কালাচাঁদের দোকান
নবীনবাবু গরিব মানুষ। পোস্ট অফিসের সামান্য চাকরি। প্রায়ই এখানে—সেখানে বদলি হয়ে যেতে হয়। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভাবসাব নেই। প্রায়ই ধারকর্জ হয়ে যায়। ঋণ শোধ দিতে নাভিশ্বাস ওঠে। নবীনবাবুর গিন্নি স্বামীর ওপর হাড়ে চটা। একে তো নবীনবাবুর ট্যাঁকের জোর নেই, তার ওপর লোকটা বড্ড মেনিমুখো আর মিনমিনে। এই যে যখন—তখন যেখানে—সেখানে বদলি করে দিচ্ছে, নবীনবাবু যদি রোখাচোখা মানুষ হতেন তবে পারত ওরকম বদলি করতে? বদলির ফলে ছেলেপুলেগুলোর লেখাপড়ার বারোটা বাজছে। আজ এ—স্কুল কাল অন্য স্কুল করে বেড়ালে লেখাপড়া হবেই বা কী করে?
এবার নবীনবাবু নিত্যানন্দপুর বলে একটা জায়গায় বদলি হলেন। খবরটা পেয়েই গিন্নি বললেন, ”আমি যাব না, তুমি যাও। আমি এখানে বাসা ভাড়া করে থাকব। আর বদলি আমার পোষাচ্ছে না বাপু!”
নবীনবাবু মাথা চুলকে বললেন, ”তাতে খরচ বাড়বে বই কমবে না। ওখানে আমারও তো আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। দুটো এস্টাব্লিশমেন্ট টানব কী করে?”
গিন্নি বললেন, ”ঠিক আছে, যাব। কিন্তু তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে এর পর বদলি করলে তুমি কিছুতেই বদলি হতে রাজি হবে না। সরকারকে পরিষ্কার জানিয়ে দিতে হবে যে, তুমি দরকার হলে মামলা করবে। তোমার মতো মেনিমুখো পুরুষদের পেয়েই তো নাকে দড়ি দিয়ে ওরা ঘোরায়।”
নবীনবাবু মিনমিন করে বললেন, ”একখানা দরখাস্ত নিয়ে ওপরওয়ালার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তা তিনি বললেন, নিত্যানন্দপুর থেকে আর বদলি করবে না। দেখা যাক।”
বাক্স—প্যাঁটরা গুছিয়ে সপরিবার এক শীতের সন্ধেবেলা নবীনবাবু নিত্যানন্দপুরে এসে পৌঁছলেন। বেশ ধকল গেল। ট্রেন থেকে নেমে অনেকটা পথ গোরুর গাড়িতে এসে তারপর আবার নদী পেরিয়ে আরও ক্রোশ দুই পথ পেরোলে তবে নিত্যানন্দপুর। গঞ্জমতো জায়গা। তবে নিরিবিলি, ফাঁকা—ফাঁকা।
রাত্রিটা পোস্টমাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন একখানা বাসা ভাড়া করলেন। পাকা বাড়ি, টিনের চাল। উঠোন আছে, কুয়ো আছে।
জায়গাটা ভালোও নয়, মন্দও নয়। ওই একরকম। তবে ভরসা এই যে, আর বারবার ঠাঁইনাড়া হতে হবে না। ওপরওয়ালা কথা দিয়েছে, এখানেই বাকি চাকরির জীবনটা কাটাতে পারবেন নবীনবাবু।
তাঁর স্ত্রী অবশ্য নাক সিঁটকে বললেন, ”কী অখেদ্দে জায়গা গো! এ যে ধাপধাড়া গোবিন্দপুর! অসুখ হলে ডাক্তার—বদ্যি পাওয়া যাবে কি না খোঁজ নিয়ে দেখো। দোকানপাটও তো বিশেষ নেই দেখছি। বাজারহাট কোথায় করবে?”
