূপে? এ চিন্তাও তখন আমার মনে উদিত হইল। বস্তুতই তখন আমার মন সন্দেহ-দোলায় দুলিতেছিল।

আমি কৌতূহলের বশবর্তী হইয়া, তাড়াতাড়ি হত ব্যক্তির দক্ষিণ হস্ত ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম। দক্ষিণ হস্ত পরিষ্কার, রক্তের চিহ্নমাত্র নাই। কিন্তু বাম হস্তের অবস্থা সেরূপ নহে, বাম হস্তের তর্জনি রক্তমণ্ডিত। কি আশ্চর্য! তবে কি লোকটি বাম হস্তের তর্জনি দ্বারা লিখিয়াছে? ইহা কি সম্ভব? না, ইহা আদৌ সম্ভব নহে। এইরূপ নানা চিন্তায় আমার মস্তিষ্ক ঘুরিয়া গেল! চক্ষু বিস্ফারিত, কেশ কণ্টকিত হইল। আমি হঠাৎ উত্তেজনাবশে চিৎকার করিয়া উঠিলাম।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

আমার চিৎকার শুনিয়া গিরিজাবাবু, পুলিশসাহেব প্রভৃতি সকলে আমার নিকট সত্বরপদে উপস্থিত হইলেন। তাঁহারা প্রায় একযোগে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হইয়াছে কি?’ আমি এতদূর উত্তেজিত হইয়াছিলাম যে, আমার বাক্যস্ফূর্তি হইল না। অতি কষ্টে আমি গিরিজাবাবুকে হত ব্যক্তির বাম হস্তের তর্জনি দেখাইয়া বলিলাম, ‘এই দেখুন!’

গিরিজাবাবু তৎক্ষণাৎ মৃতদেহের পার্শ্বে বসিয়া পড়িলেন এবং তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে বাম হস্তের অঙ্গুলিটি লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘ইন্সপেক্টর সাহেব, এ কথা কয়টি কখনও হত লোকটির দ্বারা লিখিত হয় নাই, এই দেখুন, ইহার বামহস্তের তর্জনিটি কেবল রক্ত মাথা।’

পুলিশসাহেব দুঃখের সহিত উত্তর করিলেন, ‘বোধ হয় আমি পূর্বে অত লক্ষ্য করি নাই।’

গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘এখন স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে যে হত্যাকারী স্বহস্তে না লিখিয়া এ কথা কয়টি হত ব্যক্তির অঙ্গুলির দ্বারা লিখাইয়াছে। এ কেবল পুলিশ কর্মচারীগণকে ভ্রান্তিতে ফেলিবার জন্য নহে, কোন নিরীহ লোককে বিপদে ফেলিবার নিমিত্ত। হত্যাকারী সুচতুর, এখন আপনার কিরূপ বোধ হয়?’

ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন, ‘এ বড় বিষম সমস্যা! আমরা হত লোকটির চেহারা দেখিয়াই ঠকিয়াছি। গিরিজাবাবু, আপনি এ রহস্যের দ্বার উদ্ঘাটন করুন। হত্যাকারীর সন্ধান লউন।’

ম্যাজিস্ট্রেট নীরব হইলে, একজন কনস্টেবল আসিয়া পুলিশসাহেবকে সেলাম করিয়া বলিল, ‘হুজুরের হুকুমে রামগোপালকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে, সে এখন হাজতে। সে নিজের দোষ স্বীকার করিয়াছে।’

এই কথা শুনিয়া আমি একেবারে আশ্চর্যান্বিত হইলাম। ভাবিলাম, একি হইল! আমরা কোথায় রামগোপালের নির্দোষিতা প্রমাণ করিতে যাইতেছি, আর সে কিনা নিজমুখেই তাহার সমস্ত দোষ স্বীকার করিয়াছে! দেখিলাম, এ কথায় গিরিজাবাবুর মুখেও বিস্ময়ের রেখা পড়িয়াছে, তাঁহার উজ্জ্বল চক্ষু উজ্জ্বলতর হইয়াছে। তিনি ঘন ঘন নস্য গ্রহণ ও বারান্দায় ইতস্তত ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। এমন সময়, দারোগা মধুসূদন বর্মণ আসিয়া সেখানে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিবামাত্রই গিরিজাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘রামগোপাল কি তোমার সম্মুখে নিজের দোষ স্বীকার করিয়াছে?’

দারোগা দৃঢ়তার সহিত উত্তর দিল, ‘হাঁ মহাশয়, এই দেখুন আমার ডায়েরীতে তাহার কথাগুলি ঠিকঠিক লিখিয়াছি।’

পুলিশসাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বর্মণ! তুমি এত শীঘ্র কিরূপে কার্যটি সম্পন্ন করিলে? রামগোপালকেই বা কোথায় গ্রেপ্তার করা হইয়াছে?’

দারোগা বর্মণ উত্তর করিল, ‘আমরা আপনার কথামত একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া বরাবর শ্যামবাজারে রামগোপালবাবুর বাটী গিয়া উপস্থিত হইলাম। তাঁহাকে বৈঠকখানায় দেখিতে পাইলাম না, বোধ হয় তখন তিনি আহারে বসিতে উপক্ৰম করিতেছিলেন। যাহা হউক, বিলম্ব না করিয়া, একেবারে রামগোপালবাবুর নাম ধরিয়া ডাকিলাম। ডাকিবামাত্রই তিনি ও তাঁহার স্ত্রী নিচে নামিয়া আসিলেন। আমাদিগকে দেখিয়া রামগোপালবাবু বলিলেন, ‘তোমরা কি চাও?’

আমি উত্তর করিলাম ‘মহারানীর নামে আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইলাম।’

পাঠক মহাশয়, রামগোপালবাবুর স্ত্রীকে বাহিরে আসিতে দেখিয়া বিস্মিত হইবেন না। কারণ তাঁহারা সাহেবী ধরণের লোক, বহুদিন হইতে সাহেবী চালচলন ও সাহেবী আদবকায়দা অবলম্বন করিয়াছেন, সুতরাং তাঁহাদের মধ্যে যে স্ত্রী-স্বাধীনতা একটু বেশি পরিমাণে আছে, তাহাতে আর সন্দেহ কি?

পুলিশসাহেব বলিলেন, ‘এ সকল বাজে কথা ছাড়িয়া আসল কথাগুলি বলিয়া যাও।’

মধুসূদন পুনরায় বলিতে আরম্ভ করিল, ‘আমি অনেক লোককে গ্রেপ্তার করিয়াছি। কিন্তু রামগোপালবাবু এই কথা শুনিয়া যেরূপ আঘাতপ্রাপ্ত হইয়াছেন, তাহা কোথাও দেখি নাই।’

তিনি বহুক্ষণ শূন্যদৃষ্টিতে আকাশপানে চাহিয়া রহিলেন। তাহার পর, কিছুক্ষণ পরে আমাকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘হয় আপনি আমাকে ঠাট্টা করিতেছেন, না হয় আপনার ভ্রম হইয়াছে।’

আমি উত্তর করিলাম, ‘না, আমার কোন ভুল হয় নাই।’

রামগোপালবাবু পুনরায় বলিলেন, ‘তবে আপনি আমায় গ্রেপ্তার করিতেছেন কেন?’

আমি একটু উচ্চকণ্ঠে বলিলাম, ‘কেন মিছামিছি ছেলে মানুষের মত ব্যবহার করিতেছেন? আপনার খুড়ার বিষয় কি আপনি কিছু জানেন না ? এখন কি লুকাইলে চলিবে? আপনার খুড়ার লিখিত কথা কয়েকটি যে আপনার বিরুদ্ধে উজ্জ্বল প্রমাণ।’

এই কথা শুনিয়া, রামগোপালবাবু হতজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। আমরা তাঁহাকে ধরিয়া, বৈঠকখানায় একখানি চেয়ারে বসাইলাম । তাহার পর তিনি একটু প্রকৃতিস্থ হইলে বলিলাম, ‘এখন আপনি আমার পরামর্শ গ্রহণ করুন, আপনি যে দোষী, তাহা স্বীকার করুন।’ তৎপরে তিনি শূন্যমনে, শূন্যদৃষ্টি হইয়া, ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘হাঁ, আমিই প্রকৃত দোষী।’

ইহার পর আমার ইঙ্গিতে রামদীন পাহারাওয়ালা, রামগোপালবাবুকে সম্বোধন করিয়া বলিল, ‘রামগোপালবাবু! তবে একবার আমাদের সঙ্গে চলুন।’

তিনি টলিতে টলিতে, উঠিয়া, অতি মৃদুস্বরে বলিলেন, ‘চল যাই।’

আমরা মনে করিলাম, এই খাসে আমাদের কার্য সমাপ্ত হইল ; কিন্তু তাহা হইল না।

‘আমি এতক্ষণ রামগোপালবাবুর স্ত্রীর প্রতি তত লক্ষ্য করি নাই। এখন দেখিলাম, তাঁহার স্ত্রী একখানি চেয়ারে অর্ধশায়িত অবস্থায় পতিত। তিনি যে মূৰ্ছিত হইয়াছেন, আমি অনুমানেই তাহা বুঝিলাম। যাহা হউক, আমরা সেদিকে বড় একটা লক্ষ্য না করিয়া, রামগোপালবাবুকে গাড়িতে উঠাইয়া লইয়া আসিবার উপক্রম করিতে লাগিলাম। রামগোপালবাবুও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে যাইবার জন্য দুই এক পা অগ্রসর হইতে লাগিলেন। ইত্যবসরে তাঁহার মূর্ছা ভঙ্গ হইল, হঠাৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া, তিনি পাগলিনীর মত বলিয়া উঠিলেন, ‘না—না, তুমি যেতে পাবে না, আমি তোমায় কিছুতেই যেতে দিব না।’

আমরা এইরূপ ঘটনা অনেক দেখিয়াছি, সুতরাং ইহাতে কিছু আর নূতনত্ব বোধ করিলাম না। সুতরাং আমি তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলাম, ‘এখন আর এরূপ করিলে, কোন ফলই হইবে না; আমরা আইন অমান্য করিয়া, কিছুতেই আসামী ছাড়িতে পারিব না। ইনি এখন দোষী কি নির্দোষ, বিচারে তাহার প্রমাণ হইবে। এখন আপনি উপরে যাইয়া স্থির হউন, এখন এতটা অস্থির না হইয়া, মোকদ্দমা চালাইবার জন্য ভাল উকিলের পরামর্শ গ্রহণ করিবার চেষ্টা দেখুন।’

এই কথা বলিয়া, আমি রামদীনকে পুনরায় ইঙ্গিত করিলাম। আমার কথামত রামগোপালবাবুকে গাড়িতে উঠানো হইল। রামগোপালের স্ত্রী ভূমিতে বসিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। তাঁহাদের একটা কালো কুকুর ছিল, সেটা রামগোপালবাবুর সহিত গাড়িতে উঠিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিল। আমরা বহুকষ্টে তাহাকে তাড়াইয়া দিয়া, গাড়ি হাঁকাইয়া দিলাম। গাড়িতে তাঁহাকে কথা কহাইবার জন্য অনেক যত্ন করিলাম কিন্তু তিনি একটি কথাও কহেন নাই। কেবল শূন্য নয়নে নিচের দিকে চাহিয়াছিলেন। যখন আমরা তাঁহাকে লইয়া, হাজত ঘরে প্রবেশ করিলাম, তখন তিনি উন্মত্তের ন্যায় হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, ‘হা জগদীশ্বর ! আমি কি করিয়াছি?’

