শিবেনবাবু ভালো আছেন তো
হরসুন্দরবাবু একটু নাদুসনুদুস, ধীর—স্থির—শান্ত প্রকৃতির মানুষ। তিনি কোঁচা দুলিয়ে ধুতি পরেন, ফুলহাতা জামার গলা অবধি বোতাম আঁটেন, কখনও হাতা গোটান না। শীত—গ্রীষ্ম সবসময়ে তিনি হাঁটু অবধি মোজা আর পাম্পশু পরেন। তাঁর বেশ মোটা এক জোড়া গোঁফ আছে। চুলে পরিপাটি সিঁথি। হরসুন্দরবাবু খুব নিরীহ মানুষও বটে।
সেদিন মাসের পয়লা তারিখ। হরসুন্দরবাবু সেদিন বেতন পেয়েছেন। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরছেন। যে গলিটায় তিনি থাকেন সেটা বেশ অন্ধকার, পাড়াটাও ভালো নয়। হরসুন্দরবাবু গলিতে ঢুকে কয়েক পা এগোতেই তিনটে ছোকরা তাঁকে ঘিরে ফেলল। একজন বুকে রিভলভার ঠেকাল, একজন পেটে আর অন্যজন পিঠে দুটো ছোরা ধরল। রিভলভারওলা বলল, ‘চেঁচাবেন না। যা আছে দিয়ে দিন।’
হরসুন্দরবাবু খুবই ভয় পেলেন। ভয়ে তাঁর গলা কাঁপতে লাগল। বললেন, ‘প্রাণে মেরো না ভাই। দিচ্ছি।’
মাইনের পুরো টাকাটা নিয়ে তিনজন হাপিস হয়ে গেল। হরসুন্দরবাবু ভয়ে চেঁচামেচি করলেন না যদি তারা ফিরে আসে। বাড়িতে ফিরেও কারও কাছে ঘটনাটা প্রকাশ করলেন না। ভাবলেন এ মাসটা ধারকর্জ করে চালিয়ে নিলেই হবে।
তা নিলেনও হরসুন্দরবাবু। একটা মাস দেখতে—দেখতে চলে গেল। আবার পয়লা তারিখ এল। হরসুন্দরবাবু আবার বেতন পেলেন।
ফেরার সময় যখন গলির মধ্যে ঢুকলেন তখন আচমকা ফের তিনটে লোক ঘিরে ধরল। বুকে রিভলভার, পেটে পিঠে ছোরা।
রিভালভারওলা বলল, ‘যা আছে দিয়ে দিন। চেঁচাবেন না।’
হরসুন্দরবাবু ফের ভয়ে কাঁপতে—কাঁপতে বললেন, ‘প্রাণে মেরো না ভাই। দিচ্ছি।’
মাইনের টাকা নিয়ে লোক তিনটে হাপিস হয়ে গেল।
হরসুন্দরবাবু এবারও বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু বললেন না। ভাবলেন, এ মাসটাও কোনোরকমে চালিয়ে নেবেন।
কষ্ট হল যদিও, কিন্তু হরসুন্দরবাবু চালিয়ে নিলেন। ফের পয়লা তারিখ এল। হরসুন্দরবাবু বেতন পেলেন।
বাড়ি ফেরার সময় অন্ধকার গলিতে ঠিক আগের মতোই তিনটে লোক ঘিরে ধরল তাকে। বুকে—পিঠে—পেটে ঠিক একই জায়গায় রিভালভার আর ছোরা ধরল। একই কথা বলল, এবং বেতনের টাকাটা নিয়ে হাওয়া হল।
হরসুন্দরবাবুর আজ চোখে জল এল।
বাড়ি ফিরে তিনি গুম হয়ে রইলেন। রাতে ভালো করে খেলেন না। গভীর রাতে তিনি ছাদে উঠে চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে অসহায়ভাবে ভাবলেন, কী যে করব বুঝতে পারছি না।
কাছে পিঠে কে যেন একটা হাই তুলল, তারপর আঙুল মটকানোর শব্দ হল, তারপর বলল, ‘হবি, হবি।’ হরসুন্দরবাবু চারদিকটা চেয়ে দেখলেন। ছাদ জনশূন্য, শীতকালের গভীর রাত্রে ছাদে আসবেই বা কে?
তিনি কাঁপা গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘আপনি কে?’
‘ভেবে দেখতে হবে হে, ভেবে দেখতে হবে।’
‘তার মানে?’
‘কতবার জন্মেছি তার কি হিসেব আছে? কোন জন্মে কে ছিলুম তা যে গুবলেট হয়ে যায় বাপ। এ জন্মে বিশু তো ও জন্মে নিতাই, পরের জন্মে হয়তো চিঁনেম্যান চাঁই চুঁই।’
‘আ—আপনি কোথায়? দে দেখতে পাচ্ছি না তো!’
গলার স্বরটা খিঁচিয়ে উঠে বলল, ‘দেখার চোখ আছে কি তোমার যে দেখবে? সারাদিনই তো তোমার ধারেকাছে ঘুরঘুর করি, দেখতে চেয়েছ কি কখনও?’
