হর বনাম কালী
কালীপদ মন্ডলের আত্মাকে তাড়া করে—করে হর কাপালিক হাপসে পড়েছে। কালীপদ আজ সকালেই গত হল। তা গত হওয়ার আগেই সেই রাত বারোটার সময় কালীপদর বউ গিয়ে তার হাতে—পায়ে ধরে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, ”মিনসে দু’ কলস রুপোর টাকা আর দেড়শো মোহর কোথায় লুকিয়ে রেখেছে কিছুতেই বলছে না, বাবাজি। যদি পটল তোলে তা হলে যে সব যাবে।”
হর কাপালিক গম্ভীর হয়ে বলেছিল, ”তা বন্দোবস্ত কীরকম হবে?”
কালীপদর বউ তখন চোখের জলে ভেসে বলেছিল, ”দশটা রুপোর টাকা দেব বাবাজি, এর বেশি আর চেয়ো ন।”
হর হাঃ হাঃ করে হেসে বলেছিল, ”ছুঁচো মেরে আমি হাত গন্ধ করি না। আর রুপো? ওর আর কী এমন দাম!”
তা দরদস্তুর একটা ঠিক হল। হদিশ হলে হর কাপালিক দশ মোহর আর বিশ রুপোর টাকা পাবে।
রাত দেড়টায় কালীপদর বাড়ি গিয়ে যা অবস্থা দেখল হর, তা সুবিধের নয়। কালীপদর বাক্য হরে গেছে, চোখ উলটে গোঁ—গোঁ করছে। হর অনেক মন্তর—তন্তর ছাড়ল বটে, তাতে সুবিধে হল না। কালীর মুখ থেকে বাক্যি বেরোল না। গোঁ গোঁ যে আওয়াজ বেরোচ্ছিল তার মর্মোদ্ধার করতে পারলে হয়তো হত। কিন্তু সে বিদ্যে হরর জানা ছিল না।
কালীর বউ দাক্ষায়ণী চেঁচাচ্ছিল, ”বাবাজি, এ যে পটল তুলল বলে! ভালো করে মন্তর ঝাড়ো, নইলে যে সব গেল গো!”
হর দেখল, কালীর হয়ে এসেছে। আত্মাটা বেরোল বলে। এই অবস্থাতার মুখ থেকে বাক্যি বের করা অসম্ভব। তবে উপায় আছে। আত্মাটা শরীর ছেড়ে বেরোলে সেটাকে কপ করে ধরে একটু শোধন করে ফের শরীরের মধ্যে চালান দিলে কালী ধড়ফড় করে উঠে পড়বে। তখন বাক্যি বের করা জলবত্তরলং।
তক্কে—তক্কে ছিল হর। সকালের দিকটায় আত্মাটা প্রথম উঁকি মারল নাকের ফুটো দিয়ে। কিন্তু মুন্ডুটা বের করে হরকে দেখেই সুড়ুৎ করে ফের ভেতরে ঢুকে গেল।
দাক্ষায়ণী ফের চেঁচামেচি জুড়ে দেওয়ায় হর একটা পেল্লায় ধমক দিল, ”চোপ! অম চেঁচামেচি করলে আত্মাটা যে ভিরমি খাবে বাপু! তখন এমন ডুব মেরে থাকবে যে, টিকিটারও নাগাল পাওয়া যাবে না।”
আর ঘণ্টাটাক বাদে আত্মাটা কালীর বাঁ কানের ভিতর থেকে উঁকি দিতেই হর কপাত করে থাবা মারল। কিন্তু অল্পের জন্য হল না। আত্মাটা টুক করে মুন্ডু সরিয়ে নিল।
বারবার তিনবার। হর কাপালিক বাঘের মতো খাপ পেতে বসে ছিল। এবার যাতে আর ব্যাটা ঢুকতে না পারে।
কিন্তু কী হল, এই সময়ে একটা নচ্ছার মশা কোথা থেকে এসে নাচতে—নাচতে কালীর নাকের মধ্যে ঢুকে গেল। আর তাই সর্বনাশ। মশার তাড়নায় মৃতপ্রায় কালীও হঠাৎ প্রবল একখানা হ্যাঁচ্চেচা দিয়ে ফেলল। আর তখনই আত্মাটা গুড়ুলের মতো মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে পাঁই পাঁই করে পালাতে লাগল।