আমি তাঁহার নিকটবর্তী হইয়া পুনরায় বলিলাম, ‘রামগোপালবাবু। আপনার দোষ স্বীকার করুন।’

রামগোপালবাবু নীরবে একবারমাত্র সম্মতিসূচক মস্তক নাড়িলেন। তাহার পর, অশ্রুভারাক্রান্তনেত্রে বলিলেন, ‘আমায় একাকী থাকিতে দিন।’

পাছে তিনি আত্মহত্যা করেন, এই ভয়ে নিকটে কোন অস্ত্রশস্ত্র আছে কি না, ভাল করিয়া পরীক্ষা করিলাম ও পাহারাওয়ালাকে তাহার উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে উপদেশ দিয়া, আপনাদের এখানে চলিয়া আসিলাম।’

দারোগার মুখে এই সকল কথা শুনিয়া, আমি পূর্বাপেক্ষাও অধিকমাত্রায় বিস্মিত হইলাম। পুলিশসাহেব কিন্তু অম্লানবদনে দারোগা মধুসূদনের ক্ষিপ্রকারিতা ও কার্যকারিতার যথেষ্ট প্রশংসা করিলেন। আমি কয়েকটি কথা বলিতে যাইতেছি, এমন সময় গিরিজাবাবু আমার মুখের কথা কয়টি যেন কাড়িয়া লইয়াই বলিয়া উঠিলেন, ‘স্বীকার করি, সব সত্য কিন্তু যদি আমি রামগোপালবাবুকেই প্রকৃত হত্যাকারী বলিয়া স্বীকার করি, তাহা হইলে, সে যে নিজেই আপনার নাম লিখিয়াছে, তাহাও আমাকে স্বীকার করিতে হয়। ইহা কি কখনও সম্ভব, না বিশ্বাসযোগ্য ?’

পুলিশসাহেব বলিলেন, ‘যখন দোষী নিজমুখে আপনার সমস্ত দোষ স্বীকার করিতেছে, তখন এ বিষয় লইয়া আমাদিগের আর অধিক মস্তিষ্ক চালনায় আবশ্যক কি?’

ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব, পুলিশসাহেবের এ কথা গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করিলেন না। গিরিজাবাবুর পূর্বোক্ত কথা কয়টিই তাঁহার মনে সন্দেহের উদ্রেক করিল। তিনি বলিলেন, ‘আমি এখনই হাজতে গিয়া, রামগোপালের সহিত সাক্ষাৎ ও তাহার জবানবন্দি গ্রহণ করিব।’ অতঃপর তিনি পুলিশসাহেবকে অন্যান্য আবশ্যকীয় কার্যাদি সম্পন্ন করিবার ও ডাক্তারগণের রিপোর্ট লইয়া যাইবার ভার প্রদান করিয়া, কেরানী ও ইন্টারপ্রিটারের সহিত চলিয়া গেলেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

পুলিশসাহেবের মধ্যাহ্ন-ভোজনের সময় উত্তীর্ণপ্রায়, তিনি অতি দ্রুতহস্তে গৃহের সমুদয় মূল্যবান জিনিসপত্রগুলি ফর্দ করিতে লাগিলেন। গিরিজাবাবু ও আমি—আমরা দুজনে একটু দূরে যাইয়া চিন্তা করিতে লাগিলাম। গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘তাহা হইলে, বোধ হয় হত ব্যক্তি নিজেই ওই নাম লিখিয়াছে।’

আমি বলিলাম, ‘তাহা কখনও হইতে পারে না, বামহস্তের দ্বারা লিখা কি সম্ভব? বিশেষ হত ব্যক্তি আঘাত প্রাপ্তমাত্রই মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে।’

গিরিজাবাবু আমাকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আঘাত প্রাপ্তিমাত্র কি ওই লোকটি প্রাণত্যাগ করিয়াছে?

আমি উত্তর করিলাম, ‘তাহার আহত স্থান দেখিয়া যতদূর বুঝিতে পারা যায়, তাহাতে বোধ হয়, লোকটি আঘাত প্রাপ্তমাত্রই মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। যাহা হউক, সরকারি ডাক্তারেরাও এখনই আসিবেন, তাঁহাদের রিপোর্ট দেখিলেই আমার কথার সত্যাসত্য বুঝিতে পারিবেন। এখন সে বিষয়ে বাদানুবাদ নিষ্প্রয়োজন। বিশেষ আমি একজন সামান্য ছাত্র বৈ তো নই? ডাক্তারেরা আমার অপেক্ষা অনেক জ্ঞানী।’

গিরিজাবাবু অন্যমনস্কভাবে বলিলেন, ‘ইহার ভিতর নিশ্চয়ই কোন গূঢ় রহস্য লুক্কাইত আছে। আমাকে এই রহস্য উদ্ঘাটিত করিতে হইবে। আমি আবার নূতন করিয়া ইহার তথ্যানুসন্ধান করিব। আচ্ছা, প্রথমে দারোওয়ানকেই জিজ্ঞাসা করা যাউক।’ এই কথা বলিয়া তিনি সত্বরপদে সিঁড়ির রেলিং-এর নিকট গিয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিলেন, ‘দারোওয়ান, দারোওয়ান, একবার শীঘ্র উপরে এস।’

দারোওয়ানকে ডাকিয়া, গিরিজাবাবু আর একবার মনোযোগের সহিত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে গৃহটি পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। তিনি সিঁড়ির দরজাটি দেখিলেন। দরজার তালাটি বিকৃত বা ভগ্ন হয় নাই, বা অপর কোন চাবি দিয়াও তাহা খোলা সম্ভব নহে। সুতরাং হত্যাকারী যে অন্য কোন চাবি দিয়া তালাটি খুলিয়াছিল, তাহাও বোধ হয় না। যখন গিরিজাবাবু এইরূপ অনুসন্ধান করিতেছিলেন, তখন আমি একবার সেই গৃহে প্রবেশ করিয়া নীলবর্ণ গালার শীলমোহরযুক্ত ছিপিটি কুড়াইয়া লইলাম। কেন যে ছিপিটি আমি কুড়াইলাম, তাহা আমি বলিতে পারি না।

যাহা হউক ছিপিটি যখন আমার হস্তে তুলিয়া লইয়াছি, তখন উহাকে ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম যে ছিপিটির একদিকে একটি ছিদ্র রহিয়াছে, ‘কর্ক ক্রুপ’ দিয়া খুলিলে যেরূপ ছিদ্র হয়, ঠিক সেইরূপ। ছিপিটির আর একদিক, অর্থাৎ যে দিক বোতলের মধ্যে থাকে সে দিকটি মদ লাগিয়া লাল হইয়া গিয়াছে। বোধ হইল যে, কোন তীক্ষ্ণ ছুরিকা তাহাতে বিদ্ধ করা হইয়াছে। আমার এই কুড়ানো জিনিসটি গিরিজাবাবুর কোন কাজে লাগিতে পারে ভাবিয়া, আমি সেটি গিরিজাবাবুকে দেখাইলাম। তিনি ছিপিটি দেখিয়াই একেবারে আনন্দে নাচিয়া উঠিলেন এবং বলিলেন, ‘এখন এই খুনের বিষয়ে কিছু জানিতে পারা যাইবে। যে ব্যক্তি হত্যা করিয়াছে, সে নিশ্চয়ই ইহা এখানে ফেলিয়া গিয়াছে। পাছে সেই হত্যাকারীর গাত্রে খোঁচা লাগে, ছোরার মুখটি ভাঙ্গিয়া যায়, এইজন্য সে ব্যক্তি ছোরার অগ্রভাগটি ছিপিটি বিদ্ধ করিয়া পকেটে করিয়া আনিয়াছিল। যাহা হউক, এই ছিপিটার দ্বারা আমি নিশ্চয়ই যথার্থ দোষী বাহির করিব।’

গিরিজাবাবু ও আমি এইরূপ কথোপকথনে নিযুক্ত ছিলাম, এমন সময় আমাদিগের পশ্চাতে এক কাতর দীর্ঘশ্বাস পড়িল। ফিরিয়া চাহিয়া দেখিলাম, সেই বৃদ্ধ দারোওয়ানটি আমাদের নিকট উপস্থিত। আমাদের ফিরিতে দেখিয়া সে জিজ্ঞাসা করিল, ‘মহাশয়, আমাকে আপনাদিগের কি দরকার?’

গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘এইখানে বস।’

বৃদ্ধ দারোওয়ান তাঁহার কথামত সেই স্থানে বসিয়া রহিল। গিরিজাবাবু তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন ; আমার বোধ হইল, যেন তিনি বৃদ্ধের হৃদয়ের অন্তস্থল পর্যন্ত দেখিতেছিলেন। পরে বলিলেন, ‘আমি তোমায় কতকগুলি প্রশ্ন করিতে চাই, তুমি তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিবে। তোমার মনিবের সম্বন্ধে তুমি কি জান, সংক্ষেপে তুমি তাহাই বলিয়া যাও।’

বৃদ্ধ দ্বারবানের এজাহার: আমার মনিবের নাম যোগেন্দ্রনাথ সিংহ। তাঁহার কাজকর্ম ‘জে· সিংহ’ এই নামে চলিত। প্রায় আট বৎসর হইল, তিনি এই বাটীতে বাস করিতেছেন। ইহার পূর্বে তিনি চৌরঙ্গীতে থাকিতেন। চৌরঙ্গীর যে বাটীতে তাঁহার দোকান তিনি সেই বাটীতে থাকিতেন। তাঁহার পরচুলের দোকান ছিল এবং তিনি অতি সুন্দর চুল কাটিতে পারিতেন। তিনি এই কার্যে অনেক অর্থ উপার্জন করিয়াছিলেন। বলিতে কি এই ব্যবসায়ে তিনি ধনী বলিয়া গণ্য হইয়াছেন। তাঁহার ভ্রাতুস্পুত্রের নিকট শুনা তাঁহার নগদ দেড় লক্ষ টাকার বিষয়। তাহা ছাড়া বাটীঘর ইত্যাদি ভূ-সম্পত্তি অনেক। আমার মনিব বেশ সাদাসিদা রকমের লোক ছিলেন। দোষের মধ্যে কেবল একটু মাথাপাগলা ছিলেন মাত্র। তাঁহার মনে অহঙ্কারের লেশমাত্র ছিল না। তিনি লোকের সহিত বেশ মিশিতে পারিতেন। তাঁহার গল্প বলিবার এরূপ ক্ষমতা ছিল যে, তিনি গল্প করিতে আরম্ভ করিলে, তাঁহার নিকট হইতে উঠে কার সাধ্য? তাঁহার চালচলন সাধারণ লোকের মত ছিল। আপনার উপায়ে তিনি সুখে জীবনযাপন করিতেন বটে, কিন্তু তিনি অপব্যয়ী ছিলেন না।

এই বলিয়া দারোয়ান নীরব হইল। গিরিজাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি আর বিশেষ খবর আমাকে দিতে পার?’