নবীনবাবু বললেন, ”বাজার এখান থেকে এক ক্রোশ। তাও রোজ বসে না। হপ্তায় দু’দিন হাট।”
তবেই হয়েছে। এখানে ইস্কুলটা কেমন খোঁজ নিয়েছ?”
”ইস্কুল একটা আছে মাইলটাক দূরে। কেমন কে জানে!”
”জায়গাটা এমন বিচ্ছিরি বলেই এখান থেকে তোমাকে আর বদলি না করতে ওপরওয়ালা সহজেই রাজি হয়ে গেছে। এখন মরি আমরা এখানে পচে।”
নবীনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ”কী আর করা! নিত্যানন্দপুরেই মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে।”
প্রথমদিন বাজার করতে দু’ ক্রোশ দূরে গিয়ে বেশ দমেই গেলেন তিনি। জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। প্রত্যন্ত গাঁ, এখানে জিনিস আনতে ব্যাপারীদের অনেক খরচ হয়। জিনিসপত্র তেমন ভালোও নয়। পাওয়া যায় না সব কিছু।
বাজারের হাল শুনে গিন্নি চটলেন। বললেন, ”আবার দরখাস্ত করে অন্য জায়গায় বদলি নাও। এ—জায়গায় মানুষ থাকে? মা গো!”
নবীনবাবু ফাঁপড়ে পড়লেন। এখন কী করা যাবে তাই ভাবতে লাগলেন।
একদিন সন্ধেবেলা গিন্নি এসে বললেন, ”ওগো, খুকি তেলের শিশিটা ভেঙে ফেলেছে। একটি ফোঁটাও তেল নেই আর। রাতে রান্না হবে কী দিয়ে?”
”দ্যাখো না একটু খুঁজে—পেতে। অনেক গেরস্তবাড়িতে ছোটখাটো জিনিস পাওয়া যায় শুনেছি।”
অগত্যা নবীনবাবু বেরোলেন। বেশি লোকের সঙ্গে চেনাজানা হয়নি এখনও। কার বাড়ি যাবেন ভাবছেন। ডান হাতি পথটা ধরে হাঁটছেন। ডান ধারে একটু জঙ্গল মতো আছে। হঠাৎ দেখতে পেলেন, জঙ্গলের একটু ভেতর দিকে একটা আলোই যেন জ্বলছে মনে হল। নবীনবাবু কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ঠাহর করে দেখলেন, একখানা ঝাঁপতোলা দোকান বলেই যেন মনে হচ্ছে। নবীনবাবু এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, দোকানঘরই বটে। দীনদরিদ্র চেহারা হলেও দোকানই। কালো রোগাপানা কণ্ঠধারী একজন লোক দোকানে বসে আছে। বিনয়ী মানুষ। নবীনবাবুকে দেখেই টুল থেকে উঠে বলল, ”আজ্ঞে আসুন।”
নবীনবাবু খুশি হলেন। আজকাল বিনয় জিনিসটা দেখাই যায় না। সরষের তেলের খোঁজ করতেই লোকটা বলল, ”আছে। ভালো ঘানির তেল।”
”কত দাম?”
লোকটা হেসে মাথা চুলকে বলল, ”দাম তো বেশ চড়া। তবে আপনার কাছ থেকে বেশি নেব না। ছ’টাকা করেই দেবেন।”
নবীনবাবু খুবই অবাক হলেন, দু’ ক্রোশ দূরের বাজারে তেল দশ টাকা। নবীনবাবু আড়াইশো গ্রাম তেল কিনে আনলেন। গিন্নি তেল পরীক্ষা করে বললেন, ”বাঃ, এ তো দারুণ ভালো তেল দেখছি। কোথায় পেলে গো?”