তা হরও ছাড়বার পাত্র নয়। ”ধর! ধর!” বলে করল তাড়া।
তা ধরা কি সহজ? কালীর আত্মা এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোন পেরিয়ে গিরীশ নন্দীর আমবাগানে ঢুকে পড়ল। তারপর একটা গাছের ডালে চড়াই পাখিটির মতো বসে ইতি—উতি চাইতে লাগল।
গাছতলায় দাঁড়িয়ে হর কাপালিক প্রথমটায় চোখ রাঙিয়ে খুব ধমকাল, ”নেমে আয়! নেমে আয় বলছি! নইলে কী হবে জানিস তো? এমন ঝাঁটাপেটা আর সর্ষেপোড়া দেব যে, আবার তোর মরতে ইচ্ছে করবে।”
কিন্তু ধমকে কাজ হল না। কালীর আত্মা দিব্যি ফুরফুরে হাওয়ায় গাছের ডালে বসে রোদ পোহাতে—পোহাতে চারদিকের দৃশ্য দেখতে লাগল।
হর তখন কাকুতিমিনতি করতে লাগল, ”নেমে আয় বাপু, নেমে আয়। অমন মগডালে বসে থাকিসনি। পড়ে হাড়গোড় ভাঙবে। কাজটা কি ঠিক হচ্ছে রে? মরবি মর, তা বলে পরিবারটাকে ভাসিয়ে যাওয়াটা কি ভালো কাজ হচ্ছে রে! নরকে যাবি যে! আয় বাপু, নেমে আয়, আবার শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়, কত আনন্দ হবে দেখিস।”
তা কালীর আত্মা তাকে মোটেই পাত্তা না দিয়ে ফের উড়ল। তারপর উড়তে—উড়তে পুরনো জমিদারবাড়ির মস্ত উঁচু দেউড়ির মাথায় যে পাথরের পরিটা আছে তার মাথায় বসে যেন মনের আনন্দে গান গাইল কিছুক্ষণ। না, গানটা অবশ্য শুনতে পেল না হর। সে আঠাকাঠি, জালদড়ি নিয়ে নানারকম কসরত করতে লাগল। যদি আত্মাটাকে নামিয়ে এনে ঝোলায় পোরা যায়।
কিন্তু কালীর আত্মা মহা ট্যাটন। কিছুক্ষণ গানটান গেয়ে আবার উড়ল। হর দৌড়তে লাগল পিছু—পিছু। শুধু কি দৌড়! কখনও পুকুরে নামতে হল, কখনও খালের জলে পড়ল, কখনও কাঁটাগাছে ক্ষতবিক্ষত হতে হল।
শেষে তেপান্তরের মাঠের মতো একটা ফাঁকা মাঠে একটা সজনে গাছের ডাল ধরে কালীর আত্মা দিব্যি ঝুল খেতে—খেতে তাকে মুখ ভেংচে বলল, ”তোমার কেরদানি জানা আছে।”
হর হাঁফাতে—হাঁফাতে বলল, ”নেমে আয় বাপু, তোর গায়ে আঁচড়টিও কাটব না। ভালো করে ধুইয়ে মুছিয়ে শরীরটার মধ্যে ঢুকিয়ে দেব। তারপর তোর ছুটি।”
”হেঁঃ হেঁঃ। অত সোজা নয় হে। ফের শরীরের মধ্যে ঢোকাব আর দাক্ষায়ণী দু’বেলা আমাকে উস্তম—কুস্তম করে ভূত ঝাড়বে তা আর হচ্ছে না। এই যে বেরিয়ে পড়েছি, কী যে আনন্দ হচ্ছে তা বলার নয়। এখন খাবদাব, মজা করে ঘুরব।”
”তোর আক্কেলের বলিহারি যাই। আত্মা অবার খায় নাকি? খেতে হলে মুখ চাই, পেট চাই, দাঁত চাই, জিভ চাই। তা তুই সেসব পাবি কোথায়? ছেলেমানুষি করিস না, নেমে আয়। শরীরে ঢুকলে সব পাবি। দাঁত, জিভ, পেট সব। তখন কত খাবি দেখিস।”
