বড় চোর ছোট চোর
হরেকেষ্ট বোষ্টমের বাড়িতে চুরি করতে ঢুকতে যাবে এমন সময় শীতল সাধুখাঁর সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি। নবু দাস কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ”শীতলদাদা যে!”
শীতল একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলল, ”দিনকাল কী পড়ল রে নবু, মগজ পাকল না, হাত মকশো হল না, গুরুবরণ হয়নি, দুধের ছোকরারা সব লাইনে নেমে পড়ল! ছি ছি! বিদ্যেটার ওপর ঘেন্না ধরে গেল রে!”
শীতল দাস মান্যগণ্য লোক। লাইনে তার খুব নামডাক। বয়সেও বড়। তবু কথাগুলো শুনে নবুর ভারি আঁতে লাগল। বলল, ”দ্যাখো শীতলদাদা, আমাদেরও ঘর—সংসার আছে, আমাদেরও পেট চালাতে হয়। একজন লুটেপুটে খাবে, আর আমরা আঙুল চুষব, এ তো নিয়ম নয়। আর মগজ পাকার কথা বলছ? মগজ কি আর ঘরে বসে থাকলে পাকবে? কাজে নামলেই মগজ খোলে। আর হাত পাকানোর কথা যদি বলো, তা হলে আমিও বলি, গেল হপ্তায় কি আমি বিদ্যেধর মণ্ডলের লোহার সিন্দুক ভাঙিনি?”
শীতল কঠিন হাসি হেসে বলল, ”তা ভেঙেছিস! তবে পেয়েছিলি তো লবডঙ্কা! সিন্দুকের জিনিস সেদিনই বিদ্যেধর সব সরিয়ে ফেলেছিল। তোর বরাতে জুটেছিল এক বান্ডিল দস্তাবেজ, এক পুঁটুলি তামার পয়সা আর পঁচিশটি টাকা।”
নবু বলল, ”সেটা বড় কথা নয় শীতলদা। সিন্দুক যে ভেঙেছিলাম, সেটা তো স্বীকার করবে?”
এইভাবে দু’জনের মধ্যে তুমুল তর্ক বেধে গেল। তবে কোনো চেঁচামেচি নেই, ঝগড়া হচ্ছিল ফিসফিস করে, যাতে গেরস্তর ঘুম না ভেঙে যায়! ফিসফিস করে ঝগড়া করা সোজা কথা নয়। এলেম লাগে।
শীতল বলল, ”দ্যাখ নবু, বড়দের মুখে—মুখে যে কথা বলতে নেই, এই শিক্ষেটেও তোর হয়নি দেখছি। চোর—ডাকাত যা—ই হোস, মানীর মানটা তো দিবি! যাকগে, এখন তুই কেটে পড়। সামনের ফাল্গুনে আমার ছোট মেয়ের বিয়ে। পাত্রপক্ষ ছ’ হাজার টাকা পণ চেয়েছে। তার উপর সোনাদানা। বিয়ের খরচখরচা তো বড় কম নেই! তুই বরং শিবু হালুইয়ের বাড়িতে গিয়ে কাজ সেরে আয়। সকালে গোরু কিনতে প্রতাপপুরের গোহাটায় যাবে বলে শিবু সাত হাজার টাকা জোগাড় করে রেখেছে। খাটের নিচে মেটে হাঁড়িতে আছে। যা, গিয়ে হাসিল করে আয়।”
প্রেস্টিজে লাগলেও নবু আর কথা বাড়ায়নি। শীতলদাকে চটিয়ে লাভ নেই। বুড়ো চোরদের একটা জোট আছে। সে নতুন লাইনে নেমেছে, ট্যান্ডাইম্যান্ডাই করলে, বিপদ হতে কতক্ষণ? বুড়ো চোরদের সে পছন্দ করে না বটে, কিন্তু এটা মানে যে, শীতল সাধুখাঁ, বিরিঞ্চি মণ্ডল, বিরু গায়েন, হরিপদ কীর্তনীয়ার মতো ওস্তাদের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। ওদের দোষ একটাই। নবুকে তারা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না।
একটু দাঁড়িয়ে শীতল সাধুখাঁর হাতের কাজ আর কৌশলটা দেখার ইচ্ছে ছিল নবুর। কিন্তু দেরি হয়ে যাবে বলে আর দাঁড়ায়নি।
মুশকিলটা হল, শিবু হালুইয়ের বাড়িতে ঢুকতে যেতেই, শিবুর মেজোখুড়ো যে একটু মাথাপাগলা লোক, এটা তার খেয়াল ছিল না। লোকটার দোষ হল, দাওয়ায় বসে সারারাত বকবক করে। লোকে বলে, পবনখুড়ো নাকি ভূতপ্রেতের সঙ্গে কথা কয়।