নবীনবাবু বললেন, ”আরে, কাছেই একটা বেশ দোকানের সন্ধান পেয়েছি। লোকটা বড় ভালো।”
লোকটা যে সত্যিই ভালো তার প্রমাণ পাওয়া গেল দু’দিন পরেই। ডাল ফুরিয়েছে। সন্ধের পর সেই দোকানে গিয়ে হানা দিতেই বিনয়ী লোকটা প্রায় অর্ধেক দামে ডাল দিল। বলল, ”আপনাকে দাম দিতে হবে না।”
নবীনবাবু ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলেন, ”আপনার নামই তো জানি না এখনও।”
”আজ্ঞে কালাচাঁদ নন্দী। ‘কালো’ বলেই ডাকবেন।”
”আপনি কি সব জিনিসই রাখেন কালোবাবু?”
”যে আজ্ঞে। তবে সন্ধের পর আসবেন। দিনমানে আমি দোকান খুলি না। ও—সময়ে আমার চাষবাস দেখতে হয়।”
দিন দুই পর গিন্নি হঠাৎ বললেন, ”ও গো, আজ একটু পোলাও খাওয়ার বায়না ধরেছে ছেলেমেয়েরা। ঘি আর গরম মশলা লাগবে। এনে দেবে নাকি একটু?”
কালোর দোকানে ঘি বা গরম মশলা পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছিল না নবীনবাবুর। দোনোমনো করে গেলেন।
কালাচাঁদ বলল, ”হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন পাবেন না? এক নম্বর ঘি আছে, আর বাছাই গরম মশলা।”
”দাম?”
”দাম তো অনেক। তবে আপনাকে অত দিতে হবে না। দশ টাকা করেই দেবেন।”
নবীনবাবুর হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। খানিকক্ষণ কালাচাঁদের সঙ্গে সুখ—দুঃখের কথা বলে তিনি ফিরে এলেন। গিন্নি ঘি আর গরম মশলা দেখে খুব খুশি। বললেন, ”ওগো, দোকানটা খোকাকে চিনিয়ে দিয়ো তো! দরকার মতো ওকেও পাঠাতে পারব। তা হ্যাঁ গো, দোকানটা কি নতুন খুলেছে? আজ দাস বাড়ির গিন্নি গল্প করতে এসেছিল। কথায়—কথায় তাকে কালাচাঁদের দোকানের কথা বললুম। কিন্তু সে তো আকাশ থেকে পড়ল, বলল, ”সাত জন্মে কালাচাঁদের দোকানের কথা শুনিনি।”
”হবে হয়তো, নতুনই খুলেছে। আমি খোঁজ নিয়ে বলব’খন।”
দু’দিন পর ফের কালোজিরে আর ময়দা আনতে গিয়ে নবীনবাবু বললেন, ”তা হ্যাঁ কালাচাঁদবাবু, আপনার দোকানটা কতদিনের পুরনো?”
কালাচাঁদ ঘাড়টাড় চুলকে অনেক ভেবে বলল, ”তা কম হবে না। ধরুন, এ—গাঁয়ের পত্তন থেকেই আছে।”
নবীনবাবুর একটু খটকা লাগল। দোকান যদি এত পুরনোই হবে তা হলে দাস—গিন্নি এ—দোকানের কথা শোনেনি কেন?