দরোয়ান বলিল, ‘খুব পারি। তবে শুনুন, আমি এক এক করিয়া সমস্তই বলিয়া যাই। তিনি অতিশয় সৌখিন গোছের লোক ছিলেন, কোন কিছু তিলমাত্র অপরিষ্কার দেখিতে পারিতেন না। ঘরের যেখানে একটু ময়লা হইয়াছে, যেখানে একটু ধূলা পড়িয়াছে, তাহা তিনি স্বহস্তেই পরিষ্কার করিয়া ফেলিতেন। বেলা দশটার সময় তিনি কতকগুলি বিস্কুট খানিকটা চা ও দুইটা ডিম খাইতেন। ইহাই তাঁহার প্রাতঃভোজন। তার পর তিনি বেশবিন্যাশ করিতেন। নিত্য নূতন পোশাক পরিতে তাঁহার মত লোক আমি দেখি নাই। সুন্দর পোশক নহিলে তিনি পরিতেন না। চালচলন সাহেবী ধরণের ছিল। প্রত্যহ দ্বিপ্রহরে তিনি বাটীতে আহার করিতেন না। একেবারে — হোটেলে মধ্যাহ্নে ভোজন করিতেন। প্রতিদিন তিনি ঠিক রাত্রি ১১টার সময় বাটীতে আসিতেন। তাঁহার একটু চরিত্রদোষও ছিল।’

গিরিজাবাবু এইবারে বলিলেন, ‘তাহা হইলে অনেক লোক তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিত ?’

দারোয়ান বলিল, ‘খুব অল্প। ইহার ভ্রাতষ্পুত্র রামগোপালবাবু মধ্যে মধ্যে ইঁহার সহিত দেখা করিতে আসিতেন। প্রত্যেক রবিবারে আমার মনিব ও রামগোপালবাবু একসঙ্গে উইলসন হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজন করিতেন। ইহাদের খুড়া ভাইপোর খুব সদ্ভাব ছিল। এমন কি আমি তাঁহাদের মধ্যে কখনো ঝগড়া বা বৃথা বাকবিতণ্ডা হইতে দেখি নাই যাহা কিছু ঝগড়া হইত, তাহা কেবল মৃণালিনীর সহিত।’

গিরিজাবাবু সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মৃণালিনী কে?’

দ্বারবান। কেন, মৃণালিনী রামগোপালবাবুর স্ত্রী, অতিশয় সুন্দরী, আমার মনিব সুন্দরী স্ত্রীলোকটিকে বড় ভালবাসিতেন, কিন্তু জানি না কেন, মৃণালিনী তাঁহার চক্ষের শূল ছিল। রামগোপালবাবু মৃণালিনীকে অতিশয় ভালবাসিতেন বলিয়া কর্তামহাশয় মনে মনে অতিশয় বিরক্ত হইতেন। তিনি সর্বদাই সন্দেহ করিতেন, মৃণালিনী রামগোপালবাবুকে ভালবাসে না; তাহার ভালবাসা মৌখিক, আন্তরিক নহে। আরও তিনি মৃণালিনীর চরিত্র সম্বন্ধে যেন একরকম সন্দেহ করিতেন। এই গত বৎসর মৃণালিনীর সহিত আমার মনিবের ঝগড়া হইয়া গেল। তাহার কারণ বলি শুনুন। রামগোপালবাবুর স্ত্রী আসিয়া আমার মনিবকে বলিল যে, তাঁহারা চৌরঙ্গীতে একটি জহরের দোকান খুলিতে চান এই উপলক্ষ করিয়া মৃণালিনী তাঁহার নিকট হইতে দশ হাজার টাকা চাহিলেন। কিন্তু আমার প্রভু সহসা কাহাকেও টাকা দিবার লোক ছিলেন না। তিনি বলিলেন, ‘আমি বাঁচিয়া থাকিতে কাহাকেও এক পয়সা দিব না। আমি মরিলে, তোমরা আমার টাকা দিয়া যাহা ইচ্ছা হয় করিও।’

আমি ভাবিলাম, গিরিজাবাবু এই সূত্র ধরিয়া আরও কিছু জানিবেন। কিন্তু তিনি এ সকল অনাবশ্যক কথায় বড় একটা কর্ণপাত না করিয়া একেবারে বৃদ্ধ দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘যাক, খুনটা কখন, কিরূপে তোমরা জানিতে পারিলে?’

তখন সেই বৃদ্ধ দ্বারবান সাশ্রুনয়নে বলিতে আরম্ভ করিল, ‘হায়! অন্য দিনকার মতন বেলা ১০টার সময় আমি চা ও বিস্কুট লইয়া তাঁহার ঘর খুলিয়াই দেখি, সর্বনাশ!’ এই বলিয়া সে কাঁদিতে আরম্ভ করিল।

গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘দেখিতেছি তোমার হৃদয় অল্পেই গলিয়া যায়। আমার আর বেশি সময় নাই, একটু থামো, আমার এই গোটাকয়েক কথার স্থিরভাবে উত্তর দাও। যখন তুমি দেখিলে যে, তোমার মনিব হতাবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছেন, তখন তুমি কি করিলে?’

দ্বারবান। আমি চিৎকার করিয়া সকলকে ডাকিয়া বলিলাম যে, বদমায়েস গোঁয়ার ভাইপোই এই কর্ম করিয়াছে।

গিরিজা । তুমি কিরূপে জানিতে পারিলে যে, খুনটি ঠিক রামগোপালই করিয়াছে?

দ্বারবান। সে ছাড়া আর কাহারো কাজ নহে। দুষ্ট বালক সন্ধ্যার সময় আমার মনিবের সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিল। যখন সে ফিরিয়া যায়, তখন রাত্রি বারটা। সে এখানে আসিলে আমার সহিত দেখা না করিয়া যাইত না। কিন্তু সেদিন যাইবার সময় আমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া গেল না। আমি নিশ্চয় বলিতেছি, সে যাইবার পর যতক্ষণ পর্যন্ত না এই খুনের বিষয় আমি জানিতে পারিয়াছিলাম, ততক্ষণ কেহই আমার মনিবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসে নাই।

গিরিজা। সে ব্যক্তি যে রামগোপাল, তাহা তুমি দেখিয়াছিলে?

দ্বারবান। না। অন্ধকারে তাহার মুখ ভাল করিয়া দেখিতে পাই নাই। কারণ সে তখন অতি দ্রুতপদে বাটী হইতে বাহির হইয়া গেল, তাহার উপর আবার ভাল আলোকও ছিল না।

এই কথা শুনিয়া, একেবারে উল্লাসে লাফাইয়া উঠিলাম, আমি আর থাকিতে না পারিয়া, দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘যদি তুমি তাহাকে ভাল করিয়া দেখিতেই পাও নাই, তবে তাহাকে রামগোপাল বলিয়া চিনিলে কি প্রকারে?’

আমার কথায় দারোয়ান কিছু তীব্রস্বরে উত্তর করিল, ‘রামগোপালকে ভাল করিয়া দেখি নাই বটে, তাহার কুকুরকে তো দেখিয়াছি।’

গিরিজা। রামগোপালের কুকুরটা কেমন?

দ্বারবান। সেটা একটা কালো বিলাতী কুকুর। রামগোপাল সেটাকে ‘বাঘা’ বলিয়া ডাকিত। কুকুরটা রামগোপালের সঙ্গ ছাড়া থাকিত না। এখানে তাহার সহিত প্রায়ই আসিত এবং রামগোপাল ভিন্ন অন্য কাহারো সহিত যাইত না। কুকুরটার কপালে সাদা দাগ আছে।

ইহার পর গিরিজাবাবু দরোয়ানকে বিদায় দিলেন। আবার বলিলেন, ‘বোধ হয়, রামগোপাল হত্যাকারীর মধ্যে একজন।’

আমরা যখন এই প্রকার কথাবার্তা কহিতেছিলাম, তখন সরকারী ডাক্তারদ্বয়ের আগমন হইল। তাঁহারাও একত্রিত হইয়া বলিলেন, ‘হত ব্যক্তি আঘাতমাত্রেই মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন।’

সুতরাং তিনি ‘রা—ম—গো—’ এই কয়টি কথা লিখিবার সময় প্রাপ্ত হন নাই। ডাক্তারদিগের সহিত আমার মত মিলিল দেখিয়া, আমি আনন্দিত হইলাম। পুলিশসাহেব তখনও নিজের গোঁ ছাড়েন নাই, তিনি তখনও বলিতেছেন, ‘হত্যাকারী যখন নিজের সকল অপরাধই স্বীকার করিয়াছে, তখন আমাদিগের মাথাব্যথা করিবার আবশ্যক কি?’

গিরিজাবাবুর মন এ কথায় পরিতৃপ্তিলাভ করিল না, তিনি সংশয় দূর করিবার জন্য কৃতসঙ্কল্প হইলেন। তাহার পর আমাকে বলিলেন, ‘চল জগদীশ!’ একবার হাজতগৃহে যাইতে হইবে।’

আমরা যখন হত যোগেনবাবুর বাটী হইতে বাহির হইলাম, তখন রাত্রি হইয়াছে। তখনও আমাদের আহারাদি হয় নাই। বিশেষত এই লোমহর্ষণ ঘটনার প্রতি তরঙ্গেই আমরা এতদূর বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিলাম যে, আমরা ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা একেবারে বিস্মৃত হইয়াছিলাম বলিলেই চলে। যাহা হউক, আমরা মুহূর্তকাল মাত্র সময় নষ্ট না করিয়া, একখানি গাড়ি ভাড়া করিলাম এবং বরাবর হাজতগৃহের অভিমুখে রওনা হইলাম। গিরিজাবাবু গাড়িতে বসিয়া, গভীর চিন্তায় মগ্ন হইলেন, তাঁহার মুখমণ্ডল গম্ভীর ভাব ধারণ করিল। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি সেই নীল শিলমোহরযুক্ত ছিপিটি পকেট হইতে বাহির করিয়া দেখিতে আরম্ভ করিলেন এবং বলিলেন, ‘ইহার সাহায্যেই আমি প্রকৃত দোষী বাহির করিতে পারিব।’ আমি বুঝিতে পারিলাম না, গিরিজাবাবু এই সামান্য ছিপিটির দ্বারা কতদূর কৃতকার্য হইবেন।

অনতিবিলম্বেই আমাদের গাড়ি হাজতগৃহের দ্বারে উপস্থিত হইল। সাহেব নিচে ছিলেন না। চাপরাশী বলিল, ‘সাহেব এইমাত্র উপরে গিয়াছেন।’ আমরা চাপরাশীকে সঙ্গে লইয়া উপরে যাইয়া একেবারে সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। সাহেব গিরিজাবাবুকে দেখিয়া বলিলেন, ‘গিরিজাবাবু! আমিও আপনার আগমন প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। কারণ আর একজন হত্যাকারী গ্রেপ্তার হইয়া হাজত গৃহে আবদ্ধ আছে। এইরূপ শুভমুহূর্তে ও মাহেন্দ্ৰযোগের রাসায়নিক মিলন না হইলে তো আপনাদের বড় একটা এখানে পদার্পণ হয় না।’

কারাধ্যক্ষের মৃদু শ্লেষপূর্ণ কথাগুলি শুনিয়া গিরিজাবাবু ঈষৎ হাসিলেন। তাহার পর সকলে মিলিয়া বন্দী রামগোপালের গৃহাভিমুখে অগ্রসর হওয়া গেল।

গিরিজাবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব এখানে আসিয়াছিলেন কি?’