‘আজ্ঞে, আমি যে কিছু বুঝতে পারছি না, ভয় পাচ্ছি, মাথা ঝিমঝিম করছে।’
‘আ মোলো! এ যে ভালো করতে এসে বিপদ হল।’
‘আ—আপনি কী চান?’
‘তোমার মতো গবেটদের কান দুটো মলে দিতেই চাই হে।
কিন্তু বিধি বাম সে উপায় নেই।’
‘আমি কী করেছি? আপনি আমার ওপর রাগ করছেন কেন?’
‘রাগ করব না? তিনটে কাঁচা মাথার ছোঁড়া তিন—তিনবার যে তোমাকে বোকা বানাল তা থেকে শিক্ষা পেয়েছ কি? কিছু করতে পারলে?’
‘আজ্ঞে কী করব? তাদের হাতে যে ছোরা আর বন্দুক।’
‘আর তোমার বুঝি কিছু নেই?’
‘আজ্ঞে না।’
‘কে বলল, নেই?’
‘ইয়ে, আমার বন্দুক, পিস্তল বা ছোরাছুরি নেই। তবে আমার গিন্নির একখানা বঁটি আছে, আর আমার ছেলে ভুতোর একটা পেন্সিল কাটা ছুরি আছে, আর আমার মায়ের বেড়াল তাড়ানোর জন্য একখানা ছোট লাঠি আছে।’
‘আহা, ওসব জানতে চাইছে কে? বঁটি—লাঠির কথা জিগ্যেস করেছি কি তোমায়? বলি এসব ছাড়া তোমার আর কিছু নেই?’
‘আজ্ঞে, মনে পড়ছে না। শুনেছি আমার ঠাকুর্দার একটা গাদা বন্দুক ছিল।’
‘গবেট আর কাকে বলে? বলি বন্দুক—টন্দুক ছাড়া আর কিছু নেই তোমার?’
‘আজ্ঞে না।’
‘বলি, বুদ্ধি বলে একটা বস্তু আছে জানো তো!’
‘জানি।’
‘তোমার সেটাও নেই?’
আজ্ঞে, ঠিক বুঝতে পারছি না।
একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ হল। তারপর গলার স্বরটা বলল, ‘শোনো, এবার যখন ওই মর্কটগুলো তোমাকে পাকড়াও করবে তখন একটুও ঘাবড়াবে না। হাসি—হাসি মুখ করে শুধু জিগ্যেস করবে, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভালো আছেন তো!’
‘শুধু এই কথা বললেই হবে?’
‘বলেই দেখো না।’
তৃতীয় মাসটাও কষ্টেসৃষ্টে কেটে গেল। আবার পয়লা তারিখ এল এবং হরসুন্দরবাবু আবার বেতন পেলেন।
বাড়ি ফেরার সময় বুকটা দুরুদুরু করছিল। যে—কথাটা বলতে হবে তা বারবার বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছেন। হাত—পা—কাঁপছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। গলির মুখে একটু থমকে দাঁড়ালেন। তারপর দুর্গা বলে অন্ধকারে পা বাড়ালেন।
কয়েক পা যেতে না যেতেই তিন মূর্তি ঘিরে ফেলল তাঁকে। বুকে পিস্তল, পেটে আর পিঠে ছোরা।
পিস্তলওলা বলল, ‘চেঁচাবেন না। যা আছে দিয়ে দিন।’
জীবনে কোনো সাহসের কাজ করেননি হরসুন্দরবাবু। আজই প্রথম করলেন। জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘আচ্ছা, শিবেনবাবু ভালো আছেন তো?’
ছেলে তিনটে হঠাৎ যেন থমকে গেল। আর তার পরেই দুড়দাড় দৌড়ে এমনভাবে পালাল যেন ভূত দেখেছে।
হরসুন্দরবাবু খুবই অবাক হয়ে গেলেন। এই সামান্য কথায় এত ভয় পাওয়ার কী আছে? যাক গে, এবার মাইনের টাকাটা তো বেঁচে গেল।
না, এর পর থেকে হরসুন্দরবাবুকে আর ওদের পাল্লায় পড়তে হয়নি বটে, কিন্তু তাঁর ধাঁধাটা গেল না। এই তো সেদিন তাঁর অফিসের বড়বাবু তাঁকে কাজের একটা ভুলের জন্য খুব বকাঝকা করে চার্জশিট দেন আর কী? হরসুন্দরবাবু শুধু হাসি—হাসি মুখ করে তাঁকে বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, শিবেনবাবু ভালো আছেন তো!’ তাইতে বড়বাবু এমন ঘাবড়ে গেলেন, যে আর বলার নয়। তারপর থেকে খুবই ভালো ব্যবহার করে যাচ্ছেন।
সে দিন বাজার থেকে পচা মাছ এনেছিলেন বলে হরসুন্দরের গিন্নি তাঁকে খুবই তুলোধনা করছিলেন। হরসুন্দরবাবু তাঁকেও বললেন, ‘আচ্ছা, শিবেনবাবু ভালো আছেন তো। গিন্নি একেবারে জল।’
‘হ্যাঁ, এখন হরসুন্দরবাবু খুবই ভালো আছেন। কোনো উদ্বেগ, অশান্তি নেই, বিপদ দেখা দিলেই তিনি শুধু বলেন, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভালো আছেন তো! মন্ত্রের মতো কাজ হয়।