কালাচাঁদ যেন তাঁর মনের কথা পড়ে নিয়েই বলল, ”এ—গাঁয়ে আমার অনেক শত্রু। লোকের কথায় কান দেবেন না।”
”আচ্ছা, তাই হবে।”
পরদিন নবীনবাবু এক বাড়িতে নারায়ণ পুজোর নেমন্তন্ন খেয়ে ফেরার পরই গিন্নি বললেন, ”হ্যাঁ গা, তোমার কালাচাঁদের দোকানটা কোথায় বলো তো! খোকাকে কুয়োর দড়ি আনতে পাঠিয়েছিলাম, সে তো দোকানটা খুঁজেই পেল না। পোস্ট অফিসের পিয়ন বিলাস এসেছিল। সেও বলল, ওরকম দোকান এখানে থাকতেই পারে না। বলল, ‘নবীনবাবুর মাথাটাই গেছে।”
নবীনবাবুর বুকের মধ্যে একটু যেন কেমন করল। মুখে বললেন, ”কালাচাঁদের সঙ্গে অনেকের শত্রুতা আছে কিনা, তাই ওরকম বলে।”
পরদিন টর্চের ব্যাটারি আনতে গিয়ে নবীনবাবু এ—কথা সে—কথার পর কালাচাঁদকে বললেন, ”তা কালাচাঁদবাবু, আমার ছেলেও কাল আপনার দোকানটা খুঁজে পায়নি।”
কালাচাঁদ বিনয়ের সঙ্গে বলল, ”আর কাউকে পাঠানোর দরকার কী? নিজেই আসবেন।”
”ইয়ে অন্যরা সব বলছে যে, কেউ নাকি এ—দোকানের কথা জানে না।”
কালাচাঁদ তেমনই মৃদু—মৃদু হেসে বলে, ”জানার দরকারই বা কী? আপনার ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।”
নবীনবাবুর বুকটা একটু দুরদুর করে উঠল। বললেন, ”হ্যাঁ, তা আমি তো আমিই। কিন্তু আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো খদ্দের কখনও দেখি না। দোকানটা চলে কী করে?”
কালাচাঁদ বিনীতভাবে বলল, ”একজনের জন্যই তো দোকান।’
”অ্যাঁ!”
কালাচাঁদ হাসল, ”আসবেন।”
নবীনবাবু চলে এলেন। কিন্তু তারপর আবার পরদিনই গেলেন। মাসের শেষ, হাতে টাকা নেই। খুব সঙ্কোচের সঙ্গে বললেন, ”কয়েকটা জিনিস নেব। ধারে দেবেন?”
”হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন নয়?”
”পরের মাসে মাইনে পেয়েই দিয়ে যাব।”
”তাড়া কীসের?”
ধারে প্রচুর জিনিস নিয়ে এলেন নবীনবাবু। পরের মাসে ধার শোধ করতে গেলে কালাচাঁদ জিভ কেটে বলল, ”না না, অত নয়। আমার হিসেব সব লেখা আছে। পাঁচটি টাকা মোটে পাওনা। তাও সেটা দু’দিন পর হলেও চলবে। বসুন, একটু সুখ—দুঃখের কথা কই। টাকা—পয়সার কথা থাক।”
নবীনবাবু খুবই অবাক হলেন! পাঁচ টাকা পাওনা! বলে কী লোকটা? তিনি অন্তত দেড়শো টাকার জিনিস নিয়েছেন।
তা এভাবেই চলল। চাল, ডাল, মশলাপাতি, ঘি, তেল সবই কালাচাঁদের দোকান থেকে আনেন নবীনবাবু। মনিহারি জিনিস, বাচ্চাদের খেলনা, পোশাক, শাক সবজিও ক্রমে—ক্রমে আনতে লাগলেন। মাছ মাংসও পাওয়া যেতে লাগল কালাচাঁদের আশ্চর্য দোকানে। গিন্নি খুশি। নবীনবাবুর মাইনে অর্ধেকেরও ওপর বেঁচে যাচ্ছে।
নবীনবাবু একদিন গিন্নিকে বললেন, ”ওগো নিত্যানন্দপুর থেকে বদলি হওয়ার দরখাস্তটা আর জমা দেওয়া হয়নি।”
”দিয়ো না। হ্যাঁ গো, কালাচাঁদের দোকানটা ঠিক কোথায় বলো তো! আমাকে একদিন নিয়ে যাবে?”
নবীনবাবু শশব্যস্তে বললেন, ”না না, তোমাদের কারও যাওয়ার দরকার নেই। সকলের কি সব সয়?”
গিন্নি চুপ করে গেলেন।
নবীনবাবু নিত্যানন্দপুরেই রয়ে গেলেন।