সাহেব বলিলেন, ‘হাঁ, তিনি বোধ হয় অর্ধঘণ্টার বেশি হইবে না, এখান হইতে চলিয়া গিয়াছেন। যাইবার সময় মাত্র এই কথাটি তাঁহার নিকট হইতে শুনিয়াছি যে লোকটা বড়ই সত্যবাদী; নিজের অপরাধ অস্বীকার করিতে বিন্দুমাত্র চেষ্টা করে নাই।’

কথায় কথায় আমরা রামগোপালের গৃহদ্বারে আসিয়া পঁহুছিলাম। গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘আমার অনুরোধ সকলে একটু অন্তরালে দাঁড়াইয়া চুপ করিয়া থাকুন। শুনিবেন, আমার সঙ্গে কথাবার্তায় একটি নিগুঢ় রহস্য বাহির হইয়া পড়িবে।’

কারাধ্যক্ষ পকেট হইতে চাবি বাহির করিয়া গৃহদ্বার উন্মুক্ত করিলেন। গিরিজাবাবু একাকীই গৃহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। আমরা একটা শার্সির মধ্য দিয়া দেখিতে লাগিলাম। দেখিলাম, লোকটা হাঁটুর উপর মাথা দিয়া বসিয়া রহিয়াছে। সুতরাং আমরা তাহার মুখ দেখিতে পাইলাম না। যাহা হউক সে গিরিজাবাবুর পদশব্দে হঠাৎ চমকিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া বসিল। আমরা তখন তাহাকে ভাল করিয়া দেখিয়া লইলাম। দেখিলাম, লোকটির দৃষ্টি শূন্য, উদাস, উন্মত্ত। সে দৃষ্টি দেখিয়া বুঝিলাম, লোকটির মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটিয়াছে। অথবা যেন সে ঘৃণায় আত্মবিস্মৃত হইতে বসিয়াছে।

কিয়ৎক্ষণ পরে গিরিজাবাবু ঈষদুচ্চস্বরে বলিয়া উঠিলেন, ‘রামগোপালবাবু যে! এরূপ করিয়া কষ্ট পাইতেছেন কেন?’ উত্তরের আশা করিয়া তিনি কিয়ৎকাল অপেক্ষা করিয়া রহিলেন। কিন্তু রামগোপাল আদৌ উত্তর প্রদান করিলেন না। গিরিজাবাবু অগত্যা বলিলেন, ‘এরূপ অবস্থা অত্যন্ত বিপজ্জনক বটে, কিন্তু আমিও যদি আপনার মত অবস্থায় পড়িতাম, তাহা হইলে নিশ্চয়ই আমার নির্দোষিতা সপ্রমাণ করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিতাম!’

রামগোপাল কর্কশ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, ‘আমি তো নির্দোষী নই।’

গিরিজাবাবুও ছাড়িবার পাত্র নহেন, তিনি বলিলেন, ‘উহা কি সত্য?’

রামগোপাল বলিতে লাগিল, ‘হ্যাঁ, ইহা সত্য। আমি নিজে—নিজেই এই খুন করিয়াছি। কতবার একথা আপনাদিগকে বলিব? এইমাত্র একজন আমার স্বীকারোক্তি লিখিয়া লইয়া গেলেন। আবার আপনি আমাকে জ্বালাইতে আসিয়াছেন। আপনাদের হৃদয় কি সততই লোকপীড়নে নিযুক্ত থাকে? আমার অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহাই ঘটিবে খুন করিলে ফাঁসি হয়, তাহা আমি জানি। তাহার জন্য আমি বিন্দুমাত্রও ভীত নহি। এখন আপনাদের প্রত্যেক কথার উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে মৃত্যুর অপেক্ষা যন্ত্রণাদায়ক বোধ হইতেছে।’

গিরিজাবাবু অপেক্ষাকৃত মৃদুস্বরে বলিতে লাগিলেন, ‘লোকে একেবারেই কি ফাঁসি যায়?’ সে যে দোষী, সে বিষয়ে যদি অকাট্য প্রমাণ সংগৃহীত হয় এবং বিচারে সে যদি যথার্থ হত্যাকারী প্রতিপন্ন হয়, তবে তাহার ফাঁসি হয়। তোমার দোষ সম্বন্ধে এমন কি প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, যাহাতে তোমার ফাঁসি হবে? আচ্ছা এখন কি আমার দুই একটি কথার উত্তর দিবে? তুমি কি তোমার খুড়োকে যথার্থই ঘৃণা করিতে?’

রাম। কখনোই না।

গিরিজা। তবে তুমি তাহাকে খুন করিলে কেন?

রাম। তাঁহার বিষয় পাইবার জন্য। এখন আমার কারবার ফেল হইবার উপক্রম হইয়াছে, এসময় আবার খুড়া খুব ধনী ছিলেন বটে, কিন্তু জীবিতাবস্থায় তাঁহার নিকট হইতে এক পয়সাও বাহির করা অসম্ভব ছিল। আপনি অনুসন্ধান করিলে জানিতে পারিবেন, আমার কারবারের অবস্থা কতদূর শোচনীয়।

গিরিজা। সে যাহা হউক। তুমি বোধ হয় মনে করিয়াছিলে যে তোমাকে কেহই ধরিতে পারিবে না?

রাম। আমি তাহাই আশা করিয়াছিলাম।

গিরিজা। আচ্ছা, তুমি যে বন্দুক দিয়া খুন করিয়াছিলে, সেটা তুমি কোথা হইতে আনিয়াছিলে?

আমি বিস্মিত হইয়া রামগোপালের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তাঁহার মুখে কোনপ্রকার বিস্ময়ের ভাব প্রকটিত হইল না।

রামগোপাল। সেটা অনেক দিন হইতে আমার নিকট ছিল।

গিরিজা। তুমি খুন করিয়া বন্দুকটি কি করিলে?

রামগোপাল। তাহা গঙ্গায় ফেলিয়া দিয়াছি।

গিরিজা। তাহা হইলে বন্দুকটির অনুসন্ধান একরূপ অসম্ভব দেখিতেছি।

যখন গিরিজাবাবু যথার্থ সত্য বাহির করিবার জন্য এইরূপ ভাবের কথোপকথনে নিযুক্ত ছিলেন, তখন তাঁহার মুখমণ্ডল আশ্চর্য গম্ভীর ভাব ধারণ করিয়াছিল। গিরিজাবাবু পুনরায় বলিলেন, ‘আচ্ছা, একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করি—কথাটা আমরা ভালরূপ বুঝিতে পারিতেছি না—খুন করিবার সময় তুমি কি তোমার কুকুরটি সঙ্গে লইয়া গিয়াছিলে, না সেটা আপনা আপনিই তোমার পশ্চাতে গিয়াছিল?

‘আমার কুকুর!’ অত্যন্ত বিস্ময়ের সহিত রামগোপাল এই কয়েকটি কথা উচ্চারণ করিল।

‘হ্যাঁ, তোমার সেই কুকুর,—দারোয়ান তাহাকে চিনিতে পারিয়াছিল।’ গিরিজাবাবু দৃঢ়তার সহিত একথা বলিলেন।

রামগোপাল মুখ বিকৃত করিয়া কি বলিতে যাইতেছিল, আত্মসংবরণ করিয়া ফেলিল। তাহার পর বলিল, ‘আর আমাকে কষ্ট দিবেন না। আমি আর একটি কথারও উত্তর দিব না।’

গিরিজাবাবু তাহাকে আর অধিক বিরক্ত করিলেন না। সাহেব ও আমি ঘরের বাহিরে, শার্সির ধারে দাঁড়াইয়া সকল কথাই শুনিতেছিলাম। গিরিজাবাবু হাজতঘর হইতে বাহির হইয়া আসিলে, আমিও তাঁহার সহিত মিলিত হইলাম। দুই চারিটি কথার পর আমরা সাহেবের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলাম। আমাদের গাড়ি বাহিরে অপেক্ষা করিতেছিল। শীঘ্রই গাড়িতে উঠিলাম।

আমি বলিলাম, ‘বন্দুকের কথাটা তুলিয়া আপনি বুদ্ধির কার্যই করিয়াছিলেন। নহিলে রামগোপাল যে নির্দোষী, তাহা সহজে প্রমাণিত হইত না। যাহা হউক আমাদের অনুমান যে অনেকটা সত্য হইল, তাহাই ভাল।’

গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘অনেকানেক রহস্যপূর্ণ ঘটনা দেখিয়াছি, এরূপ অপরূপ ঘটনা একটিও দেখি নাই। বাটী পৌঁছিতে দেখিতেছি রাত্রি হইবে। যাহা হউক, আজ আমাদের বাড়িতে তোমার নিমন্ত্রণ রহিল।’

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

রাত্রি দশটার উপর হইবে, আমরা গিরিজাবাবুর বাটীতে পঁহুছিলাম। গিরিজাবাবু দ্বার উন্মোচনের সঙ্কেতসূচক এক প্রকার শব্দ করিবামাত্র, দ্বার উন্মুক্ত হইয়া গেল। গিরিজাবাবু আমাকে সঙ্গে করিয়া ভিতর মহলে লইয়া গেলেন। বলা বাহুল্য, গিরিজাবাবুর অন্তঃপুরে আমার গমনের কোন বাধা ছিল না। এই অল্পদিনেই আমি গিরিজাবাবুর স্ত্রীকে মাতৃসম্বোধন করিয়াছিলাম। তিনি আমায় নিজ সন্তানাপেক্ষাও বোধ হয় স্নেহ করিতেন। ইহার ফলে আমার আহারাদি অধিকাংশ সময়েই গিরিজাবাবুর বাটীতে সম্পন্ন হইত। আজও সেই পদ্ধতির ব্যতিক্রম হইল না। আমি ও গিরিজাবাবু উভয়েই একত্রে আহার করিতে বসিলাম।

আমরা আহার করিতে বসিয়াছি, এমন সময় গিরিজাবাবুর স্ত্রী মনোরমা দেবী বলিয়া উঠিলেন, ‘তোমাদের কি খাওয়া দাওয়া কোন কাজকর্ম নেই, যখন তখন দাবা লইয়াই উন্মত্ত থাকো, খেলিতে বসিলে কি তোমাদের দিন রাত্রি জ্ঞান থাকে না?’