দাওয়ার দিকটায় সুবিধে নেই দেখে, নবু পিছন দিকটায় কচুবন পেরিয়ে গিয়ে জানালা ফাঁক করল বটে, কিন্তু কাজটা মোলায়েম হল না।
দু’বার দু’টো খটাং আর মচাৎ শব্দ করে ফেলল। শীতল সাধুখাঁ ভুল বলেনি। এখনও তার সত্যি হাত মকশো হয়নি, গুরুমারা বিদ্যেও নেই। তবে পাকা মাথা হলে ভালো করে সুলুকসন্ধান আর আপৎকালের ফন্দিফিকির জেনে—বুঝে আসত। বিপদটা হল, ওই শব্দে সামনের দাওয়ায় পবনখুড়োর বকবকানি বন্ধ হয়ে গেল। আর ঘরের ভিতর থেকে শিবু হালুই ঘুমজড়ানো গলায় একটা হাঁক মারল, ”বলি ও মেজোখুড়ো, কথা কইছ না যে বড়! তোমার কথা বন্ধ হলে যে আমার ঘুমের অসুবিধে হয়।”
পবনখুড়ো বলল, ”এই একটু জল খেলুম বাপ। কথা তো সেলাই করতে হয় কিনা, তাই গলাটা শুকিয়ে যায়। টেনে ঘুম দে বাপু। কথা আর থামাচ্ছি না।”
পবনখুড়ো ফের বকবক শুরু করল। শিবু হালুইয়েরও নাক ডাকতে লাগল। নবু ডিং মেরে জানলা গলিয়ে ঘরের ভিতর সেঁধিয়ে গেল। কিন্তু খাটের নিচে নজর করে বড্ড দমে গেল সে। মেটে হাঁড়ির যেন হাট বসে গিয়েছে। গিজগিজ করছে মেটে হাঁড়ি। এর কোনটায় হালুয়ের পো—র সাত হাজার টাকা আছে, তা কে জানে? প্রথম হাঁড়ির মুখ থেকে মালসা সরিয়ে হাত ঢুকিয়ে দেখল, গলা অবধি ধান। পরেরটায় চিটেগুড়। তার পরেরটায় তিসির তেল। কিন্তু হাল ছাড়লে তো হবে না! পরের হাঁড়িটা হাতড়ে দেখে নবু বুঝল, জায়গাটা ফাঁকা। কিন্তু হাঁড়ি রাখার বিঁড়েটা পড়ে আছে। অর্থাৎ চার নম্বর হাঁড়িটা যথাস্থানে নেই। তা হলে কি হাঁড়ি নিয়ে কেউ হাওয়া হয়েছে? গুটিদশেক হাঁড়ি তল্লাশের পর হাল ছাড়তে হল। কারণ, পবনখুড়োর বকবকানি থেমেছে এবং শিবু হালুইয়ের ঘুমও ভেঙেছে। সে হাঁক দিল, ”এ খুড়ো! ফের চুপ মেরে গেলে কেন?”
”চুপ কি আর সাধে মারি বাপ? তোর ঘরে যে ইঁদুর ঢুকেছে। বেজায় কুটুর—কুটুর শব্দ শুনছি। বলি, টাকাগুলো যদি কেটে রেখে যায়, তা হলে কাল সকালে কী দিয়ে গোরু কিনবি বাপু?”
”তাই তো!” বলে শিবু ধড়মড় করে উঠে পড়ল। নবু লহমায় জানলা গলে বাইরে লাফ মেরে পড়ল। পড়েই ছুটতে যাবে, এমন সময় জানলা গলে আর—একটা লোকও লাফিয়ে নেমে এসে ক্যাঁক করে তার ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে বলল, ”আহাম্মক কোথাকার! আর—একটু হলেই যে কাজটা কাঁচিয়ে দিয়েছিলি রে হারামজাদা!”
লোকটাকে চিনতে পেরে নবু নিশ্চিন্তির শ্বাস ছাড়ল। শত্রুপক্ষের লোক নয়। এ হল নিবারণ সরকার। তা নিবারণদাদারও হাতযশ আছে। নিবারণদাদার বউ রিকশা করে বাজারে যায়। তার খোকাখুকিরা প্রাইভেট মাস্টারের কাছে পড়ে। বাড়িতে টিউবওয়েল আছে। দোহাত্তা কামায়।
নবু হাত কচলে দেঁতো হাসি হেসে বলল, ”পাকা খবর পেয়েই ঢুকেছিলাম। তবে ফসকে গেল!”
নিবারণ অবাক হয়ে বলল, ”কীসের পাকা খবর রে? সেই গোরু কেনার সাত হাজার টাকা নাকি? সে তো আমি কখন গস্ত করে বসে আছি। সাত হাজার তো এখন আমার ট্যাঁকে। একটা হাঁড়িতে খানিক আমসত্ত্ব পেয়ে গেলাম বলে এই দেরি। ও জিনিস তো আর হালুমহুলুম করে খাওয়া যায় না। চিবিয়ে রসস্থ করে খেতে হয়। তা তোর জ্বালায় কি আর শান্তিতে বসে খেতে পারলুম!”