”হ্যাঁ, দাক্ষায়ণী আমাকে খাওয়াবে! বেঁচে থাকতে কী খেতে দিত জানো? কচু ঘেঁচু আর আলুপোড়া। যা হে বাপু, এই আমি বেশ আছি।
”না রে না, তুই মোটেই বেশ নেই। বাপু রে, এরকম বাউন্ডুলে ঘুরে বেড়ানো কি ভালো? ঝড়বৃষ্টি শীতে কষ্ট পাবি যে। ছাতা পাবি না, কম্বল পাবি না। তার ওপর যমদূতেরা চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেখতে পেলেই ধরে যমরাজের কাছে হাজির করবে। বড্ড হেনস্তা হবি যে। নেমে আয় বাপু।”
”না হে না, ওসব হচ্ছে না। তোমার মতলব বেশ জানি। দু’ঘড়া রুপোর টাকা আর দেড়শো মোহরের লোভেই এসব করছ তো! অত সোজা নয়। সে—খবর আমি কাউকে দেব না।”
”তবে রে!” বলে হর ফের তাড়া করল। কালীর আত্মা ফুড়ুত করে উড়ে পালাল।
ছুটতে ছুটতে হর কাপালিকের ঘাম ছুটে গেল। পা আর চলে না। চোখে সর্ষেফুল নৃত্য করতে লাগল। হর কাপালিক একটা গাছতলায় বসে অনেকক্ষণ দম নিল হ্যা—হ্যা করে। কালীর আত্মা পগারপার হয়েছে।
ল্যাংচাতে—ল্যাংচাতে, কাঁকালে ব্যথা নিয়ে হর কাপালিক যখন ফিরে আসছিল তখন হঠাৎ দূর থেকেই শুনতে পেল, কালীপদর বাড়িতে খুব শোরগোল হচ্ছে।
হর গিয়ে কালীর দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁ হয়ে গেল। কালী দিব্যি বসে—বসে ফলার করছে আর দাক্ষায়ণী দাঁড়িয়ে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে তাকে।
হর বলল, ”অ্যাঁ! আত্মাটা তা হলে ঢুকে গেছে দেখছি! ঢুকবেই জানতাম। যা তাড়া করেছিলাম তা আর বলার নয়!”
দাক্ষায়ণী বলল, ”বাবাজির যেমন কথা! আত্মা ঢুকবে কী গো! সেই যে হাঁচি দিল তাইতে তুমি তো ভয় খেয়ে পালালে। আর ওই হাঁচির পরই তো ইনি দিব্যি উঠে বসলেন।”
”অ্যাঁ!”
”হ্যাঁ।”
”ও তা হলে মন্তরেই কাজ হয়েছে। ঠিক আছে, এবার তা হলে ভাগজোখ হয়ে যাক।”
কালীপদ খেঁচিয়ে উঠে বলল, ”কীসের ভাগজোখ হে! অ্যাঁ! কীসের ভাগজোখ?”
হর একটু দমে গিয়ে বলল, ”আমার কিছু পাওনা হয়।”
”কচু হয়। যাও, যাও, এখন বিরক্ত কোরো না। অনেকদিন পর বাড়িতে একটু আদরযত্ন পাচ্ছি।”
হর কাপালিকের ইচ্ছে হল, হাতের চিমটেটা দিয়ে কালীকে ঘা কতক দেয়। তারপর আত্মাটাকে বের করে কমন্ডলুতে পুরে নিয়ে যায়। কিন্তু সেসব করতে সাহস হল না। দাক্ষায়ণী তার দিকে যে চোখে চাইছে তা সুবিধের নয়। ট্যা—ফোঁ করলে হয়তো পাখার বাঁট দিয়ে ঘা কতক বসিয়ে দেবে! কালীর বেঁচে থাকা মানে দু’ঘড়া রুপো আর দেড়শো মোহর।
হর কাপালিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রওনা দিল।