আমি তাড়াতাড়ি এই কথার উত্তর দিতে যাইতেছিলাম, কিন্তু গিরিজাবাবু নিজেই তাহার উত্তর দিলেন, ‘না—না, আমরা অনেকক্ষণ খেলা ছাড়িয়া দিয়াছি, ভবানীপুরে একটা খুন হইয়াছে, তাহারই তদারক—’

ইহার উপর আর কোন কথা উঠিল না। স্ত্রীর অনুরোধে গিরিজাবাবুকে হত্যাসম্বন্ধীয় সকল কথাই। আনুপূর্বিক বলিতে হইল। কথাবার্তার সহিত সুমন্থরগতিতে আমাদের ভোজনক্রিয়া যখন পরিসমাপ্ত হইল, তখন দেখিলাম, রাত্রি সাড়ে বারটা বাজিয়াছে। আমি তাড়াতাড়ি উঠিয়া, হাত মুখ ধুইলাম এবং গিরিজাবাবুর নিকট হইতে সে রাত্রির মত বিদায় লইলাম। তিনি বলিলেন, ‘তোমায় আমি কাল সকালে ডাকিয়া লইব।’

রামগোপাল সম্বন্ধীয় নানা ভাবনায় আমার নিদ্রা আসিল না। যাহা হোক, অতি কষ্টে রাত্রি চারিটার সময় নিদ্রাদেবীর সাক্ষাৎ পাইলাম।

বেলা যখন নয়টা, তখন গিরিজাবাবুর ডাকে আমার ঘুম ভাঙিল। তিনি আমায় বলিলেন, ‘কি হে। তুমি এখনও ঘুমাচ্চ? যাবে কখন? শীঘ্র এস।

তাঁহার কথা শুনিয়া, আমি তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুইলাম ও কাপড় ছাড়িয়া বাহির হইলাম। গিরিজাবাবুর দিকে চাহিয়া দেখিলাম, তিনি অন্যদিনের অপেক্ষা আজ একটু বেশ জমকালো পোশাক পরিয়াছেন। তাঁহার মুখমণ্ডলে প্রফুল্লতা বিরাজ করিতেছিল। কাল যিনি গিরিজাবাবুকে দেখিয়াছেন, আজ তাঁহার সাধ্য কি তিনি তাঁহাকে চিনিতে পারেন।

রাস্তায় বাহির হইয়া, গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘একটু চলিয়া চল, পথে যাইতে যাইতে সকল কথা বলিব।’ আমিও আর দ্বিরুক্তি না করিয়া, তাঁহার অনুসরণ করিতে লাগিলাম। আমি চিন্তায় এতই নিমগ্ন হইয়াছিলাম যে, আমার কোনদিকে দৃষ্টি ছিল না। চীনাবাজারের মোড়ে আসিয়া, গিরিজাবাবুর কথায় আমার চমক ভাঙ্গিল। তিনি বলিলেন, ‘চক্ষে দেখিয়া যাইও এবং কর্ণে শুনিয়া যাইও, সাবধান। কথাবার্তা কহিও না এবং যাহাই ঘটুক না কেন, তাহাতে বিস্ময় প্রকাশ করিও না।’

আমি বলিলাম, ‘আচ্ছা।’

চীনবাজারের ভিতরে যাইয়া, আমরা বরাবর একটি ছাতার দোকানে প্রবেশ করিলাম। দোকানদার সম্ভ্রমের সহিত আমাদিগকে অভ্যর্থনা করিল এবং জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি চাই মহাশয়।’

গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘আমার একটি রূপার হাতওয়ালা রেশমী ছাতা চাই।’

সে ব্যক্তি নানা প্রকার ছাতা দেখাইতে লাগিল। গিরিজাবাবুর একটি ছাতাও পছন্দ হইল না। আমার বোধ হইল, তাঁহার ছাতা লইবার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। তাহা না হইলে, দোকানদার যে সমস্ত ছাতা বাহির করিয়াছিল, তাহাতে পছন্দ না হইবার কোন কারণ ছিল না। আর বাস্তবিকই তাই। তিনি ছাতা দেখিতেছিলেন আর মধ্যে মধ্যে প্রশ্ন করিতেছিলেন। ক্রমে রামগোপালের দোকানের ও তাহাদের সম্বন্ধীয় অনেক কথা জানিয়া লইলেন। যখন দেখিলেন যে, আর কোন নূতন কথা দোকানদারের নিকট হইতে পাওয়া যাইতেছে না, তখন তিনি বলিলেন, ‘আচ্ছা, কাল আমি একটা নমুনা দিয়া যাইব, ঠিক সেইমত তৈয়ার করিয়া দিবেন।’

দোকানদার বলিল, ‘আপনি যেরূপ বলিবেন, সেইরূপ হইবে। আপনার মনোনীত না হইলে, আমাদিগকে দাম দিবেন না।’

গিরিজাবাবু ‘আচ্ছা’ বলিয়া, দোকান হইতে বাহির হইলেন।

তাহার পর আমরা আরও চারি পাঁচটি দোকান হইতে পূর্বোক্তরূপে কিছু কিছু সংবাদ সংগ্রহ করিলাম। সকলেরই মত যে রামগোপাল সচ্চরিত্র, পরিশ্রমী, সদ্ব্যবহারী ও বিনয়ী লোক কিন্তু দোষের মধ্যে তাহার দোকানটি ভাল চলিত না। তাহার কারণ, সকলেই বলিল যে দোকানটির মাটির দোষ । পূর্বে আরও তিনি চারিটি দোকানদার ওইখানকার মাটির দোষে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া, দোকান তুলিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছিল। রামগোপাল তাহার স্ত্রীর অত্যাধিক অনুরক্ত ছিল। রামগোপাল খুনী কি না, এ সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে সকলেই একবাক্যে বলিল, ‘সে নির্দোষী, পুলিশ ভুল করিয়া তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছে। কিন্তু শীঘ্রই তাহাকে ছাড়িয়া দিতে হইবে।’

রামগোপালের স্ত্রী মৃণালিনীর সম্বন্ধে যাহা জানিতে পারা গেল, তাহা এই। তাহার চালচলন খুব সৌখিন। মৃণালিনী অতিমাত্রায় বিলাসিনী ছিলেন। তাহাদের অবস্থা যেরূপ ছিল, সে তদপেক্ষাও উচ্চচালে চলিত। তাহার স্বামীর প্রতি তাহার যথেষ্ট আনুরক্তি ছিল, এবং তাহার চরিত্র খুব ভাল ছিল। সে নিতান্তই নূতন ও মূল্যবান পরিচ্ছদ পরিধান করিত। এই সকল শুনিয়া গিরিজাবাবু রাস্তাতে আমায় বলিলেন, ‘তাহার চরিত্রের বিরুদ্ধে কি কেহই কোন কথা বলিল না?’

আমি তাঁহার কথায় কোন উত্তর দিলাম না। আমি মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম, হত যোগেন্দ্র সিংহের চাকর যাহা বলিয়াছে, তাহার সহিত উহাদের কথায় আকাশ পাতাল প্রভেদ।

যাহা হউক আমরা রামগোপালের দোকানের সম্মুখে আসিয়া পড়িলাম। একখানি সাইনবোর্ডে ‘রামগোপাল সিংহ এন্ড কোং আসল কেমিক্যাল স্বর্ণের দোকান’ লেখা আছে। দোকানখানি বাহির হইতে দেখিতে বড় মন্দ নয় দোকানের সম্মুখে দিয়া দুই চারিবার যাতায়াত করিয়া গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘চল, ভিতর যাওয়া যাক।’

সপ্তম পরিচ্ছেদ

আমরা রাস্তাটি পার হইয়া রামগোপালের দোকানে প্রবেশ করিলাম। এক দীর্ঘকেশ, অদ্ভুতাকারের ভৃত্য দরজার নিকট বসিয়াছিল। আমাদিগকে ভিতরে প্রবেশ করিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি চান মহাশয়?’ গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘রামগোপালের স্ত্রী এখানে আছেন?’

চাকরটি উত্তর করিল, ‘হ্যাঁ, তিনি ওই ঘরে আছেন। আমি এখনি যাইয়া খবর দিই যে, দুইজন বাবু আপনার সঙ্গে দেখা করিতে চান, কারণ—’

গিরিজাবাবু আর তাহাকে কথা সমাপ্ত করিতে দিলেন না। তিনি ভ্রূকুটি সহকারে রূঢ়স্বরে বলিলেন, ‘আর বলিতে হইবে না। যখন তিনি এখানে আছেন, তখন আমরা নিজেই যাইয়া সাক্ষাৎ করিব। তুই বসিয়া থাক্‌।’

আমি অত্যন্ত কৌতূহলের সহিত ভৃত্যনির্দিষ্ট গৃহাভিমুখে চলিলাম। আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই সাক্ষাতে কিছু না কিছু রহস্য ভেদ হইতে পারে এবং তাহার জন্য আমি এতদূর উত্তেজিত হইয়াছিলাম যে, আমি কিছুতেই গম্ভীর ভাব ধারণ করিতে পারিতেছিলাম না। যাহা হউক অনেক কষ্টে গাম্ভীর্য ধারণ করিয়া আমি গিরিজাবাবুর অনুসরণ করিলাম।

কিছুদূর অগ্রসর হইয়া আমরা দোকানের শেষভাগে একটি গৃহের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। ঘরটি মাঝারি রকমের। ঘরটিতে সুন্দর সুন্দর মূল্যবান আসবাব থাকিলেও সেগুলি ঠিক শৃঙ্খলার সহিত সজ্জিত হয় নাই। এক দিকে একটি দেরাজ। তাহারই পার্শ্বে আরাম চেয়ারে শুইয়া একটি স্ত্রীলোক কি একখানি দলিল দেখিতেছিলেন। ইনিই রামগোপালবাবুর স্ত্রী, মৃণালিনী।

মৃণালিনী অসামান্য রূপলাবণ্যবতী। ঔপন্যাসিকের নায়িকার মত অথবা চিত্রকরের চিত্রের মত—মৃণালিনী সৌন্দর্যশালিনী। আমি ধারণাই করিতে পারিলাম না যে, এই সুন্দরী স্ত্রীলোক কি করিয়া একজনকে হত্যা করিবার জন্য তাহার স্বামীকে উৎসাহিত করিতে পারে।

আমাদিগকে গৃহে প্রবেশ করিতে দেখিয়া মৃণালিনী চকিতা হরিণীর ন্যায় চেয়ার হইতে উঠিয়া ভীতবিহ্বল স্বরে বলিল, ‘আপনারা কি চান?’