নবু লজ্জায় নতমুখ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
নিবারণ বলল, ”ওরে, মন খারাপ করিস না। রাত কাবার হতে এখনও মেলা দেরি। নন্দরামের ছেলের বিয়ে গিয়েছে পরশুদিন। শুনেছি পণের নগদ টাকা নন্দরামের বালিশের তলায় আছে, তা কম হবে না, হাজার দশেক তো বটেই। বেশিও হতে পারে। দ্যাখ চেষ্টা করে।”
নবু প্রমাদ গনল। একসময় নবু নন্দরামের বাড়িতে মুনিশ খাটত। হাড়ভাঙা মেহনত করে মাসকাবারে তিরিশটি টাকা মাত্র জুটত। তার ওপর নন্দরাম ভারি রাগী মানুষ, রেগে গেলে হাতের কাছে যা পাবে তাই ছুড়ে মারবে। গোরু হারিয়ে যাওয়ায় নবুর ওপর রেগে গিয়ে তার দিকেও ছুড়ে মেরেছিল বটে, তবে তখন নন্দরামের জলখাবারের সময় বলে হাতে ছিল একটা লুচিতে জড়ানো রসগোল্লা। তাই বরাতজোরে নবু বেঁচে যায়। আর সেই প্রথম রসগোল্লা দিয়ে লুচি খেতে কেমন লাগে তা টের পেয়েছিল। স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। সুবিধে শুধু এইটুকু যে, নন্দরামের অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা তাকে খুব চেনে। আর বাড়ির সুলুকসন্ধানও নবুর জানা।
দেওয়াল টপকে বাগানে ঢোকা জলের মতো সহজই হয়ে গেল। কুকুরটা তেড়ে আসতেই নবু ‘আমি রে, আমি’ বলে তার গায়ে—মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সেটা লেজ নেড়ে তার হাত—পা চেটে দিতে লাগল। সাফাইয়ের লোক ঢোকার ছোট দরজাটার ছিটকিনি বরাবর নড়বড়ে ছিল। বাইরে থেকে সেটা খুলে দেখতে কোনো মেহনতের দরকার হল না। গ্রিলের তালাটা মটকে দোতলায় উঠে যাওয়া অব্দি গা মোটে ঘামলই না নবুর। তবে তার তো কপালটা বিশেষ ভালো নয়, শেষ রক্ষে হলে হয়!
মুখখানা গামছায় ভালো করে জড়িয়ে নিল নবু। তারপর নন্দুরামের শোওয়ার ঘরের দরজাটায় হাত লাগাল। পাকা হাত হলে কোনো সমস্যাই নয়। কিন্তু মুশকিল হল, নবুর হাত এখনও নিতান্তই কাঁচা। শিক ঢুকিয়ে ভিতরের ছিটকিনি খুলবার কসরত করার সময় একটা ঢপ এবং একটা ঠং শব্দ সে সামাল দিতে পারল না। আর কপালের এমনই ফের যে, দরজার পাল্লাটা খুলতে যেতেই কবজায় এমন বিকট ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হল যে, তাতে পাথরেরও ঘুম ভেঙে যায়।
আর হলও তাই। কাঁচা ঘুম ভেঙে নন্দুবাবু উঠে বসলেন। গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ”কে রে? কার এত সাহস? কার ঘাড়ে দু’টো মাথা যে, এই অসময়ে আমাকে বিরক্ত করিস?”
নবু বুঝল, এই মওকাটাও গেল। শীতলদাদা যা বলেছিল তা হাড়েহাড়ে সত্যি। সে এখনও দুধের শিশু। বারবার তিনবার কাজ ফসকে যাওয়ায় মাথাটাও যেন কেমনধারা হয়ে গেল নবুর। সে হঠাৎ বলে বসল, ”কাজের সময় অত চ্যাঁচামেচি করবেন না তো মশাই। ওতে ভারি অসুবিধে হয়।”
একথা শুনে নন্দরাম এমন হতবাক হয়ে গেল যে, প্রথমটায় মুখে বাক্য সরল না। তারপরই হঠাৎ ”তবে রে,” বলে একটা হুংকার ছেড়ে উঠে হাতের কাছে যা ছিল তাই তুলে ছুড়ে মারল নবুর দিকে। বরাবরই নন্দরামের হাতের টিপ খুব ভালো। লুচিতে জড়ানো রসগোল্লাটাও নবুর কপালে এসে লেগেছিল, এটাও লাগল। নবু দু’হাতে কপাল চেপে ধরে ”আঁক” শব্দ করে বসে পড়ল, কিন্তু বসে পড়েই বুঝতে পারল, তার হাতের কোষে এক বান্ডিল নোট।
ধুতির কষি আঁটতে—আঁটতে নন্দরাম খাট থেকে নামবার আগেই অবশ্য নবু একলাফে চৌকাঠ ডিঙিয়ে দুদ্দাড় সিঁড়ি ভেঙে, বাগান পেরিয়ে, দেওয়াল ডিঙিয়ে হাওয়া।
পরদিন কালুচরণের দোকানে ঢুকেই নবু টের পেল, বুড়ো চোরেরা তাকে আড়ে—আড়ে দেখছে। তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ভাবটা আর যেন নেই বলেই মনে হচ্ছে। শীতল সাধুখাঁর চোখে একটু শ্রদ্ধার ভাবও যেন দেখতে পাচ্ছিল নবু। তা সে যাই হোক, নবু বেশ বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করেই বসে রইল।