গিরিজাবাবুর মুখ দেখিয়া বোধ হইল, তিনিও আমার মত চিন্তা করিতেছেন যে, এই স্ত্রীলোক কখনও হত্যাকার্যে সহায়তা করিতে পারে কি না। কিন্তু তিনি অপেক্ষাকৃত কঠোর স্বরে বলিলেন, ‘আমরা পুলিশ কর্তৃক প্রেরিত হইয়াছি এবং আমি একজন গোয়েন্দা।’

এই কথা শুনিয়া মৃণালিনী হতাশভাবে অশ্রুজল এবং ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। নানাপ্রকার স্ত্রীজনসুলভ বিলাপ ধ্বনিতে আমাদিগকে ব্যস্ত করিয়া তুলিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটা কালো কুকুরও চিৎকার করিতে করিতে আমাদিগের দিকে অগ্রসর হইল এবং আমাদিগকে আক্রমণের উদ্যোগ আরম্ভ করিল। মৃণালিনী তাহার দিকে চাহিয়া বলিলেন—‘যা, বাঘা যা, ইঁহারা আমাদের কোন অনিষ্ট করিবেন না।’ বাঘা তাঁহার কথা শুনিল ।

গিরিজাবাবু সেই মুহূর্তেই বলিয়া উঠিলেন, ‘বাস্তবিক আমরা আপনার কোন অনিষ্ট করিব না। আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য এখানে উপস্থিত হই নাই।’

ভাবিয়াছিলাম, গিরিজাবাবুর এই কথায় মৃণালিনী আশ্বস্তা হইবেন। কিন্তু তিনি গিরিজাবাবুর কথায় কর্ণপাত না করিয়া বলিলেন, ‘আজ সকালে আমি এই শমনখানা পাইয়াছি। আমাকে আজ বেলা ১২টার সময় করোনার কোর্টে উপস্থিত হইবার আজ্ঞা হইয়াছে।’

গিরিজাবাবু তৎক্ষণাৎ বলিলেন, ‘আপনি কি এমন কোন প্রমাণ দিতে পারেন না, যাহাতে আপনার স্বামীর নির্দোষিতার বিষয় প্রমাণ করিতে পারা যায়? আমাকে আপনাদের শত্রু বিবেচনা করিবেন না। আমরা দোষী ব্যক্তির যম এবং নির্দোষী ব্যক্তির পরম বন্ধু। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য এবং কর্তব্য—এ বিষয়ে সত্যের উদ্ঘাটন করা। অতএব আমাকে এ বিষয়ে আপনার যথাসাধ্য সাহায্য করিতে হইবে। যদি আপনার স্বামী নির্দোষী হন, তাহা হইলে আমি তাঁহার নির্দোষিতার প্রমাণের জন্য যথাশক্তি চেষ্টা করিব। সুতরাং আমি যাহা জিজ্ঞাসা করিব, আশা করি, আপনি তাহার সরলভাবে উত্তর দিবেন।’

মৃণালিনী প্রায় এক মিনিটকাল গিরিজাবাবুর দিকে উদাসভাবে চাহিয়া রহিলেন, পরে বলিলেন, ‘কি প্রশ্ন করিবেন, করুন?’

গিরিজাবাবু একখানি চেয়ার টানিয়া লইয়া, মৃণালিনীর সম্মুখে বসিলেন, আমিও তাঁহার পার্শ্বে একখানি চেয়ার লইয়া বসিলাম। এতক্ষণ দাঁড়াইয়াই আমাদের কথাবার্তা চলিতেছিল। গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘আপনি বোধ হয় জানিতে পারিয়াছেন যে, যোগেনবাবু রাত্রি নয়টার পর খুন হন।’

মৃণালিনী। আমি তাই শুনিয়াছি বটে।

গিরিজা। আচ্ছা, বলুন দেখি, রাত্রি নয়টার পর হইতে বারটা পর্যন্ত রামগোপালবাবু কোথায় ছিলেন ?

প্রশ্ন শুনিয়া, মৃণালিনী কাঁদিয়া উঠিলেন।

গিরিজা। ক্ষমা করুন। আপনি বোধ হয় নিশ্চয় বলিতে পারেন, পরশু সন্ধ্যার পর, আপনার স্বামী বাড়ি ছিলেন কি না?

মৃণালিনী। সে দিন সন্ধ্যার পর আমার স্বামী বাটী ছিলেন না।

গিরিজা। বলিতে পারেন কি, তিনি কোথায় গিয়াছিলেন?

মৃণালিনী। বলিতে পারি। আমাদের একজন কর্মচারী জোড়াসাঁকোয় থাকে। একটি আতরদান ও গোলাপদানে মুক্তা বসাইবার জন্য, তাহার নিকট দেওয়া হয়। কাজটা খুব জরুরী ছিল। পরশু সন্ধ্যার সময়, কারিকর কাজটি দিয়া যাইবে বলিয়াছিল। আমার স্বামী আহার করিতে করিতে বলিলেন, ‘কই, সে তো এখনও আসিল না, আমি একবার দেখিয়া আসি, সে কি করিতেছে।’ তিনি আহারাদি করিয়া, রাত্রি নয়টার সময় বাটী হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

গিরিজা। তাহা হইলে বোধ হয়, আপনাদের সেই কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিব রামগোপালবাবু তাহার নিকট গিয়াছিলেন কি না?

মৃণালিনী। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আপনি জানিতে পারিবেন না।

গিরিজা। কেন জানিতে পারিব না?

মৃণালিনী। কারণ সে তখন বাটী ছিল না। আমার স্বামী তাহার দেখা পান নাই।

গিরিজা। কিন্তু বোধ হয়, সেই বাটীর চাকর বলিতে পারিবে, রামগোপালবাবু সেখানে ছিলেন কি না?

মৃণালিনী। না মহাশয়। যে বাটীতে সে থাকে, সেখানে তাহার চাকর বাকর কেহই ছিল না।

গিরিজা। আচ্ছা। রামগোপালবাবু বাটী ফিরিয়াছিলেন কখন?

মৃণালিনী। প্রায় রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময়।

গিরিজা। তাহা হইলে, তিনি অনেক রাত্রেই বাটী ফিরিয়াছিলেন?

মৃণালিনী। হাঁ, নিশ্চয়ই। আমি তাঁহাকে এত দেরি হইবার কারণ জিজ্ঞাসা করাতে, তিনি বলিলেন, ‘গাড়ি না পাওয়ায়, আমাকে চলিয়া আসিতে হইয়াছিল।’ তিনি মদ খাইয়াছিলেন এবং আমি তাঁহার মুখে মদের গন্ধও পাইয়াছিলাম।

গিরিজা। আপনার স্বামীকে তখন কিরূপ দেখাইতেছিল?

মৃণালিনী। তাঁহাকে যেন একটু ক্রুদ্ধভাব যুক্ত বোধ হইতেছিল কিন্তু সেটা স্বাভাবিক।

গিরিজা। তখন তাঁহার বেশভূষা কেমন ছিল?

মৃণালিনী। যে বেশে তিনি ধৃত হইয়াছিলেন, সেই বেশ।

গিরিজা। তাহা হইলে, আপনি তাঁহার আকৃতিতে কিম্বা পোশাকে কিছু বিশেষত্ব দেখিতে পান নাই?

মৃণালিনী। আজ্ঞে না।

আমি চিন্তা করিতে লাগিলাম, রামগোপালের বিরুদ্ধে যে প্রকার প্রমাণ দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে সে যে দোষী, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই।

অষ্টম পরিচ্ছেদ

আমি গিরিজাবাবুর পার্শ্বে বসিয়া, মধ্যে মধ্যে মৃণালিনীর আকৃতিগত বৈলক্ষণ্য লক্ষ্য করিতেছিলাম। মৃণালিনী এরূপ ভাব প্রকাশ করিতেছিলো, যেন তিনি শোকে ও দুঃখে একেবারে মুহ্যমান হইয়া পড়িয়াছেন। কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষ্য করিয়া দেখিতে বোধ হইল, যেন তাঁহার অন্তর্নিহিত গুপ্ত আনন্দ নয়নে উদ্ভাসিত হইয়াছে। মৃণালিনীর এই ভাব দেখিয়া, আমি চিন্তা করিতে লাগিলাম, ‘তবে ইনিই কি হত্যাকাণ্ডে প্রকৃত অপরাধিনী?’ এই চিন্তা ইতিপূর্বে অনেকবার আমার মনে উদিত হইয়াছিল। মৃণালিনীর ভাব দেখিয়া সেই সন্দেহ আমার মনে বদ্ধমূল হইল। গিরিজাবাবুর নিষেধ সত্ত্বেও আমি আর নীরব থাকিতে পারিলাম না। ঈষৎ রূঢ়স্বরে মৃণালিনীকে বলিলাম, ‘আচ্ছা, যে রাত্রিতে যোগেনবাবু হত হন, সে রাত্রে আপনি কোথায় ছিলেন?’

গিরিজাবাবু আমায় ইঙ্গিতে নীরব হইতে বলিলেন। আমি নীরব হইলাম।

পরক্ষণেই গিরিজাবাবু মৃণালিনীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আচ্ছা, এই মাত্র না আপনি বলিতেছিলেন যে, আপনাদিগের কারবার ভালরূপ চলিতেছিল না?’

মৃণালিনী। আজ্ঞে হাঁ।

গিরিজা। এই টানাটানির বাজারে আপনার স্বামীকে বড় কষ্টে পড়িতে হইয়াছিল। বিশেষত আপনার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য রক্ষা করিবার জন্য তাঁহাকে বড়ই ব্যস্ত হইতে হইয়াছিল। কেমন না?

মৃণালিনী। কিন্তু মহাশয়! আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি, আমার স্বামী নির্দোষী।

গিরিজা। তাহা হইলে রামগোপালবাবু যে নিজের দোষ স্বীকার করিয়াছেন, সে সম্বন্ধে আপনার মত কি?

মৃণালিনী। আপনারা আমার স্বামীকে হঠাৎ একটা অতবড় পাপ-কার্যের নায়ক স্বরূপ গ্রেপ্তার করিলেন, সে জন্য তিনি ভীত ও নিরাশ হইয়াই নিজের দোষ স্বীকার করিয়াছেন। নিশ্চয়ই সে সময়ে তাঁহার মন স্থির ছিল না।

গিরিজা। হ্যাঁ; এ কথা না হয় স্বীকার করিলাম। কিন্তু তাহার পর হাজতে একটি রাত্রি কাটিয়া গিয়াছে, তবু তো তিনি নিজের দোষ স্বীকার করিতে ছাড়েন নাই।

মৃণালিনী । হা ভগবান, আমার স্বামী তবে নিশ্চয়ই পাগল হইয়াছেন!

উপরোক্ত কথাগুলি উচ্চারণ করিবার সময়ে মৃণালিনীর মুখ পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করিলেও, আমার মন তাঁহার প্রতি কেমন সন্দিহান হইল।

আমি এইরূপ চিন্তা করিতে লাগিলাম, যদিও রামগোপাল খুন করিয়া না থাকে, যে যথার্থ খুনী মৃণালিনী তাহাকে জানে। আমি এই সকল ভাবিতেছি, এমন সময় কথায় কথায় গিরিজাবাবু মৃণালিনীকে বলিলেন, ‘আমি এই বাটী খানাতল্লাসী করিব।’

মৃণালিনী। স্বচ্ছন্দে! আমরা এই কয়খানি ঘর ভাড়া লইয়াছি। এই লউন, তাহাদের চাবি।

গিরিজাবাবু তখনই চাবি লইয়া অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়া দিলেন। দোকান ঘর ও শুইবার ঘর দুইটি ভাল করিয়া দেখিতে লাগিলেন। দেখা শেষ হইলে উপরের ঘর দুইটি, দেখিতে চাহিলেন। মৃণালিনী বিনাবাক্যব্যয়ে নিজেই আমাদিগকে পথ দেখাইয়া লইয়া চলিলেন। তিনি নিজেই ঘর দুইটির চাবি খুলিয়া দিলেন। ঘর দুইটি ক্ষুদ্র ও নিতান্তই অপরিষ্কার। উপরিভাগ মাকড়সাগণের আবাসভূমি। এক কোণে একটি মদের পিপা পড়িয়া রহিয়াছে। মদের পিপা দেখিয়া গিরিজাবাবু মহোল্লাসে খুঁজিতে আরম্ভ করিলেন। কিন্তু সেই গালার শিলমোহরযুক্ত ছিপি পাওয়া গেল না। ইহাতে গিরিজাবাবু রামগোপালের নির্দোষিতা অনেকটা প্রতিপন্ন করিতে পারিবেন বলিয়া যৎকিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইলেন। কিন্তু বাহিরে যেন কত হতাশ হইয়া পড়িয়াছেন, এইরূপ ভাব দেখাইয়া বলিলেন, ‘কই? কিছুই তো পাওয়া গেল না। চলুন, আর একবার আমি নিচে যাই।’

আমি আগে আগে নামিয়া আসিলাম এবং কোণের ঘরে দরজা খুলিবামাত্র একটি কুকুর বিকট চিৎকারে আমাদিগকে ব্যস্ত করিয়া তুলিল। যাহা হউক, মৃণালিনীর হস্ত-সঙ্কেতে কুকুরটি নীরব হইল।

গিরিজা। এইটাই বুঝি সেই বাঘা। কুকুরটা বড় ভয়ানক।

মৃণালিনী। আজ্ঞে হাঁ মহাশয়। কিন্তু ‘বাঘা’ বড় প্রভুভক্ত। চোরের ভয়ে আমাদিগকে এই কুকুর রাখিতে হইয়াছে।

গিরিজাবাবু কুকুরটিকে নিকটে ডাকিতে লাগিলেন।

মৃণালিনী। না মহাশয়! ও কিছুতে আপনার নিকট আসিবে না। আমার ও আমার স্বামীর ডাক ছাড়া ও কাহারও কাছে যায় না।

অপর লোক হইলে হয়তো এ উত্তরে বিশেষ আস্থা প্রদর্শন করিত না, কিন্তু আমি এইস্থানে একটি সূত্র পাইলাম। আমরা দ্বারবানের জবানবন্দিতে জানিয়াছিলাম, যেদিন রাত্রে যোগেনবাবু খুন হন, সে রাত্রে বাঘাও সেখানে গিয়াছিল। আমি তৎক্ষণাৎ মৃণালিনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আচ্ছা, বলুন, দেখি, সেই খুনের রাত্রে আপনার এই প্রভুভক্ত কুকুরটি কোথায় ছিল?’

অকস্মাৎ আমার মুখে এই প্রশ্ন শুনিয়া, মৃণালিনী অবাক হইয়া গেলেন, জড়িতস্বরে বলিলেন, ‘আমি ঠিক বলিতে পারি না, আমার স্মরণ হয় না।’

আমি। বোধ হয়, সে আপনার স্বামীর সঙ্গে গিয়াছিল?

মৃণালিনী। আজ্ঞা হাঁ। সে আমার স্বামীর সহিতই গিয়াছিল।

আমি অন্যান্য প্রশ্ন করিতে যাইতেছিলাম কিন্তু গিরিজাবাবু বাধা দিয়া বলিলেন, ‘আজ আপনাকে করোনার কোর্টে যাইতে হইবে, আমরা তবে আসি।’

আমরা দুইজনে সেখান হইতে বাহির হইলাম।

নবম পরিচ্ছেদ

সেখান হইতে বাহির হইয়াই, আমরা বরাবর একটা হোটেলে প্রবেশ করিলাম। ক্ষুধার উদ্রেক হওয়াতে, যৎকিঞ্চিৎ আহারও করা গেল। তৎপরে আমরা পরামর্শ করিতে লাগিলাম। মৃণালিনী সে রাত্রে বাটীর বাহির হন নাই, ইহা নিশ্চয়। ইহাতে প্রমাণ হইতেছে যে, মৃণালিনী হত্যাকার্যে প্রকাশ্যভাবে যোগাদান করেন নাই। কিন্তু তিনি যে গুপ্তভাবে এই হত্যাকার্যে সংলিপ্ত ছিলেন না, তাহাই বা কি করিয়া বিশ্বাস করা যায়? আমার বিশ্বাস যে, মৃণালিনী এই হত্যাকাণ্ডের বিষয় সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন এবং তিনি নিশ্চয়ই হত্যাকারীকে চেনেন।

তাহা হইলে, এখন প্রকৃত হত্যাকারী কে? হত্যাকারী এমন ব্যক্তি নিশ্চয় হইবে, যাহাকে ‘বাঘা’ ঠিক তাহার প্রভু বা প্রভুপত্নীর মত দেখে এবং তাঁহাদের মত তাহার হুকুম পালন করে। কারণ ‘বাঘা’ যে সেই হত্যা-রজনীতে সেখানে গিয়াছিল, সে বিষয়ে আমরা যথেষ্ট প্রমাণও পাইয়াছি। আমার বিশ্বাস যে, ‘বাঘা’ আর একটি লোকের আজ্ঞা পালন করে, তাহা হইলে, নিশ্চয়ই এ লোকটি মাঝে মাঝে—মাঝে মাঝে কেন, প্রায়ই রামগোপালের দোকানে আসিত। এখন এ লোকটি কে? এই লোকটি যে, রামগোপাল ও মৃণালিনীর—অন্তত মৃণালিনীর বন্ধু ছিল, তাহাতে আর সন্দেহ কি ? অথচ এই হত্যাকাণ্ড এইরূপে সম্পন্ন হইয়াছে, যাহাতে রামগোপালের স্কন্ধেই হত্যাকার্যের সমুদয় দোষ পতিত হয়। তবে এই হত্যাকারী নিশ্চয়ই রামগোপালের একজন প্রবল শত্রু এবং মৃণালিনীর একজন প্রাণের বন্ধু। মৃণালিনী তাহার নাম জানেন কিন্তু প্রকাশ করিতেছেন না।

এই সকল বিষয় হইতে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইতে পারা যায় । মৃণালিনীর এক ভালবাসার পাত্র আছে, সেই ভালবাসার পাত্রটি প্রকৃত হত্যাকারী। যদিও রামগোপাল নিজেকে দোষী বলিয়া সাব্যস্ত করিতেছে কিন্তু বাস্তবিক সে নির্দোষী। মৃণালিনীর প্ররোচনায় এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হইয়াছে। হত্যাকারীর অভিপ্রায় কোনও প্রকারে রামগোপালের ঘাড়ে সেই দোষটি চাপাইয়া তাহাকে ইহলোক হইতে অপসরণান্তর দুইজনে নির্বিবাদে এই অতুল ঐশ্বর্য ভোগ করিবে। যদি ইহাই ঠিক হয়, তবে এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য—সেই প্রণয়পাত্রের অনুসন্ধান করা।

গিরিজাবাবু আমার কথা শুনিয়া কিছুক্ষণ নির্বাক রহিলেন। তাহার পর আমাকে বলিলেন, ‘তুমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর, দেখ, আমি কি উপায়ে কার্য উদ্ধার করি। আর বোধ হয়, ঘণ্টাখানেক বাদে মৃণালিনী করোনার কোর্টে যাইবে, সেই সময় সেই ছোট চাকরটা দোকানে থাকিবে আমি তাহারই সাহায্যে প্রকৃত তথ্যের আবিষ্কার করিব ।

কিছুক্ষণ আমরা দোকানের আশে-পাশে বেড়াইতে লাগিলাম। উদ্দেশ্য, কখন মৃণালিনী বাহির হন, দেখিতে পাইব। যাহা হউক, অল্পক্ষণ পরেই মৃণালিনী বাহির হইলেন। আমরাও অবসর বুঝিয়া, দোকানে প্রবিষ্ট হইলাম । আমাদিগকে হঠাৎ দোকানে প্রবেশ করিতে দেখিয়া, ছোট চাকরটা যেন ভয়ে জড়সড় হইয়া গেল। সে কোন কথা কহিবার পূর্বেই গিরিজাবাবু কিঞ্চিৎ রুক্ষস্বরে তাহাকে বলিলেন, ‘মৃণালিনী এখানে আছেন?’

চাকর। আজ্ঞা না মহাশয়, তিনি এইমাত্র বাহির হইয়া গেলেন।

গিরিজা। বাহিরে গেলেন! না, কখনই হইতে পারে না। তুই নিশ্চয়ই আমাদিগকে মিথ্যা কথা কহিতেছিস। তিনি নিশ্চয়ই ঘরের ভিতর আছেন।

চাকর। আজ্ঞা না মহাশয়, আপনার যদি বিশ্বাস না হয়, নিজে দেখিতে পারেন।

এই কথা শুনিয়া গিরিজাবাবু কপালে হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন এবং যেন কত নিরাশ হইয়াছেন, এইরূপ ভাব দেখাইতে লাগিলেন। বালক ভৃত্যটি তাঁহার ভাব দেখিয়া বিস্মিত হইয়া গেল। গিরিজাবাবু তখন একটু স্নেহসূচক স্বরে বলিলেন, ‘আচ্ছা, আমার বোধ হয়, তুমি একটা খবর দিতে পারিবে। মৃণালিনী আজ যে লোকটির সঙ্গে আমাকে দেখা করিতে বলিয়াছিলেন, তার ঠিকানাটা আমি ভুলিয়া গিয়াছি। তুমি বোধ হয়, সেই লোকটির ঠিকানা আমায় বলিয়া দিতে পারিবে।’

চাকর। কার ঠিকানা, বলুন দেখি?

গিরিজা। আঃ—তুমি তাকে জান,—এই—এই যাঃ—তার নামটাও বুঝি ভুলে গেছি। যাক্‌, তুমি তার নামটা ঠিক বলিতে পারবে বটে, যা’র সঙ্গে বাঘা প্রায়ই বেড়াতে যেত ?

চাকর। ওঃ, আপনি সাতকড়িবাবুর কথা বলিতেছেন ?

গিরিজা। হাঁ, হাঁ—সেই সাতকড়িবাবুই বটে? আচ্ছা বল দেখি, সে কি কাজ করত?

চাকর। তিনি আমার মনিবের দোকানের বড় কারিকর। প্রায় বড় বড় কাজই তো তিনি করেন।

গিরিজা। তাঁর বাড়ির ঠিকানাটা বোধ হয়, ঠিক বলে দিতে পার?

চাকর। হাঁ, তার বাড়ির ঠিকানা—নং * বলরাম দে’র স্ট্রীট, জোড়াসাঁকো।

বালক ভৃত্যটি গিরিজাবাবুকে উপরিলিখিত খবরগুলি দিয়া যেন কতই আনন্দিত হইল। সে বুঝিতে পারিল না, আমরা কি কৌশলে কার্যোদ্ধার করিলাম। যাহা হউক তাহাকে উপহাসচ্ছলে ধন্যবাদ দিয়া আমরা দোকান হইতে বাহির হইলাম।

দশম পরিচ্ছেদ

রাস্তায় বাহির হইয়াই আমি সাগ্রহে গিরিজাবাবুকে বলিলাম, ‘চলুন, আমরা এখনি যাইয়াই তাহাকে ধরি। নিশ্চয়ই সে খুনে।’

গিরিজাবাবু বলিলেন, ‘শুধু গেলে কোন কাজই হবে না। গ্রেপ্তারি পরওয়ানা না পাইলে, উহাকে ধরিবার আমাদের অধিকার নাই। শীঘ্র চল, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ হইতে একখানি পরওয়ানা বাহির করিয়া আনি।’

গিরিজাবাবু ও আমি বেগে পুলিশ কোর্টের দিকে ছুটিলাম। আমরা যাইয়া দেখিলাম যে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব টিফিনে বসিয়াছেন। গিরিজাবাবু একজন আরদালীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সাহেব কতক্ষণ টিফিনে গিয়েছেন?’

আর্দালী বলিল, ‘প্রায় আধ ঘণ্টা।’

গিরিজা। আচ্ছা, এই কার্ডখানি তাঁহাকে দাও।

আর্দালী গিরিজাবাবুকে চিনিত। সে তৎক্ষণাৎ কাৰ্ডখানি লইয়া চলিয়া গেল। অনেকক্ষণ পর ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘আপনাকে সাহেব ডাকিতেছেন।’

তাড়াতাড়ি আমরা সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। উপস্থিত হইয়াই গিরিজাবাবু তাঁহাকে আনুপূর্বিক সমস্ত কথাই বলিলেন এবং একখানি গ্রেপ্তারী পরওয়ানা প্রার্থনা করিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট তাঁহার প্রার্থনা মঞ্জুর করিলেন।

পরওয়ানা পাইয়াই গিরিজাবাবু দ্রুতপদে রাস্তায় বাহির হইলেন এবং একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া একেবারে জোড়াসাঁকোর মোড়ে আসিয়া নামিলেন, তাঁহার সহিত আমিও নামিলাম। সেখান হইতে আমরা একেবারে সাতকড়ির বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিলাম! বাটীটি একটি মেস্‌। দরজায় একটি লোক বসিয়া আছে। গিরিজাবাবু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সাতকড়িবাবু কি বাটীতে আছেন?’

‘হ্যাঁ, উপরে আছেন। উপরে উঠিয়াই ডানদিকের ঘর। বোধ হয়, এখন কাজ কচ্ছেন।’ লোকটি উত্তর করিল।

গিরিজাবাবু ও আমি ভিতরে প্রবেশ করিলাম। দুইচারি পদ যাইয়াই গিরিজাবাবু থমকাইয়া দাঁড়াইলেন এবং পুনরায় বাহির হইয়া আসিলেন। সেই লোকটিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এক বোতল ভাল মদ আনতে পার? আচ্ছা! থাক, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না, সাতকড়ি কোথা থেকে মদটদ আনে?’

লোকটি বলিল, ‘ঠিক জোড়াসাঁকোর মোড়ে যে মদের দোকান আছে, সেই দোকানটা থেকে।’

আমরা সেই দোকানে উপস্থিত হইলাম। গিরিজাবাবু দোকানদারকে বলিলেন, ‘এক বোতল বেশ ভাল মদ দাও তো। নীল শীলমোহর করা ছিপি যার, সেই মদ দাও।’

দোকানদার তৎক্ষণাৎ সেইরূপ এক বোতল মদ দিল। গিরিজাবাবু পকেট হইতে সেই ছিপিটা বাহির করিয়া, বোতলের ছিপির সহিত মিলাইয়া লইলেন। দেখিলেন, ঠিক ঠিক মিলিয়াছে । দোকানদারের সহিত একটা দর কষাকষি করিয়া, গিরিজাবাবু বাহির হইলেন, আমিও তাঁহার অনুগামী হইলাম।

আমরা একেবারে দ্রুতপদে সেই বাটীতে ফিরিয়া আসিলাম এবং কালবিলম্ব না করিয়া, একেবারে সাতকড়ি যে ঘরে থাকে, সেই ঘরের দরজায় গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, দ্বার ভিতর হইতে বন্ধ। আমরা দ্বারে আঘাত করিবামাত্র একটি সুশ্রী যুবক দ্বার খুলিয়া দিল। আমরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। ঘরটি মন্দ নয়। ঘরের এক দিকে একটি বড় টেবিল ও তাহার উপর নানাপ্রকার যন্ত্রাদি রহিয়াছে। যুবক তখন কাজ করিতেছিল।

আমাদিগকে প্রবেশ করিতে দেখিয়াই, সাতকড়ি বলিল, ‘আপনারা কি চান, মহাশয়?’

গিরিজাবাবু গম্ভীর স্বরে উত্তর করিলেন, ‘আমরা আইনবলে আপনাকে গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইলাম ।’

সাতকড়ি একটু উগ্রভাবে বলিল, ‘এঁরা পাগল নাকি! আমি কি করিয়াছি যে আমাকে গ্রেপ্তার করিবেন?’

গিরিজাবাবু রুক্ষ স্বরে বলিতে লাগিলেন, ‘আর মিছামিছি বকিতেছো কেন? তোমার সমস্ত কাণ্ডাকাণ্ড জানিতে পাইয়াছি। তুমি যখন যোগেনবাবুকে খুন করিয়া পলাও, তখন তোমাকে সেই বৃদ্ধ দারোয়ানটা চিনিতে পারিয়াছিল। আর এই ছিপিটাতে তুমি ছোরাখানা বিঁধিয়া লইয়া গিয়াছিলে।’

গিরিজাবাবুর এই সকল কথা শুনিয়া, তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল। সে যথাসম্ভব আত্মগোপন করিয়া বলিল, ‘আমি এ বিষয় কিছু জানি না, আমি সম্পূর্ণ নির্দোষী।’

গিরিজা। আচ্ছা, তুমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে ওসকল কথা বলিও। আর বলিয়াই বা হইবে কি? মৃণালিনী সমস্তই স্বীকার করিয়াছেন।

‘অসম্ভব ! তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।’ সাতকড়ি হঠাৎ এ কথাগুলি বলিয়া ফেলিল।

গিরিজা। ওঃ! তাহা হইলে, তুমি একাকীই সব ঠিকঠাক করিয়াছ। জগদীশ! দেখ তো, এই টেবিলটার ড্রয়ারগুলা ভাল করিয়া দেখ । কোন কিছু আছে কি না?

গিরিজাবাবুর কথামত আমি টেবিলের দিকে অগ্রসর হইলাম। সাতকড়ি আমার দিকে কট্‌মট্‌ করিয়া চাহিয়া রহিল।

আমি তাহাতে ভ্রূক্ষেপও করিলাম না। বিশেষ সাবধানে টেবিলের ড্রয়ারগুলি তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। তৃতীয় ড্রয়ারটিতে মৃণালিনীর স্বাক্ষরিত অনেকগুলি প্রণয়লিপি ও তাহার একখানি ফটো পাইলাম। ব্যাপার বুঝিতে আমাদিগের আর বাকি রহিল না। মৃণালিনী যে অতি গুপ্তভাবে সাতকড়ির প্রতি অবৈধভাবে অনুরক্ত, তাহা এইবার প্রকাশিত হইয়া পড়িল। সাতকড়িও অবস্থা বুঝিয়া, আপনার সমস্ত অপরাধই স্বীকার করিল এবং হত্যার কারণ কি ও যাহা ঘটিয়াছিল, সে সকলই আনুপূর্বিক আমাদিগকে বিশদভাবে বিবৃত করিল।

সাতকড়ি বলিতে লাগিল, ‘যোগেনবাবুকে হত্যা করিব বলিয়াই আমি রামগোপালের সাহায্যে তাঁহার সহিত আলাপ করি। যাহাতে যোগেনবাবুকে হত্যা করিয়া রামগোপালের ঘাড়ে হত্যাকাণ্ডের দোষ চাপাইতে পারি, ইহার জন্যই ‘বাঘা’ কুকুরকে সঙ্গে লইয়াছিলাম, কারণ লোকে জানিত, ‘বাঘা’ রামগোপাল ও মৃণালিনী ভিন্ন অপর কাহারো সহিত কোথাও যায় না। মৃণালিনীর প্রতি অবৈধ আসক্তিই আমার যোগেনবাবুকে হত্যা করিবার জন্য উত্তেজিত করিয়াছিল। ইহার আরও উদ্দেশ্য ছিল, যোগেনবাবু মরিলে ও রামগোপাল দোষী সাব্যস্ত হইলে, রামগোপালের ফাঁসি হইবে নিশ্চয় এবং তখন তাহার অতূল সম্পত্তি ভোগ দখল করিতে কেবলমাত্র মৃণালিনীই থাকিবে। মৃণালিনীর সহিত আমিও সুখে ভোগদখল করিতে পারিব।’

গিরিজা। তুমি কেমন করিয়া খুন করিলে?

সাতকড়ি। আমি যখন যোগেনবাবুর বাটী যাই, তখন রামগোপালের মত পোশাক পরিয়াই গিয়াছিলাম। সঙ্গে ‘বাঘা’ কুকুরও গিয়াছিল। দারোয়ান আমাকে রামগোপাল বলিয়াই মনে করিয়াছিল। যখন যোগেনবাবুর ঘরে প্রবেশ করি, তখন তিনি মেজেতে দাঁড়াইয়া কি করিতেছিলেন। আমি একবারে গিয়া এই ছুরি তাঁহার ঘাড়ে বসাইয়া দিলাম। যেমন আঘাত করিলাম, যোগেনবাবু তেমনই ভূমিতে পড়িয়া গেলেন, তদ্দণ্ডেই তাঁহার প্রাণবায়ু বাহির হইয়া গেল। আমি আরও দু’চারি ঘা দিলাম এবং কিছুক্ষণ পরে তাঁহার অঙ্গুলি দিয়া, ‘রা—ম—গো’ এই কয়েকটি কথা লিখিয়া বাহির হইলাম। আমি মনে মনে নিশ্চিত ধারণা করিয়াছিলাম যে, রামগোপালের উপরই পুলিশের সন্দেহ হইবে এবং তাহাকেই ধরিবে। হায়! তখন মনে করি নাই যে, অধর্মের জয় কখনও হয় না। ভগবান নির্দোষীর দণ্ডবিধান করেন না।

গিরিজা। সে যাহা হউক, হত্যা করিবার সময় তোমার মাথা ঠিক ছিল না বাবু! তুমি একটা মহা ভুল করিয়াছিলে। তাড়াতাড়ি করিতে গিয়া, যোগেনবাবুর বাম হস্তের আঙ্গুল দিয়াই লিখিয়া আসিয়াছিলে।

সাতকড়ি। না মহাশয়, এ বিষয়ে আমার মাথা আপনাদের চেয়েও স্থির ছিল। কেন, আপনারা কি শুনেন নাই যে, যোগেনবাবু বাম হস্তেই সকল কার্য সম্পাদন করিতেন!’

কিন্তু কি আশ্চর্যের বিষয়, কি গিরিজাবাবু কি পুলিশসাহেব, এ প্রশ্নটি কাহারও মনে তো উদয় হয় নাই।

আমরা কালবিলম্ব না করিয়া আসামীকে থানায় লইয়া গেলাম।

পরদিন এই মোকদ্দমা ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে উঠিল। ২/৩ দিন শুনানীর পরই তিনি মোকদ্দমাটি দায়রা সোপরদ্দ করিলেন।

মহামান্য হাইকোর্টের বিচারে সাতকড়ির ফাঁসির আদেশ হইল।

মৃণালিনী হত্যাকাণ্ডের সাহায্য করিয়াছেন বলিয়া অভিযুক্ত হইয়াছিলেন বটে, কিন্তু বিচারে তাঁহার বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যায় নাই, সুতরাং তিনি মুক্তি পাইলেন।

নির্দোষী রামগোপালও জজ সাহেবের সূক্ষ্ম বিচারে মুক্তি লাভ করিলেন। বলা বাহুল্য, রামগোপালের মুক্তিতে সকলেই সুখী হইলেন এবং আমরাও সুখানুভব করিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *